প্রবন্ধ
'সঙ্গ গুণে রঙ্গ ধরে'
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত]
হামদ ও সালাতের পর...
বুযুর্গানে মুহতারাম, আমরা সবাই দীন অর্জন করতে আগ্রহী। দীন অর্জন করার জন্য এবং দীনের উপর টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে জরুরী জিনিস হল সোহবত। সোহবত মানে সাহচর্য, সংস্পর্শ। সাহাবায়ে কেরাম রাযি. বহু উত্তম গুণের ধারক ছিলেন। কিন্তু এতো এতো গুণাবলীর কোনটি দ্বারাই তাদের নামকরণ করা হয়নি। বরং তারা যে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সোহবতে থাকতেন, তার সান্নিধ্যে সময় কাটাতেন এটাকে কেন্দ্র করেই তাদের নাম হয়েছে সাহাবী। সাহাবী শব্দটি একবচন। বহুবচনে, সাহাবা। সাহচর্য স্বাভাবিক হলে বলা হয় 'সাহিব'। কিন্তু তারা রাসূলের এত বেশি সাহচর্য লাভ করেছিলেন যে, তাদেরকে সাহিব বললে বেমানান হয়। এজন্য তাদেরকে বলা হয় সাহাবী। আরবী ব্যাকরণের নিয়ম হল, অক্ষর বেশি হলে অর্থও বেশি হয়। (আরবী লেখন পদ্ধতিতে) 'সাহিব' এর তুলনায় 'সাহাবী' শব্দে অক্ষর বেশী। সুতরাং সাহাবী শব্দে সোহবতের প্রাবল্য আছে। সাহাবায়ে কেরামের এতো এতো গুণাবলী থাকার পরও এ নামে তাদের নাম রাখা হয়েছে এ কথা বোঝানোর জন্য যে, কিয়ামত পর্যন্ত দীন অর্জন করার ও দীনের উপর টিকে থাকার নিখাঁদ ও নির্ভেজাল পন্থা হল সোহবত। ইলম অনেকভাবে অর্জন করা যায়; কিতাব পড়ে, মাদারাসায় পড়ে, তাবলীগে গিয়ে, খানকায় গিয়ে। কিন্তু সেই ইলমকে আমলে আনার জন্য সোহবত দরকার। শুধু জানলে আমল করা যায় না। আমল করার জন্য রূহানী শক্তির প্রয়োজন হয়। মানুষ যখন কোন খাঁটি আল্লাহওয়ালাকে মহব্বত করে,তার মজলিসে বসে তখন এই বসার কারণে আল্লাহ তা'আলা তাকে ইলমও দান করেন, আমল করার জন্য রূহানী শক্তিও দান করেন। পক্ষান্তরে সোহবত ছাড়া অন্য কোন পন্থায় ইলম হয়তো আসে; কিন্তু সে ইলমের ওপর আমল করা বেজায় কঠিন। মোটকথা সোহবত দ্বারা ইলমও আসে, আমলও সহজ হয়ে যায়। সব যুগেই এর ধারা চালু ছিল। আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে যাওয়ার ভিত্তি স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সাহাবায়ে কেরাম সব সময় তাঁর সোহবতে পড়ে থাকতেন। সময় পেলেই তাঁরা নবীজীর সান্নিধ্যে চলে আসতেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর সাহাবায়ে কেরাম যেখানেই ছিলেন এ মজলিস কায়েম করতেন। হযরত মু'আয ইবনে জাবাল রাযি. লোকদেরকে ডাকতেন اجلس بنا نؤمن ساعة আমাদের সাথে বসো। আমরা ঈমানী আলোচনা করি। ঈমানকে মযবুত করি। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হা.নং ৩৪৬৯৮)
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই মজলিসের ধারা বিশেষভাবে জারি রেখেছিলেন হযরত আলী রাযি.। তার থেকে হযরত হাসান বসরী রহ.। এভাবে চলতে চলতে যুগে যুগে মাশাইখগণ সোহবতের এ মুবারক ধারা চালু রেখেছেন।
হযরত মাওলানা ইলয়াস রহ. এর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা যে দাওয়াতের কাজ চালু করেছেন, এখানেও কিন্তু গভীরে গেলে ঐ সোহবত জিনিসটা আছে। যে পরিবেশে দীন নষ্ট হচ্ছে ঐ পরিবেশ থেকে বের করে লোকজনকে ভালো পরিবেশে নেয়া হচ্ছে। সবাই এখানে আল্লাহর জন্য আসছে। এখানেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভালো লোক আছে। আল্লাহওয়ালা লোক আছে। তো দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের এই যে বরকত ও সাফল্য- অন্তর্নিহিতভাবে এখানেও কিন্তু ক্রিয়াশীল ঐ ভালো লোকগুলোর অর্থাৎ আল্লাহওয়ালাদের সোহবত। একজন মানুষ যখন চার চারটি মাস ভালো মানুষের সোহবতে থাকে বা এক চিল্লা-চল্লিশ দিন সোহবতে কাটায়, আল্লাহ তা'আলা তার ঈমান ও আমলের মধ্যে অভূতপূর্ব এক পরিবর্তন সৃষ্টি করে দেন।
আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক জিনিসের জন্য নিয়ম ও মাধ্যম রেখেছেন। মানুষের যিন্দেগীতে দীন আসার মাধ্যম হল সোহবত গ্রহণ। এজন্য আমরা এটাকে অপরিহার্য করে নিই। প্রতি মাসে একবার, অন্তত তিন মাসে একবার হলেও কোন আল্লাহওয়ালার সোহবতকে গনীমত মনে করতে হবে। ইবলিস আমাদেরকে ধোঁকা দিবে, বাধা দিবে; সোহবতে যেতে দিবে না। যখনই মানুষ সোহবত গ্রহণে আগ্রহী হয়, শয়তান তার সামনে নানা অজুহাত পেশ করে। বিভিন্ন প্রয়োজন ও ঝামেলা তুলে ধরে যে, সোহবতে গেলে এগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। অথবা যার সোহবতে যাওয়ার ইচ্ছা করে ইবলিস তার কিছু ত্রুটি দেখায় আর বলে, এর কাছে গিয়ে আর কী শিখবে, এরই তো এই ভুল সেই ভুল?! শয়তান এগুলো বলে মানুষকে নেককারদের সোহবত থেকে বঞ্চিত করার জন্য। এগুলো শয়তানের হাতিয়ার। এজন্য কারও সোহবতে যেতে হলে যারা হাজার রকম গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য তালাশ করে তারা মাহরুম হয়। তবে যেটুকু দেখার- তা হল, কোন আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ তাকে ইজাযত দিয়েছেন কিনা? মানুষ তো আর নবী কিংবা ফেরেশতা নয়। মানুষের ভুল-ভ্রান্তি থাকেই। আল্লাহ সেটা বুঝবেন। সেটা বোঝার দায়-দায়িত্ব আমাদের নয়। তবে সম্ভব হলে অবশ্যই খায়েরখাহী ও কল্যাণকামিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বড়কে তার ভুল থেকে বের করে নিয়ে আসার ফিকির করতে হবে। হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলতেন, যারা আমার মু'তাকিদ (ভক্ত), আমি তাদেরকে ভয় পাই। তাদের ব্যাপারে শঙ্কিত থাকি। আর যারা আমার মুহিব্বীন, আমাকে ভালবাসে আমি তাদের কদর করি, মূল্যায়ন করি। কারণ, ভক্তরা আসে আমাকে বুযুর্গ মনে করে। তাদের বিশ্বাস মতে আমি সম্পূর্ণ নির্ভুল, নির্দোষ ফেরেশতা গোছের কিছু একটা। কিন্তু কাছে আসার পর যখন আমার কোন মানবীয় ভুল তাদের চোখে পড়ে, পিঠ ফিরিয়ে চলে যায়। বুক চাপড়ে বলতে থাকে, আহা! যা মনে করে এসেছিলাম তা তো পেলাম না। পক্ষান্তরে যারা মুহিব্বীন তারা কখনও এমন আচরণ করেন না। তারা কোন ভুল দেখলে যেভাবেই হোক মুরুব্বীকে তা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। এটা তাদের মহব্বতের আলামত। তারা আমাকে ভুল থেকে বের করে আনবেন ঠিক; কিন্তু ছেড়ে চলে যাবেন না।
আবূ আব্দুল্লাহ আন্দালুসী রহ.। অনেক বড় আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ। একবার তার জীবনে বড় এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। তিনি ছিলেন যামানার সবচেয়ে বড় পীর। বাগদাদে তার শানদার খানকা। জুনায়েদ বাগদাদীর শাইখ ও পীর। কিন্তু তিনি এক খ্রিস্টান মেয়ের প্রতি আশেক হয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। মেয়ের বাবা শর্ত দিল, বিয়ে দিতে পারি তবে আমার শুকরগুলো চরাতে হবে এবং খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে হবে। তিনি রাজী হয়ে গেলেন। এদিকে তিনি কুরআনের হাফেয ছিলেন। সব আয়াত ভুলে গেলেন। শুধুমাত্র একটি আয়াত মনে ছিল وَمَنْ يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُكْرِم (আল্লাহ যদি কাউকে অপদস্থ করেন তাকে ইজ্জত দানকারী আর কেউ নেই)। (সূরা হজ্জ- ১৮)
হাজার হাজার হাদীস জানতেন; সব ভুলে গেলেন। মনে রইল শুধুমাত্র একটি من بدل دينه فاقتلوه - (যে মুরতাদ হয়ে গেছে, ধর্মত্যাগ করেছে তাকে কতল করে দাও)। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৩০১৭)
তখন জুনাইদ বাগদাদী রহ. সহ আরো যারা তার মুরীদ ছিলেন তারা কি তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন? না তারা চলে যাননি। শাইখের পিছনে লেগে ছিলেন।
তারা তাকে বুঝাচ্ছিলেন আর আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করছিলেন। মুরীদদের কান্নাকাটির জবাবে তিনি শুধু বলছিলেন, বাবা! আমার ভেতর থেকে কী যেন একটা উড়ে গেছে। আসল ঘটনা হল, কিছু লোককে মূর্তির সামনে সিজদায় পড়ে থাকতে দেখে তার দিলের মধ্যে এই ভাবনা এসেছিল যে, এদের মত নির্বোধ আর আল্লাহর যমীনে নেই! নিজেই খোদা বানাল, আবার নিজেই তার সিজদা করল! হায় রে আহাম্মকি! এভাবে অন্যকে মনে মনে হেয় করার কারণে, তুচ্ছজ্ঞান করার কারণে তার সীনা থেকে ঈমান বের হয়ে গিয়েছিল। এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ হতে এক অগ্নিপরীক্ষা। আল্লাহ তাকে দেখাতে চাইলেন, ঈমান কারও বাহুবলে অর্জিত জিনিস নয়; এটা আল্লাহ তা'আলার অপার অনুগ্রহ ও দয়া। তিনি যাকে ইচ্ছা তার দয়ার ছায়াতলে স্থান দেন, যাকে ইচ্ছা বের করে দেন। যা হোক, এক বছর পর আল্লাহ তা'আলা তাকে তার ঈমান ফিরিয়ে দিলেন। তিনিও পূর্বের মত বরং আরও ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলেন। মুরীদদের কান্নাকাটির ফলাফল লক্ষ্য করুন! সুতরাং কেউ অন্যায় করলে তাকে অন্যায় থেকে বাঁচাতে হবে। তাকে বেইজ্জত করা হারাম।
আমার শাইখ মুহিউস সুন্নাহ হযরত হারদুঈ রহ. একবার কুতবুল আলম শাইখ যাকারিয়া রহ.-কে মাসআলা জিজ্ঞাসা করলেন, হুযূর! থুতনির নিচের বাচ্চা দাড়ি সম্পর্কে মাসআলা কী? রাখতে হবে, না কাটা যাবে? কুতবুল আলম শাইখ যাকারিয়া রহ. বললেন, রাখতে হবে। তবে দু-একটা যদি বাঁকা হয়ে মুখের ভিতরে চলে আসে সেটা ছেঁটে দিবে। তখন হারদুঈ রহ. বললেন, হযরত! আপনি তো রাখেন না। কুতবুল আলম বললেন, বাবা! আমি কাটিনি, বরং জন্মগতভাবেই বাচ্চা দাড়ি আমার গজায়ইনি। ঘটনাটি আমি এজন্য বললাম যে, শাইখ হারদুঈ তার উস্তাদের ভক্ত ছিলেন না; মুহিব ছিলেন। ভক্ত হলে তো তিনি ভেগে যেতেন। আমার মতে ভাগনেওয়ালাকেই সংক্ষেপে 'ভক্ত' বলা হয়।
কাজেই মুহিব্বীন থাকলে বড়দের ভুল শুধরে যাবে। অনেক সময় বড় বড় আলেমও পরিবারের পাল্লায় পড়ে ভুল করেন। এসব ক্ষেত্রে খোঁজ নিতে হয়, তার কোন মুহিব্বীন আছে কিনা। থাকলে তাকে দিয়ে শোধরানোর কাজ নিতে হয়। পক্ষান্তরে সবাই যদি ভক্ত হয়, জ্বী হুযূর পার্টি হয়, তাহলে বড় বদ- কিসমত; বড় ক্ষতিকারক। সাধারণত শেষ বয়সে মানুষের আকল কাজ করে না। তখন সে যে ভুল করবে ঐ ভুলের উপরই তার ইন্তিকাল হয়ে যাবে। সেখান থেকে বের করে আনার কেউ থাকবে না। এজন্য দু'আ করো, আল্লাহ যেন আমার সহীহ মুহিব্বীন দান করেন। সহীহ মুহিব্বীন আরশের নিচে ছায়া পাবে। এজন্য প্রয়োজন সোহবত। হাদীসে এসেছে, الجليس الصالح خير من الوحدة অর্থাৎ সৎ সঙ্গী একাকিত্ব হতে উত্তম। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হা,নং ৩৪৮১৯)
হযরত শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. বলতেন, সঙ্গ গুণে রঙ্গ ধরে। একটি কাঁঠাল পেকে গেলে এর সংস্পর্শে অন্যগুলোও পেকে যায়। এজন্য যারা দূর-দূরান্ত থেকে নৌকায় করে কাঁঠাল আনা-নেয়া করে, তারা আড়তে বা মোকামে পৌঁছার আগে প্রতিদিন বাছ দিয়ে (খাওয়ার বা কাউকে দেয়ার মত না পেলে) পাকা কাঁঠালগুলো নদীতে ফেলে দেয়। কারণ এর সোহবতে বাকিগুলোও পেকে যাবে। মোকাম দূরে হওয়ায় সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে সব নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আমাদের সকলেরই সোহবত অবলম্বন করা উচিত।
দ্বিতীয় আয়াত পড়েছিলাম فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا তোরা আল্লাহর (গড়া( ফিতরাতকে ধরে রাখো। এখানে الزموا শব্দ উহ্য আছে। অর্থাৎ হক কবুল করার যোগ্যতা নষ্ট করো না। আল্লাহ তাআলা প্রথমে বলেছেন, এটা ধরে রাখো। সামনে বলেছেন, لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ অর্থ : আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে কোন পরিবর্তন হয় না। (সূরা রূম- ৩০)
এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে একটা খবর, একটা সংবাদ। এদিকে মুফাসসিরগণ লিখেছেন, কুরআনে কারীমে যত খবর আছে, যত সংবাদ আছে সবখানে 'ইনশা' (নির্দেশনা) উদ্দেশ্য। অর্থাৎ নিছক ঘটনা বলা বা কোন সংবাদ দেয়া আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। বরং সব সংবাদের বাঁকে বাঁকেই 'ইনশা' অর্থাৎ শিক্ষা ও নির্দেশনা গ্রহণের দাবী থাকে।
এক হাদীসে আছে, আল্লাহ তা'আলা হযরত আদম আ. কে এক মুষ্টি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। ফলে মাটির মধ্যে যত বাহ্যিক গুণাগুণ, রঙ-রূপ ইত্যাদি আছে সব বনী আদমের মধ্যে এসে গেছে। তেমনিভাবে মাটির যত অভ্যন্তরীণ গুণাগুণ শক্ত-নরম, ঊর্বর- অনুর্বর ইত্যাদিও এসে গেছে। এটা একটা খবর, সংবাদ। মেশকাতের গ্রন্থকার খতীব তিবরীযী (রহ.৭৪১হি.) এই হাদীসটি ঈমান বিল-কদর (তাক্বদীরের প্রতি বিশ্বাস) অধ্যায়ে উপস্থাপন করেছেন। এই হাদীসের মর্ম হল, মানুষ যে তবিয়ত ও স্বভাব পেয়েছে, রঙ ও রূপ লাভ করেছে সব তার তাকদীর অনুযায়ী পেয়েছে।
এই হাদীসে দু'টো গুরুত্বপূর্ণ 'ইনশা' অর্থাৎ দিকনির্দেশনা রয়েছে-
(১) কেউ যদি ভাগ্যক্রমে মাটির কোন মন্দ প্রভাব পেয়ে থাকে, শক্ত স্বভাব পেয়ে থাকে তবুও সে মন খারাপ করবে না। সে নিজেকে কোন আল্লাহওয়ালার সোহবতে পেশ করবে। তিনি তাকে ঘষে-মেজে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে দিবেন, আল্লাহর রহমতে তখন তার দ্বারা কেউ কষ্ট পাবে না। কারো ক্ষতি হবে না। উদাহরণত কারো সারাদিন শুধু ব্যভিচার করতে মন চায় (আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন), তাহলে সে এটা কীভাবে দূর করবে? কোন আল্লাহওয়ালার কাছে নিজেকে হাওয়ালা করে দিবে। তিনি তাকে ঘষে-মেজে ঠিক করে দিবেন।
(২) যিনি তা'লীম দিবেন, তরবিয়াত করবেন তার দায়িত্ব হল, সামনে যে ছাত্র আছে সে মাটির কোন তবিয়ত, কোন স্বভাব পেয়েছে তা বুঝতে হবে। সে অনুযায়ী তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। এটাকে বলা হয় মুকতাযায়ে হাল (স্থান- কাল-পাত্র বিচারে আচরণ করা)।
যেমন দু'ব্যক্তি মিলে একটি অন্যায় করল। বিচারক একজনকে শুধু বললেন, আপনি এ কাজটি করতে পারলেন! আপনার দ্বারাও এটা সম্ভব হল! আর আরেকজনকে তিনি দশ বেত মারলেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, যাকে বলেছেন- 'আপনি এ কাজটা করতে পারলেন' সে অন্যায় করার পর অনুশোচনায় এক সপ্তাহ ঘর থেকেই বের হয়নি। আর যাকে দশ বেত মারা হয়েছে সে ঐদিন থেকেই লাফালাফি করছে; তার কোন অনুভূতিই নেই। তার অবস্থা গুলিস্তানের সেই চোরের মত যাকে লোকেরা লাথি, ঘুসি, চড়, থাপ্পড় যে যা পারল মারল। যখন সবাই ক্লান্ত হয়ে গেল তখন চোর উঠে বক্তব্য দিল, 'মানির মান আল্লায় রাখে। এক ছালায় ভী কান ছুইবার পারে নাইক্কা।' অর্থাৎ তার ধারণা হল, যে যত কিল-ঘুষিই দিক কিছু আসে যায় না। কান ধরলেই আর মান রইল না; সব শেষ। বলছিলাম, সকলের তবিয়ত এক হয় না। তাই তা'লীম, তরবিয়াতের সময় ছাত্রের তবিয়তের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।
হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় কাফেরদের এক নেতা এসেছিল। সে এমন গোত্রের লোক, যারা বাইতুল্লাহয় কুরবানীর জন্য প্রেরিত পশুগুলোর খুব ইজ্জত করত। হুযূরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তার আগমন সম্পর্কে জানতে পারলেন, সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দিলেন (তখন চৌদ্দশত সাহাবা ছিলেন), তোমরা তার সামনে দিয়ে কুরবানীর পশুগুলো লাইন ধরে নিয়ে যাও। এখানে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের তবিয়ত বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম শুধুমাত্র তার সামনে দিয়ে পশুগুলো নিয়ে গেলেন; তাকে কিছুই বললেন না। তখন সেই লোক কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হলেন যে, হায় আল্লাহ! এই লোকগুলো কুরবানীর জন্য বাইতুল্লাহয় যাবে আর এদেরকে বাধা দেয়া হবে! এদেরকে বাইতুল্লাহয় প্রবেশ করতে দেয়া হবে না! সে নবীজীর সঙ্গে কোন কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতে মক্কায় ফিরে গেল। গিয়ে কুরাইশদেরকে বলল, ভাই! তোমরা এদেরকে ছেড়ে দাও। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, তারা কুরবানীর জানোয়ার নিয়ে এসেছে। এদেরকে বাধা দিও না। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু একটু হেকমত করেছেন। লোকটিকে কিছুই বলে দিতে হয়নি। সে নিজেই হুযূরের পক্ষে তাশকীল করতে আরম্ভ করেছে। মোটকথা, এই হাদীসের আরেক নির্দেশনা হল, তবিয়ত বুঝতে হবে।
তবিয়ত বুঝে দাওয়াত দিলে মানুষ সহজেই কবুল করবে। তো বলছিলাম, আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহর দেয়া তবিয়তকে পরিবর্তন করো না। আগের আয়াতে বলা হয়েছে নেক সোহবতে যাবে। আর এ আয়াতে বলা হয়েছে গলত সোহবতে যেয়ো না। না হয় হক কবুল করার যোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাবে। আটরশি যাওয়া হারাম। যত বাগী আছে দেওয়ানবাগী, রাজারবাগী, কুতুববাগী সবগুলোতে যাওয়া হারাম। এছাড়া আরো যত কিছু দ্বারা মনের মধ্যে বক্রতা আসে এ আয়াতে সব নিষেধ করা হয়েছে। অনেক বয়স্ক লোক আছে যারা সারাক্ষণ মোবাইল টিপতে থাকে, গেইমস খেলতে থাকে। কেউ রিমোট হাতে টেলিভিশনের সামনে পড়ে থাকে। কেউ ফেসবুক চালাতে থাকে। এগুলোতে তবিয়ত নষ্ট হয়ে যায়।
ফেসবুক তো 'সাম্মে কাতেল'- প্রাণঘাতী বিষ। প্রায় লোকেরই এ বদ-অভ্যাস আছে। কাজেই গলত সোহবতে যাওয়া যাবে না। টেলিভিশন দেখা যাবে না, ভণ্ডপীরের সোহবতে যাওয়া যাবে না। দুনিয়াবী কোন সভা-সমাবেশ যেখানে দীন কায়েমের কোন কথা হয় না, সেখানেও যাওয়া যাবে না। এরূপ মজলিস সম্পর্কে তো হাদীসে বলা হয়েছে, মরা গাধা খাওয়ার জন্য জমা হয়েছিল, খেয়ে চলে গেল। অনেকে আবার তামাশা দেখার জন্যও যায়। এ আয়াতে সব নিষেধ করা হয়েছে। মওদুদীর বই পড়া যাবে না। কাদিয়ানীর বই পড়া যাবে না। গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় আমাদের যুগে এক ছাত্র ছিল। প্রখর মেধাবী; সব কিতাব মুখস্থ করে ফেলত। তবে খুব গরীব ছিল। মাদরাসার পক্ষ থেকে তার সকল খরচ বহন করা হত। তাকে উচ্চশিক্ষার জন্য হযরত শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. লালবাগে মুফতী দীন মুহাম্মাদ সাহেব রহ.-এর নিকট তাফসীর পড়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সেই ছেলেটি কীভাবে যেন বখশিবাজারে কাদিয়ানীদের কেন্দ্রে যাতায়াত করতে লাগল। ক্রমে তাদের সাথে তার সম্পর্ক হয়ে গেল। একপর্যায়ে সে কাদিয়ানীই হয়ে গেল। অথচ সে ঢাকায় এসেছিল আরো ভালো পড়াশোনার জন্য। কিন্তু খারাপ সোহবতের কবলে পড়ে শেষতক কাদিয়ানীই হয়ে গেল। তো খারাপ সোহবতে গিয়ে মানুষ যে কোন সময় মুরতাদ হয়ে যেতে পারে। ইতিহাসে এমন অনেক দুঃখজনক ঘটনা আছে। বাল'আম বাউর মুরতাদ হয়ে গেল। আব্দুল্লাহ আন্দালুসী মুরতাদ হয়ে গেল। ফিতনায় পড়ে ভাল লোকও যে কোন সময় মুরতাদ হয়ে যেতে পারে। কাজেই স্বভাব নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। ভ্রান্ত লোকদের বই পড়তে গেলে তাদের মত হয়ে
যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। কেননা তারাও কুরআন দ্বারা দলীল পেশ করেছে। আয়াতের অপব্যাখা করে, ঘাড় মুচড়ে দলীল পেশ করেছে। ওসব মারপ্যাচ সবার বুঝে আসবে না; ফলে অপব্যাখ্যাকেই সে সঠিক হিসেবে মেনে নিবে।
বর্তমান যুগের বাচ্চারা মায়ের পেট থেকে বের হয়েই মোবাইলে হামলে পড়ে। মোবাইল পেলেই সব ঠাণ্ডা। কিন্তু এটা তো এই আয়াত পরিপন্থী। জন্মগ্রহণের পর তার কানে আযান দেয়া হয়েছে, ইকামত দেয়া হয়েছে। কিন্তু এত ছোট অবস্থায়ই তার মোবাইলের নেশা হয়ে গেল! সময় পেলেই টিপতে থাকে! সাপ আসে, ব্যাঙ আসে, আর ওগুলো দেখতে থাকে! এভাবে তার খোদাপ্রদত্ত তবিয়ত নষ্ট হয়ে যায়। তাকে আর মানুষ করা যাবে না। তাকে আর ঠিক করা সম্ভব হবে না। এমনকি মাদরাসায় এসেও লুকিয়ে লুকিয়ে এগুলো দেখতে থাকে। একসময় উস্তাদদের কাছে ধরা পড়ে যায়। আল্লাহ তাকে একটা সময় পর্যন্ত তওবার সুযোগ দেন। তারপর প্রকাশ করে দেন। যে কোন গুনাহ যত গোপনেই করা হোক, আল্লাহ তা প্রকাশ করেই দেন। আল্লাহর এক নাম সাত্তার অর্থাৎ গোপনকারী। আরেক নাম মুবদি' অর্থাৎ প্রকাশকারী। পিতা-মাতা ছোট সময়ে তার তবিয়ত নষ্ট করে দিয়েছে। যার ফলে এখন মাদরাসা থেকে বহিষ্কার হচ্ছে। এরপর আরেক মাদরাসায় ভর্তি হয়। কিন্তু তবিয়ত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আবারও অপরাধ করে। ফলে সেখান থেকেও বহিষ্কার হয়। এভাবে যখন কয়েক মাদরাসা থেকে বহিষ্কার হয় তখন তার পড়ালেখাই বাদ হয়ে যায়। তার যিন্দেগী বরবাদ হয়ে যায়। এটা কেন হল? পিতা-মাতা ছোট সময়ে খেয়াল না করার দরুণ। এর ফলেই এ পরিণতি। আল্লাহ যে বলেছিলেন, আল্লাহর দেয়া স্বভাব নষ্ট করো না। এটা পিতা-মাতার মাথায় ধরে না। কেউ কুরআন-কিতাব না পড়িয়ে বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামে দিচ্ছে। কেউ সেন্ট জোসেফে দিয়ে আসে। এর দ্বারা সে পাক্কা নাস্তিক হয়। মোবাইল দ্বারা বাচ্চা সাময়িক ঠাণ্ডা হল, মায়ের কিছু কষ্ট কম হল। কিন্তু সে তো ধ্বংস হয়ে গেল। এজন্য মোবাইল, ইংলিশ মিডিয়াম, টেলিভিশন এ জাতীয় সবই এ আয়াতের মাঝে অন্তর্ভুক্ত। এসব কিছু থেকেই বেঁচে থাকতে হবে।
আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সৎসঙ্গ ইখতিয়ার করার তাওফীক দান করুন এবং আমাদের আওলাদদেরকেও অসৎসঙ্গ থেকে বিরত থাকার ও রাখার তাওফীক দান করুন। আমীন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলী
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] হামদ ও সালাতের পর... আদর্শ শিক্ষকের পরিচয় হলো- যে শিক্ষক তার নিবিড় অধ...
থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপন: পাশ্চাত্যের নগ্ন অনুকরণ
নববর্ষের সূচনাতে আল্লাহ প্রেমিক মুমিনের অনুভূতি জানুয়ারী-'১ থেকে একটি নতুন সৌরবর্ষের সূচনা হতে যাচ্ছ...
ইয়াহুদী-খ্রিস্টানদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র মুসলিম উম্মাহর করণীয়
কুরআন-হাদীসে ইয়াহুদী-খ্রিস্টানের পরিচয় ইয়াহুদী জাতি পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতি। আল্লাহ তা'আলা হযরত নূহ আ...
শরয়ী বিধানে প্রাণীর ছবি (পর্ব দুই)
ইমাম নববী রহ.বলেন, قال الزهري: النهي في الصورة على العموم وكذلك استعمال ما هي فيه ইমাম যুহরী রহ. বলে...