প্রবন্ধ

সরল পথ ও বাঁকা পথ

লেখক:মুফতী সাঈদ আহমাদ ( রাহমানিয়া )
২ এপ্রিল, ২০১৪
৭৮১২ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

ক. আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, واعْتَصِمُوا يحبل الله جَمِيعًا এবং তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রশিকে ধরো ও পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না...।' (সূরা আলে ইমরান-১০৩) 

খ. হযরত জাবের রাযি. এর সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বসা ছিলাম। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি রেখা টানলেন ও তার ডানে ও বামে দুটি রেখা টানলেন। অতঃপর মধ্যবর্তী রেখায় হাত রেখে আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন,وأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا যার অর্থ- 'এটা আমার সরল পথ, সুতরাং এর অনুসরণ কর, অন্য কোনও পথ অনুসরণ কর না, অন্যথায় তা তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে...।' (সূরা আনআম-১৫৩)

গ. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, 'বনী ইসরাঈল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল, আর আমার উম্মত তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। একটি দল ব্যতীত সব ক'টি দল জাহান্নামী হবে। সাহাবীগণ জানতে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে দল কোনটি? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে দল আমার আদর্শ ও আমার সাহাবীদের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। (সুনানে তিরমিযী: হা.২৬৪১) 

উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসের আলোকে আমরা কয়েকটি বিষয় জানতে পারলাম:- 

ক. আল্লাহর আনুগত্যে ঐক্যবদ্ধ থাকা স্বয়ং আল্লাহর নির্দেশ।

খ. এ নির্দেশ সত্ত্বেও উম্মতে মুহাম্মাদী বহু দলে বিভক্ত হবে।

গ. একটিমাত্র দল সরল পথে চলবে আর অন্যরা বাঁকা পথে হাঁটবে। 

ঘ. বাঁকা পথের পথিকেরা জাহান্নামের যোগ্য, আর সরল পথের পথিকেরা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত।

ঙ. সরল পথ হলো, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের আদর্শ। আমরা মহান আল্লাহর দরবারে জান্নাত প্রার্থনা করি। জাহান্নাম থেকে মুক্তি কামনা করি। এক মুহূর্তের জন্যও

জাহান্নামের আযাব সহ্য করার শক্তি আমাদের নেই। কাজেই জাহান্নামের আশংকা আছে এমন কাজের ধারে কাছেও যেন আমরা না যাই। বাঁকা পথে হাঁটার আগ্রহ আমাদের যেন না থাকে। ভুলেও যেন তাতে না হাঁটি। সরল পথে চলতে সাহায্য চাই স্বয়ং সরল পথের মালিকের কাছে। হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল পথ দেখিয়ে দিন। সরল পথে চলার তাওফীক দিন। বাঁকা পথের পরিচয় জানিয়ে দিন। বাঁকা পথ বর্জনের তওফীক দিন।


সরল পথের পরিচয়

সরল পথের পরিচয়ও সরল। তা হলো, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ ও সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর কর্মপন্থা। সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর কর্মপন্থা বা আদর্শ মূলত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই আদর্শ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের বিপরীতে অন্য কোনও আদর্শ সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর নেই। ইসলাম যেহেতু ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয় বরং গোটা মানব গোষ্ঠীর জন্য, কাজেই এর বাস্তব নমুনার জন্য একটি বৃহৎ জামাআতের প্রয়োজন ছিল। আল্লাহ তা'আলা এর জন্য যাদেরকে বাছাই করেছেন, তারাই হলেন জামাআতে সাহাবা। বস্তুতঃ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ হলো, মৌলিক নীতিমালা। সাহাবাগণের আদর্শ হলো, সে নীতিমালার বিশ্লেষণ, বাস্তবায়ন ও অনুশীলন। একটি অপরটি হতে পৃথক নয়। বরং এক ও অভিন্ন। সুতরাং সঠিক পথে থাকতে হলে দু'টিরই অনুসারী হতে হবে। পরিভাষায় যাকে বলে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আহ।

সরল পথের বিপরীত হলো বাঁকা পথ। যেখানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও সাহাবীগণের আদর্শ উভয়টি অথবা কোনও একটি অনুপস্থিত। সেখানে স্থান করে নিয়েছে অজ্ঞতা, খেয়াল-খুশি ও অন্য কোনও মোহ। এ বাঁকা পথের অনুসারীকে সংক্ষেপে বলা হয় 'আহলুল হাওয়া ওয়ায যালালাহ' (প্রবৃত্তি ও গোমরাহীর অনুসারী)। এ পথে কেউ হাঁটে অজ্ঞতার কারণে ও ভুলবশত। আর কেউ হাঁটে বিশেষ কোনো মোহ নিয়ে ইচ্ছাকৃত। প্রথম শ্রেণী অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলে বা ভুল ধরিয়ে দিলে সরল পথে ফিরে আসে। দ্বিতীয় শ্রেণী সাধারণত ফিরে আসে না। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,

أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ ...

অর্থ: 'তুমি কি তাকে দেখেছো, যে তার খেয়াল খুশিকে নিজ মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে এবং জ্ঞান বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তাকে গোমরাহীতে নিক্ষেপ করেছেন এবং তার কান ও অন্তর মোহর করে দিয়েছেন আর তার চোখের উপর পর্দা ফেলে দিয়েছেন? অতএব, আল্লাহর পর এমন কে আছে, যে তাকে সুপথে নিয়ে আসবে? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? (সূরা জাসিয়া- ২৩)

বস্তুত তারা ঐ সকল লোক যাদের জন্য বাহাস-বিতর্ক, মুনাযারা-সামালোচনা কোন কিছুই উপকারী হয় না। মজার ব্যাপার যে, এদের একটি নিদর্শন হলো, এরা নিজেদেরকে শতভাগ সঠিক মনে করে আর অন্যদেরকে শতভাগ বাতিল মনে করে।


যুগেযুগে সরল পথের দিশারী 

ক. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَمِمَّنْ خَلَقْنَا أُمَّةٌ ...

অর্থ: 'আমার মাখলুকের মধ্যে এমন একটি দল আছে যারা মানুষকে সত্যের পথ দেখায় এবং সেই সত্য অনুযায়ী ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। (সূরা আ'রাফ- ১৮১)

খ. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, 'আমার উম্মতের মধ্যে সাহায্যপ্রাপ্ত একটি দল সর্বদা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। কিয়ামত অবধি তারা সত্য থেকে বিচ্যুত হবে না।' (সুনানে তিরমিযী; হা. ২১৯২)

গ. তিনি আরো ইরশাদ করেন, 'ইলমে নববীর ধারক হবে প্রত্যেক প্রজন্মের নেক লোকেরা। যারা ইলমে দীনকে সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতিসাধন, বাতিল পন্থীদের মিথ্যা দর্শন ও অজ্ঞদের ভুল বিশ্লেষণ থেকে মুক্ত রাখবে।' (মিশকাত শরীফ; হা. ২৪৮) 

ঘ. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর এক হাদীসে ইরশাদ করেন, 'আলেমগণ হলেন নবীগণের ওয়ারিস। নবীগণ মীরাস হিসাবে অর্থ-কড়ি রেখে যান না। বরং রেখে যান ইলম। যে এই ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ অর্জন করেছে।' (সুনানে আবু দাউদ; হা. ৩৬৪১)

