প্রবন্ধ
মূর্তি ও ভাস্কর্যপ্রীতি : ইসলাম কী বলে?
ইসলামের যে বিষয়গুলোর নিষিদ্ধতা অকাট্য ও মুতাওয়াতিরভাবে প্রমাণিত তার মধ্যে প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ একটি। এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা তথা ঐকমত্য রয়েছে। দেশের উলামায়ে কেরাম মূলত এই ঐকমত্য পথ ও মতটি উম্মাহর সামনে তুলে ধরার প্রয়াস চালাচ্ছেন। কোন রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ থেকে তাদের এই বক্তব্য নয়। বিধানগত বিচারে প্রতিকৃতি নির্মাণ নিয়ে আমরা কয়েকটি কাঠামোতে আলোচনা করতে পারি।
এক. পূজার জন্য প্রতিকৃতি নির্মাণ
পূজার জন্য প্রতিকৃতি নির্মাণ সর্বাবস্থায় হারাম ও নিষিদ্ধ; চাই প্রাণীর প্রতিকৃতি হোক কিংবা প্রাণহীন বস্তুর। কোনও মুসলমানের জন্য পূজার উদ্দেশ্যে কোনও ধরনের প্রতিকৃতি নির্মাণ অনুমোদিত নয়। তবে প্রতিমাপূজারীরা কিছু করলে তার দায়ভার তাদেরই উপর বর্তাবে।
দুই. পূজা ছাড়া ভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রতিকৃতি নির্মাণ
যে প্রতিকৃতি পূজা ছাড়া ভিন্ন কোন উদ্দেশ্যে গড়া হয় তার বিধান হলো-
প্রাণীর প্রতিকৃতি হলে সর্বোতভাবে হারাম; চাই তা যে নামেই নির্মাণ করা হোক। মূর্তি, ভাস্কর্য ইত্যাদি শাব্দিক ভিন্নতা হুকুমের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করবে না। মুসলমানের জন্য এমন প্রতিকৃতি নির্মাণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কুরআন-সুন্নাহ বিশ্লেষণ করলে মৌলিকভাবে এর নিষিদ্ধতার তিনটি কারণ বোঝা যায়-
(ক) আল্লাহর সৃষ্টিগুণের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়।
(খ) পৌত্তলিক ও কাফেরদের অনুরূপ কর্ম সম্পাদন করা হয়।
(গ) এসব নির্মাণের পর এ সবের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা ক্রমেক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে একপর্যায়ে তা শিরকে লিপ্ত হওয়ার কারণ হয়।
উল্লিখিত তিনটি কারণ থেকে মুক্ত হয়ে প্রাণীর ভাস্কর্য বা মূর্তি নির্মাণ কি আদৌ সম্ভব? অথচ এসব কারণের মধ্য থেকে যে কোন একটি কারণের উপস্থিতি মূর্তি নির্মাণ নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এ ব্যাপারে হাদীসের ভাষ্য লক্ষ্য করুন-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول الله عز وجل: «ومن أظلم ممن ذهب يخلق كخلقي، فليخلقوا حبة، وليخلقوا ذرة»
(অর্থ:) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা'আলা বলেন, ঐ লোকের চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করতে চায়? তাদের যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে একটি শস্যদানা কিংবা একটি অণুকণা সৃষ্টি করে দেখাক! (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫৯৫৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
إن الذين يصنعون هذه الصور يعذبون يوم القيامة، يقال لهم: أحيوا ما خلقتم
(অর্থ:) যারা প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরি করে,কিয়ামতের দিন তাদেরকে আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। তাদেরকে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার করো। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫৯৫১) আল্লামা ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন, أَحْبُوا مَا خَلَقْتُمْ (যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার করো) থেকে বোঝা যায়, প্রতিকৃতি দ্বারা প্রাণীর প্রতিকৃতি উদ্দেশ্য। (আত-তামহীদ ৮/৫২৭)
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন,
فلما رآه تغير لونه وهتكه بيده ثم قال: إن أشد الناس عذابا يوم القيامة الذين يشبهون بخلق الله
(অর্থ:) ছবিযুক্ত পর্দা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়ে গেল। তিনি নিজ হাতে তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, কিয়ামত দিবসে প্রতিকৃতি তৈরিকারীদের কঠিনতম শাস্তি হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হা.নং ২৫৭১৮)
যারা প্রতিকৃতি তৈরি করে তাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, أولئك شرار الخلق عند الله يوم القيامة (অর্থ:) এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪২৭)
ভালো নিয়তে মূতি-ভাষ্কর্য নির্মাণ অতীতে শিরকে লিপ্ত হওয়ার কারণ হয়েছে
নূহ সম্প্রদায় কর্তৃক মৃতিপূজার সূচনা সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস রাযি.থেকে বর্ণিত আছে-
فكانت لحمير لآل ذي الكلاع أسماء رجال صالحين من قوم نوح فلما هلكوا أوحى الشيطان إلى قومهم أن انصبوا إلى مجالسهم التي كانوا يجلسون أنصابا وسموها بأسمائهم ففعلوا فلم تعبد حتى إذا هلك أولئك وتنسخ العلم عبدت.
(অর্থ:) (ওয়াদ্দ, সুওয়া' ইয়াগুস, ইয়াউক, নাসর) এগুলো হলো ঐ সম্প্রদায়ের নেককার ব্যক্তিদের নাম। যখন তারা মৃত্যুবরণ করলো, শয়তান ঐ সম্প্রদায়কে নির্দেশ দিলো যে, তাদের ইবাদতের স্থানে তাদের প্রতিকৃতি তৈরি করো। তারা তাই করলো। এ সময় তারা এগুলোর ইবাদত করতো না। অতঃপর প্রতিকৃতি তৈরিকারী প্রজন্ম মৃত্যুবরণ করলো। পরবর্তী প্রজন্ম প্রতিকৃতিগুলোর প্রকৃত পরিচয় ও উদ্দেশ্য বিস্মৃত হয়ে গেলো। ফলে নতুন প্রজন্ম সেগুলোর উপাসনা শুরু করে দিলো। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪৬৩৬)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
وأيضا فإن اللات كان سبب عبادتها تعظيم قبر رجل صالح كان هناك.
(অর্থ:) লাত প্রতিমার পূজার সূচনা হয়েছিলো একজন নেককার ব্যক্তির কবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সূত্রেই। (ইকতিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ২/৩৩৩)
উল্লিখিত বর্ণনাগুলোতে দেখা যাচ্ছে, মূর্তিপূজার সূচনাকালে প্রাণীর মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ পূজার জন্য হতো না; বরং ভালো ব্যক্তিদের আদর্শ ও স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই নির্মাণ করা হতো। কালক্রমে এটাই মানুষের মূর্তিপূজায় লিপ্ত হওয়ার কারণ হয়েছে। এজন্য শরীয়তে মুহাম্মাদীতে প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে উম্মতের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইমাম নববী রহ. বলেন, وأجمعوا على منع ما كان له ظل ووجوب تغييره (অর্থ:) এ ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ছায়াবিশিষ্ট মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং এমন কিছু নির্মাণ করা হলে তা নষ্ট করে ফেলা আবশ্যক। (শরহে নববী লি-মুসলিম ১৪/৮৭)
ইবনুল আরাবী রহ. বলেন, أن الصورة إذا كان لها ظل حرم بالإجماع سواء كانت مما يمتهن أم لا (অর্থ:) যে প্রতিকৃতি ছায়াবিশিষ্ট অর্থাৎ মূর্তি/ভাস্কর্য তা উম্মতের ঐকমত্যের ভিত্তিতে হারাম এবং তার ব্যবহারও হারাম; চাই সম্মানজনক ব্যবহার হোক বা অপদস্থতামূলক ব্যবহার হোক। (ফাতহুল বারী ১০/৩৮৮)
কুরআনে বর্ণিত 'তিমছাল' দ্বারা কী উদ্দেশ্য?
কুরআনে মূর্তি, ভাস্কর্য ও প্রতিমা বোঝানোর জন্য বিভিন্ন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ 'তিমছাল', 'আনছাব', 'আছনাম'। এর মধ্যে 'আনছাব' ও 'আছনাম' দ্বারা পূজনীয় মূর্তি বোঝানো হয়েছে। আর 'তিমছাল' শব্দটি কোথাও প্রতিমা ও পূজনীয় মূর্তি বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে,
আবার কোথাও প্রাণহীন বস্তুর প্রতিকৃতি বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। প্রকৃত কথা হলো, 'তিমছাল' শব্দটি মূলগত ব্যবহারে প্রাণী ও প্রাণহীন উভয় প্রকার প্রতিকৃতি বোঝানোর জন্য ব্যবহার হয়। আল্লামা যামাখশারী রহ. বলেন, لأن التمثال كل ما صوّر على مثل صورة غيره من حيوان وغير حيوان .(অর্থঃ) কোন কিছুর সদৃশ যে প্রতিকৃতি তৈরি করা হয় সেটাই 'তিমছাল'; প্রাণীর হোক কিংবা প্রাণহীন বস্তুর। (তাফসীরে কাশশাফ ৩/৫৫৫)
আল্লামা আইনী রহ. বলেন, والتمثال يكون فيه وفي غيره (অর্থ:) 'তিমছাল' শব্দটি যেমনিভাবে প্রাণীর আকৃতি বোঝানোর জন্য ব্যবহার হয় তেমনিভাবে প্রাণহীন বস্তুর আকৃতি বোঝানোর জন্যও ব্যবহার হয়। (উমদাতুল কারী; অধ্যায়: আযাবুল মুছাওইরীন ইয়াওমাল কিয়ামাহ)
কুরআন-সুন্নাহয় শব্দটি উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখন কথা হলো, কোথায় কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, তা কাদের বক্তব্য দ্বারা নির্ধারিত হবে? পরিষ্কার কথা হলো, সাহাবা-তাবেয়ীদের বক্তব্য এবং কুরআন-সুন্নাহর অন্যান্য দলীলের আলোকে উলামায়ে উম্মত তা নির্ধারণ করবেন এবং তারা তা করেছেনও। ব্যবহারিক এই ভিন্নতার দৃষ্টান্ত হলো সূরা আম্বিয়ার ৫৭ নং আয়াত। এখানে 'তিমছাল' শব্দটি প্রতিমা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার কোথাও 'তিমছাল' শব্দটি প্রাণহীন বস্তুর ভাস্কর্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সূরা সাবার ১৩ নং আয়াত।
ইমাম যামাখশারী রহ. বলেন, সূরা সাবার ১৩ নং আয়াতে 'তিমছাল' দ্বারা উদ্দেশ্য হলো প্রাণহীন বস্তুর ছবি; যেমন গাছাগাছালি ইত্যাদি। (তাফসীরে কাশশাফ ৩/৫৫৫)
সুতরাং আল্লামা যামাখশারীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী বলা যায়, পূর্ববর্তী শরীয়তেও প্রাণীর মূর্তি নির্মাণ বৈধ ছিলো না এবং কুরআনে কারীমে হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের যুগে যে 'তিমছাল' তৈরির কথা বলা হয়েছে তা ছিল প্রাণহীন বস্তুর প্রতিকৃতি। বাইবেলের বর্ণনা থেকেও এমনটি বোঝা যায়-
Do not Make for your selves images of anything in haven or on earth or in the water under the earth. (Good news bible; Page 80)
এমনিভাবে পূর্ববর্তীদের যারা প্রতিকৃতি তৈরি করতো তাদের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- فَأُولَئِكَ شِرَارُ الْخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ . (অর্থ:) এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকৃষ্ট সৃষ্টি। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪২৭)
উল্লিখিত বর্ণনা থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বেও প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরি করা হারাম ছিলো। তবে যারা উল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরি উদ্দেশ্য নিয়েছেন, তারাও এ ব্যাপারে একমত যে, পূর্ববর্তী শরীয়তে যা-ই থাকুক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়তে মুসলমানের জন্য প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরি করা সম্পূর্ণ হারাম। ইমাম নববী রহ. বলেন,فصنعته حرام بكل حال لأن فيه مضاهاة لخلق الله تعالى. (অর্থ:) সর্বাবস্থায় প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরি করা হারাম। কারণ, এতে আল্লাহর সৃষ্টিগুণের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। (শরহু মুসলিম লিন-নববী; অধ্যায়: তাহরীমু তাসবীরি সূরাতিল হাইওয়ান)
শিশুদের খেলনা দ্বারা মূর্তি ও ভাস্কর্যের পক্ষে প্রমাণ গ্রহণের কোন সুযোগ আছে কি?
মূর্তি/ভাস্কর্যের বিধান আলোচনায় শিশুদের খেলনার কথা টেনে আনা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। দু'টি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। নবীযুগে শিশুদের খেলনা প্রকৃত অর্থে মূর্তি বা ভাস্কর্য ছিল কিনা তা দীর্ঘ আলোচনা ও পর্যালোচনার বিষয়। তাই মূর্তি/ভাস্কর্যের দ্ব্যর্থহীন, অকাট্য ও সর্বসম্মত বিধানের সঙ্গে খেলনা পুতুলের প্রসঙ্গ তোলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক। যদি সে পুতুলগুলো প্রকৃত অর্থে মূর্তি/ভাস্কর্যের অনুরূপ হয়েও থাকে; নির্ভরযোগ্য বক্তব্য অনুযায়ী ইসলামের শুরুর দিকে তার বৈধতা ছিল, পরবর্তীকালে তার বিধান রহিত হয়ে গেছে।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন,
قال: وذهب بعضهم الى أنه منسوخ وإليه مال ابن بطال... رجح الداودي أنه منسوخ، وقال المنذري : إن كانت اللعب كالصورة فهو قبل التحريم.
(অর্থ:) কাযী ইয়ায রহ. বলেছেন, কতক আলেমের মতে ছবি নিষিদ্ধের হাদীস দ্বারা (প্রাণীর আকৃতিতে তৈরী) খেলনা তৈরির বৈধতাও রহিত হয়ে গেছে। ইবনে বাত্তালের অভিমতও অনুরূপ...। ইমাম দাউদী রহ. রহিত হওয়ার মতকে প্রধান্য দিয়েছেন। ইমাম বায়হাকী রহ. প্রাণীর প্রতিকৃতি নিষিদ্ধতা সংক্রান্ত হাদীস উল্লেখের পর বলেন, এর মধ্যে প্রতিকৃতি রাখার নিষিদ্ধতা প্রমাণিত হয়। সুতরাং হযরত আয়েশা রাযি.-এর ক্ষেত্রে এসবের ছাড় হারাম হওয়ার পূর্বে বলে ধরা হবে। ইবনুল জাওযী রহ. রহিত হওয়ার মতকে সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত মনে করেন। ইমাম মুনযিরী রহ. বলেন, যদি (হাদীসে উল্লিখিত) খেলনা দ্বারা প্রাণীর আকৃতিতে তৈরী খেলনা উদ্দেশ্য হয় তবে (এর ব্যাখ্যা হল) এ ঘটনা হারাম হওয়ার পূর্বেকার, আর প্রাণীর আকৃতির না হয়ে থাকলে (এ হাদীসের ব্যাখ্যা হল,) প্রাণহীন বস্তুর আকৃতিকে লু'বা বা পুতুল বলা হয়েছে। আল্লামা হালীমী রহ. এ মতটিকে সঠিক মনে করেন। তিনি বলেন, খেলনা যদি মূর্তির/প্রাণীর আকৃতিতে হয় তাহলে তা জায়েয নেই, অন্যথায় জায়েয। (ফাতহুল বারী ১০/৬৪৬)
নির্ভরযোগ্য মত অনুযায়ী সালাফের যুগে শিশুদের খেলনা পুতুল প্রাণীর প্রতিকৃতি ছিল না
শিশুদের খেলনা পুতুল সংক্রান্ত হাদীসের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের এক জামা'আতের বক্তব্য হলো- হযরত আয়েশা রাযি. যে পুতুলের কথা বলেছেন, তা দ্বারা হুবহু প্রাণীর আকৃতিতে তৈরি পুতুল উদ্দেশ্য নয় (বিশেষত বর্তমান বাজারে যে খেলনা পুতুল পাওয়া যায় তা তো অবশ্যই নয়)। এর দ্বারা উদ্দেশ্য এমন খেলনা পুতুল যা বাচ্চারা নিজেরা তৈরি করে, সেটাকে কাপড় পরায় এবং 'বাবু' মনে করে খেলাধূলা করে। এই বক্তব্যটি আমাদের দৃষ্টিতে অধিক মজবুত।
আল্লামা কুরতুবী রহ. সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসের শব্দ كنت العب بالبنات এর ব্যাখ্যায় বলেন,
وهن اللعب جمع لعبة وهو ما يُلْعَبُ به والبنات جمع بنت وهن الجواري وأضيفت اللعب للبنات لأنهن هن اللواتي يصنعنها ويلعبن بها.
(অর্থ:) 'লু'বা' বলা হয় ঐ জিনিসকে যার দ্বারা খেলা হয়। হাদীসে বর্ণিত লু'বা শব্দটি 'বানাত' (বালিকা)-এর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত করে ব্যবহারের কারণ হলো, বালিকারা নিজ হাতে এ ধরনের খেলনা পুতুল তৈরি করে থাকে। অতঃপর এগুলো দ্বারা খেলাধূলা করে। (আলমুফহিম; হা.নং ৩২৩)
হযরত আয়েশা রাযি. এর বর্ণনায় স্পষ্টভাবে এ কথার উল্লেখ নেই যে, সেই খেলনাগুলো ছবি আকৃতির ছিল। আরবদেশে বাচ্চাদের খেলনা কেমন হয় তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শাইখ হামুদ বিন আব্দুল্লাহ তুআইজিরী বলেন,
بل والظاهر والله أعلم أنها كانت على نحو لعب بنات العرب في زماننا فإنهن يأخذن عودًا أو قصبة أو خرقة ملفوفة أو نحو ذلك فيضعن قريبا من أعلاه عودا معترضا ثم يلبسنه ثيابا ويضعن على أعلاه نحو حمار المرأة وربما جعلته على هيئة الصبي في المهد ثم يلعبن بهذه اللعب ويسمينهن بنات لهن على وفق ما هو مروي عن عائشة وصواحباتها رضي الله عنهن. وقد رأينا البنات يتوارثن اللعب بهذه اللعب اللاتي وصفنا زمانا بعد زمان ولا يبعد أن يكون هذا التوارث قديما ومستمرا في بنات العرب من زمن الجاهلية إلى زماننا هذا والله أعلم.
(অর্থ:) 'বাস্তবতা তো আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। তবে বাহ্যিকভাবে মনে হয়, এই খেলনা দ্বারা আমাদের বর্তমান সময়ের মেয়েদের খেলনার মত খেলনা উদ্দেশ্য। বর্তমানের মেয়ে শিশুরা প্রথমে একটি (লম্বা) চটি, একটি (ছোট) কাঠি, গোল করে মোড়ানো একটি কাপড়ের পুটলি ও কিছু টুকরো কাপড় বা এ জাতীয় জিনিস সংগ্রহ করে। তারপর লম্বা চটিটির উপরের অংশের কাছাকাছি কাঠিটি আড়াআড়ি বাঁধে। এরপর এটার গায়ে কাপড় জড়িয়ে লম্বা চটির একেবারে মাথায় কাপড়ের পুটলিটি বেঁধে মেয়েদের ওড়না পরার মত আঁচল পরিয়ে দেয়। আবার কখনো দেখা যায়, দোলনায় বাচ্চার মত কিছু একটা বনিয়ে সেটা দিয়ে খেলা করে। তো এই জিনিসটিকে তারা بنات (কন্যা) মনে করে খেলে, ঠিক যেমনটি হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত। আমরা আমাদের অঞ্চলের মেয়েদের দেখেছি যে, পূর্বে যে ধরনের খেলনার কথা বললাম তা যুগ যুগ ধরে পরম্পরায় চলে আসছে। এ কথা বললে বাড়াবাড়ি হবে না যে, এই পরম্পরার ব্যাপারটি আরবকন্যাদের মাঝে ইসলামের শুরু যুগ থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে।' এরপর তিনি একটি বিষয় পরিষ্কার করেছেন যে, আরবের অনেক শিশু প্রাণীর আকৃতির পুতুল দ্বারা খেলে।
তাহলে পূর্বোক্ত বক্তব্যের কী বাস্তবতা রইল? এর জবাবে তিনি বলেন,
وأما السالمات من أدناس المدنية الإفرنجية ومن مخالطة نساء الأعاجم وأشباه الأعاجم فهؤلاء لم يزلن على طريقة بنات العرب. ولعبهن على ما وصفنا من قبل.
(অর্থ:) যারা ইউরোপিয়ান কালচারের (কলুষমুক্ত এবং অনারবীয়দের সংশ্রব ও সাদৃশ্যমুক্ত তারা পুতুল খেলায় এখনও (প্রাচীন) আরবকন্যাদের মতো। আর তাদের খেলনা পুতুল কেমন হয় তার বিবরণ আমি আগেই দিয়েছি। (ই'লানুন নাকীর আলাল মাফতুনীন বিত-তাসবীর ১/৬৭)
উল্লেখ্য, শাইখ বিন বায এবং শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফী উক্ত গ্রন্থের উপর প্রশংসাপত্র লিখেছেন।
আল্লামা কাশ্মীরী রহ. বলেন,
أن البنات جائزة، وكانت حقيقتها في القديم، أنهم كانوا يأخذون ثوبا، ويشدونه في الوسط فكانت لا تحى عن صورة وشكل، ولم تكن كبناتنا اليوم، فإنها تماثيل كالأصنام، فلا تجوز قطعا .
(অর্থ:) খেলনা পুতুল জায়েয। অতীতে এগুলো দ্বারা খেলার ধরন এই ছিল যে,তারা কাপড় সংগ্রহ করে এর মাঝখানে গিঠ দিতো। এ ধরনের খেলনা পুতুল (ছবির) আকার-আকৃতি বুঝায় না এবং তা আজকালের খেলনা পুতুলের মতও ছিল না। বর্তমানের খেলনা পুতুল তো প্রতিমা-মূর্তির মতো; নিশ্চিতভাবে তা জায়েয নেই। (ফয়যুল বারী ৭/৩৮৮)
সহীহ বুখারীর এ হাদীসটি উল্লিখিত বক্তব্যের সমর্থন করে। হযরত রবী বিনতে মুআওয়ায থেকে বর্ণিত,
ونصوم صبياننا، ونجعل لهم اللعبة من العهن، فإذا بكى أحدهم على الطعام أعطيناه ذاك حتى يكون عند الإفطار
(অর্থ:) আমাদের ছোট বাচ্চারা রোযা রাখতো। আমরা তাদের জন্য তুলার টুকরো দিয়ে খেলনা পুতুল বানাতাম। তাদের কেউ যখন খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতো, আমরা এই ধরনের পুতুল দিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতাম। ইফতার পর্যন্ত এভাবে কেটে যেতো। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১৯৬০)
আর আবু দাউদের হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক খেলনার ডানা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা প্রমাণ করে যে, এটা প্রকৃত অর্থে ছবি ছিল না। কারণ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করেছেন, ওটা কি জিনিস? এটা বলেননি যে, ডানা কোত্থেকে এলো?
সারকথা, বাচ্চাদের খেলনা হিসেবে তৈরী প্রচলিত খেলনা পুতুল আর নববী যুগের খেলনা পুতুল এক নয়। (বর্তমানের প্রচলিত প্রাণীর আকৃতিবিশিষ্ট পুতুলকে হারাম বলা উচিত।) কারণ-
১. যে সকল হাদীসে খেলনা পুতুলের কথা বলা হয়েছে সেগুলোতে প্রাণীর আকৃতির কথা স্পষ্ট বুঝে আসে না। অথচ হারাম হওয়ার পক্ষের হাদীসগুলো স্পষ্ট।
২. আরবে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ঐতিহ্যবাহী পরিবারের বাচ্চাদের জন্য যে খেলনা পুতুলের প্রচলন আছে, তা বাস্তব প্রাণীর আকৃতির নয়; বরং তা বাচ্চাদের কাল্পনিক পুতুল হয়ে থাকে।
তবে এ কথা ঠিক যে, এ সংক্রান্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরামের মতবিরোধ থাকায় এর অকাট্যভাবে হারাম মূর্তি/ভাস্কর্যের নিষিদ্ধতা থেকে প্রমাণিত তুলনামূলক হালকা হবে।
অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে এনে মূর্তি/ভাস্কর্য বৈধ করার প্রচেষ্টা দীন বিকৃতির নামান্তর
মূর্তি/ভাস্কর্যের নিষিদ্ধিতা অকাট্য ও উম্মতের ঐকমত্য দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত। এতদসত্ত্বেও যারা কুরআন- হাদীসের ভুল ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে তা বৈধ প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের বিকৃত মস্তিষ্কের হাল-হাকীকত আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা.-এর বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি বলেন, আপনি তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে এ জাতীয় বাক্য বারবারই শুনে থাকবেন যে, আমরা কুরআন-সুন্নাহর এমন ব্যাখ্যা প্রদান করতে চাই, যাতে তা বর্তমান যুগের চাহিদা মোতাবেক হয়। এ বাক্যের সহজ সরল অর্থ এটাই যে, বর্তমান যুগে আমরা কুরআন-সুন্নাহর আসল বিধান কি তা অনুসন্ধান করতে যাব না, বরং প্রথমে নিজেরা স্থির করে নিব যে, যুগের চাহিদা কী? তারপর কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে তার স্বপক্ষে দলীল খুঁজব। তা না পাওয়া গেলে আয়াত-হাদীসের এমন ব্যাখ্যা দান করব, যাতে তা সমকালীন চাহিদা মোতাবেক হয়ে যায়।
আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা. আরও বলেন, খৃস্টধর্ম প্রচারকগণ মুসলিম বিশ্বে তাদের ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে ঠিক এ নীতিই অবলম্বন করেছে। তারা সরলপ্রাণ মুসলিমদের ধোঁকা দেয়ার জন্য তাদের সামনে কুরআন-হাদীস দ্বারাই নিজেদের আকীদা-বিশ্বাস প্রামাণ করে থাকে। যেমন তারা বলে, দেখো কুরআনেও হযরত ঈসাকে 'কালিমাতুল্লাহ' বলা হয়েছে, তার মানে তিনি আল্লাহর 'কালাম গুণ' ছিলেন। আর ইউহান্নার ইঞ্জিলেও একথা বলা হয়েছে। কুরআনেও তাকে রুহুল্লাহ বলা হয়েছে, এর দ্বারা বোঝা যায় হযরত ঈসা আল্লাহর রূহ ও আত্মা ছিলেন..।
এভাবে যে কুরআন দ্ব্যর্থহীনভাবে ত্রিত্ববাদকে খণ্ডন করেছে, তাদের নতুন ব্যাখ্যার বদৌলতে সেই কুরআন দ্বারাই মাথা-মুণ্ডহীন এ আকীদা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো। বাকী রইল সেই আয়াত, যা ত্রিত্ববাদকে সরাসরি খণ্ডন করেছে, তো সেটা কোন সমস্যা নয়, কেননা ত্রিত্ববাদকে যখন কুরআন দ্বারা প্রমাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া হয়েছে, এর ব্যাখ্যা দেয়া কঠিন কিছু নয়। (ইসলাম ও আমাদের জীবন: খ. ১৪ পৃ. ৬২)
কুরআন/হাদীস দ্বারা প্রণীর মূর্তি/ভাস্কর্য প্রমাণকারীদের অবস্থাও হুবহু অনুরূপ। নিষিদ্ধের ব্যাপারে যতোই অকাট্য প্রমাণ থাকুক, তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, মূর্তি/ভাস্কর্য বৈধ প্রমাণ করবেই এবং নিষিদ্ধতা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট আয়াত- হাদীসের অপব্যাখ্যায় নেমে পড়বে। অতএব মুসলিমদের উচিত এদের প্রতি ভ্রক্ষেপ না করা; বরং হক্কানী উলামায়ে কেরামের কথা মেনে নেয়া। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে শিরকমুক্ত ঈমানের উপর অটল থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
শরয়ী বিধানে প্রাণীর ছবি (পর্ব এক)
প্রথমদিকে মানুষ তাদের সমাজের নেক ও সৎ লোকদের ভাস্কর্য বানাতো, চিত্র তৈরি করতো। কালক্রমে সেটাই তাদের ...
মহিলাদের দীনী শিক্ষার গুরুত্ব ও পদ্ধতি
আল্লাহ তা'আলা মানুষকে ঈমান ও আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন। ঈমান ও আমল বিষয়ে জানতে হলে ইলমে দীন হাসিল করা...
আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলী
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] হামদ ও সালাতের পর... আদর্শ শিক্ষকের পরিচয় হলো- যে শিক্ষক তার নিবিড় অধ...
শান্তি সম্প্রীতি ও উদারতার ধর্ম ইসলাম
নামে যার শান্তির আশ্বাস তার ব্যাপারে আর যাই হোক, সন্ত্রাসের অপবাদ দেয়ার আগে তার স্বরূপ উদঘাটনে দু'দণ...