প্রবন্ধ
ইবলিস ও জিন জাতি
ইবলিস
আল্লাহর নিকট ইবলিসের অবস্থান ছিল অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার। কিন্তু আল্লাহর আদেশের বিপরীত যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে আল্লাহর অবাধ্যতার দরুণ এ সম্মান ও মর্যাদা পর্যবসিত হয়েছিল লাঞ্ছনা ও অভিসম্পাতে! ইমাম বাগাবী রহ. (৫১৬হি.) বলেন,
كان اسمه عزازيل بالسريانية وبالعربية الحارث فلما عصى غير اسمه وصورته فقيل إبليس لأنه أبلس من الرحمة أي : يئس والعياذ بالله
ইবলিস শয়তানের নাম ছিল 'আযাযীল' (সুরিয়ানী ভাষা) এবং 'হারিস' (আরবী ভাষা)। যখন সে নাফরমানী করল তখন তার নাম এবং অবয়ব বিকৃত হয়ে গেল। নাম হল 'ইবলিস' (নিরাশ), কারণ সে আল্লাহর রহমত থেকে চিরদিনের জন্য নিরাশ হয়ে গেছে। (তাফসীরে রুহুল বয়ান ৫/২৫৭)
ইবলিস জিন ছিল না কি ফেরেশতা?
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وإذ قلنا للملائكة اسجدوا لآدم فسجدوا إلا إبليس كان من الجن ففسق عن أمر ربه أفتتخذونه وذريته أولياء من دوني وهم لكم عدو بئس للظالمين بدلا
অর্থ : আর যখন আমি ফেরেশতাদের আদেশ দিলাম, আদমের সামনে সিজদা কর, তখন সবাই সিজদা করল; ইবলিস ব্যতীত। সে জিন জাতিভুক্ত ছিল। কাজেই সে তার রবের আদেশ লঙ্ঘন করল। সুতরাং তবুও কি তোমরা তাকে এবং তার চেলাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছ আমাকে ছেড়ে? অথচ তারা তোমাদের শত্রু! এটা অনাচারীদের জন্য নিকৃষ্ট বদল। (সূরা কাহাফ- ৫০)
আল্লাহর নাফরমানীর পূর্বে ইবলিস জিন ছিল, না ফেরেশতা ছিল? বিষয়টি উলামায়ে কেরামের মাঝে মতবিরোধপূর্ণ। কাতাদা রহ. (১১৭হি.), যাহ্হাক রহ. (১০৬হি.), সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব রহ. (৯৪হি.), ইবনে জুরাইজ রহ. (১৫০হি.), যাজ্জাজ রহ. (৩৪০হি.), ইবনুল আম্বার রহ. (৩৩৪হি.), আবুল হাসান আশআরী রহ. (৩১৮হি.), আল্লামা তবারী রহ. (৩১০হি.), ইমাম নববী রহ. (৬৭৬হি.) ও আল্লামা কামালুদ্দীন দামেরী রহ. (৮০৮হি.) প্রমুখ উলামায়ে কেরামের
মতে ইবলিস ফেরেশতা ছিল, বরং ফেরেশতাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত ও অধিক জ্ঞানের অধিকারী হওয়াসহ প্রথম আসমানে ফেরেশতাদের সর্দার ছিল। হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. (৬৮হি.), ইবনে মাসউদ রাযি. (৩২/৩৩হি.)-দের দিকে এ মতটি সম্বন্ধযুক্ত করা হয়। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ১/৮১, তারীখে তবারী ১/৫৬, তাফসীরে তবারী ১৫/৩০০, আকামুল মারজান ফী আহকামিল জান; পৃষ্ঠা ১৭৫, হায়াতুল হায়াওয়ান; জিন অধ্যায়)
এ সকল উলামায়ে কেরাম উল্লেখিত আয়াত যাতে ইবলিসকে জিন বলা হয়েছে তার তিনটি ব্যাখ্যা করে থাকেন।
(১) جن শব্দটি جنة শব্দের থেকে উদ্ভূত। আর সে বেহেশতের উদ্যানসমূহের (পরিচর্যার) কাজে নিয়োজিত ফেরেশতাদের দায়িত্বে ছিল।
ممن يعملون في الجنان
এ কারণে জান্নাতের (جنة) দিকে সম্পৃক্ত করে তাকে জিন (جن) বলা হয়েছে। (তাফসীরে তবারী ১৫/৩০১)
(২) ফেরেশতাদের অনেক শ্রেণী রয়েছে। যেমন কাররুবিয়ূন, রূহানিয়্যূন, খাজানাহ, যাবানিয়াহ। তেমনি একটি শ্রেণী হল 'জিন'। ইবলিস এই 'জিন' كان من حي الملائكة يقال لهم الجن এ কারণেই কুরআনে তাকে 'জিন' বলা হয়েছে। তবে সাধারণ জিনদের সাথে ফেরেশতাদের এই বিশেষ শ্রেণীর জিনদের পার্থক্য হল, সাধারণ জিনদের সৃষ্টি করা হয়েছে من مارج من نار নিখাদ আগুন থেকে আর এই ফেরেশতা শ্রেণী জিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে من نار السموم আগুনবিশিষ্ট তীব্র লু হাওয়া থেকে। অন্যান্য সকল ফেরেশতাকে সৃষ্টি করা হয়েছে নূর থেকে। (তারীখে তবারী ১/৫৮, আকামুল মারজান; পৃষ্ঠা ১৭৫)
(৩) অথবা আয়াতে তাকে জিন বলার কারণ হল, জিন শব্দের উৎসমূলের অর্থ হল, 'গোপন থাকা' الاستار আর আয়াতে كان من الجن (সে জিন ছিল) এর অর্থ হলো. كان مستترا من معصية الله من قبل هذا (ইতিপূর্বে আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে সে লুকিয়ে ছিল তথা অবাধ্যতা প্রকাশ পায়নি)। আকামুল মারজান; পৃষ্ঠা ১৭৫)
অপরদিকে মুহাক্কিকীন উলামায়ে কেরামের বড় একটি জামাআত ও জমহুর মুফাসসিরীনের অভিমত হল, ইবলিস জিন ছিল এবং তাকে সাধারণ জিনদের মত আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে অধিক ইবাদত এবং সুউচ্চ মর্যাদার ক্ষেত্রে আল্লাহর দরবারে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল এবং জিন হওয়া সত্ত্বেও ফেরেশতাদের মাঝে সে বিশেষ সম্মানিত ছিল।
এ সকল উলামায়ে কেরামের মধ্যে হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের রহ., হাসান বসরী রহ., ইবনে শিহাব যুহরী রহ., শাহর বিন হাওশাব রহ. এবং মুফাসসিরদের মধ্যে আল্লামা যামাখশারী রহ. (৫৩৮হি.), ইমাম রাযী রহ. (৬০৪হি.), আল্লামা কুরতুবী রহ. (৬৭১হি.), আল্লমা ইবনে কাসীর রহ. (৭৭৪হি.), আল্লমা আবু সাঈদ রহ. (৯৮২হি.) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ১/৮১, তাফসীরে তবারী ১৫/৩০১, তাফসীরে কাশ্শাফ ২/৬৯৯, আল কামেল ফিত- তারীখ ১/২৫, হায়াতুল হায়াওয়ান; পৃষ্ঠা ২৮২, আকামুল মারজান; পৃষ্ঠা ১৭৭, তাফসীরে কাবীর ২/২১২, ২১/১২৫)
ইবলিস ফেরেশতা ছিল না জিন? এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের উভয় শ্রেণীর দলীল প্রমাণ পর্যালোচনা দ্বারা জমহুরে মুফাসসিরীনের মতটিই (ইবলিস জিন ছিল; ফেরেশতা নয়) বিশুদ্ধ প্রমাণিত হয়।
বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. তাফসীরে ইবনে কাসীর গ্রন্থে বলেন,
وقد روي في هذا آثار كثيرة عن السلف وغالبها من الإسرائيليات التي تنقل لينظر فيها، والله أعلم بحال كثير منها، ومنها ما قد يقطع بكذبه لمخالفته للحق الذي بأيدينا, وفي القرآن غنية عن كل ما عداه من الأخبار المتقدمة.
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে 'সালাফ' থেকে অনেক বর্ণনাই পাওয়া যায়। যার অধিকাংশ হল ইসরাঈলী রেওয়ায়েত। ইসরাঈলী রেওয়ায়েত নকল করা হয় কুরআন- হাদীসের আলোকে তার সত্যতা যাচাই করার জন্যে (নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করার জন্য নয়)। আর এ সকল বর্ণনার অধিকাংশেরই সত্যতা সম্বন্ধে আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। তবে কিছু বর্ণনা তো কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট বিপরীত হওয়ায় সুনিশ্চিত মিথ্যা বলে প্রমাণিত। আর কুরআনে কারীম ইসলামপূর্ব সমস্ত সংবাদ এবং বর্ণনা থেকে আমাদেরকে অমুখাপেক্ষী করে দিয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৫/১৭৪)
বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা যামাখশারী রহ. (৫৩৮হি.) তাফসীরে কাশ্শাফ গ্রন্থে ইবলিসের জিন হওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করে বলেন,
وهذا الكلام المعترض تعمد من الله تعالى لصيانة الملائكة عن وقوع شبهة في عصمتهم. فما أبعد البون بين ما تعمده الله، وبين قول من ضاده وزعم أنه كان ملكا ورئيسا على الملائكة، فعصى، فلعن ومسخ شيطانا، ثم وركه على ابن عباس.
পবিত্র কুরআনে كان من الجن (ইবলিস জিন ছিল) বলার পর ففسق عن أمر ربه (ইবলিস তার প্রতিপালকের নাফরমানী করল) বাক্যটি বলার দ্বারা মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য হল, শয়তানের অবাধ্যতার কারণে ফেরেশতা কর্তৃক আল্লাহর অবাধ্যতা প্রকাশ পাওয়ার ব্যাপারে যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করা (আর তা এভাবে যে, শয়তান ফেরেশতা ছিল না; বরং সে ছিল জিন)। সুতরাং ইবনে আব্বাসের মতকে ভিত্তি করে (যা তার থেকে সঠিকভাবে প্রমাণিত নয়) যারা বলে, 'শয়তান ফেরেশতা ছিল, ফেরেশতাদের সর্দার ছিল। এরপর আল্লাহর নাফরমানীর কারণে অভিশপ্ত হয়ে শয়তানে রূপান্তরিত হয়েছে'। তাদের প্রদেয় ব্যাখ্যা-বক্তব্য এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যের মাঝে রয়েছে অনতিক্রম্য ব্যবধান। উল্লেখিত আয়াত দ্বারা আল্লাহর যে উদ্দেশ্য তার সাথে তাদের এ ব্যাখ্যার কোন মিল নেই। (তাফসীরে কাশশাফ ২/৬৯৯)
বিখ্যাত মুফাসসির ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহ. (৬০৪হি.) তাফসীরে কাবীর গ্রন্থে 'ইবলিস ফেরেশতা ছিল' মতের স্বপক্ষে উপস্থাপিত দলীলের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণপূর্বক অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে 'ইবলিস জিন ছিল' মতটিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি এ মতের পক্ষে মোট পাঁচটি দলীল উল্লেখ করেছেন-
(১) আল্লাহ তা'আলা বলেন, وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ. অর্থ : যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, আদমকে সেজদা কর, তখন সবাই সেজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে ছিল জিনদের একজন। (সূরা কাহাফ- ৫০)
এ আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইবলিস জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতএব তার ফেরেশতা হওয়াটা সম্ভব নয়। কেননা ফেরেশতা এবং জিন সম্পূর্ণ ভিন্ন দু'টি জাতি। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا ثُمَّ يَقُولُ لِلْمَلَائِكَةِ أَهَؤُلَاءِ إِيَّاكُمْ كَانُوا يَعْبُدُونَ. قَالُوا سُبْحَانَكَ أَنْتَ وَلِيْنَا مِنْ دُونِهِمْ بَلْ كَانُوا يَعْبُدُونَ الْجَنَّ.
অর্থ: যেদিন তিনি তাদের সবাইকে একত্রিত করবেন এবং ফেরেশতাদেরকে বলবেন, এরা কি তোমাদেরই পূজা করতো? ফেরেশতারা বলবে, আপনি পবিত্র, আমাদের সম্পর্ক আপনার সাথে, তাদের সাথে নয়, বরং তারা জিনদের পূজা করতো। তাদের অধিকাংশই শয়তানে বিশ্বাসী। (সূরা সাবা-৪০,৪১)
(২) আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ. অর্থ : সে তার পালনকর্তার আদেশ অমান্য করল। অতএব তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছো? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। এটা যালিমদের জন্য খুবই নিকৃষ্ট বদল। (সূরা কাহাফ- ৫০)
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইবলিসের সন্তান-সন্ততি হয়। আর সন্তানাদি জিনদের হয়, যেহেতু তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ রয়েছে এবং তাদের বিয়েও হয়। পক্ষান্তরে ফেরেশতাদের সন্তানাদি হয় না। কারণ তারা নারী- পুরুষের শ্রেণীভেদ থেকে পবিত্র।
(৩) ফেরেশতারা কখনো আল্লাহর অবাধ্য হয় না। আল্লাহ তা'আলা বলেন,لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ অর্থ : তারা (ফেরেশতারা) আল্লাহর নির্দেশের নাফরমানী করে না। বরং তাদেরকে যা আদেশ করা হয় তারা তাই করে। (সূরা তাহরীম- ৬)
অথচ শয়তান আল্লাহর অবাধ্য হয়েছে এবং হযরত আদম আ. কে সিজদা করেনি।
(৪) ইবলিস আগুনের তৈরি। যেমন সে বলেছিল, خلقتني من نار অর্থ : সে বলল, আমি তার চেয়ে উত্তম আপনি আমাকে আগুনের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা। (সূরা সোয়াদ- ৭৬)
অথচ ফেরেশতারা হলেন নূরের তৈরি। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ২৯৯৬ কিতাবুযযুহদ)
(৫) ফেরেশতারা হলেন আল্লাহর বার্তাবাহক। ইরশাদ হচ্ছে, جَاعِلِ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا অর্থ : আল্লাহ তা'আলা ফেরেশতাদেরকে বার্তাবাহকরূপে প্রেরণ করেন। (সূরা ফাতির- ১)
আর বার্তাবাহকেরা নিষ্পাপ হয়ে থাকে। অথচ ইবলিস হল অভিশপ্ত। (তাফসীরে কাবীর ২/২১২-২১৪) ইবলিস সম্পর্কে এ ধারণা করা যে,'আল্লাহর অবাধ্যতার পূর্বে ইবলিস ফেরেশতা ছিল, বরং ফেরেশতাদের সর্দার ছিল'। দলীল প্রমাণের আলোকে এ ধারণা সঠিক নয়। উপর্যুক্ত আলোচনায় বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। তবে এটা ঠিক যে, জিন হওয়া সত্ত্বেও সে আল্লাহর ইবাদত করা এবং সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে সে ফেরেশতাদের সমপর্যায়ে ছিল। এ কারণে সিজদার আদেশের ক্ষেত্রে ফেরেশতাদের সাথে সেও আদিষ্ট ছিল। (আল মাজমূআতুস সানিয়্যাহ; পৃষ্ঠা ৫৬২, তাফসীরে কাবীর ২/২১৪)
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
(১) জিনেরা কি ইবলিসের বংশধর?
এ প্রশ্নের উত্তরে আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী রহ. (১১২৭হি.) তাফসীরে রুহুল বয়ান গ্রন্থে উলামায়ে কেরামের তিনটি মত উল্লেখ করেছেন-
(ক) হযরত হাসান বসরী রহ. (১১০হি.) এর মত হল, ইবলিস জিনদের আদি পিতা, যেমন হযরত আদম আ. মানুষের আদি পিতা।
(খ) কারো মতে ইবলিস জিনদের বংশধর। আল্লাহ তা'আলা হযরত আদম আ. এর পূর্বে পৃথিবীতে জিন জাতি সৃষ্টি করেছিলেন। জিনেরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। ফেরেশতারা তাদেরকে লোকালয় থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। ইবলিস সে জিনদেরই বংশধর ছিল।
(গ) আল্লাহ তা'আলা একটি জাতিকে সৃষ্টি করে হযরত আদম আ. কে সিজদা করতে বললে তারা অস্বীকার করল। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিলেন। অতঃপর ফেরেশতাদের সৃষ্টি করে সিজদার হুকুম দিলে তারা তা পালন করল। কিন্তু ইবলিস অস্বীকার করল, যেহেতু সে পূর্বোক্ত জাতিভুক্ত ছিল। (তাফসীরে রুহুল বয়ান ৫/২৫৭)
হযরত হাসান বসরী রহ.-এর মতটিই অধিক বিশুদ্ধ। (হায়াতুল হায়াওয়ান; পৃষ্ঠা ২৮০)
জিন জাতি
জিন জাতি আল্লাহর এক বিশেষ সৃষ্টি। কেননা দেহাবয়বসহ তাদের সকল বৈশিষ্ট্যের উৎস হল আগুন। এতদসত্ত্বেও তারা মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে।
সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অনুযায়ী আল্লাহ তা'আলা সর্বপ্রথম ফেরেশতা সৃষ্টি করেন। এরপর জিন এবং তারপর মানব জাতি সৃষ্টি করেন। আল্লামা তবারী (৩১০হি.) হযরত রবী' ইবনে আনাস রহ. এর সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,
إن الله خلق الملائكة يوم الأربعاء وخلق الجن يوم الخميس وخلق آدم يوم يوم الجمعة
অর্থ : আল্লাহ তা'আলা ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন বুধবার, জিন সৃষ্টি করেছেন বৃহস্পতিবার এবং হযরত আদম আ. কে সৃষ্টি করেছেন শুক্রবার। (তারীখে তবারী ২/৫৮)
জিনের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লামা কামালুদ্দীন দামেরী রহ. (৮০৮হি.) হায়াতুল হায়াওয়ান গ্রন্থে বলেন,
الجن أجسام هوائية قادرة على التشكل بأشكال مختلفة، لها عقول وأفهام وقدرة على الأعمال الشاقة وهم خلاف الأنس. الواحد جني ويقال إنما سميت بذلك لأنها تتقى ولا تری
অর্থ : জিন এমন এক সৃষ্টি যাদের অবয়ব এবং শারীরিক গঠন বাতাস প্রকৃতির। তারা বিভিন্ন প্রাণীর আকৃতি ধারণ করতে পারে। চিন্তাশক্তি এবং বুদ্ধি-বিবেচনাবোধও তাদের রয়েছে। কঠিন থেকে কঠিনতর কাজে তারা পারঙ্গম। তারা মানুষের বিপরীত একটি জাতি। এক বচন جنّى, তাদের এ নামকরণের কারণ হল, তারা মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় না।
ইমাম কুরতুবী রহ. (৬৭১হি.) তাফসীরে কুরতুবী গ্রন্থে বলেন,وسمي جانا لتواريه عن الأعين অর্থ : জিনকে 'জিন' নামকরণ করা হয়েছে (যেহেতু তার শাব্দিক অর্থ গোপন থাকা) আর সে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থাকে। (তাফসীরে কুরতুবী ১০/২৩)
জিন কী জিনিস দ্বারা তৈরি
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,والجان خلقناه من قبل من نار السموم অর্থ : আর জিনকে আমি সৃষ্টি করেছি (আদমের) পূর্বে আগুন থেকে যা উত্তপ্ত বায়ু ছিল। (সূরা হিজর- ২৭)
وخلق الجان من مارج من نار
অর্থ : আর তিনি জিনকে খাঁটি আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। (সূরা রহমান- ১৫)
এ দু'টি আয়াত দ্বারা এ কথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা'আলা জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন। ইমাম কুরতুবী রহ. (৬৭১হি.) তাফসীরে কুরতুবী গ্রন্থে বলেন,
ويروى أن الله تعالى خلق نارين فمرج إحداهما بالأخرى ، فأكلت إحداهما الأخرى وهي نارالسموم فخلق منها إبليس
অর্থ : বর্ণিত আছে, আল্লাহ তা'আলা দু'টি আগুন সৃষ্টি করলেন। একটিকে আরেকটির উপর ছেড়ে দিলেন। ফলে একটি অপরটিকে খেয়ে ফেলল। আর সেটিই হল نار السموم (আগুনবিশিষ্ট লু-হাওয়া)। অতঃপর তা থেকে ইবলিসকে সৃষ্টি করলেন। (তাফসীরে কুরতুবী ১৭/১৪১)
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
সীমিত জ্ঞানে প্রশ্ন হতে পারে যে, আগুন থেকে কাউকে জীবন দান করা কিভাবে সম্ভব?
কিন্তু একজন মুমিনের জন্য এ বিশ্বাস অপরিহার্য যে, মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি- বিবেচনা এবং চিন্তাশক্তি অত্যন্ত সীমিত। অনেক ক্ষেত্রেই তা আলো-আঁধারীর মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করতে সক্ষম হয় না। আর তখনই প্রয়োজন হয় 'ওহী'র আলোর। যা একজন খাঁটি মুমিনকে চিন্তার অনতিক্রম্য তীহ প্রান্তর থেকে তুলে এনে তাকে তার নিশ্চিন্ত কর্মপন্থা বাতলে দেয়।
يقولون آمنا به كل من عند ربنا
আমরা তো বিশ্বাস করি; সবকিছুই আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে। আর তাই উল্লেখিত প্রশ্নের উত্তরে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহ. তাফসীরে কাবীর গ্রন্থে বলেন, (৬০৪হি.)
هذا على مذهبنا ظاهر، لأن البنية عندنا ليست شرطاً لإمكان حصول الحياة، فالله تعالى قادر على خلق الحياة والعلم في الجوهر الفرد، فكذلك يكون قادراً على خلق الحياة والعقل في الجسم الحار.
এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের) বিশ্বাসমতে সুস্পষ্ট। কেননা আমাদের নিকট 'প্রাণের অস্তিত্বের জন্য কোন দলীলের প্রয়োজন নেই। সুতরাং যেভাবে আল্লাহ তা'আলা একটি জড় বস্তুতে প্রাণ সঞ্চারে সক্ষম, তেমনি একটি উত্তপ্ত অবয়বেও প্রাণ দানে সক্ষম। (তাফসীরে কাবীর ১৯/১৫০)
জিনের প্রকারভেদ
ফেরেশতাদের মত জিনেরও অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। হাকেম আবু আব্দুল্লাহ নাইসাবুরী রহ. (৪০৫হি.) তার আলমুসতাদরাক আলাস সহীহাইন গ্রন্থে হযরত সা'লাবা রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
الجن ثلاثة أصناف: صنف لهم أجنحة يطيرون في الهواء وصنف حيات وكلاب وصنف يحلون ويظعنون قال الحاكم: هذا حديث صحيح الإسناد ولم يخرجاه. قال الذهبي: صحيح.
জিন তিন প্রকার: (১) যাদের ডানা রয়েছে এবং ডানার সাহায্যে তারা বাতাসে ভেসে বেড়ায়, (২) যারা সাপ ও কুকুরের আকৃতিতে থাকে ও (৩) যারা যমীনে অবতরণ করে ও যমীনে বসবাস করে। (মুসতাদরাকে হাকেম; হা.নং ৩৭০২)
এই জিন জাতির মধ্য থেকে যারা মুমিন তাদেরকে বলা হয় 'জিন'। আর যারা কাফের তাদেরকে বলা হয় 'শয়তান'।
এ প্রসঙ্গে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহ.(৬০৪হি.) তাফসীরে কাবীর গ্রন্থে বলেন,
والأصح أن الشياطين قسم من الجن، فكل من كان منهم مؤمنا فإنه لا يسمى بالشيطان، وكل من كان منهم كافرا يسمى بهذا الإسم.