ঙ. হাদীস শাস্ত্রের ইমাম আ'মাশ রহ. ইমাম আবু হানীফা রহ. কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,'হে ফিকাহবিদগণ! তোমরা হলে চিকিৎসক, আর আমরা হলাম ঔষধ সরবরাহকারী।' (দরসে তিরমিযীর ভূমিকা দ্রষ্টব্য)

উল্লিখিত বাণীসমূহের আলোকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক যামানায় একটি দলকে সরল পথের রাহ্বার হওয়ার মর্যাদা দান করবেন। যারা পূর্ববর্তীদের অনুসরণে পরবর্তীদেরকে পথের দিশা দান করার কাজ আঞ্জাম দিবেন। আর পরবর্তীরা তাদের দেখানো পথে চললেই বিপথগামিতা থেকে রক্ষা পাবে ও সরল পথে অবিচল থাকতে পারবে।

রাহবারের আমলদার দলটি হবে সমকালের আলেমগণ। যারা সর্ব-সাধারণের রাহবারীর কাজের পাশাপাশি সীমাতিক্রমকারী, বাতিলপন্থী ও অজ্ঞতার স্বর্গে বাসকারীদের ত্রিমুখী শত্রুতার মোকাবেলায় ঘাম ঝরাবেন। আর এই রাহবার শ্রেণীর নেতৃত্বে থাকবেন উম্মতের কাণ্ডারী ফিকাহবিদগণ। আল্লাহ তাআলা প্রতিটি যুগে দীনী ইলমের প্রয়োজনীয় সকল বিভাগে অপেক্ষাকৃত অধিক পারদর্শীদেরকে 'ফিকহ' তথা দীনের সহীহ সমঝ দান করবেন। খোদাপ্রদত্ত সামষ্টিক দক্ষতার কারণে আমলের ক্ষেত্রে অপর আলেমরাও তাদের দিক-নির্দেশনা গ্রহণে বাধ্য থাকবেন।

সঠিক পথের দিশারী আলেমদের বড় বৈশিষ্ট্য হল, পরমত সহিষ্ণুতা, ফিতনা ফাসাদ থেকে দূরে থাকা, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তা বাদ দিয়ে আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকা, বদ-দীনী ও বাতিলের মোকাবিলায় একে অপরের সহযোগিতা করা।

কুরআন-হাদীসের মর্ম অনুধাবন করতে গিয়ে মুজতাহিদগণের মতপার্থক্য ও সাহাবীগণের আমলের বিভিন্নতার উপর নির্ভরশীল বিরোধপূর্ণ আমল তাদের নীতিগত ঐক্যে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। নিজের দল ভারী করা আর অন্যের প্রতি ঈর্ষাকাতর হওয়ার মতো হীন মানসিকতা থেকে তারা সর্বদা মুক্ত থাকে। আল্লাহর দীনের জন্য জীবন উৎসর্গকারী ও মেহনতকারী পূর্বসূরীদের সকলকেই তারা ভক্তি ও শ্রদ্ধা করে। সকলের জন্য সমান দু'আ করে। ইলম ও আমলের লাইনে যে যতটুকু অবদান রেখেছে ততটুকুর জন্য নিজেদেরকে তাদের কাছে ঋণী মনে করে। মোটকথা, সকলের মূলনীতি, আদর্শ ও গন্তব্য এক ও অভিন্ন। 

পূর্বের আলোচনায় প্রমাণিত হয়েছে, পরকালের মুক্তি বাঁকাপথ পরিহার করে সোজাপথে চলার উপর নির্ভরশীল। আর সোজাপথ হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো পথ। যে পথে সাহাবায়ে কেরাম জীবন পরিচালনা করেছেন। সাহাবীগণ নববী-আদর্শে চলে প্রত্যেকেই পরবর্তীদের জন্য রাহবার ও দিশারী হয়ে গেছেন। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে সৃষ্টিই করেছেন পরবর্তীদের জন্য নববী আদর্শের নমুনা হওয়ার জন্য। স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা কুরআনে পাকে সাহাবীগণের বহু প্রশংসা করেছেন এবং তাদেরকে অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ করেন,

فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْل مَا آمَنْتُمْ بِهِ..

অর্থ: তারা যদি তোমাদের ন্যায় ঈমান আনে তাহলে নিশ্চয় হিদায়াত পেয়ে যাবে। (সূরা বাকারা- ১৩৭)

অন্যত্র ইরশাদ করেন, وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ অর্থ : মুহাজির ও আনসারদের যারা অগ্রবর্তী ও অগ্রণী এবং পরবর্তীদের মধ্যে যারা তাদের একনিষ্ঠ অনুসারী, আল্লাহ তা'আলা তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট। তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট...। (সূরা তাওবা- ১০০)

অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের সম্পর্কে ইরশাদ করেন, اصحابی کالنجوم بایهم اقتديتم اهتديتم. আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য। তাদের যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে সুপথ পেয়ে যাবে। (জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী; হা.নং ১৭৬০)

বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন, (অর্থ) যে অনুসরণ করতে চায় সে যেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের অনুসরণ করে। কেননা তাঁরা হলেন, এ উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক পবিত্র আত্মার অধিকারী, গভীর ইলমের অধিকারী, লৌকিকতায় স্বল্প, সুপথ প্রাপ্ত ও উত্তম অবস্থা সম্পন্ন। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে নিজ রাসূলের সঙ্গ ও দীন কায়েমের জন্য মনোনীত করেছেন। তোমরা তাদের মর্যাদা অনুধাবন কর। তদের পদাঙ্ক অনুসরণ কর। কেননা তারা সকলেই সুপথপ্রাপ্ত। (জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী; হা.নং ১৮১০)

মোটকথা, সাহাবীগণের সকলেই ছিলেন আলোক-বর্তিকা। তবে তাদের পরে কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত রাহবারীর দায়িত্ব আলেমগণ পালন করবেন এবং আলেমগণের নেতৃত্বে থাকবেন ফুকাহা অর্থাৎ ফিকাহবিদগণ। সাহাবীদের যামানায়ও ফকীহগণ ছিলেন অন্যদের জন্য অনুসরণীয়। হযরত আলী রাযি. বলেন, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমরা এমন কোন বিষয়ের সম্মুখীন হই যে বিষয়ে কুরআন-হাদীসে কোন স্পষ্ট নির্দেশ নেই, সে বিষয়ে আমাদের করণীয় কী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, (সেক্ষেত্রে তোমাদের করণীয় হল,) 'ফুকাহায়ে আবেদীন' আমলদার ফিকাহবিদগণের পরামর্শ গ্রহণ করবে। ব্যক্তিগত মতানুসারে আমল করবে না। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ; হা.নং ৮৩৪) 

উল্লেখ্য, ফকীহ একবচন, ফুকাহা বহুবচন। শব্দটি তাফাক্কুহ থেকে নির্গত। অর্থ শরীয়ত-বিশেষজ্ঞ। যিনি কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস তথা শরীয়তের উৎসসমূহ থেকে বিশদভাবে শরয়ী বিধান নির্ণয় করতে পারেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, শয়তানের বিপক্ষে একজন ফকীহ এক হাজার আবিদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৬৮১)

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. এর বর্ণনামতে লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামের মাঝে শতাধিক সাহাবী ফকীহ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তার অনবদ্য গ্রন্থ ই'লামুল মুয়াক্বিয়ীন-এ ফকীহ সাহাবীগণের তালিকাও উল্লেখ করেছেন। (শাইখুল ইসলাম আল্লামা মুহাম্মদ তাকী উসমানীকৃত উসূলে ইফতা দ্রষ্টব্য)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরবর্তী সময়ের ফুকাহাদের কথাও বলে গেছেন। যেমন, হযরত মুআবিয়া রাযি. সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (অর্থ) আল্লাহ তা'আলা যার কল্যাণ চান তাকে দীনের তাফাক্কুহ দান করেন। আমি বণ্টনকারী আর দানকারী স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা। এ দলটি সর্বদা আল্লাহর দীনের উপর অবিচল থাকবে। কিয়ামত অবধি কারো বিরোধিতা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৭১)

সহীহ বুখারীর শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইবনে হাজার রহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, হাদীসটিতে অত্যন্ত স্পষ্ট করে আলেম ও ফকীহগণের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণিত হয়েছে। (ফাতহুল বারী)

অর্থাৎ তাফাক্কুহ ফিদ্ দীনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে হাদীসটি সম্পূর্ণ 'সরীহ' (স্পষ্ট)। যদিও কোন কোন হাদীস বিশারদ এর দ্বারা আহলুল ইলম (আলেমগণ) আসহাবুল হাদীস বা আহলুল হাদীসও উদ্দেশ্য বলেছেন। কিন্তু সব অর্থের সারবত্তা যে দীনের পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারীগণ সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ.। তিনি বলেন,

ونحن لا نعني باهل الحديث المقتصرين على سماعه أو كتابته أو روايته بل نعنى بهم كل من كان أحق بحفظه ومعرفته وفهمه ظاهرا وباطنا و اتباعه باطنا وظاهرا .

অর্থ : আহলুল হাদীস দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য ঐ গোষ্ঠী নয় যারা শুধু হাদীস শোনে, লেখে ও বর্ণনা করে। বরং আমাদের উদ্দেশ্য ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ যারা হাদীস মুখস্থ ও চেনার যোগ্যতা রাখে, হাদীসের সনদ ও মর্ম বোঝে এবং হাদীসের মর্ম ও অর্থ অনুযায়ী আমল করে। (তায়েফায়ে মানসূরাহ; পৃষ্ঠা ৩৮) 

বলা বাহুল্য, এ সকল যোগ্যতা যাদের মধ্যে পাওয়া যাবে হযরত আলী রাযি.কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে 'ফুকাহায়ে আবেদীন' ইবাদত-গোযার ফুকাহা বলতে তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে। সূরায়ে নিসার ৫৯ আয়াতে আল্লাহ, রাসূল ও উলুল আমরের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. সাহাবা ও তাবেঈদের বরাতে লিখেন, 'এখানে উলুল আমর দ্বারা উদ্দেশ্য اهل الفقه والدين "আহলুল ফিকহি ওয়াদ দীন' তথা ফিকহ ও দীন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ। অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদেরকে ফুকাহাদের অনুসরণ করার নির্দেশ দিচ্ছেন।

আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. যেমন সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে শতাধিক ফকীহ সাহাবীর উল্লেখ করেছেন, তেমনি সাহাবীগণের পরে তাবেঈদের যুগের বিশিষ্ট ফকীহগণের তালিকাও নিজ কিতাব ই'লামুল মুআক্কিয়ীন এ উল্লেখ করেছেন। (উসূলুল ইফতা; শাইখুল ইসলাম আল্লামা মুহাম্মদ তাকী উসমানী) তবে সাহাবা ও তাবেঈদের যুগে অন্যান্য দীনী ইলমের মত ইলমে ফিকহ স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে অস্তিত্ব লাভ করেনি। ইলমে ফিকহ শাস্ত্রীয় আকার ধারণ করে আকাবিরে তাবেঈদের যুগে। এ সময়ে যে সকল ক্ষণজন্মা মহা মনীষী শরয়ী মাসাইলকে বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস করে সংকলন করেন এবং পরবর্তীদের জন্য মাসাইল নির্ণয়ের নীতিমালা তৈরী করেদেন তাদেরকে বলা হয় আইম্মায়ে মুজতাহিদীন।

সে যুগে এ ধরনের মুজতাহিদ অনেক ছিলেন বটে তবে আল্লাহ তা'আলা যাদের এ মহান কীর্তি পূর্ণাঙ্গরূপে শতাব্দির পর শতাব্দী বহাল রেখেছেন, যাদের নীতিমালা পরবর্তী ফকীহগণ অনুসরণ করেছেন তাদেরকে এ উম্মত 'আইম্মায়ে আরবাআহ' তথা চার ইমাম হিসেবে স্মরণ করে থাকে। আর তাদের প্রণীত নীতিমালা ও তাদের সংকলিত মাসাইল ও আহকামকে 'চার মাযহাব' তথা চার পদ্ধতি আখ্যায়িত করে। নীতিমালা প্রণয়নে ও মাসাইলে তাদের মাঝে ক্ষেত্র বিশেষে যে মতানৈক্য হয়েছে তা সবই ছিল কুরআন-হাদীস নির্ভর এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল নির্ভর। কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস কিংবা সাহাবায়ে কেরামের আমলের সমর্থন ছাড়া নিছক ব্যক্তিগত মতের উপর ভিত্তি করে কোন ইমাম কোন মাসআলা বা বিধান রচনা করেননি। করেছেন বলে এমন কোন দৃষ্টান্ত তাদের কারো রচনায় ও সংকলনে দেখানো সম্ভব নয়। যার কারণে ক্ষেত্র বিশেষে পারস্পরিক মতানৈক্য সত্ত্বেও চার মাযহাবের সবগুলোই সঠিক। তাদের মতানৈক্য সাহাবীদের আমলের বিভিন্নতার উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে পূর্ব থেকেই তা অনুমোদিত। এর সব ক'টিই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত তথা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ'র অন্তর্ভুক্ত। তাদের সকলেই সোজাপথের দিশারী। সমকালে ও পরবর্তীকালের উলামা, ফুকাহা, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ঐতিহাসিক ও দার্শনিকদের প্রায় সকলেই চার মাযহাবের কোন না কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।

যথা, কাযী আবূ ইউসুফ, মুহাম্মদ ইবনুল হাসান, যুফার ইবনুল হুযাইল, আবু জা'ফর তহাবী, ইমাম শাফেয়ী রহ এর উস্তাদ ওয়াকী ইবনুল জাররাহ, হাদীস শাস্ত্রের প্রবাদ-পুরুষ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, বুখারী রহ. এর উস্তাদ মাক্কী ইবনে ইবরাহীম ও ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন, সনদ বিশ্লেষণশাস্ত্রের ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তানের মত জগদ্বিখ্যাত আলেমগণ হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।

আর ইমাম ইবনে আব্দিল বার, আল্লামা ইবনে রুশদ, ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন, ইমাম কুরতুবী, ফখরুদ্দীন রাযী ও ইবনে দাকীকুল ঈদ প্রমুখ মালেকী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।

আল্লামা খাত্তাবী, যাহাবী, সুয়ূতী, বগভী, নববী, গাযালী, ইবনে কাসীর, ইবনে হাজার, ইবনে সালাহ, ইমাম মুসলিম, নাসাঈ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ প্রমুখ শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। ইমাম বুখারীও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাফেয়ী মাসলাকের অনুসারী ছিলেন।

আল্লামা ইবনুল জাওযী, শাইখ আব্দুল কাদের জীলানী, ইবনে কুদামা, ইবনে রজব, ইমাম আবূ দাউদ প্রমুখ হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। প্রসিদ্ধ আহলে হাদীস নওয়াব সিদ্দীক হাসান সাহেবের ভাষ্যমতে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাইয়িম রহ. হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। এখানে কিছু পরিচিত নাম শুধু নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হল। সর্বসাধারণের বুঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। তাছাড়া ইলমে দীনের ইতিহাসে বিশেষ অবদানের কারণে যারাই যে নামে স্বীকৃত হয়েছেন তারা কে কোন্ মাযহাবের অনুসারী ছিলেন তা নিয়ে স্বতন্ত্র কিতাবও রচিত হয়েছে যে গুলোকে 'তাবাকাত' বলা হয়। তাবাকাত সম্পর্কে যাদের সামান্য ধারণা আছে তারা সকলেই জানেন যে আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের যুগ থেকে নিকট অতীত পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য উলামাদের কেউ বর্তমান যামানার গাইরে মুকাল্লিদদের মত লাগামছাড়া গাইরে মুকাল্লিদ ছিলেন না। এমনকি সিহাহ সিত্তার ইমামগণ এবং শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. যাদের কিতাব বগলে নিয়ে লা মাযহাবীরা মাযহাবের বিরুদ্ধে বিষবাষ্প ছড়ায় তারাও মুলনীতিতে গাইরে মুকাল্লিদ ছিলেন না । শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার নিম্নের বক্তব্যটি এ বাস্তবতাকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট করে তোলে।

 وأحمد كان أعلم من غيره بالكتاب والسنة وأقوال الصحابة والتابعين. 

অর্থ : কুরআন-সুন্নাহ,সাহাবা ও তাবেঈদের মতামত সম্পর্কে ইমাম আহমদ রহ. অন্যদের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ ছিলেন। (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২০/২২৯)

উল্লেখ্য, সাহাবা ও তাবেঈন পরবর্তী যুগে ফুকাহায়ে উম্মত চার মাযহাবে বিন্যস্ত হলেও ইমাম আবু হানীফা রহ. ছিলেন এদের সকলের পুরোধা।

ফিকহের শাস্ত্রীয় রূপদানের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফা রহ. (৮০ হি. ১৫০ হি.) ছিলেন অন্য সকল ইমামদের পথিকৃৎ। 


ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফা রহ. এর অবস্থান

ইমাম যাহাবী রহ., তাযকিরাতুল হুফ্ফায গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফা রহ. সম্পর্কে অন্য ইমামদের উক্তি উল্লেখ করতে গিয়ে লেখেন, (ক) আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. কে জিজ্ঞাসা করা হল, ইমাম মালেক রহ. শ্রেষ্ঠ ফকীহ, নাকি ইমাম আবু হানীফা? জবাবে ইবনুল মুবারক বললেন, ইমাম আবু হানীফা। (খ) ইমাম বুখারীর উস্তাদ মাক্কী ইবনে ইবরাহীম রহ. বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. সমকালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। (গ) হাদীস শাস্ত্রের ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান বলেন, ইমাম আবূ হানীফা'র সিদ্ধান্তের চেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত আমরা শুনিনি। আমরা তার অধিকাংশ কথা গ্রহণ করেছি। (ঘ) ইমাম মুযানী সূত্রে বর্ণিত, ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন, ফিকহের ক্ষেত্রে সব মানুষ ইমাম আবু হানীফার পরিবারভুক্ত। (ইমাম যাহাবীকৃত মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা দ্রষ্টব্য)

ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর জন্মভূমি ছিল কূফা নগরী। হযরত উমর রাযি. এ নগরীর গোড়াপত্তন করেন। তার নির্দেশনায় এখানে ফুকাহায়ে সাহাবার এক বিরাট জামাআত বসবাস শুরু করেন। তাদের পদচারণায় অল্পদিনেই এ নগরী ইলম ও ফিকহের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। ইমাম আজালী রহ. কূফায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সাহাবীদের সংখ্যা ১৫০০ বলেছেন। যাদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত সা'আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস, হযরত আবূ মূসা আশআরী, হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান, হযরত সালমান ফারেসী, হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রাযিয়াল্লাহু আনহুমের ন্যায় বিশিষ্ট সাহাবীগণ শামিল ছিলেন। এ বিরাট সংখ্যক সাহাবীর উপস্থিতিতে কূফা নগরীর ইলমী অবস্থা কী দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। যার ফলে চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রাযি. যখন কূফাকে দারুল খিলাফত হিসেবে নির্ধারণ করতে আসলেন তখন কূফার ইলমী অবস্থা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং বললেন, رحم الله ابن ام عبد قد ملأ هذه القرية علما. অর্থ: ইবনে মাসউদ রাযি. এর প্রতি আল্লাহর রহমত হোক তিনি এ অঞ্চলকে ইলম দ্বারা পূর্ণ করে দিয়েছেন। অতঃপর বললেন, أصحاب ابن مسعود سرج هذه الامة অর্থ: ইবনে মাসউদের শিষ্যরা এ উম্মতের প্রদীপ। বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত আনাস ইবনে সীরীন রহ. বলেন,  أتيت الكوفة فوجدت بها أربعة آلاف يطلبون الحديث واربع مأة قد فقهوا. আমি কূফায় এসে দেখতে পেলাম চার হাজার ছাত্র ইলমে হাদীস অর্জন করছে আর চারশতজন ফিকহ অর্জন করে নিয়েছে। (আল্লামা যাহিদ আল কাউসারীকৃত ফিকহু আহলিল ইরাকি ওয়া হাদীসুহুম ও শাইখুল ইসলাম আল্লামা মুহাম্মদ তাকী উসমানীকৃত দরসে তিরমিযীর ভূমিকা দ্রষ্টব্য)

মোটকথা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈদের যুগে কূফা নগরী ছিল ইলমে হাদীস ও ফিকহের কেন্দ্রভূমি। চার দিকেই ছিল ইলমের জয়জয়কার। এ কারণেই সহীহ বুখারীতে যাদের সুত্রে হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাদের মধ্যে তিনশত জনই ছিলেন কূফার অধিবাসী। (প্রাগুক্ত) 

ইমাম আবু হানীফা রহ. খোদা প্রদত্ত যোগ্যতা, তীক্ষ্ণ মেধা ও নিরলস অধ্যবসায়ের মাধ্যমে কূফা নগরীর সমকালীন সকল ফকীহ ও মুহাদ্দিসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সকল মনীষীর ইলম একত্র করে নিয়েছিলেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ইতিহাসবিদ খতীবে বাগদাদী হযরত আলী ইবনুল মাদীনী রহ. এর উক্তি এভাবে বর্ণনা করেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. এর সকল ইলম আলকামা, আসওয়াদ, হারিস, আমর ও উবাইদা ইবনে কায়েসের মধ্যে একত্রিত হয়েছে। আর এ পাঁচ ব্যক্তির ইলম ইবরাহীম নাখয়ী ও আমের শা'বীর মধ্যে পুঞ্জিভূত হয়েছে। আর এ দু'জনই ছিলেন ইমাম আবু হানীফা রহ. এর বিশিষ্ট উস্তাদ। এছাড়াও কাতাদাহ, তাউস, ইকরিমা, হাসান বসরী, আমর ইবনে দীনার, সুলাইমান আল-আ'মাশ প্রমুখের ন্যায় বিশিষ্ট তাবেয়ীগণ ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর উস্তাদ ছিলেন। যার ফলে ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবূ হানীফা রহ. অন্যান্য ইমামদেরও ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। (প্রাগুক্ত) 

প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন রহ. বলেন,  ومقامه في الفقه لا يلحق شهد له بذلك أهل جلدته وخصوصا مالك والشافعي. অর্থ: ফিকহের ক্ষেত্রে তার অবস্থান এত উঁচু ছিল যে, তার নাগালে পৌঁছা অন্যদের জন্য অসম্ভব। এ মর্মে তার সমকালীন আলেমরাই সাক্ষী। বিশেষ করে ইমাম মালেক রহ. ও ইমাম শাফেয়ী রহ.। (মুকাদ্দিমা ইবনে খালদুন)


হাদীস শাস্ত্রে ইমাম আবূ হানীফা রহ. 

ফিকহ শাস্ত্রের ন্যায় হাদীস শাস্ত্রেও ইমাম আবূ হানীফা রহ. অন্যদের ইমাম ছিলেন। নিম্নে হাদীস শাস্ত্রের ইমামদের কয়েকটি উক্তি উল্লেখ করা হল।

(ক) ইমাম বুখারীর বিশিষ্ট উস্তাদ মাক্কী ইবনে ইবরাহীম রহ. বলেন, كان اعلم اهل زمانه অর্থ : ইমাম আবু হানীফা সমকালের শ্রেষ্ঠ (তাহযীবুত তাহযীব) আলেম ছিলেন।

(খ) ইমাম আবূ দাউদ রহ. বলেন, ان ابا حنيفة كان اماما. অর্থ : নিশ্চয়ই আবূ হানীফা ইমাম ছিলেন। (তাযকিরাতুল হুফ্ফায)

(গ) প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইয়াযীদ ইবনে হারুন রহ. বলেন,  أدركت ألفا من الشيوخ وكتبت منهم فما وجدت أفقه ولا أعلم من خمسة أولهم أبو حنيفة অর্থ : আমি এক হাজার শিক্ষক পেয়েছি। তাদের থেকে হাদীস লিখেছি। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে অধিক ফকীহ, অধিক মুত্তাকী ও অধিক আলেম পেয়েছি। ইমাম আবু হানীফা রহ. ছিলেন তাদের মধ্যে প্রথম। (তাযকিরাতুল হুফ্ফায ১/১৬৯)

(ঘ) ইমাম শাফেয়ী রহ. এর প্রসিদ্ধ উস্তাদ ওয়াকী' ইবনুল জাররাহ রহ. ইমাম আবু হানীফা রহ. থেকে নয়শত হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন। (দরসে তিরমিযী; ভূমিকা দ্রষ্টব্য)

(ঙ) অধিকাংশ হাদীস সংকলক ফিকহী ( মাসাইলের সূচী অনুযায়ী কিতাব সংকলন করেছেন। পরিভাষায় সেগুলোকে সুনান কিংবা মুসান্নাফ বলা হয়। ইমাম সুয়ূতী রহ. এর বর্ণনা মতে ইমাম আবূ হানীফা রহ. কর্তৃক প্রণীত হাদীস গ্রন্থ কিতাবুল আসার হল এ জাতীয় গ্রন্থের সর্বপ্রথম।

(তাবয়ীযুস সহীফা; পৃষ্ঠা ১১৬) 


মাসাইল সংকলনে ইমাম আবু হানীফা রহ. এর নীতি

ইমাম আবু হানীফা রহ. এর তত্ত্বাবধানে যে সকল মাসআলা সংকলিত হয়েছে তা তার ব্যক্তিগত গবেষণার সমষ্টি নয়; বরং মাসাইল সংকলনের জন্য তিনি তৎকালীন কূফা নগরীর সেরা আলেমদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করেছিলেন। ইমাম ত্বহাবী রহ. আসাদ ইবনে ফুরাত রহ. এর সূত্রে সে বোর্ডের সদস্য সংখ্যা ৪০জন উল্লেখ করেছেন। এই বোর্ড কর্তৃক সংকলিত মাসাইল শামসুল আইম্মা কারদারী রহ. এর বর্ণনা মতে ছয় লাখের অধিক ছিল। ইমাম সাহেবের একান্ত ছাত্র ইমাম মুহাম্মদ রহ. কর্তৃক রচিত যে সকল কিতাব আজ দুনিয়া ব্যাপী বিদ্যমান সেগুলো মূলত ঐ সকল মাসাইলেরই পরবর্তী সংস্করণ। (আল্লামা শিবলী নু'মানীকৃত সীরাতুন নু'মান দ্রষ্টব্য)

হানাফী মাসাইল ইমাম আবু হানীফা রহ. এর ব্যক্তিগত মতামত নয়; বরং কূফা নগরীর তৎকালীন সেরা আলেমদের সমন্বিত মতামত। বিষয়টি প্রমাণিত হয় ইমাম তিরমিযী রহ. এর সুনানে তিরমিযীর বর্ণনা পদ্ধতিতেও। তিনি যেখানে ইখতিলাফী মাসাইল বর্ণনার قال الإمام الشافعي قال الإمام المالك . قال الامام احمد অর্থাৎ ইমাম শাফেয়ী এমন বলেছেন, ইমাম মালেক এমন বলেছেন, ইমাম আহমদ এমন বলেছেন মর্মে উল্লেখ করেন সেক্ষেত্রে হানাফী মত قال أهل الكوفة অর্থাৎ কূফাবাসী এমন বলেছেন এই ভঙ্গিতে। 'ইমাম আবু হানীফা এমন বলেছেন' এভাবে তিনি উল্লেখ করেন না।

মোটকথা, সাহাবা ও আকাবিরে তাবেঈদের পরবর্তী সময়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ তথা মুক্তিযোগ্য দলের পথনির্দেশের কাজ যে সকল আলেম ও ফকীহ করেছেন তাদের নেতৃত্ব ছিল আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, বিশেষ করে আইম্মায়ে আরবাআ অর্থাৎ চার মাযহাবের ইমামদের হাতে। আর ইমাম আবু হানীফা রহ. ছিলেন এদের সবার সেরা। যে কারণে উম্মতে মুহাম্মদী তাকে ইমামে আযম অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ইমাম হিসেবে স্মরণ করে। হাফেযে হাদীস আব্দুল আযীয ইবনে আবী রাওয়াদ রহ.  من احب ابا حنيفة فهو سنى ومن أبغضه فهو مبتدع অর্থ: যে আবূ হানীফাকে ভালোবাসে সে সুন্নী। আর যে বিদ্বেষ পোষণ করে সে বিদ'আতী। (ইমাম ইবনে হাজার হাইসামীকৃত আল-খাইরাতুল হিসান; পৃষ্ঠা ৪৮) প্রসিদ্ধ বুযুর্গ বিশর হাফী রহ. হতে বর্ণিত, ইমাম আল-খুরাইবী রহ. বলেন, অজ্ঞ ও হিংসুক ছাড়া আর কেউ ইমাম আবূ হানীফার সমালোচনা করে না। অনুরূপ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাফস ইবনে গিয়াস রহ. বলেন, আবূ হানীফা রহ. এর কথা চুলের চেয়ে বেশি সূক্ষ্ম, মূর্খরাই কেবল তার দোষ ধরে। (ইমাম যাহাবীকৃত মানাকিবুল ইমাম)

উল্লেখ্য, ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর সমালোচনা করা যে মূর্খতা নিম্নের কথাগুলো থেকেও তা প্রমাণিত। তারা বলে থাকে, ইমাম সাহেব (ক) হাদীস শাস্ত্রে দুর্বল ছিলেন, (খ) তিনি নিজে কোন কিতাব লিখেননি, (গ) সিহাহ সিত্তায় ইমাম সাহেবের সূত্রে কোন রেওয়ায়েত নেই, (ঘ) কোন কোন ইমামুল হাদীস ইমাম সাহেবকে দুর্বল বলেছেন ইত্যাদি। অথচ পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি, হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণ তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি নিজেও ফিকহী সূচী অনুযায়ী সর্বপ্রথম হাদীসের কিতাব সংকলন করেছেন। তার শিষ্যদের মধ্যে ইমাম বুখারীর বিশিষ্ট উস্তাদগণও রয়েছেন। তাছাড়া সিহাহ সিত্তায় তো ইমাম শাফেয়ী রহ. এর সূত্রেও কোন রেওয়ায়েত নেই। ইমাম আহমদ যিনি হাদীসের জাহাজ বলে খ্যাত ইমাম বুখারীর উস্তাদ হওয়া সত্ত্বেও বুখারীতে তার সূত্রে মাত্র তিনটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মালেক রহ. এর সূত্রে বর্ণিত রেওয়ায়েত সংখ্যাও হাতে গোনা। আর যে সকল মুহাদ্দিস ইমাম সাহেবকে যঈফ বলেছেন মর্মে বলা হয় তা কিছু বানোয়াট বর্ণনা কিংবা অজ্ঞতা প্রসূত সমালোচনা। প্রমাণের জন্য শাইখুল ইসলাম আল্লামা মুহাম্মদ তাকী উসমানীকৃত দরসে তিরমিযীর ভূমিকা দ্রষ্টব্য। এরপরও যারা ইমাম আযম আবূ হানীফা রহ. কে বাঁকা চোখে দেখে এবং অভদ্রের মতো শুধু আবূ হানীফা বলে নাম উচ্চারণ করে। তারা আসলে বাঁকাপথের অনুসারী। পরবর্তী আলোচনাসমূহে এদের মুখোশ উন্মোচিত হবে ইনশাআল্লাহ।

পূর্ববর্তী আলোচনাতে সীরাতে মুস্তাকীম তথা সোজাপথ ও সোজাপথের দিশারী সম্পর্কে আলোচনার পর এখন সোজাপথের অনুসারী সম্পর্কে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। 

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,ومن يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى অর্থ : যে ব্যক্তি তার সামনে হিদায়াত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে ও 'সাবীলুল মুমিনীন' তথা মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ অনুসরণ করবে আমি তাকে সেই পথেই ছেড়ে দেব, যা সে অবলম্বন করেছে। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব, যা অতি মন্দ ঠিকানা। (সূরা নিসা- ১১৫) রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,اتبعوا السواد الأعظم فإنه من شذ شذ في النار অর্থ : তোমরা বড় দলের অনুসরণ কর। কেননা যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে সে জাহান্নামে গিয়ে পড়বে। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ৩৯৫০)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,

إن الله لا يجمع أمتي - أو قال أمة محمد - على ضلالة، ويد الله على الجماعة، ومن شذ شذ إلى النار.

অর্থ : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা উম্মতে মুহাম্মদীকে গোমরাহীতে ঐক্যবদ্ধ হতে দিবেন না। জামা'আতের প্রতি আল্লাহর সাহায্য থাকবে। আর যে বিচ্ছিন্ন হবে সে জাহান্নামে গিয়ে পড়বে। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২১৬৭)

উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল, ফিরকায়ে নাজিয়াহ তথা মুক্তিযোগ্য দলের অন্তর্ভুক্ত হবে জামা'আতুল মুসলিমীন ও জামা'আতুল মুসলিমীনের অনুসারীগণ।

ইমাম আবু ইসহাক শাতেবী রহ. তার প্রসিদ্ধ কিতাব আল ই'তিসাম এর নবম অধ্যায়ের সপ্তদশ অনুচ্ছেদে এ জামা'আতের যে দীর্ঘ পরিচয় উল্লেখ করেছেন তার সারসংক্ষেপ হল, 'এ জামা'আত দ্বারা উদ্দেশ্য হল সাহাবায়ে কেরামের জামা'আত। অতঃপর মুজতাহিদ উলামা ও ইমামগণ এবং তাদের অনুসারী সাধারণ মুসলমানগণ। এরাই মুসলমানদের বড় দল। যদিও উলামাদের থেকে বিচ্ছিন্ন লোকের সংখ্যা তাদের চেয়ে বেশি হোক না কেন। সুতরাং যারা মুজতাহিদ উলামা ও তাদের অনুসারীদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে সে মুক্তির যোগ্য বিবেচিত হবে না। বরং হাদীসে পাকের ভাষ্য অনুযায়ী জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করবে। 

ইমাম আবু মনসূর আল বাগদাদী (মৃত্যু ৪২৯ হি.) আলফারকু বাইনাল ফিরাক নামক কিতাবে লিখেন,

فاما الفرقة الثالثة والسبعون فهي أهل السنة والجماعة من فريقي الرأي والحديث دون من يشتري لهو الحديث وفقهاء هذين الفريقين وقراؤهم ومحدثوهم ومتكلمو أهل الحديث منهم كلهم متفقون على مقالة واحدة في توحيد الصانع وصفاته وعدله وحكمته وفي أسمائه وصفاته وفي أبواب النبوة والإمامة وفي احكام العقبي وفي سائر أصول الدين وإنما يختلفون في الحلال والحرام من فروع الأحكام وليس بينهم فيما اختلفوا فيه منها تضليل ولا تفسيق وهم الفرقة الناجية .

অর্থ : তেহাত্তর নাম্বার দলটি হল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আহ। আসহাবুর রায় ও আসহাবুল হাদীস উভয় দল এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা'আলার একত্ববাদে তাঁর নাম ও গুণ বিষয়ে এবং রাসূলের নবুওয়াত ও তাঁর খলীফাগণের বিষয়ে, পরকালের বিশ্বাসে ও দীনের সকল মূলনীতিতে উভয় শ্রেণীর ফকীহ, ক্বারী, মুহাদ্দিস ও আকাইদ বিশেষজ্ঞগণ সকলেই একমত ও অভিন্ন মতাদর্শী। হালাল হারাম ও কিছু প্রাসঙ্গিক বিধি-বিধানে তাদের মতভেদ থাকলেও সে কারণে কখনো একে অপরকে গোমরাহ বা ফাসিক বলে না। এরাই মুক্তিযোগ্য দল। (আলফারকু বাইনাল ফিরাক; পৃষ্ঠা ২৭)

মোটকথা, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে আল্লাহ ও তার রাসূলের যে আনুগত্য আবশ্যক এ আনুগত্যে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল হকপন্থী একই সূত্রে গাঁথা থাকতে হবে। এদের মধ্যে আদর্শগত ও নীতিগত কোন পার্থক্য থাকবে না। মাসআলাগত ও প্রাসঙ্গিক বিধানগত পার্থক্য থাকা দোষনীয় নয়। শর্ত হল সে পার্থক্য ইজতিহাদ নির্ভর হতে হবে।


ইজতিহাদের অর্থ

ইজতিহাদ অর্থ কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত বিধানাবলীতে প্রয়োজনে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের নীতি নির্ধারণ। সমসাময়িক ও উদ্ভূত সমস্যাবলীতে কুরআন-সুন্নাহ সম্মত সমাধান প্রণয়ন। শাস্ত্রীয় পরিভাষায় যাকে বলা হয় কিয়াস ও রায়ের অনুসরণ। হযরত মু'আয ইবনে জাবাল রাযি.কে ইয়ামানে পাঠানোর সময়ে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ামানে গিয়ে তুমি বিভিন্ন বিষয়ে কীভাবে ফয়সালা করবে? তিনি বললেন, কিতাবুল্লাহ অনুযায়ী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, কিতাবুল্লাহয় না পেলে? তিনি বললেন, সুন্নাতে রাসূল অনুযায়ী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তাতেও না পেলে? তিনি বললেন, আমি নিজ রায় খাটিয়ে ইজতিহাদ করবো এবং চেষ্টায় ত্রুটি করবো না। এ জবাব শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা করলেন যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পছন্দনীয় বিষয়ের তাওফীক দিয়েছেন। (সুনানে আবী দাউদ;হা.নং ৩৫৯২, সুনানে তিরমিযী;হা.নং ১৩২৭) 

দুনিয়াব্যাপী প্রচলিত বিভিন্ন মতাদর্শ সম্পর্কে লিখিত প্রসিদ্ধ কিতাব আলমিলাল ওয়াননিহাল এ আল্লামা শাহরাস্তানী (মৃত্যু ৫৪৮ হি.) রহ. লিখেন,

ثم الاجتهاد من فروض الكفايات لا من فروض الأعيان إذا اشتغل بتحصيله واحد سقط الفرض عن الجميع وإن قصر فيه أهل عصر عصوا بتركه وأشرفوا على خطر عظيم فإن الأحكام الاجتهادية إذا كانت مرتبة على الاجتهاد وترتيب المسبب على السبب كانت الأحكام عاطلة والدرا كلها فائلة فلا بد إذن من مجتهد.

অর্থ: ইজতিহাদ ফরযে আইন নয়। তবে ফরযে কিফায়া। কোন মুজতাহিদ ইজতিহাদ করে নিলে সকলেই দায়মুক্ত হবে। অন্যথায় সকলে গুনাহগার হবে এবং মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। কেননা শরীয়তের ইজতিহাদী বিধানগুলো যখন ইজতিহাদের উপরই নির্ভরশীল তখন ইজতিহাদ না হলে সেগুলো বিলুপ্তি ও বিপর্যয়ের শিকার হবে। সুতরাং মুজতাহিদ আবশ্যক।

এ আলোচনার শেষাংশে তিনি লিখেন,

ثم المجتهدون من أئمة الأمة محصورون في صنفين لا يعدوان إلى ثالث أصحاب الحديث وأصحاب الرأي أصحاب الحديث وهم أهل الحجاز، هم أصحاب مالك بن أنس وأصحاب محمد بن إدريس الشافعي وأصحاب سفيان الثوري وأصحاب أحمد بن حنبل وأصحاب داود بن على بن محمد الأصفهاني، وإنما سموا أصحاب الحديث وأصحاب الرأي وهم أهل العراق، هم أصحاب أبي حنيفة النعمان بن ثابت ومن أصحابه محمد بن الحسن وأبو يوسف يعقوب بن إبراهيم القاضي... وإنما سموا أصحاب الرأي

অর্থ : মুজতাহিদ ইমামগণ দু'শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ। (এক) আসহাবুল হাদীস তথা আহলুল হিজায; তারা হলেন, ইমাম মালেক রহ., ইমাম শাফেয়ী রহ., সুফিয়ান সাওরী রহ., আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. ও দাউদ ইবনে আলী আলইস্পাহানী রহ. প্রমুখ ও তাদের শিষ্যবর্গ।

এরা মুজতাহিদ হওয়া সত্ত্বেও হাদীসের ধারণ-বহনের কাজ বেশি আঞ্জাম দিয়েছেন এবং কিয়াসের কাজ সাধারণত কম করেছেন। এ কারণে তাদেরকে আসহাবুল হাদীস বলা হয়।

(দুই) আসহাবুর রায় তথা আহলুল ইরাক; তারা হলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. এর শিষ্যবর্গ অর্থাৎ মুহাম্মদ ইবনুল হাসান, কাযী আবু ইউসুফ, ইমাম যুফার, হাসান ইবনে যিয়াদ, ইবনে সামাআহ, কাযী আফিয়াহ, আবু মুতী' বালখী ও বিশর আল মুরাইসী রাহিমাহুমুল্লাহ।

তারা কিয়াস করা, কুরআন-সুন্নাহ হতে আহকাম নির্ণয় করা ও উদ্ভূত সমস্যার সমাধান বের করার কাজ বেশি করেছেন বলে তাদেরকে আসহাবুর রায় বলা হয়। অতঃপর লিখেন, জেনে রাখো! উভয় পক্ষে মাসায়িল সংক্রান্ত বহু মতবিরোধ আছে। এ ব্যাপারে রয়েছে বহু সংকলন-রচনা ও বাহাস-বিতর্ক। এতদসত্ত্বেও কেউ কাউকে কাফের কিংবা গোমরাহ বলেনি। কেননা প্রত্যেক মুজতাহিদের ইজতিহাদই সঠিক। যেমনটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। (আলমিলাল ওয়াননিহাল; ১ম খণ্ড ৭ম অধ্যায়)

আল্লামা শাহরাস্তানী রহ. সকল মুজতাহিদের ইজতিহাদই সঠিক বলে ঐ হাদীসের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, 'মুজতাহিদ সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছলে দু'টি সওয়াব পাবেন আর ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছলেও একটি সওয়াব পাবেন।' (সহীহ বুখারী; হা.নং ৭৩৬২)

কারণ ইজতিহাদ নির্ভর বিষয়ে ইজতিহাদ করাই তার দায়িত্ব। কাজেই ইজতিহাদ করল তো তার দায়িত্ব পুরা করে নিল। এর উদাহরণ হল, কোন ব্যক্তি এমন অপরিচিত স্থানে উপস্থিত হল যে, কিবলার দিক নির্ণয় করতে পারছে না এবং জিজ্ঞাসা করার মতও কাউকে পাচ্ছে না। অপরদিকে নামাযের সময় চলে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে তার জন্য শরীয়তের হুকুম হল, চিন্তা-ভাবনা করে যেদিকে কিবলা হবে মর্মে প্রবল ধারণা হয় সেদিকে মুখ করে নামায পড়ে নেয়া। এতে তার নামায হয়ে যাবে। যদিও বাস্তবে তার ধারণার দিকটি কিবলার দিক না হয়।

মোটকথা, যারা মুজতাহিদ তারা তো ইজতিহাদ নির্ভর বিধানাবলীতে নিজ নিজ ইজতিহাদ অনুযায়ী আমল করবে। আল্লাহ প্রদত্ত ইজতিহাদী যোগ্যতার কারণে তারা কারো ইজতিহাদ অনুসরণ করবে না। এমনকি অনুসরণ করতেও পারবে না।

তবে মুজতাহিদ হওয়ার জন্য শুধু মেধার প্রখরতা বা দু-চারটা বই পড়ে নেয়া যথেষ্ট নয়। এমনকি নিয়মতান্ত্রিক আলেম হয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেও অন্যের অনুসরণে বাধ্য হতে হয়। আল্লামা শাহরাস্তানী রহ. লিখেন, ইজতিহাদের জন্য পাঁচটি শর্ত রয়েছে,

১. আরবী ভাষা, সাহিত্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে গভীর পাণ্ডিত্য।

২. কুরআনে পাকের তাফসীর ও তাফসীর সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞানে সামগ্রিক অবগতি। কুরআনে বর্ণিত বিধানাবলীর স্তর বিন্যাসের ক্ষমতা।

৩. হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও বর্ণনাসূত্রসমূহের সামগ্রিক জ্ঞান তথা গ্রহণযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য হাদীস, নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী, হাদীসের স্থান কাল ও পাত্র, হাদীসে বর্ণিত বিধানাবলীর শ্রেণীবিন্যাসের যোগ্যতা ইত্যাদি।

৪. সাহাবা, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন ও সালাফে সালেহীন কর্তৃক সমাধাকৃত ও সর্বসম্মত বিধানাবলী সম্পর্কে অবগতি। যেন সে ঐ সকল বিষয়েও ইজতিহাদ করতে শুরু না করে।

৫. কিয়াস ও ইজতিহাদের ক্ষেত্রসমূহ জানা। কিয়াসের পদ্ধতি ও ভিত্তি সম্পর্কে অবগতি।

এ পাঁচটি শর্ত মুজতাহিদ হওয়ার জন্য জরুরী। যার মধ্যে এ পাঁচটি শর্ত থাকবে না তার ইজতিহাদ অনুসরণযোগ্য নয়। বরং তা পরিত্যক্ত ও অনর্থক। (আলমিলাল ওয়াননিহাল; ৭ম অধ্যায়, পৃষ্ঠা ১৬২) 

বলা বাহুল্য যে, ইজতিহাদের জন্য এ সকল শর্ত সাধারণ জ্ঞানের দাবী। এর জন্য কুরআন-হাদীসের দলীল শর্ত নয়। এসব শর্ত যার মধ্যে নেই সে ইজতিহাদী মাসাইলের ক্ষেত্রে অন্যের অনুসরণ করতে বাধ্য। যাকে পরিভাষায় 'তাকলীদ' বলে। গাইরে মুজতাহিদকে তাকলীদ করতে কারো বলার প্রয়োজন পড়বে না। 

তার অযোগ্যতা ও অজ্ঞতা বা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অনুপাতে সে অন্যের তাকলীদ করতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে সে যদি কোন মুজতাহিদের তাকলীদ করে তাতে দোষের কিছু নেই। বরং তার জন্য শরীয়তের নির্দেশই হল তাকলীদ করা। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ অর্থ : তোমরা না জানলে অভিজ্ঞদেরকে জিজ্ঞেস করে নাও। (সূরা নাহল- ৪৩)

অন্যত্র ইরশাদ করেন, أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ অর্থ : তোমরা আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য কর, তাঁর রাসূলের ও তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদেরও আনুগত্য কর। (সূরা নিসা- ৫৯) 

গাইরে মুজতাহিদের জন্য মুজতাহিদের তাকলীদের মাঝেই রয়েছে শরীয়তের অনুসরণ। এর উদাহরণ হল, কোন ব্যক্তি এমন স্থানে উপস্থিত যে কিবলার দিক নির্ণয় করতে পারছে না। কিন্তু সেখানে এমন লোক উপস্থিত যে কিবলার দিক সম্পর্কে অবগত। এ ক্ষেত্রে অবগত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করে নেয়া তার উপর ওয়াজিব। 

ইমাম শাতেবী রহ. লিখেন,

أن العالم بالشريعة إذ اتبع في قوله وانقاد إليه الناس في حكمه فإنما اتبع من حيث هو عالم وحاكم بها وحاكم بمقتضاها لا من جهة أخرى فهو في الحقيقة مبلغ عن رسول الله (صلى الله عليه وسلم) المبلغ عن الله عز وجل... 

অর্থ : শরীয়ত-বিশেষজ্ঞ আলেমের অনুসরণ ও আনুগত্য এ দৃষ্টিকোণ থেকেই করা হয় যে, তিনি শরীয়ত সম্পর্কে অবগত। শরীয়ত মোতাবেক ও শরীয়তের চাহিদা মোতাবেক সিদ্ধান্ত দাতা। অন্য কোন বিবেচনায় নয়। কেননা আলেম মূলত রাসূলের বার্তা বহনকারী। আর রাসূল হলেন আল্লাহর বার্তা বহনকারী। (আলই'তিসাম; ১০ম অধ্যায়, পৃষ্ঠা ৫৩০)

সারকথা, ইজতিহাদ নির্ভর বিষয়ে শরীয়ত মান্য করার উপায় মাত্র দু'টি। (এক) মুজতাহিদ হলে নিজস্ব ইজতিহাদ অনুযায়ীই আমল করবে। (দুই) মুজতাহিদ না হলে কোন মুজতাহিদের অনুসরণ করবে। কেননা এক্ষেত্রে মুজতাহিদ হল চক্ষুষ্মান। আর অমুজতাহিদ হল দৃষ্টিহীন। চক্ষুষ্মান পথ চলতে অন্যের হাত ধরবে না। আর দৃষ্টিহীন কোন চক্ষুষ্মানের হাত ধরে চলবে। একাকীও চলবে না এবং কোন চক্ষুষ্মানের হাতে হাত রাখেনি এমন অন্ধ লোকের হাতেও হাত রাখবে না। একাকী চললে বা অন্য অন্ধের অনুসরণ করলে নিশ্চিত সে পথ হারাবে। সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতে সাবীলুল মুমিনীনকে অনুসরণ করা, সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতে উলুল আমরের আনুগত্য করা, সুনানে ইবনে মাজাহ'র ৩৯৫০ নং হাদীসে 'সাওয়াদে আযম' তথা বড়দলের সঙ্গে থাকা আর হযরত মু'আয ইবনে জাবালের ইজতিহাদ অনুযায়ী চলা এবং সূরা নাহলের ৪৩ নং আয়াতে বিজ্ঞদের জিজ্ঞেস করে চলা উপরোক্ত কথার অকাট্য প্রমাণ। এটাই সোজা পথ, এটাই মুক্তির পথ।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

অসৎ আলেম ও পীর

সূরা আরাফের শেষ ভাগে আল্লাহ পাক উল্লেখ করিয়াছেন যে, সৃষ্টির আদিতেই সমস্ত মানবজাতিকে তিনি সতর্ক করিয়া...

মুজাহিদে আযম, আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৬৭৫৯ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →