প্রবন্ধ

ইসলামী আইন: প্রসঙ্গ বাল্যবিবাহ

লেখক:মাওলানা হাফিজুর রহমান
১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
১০১৭৯ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

বিবাহ বিধিবদ্ধ দাম্পত্য জীবন বিনির্মাণের প্রধানতম সূত্র। এটি নারী-পুরুষের মধ্যকার সবচেয়ে প্রাচীনতম বন্ধন। এ বন্ধন সূত্রেই মানুষ আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে থাকে; সদ্যভূমিষ্ট মানবশিশুটি লাভ করে বৈধতার স্বীকৃত অধিকার। মানবীয় জীবন-ধারার সূচনাকাল থেকেই এ সূত্রটির কার্যকারিতা চিরস্বীকৃত হয়ে আসছে। আল্লাহপ্রদত্ত এ বিবাহ নীতিকে কেন্দ্র করেই এ ধরাধামে মানবীয় জীবনপ্রণালী সূচিত হয়। কালে কালে মানবীয় প্রথা-আদর্শে নানা আঙ্গিকে উত্থান পতন ঘটলেও বিবাহ ধারণাটি এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে বেশ শক্তিমত্তার সাথেই। তাই পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মেই বিবাহ প্রক্রিয়াটিকে বেশ ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে চর্চা করা হয়। যে পবিত্র সত্তা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই তার সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বৈবাহিক আইন প্রণয়ন করেছেন। এ আইনের মূলধারাগুলো কুরআন হাদীসের ছত্রে ছত্রে বেশ পরিচ্ছন্নভাবেই বিবৃত হয়েছে। হাদীস- ফিকহের গ্রন্থগুলোতে এর প্রয়োজনীয় উপধারাগুলোও যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এরপর আর তাতে সংযোজন বিয়োজনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। ব্যক্তিবিশেষের জন্য সময় বিবেচনায় এ জাতীয় আইনগুলো ভিন্ন আঙ্গিকেও উপস্থাপিত হতে পারে। এর জন্যও সংশ্লিষ্ট আইনে ভিন্ন ভিন্ন পরিচ্ছেদ ও উপধারা রচিত হয়েছে।

ইসলামী আইনের কোথাও বিবাহ প্রথাটি বয়সসাপেক্ষ বিবেচনায় উপস্থাপিত হয়নি। সেখানে এর জন্য সময়-কালও বেধে দেয়া হয়নি। যে কোনো বয়সে বিবাহ চুক্তিটি হয়ে যেতে পারে। তবে দাম্পত্য জীবন সূচনার জন্য সাবালকত্বসহ আবশ্যিক সক্ষমতার বিধান সেখানে আরোপিত হয়েছে। যৌনজীবন যাপনের ক্ষেত্রে প্রকৃতিগতভাবেই বয়সকেন্দ্রিক একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বয়সকেন্দ্রিক সে সাবালকত্বের সীমবদ্ধতা ছাপিয়ে নতুন কোনো সীমানা প্রাচীর নির্মাণের সুযোগ ইসলামী আইনে রাখা হয়নি। ইদানিং মানবরচিত আইনের সূত্র ধরে 'বাল্যবিবাহ' যুক্ত শব্দটির বেশ প্রচারণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নিবন্ধে ইসলামী আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বাল্যবিবাহ বিষয়ে বিস্তৃত একটি আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।


বাল্যবিবাহ পরিচিতি

বাল্য অর্থ ছেলেবেলা, বালকবয়স, ষোল বৎসর বয়স পর্যন্ত জীবনকাল। বাল্যবিবাহ অর্থ বাল্যকালে বা অপরিণত বয়সে বিবাহ। (সংসদ বাংলা অভিধান; পৃষ্ঠা ৪২৫)

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৩ (খসড়া) ২ নং ধারার (গ) য়ে বলা হয়েছে 'বাল্যবিবাহ' অর্থ সেই বিবাহ যাহাতে সম্পর্ক স্থাপনকারী পক্ষদ্বয়ের যে কোনো একজন নাবালক।

নাবালকত্বের মেয়াদ

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯ (১৯২৯ সালের ১৯ নং আইন) এর ২নং ধারার 'ঘ' অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'নাবালক' (Minor) বলতে পুরুষের ক্ষেত্রে একুশ বৎসরের কম এবং নারীর ক্ষেত্রে আঠার বৎসরের কম যে কোনো ব্যক্তিকে বুঝাবে।' একই কথা বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৩ (খসড়া) ২নং ধারার (খ) য়ে বলা হয়েছে।

তবে ইসলামী আইন অনুসারে, একজন বালক বা বালিকা যখনই প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে তখনই তার নাবালকত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। (Child- Marriage-Prevention-Law-2013, মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স ও মুসলিম আইন ৪১৪) 


শিশু শব্দের বিচিত্র রূপ

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৩ (খসড়া) তে বলা হয়েছে, 'শিশু' (Child) অর্থ অনুর্ধ্ব আঠার বৎসরের কম বয়সী কোন ব্যক্তি। 'শিশু বিবাহ' (Child marriage) অর্থ সেই বিবাহ যাহাতে সম্পর্ক স্থাপনকারী পক্ষদ্বয়ের যে কোন একজন শিশু। (Child-Marriage- Prevention-Law-2013) সেভ দ্য চিলড্রেন থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশে কর্মজীবী শিশু ম্যাথিউ এ কিং ও সহযোগী রায়ান এর নক্স বইটিতে ১৯৯৬ সনে ব্লাঙ্কেট পরিচালিত গবেষণায় শিশুর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-যে মানব সন্তানের কিছু বোঝার ক্ষমতা নেই তাকে বলা হয় শিশু। 

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী যে কোনো মানব সন্তানকেই শিশু বলা হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় শিশু নীতি ১৮ বছরের নিচের যে কোনো বালক- বালিকাকে শিশু বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাবালকত্ব আইনে বেশ স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সাবালকত্বের বয়স শুরু হবে ১৮ বছর থেকে। শিশুর সংজ্ঞা দু'টির মাঝে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশে 'শিশু এবং অল্পবয়সী' শব্দটির আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত কিছু প্রকল্পে শিশু বয়সের নিয়ম মেনে চললেও অধিকাংশ কার্যক্রমের ক্ষেত্রে শিশু বয়সের সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম মানা হয় না। বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থায় শিশু অভিধাটি বিচিত্ররূপে উপস্থাপিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন আইনে শিশুর বয়সকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।


বাংলাদেশে প্রযোজ্য প্রচলিত বিভিন্ন আইনে শিশুর সংজ্ঞা 

১. চাকুরীতে নিয়োগের অনুমতি প্রসঙ্গে-(কারাখানা আইন-১৯৬৫; দোকান ও প্রতিষ্ঠান আইন-১৯৬৫; শিশু শ্রমিক নিয়োগ আইন-১৯৩৮।) বয়সসীমা ১২ থেকে ২১ বছরের মধ্যে হলে শিশু হিসেবে গণ্য।

২. বিবাহের ক্ষেত্রে বয়সসীমা মেয়েদের জন্য ১৮ বছর ও ছেলেদের জন্য ২১ বছর।

৩. তামাক, সুরা বা অন্য কোন মারাত্মক ড্রাগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ১৬ বছর।

৪. বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বশেষ বয়স ১০ বছর।

৫. সামরিক বাহিনীতে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণের বয়স ১৬ বছর (অভিভাবকের সম্মতিতে)।

৬. ফৌজদারী দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে ১২ বছর থেকে সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব বর্তাবে এবং ফৌজদারী আইন ভঙ্গ করা সম্পর্কিত খণ্ডনযোগ্য আনুমানিক বয়স সীমা ৭ থেকে ১১ বছর।

৭. গ্রেফতার, আটক বা কারারুদ্ধের মাধ্যমে ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা বিষয়ে (ফৌজদারী দায়-দায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত) নির্ধারিত কোন বয়স নেই।

৮. মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে ১৭ বছর; ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ৭ বছর; তবে শর্ত থাকে যে বয়সের অনুমান সম্পর্কে কোন যুক্তি খণ্ডন করা হয়নি।

৯. আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য যদিও কোন সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারিত নেই; তবে সাক্ষীকে অবশ্যই প্রশ্ন বোঝা এবং উত্তর দেয়ার মতো যথেষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন ও সচেতন হতে হবে।

১০. আদালতে অভিযোগ দায়েরের মাধ্যমে প্রতিকার পাবার ক্ষেত্রে (অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া) বয়সসীমা ১৮ বছর।

১১. যুদ্ধক্ষেত্রে নন-কমিশন অফিসারের জন্য ৬ মাসের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর এবং কমিশন্ড অফিসারের জন্য দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে।

(সূত্র: First periodic report of the Government of Bangladesh under the Convention on the Rights of the Child [Draft]; Ministry of Women and Children Affairs; Government of People's Republic of Bangladesh, Dhaka, November- 2000)

এর বাইরেও বাংলাদেশে প্রচলিত কিছু কিছু আইনে শিশু হিসেবে কাদেরকে অভিহিত করা যাবে, সে সম্পর্কিত বিধানের উল্লেখ রয়েছে।

চুক্তি আইনে বলা হয়েছে যে, ১৮ বছর বয়সের কম কোন ব্যক্তি চুক্তি করতে পারে না। এই আইনে ১৮ বছরের কম বয়সের মানব সন্তানকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

নিম্নতম মজুরী আইনে ১৮ বছর পূর্ণ না হলে সে শিশু হিসেবে গণ্য হয়।

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের তালাক আইনে নাবালক নির্ধারণের ক্ষেত্রে পুত্রের ১৬ বছর এবং কন্যার ১৩ বছরের কম হলে নাবালক বলা হয়েছে।

খনি আইনে ১৫ বছর পূর্ণ না হলে তাকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। শিশুকে খনিতে কাজে নেয়া যায় না।

১৯৩৯ সালের মোটর গাড়ী আইনে ১৮ বছরের কম বয়সের ব্যক্তিকে গাড়ী এবং ২০ বছরের কম বয়সের ব্যক্তিকে বড় গাড়ী চালানোর অনুমতি দেয়া হয় না। (তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট) কথা হলো শিশু শব্দটিকে নিয়ে এত টানা হেচড়া এত পানি ঘোলা করার কী স্বার্থকতা থাকতে পারে।


সংজ্ঞাগত বিপত্তি (!) 

একটি প্রশ্ন, বালক নাবালক শব্দ দু'টি কি বিপরীতার্থক শব্দ? বাহ্য দৃষ্টিতে শব্দদু'টিকে বিপরীতার্থক বলেই মনে হবে। কারণ মূল শব্দ হলো, বালক। এর আদিতে না উপসর্গ যুক্ত হয়ে বিপরীত অর্থ প্রকাশ করছে। যদিও এটা ফারসী ব্যাকরণিক নীতি; কিন্তু বাংলা ব্যাকারণেও এ নীতির সিদ্ধতা বিদ্যমান। এ নীতি অনুসারে শব্দদু'টির মূল ধাতু ভাষাগত দৃষ্টিকোণ থেকে এক ও অভিন্ন। আর তা হলো, আরবী বা-লা-গা (بلغ- যৌবনে পদার্পণ করা)। আর এ ধাতুমূল থেকে গঠিত হয়েছে কর্তাবিশেষ্য বালিগ। আরবী এ বালিগ শব্দটিকে ফারসী ব্যাকরণে আদিতে না উপসর্গ যুক্ত করে বিপরীতার্থক শব্দ তৈরি করা হয়েছে। ফারসী এবং উর্দু ভাষাতে সে বালিগ শব্দটি বালেগ নাবালেগ শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই ফারসী উর্দুর নাবালেগ বাংলায় এসে নাবালক হয়েছে। নাবালক শব্দের এ রূপান্তর প্রক্রিয়া বাংলা ব্যাকরণে স্বীকৃত। সংসদ এবং বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে এ রূপান্তর ধারাকে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু বালক শব্দটির ক্ষেত্রে বাংলা অভিধানবেত্তারা এ রূপান্তর ধারাকে স্বীকার করতে রাজি নন। তারা বলেন, সংস্কৃত বাল শব্দান্তে ক যুক্ত হয়ে বালক শব্দের রূপ পরিগ্রহ করেছে। আমরা যদি ব্যুৎপত্তিগত প্রথম মতটি গ্রহণ করি তবে বালক নাবালকের আইন ও অভিধানগত সংজ্ঞায় বড় ধরনের অসঙ্গতি ও বিপত্তি দৃষ্টিগোচর হবে। কারণ অভিধানে বালকের অর্থ করা হয়েছে 'ষোল বৎসরের অনধিক ব্যক্তি'। অন্য দিকে আইনে নাবালকের অর্থ করা হয়েছে নারী পুরুষ ভেদে ১৮ এবং ১৯ বছরের কম বয়স্ক ব্যক্তি। অথচ প্রথম ব্যুৎপত্তির দিক থেকে বালক অর্থ যৌবনপ্রাপ্ত আর নাবালক অর্থ অপ্রাপ্ত বয়স্ক। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দশ বছরের একটি ছেলে এক দিক থেকে বালক এবং নাবালকও। এটা তো বড় ধরনের অসঙ্গতি। তবে যদি আমরা বাংলা আভিধানিক ব্যুৎপত্তির দিকটি আমলে নিই তবে অসঙ্গতির পরিমাণ কমে আসবে। কারণ তখন বালক নাবালক শব্দ দু'টি সমার্থবোধক শব্দে পরিণত হবে। তবে বিপত্তি খানিকটা থেকেই যাবে। কারণ বাংলা ব্যাকরণগুলোতে বাল্য বা বালকের অর্থ করা হয়েছে 'ষোল বৎসরের অনধিক ব্যক্তি'। আর বালিকার অর্থ করা হয়েছে 'অনধিক ষোল বৎসরের নারী'। সুতরাং যদি ছেলে এবং মেয়ের বয়স ১৭ হয় তাহলে আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ক বাল্যবিবাহের আওতায় পড়বে না। অথচ সংসদীয় আইনে তা সম্পূর্ণরূপে বাল্যবিবাহের আওতাভুক্ত। এমন কি যদি মেয়ের বয়স ১৮ হয় এবং ছেলের বয়স ২০ হয় কিংবা মেয়ের বয়স ১৭ এবং ছেলের বয়স ২১ হয় তখনও এ বিবাহ সংসদীয় আইনের খড়গ থেকে মুক্ত হবে না। তো এক্ষেত্রে সংসদীয় আইন আর ভাষা আইনে সংঘর্ষ বেধে যাচ্ছে। এক আইনে একটার বৈধতা দিলে অন্য আইনে সেটাকে আইনত দণ্ডনীয় বলে ঘোষণা দিচ্ছে। এভাবে এক আইন দ্বারা অন্য আইনকে নিয়ন্ত্রণ করার আইনগত বৈধতা কতটুকু- এ বিষয়টিও একটি পর্যালোচনাসাপেক্ষ বিষয়। অন্যদিকে নাবালক শব্দটির আভিধানিক এবং ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো অপ্রাপ্ত বয়স্ক, বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করেনি এমন বালক। কিন্তু বাল্যবিবাহ আইনে শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত এবং আভিধানিক অর্থের দিকে লক্ষ্যই করা হয়নি। সেখানে নাবালক শব্দের এমন একটি সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে যার সাথে শব্দটির সামান্যতম সংশ্লিষ্টতা নেই। কারণ পৃথিবীতে সম্ভবত এমন কোনো মেয়ে সন্তান নেই যে ১৮ বছরের পূর্বে বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করেনি। তেমনিভাবে এমন কোনো ছেলে সন্তানও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ২১ বছরের আগে যৌবনে পদার্পণ করেনি। সাধারণত মেয়েরা দশ বারো বছর বয়সে আর ছেলেরা চৌদ্দ পনের বছর বয়সে প্রাপ্তবয়সে উপনীত হয়ে যায়। শব্দটির উপরে আইনী খড়গ না চালিয়ে বছর বিবেচনায়ই আইনটি প্রণয়ন করা যেত। তাহলে শব্দগত এবং সংজ্ঞাগত এত বিপত্তির জঞ্জাল সৃষ্টি হতো না। তাছাড়া এ আইনটি করার ফলে ভাষানীতির মাঝে বড় ধরনের একটি অবাঞ্ছিত দেয়াল দাঁড়িয়ে গেল। কারণ যেসব ছেলে মেয়েগুলো এখনো বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করেনি মানুষ তাদেরকে কী অভিধায় অভিহিত করবে? তাদের জন্য তো আর আলাদা কোনো শব্দই অবশিষ্ট নেই। আর বিশ বছর বয়সের আগে বাবা হওয়ার দৃষ্টান্ত এ সমাজে অনেক রয়েছে। বিশেষত বেদে পল্লিতে তো এটা নিতান্তই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তো দেখা যাচ্ছে, বাবা, মা এবং ছেলে সবাই শিশু। একটি পরিবারের সবাই শিশু। কি হাস্যকার একটি ব্যাপার!

সংসদীয় এ আইনের ফলে এখন শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন বলে আলাদা কোনো স্মৃতিময় শব্দের অস্তিত্ব থাকবে না। এখন যেটা শৈশব সেটাই যৌবন, যেটা কৈশোর সেটাই শৈশব। অথচ বাংলাদেশে ছেলেবেলা বা মেয়েবেলাকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করার নীতি আবহমান কাল থেকেই প্রচলিত। ৫ বছরের নিচে শৈশবকাল, ৬ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বাল্যকাল এবং ১১ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত কৈশোরকাল। (বাংলাপিডিয়া ১৩/৬২)

শৈশব বললে নিষ্পাপ শিশুর মুখের একটি হাসির রেখা ফুটে উঠত। এখন তা আর ফুটে উঠবে না। এখন নিষ্পাপ শিশুর হাসি বলে কোনো শব্দের স্বার্থকতা নেই। এখন শিশুটি আর নিষ্পাপ নয় পাপীও হতে পারে। কৈশোর বললে যে দুরন্তপনার একটি স্মৃতিময় চিত্র ফুটে উঠত তাও আর তেমন সুন্দর করে ফুটে উঠবে না। কারণ দোলনার নিষ্পাপ শিশুটি যদি সেকেন্ডের ভিতরে বিশ বছরের ইয়া বড় তাগড়া যুবকে পরিণত হয়ে যেতে পারে তবে কিশোর আর পিছিয়ে থাকবে কেন। কৈশোর তো শৈশবের পরবর্তী ধাপের নাম। এভাবে শব্দ ও শব্দ শিল্পীদের উপর অবিচার করার কোনো মানে হয় না। 


বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে যখন বৃটিশ প্রশাসনের জগদ্দল পাথর ভারত উপমহাদেশে জেঁকে বসে তখন প্রথম দিকে তারা পূর্ব থেকে চলে আসা মুসলিম আইনের উপর কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করে নি। কিন্তু ধীরে ধীরে মুসলিম আইনের উপর বৃটিশ খড়গ নেমে আসে। মুসলিম আইনের পরিধি সংকীর্ণ হতে থাকে। এমনকি শেষ অবধি ব্যক্তিগত আইনের উপরও বৃটিশ আইনের বিষেল থাবা আঘাত হানে। ফলে বৃটিশ শাসনের অবসানকালে তিনটি ব্যক্তিগত মুসলিম আইন প্রণীত হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯ (The Child Marriage Restraint Act, 1929, Act No. XIX of 1929)। আইনটি ১ অক্টোবর, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত হয়। আর ১৯৩০ সনের পহেলা এপ্রিল হতে বলবৎ হয়। এ আইনে ১৪ বছরের নিচের পাত্রী এবং ১৮ বছরের নিচের পাত্রের বিবাহ আইনত দণ্ডনীয় বলে ঘোষণা করা হয়। তবে এর আগে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে সাবালকত্ব আইন নামে একটি আইন পাশ করা হয়েছিল। সে আইনের ৩ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, নাবালকত্বের মেয়াদ পূর্ণ হবে ১৮ বছর বয়সে। তবে যদি কোনো নাবালকের অভিভাবকও ওই নাবালকের সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব কোর্ট অফ ওয়ার্ডের ওপর ন্যস্ত থাকে তাহলে নাবালকত্বের বয়সসীমা ২১ বছর পর্যন্ত বর্ধিত হবে। (বাংলাপিডিয়া ৯/৩৩৯, ১১/২৬৫)

বৃটিশ শাসন অবসানের সাথে সাথে তাদের আইন ব্যবস্থারও অবসান হওয়া ছিল বিবেকের একটি অপরিহার্য দাবি। কিন্তু আমাদের প্রচণ্ড আক্ষেপের সাথে প্রত্যক্ষ করতে হয় তার উল্টো চিত্র। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান সরকার একটি ল' কমিশন গঠন করে। এ কমিশনে উলামায়ে কেরামকে সদস্যভুক্ত করা হয়। এ কমিশনে যখন পারিবারিক আইনের বিষয়াদি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয় তখন উলামায়ে কেরাম পারিবারিক সমস্যার আইনী সমাধানকল্পে কুরআন- সুন্নাহর আলোকে যুগোপযুগী এবং যুক্তিপূর্ণ কিছু প্রস্তাবনা পেশ করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ল' কমিশন এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। পরিবার সম্পর্কিত আইনী বিষয়গুলো এভাবেই অমীমাংসিত থেকে যায়।

এরপর পাকিস্তান সরকার ১৯৫৫ সালে মুসলিম আইন সংশোধনকল্পে (!) ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি ফ্যামিলি কমিশন গঠন করে। ড. খলিফা সুজা উদ্দীনকে এ কমিশনের সভাপতি করা হয়। তার মৃত্যুর পর প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মি. আব্দুর রশীদকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। কমিশন গৃহীতব্য মুসলিম পারিবারিক আইনের ধারাগুলোকে সামনে রেখে প্রস্তুতকৃত কিছু প্রশ্নপত্র সারা দেশে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে প্রচারিত এ প্রশ্নপত্রের জবাব লিখে প্রচণ্ড রকমের আপত্তি জানানো হয়। উক্ত কমিশন উলামায়ে কেরামের যুক্তিপূর্ণ জবাব এবং সমালোচনা ও আপত্তির কোনো তোয়াক্কা না করে ১৯৫৬ সনের জুন মাসে রিপোর্ট পেশ করে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইনের সুপারিশ করে। রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের ধর্মভীরু মুসলিম জনতার পক্ষ থেকে প্রচণ্ড রকমের প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এ ব্যাপারটিকে মুলতবী ঘোষণা করে।

কিন্তু ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সেনাপ্রধান আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক আইন জারি হওয়ার সাথে সাথে সমাহিত করা সে প্রস্তাবিত আইনকে উদ্ধার করে তা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধনের জন্য আইন কমিশনের কিছু সুপারিশ কার্যকর করার ঘোষণা প্রদান করা হয়। মিডিয়ায় চাউর হয়ে যায়, কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী মুসলিম পারিবারিক আইন পাশ হতে যাচ্ছে। তখন পাকিস্তানের ১৪ জন খ্যাতিমান আলেম অনুমোদিতব্য এ আইনের উপর একটি পর্যালোচনাপত্র তৈরি করেন এবং তা গভর্নমেন্ট বরাবর পেশ করে প্রতিবাদ জানানো হয়, যেন কুরআন সুন্নাহ বিরোধী এ আইন পাশ না করা হয়। এ পর্যালোচনা প্রতিবেদনটি গ্রহণ করার পরিবর্তে তারা এর প্রচারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। উপরন্তু তারা কিছু অপরিণামদর্শী আলেমের সহযোগিতায় এ আইনের স্বপক্ষে অযৌক্তিক দলীল-প্রমাণের এক বিশাল স্তুপ তৈরি করে নেয়। ফলে ১৯৬১ সালে জেনারেল আইয়ুব খান উক্ত কমিশনের রিপোর্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশটি ইসলামী আইন (?) হিসেবে জারি করে দেন। যা ১৯৬১ সালের ৮ নং অধ্যাদেশ নামে পরিচিত। এ আইনটি ১৯৬১ সালের ১৫ জুলাই হতে কার্যকর করা হয়। (মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ., জাওয়াহিরুল ফিকহ ৪/২৩৪-৩৬, জাস্টিস মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, হামারে আইলী মাসায়েল ১১-১৪, বাংলাপিডিয়া ৩/৩৮৬, ১১/২৬২, মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স ও মুসলিম আইন; পৃষ্ঠা ৯২)

১৯৬১ সালে পাশকৃত মুসলিম পারিবারিক আইনের ১২ নম্বর ধারটি ছিল ১৯২৯ সালের বৃটিশ আইন 'বাল্যবিাহ নিরোধ আইন ১৯২৯' এরই নতুন সংস্করণ। এ ধারাটিতে ১৮ বছরের কমবয়সী ছেলে এবং ১৬ বছরে বমবয়সী মেয়ের বিবাহকে আইনত নিষিদ্ধ করা হয়। তবে বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৮৪ সালের এক সংশোধনী আইনে ২১ বছরের কমবয়সী পুরুষ এবং ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়ের বিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয়। (জাওয়াহিরুল ফিকহ ৪/২৬৪,বা.পি. ১৩/৬৪) 


বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের উদ্দেশ্য

আইনটির উদ্দেশে বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এ আইনের উদ্দেশ্য, বিবাহের বৈধতা কিংবা অবৈধতা প্রশ্ন উত্থাপন নয়। ব্যক্তিগত আইনে যদি কোন বিবাহ বৈধ বলে গণ্য অথচ অত্র আইনে প্রতিকূল হলে তা শাস্তিযোগ্য। সেখানে 'এ আইনে প্রভাবিত বিবাহের বৈধতা' শিরোনামে বলা হয়েছে ব্যক্তিগত আইনে সম্পাদিত বিবাহ এ আইন দ্বারা প্রভাবিত হবে না। যারা এ বাল্যবিবাহ সম্পাদন করবে তারাই শাস্তি পাবে। আইনটির ৪ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, কেহ একুশ বৎসর বয়সোর্ধ্ব সাবালক পুরুষ অথবা আঠার বৎসর বয়সোর্ধ্ব সাবালিকা নারী কোন বাল্যবিবাহের চুক্তি করলে, সে একমাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা একহাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে। (মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স ও মুসলিম আইন ৪১৪) 

তবে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৩ (খসড়া) তে শাস্তির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, একুশ বৎসরের অধিক বয়স্ক কোন পুরুষ বা আঠার বৎসরের অধিক বয়স্ক নারী কোন শিশু বা নাবালকের সহিত বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তি করিলে সেই ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবে। এছাড়াও সেখানে বাল্যবিবাহ পরিচালনাকারী (কাজী) এবং এর সাথে সম্পৃক্ত পিতা-মাতা বা অভিভাবকের শাস্তি বিধানের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ -এর ১২ (১) (ক) ধারা অনুসারে একজন নাবালকের বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। (প্রাগুক্ত ১০১) 

তবে 'বাল্যবিবাহ নিরোধ' ২০১৪ শিরোনামের একটি খসড়া আইনে ('মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে নামিয়ে ১৬ করার একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ উদ্যোগ- পরিকল্পনা নানা মহল থেকে তীব্রভাবে সমালোচিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একটি কৌশল অবলম্বন করে। আর তা হলো, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ ই থাকবে। তবে মা-বাবা চাইলে ১৬ বছরেও বিয়ে হতে পারে। সম্পাদকীয়', আলোকিত বাংলাদেশ; ৮ মার্চ ২০১৫)

বৃটিশরা যে দুষ্ট চিন্তা ও ইসলাম বিদ্বেষ মাথায় নিয়ে মুসলিম পারিবারিক এ আইনটির উপর আইনী খড়গ চালিয়েছিল তার বিষবাষ্প অর্ধশত বছর পরও আমাদের এ দেশীয় মুসলিম (!) আইনবেত্তাদের কলমে উদগীরিত হচ্ছে। একজন আইনবিদ বলছেন,

১৯২৯ সালে প্রণীত এই আইনটির মাধ্যমেই ইংরেজগণ ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম সংস্কারমূলক উদ্দেশ্য গ্রহণ করে। মুসলিম সমাজের ক্রমঅবনতির জন্য বাল্যবিবাহ বহুলাংশে দায়ী ছিল। হেদায়া মোতাবেক বিবাহযোগ্য হওয়ার জন্য বালকদের ক্ষেত্রে বারো বৎসর এবং বালিকার ক্ষেত্রে নয় বৎসর সাবালকত্বের বয়স ধরা হইত। ইহার ফলে মুসলিম সমাজে মারাত্মক গোলযোগ ও অপকর্ম দেখা দেয় এবং বিবাহ ইচ্ছুক পক্ষসমূহ ও তাহাদের গুরুজনেরা বাল্যবিবাহের দিকে ঝুঁকিয়া পড়ে। সাবালকত্বের বয়স নির্ধারণ করতঃ বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করিয়া এবং বিধি ভঙ্গের জন্য দণ্ডের বিধান নিশ্চিত করিয়া বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন বাল্যবিবাহের বিষময় ফল রোধ করে। (মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স ও মুসলিম আইন; পৃষ্ঠা ৮৫)

একটি আইন প্রণয়নের পেছনে কিছু যুক্তির বেসাতি দেখাতে হয়। বৃটিশ প্রশাসন ইসলাম বিদ্বেষ মাথায় রেখে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যে হাস্যকর যুক্তিগুলো তুলে ধরেছিল সেই যুক্তিগুলোই আমাদের আইনবিদ (!)রা পরিপূর্ণ আস্থার সাথে তুলে ধরছেন। স্বকীয়তাবোধ, আত্মমর্যাদাবোধ সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানের দৈন্যদশা হলে যে অবস্থা সৃষ্টি হয় তাই অ্যাডভোকেট মহোদয়ের কলমে দৃশ্যমান হলো।


বাল্যবিবাহ: ইসলামী দৃষ্টিকোণ 

বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসাশাস্ত্র মতে বাল্যবিবাহের প্রকৃত সংজ্ঞা হলো, বয়ঃসন্ধিকালীন বয়সে পদার্পণের পূর্বেই বিবাহের সিঁড়িতে আরোহণ করা। সুতরাং ১৮ বছরের পূর্বকালীন বিবাহকে বাল্যবিবাহ নামে অভিহিত করা বৈজ্ঞানিক এবং শরয়ী নীতিমালা অনুসারে যথার্থ নয়। বিবাহের বিষয়টি বস্তুত সাবালকত্বের সাথে সম্পৃক্ত। সাবালকত্ব এমন একটি আবহ যেখানে মানুষ তার নাবালকত্বের পর্যায় পেরিয়ে সাবালকত্বের বয়সে পদার্পণ করে। আর এ সময়টায় মানুষের মাঝে ফিজিয়োলোজিক্যাল (শরীরবৃত্তিক) এবং সাইক্লোজিক্যাল (মনোবৃত্তিক) পরিবর্তন দেখা দেয়। আর সাবালকত্বের বয়স আন্তর্জাতিকভাবে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ৯ থেকে ১৬ বছরের মাঝে ওঠানামা করে। (ড. হুসামুদ্দীন আফফানা, আযয্যিওয়াজুল মুবকির ১/৪) 

ইসলামের দৃষ্টিতে বাল্যবিবাহের দু'টি অর্থ লক্ষগোচর হয়। (১) সংকীর্ণ অর্থ। অর্থাৎ বালক-বালিকা প্রজননক্ষমতা অর্জনের বয়সে কিংবা বয়ঃসন্ধিকাল বয়সে উপনীত হওয়ার পর থেকে বৈবাহিক বয়সের সূচনা হবে। এটি মূলত সাবালকত্ব ও নাবালকত্বের স্বভাবজাত মানদণ্ড। ইসলাম প্রকৃত নাবালকত্বের সীমারেখার উপর কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ বিধি আরোপ করেনি। একজন বালক কিংবা বালিকা যখন প্রজননক্ষমতা অর্জন করবে তখন থেকেই ইসলাম তার উপর সাবালকত্বের যাবতীয় বিধান আরোপ করবে। (২) মুক্ত অর্থ। অর্থাৎ সূচনা বয়স থেকেই নবজাতকের বৈবাহিক বয়সের ধারা সূচিত হবে। তবে ইসলামী শরীয়া আইনে অপরিপক্ব এবং অনুপযোগী বয়সে যৌন জীবন বিধিসম্মত করা হয়নি।

ইমাম ইবনে শুবরুমা, আবু বাকার আসাম্ম এবং উসমান বাত্তী রাহ. প্রমুখের অভিমত হলো, প্রজননক্ষমতা অর্জন তথা প্রাপ্তবয়সে উপনীত হওয়ার পূর্বে বালক- বালিকার বিবাহ বিধিসম্মত নয়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামী আইনবেত্তাগণ এ অভিমতটিকে বিচ্ছিন্ন, অপ্রণিধানযোগ্য এবং সর্বসম্মত অভিমত পরিপন্থী মত বলে অভিহিত করেছেন। বিচ্ছিন্ন এ আইনী অভিমতটিকে কেন্দ্র করে আরব রাষ্ট্র সিরিয়ায় বিবাহ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। (ড. ওয়াহবাহ যুহাইলী, আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহ ৭/১৮৩-৮৮)। সর্বসম্মত না হলেও এ আইনী অভিমতটির একটি ভিত্তি রয়েছে। কিন্তু প্রচলিত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটি সর্বসাকুল্যে অনুমাননির্ভর এবং সম্ভাব্য সমস্যা রোধকল্পে প্রণীত। প্রাকৃতিক বিধানের সাথে এর কোনোই সাযুজ্য রাখা হয়নি। 


বাল্যবিবাহ বিধানের দালিলিক পর্যালোচনা 

পবিত্র কুরআনের ভাষ্য, তোমাদের যে সকল স্ত্রীর আর ঋতুমতী হবার আশা নেই তাদের ইদ্দত সম্বন্ধে তোমরা সন্দেহ করলে তাদের ইদ্দতকাল হবে তিন মাস এবং যারা এখনো রজঃস্বলা হয়নি তাদেরও (ইদ্দতকাল হবে তিন মাস)। ('সূরা তালাক'-৪)

কুরআনিক ভাষ্যটিতে ঐসব কিশোরীদের ইদ্দতের কথা আলোচিত হয়েছে যারা এখনো রজঃস্বলা বয়সে উপনীত হয়নি। আর এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা, ইদ্দত বিবাহোত্তর ডিভোর্স কিংবা স্বামী মৃত্যুর সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয়। এতে সুষ্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়, কুরআনিক আইনমতে বয়ঃসন্ধিকালের পূর্বেকার বিবাহ বিধিসম্মত। অথচ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে নিছক প্রজনন ক্ষমতা অর্জনের পূর্বকালীন বিবাহই নয়; বরং প্রাপ্তবয়সে উপনীত হওয়ার চার পাঁচ বছরের পরবর্তী বিবাহকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

হাদীসের ভাষ্য, (১) আয়িশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার যখন ছয় বছর বয়স হয় তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে নেন। আর আমার যখন নয় বছর বয়স হয় তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সাথে বাসর যাপন করেন। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫১৩৪, সহীহ মুসলিম; হা.নং ৩৫৪৫)

(২) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদরের কন্যা ফাতেমা রাযি. কে আলী রাযি. এর সাথে অল্প বয়সে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করেন।

(৩) উমর রাযি. আলী রাযি. এর অল্পবয়সী মেয়ে উম্মে কুলসূম রাযি. এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

(৪) যুবাইর ইবনুল আউয়াম রাযি. এর কন্যা যখন প্রাপ্তবয়সে উপনীত হন তখনই কুদামা ইবনে মাযউন রাযি. তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। (আবু হুসাম তারফাবী, আল-উনফ যিদ্দাল মারআহ ১/৪৯)

(৫) ইবনে ইসহাক সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে সালামা রাযি. এর অল্পবয়স্ক ছেলে সালামার সাথে হামযা রাযি. এর ছোট্ট মেয়েকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিয়ে দিয়েছিলেন। (আহকামুল কুরআন লিলজাসসাস ২/৩৪৪, মাকালাতুন ফিত তাশাইউ ৪৮/৩৬, আলমাবসূত লিস সারাখসী ৪/২১২)

এছাড়াও বাল্যবিবাহ সম্বন্ধে সাহাবা তাবিয়ীদের আরো অসংখ্য উক্তি ও কর্মপন্থা- হাদীস, ফিকহ ও ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। 


উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত

ইসলামী শরীয়ার সূচনাকাল থেকে অদ্যাবধি উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, অল্পবয়সী শিশু-কিশোরদের বিবাহ বিধিসম্মত। ইমাম আবু বকর জাসসাস রাহ. সূরা নিসার ৩ নম্বর আয়াতের অধীনে (আর যদি তোমরা ভয় করো যে, পিতৃহীন মেয়েদের অধিকার তোমরা যথাযথভাবে আদায় করতে পারবে না তবে সে সব মেয়েদের মধ্য হতে তোমাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি আশঙ্কা করো যে, তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না তবে একটিই; অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা বিদ্যমান।) বলেন, এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, পিতার জন্য তার ছোট্ট মেয়েকে বিবাহ প্রদান করা বিধিসম্মত। কারণ এ আয়াত দ্বারা সব রকমের অভিভাবকদের জন্য তাদের অধীনস্ত বালিকাকে বিবাহ দেয়া বিধিত হওয়া প্রমাণিত। তো পিতা নিকটস্থ অভিভাবক হিসেবে এ অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় বেশি অগ্রগণ্য হবে। উপরন্তু বাল্যবিবাহ বৈধতার ব্যাপারে পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কোনো ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞের ব্যতিক্রম অভিমত আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। (আহকামুল কুরআন লিলজাসসাস ২/৩৪৬)


ইসলামী বিবাহ আইনের তাৎপর্য

ইসলাম কেন বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে এতটা উদার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেছে- এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা সংক্ষিপ্ত পরিসরে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরবো যাতে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের সামাজিক বিপত্তি ও অসঙ্গতিগুলো পরিষ্কার ফুটে উঠে। 

১. একব্যক্তির প্রাপ্তবয়সী একটি ছেলে বা মেয়ে রয়েছে। উন্মাতাল যৌনতা ও অশ্লীলতার সয়লাবে তার সন্তানের চারিত্রিক অবক্ষয় চরম আকার ধারন করেছে। সে দেখছে, যদি তার সন্তানের বিবাহের ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে তার সন্তানকে চরম অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। এদিকে উপযুক্ত সম্বন্ধও হাতের নাগালে রয়েছে। তার এ দুঃসময়ে আইন তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বলবে, এ চরম অবক্ষয়ের মুহূর্তেও তুমি তোমার সন্তানকে ১৮ বা ২১ বছর আগে বিবাহ করাতে পারবে না। আইনী খড়গের কারণে তার সন্তানের অধঃপতন স্বচক্ষে দেখা ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকবে না। কারণ বিবাহ ছাড়া এ ব্যধির কোনোই প্রতিষেধক নেই।

২. রোগবিছানায় শায়িত অশীতিপর বৃদ্ধ বাবার একটিমাত্র পনের বছর বয়সী কন্যা। তার ভিটায় বাতি জ্বালাবার আর কোনো উত্তরাধিকারী নেই। জীবনের শেষ বেলায় এসে সে চাচ্ছে, তার আদরের কন্যাটিকে একজন চরিত্রবান ভদ্র ছেলের হাতে তুলে দিয়ে আত্মিক প্রশান্তির সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করবে। কিন্তু আইনী বাধ্যবাধকতার কারণে তার কন্যাকে অসহায় অবস্থায় রেখে দুঃখাক্রান্ত মন নিয়ে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করতে হবে। আর তার আদরের মেয়েটি তার মৃত্যুর পর স্বার্থান্বেষী মহলের শিকার হয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদবে।

৩. একজন বিধবা নারীর একটিমাত্র প্রাপ্তবয়স্কা কন্যা রয়েছে। আর্থিক অনটনের কারণে নিজের জন্য দু'মুঠো আহার যোগাড় করা, নিজের মান-সম্মান রক্ষা করা তার জন্য একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সঙ্কটময় মুহূর্তে তার মেয়েকে নিজের কাছে রাখা তো সীমাহীন কষ্টের ব্যাপার। সাথে সাথে এ আশঙ্কাও রয়েছে, দ্রুত বিবাহের ব্যবস্থা না করলে তার আদরের মেয়েটি অসভ্য মানুষের লালসার শিকার হবে। বিধবার এমন দুঃসময়ে আইন বলবে, নাবালকত্বের মেয়াদ শেষ না হলে তুমি তোমার মেয়েকে বিবাহ দিতে পারবে না। আইনী সীমাবদ্ধতার কারণেই অস্বচ্ছল আশ্রয়হীন একটি পরিবারে নেমে আসবে দুর্যোগের কালো মেঘের পর কালবৈশাখী ঝড়। 

৪. বিবাহের ক্ষেত্রে এ আইনী সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের সমাজের চারিত্রিক অবক্ষয় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। যিনা-ব্যাভিচার, অশ্লীলতা ও যৌনতার প্রাদুর্ভাব ঘটবে। যা রাষ্ট্রের জন্য চূড়ান্ত পরিণতি ডেকে আনবে। কারণ উঠতি বয়সের যুবক যুবতীরা বিবাহের অনুমতি না পেয়ে তাদের জৈবিক চাহিদা নিবারণ করার লক্ষ্যে অবাধ যৌনাচারের নিষিদ্ধ পথ মাড়াতে বাধ্য হবে।

৫. বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের কার্যকারিতাকে ফলপ্রসূ করার জন্যে জন্মনিবন্ধন আবশ্যক করে দেয়া হয়েছে। ফলে এ বিষয়টি গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য সীমাহীন মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বিবাহের ক্ষেত্রে মানুষ হয়তো মিথ্যা সাক্ষ্য আনতে বাধ্য হচ্ছে নতুবা সন্তানের বয়সকে বিবাহযোগ্য করার জন্য অবিধানিক কোনো পন্থা গ্রহণ করছে। সমাজে এগুলো নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। (জাস্টিস মুফতী তাকী উসমানী, হামারে আয়েলী মাসায়েল (ঈষৎ সংক্ষেপিত, পরিবর্তিত পরিবর্ধিত ১৫৭) 

বাল্যবিবাহের কারণে সমাজে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়। এ সমস্যা নিরসনকল্পেই হয়তো বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনের উদ্দেশ্য ও উপকারিতা নিঃসন্দেহে যথাস্বীকৃত। কিন্তু বাল্যবিবাহের কারণে সামাজিক যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা নিতান্তই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিচ্ছিন্ন দু- একটি সমস্যার সমাধানকল্পে পুরো বিবাহ ব্যবস্থাটিকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা যৌক্তিক তা বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ সমাজে এমন অনেক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যার পরিপ্রেক্ষিতে অভিভাবকবৃন্দ তাদের সন্তানকে অল্পবয়সে বিবাহ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাধ্য হন। এ জন্য ইসলামী আইনে বাল্যবিবাহের ব্যাপারটিকে উন্মুক্তভাবে রেখে দেয়া হয়েছে। এখানে বাল্যবিবাহের ব্যাপারে কোনোরূপ উৎসাহ প্রদান করা হয়নি এবং এব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়নি। আমরা গ্রামের সবুজ পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। আমাদের শৈশব-কৈশোর আমতলা-জামতলা আর নদী-নালা, খাল-বিলে দৌড়-ঝাঁপ করেই কেটেছে। বাল্যবিবাহের সমস্যাগুলোকে যেভাবে আজ ফলাও করে প্রচার করা হয় তার কিয়দাংশ আমরা আমাদের সামাজিক জীবনে প্রত্যক্ষ করিনি। আইন প্রণয়নোত্তর আজ সমস্যার হার বের করতে জরিপ চালানো হচ্ছে। তো সে জরিপ তো আইনের অনুগামী করেই প্রস্তুত করা হবে। বলা হচ্ছে, বাল্যবিবাহের ফলে নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তো নারীশিক্ষা বৃদ্ধি করার কি আর কোনো উপায় নেই? একটি বৈধ বিষয়কে নিষিদ্ধ করে নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে হবে? একসময় অমুসলিমরা মুসলিমদের কাছ থেকে প্রকৃত সভ্যতার পাঠ গ্রহণ করত। আজ মুসলিমরা অমুসলিমদের থেকে যতসব অসভ্যতা আর অপসংস্কৃতির কারিকুলাম রপ্ত করছে। অমুসলিমরা একটি আইন করছে আর সে আইন আমরা কোনো বাছ বিচার ব্যাতিরেকে লুফে নিচ্ছি। এখন ওরা দাতা আর আমরা গ্রহীতা। এ যেন 'সকালবেলার ধনী রে তুই ফকীর সন্ধ্যাবেলা।' 


বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দু'টি ধাপ রয়েছে

(১) প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হওয়ার পূর্বেই অভিভাবক বালক বা বালিকাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন। বিবাহের ব্যাপারে বালক-বালিকার সুস্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে বিবাহ চুক্তিকালে তারা কিছু বলতে পারে না বা বলার সুযোগ পায় না। কিন্তু বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করার পর তাদের মাঝে পছন্দ অপছন্দসহ নানা রকম রুচিবোধের সৃষ্টি হয়। তো রুচির তারতম্যের কারণে বরের কনে বা কনের বর পছন্দ না-ও হতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে যদি তাদের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ককে আইনগতভাবে অবিচ্ছিন্ন ও বহাল রাখা হয় তবে তাদের দাম্পত্যজীবন সুখের হবে না। তাদের সুখময় জীবনের জন্য এ বিবাহ কাল হয়ে দাঁড়াবে। ইসলামী আইনে বৈবাহিক এ সঙ্কট সমাধানের জন্য 'খিয়ারে বুলুগ'-এর অপশন রাখা হয়েছে। অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হওয়ার পর বর কনের জন্য যৌক্তিক ব্যাখ্যাসাপেক্ষে পূর্বোক্ত বিবাহ বন্ধন বিলুপ্ত করার অধিকার থাকবে। এ সংক্রান্ত নীতিমালা ইসলামী আইনের গ্রন্থগুলোতে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।

আজ বাল্যবিবাহের কারণে সমাজে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয় তার সবই ইসলামী আইনের বৈবাহিক নীতি সম্বন্ধে সুষ্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে হয়ে থাকে।

(২) প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হওয়ার পর ১৮-২১ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে যুবক যুবতীকে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করিয়ে দেয়া হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, যদি সক্ষমতা এবং বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদে বিবাহটি সংঘটিত হয়ে থাকে এবং পরবর্তীতে এ বিবাহের কারণে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় তবে বিবাহ না করার কারণে যে সমস্যা সৃষ্টি হতো, সে সমস্যাটা বিবাহোত্তর উক্ত সমস্যা থেকেও অধিক গুরুতর হতো। আর যদি সক্ষমতা এবং প্রয়োজন ব্যতিরেকে এ বিবাহের আয়োজন হয়ে থাকে তবে এ জাতীয় বিবাহের অনুমতি ইসলামী আইনে নেই; বরং এটা বিবাহকারী বা বিবাহ পরিচালনাকারী অভিভাবকদের অজ্ঞতা ও মূর্খতার ফল। অপ্রয়োজনীয় বাল্যবিবাহের কারণে সমাজে যে সমস্যার সৃষ্টি হয় তার সমাধান আইন নয়; বরং নৈতিক সুশিক্ষার ব্যাপক প্রচার প্রসারই এ জাতীয় সমস্যার সমাধানের বার্তা বয়ে আনতে পারে। বস্তুত অশিক্ষা ও অপসংস্কৃতিই অপ্রয়োজনীয় বাল্যবিবাহের জন্য বহুলাংশে দায়ী। সারকথা, বাল্যবিবাহকে ঢালাওভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া বাল্যবিবাহপ্রসূত সামাজিক সমস্যার প্রকৃত ও সুষ্ঠু সমাধান নয়; বরং এতে আরো হাজারো সমস্যার প্রাদুর্ভাব ঘটবে। এর সুষ্ঠু সমাধান হলো, শিক্ষার ব্যাপক প্রচার প্রসার করা। বিশেষত ইসলামী পারিবারিক শিক্ষানীতির ব্যাপক প্রচার প্রসার করা। যাতে শিশু কিশোরেরা উপলব্ধি করতে পারে ইসলামী আইন তাদেরকে কি পরিমাণ সুযোগ প্রদান করেছে। এখন কেউ যদি অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার কারণে ইসলামী আইনের সুবিধা ভোগ না করে তবে সেটা আইনের দোষ নয়। এ কারণে তো আইনের উপর সংস্কার ও সংশোধনীর খড়গ চালানো যায় না; বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মাঝেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। (হামারে আয়েলী মাসায়েল; পৃষ্ঠা ১৬৩-৬৫ অবলম্বনে) 


নতুন প্রজন্মের অপরাধপ্রবণতা

ড. গুডুচ সি শুফলার ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন এর সামনে প্রদত্ত বক্তৃতায় বলেছিলেন, উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের যৌন আবেগ-অনুভূতি মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। 

ইটার্নি জেনারেল ক্লার্ক ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন এর উদ্ধৃতিতে বলেন, 'হত্যা, প্রতারণা এবং ব্যভিচার সংঘটনের ক্ষেত্রে সতের বছর বয়সী যুবক যুবতীরাই সবচাইতে বেশি জড়িত। বিশেষত শতকরা ত্রিশ পার্সেন্ট অবৈধ যৌন অপরাধের সাথে সতের বছর বয়সী যুবক যুবতীরা জড়িত। এটা তো শুধু ঐসব যুবক যুবতীদের কথা যারা অবৈধ যৌনাচারের অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে।' নিনা অ্যাপ্টন তার লাভ অ্যান্ড দ্য ইংলিশ গ্রন্থে জনৈক ইউরোপিয়ান স্কুল মাস্টারকে উদ্ধৃত করে রিপোর্ট করেন, 'আমার স্কুলের শিশুদের মাঝে পাঁচ বছর বয়স থেকেই কোর্টশিপ তথা প্রাকবৈবাহিক যৌনতার চর্চা শুরু হয়ে যায়। সেখানে আপনি অল্পবয়সী যুবক- যুবতীদের পরস্পরকে 'আহ্বান' করতে দেখতে পাবেন। বিশেষত যে সব শিশুদের কোনো বোন নেই তারাই সবচাইতে বেশি পরিমাণে 'যৌনক্রীড়া'য় লিপ্ত হচ্ছে।'

অন্যত্র স্কুল শিক্ষক বলেন, 'এখানকার উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের মাঝে যৌন চর্চা এত বেশি পরিমাণে হয় যে, তার পরিসংখ্যান আমি তুলে ধরতে পারবো না। আর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের সরকারী রিপোর্ট মতে প্রতি পঞ্চাশ জন মানুষের মধ্যে একজন মেয়ে শিশু অবশ্যই এমন রয়েছে যে সতের বছর বয়সের পূর্বে সন্তান প্রসবের আশা পোষণ করতে পারে।'

উপরোক্ত রিপোর্ট উদ্ধৃত করার পর নিনা অ্যাপ্টন লিখেন, 'এখানে এরকম অনেক ঘটনাও ঘটছে যে, এগার বার বছর বয়সেই মেয়েরা সন্তান প্রসব করেছে।' (নিনা অ্যাপ্টন, লাভ এ্যান্ড দ্যা ইংলিশ; পৃষ্ঠা ৩৩৮ (১৯৬০), হামারে আয়েলী মাসায়েল; পৃষ্ঠা ১৮৪, ৮৫) 


বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের অন্তরালে

এটা তো স্বতঃস্বীকৃত যে, এ আইন প্রণয়নের ব্যাপারটি প্রথমে কোনো মুসলিম আইনবিদের মাথায় আসেনি। অমুসলিম বিশেষত বৃটিশরা উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আওয়াজ তোলে। তারা কিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ আইনের আওয়াজ তুলে ছিল। তন্মধ্য হতে অন্যতম তিনটি উদ্দেশ্য হলো,

১. একথা প্রমাণ করা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম আয়েশা রাযি. কে ছয় বছর বয়সে বিবাহ করে এবং ফাতেমা রাযি. কে তের বছর বয়সে আলী রাযি. এর সাথে বিবাহ দিয়ে নারী জাতির উপর অন্যায় অবিচার করেছেন। তেমনিভাবে আলী রাযি. উম্মে কুলসুম রাযি. কে তের বছর বয়সে উমর রাযি. এর সাথে বিবাহ দিয়ে মেয়েদের উপর কঠোরতা করেছেন। এভাবে তারা ইসলামী আইনের উপর আঘাত হানার কার্যক্রম হাতে নেয়। (নাউযুবিল্লাহ)

২. উঠতি বয়সের মুসলিম তরুণ- তরুণীরাও ইউরোপ আমেরিকানদের অনুসরণ করে প্রবৃত্তির চাহিদা মত মুক্তমনা পরিবেশে জৈবিক আনন্দ বিনোদন করে কাটাবে। পরিশেষে তাদের জীবনযাত্রাকে বিষাক্ত করে তুলবে।

৩. মুসলিম তরুণীদের অল্পবয়সে বিবাহ হলে তারা মাতৃজীবনে অধিক সংখ্যক সন্তান জন্মদান করবে। এতে মুসলিমদের জনসংখ্যা অধিক হারে বেড়ে যাবে। সুতরাং একজন মুসলিম মা যেন তিনজনের অধিক সন্তান জন্মদান না করতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর সে ব্যবস্থা হলো, ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে কোনো মুসলিম তরুণী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। আর তাদের সন্তান ধারণের সর্বশেষ মেয়াদ হলো ৩৫ বছর। এরপর আর তারা গর্ভে সন্তান ধারণ করতে পারবে না। এবং দু'টি সন্তান গর্ভে আসার মাঝে পাঁচ বছর ব্যবধান থাকতে হবে। সারকথা মুসলিম তরুণীরা গড়ে তিনটির অধিক সন্তান গর্ভে ধারণ করতে পারবে না। (আবূ হুসাম তারফাবী, আল-উনফ যিদ্দাল মারআহ ১/৪৬)


অভিযোগ ও খণ্ডন

ক্যাথলিক সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত খ্রিস্টধর্ম প্রচারক নারীদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা স্মারক গ্রন্থে (পৃ. ৬৯-৭১) এবং কিতাবুদ দালীল নামক অন্য একটি গ্রন্থে (পৃ. ৮২) বাল্যবিবাহের ব্যাপারে কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। যথা, 

১. বিশ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে গর্ভে সন্তান ধারণ করার ফলে মা এবং নবজাতকের উপর মারাত্মক ঝুঁকির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।

খণ্ডন : ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা এ অভিযোগ স্বীকার করে না। কারণ আবহমান কাল থেকেই ১৪-১৫ বছর বয়সী তরুণীদের বৈবাহিক ধারা চলে আসছে। অথচ তাদের অভিযোগের সত্যতা যথার্থ প্রমাণিত নয়। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তবে সেটা অন্য কোনো কারণে ঘটে থাকবে যা বিশ বা ততোধিক বছর বয়সী নারীদের বেলায়ও ঘটে থাকে।

২. সন্তান প্রতিপালন, পারিবারিক ও সামাজিক জ্ঞানের জন্য যে পরিমাণ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বাল্যবিবাহ সে পরিমাণ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

খণ্ডন: (ক) পৃথিবীর বড় বড় জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, লেখকদের ব্যাপারে যদি অনুসন্ধান চালানো হয় তাহলে দেখা যাবে অধিকাংশ মনীষীদের মায়েরাই সাক্ষর জ্ঞান ও পাঠ্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিল না। তবে এসব মহামনীষীদের প্রতিপালনের দায়িত্ব কারা পালন করেছিল? ভিন্ন কোনো শিক্ষিত নারী?

(খ) যদি কর্মজীবী শিক্ষিত নারীদের সন্তানদের উপর জরিপ চালানো হয় তাহলে দেখা যাবে তাদের অনেকেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ এবং অসফল। পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমে এদের নিয়ে প্রতিদিন লেখালেখি হচ্ছে। কারণ তারা শৈশবে মায়ের আদর- সোহাগ ও স্নেহ-ভালোবাসা পায় না। এদের মায়েদের সময় থাকে না তাদেরকে প্রতিপালন করার। ফলে তারা নার্স, আয়া বুয়াদের কোলেই অনাদর অবহেলায় বেড়ে উঠছে।

(গ) যদি পারিবারিক অশান্তি, অমিল সর্বোপরি পারিবারিক যাবতীয় সমস্যার প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয় তাহলে দেখা যাবে, এসবের অধিকাংশই কলেজ-ভার্সিটি পাশ করা শিক্ষিত নারীদের মাধ্যমেই সংঘটিত হচ্ছে। এখানে আমি শিক্ষার ব্যাপারে বিরূপ কোনো মন্তব্য করছি না এবং নারীশিক্ষার বিরুদ্ধেও বলছি না। তবে যে শিক্ষা নারীকে সন্তান প্রতিপালন, পরিবার পরিচালনা এবং স্বামীর আনুগত্যের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলবে সেটা ঐ শিক্ষা নয় যা স্ত্রীকে স্বামীর মুখোমুখি হয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলতে সহায়তা করবে।

৩. বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েরা স্বামী এবং তার পরিবারের সাথে বোঝাপড়া করে চলতে পারে না। ফলে পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টি হয়।

খণ্ডন : (ক) এ সমস্যা একমাত্র বাল্যবিবাহের কারণেই সংঘটিত হয় না বরং এ জাতীয় সমস্যার জন্য অন্যান্য উপসর্গ দায়ী।

(খ) স্বামী বা পরিবারের সাথে বোঝাপড়া করে চলতে না পারার ব্যাপারটি ঐ সমস্ত নারীদের ক্ষেত্রে বহু গুণ বেশি সংঘটিত হয় যারা ১৮ বা ২০ এর কোঠা অতিক্রম করে বিবাহের সিঁড়িতে পা দিয়েছে। কারণ তারা এতদিনে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ও স্বতন্ত্র চিন্তা-চেতনা লালন করার সুযোগ পেয়ে থাকে। এবং সে ব্যক্তিক ও চিন্তাগত চাহিদাগুলো স্বামীর কাছ থেকে যে কোনো উপায়ে আদায় করে নিতে বদ্ধপরিকর হয়। আর এখান থেকেই সূচিত হয় পারিবারিক কলহের প্রধান উপজীব্য। আপনি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সামনে প্রশ্ন রাখুন তাদের মাঝে দাম্পত্য কলহের হার কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে?

(গ) অল্পবয়সী মেয়েরা বয়সী মেয়েদের তুলনায় তাদের স্বামী এবং শ্বশুর পরিবারের অধিক অনুগত হয়ে থাকে। কারণ বয়সী মেয়েরা তাদের মনমতো পারিবারিক জীবন যাপনে বেশি আগ্রহ বোধ করে থাকে। (আবূ হুসাম তারফাবী, আল-উনফ যিদ্দাল মারআহ ১/৫০-৫১) 


বিশিষ্টদের বাল্যবিবাহ

বাল্যবিবাহ নিয়ে মূলধারার মিডিয়াগুলো অবিরাম ঘাম ঝরিয়ে চলছে। বাল্যবিবাহ নিরোধকল্পে তারা সাধ্যের সবটুকু বিলিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। অথচ তাদের বরণীয় যারা তারাই বাল্যবিবাহকে সমাদর আয়োজনে বরণ করে নিয়েছিলেন। আমরা নিম্নে মূলধারার (?) রাজনীতিক, আইনবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের নিকট সমাদৃত ও বরণীয় কিছু ব্যক্তিদের নাম তুলে ধরবো যারা বাল্যবিবাহে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং শিশুপরিণয়ের তারা ঘোর সমর্থক ছিলেন।

(১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ক. যশোরের দক্ষিণ ডিহি গ্রামের শুকদেব রায় চৌধুরীর বংশের ঠাকুর এস্টেটের গোমস্তা বেনীমাধবের কন্যা ভবতারিনী দেবীর সাথে রবীন্দ্রনাথের যখন বিয়ে হয় তখন তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর এবং ভবতারিনী দেবীর বয়স ছিল ১০/১১ বছর। সুতরাং বর বাদ দিলেও কনের বয়সের বিবেচনায় এ বিয়ে ছিল সম্পূর্ণ বাল্যবিবাহ। মৃণালিনী দেবী মারা যান ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর তারিখে। তার বয়স হয়েছিল তখন মাত্র ঊনত্রিশ বছর। প্রায় ঊনিশ বছর বয়সে পাঁচ সন্তানের জননী হয়েছিলেন তিনি।

খ. ১. কবির প্রথম কন্যা মাধবীলতা বেলা। বয়স তের পেরিয়ে কেবলই চৌদ্দতে পা দিয়েছে। কবি তখন তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত পাত্রের সন্ধান পেয়ে মেয়েকে বাল্য বয়সেই পাত্রস্থ করেন। বিয়ের সময় বেলার বয়স ছিল ১৪ বছর এবং জামাতা শরৎ চক্রবর্তীর বয়স ছিল ঊনত্রিশ বছর। স্বামীর সাথে বেলার বয়সের ব্যবধান ছিল ১৫ বছর।

২. কবির সেজো মেয়ে রেনুকা, ডাক নাম রানী। রানী কেবল এগারোতে পা দিয়েছে। কবি তাঁকে এ বয়সেই বিয়ে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেন।

৩. রবীন্দ্রনাথের সর্বকনিষ্ঠ কন্যা মীরা (১৮৯৪-১৯৬৯), ডাক নাম অতসী। কবি তার ছোট্ট এ মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন। যখন বিয়ে সম্পন্ন হয় মীরার বয়স তখন ১৩ বছর। 

(২) রবি ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) বিয়ে করেছিলেন ১৪/১৫ বছর বয়সে। তখন তার স্ত্রী সারদা দেবীর বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর।

(৩) শিবনাথ শাস্ত্রী বিয়ে করেছিলেন ১২/১৩ বছর বয়সে। তখন তার স্ত্রীর বয়স ছিল ১০ বছর। 

(৪) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিয়ে করেছিলেন ১৪ বছর বয়সে। তখন তার স্ত্রীর বয়স ছিল ৮ বছর।

(৫) বঙ্কিমচন্দ্র বিয়ে করেছিলেন ১১ বছর বয়সে তখন তার স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর।

(৬) রাজনারায়ণ বসু বিয়ে করেছিলেন ১৭ বছর বয়সে। তখন তার স্ত্রীর বয়স ছিল ১১ বছর।

(৭) জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ১৯ বছর বয়সে। তখন তার স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর।

(৮) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ১৭ বছর বয়সে। তখন তার স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর। 

(সূত্র : http://www.dailysangram.com/post/ 278817

(৯) বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তখন তার বয়স হয়েছিলো ১৮ বছর এবং তার স্ত্রীর বয়স হয়েছিল মাত্র ৮ বছর। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বেশ আয়েশী উপস্থাপনায় তার বিবাহ বয়স নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো তেরো হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, 'তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।' রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান; পৃষ্ঠা ৬-৮) - http:// www.sonelablog.com


বৈবাহিক বয়স: প্রেক্ষিত ইউরোপ আমেরিকা ও বিভিন্ন ধর্মীয় দর্শন

১. স্পেনের ক্যাথলিক গির্জা থেকে বিবাহের বয়স নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিবাহ চুক্তি শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত হলো, বরের বয়স ন্যূনপক্ষে ১৪ এবং কনের বয়স ১২ হতে হবে। তেমনিভাবে আমেরিকার অ্যারিজোনা, ফ্লোরিডা, আইডাহো রাজ্যের বিবাহ আইনেও বলা হয়েছে, বিবাহের ক্ষেত্রে বরের বয়স ন্যূনপক্ষে ১৪ এবং কনের বয়স ১২ হতে হবে।

২. আমেরিকার কলোরাডো রাজ্যের বিবাহ আইনে বলা হয়েছে, বিবাহের ক্ষেত্রে বরের ২১ কনের ১২ বছর পূর্ণ হতে হবে। 

৩. যুগোস্লাভিয়ার বিবাহ আইনে বলা হয়েছে, ছেলের ১৫ এবং মেয়ের ১৩ বছর পূর্ণ হতে হবে।

৪. আমেরিকার আলাবামা রাজ্যের বিবাহ আইনে বলা হয়েছে, ছেলের ১৭ বছর এবং মেয়ের ১৩ বছর পূর্ণ হতে হবে।

৫. ইতালির বিবাহ আইনে বলা হয়েছে, ছেলের ১৬ এবং মেয়ের ১৪ বছর পূর্ণ হতে হবে।

৬. গ্রিসের বিবাহ আইনে ১৮ এবং ১৪ বছর শর্ত করা হয়েছে।

৭. ইউরোপের বেলজিক রাজ্যের বিবাহ আইনে যথাক্রমে ১৮ এবং ১৫ বছরে শর্ত করা হয়েছে।

৮. জাপানের বিবাহ আইনে ১৭ এবং ১৫ বছর করা হয়েছে।

৯. নেদারল্যান্ড এবং হাঙ্গেরিতে ১৮ এবং ১৬ বছর করা হয়েছে।

১০. ইয়াহুদী ধর্মে বিবাহের ক্ষেত্রে ছেলের বয়স ১৮ এবং মেয়ের বয়স ১৩ করার বিধান রাখা হয়েছে। (আলা আবূ বাকার কৃত ইনসানিয়াতুল মারআতি বাইনাল ইসলামি ওয়াল আদইয়ানিল উখরা এর সৌজন্যে আবূ হুসাম তারফাবী, আল-উনফ যিদ্দাল মারআহ ১/৫২)

১১. অন্যদিকে বাংলার হিন্দু পরিবারগুলোর মাঝে প্রাচীনকাল থেকেই বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল। হিন্দু সমাজে ছেলেমেয়েদের বিশেষ করে মেয়েদের, বাল্যকালে বয়ঃসন্ধির পূর্বেই বিবাহ দেয়াকে ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করা হতো। প্রচীন হিন্দু আইনপ্রণেতা মনু নারীর বিয়ের বয়সের যে বিধান দিয়েছেন, তা হলো ত্রিশ বছরের পুরুষ বারো বছরের কন্যাকে বিয়ে করবে। চব্বিশ বছরের পুরুষ আট বছরের কন্যাকে বিয়ে করবে, নইলে ধর্ম লঙ্ঘিত হয়। (বাংলাপিডিয়া ৯/৩৩৯) 

আরবের দৈনিক আঞ্চলিক পত্রিকা আল-হায়াতে রোচেস্টার/রোচেসরাজ ভার্সিটির নারী গবেষণা কেন্দ্রের একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে আমেরিকায় বিবাহের হার আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। হ্রাস পাওয়ার কারণ হলো,

(১) আমেরিকানরা বিবাহ বয়সকে অধিক বিলম্বিত করে চলেছে। ১৯৬০ সালে নারীর বিবাহের গড় বয়স ছিল বিশ বছর। আর পুরুষের বিবাহের গড় বয়স ছিল ২৩ বছর। ১৯৯৭ সনে গিয়ে বিবাহ বয়সের গড় গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২৫- ২৭ বছরে। 

(২) মানুষের বিবাহের বয়স যত বৃদ্ধি পেতে থাকে বিবাহের প্রতি মানুষের আগ্রহ তত হ্রাস পেতে থাকে। ফলে অনেক আমেরিকান মেয়ে বৈবাহিক সূত্রবিহীন সন্তান প্রসব করে থাকে। ষাটের দশকে আমেরিকাতে ২৫.৩ পার্সেন্ট শিশু বৈবাহিক সূত্রবিহীন জন্ম লাভ করে। ১৯৯৭ সনে গিয়ে বিবাহসূত্র- বিহীন শিশুর হার দাঁড়ায় ৩৫ পার্সেন্ট।

(৩) বিবাহ বয়স বৃদ্ধি দাম্পত্য জীবন এবং পারিবারিক জীবনের প্রতি মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। ফলে দেখা যাচ্ছে একছাদের নিচে একজন পুরুষ এবং মহিলা বিবাহবিহীন যৌনজীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। (ড. হুসামুদ্দীন আফফানা, আযযিওয়াজুল মুবকির ১/৬) 


বাল্যবিবাহ বনাম বাল্যব্যভিচার 

বিবাহে সমস্যা। ব্যভিচারে সমস্যা নেই। সামাজিক দৃষ্টিতে বিষয়টা ঘৃণিত ও আপত্তিকর মনে হলেও আইনের দৃষ্টিতে বিষয়টা সামান্যতমও ঘৃণার নয়; পুরোটাই বিধিসম্মত।


ভূতাশ্রিত সরিষা দ্বারা ভূত তাড়ানো হাস্যকর বৈ কিছুই নয়

সম্প্রতি আলজাজিরা পরিবেশিত একটি সংবাদ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। যে আমেরিকা পৃথিবীব্যাপী বাল্যবিবাহ বন্ধে আদা-জল খেয়ে মাঠে নেমেছে সে আমেরিকাই বাল্যবিবাহ জ্বরে কঠিনভাবে আক্রান্ত। শিশু অধিকার ও মানবাধিকার বিষয়ক সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আমেরিকার মাটিতেই বিদ্যমান। শিশু অধিকারে অন্যতম একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাল্যবিবাহ নিরোধ প্রকল্প। অথচ সে আমেরিকার অধিকাংশ রাজ্যে এখনো বাল্যবিবাহ অনুমোদিত। ২৫টি রাজ্যে অল্পবয়সী মেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স পর্যন্ত নির্ধারিত নেই। অন্যদিকে অবশিষ্ট রাজ্যগুলোতে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৩ রাখা হয়েছে। আমেরিকার শিশুবিয়ে বন্ধে আন্দোলনকারী সর্বশেষে মুক্ত নামক একটি মুভমেন্টের সর্বশেষ তথ্যমতে ২০০০ সাল থেকে নিয়ে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৭ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের সংখ্যা দুই লক্ষেরও বেশি। পাশাপাশি আলাস্কা, লুইজিয়ানা ও উত্তর ক্যারোলিনা রাজ্যে ১২ বছর বয়সী মেয়েদের এঙ্গেজমেন্ট হয়। গত ১০ বছরে আমেরিকায় ১২ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের সংখ্যা প্রায় আড়াই লক্ষ। ফারিদি রিসেল নেতৃত্বাধীন সংগঠনটি আরো জানায়, অধিকাংশ বিবাহ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক  মেয়েদের মাঝেই সংঘটিত হয়। হিউম্যান রাইট ওয়াচ জানায়, ২০০০ হতে ২০১০ সালের মধ্যে ফ্লোরিডা রাজ্যে ১৬৪০০ এর বেশি বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয়। আর শুধু নিউইয়র্কেই ১৮ বছরের নিচে ৩৮৫০ জনের বেশি শিশুর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। আরবের বৃদ্ধ শাইখদের অসম (?) বিবাহের সংবাদ মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করলেও মার্কিনিদের এসব 'কিত্তি-কলাপ' নিয়ে কোনো আলোচনা নেই বললেই চলে। দ্বিচারী এ মনোভাব বিশ্বসভ্যতায় মানবাধিকার রফতানীকারী শক্তিশালী একটি দেশের স্পষ্ট নৈতিক দেউলিয়াত্বেরই পরিচয় বহন করে। (ourislam24.com)

নারী পুরুষের যৌনজীবন একপ্রকৃতির নয় গড়পরতা মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা ৪৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। একজন নারী তার যৌনজীবনে প্রায় চারশ'র মতো ডিম্বকোষ উৎপাদন করতে পারে। পক্ষান্তরে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা মেয়েদের মত এতোটা সীমিত নয়। বৃদ্ধ বয়সেও পুরুষের শুক্রকীট উৎপাদনক্ষমতা সচল থাকে। মেয়েদের জীবনে পুরুষের তুলনায় বার্ধক্য আসে অতি দ্রুত। তাই বৃদ্ধা নারীর গড়পরতা বৃদ্ধি সব দেশেই বেশি দেখা যায়। পৃথিবীতে বৃদ্ধ পুরুষের তুলনায় বৃদ্ধা নারীর সংখ্যাই বেশি। মানসিক দিক থেকেও নর-নারীর বিকাশ-বৃদ্ধি একরকম নয়। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা কথা বলতে শেখে আগে। তারা সংসার সম্বন্ধেও অভিজ্ঞ হয়ে উঠে ছেলেদের আগে। তাই ছেলে-মেয়ের মানসিক ও জৈবিক বয়সকে একাকার করে দেখতে চাওয়া বিজ্ঞানসম্মত নয়। ছেলে-মেয়ের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিবাহ বয়স নির্ধারণ করতে হলে মানব জীবনের এসব জৈব বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। মেয়েদের বিবাহ বয়স বৃদ্ধি করে তাদের আইবুড়ি করা হবে তাদের জন্য চরম ক্ষতিকর। অধিক বয়সী মেয়েরা সন্তান ধারণে পেইন সমস্যায় ভোগেন বেশি। অনেক ক্ষেত্রে তাদের গর্ভজাত সন্তান হয় হাবাগোবা। কারণ তাদের জরায়ুতে ভ্রুণের প্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। এ বয়সে ভ্রুণের মাথার উপর জরায়ু প্রাচীরের চাপ পড়ে। ফলে বেশি বয়সী নারীর সন্তান হাবাগোবা হবার আশঙ্কা খুব বেশি। ইংরেজিতে এরকম হাবাগোবা সন্তানকে বলা হয় মঙ্গোলিয়ান ফিব্ল মাইন্ডেড। উপরন্তু বেশি বয়সের মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীর সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে না। ফলে বেশি বয়সী মেয়েদের বিবাহে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি। সুতরাং বিবাহ-বয়স নিরূপণের ক্ষেত্রে এসব বাস্তবতাকেও বিবেচনায় নেয়া কর্তব্য। (http://www.onnodiganta.net/article /detail/4906) 


ব্যাকডেটেড কে বা কারা? 

বাংলাদেশে এখন বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন শিরোনামে যে আইনটি চলছে তা মূলত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯ হতে উদগত। সেকালে এ আইনটিকে এ নামে ডাকা হতো না। ডাকা হতো সারদা আইন নামে। আইনটি তৈরী করেছিলো হরবিলাস সারদা নামক এক ব্যক্তি, যাকে ব্রিটিশরা অতিশয় আনুগত্য প্রদর্শনের দরুণ দেয়ান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেছিলো। হরবিলাস সারদা ছিলো হিন্দু হিতৈষী। হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সে একটি গ্রন্থও রচনা করে। বস্তুতঃ সে সময় বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটি হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ প্রয়োজন হয়ে পড়ে তার অন্যতম কারণ যৌতুক প্রথা। সেকালে অনেক হিন্দু বাবা-মা আর্থিক অসচ্ছলতার দরুণ মেয়ের যৌতুক যোগাড় করতে সক্ষম হতো না। ফলে মেয়েটি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে গেলে তাকে আইবুড়ি ডাকা হতো এবং বিবাহ দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়তো। কারণ হিন্দুদের সমাজ-জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় প্রধানত মনুর বিধান অনুসারে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, মেয়েদের আট বছর বয়সের মধ্যেই বিবাহ প্রদান করতে হবে। হিন্দু সমাজে আট বছর বয়সী বালিকাকে বলা হয় গৌরী। গৌরী অর্থ অবিবাহিতা অষ্টমবর্ষীয়া বালিকা। গৌরীদান মানে অষ্টমবর্ষীয়া কন্যাকে বিবাহে সম্প্রদান। তখন বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে মেয়েদের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিলো ১৪ বছর। এতে করে হিন্দু বাবা-মায়েরা অন্তত যৌতুক প্রস্তুত করার জন্য কিছুটা সময় পেতো। হরবিলাস সারদা ১৯২৭ সালে বাল্যবিবাহ বিষয়ে যে আইনটি তৈরি করেছিলো তা ছিলো মূলত হিন্দু বাল্যবিবাহ আইন। পরবর্তীকালে সুকৌশলে হিন্দু, মুসলিম সকলের উপর এ আইনটি চাপিয়ে দেয়া হয়। যা হোক, সে সময় সারদা আইনের অন্যতম বেইজ ধরা হয় Age of Consent বা যৌনসম্মতি বয়স তথা নারীদের বয়ঃপ্রাপ্তির সময়কে। সে সময় নারীরা সাধারণত ১৪ বছর বয়সে বয়ঃপ্রাপ্ত হতো। অতি সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, সময় যতো যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা ততো দ্রুত বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে। কয়েক বছর আগে জার্মান বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দাবি করেছেন, ১৮৬০ সালে মেয়েরা বয়ঃপ্রাপ্ত হতো ১৬.৬ বছর বয়সে। ১৯২০ সালে তা নেমে আসে ১৪.৬ বছর বয়সে। ১৯৫০ সালে তা হয় ১৩.১ বছর বয়স। ১৯৮০ সালে তা আরো নেমে দাঁড়ায় ১২.৫ বছর বয়সে।

এবং ২০১০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১০.৫ বছর বয়সে।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বাল্যবিবাহ নিরোধ বা সারদা আইন প্রণয়ন করা হয়েছিলো নারীদের বয়ঃপ্রাপ্তি বয়সকে কেন্দ্র করে। তখন মেয়েদের বয়ঃপ্রাপ্তি হতো ১৪ বছর বয়সে, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলছে বর্তমানে মেয়েদের বয়ঃপ্রাপ্তির বয়স ১০ বছরে নেমে এসেছে। সে হিসেবে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটি ব্যাকডেটেড বা মান্ধাতার আমলের আইন, যা বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞান সমর্থন করে না। বর্তমান অনেকে এ আইনকে আধুনিকতা হিসেবে ধারণা করতে পারেন, কিন্তু বাস্তবে এ আইনকে যারা সঠিক মনে করে তারাই ব্যাকডেটেড এবং যারা সঠিক মনে করে না তারাই আধুনিক। (https://www.facebook.com/noyon chatterjee5)


সাবালকত্বের সূচনা বয়সে বিবাহের ইতিবাচক দিক

১. সূচনা বয়সী মেয়েদের প্রজননক্ষমতা অধিক বয়সী মেয়েদের সন্তান প্রজননক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি। 

২. গর্ভাশয়, ডিম্বাশয় এবং স্তনের অবাঞ্ছিত স্ফীতি ঐসব মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক কম লক্ষ্য করা যায় যারা সূচনা বয়সে গর্ভ ধারণ করে এবং সন্তান প্রসব করে। 

৩. জরায়ুর বাইরে গর্ভসঞ্চার (Ectopic Pregnancy - الحمل المهاجر) - আমেরিকার বিশিষ্ট বিজ্ঞানী রাবিন তার ১৯৮৩ সনের একটি গবেষণায় প্রমাণ করেছেন, যেসব নারীদের বয়স ৩৫ এর ঊর্ধ্বে তাদের জরায়ুর বাইরে গর্ভসঞ্চারের হার ১৭.২ পার্সেন্ট। আর যেসব মেয়েদের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে তাদের অকাল গর্ভসঞ্চারের হার ৪.৫ পার্সেন্ট।

৪. গর্ভচ্যুতি রোধ: আমেরিকান বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হ্যাওয়েন এর গবেষণা মতে ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বের নারীদের গর্ভচ্যুতির হার অল্পবয়সী নারীদের তুলনায় চার গুণ বেশি। সারকথা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রমাণ করে, যেসব মেয়েদের বয়স ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে তাদের গর্ভজটিলতা তেমন একটা লক্ষ্য করা যায় না। আর ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের যে গর্ভজটিলতা সৃষ্টি হয় তাও তুলনামূলক অনেক কম। পার্কল্যান্ড হসপিটাল টেক্সাস এর বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্যাটিন এ বিষয়টি প্রমাণ করেছেন।

(ড. হুসামুদ্দীন আফফানা, আযযিওয়াজুল মুবকির ১/৭)

উল্লেখ্য, যে সব রাষ্ট্রে শীতের মাত্রা তুলনামূলক বেশি সে সব রাষ্ট্রে সাবালকত্বের মেয়াদ দীর্ঘ হয়। এজন্যই তারা বিবাহ বয়স ১৮ নির্ধারণ করে থাকে। তো গ্রীষ্মপ্রবণ রাষ্ট্রগুলোতে বিবাহ বয়স বৃদ্ধি করে বিশ-একুশ বছর করার কি কারণ থাকতে পারে? এখানে তো সাবালকত্বের মেয়াদ দীর্ঘ হয় না। উপরন্তু শীতপ্রধান দু'টি রাষ্ট্র সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড বিবাহস্বল্পতা এবং প্রজননস্বল্পতার কারণে বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। কারণ বিবাহ বয়সের ক্ষেত্রে এ জাতীয় বাধ্যবাধকতা অবাধ এবং উন্মুক্ত যৌনাচারের দিকে ঠেলে দেয়। সুতরাং তাদের আর বিবাহের প্রয়োজন পড়ে না। (আবু হুসাম তারফাভী, আল-উনফ যিদ্দাল মারআহ ১/৫৩)

তথ্যসূত্র: কুরআনুল কারীম; সহীহ বুখারী; সহীহ মুসলিম; ড. হুসামুদ্দীন আফফানা, আযযিওয়াজুল মুবকির; আহকামুল কুরআন লিলজাস্সাস; মাকালাতুন ফিত তাশাইউ; আলমাবসূত লিস সারাখসী; নিনা অ্যাপ্টন, লাভ এ্যান্ড দ্যা ইংলিশ; আবূ হুসাম তরফাবী, আল-উনফ যিদ্দাল মারআহ; কিতাবুদ দলীল; সংসদ বাংলা অভিধান; মোহাম্মাদ হাবিবুর রহমান, ইসলামীক জুরিসপ্রুডেন্স ও মুসলিম আইন; Child Marriage Prevention Law; বাংলাপিডিয়া; মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ., জাওয়াহিরুল ফিকহ; জাস্টিস মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, হামারে আয়েলী মাসায়েল; দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ও ইন্টারনেট।

মন্তব্য (...)