প্রবন্ধ
হালাল রিযিক : আল্লাহ প্রদত্ত বড় নিয়ামত
পৃথিবীতে আগমনের পর জীবনধারণের জন্য মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন রিযিক। রিযিক বলতে আমরা সাধারণত খাদ্য-পানীয় বুঝে থাকি। নিঃসন্দেহে এগুলোও রিযিক; তবে কুরআন-হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী রিযিকের মর্ম আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক। পৃথিবীতে সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের যত কিছুর প্রয়োজন হয়, কুরআন-হাদীসে তার সবগুলোকেই রিযিক অভিহিত করা হয়েছে। খাদ্য-পানীয়, বস্ত্র-বাসস্থান, স্বাস্থ্য-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা, স্ত্রী-সন্তান, সম্মান-সুখ্যাতি সবকিছুই রিযিক। রিযিক প্রদান আল্লাহর দায়িত্বে আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ তা'আলা আমাদের জীবনের সর্বাধিক কাঙিক্ষত বস্তু রিযিকের দায়িত্বভার নিজের উপর গ্রহণ করে নিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا অর্থ: পৃথিবীতে এমন কোনো প্রাণী নেই, যার রিযিকের দায়িত্বভার আল্লাহ নিজে গ্রহণ করেননি। (সূরা হুদ-৬)
আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক সৃষ্টিজীবকে রিযিক প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়টি হাদীসে পাকে এভাবে বর্ণিত হয়েছে- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (অর্থ:) সৃষ্টির সময় মাতৃগর্ভে তোমাদের অস্তিত্ব চল্লিশ দিন পর্যন্ত শুক্রকীট আকারে পড়ে থাকে। তারপর চল্লিশ দিনে তা জমাট রক্তে পরিণত হয়। তারপর চল্লিশ দিনে তা একটি গোশতপিণ্ডে পরিণত হয়। এরপর ঐ গোশতপিণ্ডের কাছে একজন ফেরেশতা প্রেরণ করা হয়। প্রেরিত ফেরেশতাকে ঐ গোশতপিণ্ড সম্পর্কে চারটি বিষয় লিখে দেয়ার আদেশ করা হয়- রিযিক, মৃত্যু, আমল, ভাল-মন্দ ভাগ্য। এটা করার পর তার মাঝে রূহ প্রদান করা হয়। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৩২০৮)
রিযিক সুনির্ধারিত ও লিপিবদ্ধ
রোগ-শোকে, অভাব-অনটনে ও হতাশা-ব্যর্থতায় আমরা যে 'হায় কপাল!' বলে আহাজারি করি, হাদীসে বর্ণিত 'ভাল-মন্দ ভাগ্য' দ্বারা সেই 'হায় কপাল!' বোঝানো হয়েছে। সারাটি জীবনব্যাপী আমরা যে রিযিকের জন্যে নিরন্তর দৌড়ে চলছি, এ-ও ঐ ভাগ্যেরই লিখন। কিন্তু সে কথা আমরা খুব কমই স্মরণ রাখি। আর স্মরণ রাখি না বলেই নানারকম পেরেশানী ও হতাশায় জর্জরিত হতে থাকি। আমরা যদি সৃষ্টিলগ্নেই আল্লাহ কর্তৃক আমাদের রিযিক নির্ধারণের কথাটুকু মনে রাখতে পারি, তাহলে রিযিক অন্বেষণের ব্যর্থতাগুলো আমাদের হতাশার কারণ হবে না। আমরা বুঝতে পারব, কেবল চেষ্টাটুকুই আমার করার ছিলো, কাঙ্ক্ষিত বস্তু অর্জন করে ফেলা নয়। সুতরাং যা পাইনি তা ভাগ্যে নেই বলেই পাইনি, আর যা পেয়েছি তা ভাগ্যে ছিল বলেই পেয়েছি। এ ব্যাপারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নলিখিত হাদীসটিও আমাদের জন্য বড় সান্ত্বনার উপকরণ- إِنَّ نَفْسًا لَنْ تَمُوتَ حَتَّى تَسْتَوْفِي رِزْقَهَا وَإِنْ أَبْطَأَ عَنْهَا মনে রেখো, কোনো প্রাণীই তার ভাগ্যে লেখা রিযিক পরিপূর্ণভাবে বুঝে পাওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করবে না; যদিও তা পেতে বিলম্ব হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ২১৪৪)
কাজেই একজন মুমিন রিযিক অর্জনের নিয়মতান্ত্রিক মেহনত জারী রাখার পাশাপাশি এই বিশ্বাসও অন্তরে বদ্ধমূল রাখবে যে, তার ভাগ্যে যতটুকু লেখা আছে, তার চেয়ে সামান্যও বেশি সে পাবে না, পেতে পারে না।
উপার্জন-প্রচেষ্টা ও তাওয়াক্কুল দুটোই জরুরী
নিয়মতান্ত্রিক মেহনত জারী রাখার কথাটি বলার কারণ হলো, দুনিয়া দারুল আসবাব অর্থাৎ উপায়- উপকরণের জগৎ। এখানে সবরকম কাজই কোনো না কোনো বাহ্যিক উপকরণের সঙ্গে জড়িত। এটাই সুন্নাতুল্লাহ তথা আল্লাহর সাধারণ নিয়ম। তাই রিযিকের ব্যাপারে তাকদীরের বিশ্বাসের পাশাপাশি আমাদেরকে নিয়মতান্ত্রিক চেষ্টাও করে যেতে হবে। এটা শরীয়তেরই নির্দেশ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিযিক উপার্জনকে মর্যাদাপূর্ণ 'ফরয' শব্দে ব্যক্ত করেছেন- طلب كسب الحلال فريضة بعد الفريضة (নামায-রোযা জাতীয়) উচ্চস্তরের ফরয (পালন)-এর পর হালাল উপার্জনও ফরয। (সুনানে কুবরা লিল-বাইহাকী; হা.নং ১১৬৯৫)
কাজেই শরীয়তের অন্যতম নির্দেশ তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহ-ভরসার পাশাপাশি উপার্জনের ফরয দায়িত্বটিও সমানভাবে স্মরণ রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, অন্যান্য ফরয দায়িত্বে অবহেলা যেমন শরীয়তে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তেমনি উপার্জনের ফরয দায়িত্বে অবহেলা করাও শরীয়তে কাম্য নয়।
বিষয়টি কুরআনে কারীমের নিম্নলিখিত আয়াতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে-
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ অর্থ: অতঃপর যখন (জুমু'আর) নামায শেষ হয়ে যাবে, তখন তোমরা ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়বে আর আল্লাহর অনুগ্রহ (রিযিক) অন্বেষণ করবে। (সূরা জুমু'আ- ১০)
ঠিক একই কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় যে দু'আ শিক্ষা দিয়েছেন, তাতেও রিযিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে- اللهم إني أسألك من فضلك অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার বিশেষ অনুগ্রহ (রিযিক) কামনা করছি। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৭১৩)
অনেকে না বুঝে তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহ-ভরসা এবং রিযিক অন্বেষণের চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে বিপরীতধর্মী মনে করে। তাদের কাছে রিযিকের জন্য দৌড়ঝাঁপ করা তাওয়াক্কুল-বিরোধী মনে হয়। এটা এক ধরনের অজ্ঞতা। মূলত এ দু'টোতে কোন বৈপরিত্ব নেই; একই ক্ষেত্রে এবং একই সময়ে উভয়টির সমাবেশ ঘটতে পারে; বরং সমাবে ঘটাতে হবে। হাদীসে বর্ণিত আছে-
একবার জনৈক সাহাবী নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে উট থেকে নামলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি উটটি কোথাও বেঁধে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করব, নাকি না বেঁধেই তাওয়াক্কুল করব? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আগে তুমি উটটি বাঁধো, তারপর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করো। (জামে তিরমিযী; হা.নং ২৫১৭)
এসব আয়াত ও হাদীস আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, ইসলাম মানুষকে অবাস্তব বিশ্বাস ও কর্মের পেছনে ছুটতে বলে না। আমরা বাস্তবতায় বাস করেই পরম সত্য ভালো-মন্দ তাকদীরে বিশ্বাস করব। অর্থাৎ তাওয়াক্কুল আমাদের বিশ্বাসের জায়গা, আর রিযিকের জন্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা আমাদের দায়িত্ব। দু'টোই আল্লাহ নির্দেশিত বিধান। একজন খাঁটি মুমিন দুটোকেই পরম যত্নে একসঙ্গে ধারণ করে।
স্বহস্তে উপার্জনের গুরুত্ব
কুরআন-হাদীসে উপার্জনের গুরুত্বের পাশাপাশি নিজ হাতে উপার্জনের প্রতিও বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং বিভিন্ন ফযীলত বর্ণনা করে এ ব্যপারে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِنْ رِزْقِهِ অর্থ: তিনিই তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন; অতএব তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ করো এবং তাঁর দেয়া রিযিক থেকে আহার গ্রহণ করো। (সূরা মুলক- ১৫)
হাদীসে পাকে আরো চমৎকারভাবে স্বহস্তে উপার্জিত রিযিকের ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (অর্থ:) মানুষের জন্য স্বহস্তে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম স্বহস্তে উপার্জিত খাদ্য গ্রহণ করতেন। (সহীহ বুখারী; হা.নং ২০৭২)
আমরা যদি নবী-রাসূলগণের জীবন- চরিত অধ্যয়ন করি, তাহলে দেখতে পাবো, আল্লাহ তা'আলা দুনিয়াতে যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন, তাঁদের সকলকে দিয়েই উপার্জনের কাজ করিয়েছেন এবং তাঁরও নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী হালাল উপার্জনের চেষ্টা করেছেন। নবীদের স্বহস্তে হালাল উপার্জনের কিছু নমুনা লক্ষ্য করুন- হযরত শুআইব আলাইহিস সালাম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মানুষের কাজ করে দিয়েছেন। হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম লোহার আসবাবপত্র নিজ হাতে তৈরি করে বিক্রি করতেন। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম বহু বছর বকরি চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। স্বয়ং আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মক্কার পাহাড়ে পাহাড়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বকরি চরিয়েছেন, হযরত খাদিজা রাযি.-এর ব্যবসার মহাব্যবস্থাপক হয়ে সুদূর সিরিয়ায় সফর করেছেন।
অপরদিকে বেকারত্ব ও পরনির্ভরতা ইসলামের মেজায-পরিপন্থী। আদতে ইসলামের কোথাও এর সুযোগ রাখা হয়নি। নবী-রাসূলগণের এ স্বভাব-রুচি সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনসহ আমাদের পূর্বসূরীদের সকলেই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অনুসরণ করতেন।
উপার্জন হতে হবে হালাল
ইসলামের অনুপম সৌন্দর্য হলো, ইসলাম তার বিধি-বিধানের মাধমে বান্দাকে আল্লাহর সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। এজন্য ইসলাম জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই মানুষকে পূর্ণ স্বাধীন করে দেয়নি; বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম- নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে, যেন সে কোন ক্ষেত্রেই উক্ত নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন না করে। আর এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই ইসলাম আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্কটি সচল ও সজীব রাখে।
জীবিকা উপার্জন মানব জীবনের এমন একটি প্রয়োজন, যা প্রত্যেককে আপন আপন স্বার্থের হিসেব কষতে শেখায়। এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর সকল দেশের সকল মানুষের মেরুদণ্ড সোজা রাখার অন্যতম উপায় অর্থনীতির কথাও চলে আসে। সুতরাং উপার্জন ও অর্থনীতির এই জায়গাটিতে ব্যক্তিগত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের হস্তক্ষেপের সীমারেখা ও সুন্দরতম কোন নিয়ম-পদ্ধতি নির্ধারণ করা না হলে কোনো ব্যক্তি ও জাতিই আয়-উপার্জনের কোনো একটি পরিমাণে পরিতুষ্ট থাকবে না। আরো চাই আরো চাই-ই হয়ে উঠবে সবার জীবনের একমাত্র সাধনা। ফলে নীতিহীন মানুষের অবাধ লালসা নির্দয়ভাবে কেড়ে নেবে হাজারো মানুষের রুটি-রুজি। গুটিকয়েক মানুষের কাছে পুঞ্জীভূত হবে লক্ষ- কোটি মানুষের সম্মিলিত সম্পদ। এজন্য কুরআন-হাদীস একদিকে যেমন উপার্জনের প্রতি আমাদেরকে বিপুলভাবে উৎসাহ দিয়েছে, অপরদিকে আমাদেরকে বেঁধে দিয়েছে কিছু সুসংহত নীতিমালায়। যেন এই নিয়ম- নীতির আওতায় থেকেই আমরা খুঁজে নিতে পারি আমাদের বেঁচে থাকার উপায় উপকরণ এবং মানবসমাজে বজায় থাকে অর্থনৈতিক ভারসাম্য। ইসলামে উপার্জনের এই বিধিবদ্ধ পথটিকেই বলা হয়েছে হালাল আর বিধিবহির্ভূত পথটিকে বলা হয়েছে হারাম।
উপার্জনের ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হালাল-হারামের মূলনীতি এই-
এক. উপার্জিত বস্তুটি হালাল হওয়া।
আল্লাহ তা'আলা কুরআনে কারীমের সূরা বাকারায় মদ-জুয়ার বিধান আলোচনা প্রসঙ্গে কোন্ জিনিসটি হালাল তার একটি মূলনীতি বাতলে দিয়েছেন- يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا অর্থ: হে নবী! লোকে আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন, এ দুটোতে রয়েছে বিরাট পাপ ও অকল্যাণ, আবার মানুষের জন্যে উপকারও। তবে এ সবের পাপের ভয়াবহতা কল্যাণের চেয়ে অনেক বেশি। (সূরা বাকারা- ২১৮)
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি- কোনো বস্তুর হালাল-হারাম নির্ণয়ে কল্যাণ-অকল্যাণের পরিমাণ ও মাত্রা অত্যন্ত সহজ একটি মাপকাঠি। যেখানে কল্যাণের বিপুল উপস্থিতি থাকবে, স্বাভাবিকতই সেটা হালাল হবে। আর যেখানে অকল্যাণের তুলনায় কল্যাণের উপস্থিতি থাকবে নামমাত্র, স্বাভাবিকতই সেটা হালাল হবে না। হালাল ও হারাম বস্তু নির্ণয়ে এটি একটি মৌলিক বিধান। এর মাধ্যমে ইসলামের হালাল-হারাম নীতির স্বভাব ও রুচি আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু ইসলাম আমাদেরকে এই মূলনীতি বলেই ছেড়ে দেয়নি; বরং মোটাদাগের হালাল- হারাম বস্তুসমূহকে বাছাইও করে দিয়েছে। উদাহরণত আল্লাহ তা'আলা বলেন-
قُلْ لا أجِدُ في ما أُوحِيَ إلَيَّ مُحَرَّمًا عَلى طاعِمٍ يَطْعَمُهُ إلّا أنْ يَكُونَ مَيْتَةً أوْ دَمًا مَسْفُوحًا أوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإنَّهُ رِجْسٌ أوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ
অর্থ: বলো, আমার কাছে যে ওহী অবতীর্ণ হয়েছে তাতে মৃতজন্তু, বহমান রক্ত কিংবা শূকরের মাংস ছাড়া লোকে যা আহার করে তার মধ্যে কোনো হারাম জিনিসই আমি পাই না। কারণ, এগুলো অবশ্যই অপবিত্র অথবা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গের ফলে অবৈধ। (সূরা আনআম- ১৪৫)
كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ
অর্থ: আমি তোমাদেরকে জীবনোপকরণ হিসেবে যা দিয়েছি, তা থেকে উত্তম ও হালালগুলো খাও। (সূরা ত্ব-হা- ৮৮)
ويُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ
অর্থ: আর তিনি (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের জন্যে উত্তম বস্তুসমূহকে হালাল করেছেন আর অপবিত্র বস্তুসমূহকে হারাম করেছেন। (সূরা আরাফ- ১৫৭)
وَكُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ حَلَالًا طَيِّبًا
অর্থ: আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে রিযিক হিসেবে যা দিয়েছেন, তা থেকে উত্তমগুলো আহার করো। (সূরা মায়িদা- ৮৮)
দুই. উপার্জনের পন্থাটিও হালাল হওয়া। অনেক ভালো জিনিসও আহরণপদ্ধতির ত্রুটির কারণে ভয়ানক মন্দ জিনিসে পরিণত হয়। রিযিক বিষয়ক হালাল- হারামের ক্ষেত্রে এটি আরো বাস্তব। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে হারাম বস্তুসমূহ যথা: মদ, শূকরের গোস্ত, পেশাব-পায়খানা ইত্যাদির ব্যাপারে তো খুব সতর্ক থাকি। কিন্তু হালাল বস্তু হালাল উপায়ে সংগহ করছি কিনা সে ব্যাপারে থাকি চরম উদাসীন। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে দুটো বিষয়ই সমান গুরুত্বের দাবি রাখে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারাটি জীবন উম্মতকে হালাল জিনিস হালাল উপায়ে অর্জন ও আহরণ করার শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ উপার্জনের প্রক্রিয়াটি শুধু আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত তা-ই নয়, বান্দার হকও এতে জড়িয়ে থাকে নিবিড়ভাবে। এ জন্য কোনো বস্তু হালাল হওয়া সত্ত্বেও তা আহরণ ও উপার্জন করতে গিয়ে যেন শরীয়তনির্দেশিত উপার্জনপন্থা লঙ্ঘিত না হয়, অন্যের অধিকার নষ্ট না হয়, এদিকেও গুরুত্বের সঙ্গে নজর দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, একজনের উপার্জন যেন অন্যের দুঃখ-দুর্দশা ও দুর্ভোগের কারণ না হয়। শোষণ, নির্যাতন, লুটপাট, ধোঁকাবাজি, জালিয়াতি, মজুদতারি, কালোবাজারি, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের দ্বারা আমাদের উপার্জন যেন কলুষিত না হয়- ইসলাম এ ব্যাপারে আমাদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
يا أيها الذين آمنوا لا تأكلوا أموالكم بينكم بالباطل إلا أن تكون تجارة عن تراض منكم
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রাস করো না। হ্যাঁ, পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে ব্যবসা করলে তা তোমাদের জন্য বৈধ। (সূরা নিসা- ২৯)
وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
অর্থ: তোমরা একে অন্যের সম্পদ অবৈধভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পদের কিয়দাংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকগণের নিকট পেশ করো না। (সূরা বাকারা- ১৮৮)
সুতরাং উপার্জনের ক্ষেত্রে আমাদেরকে একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, আমাদের সম্পদে যেন কোনো ধরনের হারামের অনুপ্রবেশ না ঘটে। হারাম উপার্জনের প্রতি আমি কেনইবা লালায়িত হবো, অথচ আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন রিযিক আল্লাহর পক্ষ থেকে বণ্টন করেই দেয়া আছে এবং আমার ভাগের অংশ অবশ্যই আমি পাবো। হাদীসে পাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- (অর্থ:) তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং রিযিক অন্বেষণের পন্থা বৈধ ও সুন্দর করো। সেইসঙ্গে আল্লাহর উপর ভরসাও রাখো। মনে রেখো-কোনো প্রাণীই তার ভাগ্যে লেখা রিযিক না পেয়ে মৃত্যুবরণ করবে না; যদিও তা আসতে বিলম্ব হয়। কাজেই তোমরা আল্লাহর ভয় অন্তরে ধারণ করে উপার্জনের পদ্ধতি সুন্দর করো। যা হালাল তা-ই গ্রহণ করো আর যা হারাম তা পরিহার করে চলো। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ২১৪৪)
হারাম রিযিকের অশুভ পরিণতি
আমরা আল্লাহ তা'আলার যত রকম ইবাদত-বন্দেগী করি, সবগুলোই একটা কেন্দ্রবিন্দুতে একীভূত হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় সেই বিন্দুটি হচ্ছে দু'আ। মূলত কোনো ইবাদতই দু'আবিহিন আদায় হয় না। এ কারণেই হাদীসে পাকে দু'আকে সকল ইবাদতের মগজ বা সারবত্তা অভিহিত করা হয়েছে।
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, বান্দার হারাম রিযিকের পরিণতি হলো, তার সকল ইবাদতের সারবত্তা-দু'আ কবুল করা হবে না। একজন মুমিনের জীবনে এর চেয়ে বড় দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে যে, তার মালিক তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না! আমাদের চিন্তা করা উচিত, দুনিয়াবী ক্ষণস্থায়ী সুখ- শান্তির জন্য আমি তো এমন কোনো কাজ করে বসছি না, যার কারণে আমার সারা জীবনের আল্লাহপ্রাপ্তির সাধনা ধুলোয় মিশে যাচ্ছে? হাদীস শরীফে বড় হৃদয়গ্রাহী পন্থায় হালাল রিযিকের গুরুত্ব ও হারাম রিযিকের অপকারিতা তুলে ধরা হয়েছে। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (অর্থ:) নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা রাসূলগণকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, মুমিনদেরকেও সে নির্দেশই দিয়েছেন। তিনি রাসূলগণকে বলেছিলেন, হে রাসূলগণ! আপনারা পবিত্র খাবার গ্রহণ করুন, তারপর নেককাজ করুন। আর মুমিনদেরকে বলেছেন, হে ঈমানদার বান্দাগণ! আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে পবিত্রগুলোই তোমরা গ্রহণ কর। অতঃপর নবীজী একব্যক্তির দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, যে কিনা দূর-দূরান্ত সফর করে বেড়াচ্ছে, চুলগুলো এলোমেলো, শরীর ধুলোমলিন, আসমানের দিকে হাত তুলে বলে ইয়া রব্ব! ইয়া রব্ব!! কিন্তু কেমন করে তার দু'আ কবুল হবে, যখন তার খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র স-ব হারাম? (সহীহ মুসলিম; হা.নং ১০১৫)
আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী রহ. জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম গ্রন্থে এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, হাদীসে উল্লিখিত এই ব্যক্তির মধ্যে দু'আ কবুলের চারটি কারণ বিদ্যমান ছিল, তবুও তার দু'আ কবুল করা হয়নি।
প্রথম কারণ হলো- সে মুসাফির। বিভিন্ন হাদীসে মুসাফিরের দু'আ কবুলের ওয়াদা বর্ণিত হয়েছে। কারণ এ সময় আল্লাহর উপরই বান্দা সবচেয়ে বেশি ভরসা করে থাকে। তার অন্তর বিগলিত থাকে। অর্থাৎ খোদ সফরই দু'আ কবুলের অনেক বড় কারণ।
দ্বিতীয় কারণ হলো- তার জীর্ণশীর্ণ পোশাক আর ধুলোমলিন শরীর। হাদীসে আছে- জীর্ণপোশাক, শীর্ণদেহ আর এলোচুলো অনেক মানুষ আছে, যাদেরকে কেউ মূল্যায়ন করে না। সব দরজা থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তাদের ভেতরের শক্তি এতোটা মজবুত যে, তারা যদি আল্লাহর উপর ভরসা করে কোনো বিষয়ে কসম করে বসে, আল্লাহ অবশ্যই তাদের কসমের মর্যাদা রক্ষা করেন। সম্ভবত এ কারণেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইস্তেসকার নামাযে বের হতেন, তখন খুবই সাদামাটা পোশাকে বিনয়ের সাথে বের হতেন, যেন আল্লাহ তাঁর দু'আ কবুল করেন।
তৃতীয় কারণ হলো- আসমানের দিকে হাত উঁচিয়ে দু'আ করা। হাদীসে আছে, আল্লাহ বড় লজ্জাশীল, দয়াময়। যখন তাঁর দিকে কেউ দুই হাত প্রসারিত করে চাইতে থাকে, তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।
চতুর্থ কারণ হলো- রব্ব (মালিক) শব্দে আল্লাহকে ডাকা। হাদীসে আছে, কোনো বান্দা যখন তার দু'আয় চারবার ইয়া রব্ব! ইয়া রব্ব! বলে ডাকে, আল্লাহ তা'আলা তাকে বলেন, আমি প্রস্তুত, তুমি আমার কাছে যা চাও আমি তাই দেব। সম্ভবত এ কারণেই আল্লাহ তা'আলা যখন আমাদেরকে কুরআন শরীফে তাঁর কাছে দু'আ করার শব্দাবলী শিক্ষা দিয়েছেন, তখন প্রায় অধিকাংশ দু'আই 'রাব্বানা' দিয়ে শুরু করেছেন। এখানে চিন্তা করার বিষয় হলো- একজন ব্যক্তি দু'আ কবুলের চার- চারটি শর্তসহ আল্লাহর কাছে দু'আ করছে, কিন্তু আল্লাহ তার ডাক শুনছেন না! নবীজী আমাদেরকে এর কারণটিও বলে দিয়েছেন যে, দু'আ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণ তার হারাম উপার্জন ও হারাম গ্রহণ।
সুতরাং একজন মুমিন হিসেবে আমাদের ভেবে দেখা উচিত, জীবনে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাতের পাবন্দি তো করছি, কিন্তু শরীয়তের দৃষ্টিকোন থেকে আমার রিযিক হালাল আছে কিনা তার কি কখনো খোঁজ করেছি? কেয়ামতের কঠিনতম দিনে আমাদেরকে যে পাঁচ প্রশ্নের জবাবদিহি করতে হবে, তার একটি থাকবে- রিযিক কোত্থেকে কীভাবে উপার্জন করেছি। অর্থাৎ হালাল বস্তু হালাল পদ্ধতিতে, নাকি হারাম বস্তু হারাম উপায়ে? আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সতর্ক হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
ইয়াহুদী-খ্রিস্টানদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র মুসলিম উম্মাহর করণীয়
কুরআন-হাদীসে ইয়াহুদী-খ্রিস্টানের পরিচয় ইয়াহুদী জাতি পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতি। আল্লাহ তা'আলা হযরত নূহ আ...
শরয়ী বিধানে প্রাণীর ছবি (পর্ব দুই)
ইমাম নববী রহ.বলেন, قال الزهري: النهي في الصورة على العموم وكذلك استعمال ما هي فيه ইমাম যুহরী রহ. বলে...
পর্দা নারীর আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক
দু'টি চিত্র লক্ষ্য করুন। প্রথমটি ইসলামের স্বর্ণযুগের। আর দ্বিতীয়টি তথাকথিত প্রগতি-যুগের। চিত্র-১ খলী...
ইলমে দীন ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় ভাবনা
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعم...