প্রবন্ধ
ওয়ায-মাহফিল আয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম-নীতি
ওয়ায মাহফিলের উদ্দেশ্য
দৈনন্দিন জীবনে মহান আল্লাহ পাকের বিধি-বিধান সঠিকভাবে পালন করার জন্য প্রয়োজনীয় দীনী ইলম শিক্ষা করা এবং দীনের সহীহ জযবা ও সুস্থ চেতনা ধারণ করা প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের জন্য ফরযে আইন। ওয়ায মাহফিলের আয়োজন দ্বারা আসল উদ্দেশ্য হলো, দীনী কথা শুনে শুনে অন্তরে দীনের জযবা পয়দা করা এবং ইলমে দীন শিক্ষা করা। এজন্য প্রত্যেক এলাকায় সচেতন দীনদার ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে বৎসরে একাধিকবার ওয়ায মাহফিলের আয়োজন করা উচিত। তবে ওয়ায মাহফিল দ্বারা যেন শ্রোতাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জিত হয়, সেজন্য ওয়ায মাহফিল আয়োজনের সঠিক পদ্ধতিও জানা দরকার।
ওয়ায়েয/বক্তা ও মেহমান নির্বাচন প্রসঙ্গ
১. হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা হযরত ডাক্তার আব্দুল হাই আরেফী রহ. হাকীমুল উম্মতের বয়ানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন-
'তাঁর বয়ান শোনে শ্রোতাদের অন্তঃকরণ আলোকিত হতো, দৃষ্টিভঙ্গির পরিশুদ্ধি এবং দীনের সমঝ পয়দা হতো। হযরতের বয়ানের বিশেষ দিক এই ছিলো যে, তাতে হক-বাতিলের পার্থক্য, আকীদা-বিশ্বাসের দৃঢ়তা, দীনের সঠিক ও সুস্থ চেতনা এমনভাবে সৃষ্টি হতো যে, নাস্তিকতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত ব্যক্তির অন্তরও সত্যের আলোয় আলোকিত হতো। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও কল্পনা-সন্দেহ থেকে মন-মস্তিষ্ক নিষ্কলুষ হয়ে যেতো। শয়তানের প্ররোচনার জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো। বর্ণনাশৈলীতে এতোটাই মুগ্ধতা ছিলো যে, শ্রোতাদের অন্তর আল্লাহর মহব্বতের সাগরে অবগাহন করে সিক্ত ও তৃপ্ত হতো। কবির এ বক্তব্যের যথার্থতা পুরোপুরি দৃষ্টিগোচর হতো-
از دل خیزد بر دل ریزد
'অন্তর থেকে নিঃসৃত হয়ে অন্তরে গিয়ে আঘাত করতো!'
কাজেই দীনী মাহফিলের বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এমন হক্কানী আল্লাহওয়ালা উলামায়ে কেরামকে দাওয়াত দেয়া উচিত, যাদের বয়ানে কমবেশি উল্লিখিত গুণাবলী পাওয়া যায়।
২. দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে এমন বক্তাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত যারা ওয়াযের বিনিময় গ্রহণ করেন না। কারণ ওয়ায করা আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালামের কাজ। আর এ কাজ দ্বারা তখনই উম্মতের ব্যাপক ফায়দা হয় যখন তা নবীগণের তরীকায় করা হয়। আর কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত আছে, আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম ওয়াযের বিনিময় গ্রহণ করতেন না। তাঁরা একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে বিনিময় পাওয়ার আশায় ওয়ায করতেন। (সূরা ইয়াসীন-২১, সূরা শু'আরা-১২৭)
৩. দীনের ব্যাপারে জাহেল ও অজ্ঞ লোককে বক্তা নির্বাচন করা জায়েয নেই; চাই সে যত সুন্দর ও সুরেলা বয়ানই করুক। এদেরকে বক্তা নির্বাচন করা কিয়ামতের আলামত। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫৯, ১০০)
৪. অপরিচিত বা অজ্ঞাত বক্তা-যার ইলম ও আমল সম্পর্কে হক্কানী আলেম সমাজ অবগত নন- এমন কাউকে দাওয়াত না দেওয়া।
৫. বে-আমল আলেম এবং টেলিভিশনের বক্তাদেরকে মাহফিলের বক্তা নির্বাচন করা উচিত নয়। এদের দ্বারা জনগণের মধ্যে দীনের পরিবর্তে বদদীনী ও গোমরাহী সৃষ্টি হয়। (সূরা বাকারা-৪৪, মুসলিম শরীফ; হা.নং ১৪৫, শু'আবুল ঈমান লিল-বাইহাকী হা.নং ৯০১৬, ৯০১৮)
৬. ওয়াযকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে এমন বক্তাদেরকেও পারতপক্ষে দাওয়াত না দেয়া। একজন আলেম যখন ওয়াযকে তার জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করে, তখন পেশাগত স্বার্থে তাকে এমন কিছু উপায় ও কৌশল গ্রহণ করতে হয়, যা ওয়াযের প্রভাব ও সুফল নষ্ট করে দেয়। যেমন: এ ধরণের বক্তাগণ সাধারণত চুক্তি করে টাকা নিয়ে থাকেন, যা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের সুন্নাত পরিপন্থী। তাছাড়া এ ধরণের বক্তাগণ শ্রোতাদেরকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করার জন্য বিষয়বস্তু, স্বর ও সুরে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের লৌকিকতা কৃত্রিমতা অবলম্বন করেন এবং ইনিয়ে বিনিয়ে হাস্যরস ও অভিনয় করে ওয়ায মাহফিলকে কৌতুকের মঞ্চ বানিয়ে ফেলেন। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি এ উদ্দেশ্যে আসমানী ইলম শিক্ষা করবে যে, তা দ্বারা বিতর্ক করে আলেমদেরকে পরাজিত করবে, অথবা মূর্খদেরকে অবদমিত করবে, অথবা জনসাধারণকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করবে আল্লাহ তা'আলা তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। (তিরমিযী শরীফ; হা.নং ২৬৫৪)
৭. যে সকল বক্তা শ্রোতাদেরকে মাজার- ওরস ইত্যাদি কেন্দ্রিক বিদ'আতী কর্মকাণ্ডের প্রতি উৎসাহ দেয় এবং হক্কানী উলামায়ে কেরামের প্রতি জনসাধারণকে আস্থাহীন করার লক্ষ্যে উলামায়ে কেরামকে গালমন্দ করে তাদেরকে দাওয়াত না দেওয়া।
৮. হক্কানী উলামায়ে কেরামের মত ও পথ হতে বিচ্যুত কোনো ভ্রান্ত মতবাদের অনুসারী যথা: মাযহাব-বিরোধী, সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনাকারী এদেরকে বক্তা হিসেবে দাওয়াত দেয়া যাবে না।
৯. প্রকাশ্য ফাসেক ও বে-আমল কোন লোককে মাহফিলের সভাপতি,পরিচালক কিংবা বিশেষ অতিথি বানাবে না। এতে খোদাদ্রোহীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ফাসেককে সম্মান জানালে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। (সহীহ বুখারী; হা. নং ৫৯)
১০. টাকা-পয়সা কালেকশনের জন্য কোনো বক্তাকে দাওয়াত না দেওয়া। মাহফিলের নামে বক্তা দিয়ে টাকা কালেকশন করানো উম্মতের সঙ্গে প্রতারণার শামিল!
বয়ানের বিষয়বস্তু প্রসঙ্গ
১. ডাক্তার আব্দুল হাই আরেফী রহ. হযরত থানভী রহ.-এর বয়ানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন-
'হযরতের বয়ান অধ্যয়নের দ্বারা এ বিষয়ের সুস্পষ্ট অবগতি হবে যে, কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে বান্দার জন্য কী আদেশ- নিষেধ রয়েছে? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ও কর্ম কেমন ছিলো? সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিত কী ছিলো? মুফাসসিরীন, মুহাদ্দিসীন, ফুকাহা ও সুফিয়ায়ে কেরাম কারা ছিলেন এবং তাদের বৈশিষ্ট্যই বা কী ছিলো? মাযহাবের ইমামগণের মতভেদ কী কারণে? ইসলামী দর্শন বলতে কী বুঝায়? নফস ও শয়তান মানুষের জীবনের উপর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়? মুসলমানদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির সঠিক কর্মপন্থা কী? দুনিয়াবী ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা বিনোদন-ভ্রমণের ক্ষেত্রে ইসলামী রীতি- নীতি কী? জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলমানদের আবিষ্কার কী ছিলো? মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও খানকাহগুলো কীভাবে মুসলমানদের জন্য হিদায়াত ও পথনির্দেশক হয়েছিলো? পারিবারিক ও সামাজিকভাবে একজন মুসলমানের জীবনধারা কেমন হওয়া উচিত? সামাজিক প্রথা ও বিদ'আত মুসলমানদের কতটা দীনী ক্ষতি সাধন করেছে? ইংরেজী শিক্ষা ও কৃষ্টি-কালচার দ্বারা মুসলমানদের স্বভাব- চরিত্র কতটা বিষাক্ত হয়েছে..?' (মাআসিরে হাকীমুল উম্মত; পৃষ্ঠা ৩৩৪)
কাজেই হক্কানী এবং বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম দীনের জরুরী সকল বিষয়ে প্রামাণ্য আলোচনা করবেন। অপ্রয়োজনীয় আলোচনা থেকে বিরত থাকবেন। ওয়াযের মধ্যে ভিত্তিহীন কিসসা-কাহিনী বলে শ্রোতাদের হাসানো বা কাঁদানোর বদরসম থেকে বিরত থাকবেন। (মুসলিম শরীফ; হা.নং ৫০৫)
২. বয়ানের মধ্যে তারগীবী বা উৎসাহমূলক কথার সাথেসাথে যে পাঁচটি বিষয়ের ইলম অর্জন করা শরীয়তে ফরযে আইন (আকাইদ, ইবাদাত, মু'আমালাত, মু'আশারাত, আখলাক) এগুলোর উপরও আলোচনা রাখবেন। এজন্য কোন মাহফিলে কয়েকজন ওয়ায়েয হলে তাদের মধ্যে ওয়াযের বিষয়বস্তু বণ্টন করে দেয়া ভালো। (সূরা বাকারা-১৭৭, সহীহ বুখারী; হা.নং ৫০, মুসলিম শরীফ; হা.নং ৯)
৩. মাহফিলের মধ্যে সুন্নাতের আলোচনা করবেন এবং নামাযসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আমলের বাস্তব প্রশিক্ষণ দিবেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; বরং এটা মাহফিলের মূল উদ্দেশ্যও বটে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৬৭৭)
৪. মাহফিলের মধ্যে কোন হক্কানী পীর- মাশায়েখ শ্রোতাদেরকে যিকিরের মশক করাতে চাইলে মাইক ছাড়াই করাবেন। মাইকে যিকির করা শরীয়তের দৃষ্টিতে পছন্দনীয় নয়। তাছাড়া আজকাল হক্কানী পীর নয় এমন বক্তাও নিজের খেয়াল- খুশী মত যিকির করাতে থাকে, এটাও ঠিক নয়। (সূরা আ'রাফ-২০৫, মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৯৪৯৫)
প্রচলিত ওয়ায মাহফিলের বর্জনীয় বিষয়াদি
১. যেহেতু দীর্ঘ সময়ব্যাপীকৃত ওয়ায সাধারণ মানুষ মনে রাখতে পারে না, এজন্য রাত ১০/১১টার মধ্যেই মাহফিল শেষ করা উচিত। আজকাল অনেক জায়গায় সারা রাত ওয়ায করার নিয়ম চালু হয়ে গেছে, এটা বন্ধ করা উচিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ততক্ষণ ওয়ায করতে বলেছেন যতক্ষণ লোকদের আগ্রহ থাকে। আর সাধারণত মানুষের কমজোরীর কারণে সারা রাত আগ্রহ থাকে না। উপরন্তু দীর্ঘ রাতজাগা এ ওয়ায সকালে অধিকাংশ শ্রোতারই মনে থাকে না! (সহীহ বুখারী; হা.নং ৬৩৩৭)
২. দূর-দূরান্ত পর্যন্ত না দিয়ে মাহফিলের মাইক-ব্যবস্থা প্যান্ডেলের সীমার মধ্যে রাখা আবশ্যক। যেন আগ্রহীরা প্যান্ডেলে চলে আসে এবং ব্যস্ত, অসুস্থ ও ইবাদতে মগ্ন ব্যক্তিদের কাজে, বিশ্রামে ও ইবাদতে বিঘ্ন না ঘটে। হাদীস শরীফে কথা কিংবা কাজে ব্যস্ত লোকদেরকে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় দীনী নসীহত করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা এর দ্বারা সে বিরক্ত হবে এবং তার কাজে বিঘ্ন ঘটবে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৬৩৩৭)
৩. ওয়ায মাহফিলের ইশার জামা'আত স্থানীয় মসজিদসমূহের সময়সূচী অনুযায়ী আদায় করে নিতে হবে। আগে-পরে করা হলে মাইকের আওয়াযে আশপাশের মসজিদগুলোর জামা'আতের সমস্যা হয় এবং মাহফিলে উপস্থিত মুসল্লীগণ ইশার জামা'আতের ব্যাপারে পেরেশান হয়। অনেক স্থানে দীর্ঘ রাতব্যাপী ওয়ায হওয়ার পর ইশার নামায মাকরূহ ওয়াক্তে পড়া হয়, এটা অবশ্য-পরিত্যাজ্য। (সূরা নিসা-১০৩, সহীহ বুখারী; হা.নং ৬২৪৫)
৪. মানুষকে ওয়ায মাহফিলের দাওয়াত দিয়ে তাদের থেকে চাঁদা কালেকশন করবে না। কারণ প্রচারপত্রে ওয়ায শোনানোর ঘোষণা বা ওয়াদা করা হয়। চাঁদার প্রয়োজন হলে স্থানীয় জনসাধারণকে ডেকে পরামর্শসভা করবে এবং সাহায্যের আবেদন করবে। (সূরা বাকারা-৪০)
৫. ওয়াযের শেষে গণদাওয়াত ও শিরনী -তবারকের নামে কোন কিছু বিতরণের ব্যবস্থা করবে না। এতে শ্রোতাদের মনোযোগ ওয়াযের দিকে না থেকে খানার দিকে থাকে। সে ক্ষেত্রে বয়ানের দ্বারা তেমন কোন উপকার পরিলক্ষিত হয় না। (সহীহ বুখারী; হা.নং ২৬৯৭, সহীহ মুসলিম; হা.নং ১৭১৮, রদ্দুল মুহতার ২/১৪০)
৬. ওয়ায মাহফিল জমানোর জন্য কুরআন তিলাওয়াত করাবে না। কারণ মাহফিল জমানোর জন্য কুরআন নাযিল হয়নি। এর পরিবর্তে গানের সুরে নয় এমন হামদ-নাত ও ভালো অর্থবোধক গজল পরিবেশন করতে পারবে বা তালিবে ইলমদের দ্বারা তাদের শিক্ষা- দীক্ষার প্রদর্শনী করাতে পারবে।
হ্যাঁ, নিয়মতান্ত্রিক বয়ান ও ওয়ায শুরু হওয়ার পূর্বমুহূর্তে খায়ের ও বরকতের জন্য কুরআন তিলাওয়াতের দ্বারা শুরু করবে। এ সময় সকলেই কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি মনোযোগ দিবে ও তিলাওয়াতের আদবের দিকে লক্ষ্য রেখে শুনবে। (আলমগীরী ৫/৩১৫, রদ্দুল মুহতার ১/৫১৮)
৭. চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে মাহফিল করবে না। এতে পথচারীদের কষ্ট দেয়া হয়, যা শরীয়ত-বিরোধী কাজ। সুতরাং মসজিদ-মাদরাসা বা কোন মাঠে- ময়দানে মাহফিলের ব্যবস্থা করবে। (যিকর ও ফিকর: ১৪৩)
৮. মাহফিলের রাস্তায় কোন গেট বা তোরণ বানাবে না। রঙ-বেরঙের পতাকা লাগাবে না। নিছক বিলাসিতা ও শৌখিনতার জন্য রঙ-বেরঙের বাহারি বাতি জ্বালানো বা তোরণ নির্মাণ করার দ্বারা ধর্মীয় গাম্ভীর্য ও আধ্যাত্মিকতা নষ্ট হয়। এগুলোর আয়োজন অগ্নিপূজক ও মূর্তিপূজকদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। উপরন্তু তা অপচয়ের শামিল। আর বিজাতীয় অনুকরণ ও অপচয় সম্পূর্ণ হারাম! (সূরা বনী ইসরাঈল-২৭, সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ৪২৫, যিকর ও ফিকর: ২৫)
৯ . অনেক বক্তা নিজের চা পানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য শ্রোতাদেরকে যিকির-দুরূদে লাগিয়ে দেন এবং এই সুযোগে চা ইত্যাদি পান করেন। এটা দৃষ্টিকটু কাজ। দীনী উদ্দেশ্যবিহীন এভাবে দুরূদ পড়াও নিষেধ। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৬৩৩৭, ফাতহুল বারী ১১/১৬৭)
১০. মাহফিলের ছবি তুলবে না এবং ভিডিও করবে না। অন্য কাউকে করতেও দিবে না; বরং সকলকে নিষেধ করবে। এতে দীনী মাহফিলের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য বরবাদ হয়ে যায় এবং বদদীনী ও গোমরাহী কায়েম হয়। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫৯৫০, সহীহ মুসলিম হা.নং ২১০৯)
১১. মাহফিলের প্রচারপত্র যথা: পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদিতে দিন, তারিখ ও স্থান উল্লেখ করবে। বক্তাদের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। লোকদেরকে ব্যক্তির আকর্ষণে সমবেত করবে না; দীনের আকর্ষণে সমবেত করবে। ব্যক্তি তো চিরকাল থাকে না। এমনকি (আল্লাহ না করুন) অনেক বড় ব্যক্তিও হকের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তার অনুসারীরাও বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে! আল্লাহ হেফাযত করুন। আমীন! (আল-হিলয়া লি-আবি নুআইম ১/৩০৫-৩০৬)
১২. কোন বক্তার আগমনে নারায়ে তাকবীর বা অন্য কোন শ্লোগান দিবে না। এটা সুন্নতের খেলাফ। বিশেষ করে ওয়াযের মধ্যে কোন বক্তার আগমনে চলমান বক্তার বয়ান বন্ধ করে কোন বক্তার নামে শ্লোগান দিবে না। কুরআন- সুন্নাহর আলোচনার মর্যাদা অনেক উঁচু। কারো আগমনে তা বন্ধ করার অবকাশ নেই। কোন বক্তার ব্যাপারে 'প্রধান আকর্ষণ', 'জলসার মধ্যমণি' ইত্যাদি বলে অন্যান্য মেহমানদেরকে হেয় করবে না। কারণ সকলেই হক্বানী আলেম ও সম্মানিত। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৬৩৩৭, ফাতহুল বারী ১১/১৬৭)
১৩. যেসব রাস্তায় সিএনজি অটোরিকশার মতো যানবাহন চলে, এর আশপাশে কোন মাহফিল হলে দেখা যায়, মাহফিলের আয়োজকরা ওই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী প্রতিটি যানবাহনকে আটকে দেয় এবং মাহফিলের জন্যে টাকা আদায় করে। অনেক সময় টাকা না দেয়া পর্যন্ত গাড়িটিকে ছাড়া হয় না। অথচ কারও কাছ থেকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাপাচাপি করে টাকা আদায় করা এবং সেই টাকা ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারাম! (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ২০৬৯৫)
১৪. মাহফিলের মহিলা-প্যান্ডেলে প্রজেক্টর স্থাপন করে মহিলা শ্রোতাদের জন্য বক্তাকে সরাসরি দেখার ব্যবস্থা করা খুবই আপত্তিকর একটি ত্রুটি। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রা. বর্ণনা করেন-
একদা আমি ও মাইমুনা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছিলাম। তখন সেখানে অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. আগমন করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বললেন, 'তোমরা তার থেকে আড়ালে চলে যাও।' আমরা নিবেদন করলাম, ইনি তো অন্ধ। অর্থাৎ আমাদেরকে দেখবে না, চিনবে না তাহলে আমরা আড়ালে যাবো কেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'তোমরাও কি অন্ধ হয়ে গেলে নাকি! অর্থাৎ সে তোমাদেরকে দেখছে না ঠিক কিন্তু তোমরা তো তাকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছো।' (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ৪১১৪)
এ হাদীস প্রমাণ করছে, পুরুষদের জন্য যেমন বিনা প্রয়োজনে পরনারীকে দেখার অনুমতি নেই, তেমন নারীদের জন্যও পর-পুরুষকে দেখার অনুমতি নেই ।
ওয়ায মাহফিলে মহিলাদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গ
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দীনের জরুরী ইলম শিক্ষা করা মহিলাদের উপরও ফরয। তবে এর শরীয়সম্মত পদ্ধতি হলো- পুরুষ লোকেরা দীন শিখে এসে মাহরাম মহিলাদেরকে দীন শেখাবে। অতঃপর এই শিক্ষিত মাহরাম মহিলারা ঘরের অন্যান্য মহিলাদেরকে, অনুরূপভাবে আশপাশের মহিলাদেরকে সহীহ- শুদ্ধভাবে কুরআন মাজীদ শেখাবে, প্রয়োজনীয় মাসআলা মাসাইল শেখাবে, হক্কানী উলামায়ে কেরামের রচিত কিতাব থেকে ওয়ায-নসীহত পড়ে পড়ে শোনাবে। প্রয়োজনে মাঝে মাঝে মাহরাম পুরুষের তত্ত্বাবধানে হক্কানী আলেম ও বুযুর্গদেরকে ঘরোয়া পরিবেশে এনে পর্দা-পুশিদার সাথে নসীহতের ব্যবস্থা করবে।
একবার কতিপয় মহিলা সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার মজলিসে পুরুষদের সঙ্গে বসতে পারি না, আমাদের জন্য একটি দিন ধার্য করুন, যাতে সেই দিনে আমরা আপনার কাছ থেকে নসীহত শুনতে পারি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে موعدكن بيت فلانة নির্ধারিত দিন অমুক মহিলার ঘরে জমায়েত হও। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে গিয়ে তাদেরকে ওয়ায-নসীহত করলেন। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১০১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা.নং ২৯৪১)
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মহিলারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত শ্রেষ্ঠতম ইমামের পেছনে নামায আদায়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় মসজিদে নববীর জামাআতে অংশগ্রহণ করতো। তবে এর জন্য বেশ কিছু শর্ত ছিল।
যেমন: ১. পূর্ণ পর্দার সাথে আসতে হবে।
২. সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারবে না।
৩. সাজসজ্জা পরিত্যাগ করতে হবে।
৪. রাতে আসবে, দিনে আসবে না।
৫. মহিলারা সবার পরে আসবে এবং নামায শেষে পুরুষদের আগে বের হয়ে যাবে।
৬. কোনো অবস্থাতেই পুরুষদের সাথে মেলা-মেশার আশঙ্কা না থাকতে হবে। অতঃপর একসময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হায়াতেই মহিলাদেরকে মসজিদে নববীতে না এসে নিজের ঘরের অন্দরমহলে নামায পড়ার জন্য তাকীদ করতেন। যেমন, একদা হযরত উম্মে হুমাইদ রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে বললেন, আমি আপনার সঙ্গে নামায পড়তে ভালোবাসি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি জানি, তুমি আমার পেছনে নামায পড়তে ভালোবাসো। কিন্তু তোমার ঘরের একান্ত কামরায় আদায়কৃত নামায তোমার বাইরের হুজরায় নামায অপেক্ষা উত্তম। আর তোমার হুজরায় নামায তোমার বাড়ীতে নামায অপেক্ষা উত্তম। আর তোমার বাড়ীতে নামায তোমার মহল্লার মসজিদে নামায অপেক্ষা উত্তম। আর তোমার মহল্লার মসজিদে নামায আমার মসজিদে নামায অপেক্ষা উত্তম। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর উক্ত মহিলা নিজ ঘরের একান্ত কামরায় নামাযের স্থান নির্ধারণ করে নিলেন এবং আমরণ তাতেই নামায আদায় করলেন। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৭০৯০, সহীহ ইবনে খুযাইমা; হা.নং ১৬৮৯, সহীহ ইবনে হিব্বান; হা.নং ২২১৭)
অতঃপর নবীজীর ইন্তিকালের পর সামাজিক পরিবেশের সামান্য পরিবর্তনের কারণে অনেক সাহাবী মহিলাদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করে দেন এবং মহিলারাও মসজিদে আসা বন্ধ করে দেন। নবীজীর পুণ্যাত্মা স্ত্রীগণ এবং অন্যান্য মহিলা সাহাবীদের তাকওয়া-তাহারাত ও খোদাভীতি, যা কিনা প্রবাদতুল্য এবং পরবর্তী যুগের মহিলাদের জন্য আদর্শ- তাঁদের ব্যাপারে যদি মসজিদে গমন নিষেধ হয়, তাহলে এমন ফেতনা-ফাসাদের ব্যাপকতার যুগে প্রকাশ্যে দিবালোকে বেপর্দার সাথে দূর- দূরান্ত থেকে মহিলাদের ওয়ায-মাহফিলে যাতায়াত কীভাবে অনুমোদিত হতে পারে? আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সঠিকভাবে দীনী মাহফিল করার তাওফীক দান করুন এবং এর দ্বারা উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন!
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
মহিলাদের দীনী শিক্ষার গুরুত্ব ও পদ্ধতি
আল্লাহ তা'আলা মানুষকে ঈমান ও আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন। ঈমান ও আমল বিষয়ে জানতে হলে ইলমে দীন হাসিল করা...
নবীজীর ভালোবাসা ও সুন্নাতী যিন্দেগী
হযরত সালমান মনসুরপুরী রহ. বলেন, নবীজীর মুহাব্বত হৃদয়ের শক্তি, রূহের খোরাক, চোখের শীতলতা, দেহের সজীবত...
সীরাতুন্নবী-মীলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] দু'টি শব্দের সমন্বয়ে সীরাতুন্নবী শব্দটি গঠিত। একটি হল 'সীরাত' অপরটি 'আন...
আলোকময় কুরআন
আজ জুমু'আর দিন। এ দিনে সূরা কাহাফ তিলাওয়াতের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। এটা পনের পারায় শুরু হয়ে ষোল পারায় শে...