প্রবন্ধ
হযরতজী ইলিয়াস সাহেব রহ.-এর নির্বাচিত বাণীসমূহ
বর্তমান বিশ্বে জনসাধারণের মাঝে সহীহ দীনী মেহনতসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কার্যকর, নিরাপদ ও ব্যাপক মেহনতের নাম হচ্ছে দা'ওয়াত ও তাবলীগের মেহনত। বিশ্বের যেখানেই মুসলমান আছে সেখানে এ মেহনতও আছে। হক্কানী আলেমগণের পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থনের বদৌলতেই এ কাজ তার সঠিক সীমায় থাকবে মর্মে স্বয়ং এ ধারার প্রতিষ্ঠাতা যে অমূল্য বাণী উচ্চারণ করেছেন তার কয়েকটি নিম্নে অনুবাদ করে দেয়া হলো। এ মেহনতের সঙ্গে যুক্ত সাথীরা যদি উল্লিখিত বাণীসমূহ মনোযোগ দিয়ে পড়েন ও অনুধাবন করেন তাহলে অনেক ফিতনা থেকে মুক্ত থাকবেন ইনশাআল্লাহ।
১. বর্তমানে নবুওয়াতের সিলসিলা খতম হয়ে যাওয়ার কারণে এ ধরনের কাজের যিম্মাদারী উম্মতের উলামায়ে কেরামের উপর অর্পিত হয়েছে। উলামাগণ নবীগণের ওয়ারিস। তাই তাদের জন্য জরুরী হল, তারা পথভ্রষ্টতা ও বিকৃতি থেকে জাতিকে রক্ষা করার প্রতি বিশেষ মনোনিবেশ করবেন। এর একমাত্র উপায় হল নিয়ত সহীহ-শুদ্ধকরণ। বস্তুত জনসাধারণের নিয়ত বিশুদ্ধ করার ফিকির করে তাদের আমলের মধ্যে লিল্লাহিয়্যাত ও হাকীকত পয়দা করা উম্মতের উলামা এবং দীনের ধারক-বাহকদের বিশেষ দায়িত্ব।
২. মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক জিনিস ও প্রতিটি কাজ তার উসূল ও নিয়ম- পদ্ধতির মাধ্যমেই সহজ হয়ে থাকে। বর্তমান সমাজে একটি সমস্যা হল, উসূলের পাবন্দীকে সমস্যা মনে করা হয় এবং তা থেকে নিজেদেরকে সবসময় দূরে রাখা হয়। অথচ দুনিয়ার সাধারণ থেকে অতিসাধারণ কাজও উসূলের পাবন্দী ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা ছাড়া সম্পাদন করা সম্ভব হয় না। নৌকা, জাহাজ, রেলগাড়ি, মোটর সাইকেল সবকিছুই নির্দিষ্ট উসূলের উপর পরিচালিত হয়। এমনকি রুটি-তরকারী ও তার নিয়মমাফিক প্রস্তুত করা হয়।
৩. আমাদের মেহনত মুজাহাদার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আনীত ইসলামের পরিপূর্ণ ইলমী ও আমলী নেযামের সঙ্গে উম্মতকে সম্পৃক্ত করে দেয়া। এটাই হচ্ছে আমাদের আসল মাকসাদ। তাবলীগী কাফেলার ঘোরাফেরা এবং গাশত হচ্ছে সেই মাকসাদ অর্জনের প্রাথমিক মাধ্যম। কালিমা, নামাজের তালকীন ও তা'লীম যেন পূর্ণ নেসাবের আলিফ-বা-তা (ক-খ-গ ) মাত্র।
৪. আমাদের সাধারণ কর্মীরা যেখানেই যাবে সেখানকার স্থানীয় হক্কানী উলামা এবং বুযুর্গানে দীনের খিদমতে উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করবে। তাদের নিকট যাবে শুধুমাত্র উপকৃত হওয়ার আশায়; সরাসরি তাদেরকে এ কাজের দাওয়াত দিবে না। ঐ সকল উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীন যে সকল দীনী কাজে লিপ্ত রয়েছেন কর্মীরা সে সম্পর্কে এবং সে কাজের ফায়েদা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত রয়েছেন। উলামায়ে কেরাম যদি তোমাদের কাজের প্রতি আকৃষ্ট হন তাহলে তাদেরকে মুরব্বী হিসেবে ‘সার পুরস্তী'র (পৃষ্ঠপোষকতা) জন্য আবেদন জানাবে এবং তাদের প্রতি দীনী আদব ও ইহতিরাম বজায় রেখে নিজেদের কথাগুলো তাদের সামনে পেশ করবে।
৫. (একবার বয়সে ছোট এক আলেমে দীনকে লক্ষ্য করে বলেন,) মাওলানা! দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে ইলম ও যিকিরের অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। ইলম ছাড়া না আমল হতে পারে, না আমলের জ্ঞান বা পরিচয় হতে পারে। আর যিকির ব্যতীত ইলম অন্ধকারই অন্ধকার; তার মধ্যে নূর আসতেই পারে না। কিন্তু আমাদের কর্মীদের মধ্যে এর বড় অভাব রয়েছে। আহলে ইলম ও আহলে যিকির এ কাজকে আপন করে নিলেই কেবল তাবলীগের কাজ পূর্ণ হবে।
৬. মুসলমানগণ চার নিয়তে আলেম- উলামার খিদমত করবে-
এক. ইসলাম ধর্মের কারণে।
দুই. উলামাগণের কলব এবং দেহ উলূমে নবুওয়াতের বাহক; এ কারণেও তারা সম্মান ও খিদমতের উপযুক্ত।
তিন. তারা আমাদের দীনী কাজের নিগরানী ও দেখাশোনা করে থাকেন।
চার. আলেম-উলামার কোন কিছুর জরুরত বা প্রয়োজন আছে কি না, তা জানার জন্য।
৭. একবার দারুল উলূম দেওবন্দ ও সাহারানপুর মাদরাসায় যাবে এমন একটি জামাআতের কাছে ঐ এলাকাগুলোর উলামায়ে কেরাম বরাবর একটি পত্র লিখেন, যার ভাষ্য ছিল এরূপ- পত্রবাহক সাধারণ মুসলমানদের এই জামাআতকে দাওয়াতের কাজ করার জন্য পাঠানো হয়েছে। আপনাদের সময় অনেক মূল্যবান। আপনাদের মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় ফারেগ করে সম্ভব হলে এই জামাআতের পৃষ্ঠপোষকতা করার অনুরোধ রইল।
আর জামাআতের সাথীদেরকে এই মর্মে সতর্ক করে দেয়া হল যে, যদি উলামায়ে কেরাম দাওয়াতের এ কাজের প্রতি গুরুত্ব না দেন তাহলে তাদের প্রতি তোমাদের অন্তরে যেন কোন প্রকার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়; বরং মনে করবে, তারা আমাদের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। রাত্রি বেলায় যখন অন্যরা আরামের ঘুমে বিভোর থাকে তখনও তারা ইলমে দীনের খেদমতে মশগুল থাকেন। মনে রাখবে, বিনা কারণে একজন সাধারণ মুসলমানের প্রতি বদগুমানী বা কুধারণা করাও আত্মঘাতী ও জীবন বিনাশী কাজ। আর উলামায়ে কেরামের ব্যাপারে আপত্তি ও প্রশ্ন উত্থাপন তো আরো ভয়াবহ এবং মারাত্মক বিষয়। মুসলমানের ইজ্জত করা আর উলামায়ে কেরামের যথাযথ সম্মান করা দাওয়াত তাবলীগের বুনিয়াদী কাজ। মুসলমানকে ইজ্জত করতে হবে ইসলামের কারণে। আর উলামায়ে কেরামকে সম্মান করতে হবে ইলমে দীনের ধারক-বাহক হিসেবে।
৮. (হযরত মাওলানা ইলয়াস রহ. লক্ষ্ণৌ সফরে জনৈক প্রসিদ্ধ আলেমে দীনকে জামাআতের সঙ্গে আসার দাওয়াত দিয়েছিলেন। ঐ মাওলানা সাহেব হযরতের ডাকে সাড়া দিয়ে জামাআতের সঙ্গে শরীক হলেন। হযরত তখন ঐ মাওলানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,) হযরত! আমি আপনাকে ওয়াজ করার জন্য এই কষ্ট দেইনি। আমাদের এ কাজে ওয়াজ ও বক্তৃতা শুধুমাত্র একটি আনুষঙ্গিক বিষয়। আপনার মত বুযুর্গকে সফরের কষ্ট শুধুমাত্র এজন্য দিয়েছি যে, নিজস্ব জায়গায় আপন কর্মস্থলে থাকা অবস্থায় আমার এ কাজ বোঝার এবং তা নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ আপনার হয়ে ওঠে না। এখন সেসব থেকে ফারেগ হয়ে এ কাজ নিয়ে চিন্তা ফিকির করতে পারবেন।
৯. এ বিষয়টি লক্ষণীয়, আমরা যে সকল আকাবির থেকে ফয়েয হাসিল করি তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যেন শুধুমাত্র আল্লাহ তা'আলার লাইনেই থাকে। শুধু এ ক্ষেত্রেই যেন আমরা তাদের কথাবার্তা ও হালতের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকি। বাকি ব্যাপারে তথা তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যাপারে যেন বেখবর থাকি। কেননা তা তাদের মানবীয় গুণাবলীর অংশবিশেষ। তাতে অবশ্যই কোন দুর্বলতা থাকতে পারে। মানুষ যখন সেদিকে দৃষ্টি দিবে তখন তা তাদের মাঝেও সংক্রমিত হবে। আবার কখনো মনের মাঝে বিভিন্ন প্রশ্ন ও আপত্তি দেখা দিবে, যা পরিণামে দূরত্ব সৃষ্টি ও মাহরূমীর কারণ হবে।
১০. তোমরা ঐ সকল উলামায়ে কেরামের খিদমত করো, যারা এখনও তোমাদেরকে দীন শেখানোর প্রতি মনোনিবেশ করেননি। যে সকল আলেম এখনও তোমাদের প্রতি মনোযোগ দেননি, তোমরা যদি তাদের খিদমত করতে থাক তাহলে তারাও তোমাদের দীনী খিদমত করতে শুরু করবেন।
১১. তাবলীগ জামাআতের নেসাবে তা'লীমের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল, তাজবীদ। কুরআনে কারীম সহীহ- শুদ্ধরূপে তিলাওয়াত করা অত্যন্ত জরুরী বিষয়৷
ما أذن الله لشيء كأذنه لنبي يتغنى بالقرآن
(আল্লাহ তা'আলা কোন জিনিসকে এত মনোযোগ দিয়ে শোনেন না, যতটুকু শোনেন কেউ সুমিষ্ট স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করলে।
১২. যে সকল লোক দীনদারী ও দীনের ইলম থাকা সত্ত্বেও দীনের উন্নতি এবং উম্মতের ইসলাহের জন্য অতটুকু মেহনত-মুজাহাদা করে না, যতটুকু নায়েবে রাসূল হিসেবে করা প্রয়োজন, তাদের ব্যাপারে হযরতের মুখ থেকে একদিন একথা বেরিয়ে গেল যে, ‘তাদের প্রতি আমার বড় দয়া হয়'। অতঃপর দীর্ঘক্ষণ ইসতিগফার করার পর বললেন, আমি ইসতিগফার এজন্য করছি যে, আমার মুখ থেকে এ দাবীর কথাটা বের হয়ে গেল যে, তাদের প্রতি আমার দয়া হচ্ছে।
১৩. একবার প্রসঙ্গক্রমে সে যামানার একজন বিখ্যাত আলেম লেখক এবং দীনের খাদেমের আলোচনা আসল, যার আমলী ত্রুটির কারণে তার উপর বিশেষ দীনদার তবকার লোকদের উপত্তি ছিল। তখন এ প্রসঙ্গে হযরত বলেন, আমি তো তার কদর করি, তার মাঝে কোন আমলী ত্রুটি থাকলে আমি তা জানতেও চাই না। কেননা তা তো আল্লাহ তা আলার ব্যাপার। হয়তো তার নিকট এর কোন ওযর আছে। আমাদের তো আল্লাহর পক্ষ থেকে এমনভাবে দু'আ করার নির্দেশ রয়েছে যে,وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا অর্থ : হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের অন্তরে মুমিনদের প্রতি কোন বিদ্বেষ রেখো না। (সূরা হাশর- ১০)।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
ঈমানের মেহনত : পরিচয় ও পদ্ধতি
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] হামদ ও সালাতের পর.. মুহতারাম হাযেরীন! আল্লাহ তা'আলা বান্দাদের জন্য চারট...
দা'য়ীর সাথে আল্লাহ তা'আলা আছেন
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] হামদ ও সালাতের পর... আহলে ইলমের ওয়াদা রূহের জগতে আল্লাহ তা'আলা সাধারণ ল...
বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় ভিন দেশী সংস্কৃতির প্রবর্তন
...
মুমিনের কিছু গুণ
ঈমান কী? ১. উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীস-হাদীসে জিবরীলে এসেছে- فَأَخْبِرْنِي عَن...