প্রবন্ধ
শরয়ী বিধানে প্রাণীর ছবি (পর্ব এক)
প্রথমদিকে মানুষ তাদের সমাজের নেক ও সৎ লোকদের ভাস্কর্য বানাতো, চিত্র তৈরি করতো।
কালক্রমে সেটাই তাদের পূজনীয় বস্তুতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ইমাম বুখারী রহ. قوله تعالى ودا ولا سواعا ولا يغوث ويعوق অধ্যায়ে ইবনে আব্বাস রাযি. বর্ণিত একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন- 'ওয়াদ্দা', 'সু য়া'আ', 'ইয়াগুছ', 'ইয়াউক' মূলত নূহ সম্প্রদায়ের সৎ লোকদের নাম। তাদের মৃত্যুর পর তাদের নামে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের জন্য শয়তান নূহ সম্প্রদায়কে প্ররোচিত করলো (যেন তাদের দেখে ইবাদতের কথা স্মরণ হয়) তারা তাই করল। যখন সৎ উদ্দেশ্যে ভাস্কর্য স্থাপনকারী এসব লোক দুনিয়া থেকে চলে গেল পরবর্তী প্রজন্ম মূল উদ্দেশ্য ভুলে গেল এবং এগুলোরই পূজা করা শুরু করে দিল। (বুখারী শরীফ; হা. ৪৯২০)
তাফসীরে তাবারীতে আছে, এরা হযরত নূহ আ. এর যুগেরও পূর্বে হযরত আদম আ. এর সন্তানদের মধ্য থেকে ছিল। তারা ছিল সৎ ও নেককার। তাদের মৃত্যুর পর অনুসারীরা ইবাদতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির জন্য তাদের চিত্র তৈরি করে রাখার সিদ্ধান্ত নিল এবং তাই করল। যখন এই স্তরের সবাই দুনিয়া থেকে চলে গেল, শয়তান পরবর্তী প্রজন্মকে বোঝালো যে, পূর্ববর্তীরা এই ছবিগুলোরই ইবাদত করতো। তাদের ওসিলায় বৃষ্টি বর্ষিত হতো। (তোমরাও তাদের ইবাদত করো যাতে কল্যাণ লাভ করতে পারো)। লোকেরা এরপর এগুলোরই ইবাদত শুরু করে দিল। (তাফসীরে তাবারী ১৯/১১৮) হাফেয ইবনে কাসীর রহ. সূরা নূহ এর ১৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ছবি-ভাস্কর্য এবং মূর্তি বানানোর ব্যাপারে বিভিন্ন রেওয়ায়েত এনে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর-৮/২০৮)
পূর্ববর্তী শরীয়তে ছবির হুকুম
হাফেয ইবনে হাজার রহ. বলেন,
أن ذلك كان جائزا في تلك الشريعة وكانوا يعملون أشكال الأنبياء والصالحين منهم على هيئتهم في العبادة ليتعبدوا كعبادتهم وقد قال أبو العالية لم يكن ذلك في شريعتهم حراما ثم جاء شرعنا بالنهي عنه.
কারও কারও মতে এগুলো (চিত্র এবং ভাস্কর্য) পূর্ববর্তীদের শরীয়তে বৈধ ছিল। তারা নবীদের এবং নেককার লোকদের ইবাদতের ধরন ও আকৃতি অনুযায়ী ছবি, ভাস্কর্য তৈরি করত যেন তা দেখে দেখে হুবহু তাদের মত ইবাদত করতে পারে। আবুল আলিয়াহ বলেন, পূর্ববর্তীদের শরীয়তে এগুলো হারাম ছিল না।
শরীয়তে মুহাম্মাদীতে ছবির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছে। (ফাতহুল বারী ১০/৪৬৭, তাফসীরে কাশশাফ ৩/৫৫৫) সূরা সাবা এর ১৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু বকর আল-জাসসাস (মৃত্যু-৩৭০হি.) বলেন,
يدل على أن عمل التصاوير كان مباحا وهو محظور في شريعة النبي صلى الله عليه وسلم.
অন্যান্য শরীয়তে তাসবীর বানানো বৈধ ছিল। কিন্তু শরীয়তে মুহাম্মাদীতে তা হারাম। (আহকামুল কুরআন ৩/৫৮৪)
মুফতী শফী রহ. লিখেছেন,
تصاویر کی حرمت شریعت اسلامیہ محمدیہ کا مخصوص حکم ہے ، پہلے انبیاء کی شریعتوں میں تصاویر ممنوع نہیں تھیں، جیسا کہ قرآن کریم حضرت سلیمان کے قصہ میں ان کے حکم سے جنات کا تصاویر بنانا مذکور ہے ، یعملون له ما يشاء من محاريب وتماثيل .... اور ہجرت سے پہلے شریعت اسلامیہ میں تصاویر کی حرمت کا ثبوت نہیں ہے، ہجرت کے بعد احکام حرمت کے آئے ہیں۔
ছবি হারাম হওয়া শরীয়তে মুহাম্মাদীর বিশেষ হুকুম। পূর্ববর্তী নবীদের শরীয়তে ছবি নিষিদ্ধ ছিল না। তদ্রূপ হিজরতের পূর্বে ইসলামী শরীয়তে ছবি হারাম হওয়ার কোন প্রমাণ নেই। হিজরতের পরই মূলতঃ ছবি হারাম হয়। (তাসবীর কে শরয়ী আহকাম; পৃষ্ঠা-১২)
তবে অপর এক বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, পূর্ববর্তী শরীয়তেও চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য তৈরি হারাম ছিল। ইমাম বুখারী রহ. হযরত আয়েশা রাযি. এর সূত্রে বর্ণনা করেন,
أَنَّ أُمَّ حَبِيبَةَ، وَأُمَّ سَلَمَةَ ذَكَرَتَا كَنِيسَةً رَأَيْنَهَا بِالحَبَشَةِ فِيهَا تَصَاوِيرُ، فَذَكَرَتَا لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: «إِنَّ أُولَئِكَ إِذَا كَانَ فِيهِمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ فَمَاتَ، بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا، وَصَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّوَرَ، فَأُولَئِكَ شِرَارُ الخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ القِيَامَةِ»
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তাদের কোন পূণ্যবান লোক মারা গেলে তারা তার কবরের উপর ইবাদতখানা নির্মাণ করত এবং তাতে প্রতিকৃতি স্থাপন করত। এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি। (সহীহ বুখারী; হা. ৪২৭)
হাফেয ইবনে হাজার রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন,
فإن ذلك يشعر بأنه لو كان ذلك جائزا في ذلك الشرع ما أطلق عليه صلى الله عليه وسلم أن الذي فعله شر الخلق فدل على أن فعل صور الحيوان فعل محدث أحدثه عباد الصور
এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, যদি তাদের শরীয়তে ছবি জায়েযই হত তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিকৃতি স্থাপনকারীদেরকে নিকৃষ্ট সৃষ্টি আখ্যায়িত করতেন না। হাদীস থেকে বোঝা গেল, চিত্রাঙ্কন, প্রতিকৃতি তৈরি এটা ছবি পূজারীদেরই আবিষ্কার। আর সূরা সাবা এর ১৩ নং আয়াতে 'তামাছীল' দ্বারা উদ্দেশ্য প্রাণহীন বস্তুর ছবি। (ফাতহুল বারী ১০/৪৬৮) আল্লামা যামাখশারী রহ. (মৃত-৫৩৮ হি.) লিখেন, ويجوز أن يكون غير صور الحيوان كصور الأشجار وغيرها. সূরা সাবা এর ১৩ নং আয়াতে 'তামাছীল' দ্বারা উদ্দেশ্য হতে পারে প্রাণহীন বস্তুর ছবি। যেমন, গাছ-গাছালি ইত্যাদির ছবি। (তাফসীরে কাশ্শাফ ৩/৫৫৫)
বাইবেলে এখনো পর্যন্ত প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরির নিষিদ্ধতার হুকুম বিদ্যমান রয়েছে।
'Do not make for your selves images of anything in heaven or on earth or in the water under the earth. (HOLY BIBLE (Good news Bible) p. 80. The Bible society of India)
মুফতী তাকী উসমানী দা.বা.তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম (৪/৯৬) -এ তাওরাত থেকে উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন,
جاء في سفر التثنية لئلا تفسدوا وتعملوا لأنفسكم تمثالا منحوتا صورة مثال ما شبه ذكر أو انثى... الخ
যাতে তোমরা ফাসাদ সৃষ্টি না করো এবং খোদাইকৃত প্রতিকৃতি তৈরি না করো যা ছেলে-মেয়ের আকৃতি সদৃশ। মোটকথা, পূর্ববর্তী উম্মতের জন্য আকৃতি বানানো, চিত্রাঙ্কন করা, ভাস্কর্য তৈরি করা হারাম হওয়ার ব্যাপারে মজবুত দলীল রয়েছে।
চিত্রাঙ্কন ও প্রতিকৃতি তৈরির ব্যাপারে হাদীসের ভাষ্য
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إن الذين يصنعون هذه الصور يعذبون يوم القيامة ويقال لهم : أحيوا ما خلقتم.
যারা প্রাণীর ছবি প্রস্তুত করে তাদেরকে কিয়ামতের দিন আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। তাদেরকে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার করো। (সহীহ বুখারী; হা.৫৯৫১, সহীহ মুসলিম; হা.২১০৮) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إن أشد الناس عذابا عند الله يوم القيامة المصورون
কিয়ামত দিবসে ছবি অঙ্কনকারীদের কঠিনতম শাস্তি হবে। (সহীহ বুখারী; হা.৫৯৫০, সহীহ মুসলিম; হা.২১০৯)
আবু যুর'আ রহ. বলেন, دخلت مع أبي هريرة في دار مروان فرأى فيها تصاوير আমি আবু হুরায়রা রাযি. এর সঙ্গে মারওয়ানের গৃহে প্রবেশ করলাম। সেখানে কিছু চিত্র তার দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,
ومن أظلم ممن ذهب يخلق كخلقي فليخلقوا حبة وليخلقوا ذرة أو ليخلقوا حبة أو ليخلقوا شعيرة
ঐ লোকের চেয়ে বড় যালেম আর কে যে আমার সৃষ্টির মতো কোন কিছু সৃষ্টি করতে চায়। (তাদের যদি সামর্থ্য থাকে তবে) সৃষ্টি করুক একটি কণা, একটি শস্য কিংবা একটি যব। (সহীহ বুখারী; হা.৫৯৫৩, সহীহ মুসলিম; হা.২১১১)
সাঈদ ইবনে আবুল হাসান রহ. বলেন,
كنت عند ابن عباس رضي الله عنهما إذ أتاه رجل فقال يا أبا عباس إني إنسان إنما معيشتي من صنعة يدي وإني أصنع هذه التصاوير فقال ابن عباس لا أحدثك إلا ما سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول سمعته يقول من صور صورة فإن الله معذبه حتى ينفخ فيها الروح وليس بنافخ فيها أبدا. قربا الرجل ربوة شديدة واصفر وجهه فقال ويحك إن أبيت إلا أن تصنع فعليك بهذا الشجر كل شيء ليس فيه روح
আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. এর কাছে বসা ছিলাম। ইতোমধ্যে এক ব্যক্তি এসে তাকে বললো, হে ইবনে আব্বাস! আমি একজন হস্তশিল্পী। হাতে তৈরি প্রতিকৃতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করি। (এই পেশা কি বৈধ?) হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. বললেন, আমি শুধু তোমাকে সে কথাই বলবো যা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে শুনেছি। আমি তাকে বলতে শুনেছি, যে কেউ কোন প্রতিকৃতি তৈরি করে আল্লাহ তা'আলা তাকে আযাব দিবেন যে পর্যন্ত না সে তাতে প্রাণ দান করে। অথচ সে প্রাণ দান করতে পারবে না। এ কথা শুনে সে অস্থির হয়ে পড়ল এবং তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তখন হযরত ইবনে আব্বাস বললেন, যদি তৈরি করতেই হয় তবে প্রাণহীন বস্তুর প্রতিকৃতি তৈরি করবে। (সহীহ বুখারী; হা.২২২৫)
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন,
أن النبي صلى الله عليه و سلم لم يكن يترك في بيته شيئا فيه تصاليب إلا نقضه وفي نسخة تصاوير.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঘরে ছবি অঙ্কিত কিছু দেখলে তা বিনষ্ট করে দিতেন। (সহীহ বুখারী; হা. ৫৯৫২)
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
يخرج عنق من النار يوم القيامة له عينان يبصر بهما وأذنان يسمع بهما ولسان ينطق به فيقول إني وكلت بثلاثة بكل جبار عنيد وبكل من ادعى مع الله إلها آخر والمصورين إسناده صحيح على شرط الشيخين.
কিয়ামত দিবসে জাহান্নাম থেকে একটি গর্দান বের হবে তার দু 'টি চক্ষু হবে যা দ্বারা দেখবে, দু 'টি কান হবে যা দ্বারা শুনবে, জিহ্বা থাকবে যা দ্বারা কথা বলবে। সে বলবে, আমাকে তিন ব্যক্তির (শাস্তির) দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে, (১) প্রত্যেক অবাধ্য স্বেচ্ছাচারী, (২) যে আল্লাহ তা'আলার সাথে অন্য ইলাহকে শরীক করে (৩) ছবি অঙ্কনকারী। (মুসনাদে আহমদ; হা.৮৪৩০, সুনানে তিরমিযী; হা. ২৫৭৪, বাইহাকী ফী শু'আবিল ঈমান; হা.৬৩১৭)
ঘরে ছবি রাখা বা টানানোর ব্যাপারে হাদীসের ভাষ্য
হযরত আবু ত্বলহা রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لا تدخل الملائكة بيتا فيه كلب ولا صورة
ঐ গৃহে রহমতের ফেরেশতারা প্রবেশ করে না যাতে কুকুর বা ছবি রয়েছে। (সহীহ বুখারী; হা. ৩২২৫, সহীহ মুসলিম; হা. ২১০৬)
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. বলেন,
وعد النبي صلى الله عليه وسلم جبريل فراث عليه حتى اشتد على النبي صلى الله عليه وسلم فخرج النبي صلى الله عليه وسلم فلقيه فشكا إليه ما وجد فقال له إنا لا ندخل بيتا فيه صورة ولا كلب
একবার হযরত জিবরাইল আ. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিশ্রুত সময়ে তিনি আসছিলেন না। এতে নবীজীর কষ্ট হচ্ছিল। তিনি বেচইন হয়ে বাইরে বের হলেন। তখন জিবরাইল আ. এর সঙ্গে তার সাক্ষাত হল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কষ্ট পেয়েছেন বলে অভিযোগ করলেন। তাকে তখন জিবরাইল আ. বললেন, আমরা এমন ঘরে প্রবেশ করি না যাতে কোন প্রাণীর ছবি থাকে বা কুকুর থাকে। (সহীহ বুখারী; হা. ৫৯৬০)
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لا تدخل الملائكة بيتا فيه تماثيل أو تصاوير
ফেরেশতারা ঐ ঘরে প্রবেশ করে না যাতে মূর্তি বা ছবি রয়েছে। (সহীহ মুসলিম; হা.২১১২)
হযরত জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত,
نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الصورة في البيت ونهى أن يصنع ذلك
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে ছবি রাখতে এবং তা তৈরি করতে নিষেধ করেছেন। (সুনানে তিরমিযী; হা.১৭৫৩)
যারা প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরি করে তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের লা'নতে পতিত হয় এবং তারা আল্লাহ তা'আলার নিকৃষ্টতম মাখলুক
যারা প্রতিকৃতি তৈরি করে কিংবা চিত্রাঙ্কন করে তাদের ব্যাপারে হযরত আয়েশা রাযি. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, أولئك شرار الخلق عند الله এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি। (সহীহ বুখারী; হা. ৪২৭)
হযরত আবু জুহাইফা রাযি. বলেন,
إن النبي صلى الله عليه و سلم نهى عن ثمن الدم وثمن الكلب وكسب البغى ولعن آكل الربا وموكله والواشمة والمستوشمة والمصور
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষিদ্ধ করেছেন রক্তের মূল্য, কুকুরের মূল্য এবং ব্যভিচারের দ্বারা উপার্জিত অর্থ। আর লা'নত করেছেন সুদ ভক্ষণকারী ও সুদ প্রদানকারীর উপর, উল্কি অঙ্কনকারী ও উল্কি গ্রহণকারীর উপর এবং প্রতিকৃতি প্রস্তুতকারীর উপর। (সহীহ বুখারী; হা. ৫৯৬২, সুনানে আবু দাউদ; হা. ৩৪৮৩)
হযরত ইকরামা রহ. বলেন,إن الذين يؤذون الله ورسوله ..... (যারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে কষ্ট দেয় আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের উপর লা'নত করেছেন।) এই আয়াত দ্বারা ছবি অঙ্কনকারী উদ্দেশ্য। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হা.২৫৭২৪, আত-তামহীদ ৮/৫২৭, হিলয়াতুল আউলিয়া ৩/৩৩৮)
বসা বা হেলান দেয়ার বস্তুতে ছবি অঙ্কন করাও হারাম
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন,
عن عائشة رضي الله عنها: أنها اشترت نمرقة فيها تصاوير فقام النبي صلى الله عليه وسلم بالباب فلم يدخل فقلت أتوب إلى الله مما أذنبت قال ما هذه النمرقة. قلت لتجلس عليها وتوسدها قال إن أصحاب هذه الصور يعذبون يوم القيامة يقال لهم أحيوا ما خلقتم وإن الملائكة لا تدخل بيتا فيه الصور
তিনি একটি গদি বা তাকিয়া ক্রয় করেছিলেন, যাতে ছবি অঙ্কিত ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দেখে দরজায় দাড়িয়ে গেলেন। ভেতরে প্রবেশ করলেন না। আয়েশা রাযি. বলেন, আমি বললাম, আল্লাহর কাছে তওবা করছি (একটু বলবেন,) আমার কী অপরাধ? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা কেমন গদি! আমি বললাম, আপনার বসা ও হেলান দেয়ার জন্য! নবীজী বললেন, এমন ছবিওয়ালাদেরকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা যা সৃষ্টি করেছ তাতে প্রাণ সঞ্চার করো। আর ফেরেশতারা ঐ গৃহে প্রবেশ করেন না যাতে প্রাণীর ছবি থাকে। (সহীহ বুখারী; হা. ২১৫০)
'সুরত' ও 'তিমছাল' এর অর্থ
ছবি সম্পর্কিত হাদীসগুলোতে কোথাও 'সূরত' শব্দটি এসেছে, কোথাও এসেছে 'তিমছাল'। আল্লামা আইনী রহ.বলেন,
قيل لا فرق بين الصورة والتمثال والصحيح أن بينهما فرقا (1) وهو أن الصورة تكون في الحيوان والتمثال يكون فيه وفي غيره (2) وقيل التمثال ما له جرم وشخص والصورة ما كان رقما أو تزويقا في ثوب أو حائط
কারো কারো মতে 'সূরত' এবং 'তিমছাল' এর মধ্যে অর্থগত কোন পার্থক্য নেই। তবে এক্ষেত্রে সঠিক কথা হলো, এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। (১) 'সূরত' বলা হয়, প্রাণীর আকৃতিকে। আর 'তিমছাল' যেমনিভাবে প্রাণীর আকৃতি বোঝায়, প্রাণহীন বস্তুর আকৃতিও বোঝায়। (২) কারো মতে 'তিমছাল' বলা হয় সেই ছবিকে যার আকার আয়তন রয়েছে। আর ছবি বলা হয় আকার আয়তনহীন চিত্র, কাপড় বা দেয়ালের কারুকাজকে। (উমদাতুল কারী ১৫/১২৪)
আল্লামা যামাখশারী রহ. লিখেন,
لأن التمثال كل ما صوّر على مثل صورة غيره من حيوان وغير حيوان. أو تصوّر محذوفة الرؤوس
কোন কিছুর সদৃশ যে ছবি অঙ্কন করা হয় সেটাই 'তিমছাল' প্রাণীর হোক কিংবা প্রাণহীন বস্তুর। (তাফসীরে কাশ্শাফ ৩/৫৫৫)
আল্লামা ইবনুল হুমাম লিখেছেন,
في المغرب الصورة عام في ذي الروح وغيره، والتمثال خاص بمثال ذي الروح لكن المراد هنا ذو الروح، فإن غير ذي الروح لا يكره
আল-মুগরিব-এ আছে, 'সূরত' শব্দটি প্রাণী এবং প্রাণহীন উভয় ছবির ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। আর 'তিমছাল' প্রাণীর আকৃতির সাথে খাস। তবে হাদীসে উভয় শব্দ দ্বারা প্রাণীর ছবিই উদ্দেশ্য। কারণ প্রাণহীন বস্তুর ছবি হারাম না। (ফাতহুল কাদীর ১/৩৬২)
সুতরাং বোঝা গেল, হাদীসে 'তিমছাল' দ্বারা উদ্দেশ্য প্রাণীর ছবি; দেহবিশিষ্ট হোক বা না হোক।
দেহ বিশিষ্ট মূর্তি যেমন হারাম তেমনই অঙ্কিত ছবিও হারাম
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন,
قدم رسول الله صلى الله عليه وسلم من سفر وقد سترت بقرام لي على سهوة لي فيها تماثيل فلما رأه رسول الله صلى الله عليه وسلم هتكه وقال أشد الناس عذابا يوم القيامة الذين يضاهون بخلق الله قالت فجعلناه وسادة أو وسادتين
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফর থেকে ফিরলেন। আমি কক্ষের দরজায় একটি পর্দা ঝুলিয়েছিলাম যাতে ছবি অঙ্কিত ছিল। তিনি তা খুলে ফেললেন এবং বললেন, কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠিন আযাব দেয়া হবে যারা আল্লাহর সৃষ্টি-বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। উম্মুল মুমিনীন বলেন, তখন আমরা তা কেটে ফেললাম এবং একটি বা দু'টি বালিশ বানালাম। (সহীহ বুখারী; হা. ৫৯৫৪, সহীহ মুসলিম; হা.২১০৭)
মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে (হা. ২৫৭১৮) হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে,فلما رآه تغير لونه
وهتكه بيده، ثم قال: إن أشد الناس عذابا يوم القيامة الذي يشبهون بخلق الله
ছবিযুক্ত পর্দা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেল। তিনি নিজ হাতে তা ফেড়ে ফেললেন। হযরত আলী রাযি. বলেন,
صنعت طعاما فدعوت النبي صلى الله عليه و سلم فجاء فدخل فرأى سترا فيه تصاوير فخرج وقال إن الملائكة لا تدخل بيتا فيه تصاوير
আমি খাবার তৈরি করলাম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত করলাম। তিনি ঘরে প্রবেশ করে একটি পর্দা দেখতে পেলেন যাতে ছবি অঙ্কিত ছিল। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন এবং বললেন, ফেরেশতারা ঐ ঘরে প্রবেশ করেন না যাতে ছবি রয়েছে। (সুনানে নাসাঈ; হা. ৫৩৫১) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত,
أن النبي صلى الله عليه و سلم لما رأى الصور في البيت يعني الكعبة لم يدخل وأمر بها فمحيت ورأى إبراهيم وإسماعيل عليهما السلام بأيديهما الأزلام فقال قاتلهم الله والله ما استقسما بالأزلام قط
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল্লাহয় বিভিন্ন প্রতিকৃতি দেখে তাতে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং সেগুলো বিলুপ্ত করার আদেশ দিলেন। তার আদেশে সেগুলো মুছে দেয়া হয়। এগুলোর মধ্যে ইবরাহীম আ. ও ইসমাঈল আ. এর প্রতিকৃতি ছিল। তাদের হাতে ছিল ভাগ্য নির্ধারণী শর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ ওদের (এগুলোর নির্মাতাদের) ধ্বংস করুন। তাদের জানা ছিল যে, এই দু'জন কখনও শর দ্বারা ভাগ্য গণনা করেননি। (মুসনাদে আহমদ; হা.৩৪৫৫)
إسناده صحيح على شرط البخاري رجاله ثقات رجال الشيخين غير عكرمة فمن رجال البخاري
উসামা রাযি. বলেন,
دخلت مع النبي صلى الله عليه وسلم الكعبة، فرأى في البيت صورة فأمرني فأتيته بدلو من الماء، فجعل يضرب تلك الصورة، ويقول
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কা'বা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলাম তখন কিছু চিত্র তার দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি এক বালতি পানি আনতে বললেন। আমি পানি উপস্থিত করলাম। তিনি পানি দ্বারা ছবিগুলো মুছতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, قاتل الله قوما يصورون ما لا يخلقون আল্লাহ তাদের বিনাশ করুন যারা এমন কিছুর ছবি অঙ্কন করে যা তারা সৃষ্টি করতে পারে না। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হা. ২৫৭২২)
হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত,
قدم رسول الله صلى الله عليه وسلم من سفر وقد سترت على بابي درنوكا فيه الخيل ذوات الأجنحة فأمرني فنزعته
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এক সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন। আমি দরজায় একটি ঝালরযুক্ত পর্দা ঝুলিয়েছিলাম। যাতে পাখাওয়ালা ঘোড়ার ছবি অঙ্কিত ছিল। তিনি তা খুলে ফেলার আদেশ দিলে আমি তা খুলে ফেললাম। (সহীহ মুসলিম; হা. ২১০৭)
উল্লেখ্য যে, (ক) ছবি নিষিদ্ধের হাদীসগুলো হাদীসের প্রায় কিতাবে এমনকি সহীহ বুখারীতেও পোশাকের অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। আর পোশাকে দেহ বিশিষ্ট ছবি নয়, অঙ্কিত ছবিই থাকে। (খ) কোনও কোনও বর্ণনায় ছবি অঙ্কনকারীকে প্রাণীর ছবি বাদ দিয়ে গাছপালা ও পাহাড়-পর্বতের দৃশ্য বানাতে বলা হয়েছে, যা দেহ বিশিষ্ট হওয়ার কথা নয়। (গ) বাইতুল্লাহয় রাখা ছবি বালতির পানিতে মুছে দেয়ার দ্বারাও বুঝে আসে যে, সেখানে তুলিতে আঁকা ছবিও ছিল।
হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. হাতে তৈরি প্রতিকৃতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহকারীকে বলেছেন,
إن أبيت إلا أن تصنع فعليك بهذا الشجر كل شيء ليس فيه روح.
প্রতিকৃতি যদি তৈরি করতেই হয় তবে গাছপালা ও প্রাণহীন বস্তুর প্রতিকৃতি তৈরি করবে। (সহীহ বুখারী; হা.২২২৫)
ছবি দ্বারা সব ধরনের প্রাণীর প্রতিকৃতি এবং চিত্র উদ্দেশ্য
হযরত আলী রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, জিবরাইল আ. বলেছেন
إنها ثلاث لن يلج ملك ما دام فيها أبدا واحد منها كلب أو جنابة أو صورة روح إسناده ضعيف
যতক্ষণ পর্যন্ত এই তিন জিনিস ঘরে থাকবে ফেরেশতারা তাতে কখনো প্রবেশ করবে না-কুকুর, গোসল ফরয হয়েয়ে এমন ব্যক্তি কিংবা কোন প্রাণীর ছবি। (মুসনাদে আহমদ; হা.৬৪৮)
আল্লামা ইবনে আব্দুল বার বলেন, احيوا ما خلقتم যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার করো) থেকে বোঝা যায় ছবি দ্বারা প্রাণীর ছবি উদ্দেশ্য। (আত-তামহীদ ৮/৫২৭)
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
শরয়ী বিধানে প্রাণীর ছবি (পর্ব চার)
ছবির ব্যবহার এবং সংরক্ষণের বিধান পূর্বের আলোচনায় দলীল প্রমাণের আলোকে এ কথা সাব্যস্ত হয়েছে যে, সব ধরন...
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বাণী ও বার্তা, মর্ম ও মর্যাদা!
...
ইসলামী আইন: প্রসঙ্গ বাল্যবিবাহ
বিবাহ বিধিবদ্ধ দাম্পত্য জীবন বিনির্মাণের প্রধানতম সূত্র। এটি নারী-পুরুষের মধ্যকার সবচেয়ে প্রাচীনতম ব...
শরীয়তের দৃষ্টিতে বাসা বাড়ি ভাড়া নেয়ার নিয়মনীতি
...