প্রবন্ধ

মাযহাবের মহান ইমামগণের উপর আরোপিত অপবাদের অপনোদন

লেখক:মাওলানা আব্দুল মালেক
৩ জুলাই, ২০১৪
২৬৩২ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

মূল আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ.

কুরআন হাদীসের জটিল ও দ্বিমুখী অর্থবহ বিষয়াদির সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধান পেশ করে যারা গোটা উম্মাহর কুরাআন- হাদীসের আলোকে জীবন যাপনের পথকে সুগম করেছেন তারা হলেন এই উম্মাহর ইমাম। ইমামগণ ছিলেন উম্মাহর জন্য নিবেদিত প্রাণ। কুরআন সুন্নাহের প্রতি তাদের আগ্রহ ও আসক্তির কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। কিছু অবুঝ ভাই উম্মাহর সর্বজন স্বীকৃত এই ইমামগণের ব্যাপারে এমন সব মন্তব্য করেছেন যা একজন সাধারণ মুসলমানের ক্ষেত্রে করাও বড় দুঃখজনক ব্যাপার। বিশেষ করে তাদের প্রতি এই অপবাদ দেয়া যে, তারা হাদীস বেশি জানতেন না, হাদীস বাদ দিয়ে তারা কিয়াসের উপর আমল করেছেন। এগুলোকে তাদের অজ্ঞতা ও হঠকারিতার বহিঃপ্রকাশ বলা চলে। তবে এই ফেতনা আজকের নয়, বহু আগ থেকেই চলে আসছে। এদেরকে 'ঠাণ্ডা' করতে বহু হক্কানী উলামায়ে কেরাম শুরু থেকেই কলম হাতে নিয়েছেন। ৭ম ৮ম শতকের মহামনীষী আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. এ বিষয়ে রফউল মালাম আন আইম্মাতিল আ'লাম নামে স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ রচনা করছেন। 


বিশিষ্ট ইমামদের উপর উত্থাপিত অভিযোগের খণ্ডন

এ প্রবন্ধে আমরা আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার উক্ত কিতাবের কিছু চুম্বকাংশ পেশ করবো। তবে এর পূর্বে ইমামগণের নিকট হাদীসের মর্যাদা ও অবস্থান কেমন ছিল এবং হাদীসের উপর আমল করার প্রতি তাদের আগ্রহ ও গুরুত্ব কত বেশি ছিল তা স্বয়ং ইমামগণের ভাষায়ই তুলে ধরবো।

ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেন, (অর্থ) মানুষের মাঝে যত দিন হাদীস অন্বেষণকারী থাকবে মানুষ ততদিন কল্যাণ ও নিরাপত্তায় থাকবে। মানুষ যখন হাদীস ভিন্ন অন্য জ্ঞান অন্বেষণ করবে, তখন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।' তিনি আরো বলেন, (অর্থ) ‘তোমরা আল্লাহ তা'আলার দীনের ক্ষেত্রে নিজস্ব মত প্রদানে বিরত থাক এবং রাসূলের সুন্নাহকে মজবুতভাবে অনুসরণ কর, যে ব্যক্তি সুন্নাহ পরিত্যাগ করবে সে ভ্রান্তিতে নিপতিত হবে। (মীযানুল কুবরা,শা'রানী ১/৫১)

ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, (অর্থ) 'রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস বর্ণনা করে তার খেলাফ মত প্রদান করলে কোন্ যমীন আমাকে রহম করবে?' (খাতিমাতু মিফতাহিল জান্নাহ ফিল ইজতিহাদি বিসসুন্নাহ)

ইমাম মালেক রহ. বলেন, (অর্থ) ‘নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহসমূহ নূহ আ. এর নৌকার ন্যায়। যে তাতে আরোহন করবে, সে নাজাত পাবে। আর যে তা থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে সে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হবে।' ইমাম আহমদ রহ. বলেন, (অর্থ) 'যে ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস (সুন্নাহ) প্রত্যাখ্যান করেছে সে তো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে'। (মানাকিবুল ইমাম আহমাদ; পৃষ্ঠা ১৮২)

এছাড়া সিয়ার ও তারীখের কিতাবসমূহে তাদের এ ধরনের উক্তি ভরপুর। ইমামগণের এসব উক্তির সারকথা হল, হাদীস গ্রহণে ও পালনেই নাজাত। আর হাদীস পরিহারে ধ্বংস অনিবার্য। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ইমামগণের নিকট হাদীসের গুরুত্ব কত বেশি ছিল। এরপরও তাদের উপর এই অপবাদ আরোপ করা যে, তারা হাদীস পরিত্যাগ করেছেন, খুবই আশ্চর্যজনক। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া এসব অপবাদ ও অমূলক উক্তির খণ্ডনে লিখেন,


 وليعلم أنه ليس أحد من الأئمة المقبولين عند الأمة قبولا عاما يتعمد مخالفة رسول الله صلى الله عليه وسلم في شيء من سنته؛ دقيق ولا جليل؛ فإنهم متفقون اتفاقا يقينيا على وجوب اتباع الرسول وعلى أن كل أحد من الناس يؤخذ من قوله ويترك إلا رسول الله صلى الله عليه وسلم ولكن إذا وجد لواحد منهم قول قد جاء حديث صحيح بخلافه فلا بد له من عذر في تركه . وجميع الأعذار ثلاثة أصناف : أحدها : عدم اعتقاده أن النبي صلى الله عليه وسلم قاله. والثاني : عدم اعتقاده إرادة تلك المسألة بذلك القول والثالث : اعتقاده أن ذلك الحكم منسوخ 


‘জেনে রাখা উচিত, উম্মাহর নিকট ব্যাপকভাবে মকবূল ও সমাদৃত ইমামগণের কেউই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছোট বড় কোনো সুন্নাতেরই ইচ্ছাকৃত কোনো বিরোধিতা করেননি। কারণ ইমামগণ দু'টি বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে একমত হয়েছেন, (এক) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এত্তেবা অনুসরণ ওয়াজিব। (দুই) মানুষের সব কথা গ্রহণযোগ্য হবে না ঠিক কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কথাই গ্রহণ করা হবে।

তবে কোনো ইমাম থেকে যদি এমন মত পাওয়া যায় যা সহীহ হাদীসের সাথে বাহ্যত বিরোধপূর্ণ মনে হয়, তবে বুঝতে হবে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে তার কোনো ওযর বা কৈফিয়ত আছে। তাদের সকল ওযর মৌলিকভাবে তিন ধরনের।

(ক) মুজতাহিদ (কুরআন-হাদীসে পারদর্শী ব্যক্তি) ইমামের জানামতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে এমনটি বলেননি। 

(খ) মুজতাহিদ ইমামের মতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদীস দ্বারা এই মাসআলা বুঝানোর ইচ্ছা করেননি।

(গ) মুজতাহিদের মতে ঐ হাদীসটির হুকুম রহিত হয়ে গেছে।

ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, এই তিন প্রকার ওযরের পিছনে আবার অনেক কারণ রয়েছে। অতঃপর তিনি বিস্তারিতভাবে দশটি কারণ আলোচনা করেছেন। নিম্নে সংক্ষেপে সেগুলো পেশ করা হল,


১. হাদীসটি সম্পর্কে অবহিত না হওয়া।

অনেক ক্ষেত্রে মুজতাহিদ ইমামের নিকট সুনির্দিষ্ট কোন বিষয়ের হাদীস পৌঁছে না। তখন তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সমাধান কুরআনের কোন আয়াতের বাহ্যিক অর্থ বা তার জানা কোন হাদীসের মাধ্যমে দেন। অনেক ক্ষেত্রে ইজতিহাদ, কিয়াসের মাধ্যমেও দেন। এতে পেশ করা সমাধান মুজতাহিদের অজানা হাদীসের সাথে কখনো বিরোধপূর্ণ হয়, অনেক ক্ষেত্রে আবার সঙ্গতিপূর্ণও হয়। কিন্তু মুজতাহিদের কাছে যেহেতু হাদীসটি পৌঁছেনি তাই তার দেয়া সমাধান হাদীসটির সাথে বিরোধপূর্ণ হলেও তার উপর কোন অভিযোগ উত্থাপিত হবে না। কারণ হাদীসটি অজানা থাকায় সে অনুযায়ী সমাধান পেশ করার মুকাল্লাফ বা ভারার্পিত নন তিনি।

(আল্লামা ইবনে তাইমিয়া বলেন,) সালাফ বা অতীত ইমামদের যেসব মত হাদীসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ পাওয়া যায় তার অধিকাংশ এ কারণেই।

এমনটি ঘটা বিরল কিছু না। খুলাফায়ে রাশেদীন থেকেও এমন ঘটনার অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, অথচ তারা ছিলেন হাদীস বিষয়ে উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী।

হযরত আবু বকর রাযি. কে দাদীর মিরাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এই বিষয়ে কুরআনে তো কিছু নেই। সুন্নাহতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কিছু আছে কি না আমার জানা নেই। তবে আমি অন্যদেরকে জিজ্ঞাস করবো। এরপর তিনি অন্যান্য সাহাবাদেরকে জিজ্ঞাস করলেন। তখন হযরত মুগীরা ইবনে শু'বা, মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা এবং ইমরান ইবনে হুসাইন রাযি. বললেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাদীকে এক ষষ্ঠাংশ দিয়েছেন। তো দেখুন, অন্যদের তুলনায় হযরত আবু বকরের হাদীস বেশি জানা থাকলেও এই বিষয়টি জানা ছিল না।

এভাবে হযরত উমর রাযি. বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি বিষয়ক একটি হাদীস হযরত আবু মূসা আশআরী রাযি. থেকে জানেন।

আর হযরত উসমান রাযি, স্বামী মারা গেলে স্ত্রী স্বামীর বাড়িতে অবস্থান করার হাদীসটি জানেন ফুহায়রা বিনতে মালেকের মাধ্যমে।

হযরত আলী রাযি. স্ত্রী গর্ভবর্তী অবস্থায় স্বামী মারা গেলে স্ত্রীর ইদ্দত যে সন্তান প্রসব পর্যন্ত হবে এই হাদীসটি জানেন সুবাইআ আসলামিয়্যাহ রাযি. এর কাছ থেকে। এ ধরণের আরো অসংখ্য অগণিত উদাহরণ রয়েছে।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী তার হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা আলইনসাফ কিতাবে লিখেন, “কিছু ব্যক্তি এই প্রথম কারণটি দ্বারা মারাত্মক ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। তারা হাদীস অনুযায়ী আমল না করার অন্যান্য সব কারণ বাদ দিয়ে শুধু এটিকেই একমাত্র কারণ বানিয়ে নিয়েছেন। ফলে যেখানেই কোনো মুজতাহিদের মতামত বাহ্যিকভাবে হাদীসের খেলাফ মনে হয়, সেখানেই তারা ধরে নেন যে, এই হাদীসটি ঐ মুজতাহিদের নিকট পৌছেনি। এ পদক্ষেপ খুবই অসঙ্গতিপূর্ণ।

আর আল্লামা ইবনে তাইমিয়া সালাফের যেসব ঘটনা নকল করেছেন তা হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। সুতরাং এ কথা বলা যে, ‘হাদীসের উপর আমল না করা অধিকাংশ সময় এ কারণে হয়' প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। কারণ এমন ঘটনা খুব বেশি না, খুব বিরল এবং কদাচিৎ ঘটেছে।

তাছাড়া এই ওযরটি একাল সেকাল সবকালে ঐ সকল মাসআলার ক্ষেত্রেই বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত যার সম্মুখিন হতে হয় কালেভদ্রে। আর আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বর্ণিত ঘটনাবলী এ কথারই প্রমাণ বহন করে। কিন্তু যে সকল মাসআলা দৈনন্দিনের, বারবার যার সম্মুখীন হতে হয় সেক্ষেত্রে তো এই কারণটি প্রয়োগযোগ্য না। যেমন ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া না পড়া, আমীন উঁচু আওয়াজে বলা বা নিম্ন স্বরে বলা, রুকুতে যাওয়ার সময় ও রুকু হতে উঠার সময় হাত উঠানো না উঠানো, আযান ইকামতে শব্দ কয়টি হবে? ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রতিদিন সবার সামনে বারবার আসে। সুতরাং এসব বিষয়ে সাহাবা, তাবেয়ীদের কাছে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত পৌঁছেনি বলা একেবারে মূর্খতা।


২. কোনো ইল্লতের কারণে হাদীসটি প্রামাণ্য না হওয়া। 

মুজতাহিদের নিকট হাদীস পৌঁছেছিল কিন্তু এই হাদীস তার কাছে ত্রুটিমুক্তভাবে প্রমাণিত ছিল না। কারণ ঐ হাদীসের কোনো রাবী হয়তবা তার নিকট মাজহুল (অজ্ঞাত) ছিল। অথবা মুত্তাহাম (মিথ্যায় অভিযুক্ত) ছিল বা সায়্যিয়ুল হিফয (স্মৃতি শক্তি দুর্বল) ছিল। অথবা হাদীসটি তার কাছে মুনকাতে' (বিচ্ছিন্ন সনদে) পৌঁছেছে বা রাবী হাদীসের শব্দ যবত (আয়ত্ত) করতে পারেনি।

আরো আলোচনার পর তিনি লিখেন, কোন হাদীসের উপর আমল ছেড়ে দেয়ার ঘটনা এ কারণেই খুব বেশি ঘটে। এ কারণটির উপস্থিতি প্রথম যুগের তুলনায় তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের থেকে নিয়ে প্রসিদ্ধ ইমামগণ ও তৎপরবর্তীদের মধ্যে অনেক বেশি দেখা যায়। বলা যায় প্রথম কারণ থেকে এটিই বেশি বিদ্যমান।


৩. হাদীস সহীহ যঈফ হওয়ার ক্ষেত্রে ইখতিলাফ।

একজন মুজতাহিদ তার গবেষণা অনুযায়ী এক হাদীসকে যঈফ বলেছেন অন্য মুজতাহিদ ঐ একই হাদীসকে সহীহ বলেছেন। হতে পারে যিনি যঈফ বলেছেন তার কথা ঠিক। কিংবা যিনি সহীহ বলেছেন তার কথা, বরং কারো কারো দৃষ্টিতে তো একই সাথে দুই মুজতাহিদের কথাই সঠিক। তাদের বক্তব্য হলো, كل مجتهد مصيب প্রত্যেক মুজতাহিদ সঠিক এবং অভ্রান্ত।


৪. কিছু হাদীসে আমলযোগ্য হওয়ার জন্য নির্ধারিত শর্তাবলী পরিপূর্ণ না পাওয়া।

আদেল (সৎ) এবং হাফেয (স্মৃতিশক্তির অধিকারী) এর সূত্রে বর্ণিত খবরে ওয়াহিদ (বর্ণনা সূত্রের কোন পর্যায়ে একক বর্ণনাকারী থাকলে তাকে খবরে ওয়াহিদ বলে) দলীলযোগ্য হওয়ার জন্য মুজতাহিদ এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেন যা অন্য মুজতাহিদের দৃষ্টিতে শর্ত না। যেমন কেউ শর্ত করেছে হাদীসটি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে যাচাই করে দেখতে হবে (অর্থাৎ সতঃসিদ্ধ বর্ণনার আলোকে এ ধরনের খবরে ওয়াহিদের অর্থ যাচাই করে দেখতে হবে)। তদ্রূপ কারো কারো নিকট শর্ত হলো, শরীয়তের স্বাভাবিক মূলনীতির সাথে বিরোধপূর্ণ হলে বর্ণনাকারী ফকীহ (হাদীসের মর্ম এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী) হওয়া।

কেউ বলেন, মানুষ ব্যাপকভাবে যে বিষয়ের সম্মুখিন হয় এমন বিষয়ের হাদীস হলে তা অসংখ্য বর্ণনাকারী কর্তৃক প্রচারিত ও প্রকাশিত হওয়া।

তো যে মুজতাহিদ যে পর্যায়ের হাদীস গ্রহণের জন্য যে শর্ত করেছেন তার অনুপস্থিতিতে তিনি তা গ্রহণ করতে অপারগ। এ কারণে হাদীসটির উপর আমল অনেক সময় ছেড়ে দেন। অথচ অন্য মুজতাহিদ দিব্যি সেই খবরে ওয়াহিদের উপর আমল করছেন।


৫. হাদীস ভুলে যাওয়া।

"মুজতাহিদের কাছে হাদীস পৌঁছেছিল এবং হাদীসটি তার নিকট প্রমাণ-সিদ্ধও কিন্তু তিনি তা ভুলে গেছেন। যেমন, (ক) জুনুবী বা যে ব্যক্তির উপর গোসল ফরয তার জন্য তায়াম্মুমের বিধান বিষয়ক হাদীস হযরত উমর রাযি ভুলে গিয়েছিলেন। হযরত আম্মার রাযি, তাকে স্মরণ করিয়ে দেন। (খ) হযরত উমর রাযি. একবার বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বক্তব্যে তিনি বললেন, কেউ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী ও মেয়েদের মহরের বেশি মহর ধার্য করতে পারবে না। এ সময় একজন মহিলা এই আয়াত পড়ে শুনালেন وآتيتم إحداهن قنطارا হযরত উমর রাযি. তৎক্ষণাৎ এই আয়াত গ্রহণ করেন। ফয়সালার সময় তার এই আয়াতের কথা স্মরণ ছিল না। অথচ তিনি কুরআনের হাফেয ছিলেন। 

(গ) হযরত আলী রাযি. জঙ্গে জামালের সময় হযরত যুবাইর রাযি, কে তাদের দু'জনের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি যুদ্ধ হতে ফিরে আসেন। 

আল্লামা ইউসুফ লুধিয়ানভী রহ. বলেন, মানুষ মাত্রই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কোনো বিশেষ সময়ে কোনো কিছু স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এ কথা সবার মনে রাখা উচিত যে, কোনো প্রমাণ ছাড়া কারো প্রতি ভুলের দাবি করা বড় ভুল। তারপরও ভুলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে বিরল এবং কদাচিত ঘটা বিষয়ে। ইবনে তাইমিয়া রহ. এর উদাহরণ এর স্পষ্ট প্রমাণ। কিন্তু যে আমল প্রতিদিন বারবার করা হয় সেসব আমলের ক্ষেত্রে ভুলের দাবী করা নিতান্তই অমূলক। যেমন, অনেক জ্ঞান প্রতিবন্ধীকে বলতে শোনা যায়, রুকুতে যাওয়ার সময় ও রুকু হতে উঠার সময় রফয়ে ইয়াদাইনের কথা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. ভুলে গেছেন। অথচ রফয়ে ইয়াদাইন দৈনন্দিনের আমল। আর ইবনে মাসউদ রাযি. এর মতো ব্যক্তি যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ খাদেম ছিলেন। যাকে বলা হয় "রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জুতা ও তাকিয়ার বাহক', যিনি সর্বদা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলেন সেই তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি নামাযে রাফয়ে ইয়াদাইন করবে তা ভুলে যাবেন; কীভাবে সম্ভব?


৬. হাদীসের হেদায়াত-দিকনির্দেশনা সম্পর্কে অনবহিত থাকা।

"মুজতাহিদ ইমামের হাদীসের মর্মার্থ জানা না থাকা। এটা কখনো এই জন্য হয় যে, হাদীসে যে শব্দটি এসেছে তা 'গরীব' (অপরিচিত) যেমন, মুখাবারাহ, মুযাবানাহ, মুহাকালাহ, মুলামাসাহ ইত্যাদি। আবার কখনো এজন্য হয় যে, মুজতাহিদের নিজ ভাষা ও পরিভাষায় ঐ শব্দের যে অর্থ হয় তা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষার বিপরীত অর্থ। আর তিনি হাদীসকে নিজের ভাষার অর্থে প্রয়োগ করেছেন। আবার কখনো এজন্য হয় যে, শব্দটি একাধিক অর্থবোধক বা দুর্বোধ্য, অথবা হাকীকত ও মাজায (আসল অর্থ ও রূপক অর্থ ) উভয়ের সম্ভাবনাময়। ফলে মুজতাহিদ ইমামের কাছে যে অর্থটা বেশি সহীহ মনে হয়েছে সেই অর্থের প্রয়োগ করেছেন অথচ হাদীসের উদ্দেশ্য আরেকটি ছিল।'

আল্লামা ইউসুফ লুধিয়ানবী বলেন, এই বিষয়টি বোধগম্য হয় না যে, মুজতাহিদ ইমামের হাদীসের মর্মার্থই জানা থাকবে না। কারণ ইজতিহাদের প্রথম শর্তই হল ভাষাজ্ঞান ও মর্ম উদ্ধারের পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে অবগতি লাভ করা। সুতরাং এই ধরনের ব্যক্তি কীভাবে মুজতাহিদ হতে পারে? তাই এটিকে হাদীসের উপর আমল না করার কারণ বলা যায় না। 


৭. হাদীসটি এই মাসআলা বুঝায় না।

মুজতাহিদের ধারণা এই হাদীস দিয়ে এই মাসআলা বুঝা যায় না। এই কারণটি ও পূর্বের কারণটির মধ্যে পার্থক্য হল, ঐ সুরতে তিনি জানেন না যে, এই শব্দটি দ্বারা এই অর্থ বুঝা যায় বা যায় না। আর এই সপ্তম সূরতে শব্দের দ্বারা কোন অর্থ উদ্দেশ্য সেটা তো জানেন কিন্তু শরয়ী মূলনীতির আলোকে এই অর্থ ও মর্ম সহীহ বলে মনে হয় না, তাই এই হাদীসের উপর আমল ছেড়ে দেন চাই বাস্তবে তার খেয়াল সহীহ হোক বা না হোক।


৮. কুরআন-হাদীসের বাণীর অর্থ ও মর্মের বিপরীতে দলীল থাকা।

মুজতাহিদ ইমামের খেয়াল হল, এই নস বা পাঠের মর্মের বিপরীতে এমন কোন দলীল বিদ্যমান আছে। যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই বাণীর এই অর্থ উদ্দেশ্য নয়। যেমন 'আম' এর বিপরীতে 'খাস' বিদ্যমান থাকা, মুতলাকের বিপরীতে মুকাইয়্যেদ থাকা, অথবা 'আম' এর বিপরীতে এমন জিনিস থাকা যা ওয়াজিব হওয়াকে অস্বীকার করে। অথবা হাকীকতের বিপরীতে এমন করীনা বা লক্ষণ বিদ্যমান থাকা যা মাজাযের প্রমাণ বহন করে। এই জাতীয় আরো বিরোধপূর্ণ বহু প্রকার হতে পারে। এই প্রকারটি খুবই ব্যাপক ও বিস্তৃত। কেননা শাব্দিক বৈপরীত্য ও একমতকে অন্য মতের উপর প্রাধান্য দেয়া এক অকূল সমুদ্র তুল্য ব্যাপার।' 


৯. যঈফ, রহিত কিংবা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ হওয়ার দলীল থাকায় (যে দলীলটি সব ইমামদের দৃষ্টিতে এক্ষেত্রে দলীল হওয়ার যোগ্য) কোন হাদীসের উপর আমল ছেড়ে দেয়া।

মুজতাহিদের দৃষ্টিতে হাদীসের বিপরীতে এমন সব দলীল বিদ্যমান যা হাদীসটি যঈফ বা মানসূখ কিংবা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ হওয়ার কথা বুঝায়। আর হাদীসের বিপরীত ঐ দলীলটি সর্বসম্মতিক্রমে হাদীসের প্রতিপক্ষ হওয়ার যোগ্যতা রাখে। যেমন কোনও আয়াত হাদীস বা ইজমা।


১০. যঈফ, রহিত কিংবা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ হওয়ার ব্যাপারে দলীল থাকায় (তবে দলীলটি সবার দৃষ্টিতে দলীল হওয়ার যোগ্য নয়) কোন হাদীসের উপর আমল করা ছেড়ে দেয়া।

'হাদীসের বিপক্ষে এমন দলীল বিদ্যমান মনে করা ছেড়ে দেয়া হাদীসের যঈফ, মানসূখ বা ব্যাখ্য সাপেক্ষ হওয়া বুঝায়। এ দলীল অন্যদের নিকট মুআরিয বা বিপরীত হওয়ার যোগ্য না।

হাদীস তরকের এই দশটি কারণ উল্লেখ করার পর ইবনে তাইমিয়া রহ. লিখেন, 'এই দশটি কারণ তো খুবই স্পষ্ট। আর অনেক হাদীসের ক্ষেত্রে হয়তো মুজতাহিদ ইমামের নিকট হাদীসের উপর আমল না করার এমন সব দলীল থাকতে পারে যা আমরা জানতে সক্ষম হইনি। কেননা ইজতিহাদের ক্ষেত্র অনেক প্রশস্ত। আর আমরাতো আহলে ইলমের সীনায় যত ইলম আছে তার সব জানতেও সক্ষম হইনি।'

আল্লামা ইউসুফ লুধিয়ানবী বলেন, উল্লিখিত দশটি কারণের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় প্রথম প্রকার ও পঞ্চম প্রকার ছাড়া বাকী সবগুলোর মূল হল, ইজতিহাদী ইখতিলাফ। দুই পক্ষের কোনো এক পক্ষকে এ কথা বলা অসম্ভব যে, তারা নিশ্চিত ভুলের উপর আছে। এছাড়া ভাবার বিষয় হল, ইলমের সাগর আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার মত ব্যক্তির একথা বলা যে, 'ইজতিহাদের সকল ক্ষেত্র সম্পর্কে অবগতি লাভ করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়' এর দ্বারা ইজতিহাদের মান ও মাকামের উচ্চতা সম্পর্কে কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়।'

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ইমামগণের নিকট সুন্নাতের গুরুত্ব-মাহাত্ম ছিল অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। তারা সবাই সুন্নাহ মানার মধ্যেই সফলতা ও নাজাত বলে মন্তব্য করেছেন। আর সুন্নাহ পরিত্যাগ করার পরিণাম ব্যর্থতা ও ধ্বংস বলে উল্লেখ করেছেন। 

আর দৃশ্যত তারা যে হাদীস পরিত্যাগ করেছেন বলে মনে হয়, তার কারণ আমরা ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কলম থেকে জানতে পারলাম। যার দশটি কারণের আটটিই হল ইজতিহাদী ইখতিলাফ। তাই যেকোনো একজনের মতকে সুনিষ্টিভাবে সহীহ বলা অসম্ভব আবার ভুল বলাও অসম্ভব। ফলে তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবে সহীহ হলে তারা দ্বিগুণ সওয়াব পাবেন, আর বাস্তবে সহীহ না হলেও তারা অবশ্যই একটি সওয়াব পাবেন।

দু'টি কারণ তথা হাদীস সম্পর্কে অবহিত না হওয়া ও হাদীস ভুলে যাওয়া, এ দু'টি খুবই নাদের ও বিরল। যা কেবল নাদের ও বিরল বিষয়ের ক্ষেত্রেই হতে পারে। তাই ইবনে তাইমিয়ার কথা থেকে কারও জন্য এই স্বার্থসিদ্ধির কোনও সুযোগ নেই যে, প্রতিদিনের বারবার পালনীয় বা প্রসিদ্ধ বিষয়ের ক্ষেত্রে ইমামের মতামত দৃশ্যত কোনো হাদীসের বিপরীত পেলেই চিন্তাভাবনা ছাড়া অকপটে বলে দিবে যে, ঐ ইমামের নিকট এ বিষয়ের হাদীস পৌঁছেনি বা তিনি হাদীস ভুলে গেছেন এটা স্পষ্ট বোকামী।

স্বয়ং ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মত ব্যক্তি যেখানে নির্দ্বিধায় একথা স্বীকার করে গিয়েছেন যে, 'ইজতিহাদের ক্ষেত্র খুবই প্রশস্ত, আর আমরা ইমামগণের সীনায় যত ইলম ছিল তার সব জানতে সক্ষম হইনি' সেখানে আমাদের মত স্বল্প জ্ঞান ও স্থুল দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য ইমামগণের ব্যাপারে কিছু বলতে গেলে ইবনে তাইমিয়ার এই স্বীকারোক্তিটা সামনে নিয়ে বলা। বিশেষ করে যেসব ভাই আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. কে নিজেদের অন্যতম অনুসরণীয় ব্যক্তি বলে কথাবার্তায় ও ভাবভঙ্গিতে প্রকাশ করেন, তাদের কাছে সবিনয় অনুরোধ, আপনারা ইবনে তাইমিয়া রহ. এর শুধু কিছু বিষয়ের প্রতি নযর না রেখে তার সামগ্রিক বিষয়ের প্রতি নযর রাখুন; ইবনে তাইমিয়ার রচনাটি মূলত আপনাদের জন্যই। এটা সংগ্রহ করুন এবং বারবার পড়ুন। ইনশাআল্লাহ উম্মাহের সর্বজন স্বীকৃত ইমামগণের প্রতি অমূলক মন্তব্য করা হতে আল্লাহ তা'আলা আপনাদেরকে হেফাযত করবেন এবং তাদের অবস্থান ভারে আপনাদের মাথা নত হয়ে আসবে। আল্লাহ তা'আলা সবাইকে ক্ষমা করুন ও সহীহ বুঝ দান করুন। আমীন।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

এক তালিবুল ইলমের গল্প

...

শাইখ আলী তানতাভী
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১৫৯৬৮ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

মুফতী আতীকুল্লাহ

মাওলানা আইনুল হক ক্বাসেমি

মাওলানা মাসরূর বিন মনযূর

হযরত মাওলানা ইদরীস কান্ধলবী রাহ.

শাইখুল হাদীস যাকারিয়া কান্ধলভী রহ.

আল্লামা ইউসুফ বানুরী রহঃ

মাওলানা মীযান হারুন

আল্লামা আনওয়ার জুনদী রহঃ

মাওঃ আসজাদ কাসেমী

আল্লামা সায়্যিদ সুলাইমান নদবী রহ.

ডঃ নজীব কাসেমী

আল্লামা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী রহঃ

মুহাদ্দিছুল আসর আল্লামা হাবীবুর রহমান আ'যমী রহঃ

মাওলানা মুহাম্মাদ আনওয়ার হুসাইন

মাওলানা মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

আল্লামা সাঈদ আহমাদ পালনপুরী রহঃ

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহঃ

মুফতী শুআইবুল্লাহ খান দাঃ

আল্লামা আব্দুর রাযযাক ইস্কান্দার রহঃ

আল্লামা ডঃ মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ্‌ রহঃ