বিশুদ্ধ মতানুযায়ী শয়তান জিনদেরই একটি শ্রেণী। মুমিন জিনদেরকে শয়তান বলা হয় না; বরং কাফের জিনদের শয়তান বলা হয়। (তাফসীরে কাবীর ১৯/১৪৯)
শয়তানপ্রকৃতির জিনদের মধ্যে আরেক শ্রেণী রয়েছে, যাদেরকে غيلان (গীলান, বাংলায় 'ভূত') বলা হয়। আরবদের ধারণানুযায়ী غيلان (ভূত) হল দুষ্ট প্রকৃতির শয়তান জিন, যারা রাস্তাঘাটে ভয়ঙ্কর আকৃতি ধারণ করে পথচারীকে ভয় দেখিয়ে থাকে; কখনো মেরেও ফেলে। (আন নিহায়া ফী গরীবিল হাদীস ৩/৩৫৫)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইদ থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে غيلان (ভূত) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে নবীজী (ﷺ) বললেন, سحرة الجن (এরা হল জিনদের জাদুকর শ্রেণী)। (মাকায়িদুশ শায়তান লিইবনি আবিদ দুনইয়া; হা.নং ৩, মউসূ'আতুল ইমাম আবিদ দুনইয়া ৪/৩২৮)
হযরত সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযি. বলেন, غول (ভূত) দেখলে আমাদেরকে (নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে) নামায (তথা আল্লাহর যিকর, আয়াতুল কুরসী ইত্যাদি) দ্বারা উচ্চ আওয়াজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (মুসনাদে বাযযার; হা.নং ১২৪৭, আন নিহায়া ফী গরীবিল হাদীস ৩/৩৫৫)
জিনদের কিছু বৈশিষ্ট্য
(১) আকৃতি পরিবর্তন: জিনদের একটি বৈশিষ্ট্য হল (আল্লাহর হুকুমে) তারা মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর আকৃতি ধারণ করতে পারে। আল্লামা বদরুদ্দীন শিবলী রহ. (৭৬৯হি.) আকামুল মারজান ফী আহকামিল জান গ্রন্থে বলেন,
لا شك ان الجن يتطورون ويتشكلون في صور الانس والبهائم فيتصورون في صور الحيات والعقارب وفي صور الابل والبقر والغنم والخيل والبغال والحمير
কোন সন্দেহ নেই, জিনেরা বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং মানুষ, জন্তু যেমন: সাপ, বিচ্ছু, উট, গরু, ছাগল, ঘোড়া, খচ্চর, গাধা ইত্যাদির আকৃতি ধারণ করে। (আকামুল মারজান; পৃষ্ঠা ২৮)
বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইবনে জারীর তবারী রহ. বর্ণনা করেন, ...ইমাম সুদ্দী রহ. (১২৭হি.) আয়াতে কারীমা وإذ يمكر بك الذين كفروا ليثبتوك أو يقتلوك أو يخرجوك অর্থাৎ আর স্মরণ করুন, যখন কাফেররা আপনার সম্বন্ধে দূরভিসন্ধি করছিল যে, আপনাকে বন্দি করে রাখবে। হত্যা করে ফেলবে কিংবা দেশান্তর করে দেবে।) এর প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে বলেন,
'মদীনার আনসাররা ইসলাম গ্রহণের পর কুরাইশের নেতৃস্থানীয় কাফেররা যখন (ইসলামকে রুখে দেয়ার হীন মানসে) দারুন নদওয়ায় শলাপরামর্শে বসল তখন 'নাযদ' নিবাসী একজন প্রবীণের আকৃতিতে সেখানে ইবলিস শয়তান এসে উপস্থিত হল (এবং পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধভাবে হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার পরামর্শ দিল। (তাফসীরে তবারী [সূরা আনফাল- ৩০])
খাদ্য গ্রহণ
জিনেরা খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। কাজী আবু ইয়ালা রহ. বলেন,والجن يأكلون ويشربون ويتناكحون كما نفعل অর্থ: জিনেরা আমাদের মতই খাবার গ্রহণ করে এবং তাদের পরস্পরে বিয়েও হয়। (আকামুল মারজান; পৃষ্ঠা ৩৯)
সহীহ মুসলিমের 'কিতাবুস সালাত' অধ্যায়ে হযরত ইবনে মাসউদ রাযি. এর সূত্রে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, 'একরাতে জিনেরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করল। কুরআন তিলাওয়াত শুনলো। ফিরে যাওয়ার পূর্বে জিনেরা নিজেদের খাবারের প্রসঙ্গ তুললে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, لكم كل عظم ذكر اسم الله عليه يقع في أيديكم أوفر ما يكون لحما وكل بعرة علف لدوابكم বিসমিল্লাহ বলে জবাইকৃত প্রাণীর হাড্ডি যখন তোমরা হাতে নিবে, তখন তা পূর্বের চেয়েও অধিক গোশতসম্পন্ন হবে আর পশুর মল হল তোমাদের জানোয়ারের খাবার। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৪৫০)
বিবাহ ও সন্তান-সন্ততি
জিনেরা মানুষের মতই বিয়ে করে এবং তাদের সন্তান-সন্ততিও হয়। নিম্নোক্ত আয়াতই এর সুস্পষ্ট প্রমাণ। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِي وَهُمْ لَكُمْ অর্থ : অতএব তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছ? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। (সূরা কাহাফ- ৫০)
জিনেরাও শরীয়ত মানতে আদিষ্ট
মানুষের মত জিন জাতিও আল্লাহর হুকুম পালনে আদিষ্ট। পবিত্র কুরআন মাজীদে সূরা আর-রাহমানে আল্লাহ তা'আলা বলেন,فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ অর্থ : অতএব, তোমরা উভয়ে (জিন এবং মানব) তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? (সূরা রহমান- ৫৭)
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহ. (৬০৪হি.) উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন,اطبق الكل على أن الجن كلهم مكلفون উলামায়ে কেরামের সর্বসম্মত মত হল, জিনেরা মুকাল্লাফ অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম পালনে আদিষ্ট। (তাফসীরে কাবীর [সূরা আর-রাহমান- ৫৭])
জিনদের মধ্যে কি নবী প্রেরণ করা হয়েছে?
জিনেরা আল্লাহর হুকুম পালনে আদিষ্ট এ ব্যাপারটির মতো উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারেও একমত যে, হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী মানুষ ও জিন জাতির জন্য রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা ঐ সকল জিনদের কথা উল্লেখ করেছেন যারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কুরআন শুনে নিজেদের কওমকে দাওয়াত দিয়েছিল।
يا قومنا أجيبوا داعي الله وآمنوا به يغفر لكم من ذنوبكم ويجركم من عذاب أليم
অর্থ : হে আমাদের কওম! তোমরা আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর (নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) ডাকে সাড়া দাও এবং তার উপর ঈমান আন। (সূরা আহকাফ- ৩১)
ইমাম কুরতুবী রহ. (৬৭১হি.) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন,وهذا يدل على أنه كان مبعوثا الى الجن والانس.
এ আয়াত প্রমাণ করে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সকল জিন ও মানুষের কাছে নবী বানিয়ে পাঠানো হয়েছে। (তাফসীরে কুরতুবী [সূরা আহকাফ- ৩১])
হযরত জাবের রাযি. সূত্রে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
أعطيت خمسا لم يعطهن أحد قبلي كان كل نبي يبعث إلى قومه خاصة وبعثت إلى كل أحمر وأسود.
আমাকে পাঁচটি জিনিস এমন দেয়া হয়েছে যা আমার পূর্বে কাউকে দেয়া হয়নি। ইতোপূর্বে প্রত্যেক নবী কেবল তার গ্রোত্রের জন্য প্রেরিত হত, আর আমাকে প্রত্যেক লাল ও কালোর জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৫২১)
হযরত মুজাহিদ রহ. (১০১হি.) احمر واسود এর ব্যাখ্যায় বলেন,
الأحمر والأسود : الجن والإنس
অর্থাৎ এ দুটির অর্থ হল, জিন এবং মানব। (তাফসীরে কুরতুবী [সূরা আহকাফ- ৩১])
হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে জিনদের মাঝে কোন জিনকে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে।
যাহ্হাক রহ. (১০৬হি.) এর মতে হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে জিনদের মাঝে জিনকেই নবী হিসেবে প্রেরণের ধারা অব্যাহত ছিল। তবে হযরত ইবনে আব্বাস রাযি., ইবনে জুরাইজ, মুজাহিদ,কালবী, আবু উবাইদ, ওয়াহিদী রহ. সহ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জমহুর উলামায়ে কেরামের মত হল 'কোন জিনকে নবী বা রাসূল হিসেবে কখনো প্রেরণ করা হয়নি। তবে জিনদের মধ্যে 'দাঈ' (দীনের দাওয়াত প্রদানকারী) ছিল। যারা মানুষের মাঝে প্রেরিত নবীদের থেকে হুকুম আহকাম শুনে গিয়ে নিজেদের কওমকে দাওয়াত দিত।
এ মতটিই বিশুদ্ধ। মুফাসসির ইমাম কুরতুবী রহ. (৬৭১হি.), ইমাম জারীর তবারী রহ., ইমাম ইবনে কাসীর রহ. (৭৭৪হি.), জমহুর উলামায়ে কেরামের মতটিকেই সঠিক বলেছেন। (তাফসীরে তবারী [সূরা আনআম- ১৩০],
তাফসীরে কুরতুবী [সূরা আহকাফ- ১৩০], তাফসীরে ইবন কাসীর [সূরা রহমান- ২২], আকামুল মারজান; পৃষ্ঠা ৪৬)
হযরত হাসান বসরী রহ. (১১০হি.) বলেন,
بعث الله محمدا صلى الله عليه وسلم إلى الإنس والجن ولم يبعث الله تعالى قط رسولا من الجن ومن أهل البادية ولا من النساء وذلك قوله تعالى وما أرسلنا من قبلك إلا رجالا نوحي إليهم من أهل القرى (سورة يوسف - (۱۰۹)
অর্থ : আল্লাহ তা'আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মানুষ ও জিন জাতির প্রতি রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা কোন জিন, গ্রাম্য বেদুঈন এবং নারীকে কখনো নবী বানাননি। যেমনটি আল্লাহ তা'আলা নিজেই বলেন, 'আর আমি আপনার পূর্বে যত রাসূল প্রেরণ করেছি, বিভিন্ন জনপদের অধিবাসীদের মধ্য হতে তারা সকলে মানুষই ছিলেন। (সূরা ইউসুফ- ১০৯)
জিনেরা জান্নাত জাহান্নামে যাবে কি না?
এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম একমত যে, জিনদের মধ্যে যারা কাফের, তাদেরকে জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হবে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা আপন কওমের নিকট দাওয়াত প্রদানকালে দাঈ জিনদের কথা এভাবে বিবৃত করেছেন, وَأَمَّا الْقَاسِطُونَ فَكَانُوا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا. এ আয়াত দ্বারা কাফের জিনদের জাহান্নামে প্রবেশের বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। (তাফসীরে কুরতুবী [সূরা জিন- ১৫])
তবে জিনদের মধ্যে যারা মুমিন, সৎকর্মশীল তারা জান্নাতে যাবে কি না? এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মতবিরোধ রয়েছে।
(১) কারো মতে তারা মূল জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তবে জান্নাতের এতটুকু কাছাকাছি থাকবে যে, মানুষ তাদেরকে দেখতে পাবে, কিন্তু তারা মানুষকে দেখতে পাবে না। ইমাম মালেক রহ. (১৭৯হি.) ও ইমাম শাফেয়ী রহ. (২০৪হি.) এরও এই অভিমত।
(২) কারো মতে মুমিন জিনেরা আ'রাফে (জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী স্থানে) থাকবে।
(৩) অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে মুমিন মানুষের মতো মুমিন জিনেরাও জান্নাতে প্রবেশ করবে।
তৃতীয় মতটিই বিশুদ্ধ। কেননা মানুষের মত জিনেরা যখন আল্লাহর আদেশ- নিষেধ পালনে আদিষ্ট, তখন আদেশ পালনের পুরস্কার স্বরূপ জান্নাতে প্রবেশ এবং নিষেধ অমান্যের শাস্তি স্বরূপ জাহান্নামে প্রবেশের ক্ষেত্রেও মানুষের মত হওয়াই স্বাভাবিক। বিভিন্ন আয়াতের ব্যাপকতা দ্বারা এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَلِمَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّہٖ جَنَّتٰنِ ۚ فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّکُمَا تُکَذِّبٰنِ ۙ
আর যে ব্যক্তি নিজ রবের সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করতে থাকে, তার জন্য (বেহেশতে) দুটি উদ্যান থাকবে। অতঃপর হে জিন ও মানব! তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে। (সূরা রহমান- ৪৭)
উক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, জিনদের জন্যও জান্নাত রয়েছে। কেননা تكذبان শব্দ দ্বারা আল্লাহ তা'আলা মানুষ এবং জিন জাতিকে সম্বোধন করেছেন। (তাফসীরে কুরতুবী [সূরা রহমান- ১৩], আকামুল মারজান; পৃষ্ঠা ৬৮)
বিখ্যাত মুফাসসির ইমাম কুরতুবী রহ. (৬৭১হি.) সূরা রহমান, সূরা কাহাফ, সূরা জিন প্রসঙ্গে বলেন,
هذه السورة الأحقاف وقل أوحي دليل على أن الجن مخاطبون مكلفون مأمورون منهيون مثابون معاقبون كالإنس سواء، مؤمنهم كمؤمنهم وكافرهم ككافرهم، لا فرق بيننا وبينهم في شيء من ذلك.
এই সূরা (আর-রহমান), সূরা আহকাফ এবং সূরা জিন এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, (মানুষের মত) জিনেরাও মুকাল্লাফ, আদেশ নিষেধের শৃঙ্খলে তারাও আবদ্ধ। মানুষের মত তাদেরকেও তাদের ভালো-মন্দ কাজের উপযুক্ত প্রতিদান দেয়া হবে। তাদের মুমিন এবং কাফেরদের প্রাপ্তি এবং পরিণতি ঠিক তাই হবে যা মুমিন মানুষ ও কাফের মানুষের ক্ষেত্রে হবে। পুরস্কারপ্রাপ্তি ও শাস্তিভোগের ক্ষেত্রে মানুষ ও জিনের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। (তাফসীরে কুরতুবী [সূরা রহমান- ৩৬])
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
আলোকময় কুরআন
আজ জুমু'আর দিন। এ দিনে সূরা কাহাফ তিলাওয়াতের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। এটা পনের পারায় শুরু হয়ে ষোল পারায় শে...
মহিলাদের দীনী শিক্ষার গুরুত্ব ও পদ্ধতি
আল্লাহ তা'আলা মানুষকে ঈমান ও আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন। ঈমান ও আমল বিষয়ে জানতে হলে ইলমে দীন হাসিল করা...
থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপন: পাশ্চাত্যের নগ্ন অনুকরণ
নববর্ষের সূচনাতে আল্লাহ প্রেমিক মুমিনের অনুভূতি জানুয়ারী-'১ থেকে একটি নতুন সৌরবর্ষের সূচনা হতে যাচ্ছ...
ইলমে দীন ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় ভাবনা
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعم...