প্রবন্ধ

অসৎ আলেম ও পীর

লেখক:মুজাহিদে আযম, আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)
৫ জানুয়ারী, ২০১৫
৬৭১৮ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

সূরা আরাফের শেষ ভাগে আল্লাহ পাক উল্লেখ করিয়াছেন যে, সৃষ্টির আদিতেই সমস্ত মানবজাতিকে তিনি সতর্ক করিয়া দিয়াছেন যে, শিরক আর মূর্তিপূজা শুধু মূর্তি বানাইয়া পূজা করার নাম নয়। আল্লাহ তাহার নবীর মাধ্যমে যে শরীয়ত দুনিয়াতে পাঠাইয়াছেন, নবীর সেই শরীয়তের বিরূদ্ধে রাজপক্ষ অবলম্বন করাও একপ্রকার শিরক এবং মূর্তিপূজা। এই ধরণের মূর্তিপূজা এবং শিরকের সাড়ে তিন হাজার বৎসর পূর্বের একটি ঘটনা বর্ণনা করিয়াছেন এবং তিনি যে সৃষ্টির আদিতেই অঙ্গীকার নিয়াছেন যে, ঐ ধরণের শিরকও তোমরা করতে পারবা না, করলে জাহান্নামের মহাগ্নিতে শাস্তি ভোগ করিতে থাকবে, একথাও তিনি উল্লেখ করিয়া বুঝাইয়া দিয়াছেন। এতদসত্ত্বেও যখন 'বলআম বাউরা' আলেম হওয়া সত্ত্বেও, আবেদ হওয়া সত্ত্বেও প্রবৃত্তির বশবর্তী হইয়া, লোভের বশীভূত হইয়া নবীর শরীয়ত বাদ দিয়া টাকার লোভে স্ত্রীর মাধ্যমে প্রবঞ্চনায় গোমরাহ হইয়াছে, তখন আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেন- তাদের আমি চক্ষু দিয়াছি, কান দিয়াছি, জ্ঞান ও বিবেক দিয়াছি তা সত্ত্বেও তার দ্বারা কাজ নিতেছে না, যারা এরূপ করবে, যারা আমার দেওয়া স্বাধীন ক্ষমতা, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অপব্যবহার করবে তারা যেন জাহান্নামের কাষ্ঠ হইবার জন্যই সৃষ্টি হইয়াছে এইরূপ বুঝা যায়।

নজির স্বরূপ একটি ঘটনা বর্ণনা করিতেছি- এই ঘটনা থেকে সকলের সতর্ক হয়ে চলা দরকার, লোভের বশীভূত হইয়া, টাকার দাস হইয়া, স্ত্রীর কুমন্ত্রণায় বা অন্য কারো প্ররোচনায় কখনো কিছুতেই নবীর শরীয়তের পক্ষ পরিত্যাগ করিয়া লোভের বশীভূত হইয়া বা ভীত হইয়া রাজপক্ষ অবলম্বন করা চাই না। ঘটনাটি আল্লাহ তাআলা অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করিয়াছেন, তার কিছু বিস্তারিত বর্ণনা তাফসীর হইতে উদ্ধৃত করিতেছি। আল্লাহ তাআলা এ কথা পরিষ্কার বলে দিয়াছেন যে, আল্লাহর নাম, আল্লাহর গুণাবলী, আল্লাহর কাম, আল্লাহর ধর্ম সর্বৈব ভাল। একদল লোক দুনিয়াতে এমন আছে, যারা আল্লাহর আদেশ অনুসারে আল্লাহর ধর্মকে, আল্লাহর নামকে অ-জায়গায়, স্বার্থের জায়গায়, লোভের জায়গায় ব্যবহার করে না বরং তারা সত্য হেদায়াত করে এবং সত্য অনুসারে সুবিচার করে। পক্ষান্তরে আর একদল লোক আছে যাদের সৃষ্টিই যেন করা হইয়াছে জাহান্নামের কাষ্ঠ হওয়ার জন্য। তারা স্বার্থের জায়গায়, লোভের জায়গায়, অ-জায়গায়, কু-জায়গায় আল্লাহর ধর্মকে ব্যবহার করে। হে আমার নবী এবং নবীর শরীয়তের তাবেদারগণ! তাদের শাস্তি স্বয়ং আল্লাহই দিবেন, আপনারা তাদের পরোয়া করবেন না বা তাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইবেন না। আপনারা হক কথাই বলিয়া যাইবেন, হকের উপরই দৃঢ় থাকবেন, হক ইনসাফই করতে থাকবেন। 

অর্থলোভী, স্বার্থপর, সরকার-ঘেষা আলেম ও পীরের নজিরের সাড়ে তিন হাজার বৎসর পূর্বের ঘটনা আল্লাহ অতি সংক্ষেপে বলিয়াছেন- 

﴿وَٱتۡلُ عَلَیۡهِمۡ نَبَأَ ٱلَّذِیۤ ءَاتَیۡنَـٰهُ ءَایَـٰتِنَا فَٱنسَلَخَ مِنۡهَا فَأَتۡبَعَهُ ٱلشَّیۡطَـٰنُ فَكَانَ مِنَ ٱلۡغَاوِینَ ۝١٧٥ وَلَوۡ شِئۡنَا لَرَفَعۡنَـٰهُ بِهَا وَلَـٰكِنَّهُۥۤ أَخۡلَدَ إِلَى ٱلۡأَرۡضِ وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُۚ فَمَثَلُهُۥ كَمَثَلِ ٱلۡكَلۡبِ إِن تَحۡمِلۡ عَلَیۡهِ یَلۡهَثۡ أَوۡ تَتۡرُكۡهُ یَلۡهَثۚ ذَّ ٰ⁠لِكَ مَثَلُ ٱلۡقَوۡمِ ٱلَّذِینَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَاۚ فَٱقۡصُصِ ٱلۡقَصَصَ لَعَلَّهُمۡ یَتَفَكَّرُونَ ۝١٧٦﴾ 

আল্লাহ বলিয়াছেন- হে আমার নবী! আপনি পরবর্তী সমস্ত যুগের, সমস্ত মানুষের চিন্তার খোরাকের জন্য নজীর স্বরূপ ঘটনা বর্ণনা করুন, বুঝাইয়া দেন যে, মানুষ বাহ্যিক দৃষ্টিতে যত বড়ই আলেম, যত বড়ই আবেদ ও পীর হউক না কেন, যদি সে নিজে চেষ্টা ও ইচ্ছা করে তার লোভ ইত্যাদি রিপুকে দমন না করে টাকার লোভী বা স্বার্থপর, সরকার- ঘেষা হইয়া যায়, তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ হইবে। দুনিয়াতেও সে সৎ ও শিষ্টদের কাছে কুত্তার মত দুর! দুর! ছেই! ছেই! ইত্যাদি ঘৃণিত শব্দ ব্যবহারের উপযুক্ত হইবে এবং আখেরাতের ভীষণ আযাব তো আছেই। মানুষের এই ধরণের লোভ ইত্যাদি রিপু আজ নতুন পয়দা হয় নাই। সৃষ্টির আদি থেকেই রিপুর সঙ্গে জিহাদ করিয়া জয়লাভ করিয়া সত্যিকার মনুষ্যত্বের পরিচয় দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা লোভ ইত্যাদি রিপু মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করিয়া দিয়াছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সতর্কও করিয়া দিয়াছেন যে, খবরদার! রিপুর বশ, রিপুর দাস হইও না বরং সদা রিপুকে দমন করিয়া রাখিও। 

বলআম বাউরার ঘটনা:

সাড়ে তিন হাজার বৎসর পূর্বের হযরত মুসা আলাইহিস সালামের জামানার ঘটনাটি এই- বলআম বাউরা নামে অতি বড় একজন আলেম ছিলেন। তিনি এত বড় আবেদ ও এত বড় পীর ছিলেন যে, তিনি যা কিছুই দুআ করতেন, তাই আল্লাহর দরবারে কবুল হইয়া যাইত। একবারকার ঘটনা এই হইল যে, হযরত মুসার শরীয়তের হুকুমের সঙ্গে এবং তৎকালীন বাদশার সঙ্গে মুকাবেলা হইল। বাদশার পক্ষের লোকেরা বহু টাকা তার স্ত্রীকে দিয়া বলআম বাউরাকে রাজার পক্ষ হইয়া হযরত মুসার শরীয়তের বিরুদ্ধে যাইতে তাহাকে প্রস্তুত করল। প্রথমত: তার গৌরব ছিল যে, সে যা দুআ করবে, তাই কবুল হইবে। কাজেই সে প্রস্তুত হইয়া গেল। পাহাড়ে নির্জনে গিয়া হযরত মুসা যাতে পরাস্তও পর্যুদস্ত হন, রাজা যাতে জয়ী হয়- সেইরূপ দুআ করার জন্য কিন্তু দুআ করিবার সময় তাহার জবান উল্টিয়া গেল। হযরত মুসার জয়ের এবং রাজার পরাজয়ের দুআ তার মুখ দিয়া বাহির হইল। তারপর যেহেতু এক পাপে আর এক পাপকে ডাকিয়া আনে, সে রাজাকে কুমন্ত্রণা দিল যে, এখন মুসাকে পর্যুদস্ত করার এক উপায় আছে। সে উপায় এই যে, তোমরা ষোড়শী সুন্দরী যুবতী নারীদের মুসার লস্করের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ফেরী-দোকানদারী করার জন্য পাঠাইয়া দাও! মুসার লস্করের মধ্যে সব যুবকের দল। স্ত্রী ছাড়া তারা অনেক দিন আছে। যৌন ক্ষুধা তাদের প্রবল হইয়া আছে। পুরা লস্করের মধ্যে যদি একটি লোকেও একটি সুন্দরী নারীর সাথে যিনা করে অর্থাৎ তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইয়া তার সতীত্ব নষ্ট করে, তবে মুসার লস্কর থেকে আল্লাহর মদদ হটিয়া যাইবে, হয়ত আল্লাহর গযবও নাযিল হইতে পারে, ফলে তোমরা জয়ী হইয়া যাইবে। এই কুমন্ত্রণা অনুসারে কাজ হইল। হযরত মুসার লস্করের মধ্য হইতে একজন লোক যখন যিনা করিল তখন আল্লাহর গযব নাযিল হইয়া ৭০ হাজার সৈন্য প্লেগ রোগে আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইল। তারপর হযরত মুসার প্রধান সেনাপতি খবর পাইয়া ঐ যিনাকারী এবং যিনাকারিনী উভয়কে বল্লম দ্বারা বিদ্ধ করিয়া আসমানের দিকে উঠাইয়া ধরিয়া আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করিল যে, 'আমরা ব্যভিচারীকে এই ভাবেই শাস্তি দিব!' 

প্রার্থনার পর প্লেগ রোগ কমিয়া যায়। ওদিকে বলআম বাউরার জিহ্বা কুত্তার মতো ঝুলিয়া যায় এবং লোকেরা তাহাকে কুত্তার মতো দুর! দুর! ছেই! ছেই করতে থাকে।

সরকার ঘেষা, অর্থলোভী, স্বার্থপর আলেম ও পীরের এটাই আসল শাস্তি। দুনিয়া আল্লাহর শেষ বিচারের স্থান নয়, সে জন্য এক জায়গায় তিনি দেখাইয়া দিয়াছেন, বাকী সবাইকে চিন্তা করিয়া ঐরূপ মহাপাপ থেকে বিরত থাকার জন্য উপদেশ দিয়াছেন।

আমার উদ্দেশ্য- ভাইদেরে, সমাজকে এবং রাষ্ট্রকে সতর্ক করা, সমাজে বিশৃঙ্খলা আনয়ন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। যারা সমাজে সত্যের বিরুদ্ধে, শরীয়তের বিরুদ্ধে কাজ করে সমাজে বিশৃঙ্খলা আনয়ন করিতেছে বিশৃঙ্খলার জন্য তারাই দায়ী। আমি হক কথা না বললে আল্লাহর কাছে দায়ী হইব। শুধু সেই জন্য হক কথা সব ভাইকে জানাইয়া দিতে বাধ্য হইতেছি।

এত বড় আলেমটা, এত বড় আবেদ- পীরটা কেমন করে বিগড়ে গেল? আল্লাহ তার সংক্ষিপ্ত আয়াতের ভিতর তাও বর্ণনা করিয়া দিয়াছেন, লোভ-রিপু বিড়ালের মধ্যেও আছে, অন্যান্য ইতর প্রাণীর মধ্যেও আছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে দুইটি জিনিস বেশী আছে। তার মধ্যে বিবেক আছে, বিবেকের দ্বারা সে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বুঝিতে পারে। লোভের বশীভূত হইয়া রাজপক্ষ অবলম্বন না করিয়া নবীর শরীয়তের পক্ষই যে তার অবলম্বন করা উচিৎ ছিল, এ জ্ঞান মানুষকে দেওয়া হইয়াছে। তাছাড়াও কুপ্রবৃত্তিকে দমন করিয়া রাখার সংযম শক্তিও মানুষকে দেওয়া হইয়াছে। বিড়াল-কুকুরকে এই শক্তি দেওয়া হয় নাই।

আল্লাহ বলিয়াছেন- বলআম বাউরার প্রথমত: বিবেকের ভিতরে ইচ্ছা শক্তি এবং সংযম শক্তি ছিল, সেই শক্তির দ্বারা আমি তাকে আমার কিতাবের ইলম দিয়াছিলাম, তার সেই ইলমকে শক্ত করিয়া ধরিয়া থাকা উচিৎ ছিল, তা সে করে নাই বরং সে ইচ্ছা করিয়াই আমার কিতাবের ইলমের থেকে সরিয়া গিয়াছে, কিতাবের ইলমকে দূরে সরাইয়া দিয়াছে, তখনই শয়তান আসিয়া তার পেছন লহিয়াছে, তারপর শয়তানের কুমন্ত্রণায় সে একেবারে গোমরাহ হইয়া গিয়াছে। তারপর আল্লাহ বলিতেছেন, কোটি কোটি টাকার তুলনায়ও আমার কিতাবের ইলমকে তার উর্ধ্বে স্থান দেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু সে তা করে নাই। সে সামান্য লোভ-রিপুর বশবর্তী হইয়া দুনিয়ার দিকে ঝুকিয়া গিয়াছে, অথচ সে যদি লোভ-রিপুকে দমন করিয়া, টাকার লোভকে পরিত্যাগ করিয়া আমার কিতাবের ইলমকে উর্ধ্বে স্থান দিত, তবে আমিও তাকে আমার কিতাবের ইলমের বরকতে অনেক উর্ধ্বে স্থান দান করিতাম, তার মর্যাদাও অনেক বাড়াইয়া দিতাম। কিন্তু সে যেমন আমার কিতাবের ইলমকে দূরে, নিচে ফেলিয়া দিয়াছে, আমিও তাকে অপমানিত কুত্তার মত করিয়া দিয়াছি।

দেখা গেল মানুষ ইচ্ছা করিয়াই নিজে আগে খারাবীর দিকে যায়, তারপর শয়তান আসিয়া ধরে এবং শয়তান ক্রমান্বয়ে কুমন্ত্রণা দিয়া অধিক গোমরাহীর দিকে লইয়া যাইতে থাকে। এটাও বুঝা গেল যে, আল্লাহর কিতাবের ইলমকে যাহারা ইজ্জত দিবে, আল্লাহ তাহাদিগকে ইজ্জত দিবেন। পক্ষান্তরে যে সব লোক আলেম হওয়া সত্ত্বেও বা আলেম না হইয়া আল্লাহর কিতাবের ইলমের ইজ্জত না দিবে, আল্লাহ তাহাদিগকে ভীষণ জিল্লতি এবং অপমান দান করবেন। এই আয়াতের বিশেষ উপদেশ এই যে, আলেমের কখনো অর্থলোভী, সরকার-ঘেষা হওয়া চাই না।

নতুবা তাহার পরিণাম অতি ভয়াবহ। আদি ইবনে হাতেম নতুন মুসলমান হইয়া যখন আমাদের হযরতের সঙ্গে আসিয়া দেখা করিয়াছেন, হযরত তাহাকে ক্রুশকাষ্ঠ পরিত্যাগ করিতে বলিয়াছেন এবং এই আয়াত পাঠ করিয়াছেন,اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ আয়াতের তরজমা এই- তারা অর্থাৎ হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উম্মত খ্রিস্টানরা হযরত ঈসার (আ.) সত্য ধর্মকে ছাড়িয়া তাহাদের রাজা- বাদশাহদের এবং সেই সঙ্গে জনসাধারণরা তাহাদের আলেমদের এবং পীরদের কে খোদা বানাইয়া নিয়াছে। অর্থাৎ তাহাদের আলেমরা এবং পীরেরা লোভের বশীভূত হইয়া রাজা- বাদশাহদের কাছে আসিয়াছে। রাজা- বাদশাহরা তাহাদের মন-মতো হারামকে হালাল করার, হালালকে হারাম করার ফতওয়া চাহিয়াছে, তাহারা তদ্রূপই করিয়াছে। অতএব তাহারা আল্লাহর দীন নবীর শরীয়তকে ছাড়িয়া পীরদের এবং আলেমদের প্রকৃত সত্য ধর্মকে হারাইয়া ফেলিয়াছে। সত্যকে তাহারা মিথ্যা বানাইয়াছে। 

আদি রা. প্রশ্ন করিয়াছেন যে, আমরা তো আমাদের পাদ্রী-পোপদেরে খোদাও বানাই নাই, পূজাও করি নাই। হযরত বুঝাইয়া দিয়াছেন, খোদার হারামকৃত জিনিসগুলিকে তোমরা তোমাদের পাদ্রী- পোপদের মিথ্যা ফতওয়া অনুসারে হালাল করিয়া লইয়াছ। মিথ্যাকে সত্য করিয়া লইয়াছ। যেমন হযরত ঈসার (আ.) ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা, অথচ তোমরা এই মিথ্যাকে তোমাদের পাদ্রীদের ফতওয়া অনুসারে এমন সত্য বানাইয়া লইয়াছ যে, এইটা তোমাদের ধর্মের প্রধান প্রতীক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অথচ এইটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, এইরূপে হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর সৃষ্ট দাস এবং প্রেরিত নবী কিন্তু তোমরা তোমাদের সেন্ট পাদ্রীর মিথ্যা ফতওয়া অনুসারে জ্ঞান-বিবেক-শরীয়ত সব বাদ দিয়া এই মিথ্যাকে সত্য মনে করিতেছ। হযরত মূসার (আ.) তাওরাত কিতাবের শরীয়ত এবং ইঞ্জিল কিতাবের শরীয়তই হযরত ঈসার (আ.) শরীয়ত ছিল এবং মুক্তির পথ ছিল কিন্তু তোমরা তোমাদের পাদ্রী সেন্টপলের মিথ্যা প্ররোচনায় প্ররোচিত হইয়া সব শরীয়তকে বাদ দিয়াছ; মিথ্যা শূলীকে, মিথ্যা পুত্রবাদকেই মুক্তির পথ মনে করিয়াছ, অথচ এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। শূকর, সুদ, নারীর সতীত্ব হরণ তোমাদের শরীয়তে হারাম ছিল কিন্তু তোমাদের পাদ্রীরা রাজা-বাদশাহদের মন-মতো ফতওয়া দিয়া এই জঘন্য হারামগুলিকেও হালাল করিয়াছে।

আল্লাহ যে বলিয়াছেন, রাজা-বাদশাহদের এত মোহ, এত ভীতি থাকা সত্ত্বেও একদল লোক, একদল আলেম হকের উপর টিকিয়া থাকিবে, এর নযীর পূর্ববর্তী নবীদের মধ্যেও পাওয়া যায়। যেমন হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম হক মাসআলা বাতাইয়াছিলেন যে, তিন তালাক দেওয়া স্ত্রীকে ঘরে রাখা হারাম এবং স্ত্রীর মেয়েকে বিবাহ করা হারাম কিন্তু এই হক মাসআলা তৎকালীন রাজার মতের বিরুদ্ধে হওয়াতে রাজা হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামকে কতল করিয়া ফেলে। আল্লাহর তরফ হইতে আযাব ও গযব আসিয়া রাজা মাটির তলে ধ্বসিয়া ধ্বংস হইয়া যায় এবং শত্রুরা আসিয়া ৭০ হাজার লোককে কতল করিয়া দেশ দখল করিয়া নেয়।

আমাদের হযরতের উম্মতের মধ্যে যেহেতু আর নবী হইবে না, সেজন্য উম্মতের যিম্মায়ই আমর বিল মা'রূফ ও নাহী আনিল মুনকারের দায়িত্ব ন্যস্ত হইয়াছে। খোলাফায়ে রাশেদীনগণের দ্বারা একসঙ্গে রাজত্বের খেদমতও হইয়াছে, ইসলামের খেদমতও হইয়াছে। অন্যান্য বাদশাহরা ভোগ-বিলাসে মত্ত রহিয়াছে। শুধু তাই নয়, অধিকন্তু কোন কোন মুসলমান বাদশাহ এমন হইয়াছে যে, হক মাসআলা বাতানোর কারণে হক্কানী আলেমদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করিয়াছে কিন্তু হক্কানী আলেমগণ হক শরীয়তের হক কথা বলা হইতে বিরত থাকেন নাই।

আমাদের ইমাম আযম, ইমাম আবূ হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনজন বাদশাহর যামানা পাইয়াছেন। বাদশাহগণ তাহাকে চীফ জাস্টিসের পদ অফার (পেশ) করিয়াছে কিন্তু যেহেতু বাদশাহরা নিজেদের স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছিল- সেজন্য ইমাম সাহেব জেলের কষ্ট ভোগ করিয়াছেন। কোড়া মারিয়া তার পবিত্র পৃষ্ঠদেশকে ক্ষত- বিক্ষত করা হইয়াছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত জেলের মধ্যে তাহাকে বিষ পান করাইয়া হত্যা করিয়া ফেলা হইয়াছে। তবু বাতিল হুকুমতের চীফ জাস্টিসের পদ গ্রহণ করেন নাই। কারণ তিনি জানিতেন যে, ঐসব বাদশাহদের মতের বিরুদ্ধে বিচার করার মত স্বাধীনতা তাহাকে তাহারা দিবে না। মনসূর বাদশাহ ইমাম মালেককে হাদীস বর্ণনা করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন। ইমাম মালেক রহ. হাদীস থেকে বিরত থাকেন নাই, সেজন্য বাদশাহর তরফ হইতে তাহাকে কোড়া মারা হইয়াছে। তা সত্ত্বেও তিনি সত্য হাদীস বর্ণনা হইতে বিরত থাকেন নাই। কেননা অন্য হাদীসে আছে, সত্য হাদীসের ইলম জানা থাকলে প্রশ্নের উত্তর না দিলে তাকে সত্য গোপন করার কারণে আগুনের লাগাম পরানো হইবে। ইমাম মালেক রহ. রাসূলের শরীয়তের পক্ষ পরিত্যাগ করিয়া সরকার পক্ষ অবলম্বন করেন নাই।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের সঙ্গে মামুনুর রশীদ বাদশাহর বাতিল মত গ্রহণ করার কারণে মতবিরোধ হয়। মামুনুর রশীদ বাদশাহ বলে কুরআন সৃষ্ট, অথচ এটা সম্পূর্ণ বাতিল কথা। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল সত্যের উপর দৃঢ় থাকেন। তিনি সর্বদা বলতে থাকেন- কুরআন আল্লাহর কালাম, আল্লাহর বাণী, আল্লাহর বাণী অনদি-অসৃষ্ট। আল্লাহর বাণী সৃষ্ট হইতে পারে না। তিনজন বাদশাহ মামুনুর রশীদ, মু'তাসিম বিল্লাহ, ওয়াসিফ বিল্লাহ পরপর ২৮ মাস যাবৎ তাহাকে জেলে নির্যাতন করিতে থাকে। দৈনিক উলঙ্গ পিঠে ১০টা করিয়া কোড়া মারিতে থাকে। পৃষ্ঠদেশ থেকে ছলছল করিয়া রক্ত বাহির হইতে থাকে, তবুও তিনি এক মুহূর্তের জন্যও হক মাসআলা বলিতে একটুও ভীত হন নাই বা ত্রুটি করেন নাই। চতুর্থ বাদশাহ মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ আসিয়া তাহার গৌরবান্বিত ভূমিকায় মুগ্ধ হইয়া তাহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাহাকে রেহাই দান করেন।

মোঘল বংশীয় দিল্লীর সম্রাট আকবর দুইজন সরকার ঘেঁষা, অর্থলোভী আলেমের সহায়তায় পবিত্র শরীয়তের অনেক মাসআলা পরিবর্তন করিয়া ফেলে। এমনকি শরীয়তে মুহাম্মাদিয়াকে একেবারে বাতিল করিয়া দীনে ইলাহী জারি করিতে চেষ্টা করে। আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর বাদশাহও বাপের অনুকরণ করে। হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি আকবর ও জাহাঙ্গীরের বাতিল মতবাদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দণ্ডায়মান হন। জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানীকে দরবারে ডাকাইলেন। তিনি দরবারে আসিয়া মাথা নত না করিয়া, কুর্নিশ না করিয়া রাসূলের সুন্নাত অনুসারে 'আসসালামু আলাইকুম' বলিলেন। এ অপরাধে জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানীকে গোয়ালিয়রের জেলে কয়েদী করিয়া পাঠাইয়াছিল। মুজাদ্দিদে আলফেসানী ছয় মাস জেলে কয়েদ ভোগ অবস্থায় কয়েদীদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ করা আরম্ভ করিলেন। ছয় মাস পর জেল মালিক হিন্দু রাজা জাহাঙ্গীর বাদশাহর নিকট রিপোর্ট পাঠাইল, 'আপনি এমন একজন কয়েদী জেলে আটকাইয়াছেন, যাহার প্রচারের ফলে এবং তাহার নৈতিক-আধ্যাত্মিক বলে জেলের পশুগুলি সব মানুষ এবং মানুষগুলি সব দেবতা ও ফেরেশতা হইয়া গিয়াছে'।

এই রিপোর্টে মুগ্ধ হইয়া জাহাঙ্গীর বাদশাহ হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং বাতিল মতবাদ থেকে তওবা করেন। হক্কানী আলেমদের বাতিল রাজ-শক্তির দ্বারা এই নির্যাতন ভোগ করার নযীর অনেক রহিয়াছে। আবার লোভী, স্বার্থপর, সরকার ঘেঁষা আলেম নামধারী, আলেম নামে কলঙ্ক লেপনকারীদের সংখ্যারও অভাব নাই। আসল জিনিস দেখতে হইবে যে, এ সম্পর্কে আল্লাহ এবং রাসূল কী ফয়াসালা দিয়াছেন।

আল্লাহর ফয়সালা বলআম বাউরার ঘটনার মধ্যে উল্লেখ করিয়াছি। এখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরকার ঘেঁষা আলেম, পীর নামধারীদের সম্পর্কে কী বলিয়া গিয়াছেন? কী হিদায়াত দান করিয়া গিয়াছেন? সেই সম্পর্কে কিছু সংখ্যক হাদীস পাঠকদের সামনে উদ্ধৃত করিতেছি।

ألا إن شر الشر شرار العلماء وإن خير الخير خيار العلماء مشكاة المصابيح ٥٧/١

অর্থ : আলেম- যাহারা সৎ আলেম, তাহাদের চেয়ে ভালো, নবীদের পরে মানব সমাজের মধ্যে আর কেউই নাই। কিন্তু আলেম হয়ে যদি অসৎ আলেম হয় অর্থাৎ বে-আমল অর্থাৎ লোভী হয় তবে সেইরূপ আলেমের চাইতে নিকৃষ্ট ও খারাপ আর কেউই নাই। সমস্ত মানব জাতির মধ্যে তাহারাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং সবচেয়ে খারাপ।

এইরূপ খারাপ আলেমদের হাদীসের ভাষায় علماء سوء 'উলামায়ে ছু' অর্থাৎ অসৎ আলেম বলা হইয়াছে। তাহাদের যে ভীষণতম আযাব হইবে এ কথাও হাদীসে পরিষ্কার বলা হইয়াছে এবং মুসলিম সরকারকে এবং মুসলিম জনসাধারণকে তাহাদের থেকে সতর্ক থাকার জন্য এবং তাহাদের থেকে দূরে থাকার জন্য অতি কঠোর ভাষায় সতর্কবাণী দান করা হইয়াছে। দয়ার নবী হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব কথাই আমাদের আগের থেকেই বাতাইয়া গিয়াছেন।

হাদীসে হযরত বলিয়াছেন,

من قرأ القرآن وتفقه في الدين ثم أتى صاحب سلطان طمعا لما في يديه طبع الله على قلبه وعذب كل يوم بلونين من العذاب لم يعذب به قبل ذلك. كنز العمال ٣٩/١٤ 

অর্থ : যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করিয়া এবং কুরআন-হাদীসের বিদ্যার গভীর জ্ঞান হাসিল করিয়া সরকার থেকে কিছু পাওয়ার লোভে সরকারি দরবারে যাতায়াত করবে অর্থাৎ সরকার ঘেঁষা হইবে, আল্লাহ তা'আলা তাহার দিলের উপর মোহর মারিয়া দিবেন এবং তাহাকে দৈনিক এমন দুই প্রকার সাংঘাতিক শাস্তি ও আযাব দেওয়া হইবে, যা তাহার পূর্বে অন্য কাউকে দেওয়া হয় নাই, তাহার পূর্বে এত বড় আযাব আর কখনো হয় নাই।

হাদীসে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন,

 العلماء أمناء الرسل على عباد الله ما لم يخالطوا السلطان ويداخلوا الدنيا فإذا خالطوا السلطان و داخلوا الدنيا فقد خانوا الرسل فاحذروهم واعتزلوهم. كنز العمال للمتقي الهندي ۳۷۱/۱۰

অর্থ: আলেমগণ প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে আল্লাহর বান্দাদের জন্য আমানত গচ্ছিত গ্রহণকারী। কিন্তু যে আলেমগণ আলেম হওয়া সত্ত্বে দুনিয়ার লোভে সরকারের দরবারে যাতায়াত করবে এবং টাকার লোভী হইবে, সেই সমস্ত আলেমগণ আলেম হওয়া সত্ত্বেও রাসূলের আমানতে খেয়ানতকারী প্রমাণিত হইবে। অতএব হে মুসলিম সরকার! ওহে মুসলিম জনসাধারণ! তোমরা সকলেই এই ধরণের আলেম থেকে সতর্ক থাকিও এবং তাহাদের থেকে অতি সতর্কতার সহকারে দূরে থাকিও।

হযরত বড় পীর সাইয়িদুনা আব্দুল কাদের জিলানী রহ. উলামায়ে ছু সম্বন্ধে বলিতেছেন,

ويل لأمتي من علماء السوء يتخذون هذا العلم تجارة يبيعونها من أمراء زمانهم ربحا لأنفسهم لا أربح الله تجارتهم. (كنز العمال ٤٠/١٤

অর্থ : হে যুবক ভাইগণ! আল্লাহ ধৈর্য ধারণ করিতেছেন। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল। সেই জন্যই আল্লাহ যখন তখন ধরপাকড় করিতেছেন না; তিনি যখন পাকড়াও করিবেন, তাঁহার পাকড়াও হইবে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।

কতকগুলি লোক আছে আলেম নামধারী,তাহারা আল্লাহর হুকুম-আহকামের ইলম ও জ্ঞান কিছুটা হাসিল করিয়াছে বটে কিন্তু আল্লাহর জ্ঞান হাসিল করে নাই, আল্লাহকে চিনে নাই, আল্লাহর মারেফাত তাহারা পায় নাই; তাহারা অন্য লোকদেরে অসৎ কাজ করিতে নিষেধ করে কিন্তু নিজেরা অসৎ কাজ হইতে বিরত থাকে না, তাহারা অন্য লোকদেরকে আল্লাহর দিকে আসার জন্য দাওয়াত দেয়, উৎসাহ দেয় কিন্তু নিজেরা আল্লাহর থেকে দূরে ভাগিয়া থাকে, আল্লাহর সামনে আল্লাহর নাফরমানী কাজ করে, বড় বড় গুনাহের কাজও করে, তাহাদের নাম সব আমার কাছে তারিখওয়ার লেখা আছে। খবরদার! তাহাদের কারণে আপনারা ধোঁকা খাইবেন না, ধোঁকায় পড়িবেন না। হে খোদা! আমারও গুনাহ মাফ করিয়া দাও, তাহাদেরও গুনাহ মাফ করিয়া দাও।

হে যুবক বন্ধুগণ! আপনারা আল্লাহকে এবং আল্লাহর খাঁটি আলেম ও আউলিয়াগণকে চিনিতে পারেন নাই। সেই জন্যই হয়ত আল্লাহর শানে এবং আল্লাহর খাঁটি আলেম ও আউলিয়াগণের শানে কটুক্তি করিতেছেন। কিন্তু সাবধান! আমার কথা শুনুন এবং নিজেদের জীবন গঠন করুন। নিশ্চয় জানিবেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই সত্য, আল্লাহ মিথ্যা নন। আমরা তাঁহার সৃষ্টি। আল্লাহ মানুষকে একটি কলব রূহ (বিবেক) ও একটি নফসও (মন) দান করিয়াছেন। বিবেকের মধ্যে থাকে সত্য এবং আল্লাহর গুপ্ত রহস্যাবলী এবং আল্লাহর কালামের সত্য অর্থাবলী এবং নফসের মধ্যে এবং মনের মধ্যে থাকে আল্লাহ বিরোধী নানাপ্রকার কু-প্রবৃত্তি, কুসংস্কার এবং কু-অভ্যাসাদি। এই কলবও যাবৎ পর্যন্ত অনাদি, অনন্ত, চির- জীবন্ত, সর্বশক্তিমান আল্লাহর সঙ্গে শক্ত এবং শক্তিশালী যোগাযোগ স্থাপন না করিতে পারিবে, তাবৎ পর্যন্ত সে কিছুতেই নাজাত এবং মুক্তি লাভ করিতে পারিবে না।

আশ্চর্য আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য, একই মুখ দিয়া বাহির করা হয় কথা। নফসের মিথ্যা কথা এবং রূহের সত্য কথা একই মুখ দিয়া বাহির হয়। সৎ লোকেরও যেমন একখানা মুখ; চোরের, ধোঁকাবাজেরও তদ্রূপ একখানা মুখই থাকে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! চিনার উপায় কী? হে ভাইগণ! চিনবার জন্য কোন উপায় নাই, অন্য কেউ চিনলেও তাহাতে তোমার কোন ফায়দা নাই। তোমারই চিনিতে হইবে কুরআন ও হাদীসের আলোতে। তুমি একা একা বসিয়া এক আল্লাহকে হাজির-নাজির জানিয়া গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখ, তুমি কার দাসত্ব করিতেছ? তোমার মধ্যে হুব্বে মাল, হুব্বে রিয়াসাত আছে কি না? না মালের দাসত্ব, নফসের দাসত্ব, প্রবৃত্তির দাসত্ব করিয়া মাল চাহিতেছ? উত্তম খানা, উত্তম পোশাক, উত্তম বিল্ডিং, উত্তম ফার্ণিচার, উত্তম ব্যাংক-ব্যালান্স, উত্তম উপাদেয়- মিষ্টি খাদ্য উপভোগ, গাড়ি হউক, বাড়ি হউক, সব জায়গা থেকে সম্মান আসুক, নেতৃত্ব আসুক, এই চাহিতেছ? এ তোমার মনে?

প্রশ্নের উত্তর আমাকে দেওয়ার দরকার নাই। গভীর রাত্রে একা একা বসিয়া চিন্তা কর, এ প্রশ্নের উত্তর আলিমুল গায়েব আল্লাহর দরবারে, আলিমুল গায়েব আল্লাহকে দিতে পারিবা কি না? যদি আল্লাহকে উত্তর দিতে পার যে, তুমি খাঁটি আল্লাহর বান্দা, তবে তো তুমি মুমিন, নতুবা মুনাফিক। আমি তোমাকে মুনাফিক বলিতেছি না, তুমি নিজের বিচারে, আল্লাহর বিচারে মুনাফিক।

সত্য-নির্মল কলব ও বিবেক অনবরত সমস্ত সৃষ্টিকে বাদ দিয়া তাহাদিগকে পাছে ফেলিয়া স্রষ্টার দিকে দ্রুতগতিতে ধাবিত হইতে এবং সফর করিতে থাকে। পথিমধ্যে অনেক রকমের মোহ তাহাকে টানিয়া ধরে, কিন্তু সে সবাইকে সালাম করিয়া (এড়াইয়া) আগে চলে যায়, কারোর দিকে সে ফিরে চায় না, কেউ তাহার পথে বাধা দিতে পারে না।

যাহারা উলামায়ে হক্কানী, তাহারা তাহাদের ইলম অনুযায়ী আমল করেন। তাহারাই প্রকৃত প্রস্তাবে নায়েবে নবী, সালাফে সালেহীনদের কায়েম মাকাম এবং কালের শ্রেষ্ঠতম মানুষ। তাহাদের ব্যক্তিগত, স্বার্থগত কোন মকসূদ থাকে না, তাহাদের একমাত্র মকসূদ থাকে আল্লাহর দ্বীন জারি, নবীর শরীয়ত জারি।

সেজন্য তাহারা জীবনের উপর বিপদ আসিলেও জীবনভর কাহারো পরোয়া না করিয়া আমর বিল মা'রূফ (সৎ কাজের আদেশ) ও নাহী আনিল মুনকার (বদ কাজে নিষেধ) করিতে থাকে।

আল্লাহ উলামায়ে ছু'র উদাহরণ দিয়াছেন কুত্তার সঙ্গে এবং গাধার সঙ্গে।

আলেম খাঁটি কি না চিনিবার আর একটি আলামত এই যে, আলেম খাঁটি হইলে তাহার ইলম যত বাড়িবে, ততই তাহার ভয় বাড়িবে এবং আল্লাহর ফরমাঁবরদারী বাড়িবে। যাহাদের আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন বাড়িবে না, আল্লাহর ভয়ে সন্দেহের জিনিসের থেকে বাঁচিয়া থাকার পরহেযগারী বাড়িবে না, আল্লাহর ভয়ে নিজের ভুল স্বীকার বাড়িবে না, আল্লাহকে রাজি করার কষ্ট করা বাড়িবে না, বার বার আল্লাহর ভয়ে ক্ষমা প্রার্থনা বাড়িবে না, নফসকে শাস্তি দেওয়া বাড়িবে না, নফসের সঙ্গে কঠোর জিহাদ বাড়িবে না, নফসকে আদব শিক্ষা দেওয়া এবং অনবরত মুজাহাদা করা বাড়িবে না এবং আল্লাহর নূর হাসিল করার জন্য অনবরত কষ্টের জীবন-যাপনের স্পৃহা বাড়িবে না, নফসের সঙ্গে, শয়তানের সঙ্গে দুশমনী করা বাড়িবে না, পক্ষান্তরে বাড়িবে এই চিন্তা- কাপড় ভালো হউক, খানা-পিনা ভালো হউক, কুরছি-চেয়ার ভালো হউক, লেবাস-পোশাক ভালো হউক, হছব-নছব ভালো ও বড় মানুষের সঙ্গে হউক, বড় লোকদের সঙ্গে উঠা-বসার সুযোগ হউক, পার্টিতে দাওয়াত হউক। তবে বুঝা যাইবে যে, সে আর আলেমে হক্কানী নাই- সে আলেমে ছু অর্থাৎ অসৎ হইয়া গিয়াছে। হে ভাই! এসব জিনিসের চিন্তা তুমি নিজের থেকে দূর করিয়া দাও।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

একটি প্রচলিত বর্ণনা : একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর

...

মাওলানা আবু হাসসান রাইয়ান
৫ নভেম্বর, ২০২৪
১১২৩ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →