প্রবন্ধ
ইলমে দীন ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় ভাবনা
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الاسلام دينا.বর্ণিত আয়াতে একই বিষয় বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রথম অংশ اليوم أكملت لكم دينكم অর্থ, আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছি।
উলামায়ে কেরাম বলেন, এ আয়াত নাযিলের পর আহকাম বিষয়ক আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি। আহকাম সংবলিত যত আয়াত আছে সব এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে নাযিল হয়েছে। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর ওহী তো এসেছে, কিন্তু আহকাম এর পূর্বেই এসেছিল; পরে নয়। সুতরাং বর্ণিত আয়াতে দীন দ্বারা উদ্দেশ্য আহকাম। আহকাম দীনের মূল বিষয়। যদি আহকামের উপর আমল না থাকে তবে সে সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত হলো বাদাম বিহীন (বাদামের) খোসা। দেখতে খুব শানদার কিন্তু ভিতরটা শূন্য।
দীনের ভিত্তি হল আকায়েদ। আকায়েদ হল শিকড়তুল্য, যার উপর আহকামের ডালপালা ছড়ায়। তবে এটা হল এক দিক বিবেচনায়। এক্ষেত্রে আরেকটি দিক হল, শাখা- প্রশাখাই বেশি উপকারে আসে। আম গাছের শিকড় খনন করে কী পাওয়া যাবে? ডাল বা শাখায় আম ধরলেই না উপকৃত হওয়া যাবে। মোটকথা, এক জিনিসকে বিভিন্নভাবে বিবেচনা করা যায়। এক বিবেচনায় দীনের ভিত্তিমূল আকায়েদ। আর আকায়েদের উপরই দীনের ডালপালা ছড়িয়েছে। কিন্তু পরিণাম বিচারে গাছের ফলই আসল। দীনের আহকাম হল দীনের ফল এবং আহকামই দীনের মূল উদ্দেশ্য। তাই আহকাম অবতীর্ণ হয়ে যখন তা পূর্ণাঙ্গ হয়ে গেল তখন এই আয়াত নাযিল হল।
দীন আল্লাহ তা'আলার নেয়ামত; নেয়ামতের শোকরগুজারীর পদ্ধতি
এরপর একই বিষয়বস্তু আল্লাহ তা'আলা ভিন্নভাবে আলোচনা করেছেন। ইরশাদ করেন, وأتممت عليكم نعمتي অর্থ, আমি তোমাদের উপর আমার নেয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। অর্থাৎ দীন যা আল্লাহ তা'আলা পূর্ণাঙ্গ করেছেন, এটা আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নেয়ামত। নেয়ামতের শোকরগুজারী আবশ্যক। আল্লাহ তা'আলা বলেন, যদি আমার নেয়ামতের শুকরিয়া করো আমি নেয়ামত বাড়িয়ে দিবো। আর যদি নাশোকরী করো (জেনে রেখো) আমার পাকড়াও অত্যন্ত কঠিন।
আয়াতের এ অংশে যে জিনিসকে নেয়ামত বলা হল, সে জিনিসকেই প্রথম অংশে দীন বলা হয়েছে। আর এখানে ‘দীন' শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হল ‘আহকাম’। সুতরাং আহকামকে আল্লাহ তা'আলা নেয়ামত বললেন। প্রত্যেক নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের পদ্ধতি ভিন্ন হয়। সম্পদের শুকরিয়া আদায়ের পদ্ধতি হল, জায়েয পন্থায় উপার্জন করা এবং জায়েয পথে খরচ করা। কিন্তু কেউ যদি জায়েয-নাজায়েযের পরওয়া না করে সম্পদ উপার্জন করে কিংবা উপার্জন করল জায়েয পন্থায় কিন্তু ব্যয় করল যেখানে সেখানে, অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশিত পথে খরচ করল না। এতে মালের শুকরিয়া তো করা হল না; বরং নাশোকরিই হল।
তদ্রূপ কারো সন্তান আছে। তো সন্তানের ক্ষেত্রে শুকরিয়া আদায়ের এক পন্থা, আবার স্ত্রী থাকলে তার ক্ষেত্রে শুকরিয়া আদায়ের ভিন্ন পন্থা। অনুরূপ পিতা-মাতা থাকলে তাদের শুকরিয়া আদায়ের পন্থাও অন্য রকম।
দীনও এক বড় নেয়ামত। এর শুকরিয়া আদায়ের পন্থা হল, দীনের বিধি-বিধান মেনে চলা। সে অনুযায়ী আমল করা।
নাজাতের একমাত্র পথ দীনে ইসলাম
ঠিক একই বিষয়বস্তু আল্লাহ তা'আলা আরেকভাবে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, ورضيت لكم الاسلام دينا অর্থ, আমি তোমাদের জন্য পছন্দ করেছি দীনে ইসলামকে। অর্থাৎ এ দীন নিয়ে আমার কাছে আসতে পারলে জান্নাতের নেয়ামত দ্বারা সম্মানিত হবে, অন্যথায় মাহরুম থাকবে। ইসলাম কী? ইসলাম তো আহকামের নাম। ঈমান হল আকীদার নাম। ঈমানের অর্থ, অন্তরে বিশ্বাস করা, আর ইসলামের অর্থ হল, মাথা পেতে মেনে নেয়া। আল্লাহ তা'আলা যে আহকামের কথা বলেছেন তার সামনে নিজেকে সোপর্দ করে দেয়া। যে ব্যক্তি ইসলামকে এভাবে মেনে নিল সেই উত্তম ব্যক্তি। আল্লাহ তা'আলা বলেন,إنا عرضنا الأمانة على السموات আমি এ আমানত পেশ করেছিলাম আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পাহাড়-পর্বতের সামনে। তারা এটা বহন করতে অস্বীকার করল ও শঙ্কিত হল আর তা বহন করে নিল মানুষ।
ইসলামে পরিপূর্ণ দাখেল হতে হবে
আল্লাহ তা'আলা বলেন, يا ايها الذين امنوا ادخلوا في السلم كافة. অর্থ : হে মুমিন সকল! ইসলামে সম্পূর্ণরূপে প্রবেশ কর। আয়াতে কারীমায় ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ করতে বলা হয়েছে। কারণ কেউ এমনও হতে পারে যে, তার এক পা ইসলামের নৌকায় আর অপর পা অন্য নৌকায়। বর্তমানে অনেক মুসলমান এমন রয়েছে, যে জুম'আর নামায পড়তে আসে, কিন্তু জুম'আর দিন আছরে আসে না, ফজরে আসে না। জুম'আয় আসা তো খারাপ কিছু নয়। কিন্তু জুম'আর দিন ফজর, আসরে না আসা হল অন্যায়। অনেক মুসলমানকে দেখা যায়, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, কিন্তু চেহারা একেবারে পরিষ্কার; দাড়ি মুণ্ডায়। আল্লাহর রাসূলের চেহারার সাথে তার কোন প্রকার মুহাব্বত নেই; বরং বিদ্বেষ। তাহলে এ ব্যক্তি যে নামায পড়ছে, কার আনিত হুকুমের উপর আমল করছে?
এমন মুসলমানের ব্যাপারে বলা হয় এক পা ইসলামে, এক পা বাইরে। এক পা রাসূলের আনুগত্যের জন্য সঁপে দিয়েছে অপর পা সঁপেছে চাকুরী, ফ্যাশন ইত্যাদি পালনের জন্য।
শিক্ষা ব্যবস্থা দু'ভাগে বিভক্ত
এখন আমরা মূল বিষয়ের আলোচনায় আসি। শিক্ষা ব্যবস্থা দু'ভাগে বিভক্ত। (এক) দীনী শিক্ষা ব্যবস্থা, (দুই) দুনিয়াবী শিক্ষা ব্যবস্থা। কুরআন- হাদীসে এই দুই শিক্ষা ধারার স্তর ভিন্ন ভিন্ন বলা হয়েছে। একটিকে ‘জরুরী' বলা হয়েছে। অপরটিকে 'পছন্দনীয় বলা হয়েছে। উভয়টিকে ভিন্ন ভিন্ন স্তরের বলা হয়েছে।
শরীয়তে এভাবেই মাসআলা- মাসাইলের শ্রেণী বিন্যাস করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ হালাল রিযিক কামাই করা ফরয। কিন্তু এটা হল দ্বিতীয় স্তরের ফরয। হাদীসে এসেছে,كسب الحلال فريضة بعد الفريضة. হালাল রুজি কামাই করা ফরয। কিন্তু তার অবস্থান হল প্রথম স্তরের ফরযের পর। উভয় স্তরের খেয়াল রেখে চলা আবশ্যক। নামায, রোযা এবং হজ্জ প্রথম স্তরের ফরয। সুতরাং এই স্তরের ফরয আদায়ের পর হালাল রুযি কামাইয়ে মনোনিবেশ করতে হবে।
درکفے جام شریعت درکفے سندان عشق
ہرہوسنا کہ نہ داند جام وسندان باختن
অর্থ : অনভিজ্ঞ আশিক শরীয়তের নাযুক পেয়ালা আর ইশক ও মুহাব্বতের হামানদিস্তা নিয়ে খেলতে জানে না। কাচের পেয়ালায় লোহার কাঠির পরিমিত আঘাতে সুর-লহরী সৃষ্টি করা কাঁচা লোকের কাজ নয়। একমাত্র ঝুনো ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিই তা করতে পারঙ্গম। অর্থাৎ, এ ধরণের ব্যক্তিই উভয় ফরয নিয়ে একসাথে চলতে পারে। নামায পড়তে হবে, সময় মতো দোকান খুলতে হবে, চাকুরীর দায়িত্বও পুরা করতে হবে। সবদিক সামলে চলা সুকঠিন। কিন্তু বান্দা যখন হিম্মত করে আল্লাহ তা'আলা রাস্তা খুলে দেন।
দীন এবং দুনিয়ার মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে দীনের অগ্রাধিকার হবে
যদি দীন-দুনিয়া মুখোমুখি হয়ে যায় এবং অবস্থা এমন হয়ে যায় যে, উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান কঠিন হয়ে পড়ে, তাহলে প্রথম শ্রেণীকে প্রথম স্তরে আর দ্বিতীয় শ্রেণীকে দ্বিতীয় স্তরে রাখতে হবে। নামায এবং দোকানদারীর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে নামাযকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ রিযিকদাতা হলেন আল্লাহ তা'আলা; দোকান নয়। ইংল্যান্ডে এক যুবক কারখানায় চাকুরী করত। রমাযান মাস চলছিল। গরমও ছিল প্রচণ্ড। সে যোহরের সময় বসের কাছে নামাযের অনুমতি চাইল। বস অনুমতি দিল না। রোযা অবস্থায় স্ক্রু তো এমনিতেই ঢিলে থাকে। অর্থাৎ, মেজায মর্জি স্বাভাবিক থাকে না। অনুমতি না পেয়ে তার মাথা খারাপ হয়ে গেল। চাকুরির পরওয়া না করে কোট গায়ে সোজা হাঁটা দিল। নিশ্চিন্ত মনে যোহর পড়ে আমার কাছে আসল। বলল, আমি তো এই এই করে এসেছি। বললাম, খুব ভাল করেছ। আল্লাহ তা'আলা তার অন্য আয় রোজগারের ব্যবস্থা করে দিলেন । এখন সে লোকদেরকে ড্রাইভিং শিখায়। বেশ কয়েকটা বাড়ির মালিক। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর দীনের জন্য দ্বিতীয় স্তরের ফরয ছেড়ে দিবে আল্লাহ তা'আলা তার জন্য অন্য রাস্তা খুলে দিবেন।
সারকথা হল, যতক্ষণ দুই স্তরের মধ্যে বিরোধ না দেখা দেয় ‘জামে শরীয়ত' আর ‘সানদানে ইশক' নিয়ে খেল। কিন্তু যখন বিরোধ দেখা দিবে দীনকে প্রাধান্য দিতে হবে। এটাই শরীয়তের সবক এবং এতেই মুমিনের সফলতা।
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা'আলা ইলমকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। 'জরুরী ইলম' হল দীনী শিক্ষা। দীনী শিক্ষা ছাড়া অন্যসব শিক্ষা পছন্দনীয়। হ্যাঁ, কিছু দুনিয়াবী ইলম হারাম। অর্থাৎ যে ধরণের জ্ঞান মানুষের জন্য ক্ষতিকর যেমন, যাদু-টোনা শেখা, জ্যোতিষশাস্ত্র শেখা, গান-বাজনা শেখা ইত্যাদি। এ ধরণের শিক্ষা অর্জন করা হারাম।
দীনী ইলম ছাড়া যত ইলম আছে সেগুলোকে দ্বিতীয় নম্বরে রাখা হয়েছে। হাদীসে এসেছে,طلب العلم فريضة على كل مسلم. অর্থ : ইলমে দীন হাসিল করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। উলামায়ে কেরাম বলেছেন, এ হুকুম নারী পুরুষ সকলের জন্য বরাবর। পুরুষের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। এই হাদীসে ইলম দ্বারা উদ্দেশ্য দীনী ইলম। দুনিয়াবী ইলম বা জাগতিক জ্ঞান উদ্দেশ্য নয় এবং এক্ষেত্রে এ হাদীস ব্যাপকও নয়।
কিছু লোকের ভুল ধারণা রয়েছে। তারা এ হাদীসকে ব্যাপক মনে করে। দীনী ইলম এবং দুনিয়াবী ইলম উভয় ইলমকে এ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত মনে করে। এটা ঠিক নয়। তো ইলমকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছে,العلم ثلاثة : آية محكمة اوسنة قائمة فريضة عادلة وما سوى ذلك فهو فضل অর্থাৎ জরুরী ইলম তিন ধরণের- (১) কুরআনে কারীমের ইলম (آية محكمة), (২) হাদীস শরীফের ইলম ( سنة قائمة) এবং (৩) আহকামের ইলম অর্থাৎ ফিকহের ইলম (فريضة عادلة)। এছাড়া যত ইলম আছে সব হল পছন্দনীয় ইলম, সেগুলোরও ফযীলত আছে। সেই ইলমও মাথার তাজ (কিন্তু জরুরী নয়)। (وما سوى ذلك فهو فضل নাহব সরফের ইলম, আদব ইনশার মা'রিফাত, মানতিক- ফালসাফার যোগ্যতা, ইতিহাস শেখা, চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করা এ সবই ফযীলতের বিষয়। কিন্তু এগুলো হল দ্বিতীয় স্তরের জ্ঞান। প্রথম স্তরের ইলমের পর এর অবস্থান; তার আগে নয়। ভাষাজ্ঞানের ব্যাপারও এমন। হিন্দি, ইংরেজি জানা খারাপ কিছু নয়; বরং পছন্দনীয়। কিন্তু জরুরী ইলমের মধ্যে এসব পড়ে না। প্রথমে কুরআন পড়তে ও জানতে হবে, এরপর অন্যান্য ভাষা।
তদ্রূপ মাদরাসাগুলোতে যে ইলম পড়ানো হয় সেগুলোও সব এক স্তরের নয়। মাদরাসায় যে ইলম পড়ানো হয় সেগুলো দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। (এক) علوم عالية মৌলিক ইলম। (দুই) علوم آلية সহায়ক ইলম। অর্থাৎ এক প্রকার জ্ঞান হল 'জরুরী ইলম' যে উদ্দেশ্যে মূলত এই মাদরাসাগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ প্রকার ইলম তিন বা ছয় বিষয়ের ইলম। (১) কুরআন, (২) হাদীস, (৩) ফিকহ। এ তিন প্রকারের সঙ্গে এগুলোর মূলনীতি মিলানো হলে মোট ছয়টি বিষয় হবে। অর্থাৎ (৪) উসূলে তাফসীর, (৫) উসূলে হাদীস, (৬) উসূলে ফিকহ। এই ছয় প্রকারের ইলম হল 'জরুরী ইলম'। বাকী যে ইলম মাদরাসায় পড়ানো হয় সেগুলো হল ‘সহায়ক ইলম'। অর্থাৎ যে ইলম শেখানোর জন্য মাদরাসার প্রতিষ্ঠা তার সহায়ক ইলম। মাদরাসায় এগুলোকে সহায়ক হিসেবেই পড়ানো হয়; মূল হিসেবে নয়। তো 'জরুরী ইলম' এর সহায়ক ইলমই যেখানে ফরয ও উদ্দেশ্যের মর্যাদা রাখে না, তাহলে যে ইলম শুধু দুনিয়াবী লাভের জন্য শেখা হয় কীভাবে তা মূল এবং ফরযের মর্যাদা পেতে পারে? এ ধরণের ইলমকে বেশির চেয়ে বেশি 'সম্মান'-এর মর্যাদা দেয়া যেতে পারে, পছন্দনীয় বলা যেতে পারে। তার বেশি কিছু নয়।
দুই নৌকায় পা রেখে চলা সম্ভব নয়
এ বিষয়টিও ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, দীনী এবং দুনিয়াবী ইলম একটা পর্যায় পর্যন্ত একসঙ্গে চলতে পারে। চূড়ান্ত ধাপ পর্যন্ত একসঙ্গে চলতে পারে না। মাদরাসাগুলোতে দু'ধরণের ইলম একসঙ্গে নিয়ে চলার প্রচলন আছে। স্কুলেও তাই। প্রাথমিক পর্যায়ে একাধিক বিষয়ের পড়ালেখা একসঙ্গে চলতে পারে। কিন্তু যখন কলেজের প্রসঙ্গ আসবে, বিভাগ আলাদা হয়ে যাবে তখন যে কোন এক বিষয় নিয়ে পড়তে হবে। মাদরাসায়ও যতদিন প্রাইমারী, সেকেন্ডারী স্তরে পড়াশোনা হবে ততদিন সব বিষয় পড়ানো হবে। ভাষাজ্ঞানও দেয়া হবে, অঙ্কও- ভূগোলও শেখানো হবে। সাথে সাথে তা'লীমুল ইসলাম, দীনী তা'লীমের কিতাবাদী, নাযেরা, কুরআন শরীফ সব পড়ানো হবে। কিন্তু একটা স্তরে গিয়ে অন্য সব বাদ পড়ে যাবে। যে মৌলবী হতে চায় তার জন্য মাওলার (আল্লাহর) ইলমে মনোনিবেশ করতে হবে।
'মাওলা' আল্লাহ তা'আলার সিফাত। (نعم المولى ونعم النصير) সে হিসেবে মৌলবী কথাটির অর্থ হল, এমন ব্যক্তি যার আল্লাহ তা'আলা এবং তার দীনের জরুরী ইলম হাসিল আছে। 'আলেমের' স্তর মৌলবীরও উপরে। মৌলবী হওয়া সহজ। প্রতি বছর হাজারো মৌলবী তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আলেম খুব কম তৈরি হয়। যে ব্যক্তি কোন মাদরাসা থেকে ফারেগ হয় সাধারণত সে আল্লাহওয়ালা হয়েই বের হয়। তার বেশ-ভূষা, চাল-চলন, জীবন-যাপন সব শরীয়ত মুতাবেক হয়। এ ব্যক্তিই আল্লাহওয়ালা। এ কথা মানতে হবে যে, চালের মধ্যে পাথরকণা থাকবেই। কোন মৌলবীকে যদি আল্লাহওয়ালা নাও মনে হয় এতে অভিযোগের কিছু নেই। কিন্তু আলেম হওয়ার জন্য ফারেগ হওয়ার পর অনেক কিছু করতে হয়। দীর্ঘ একটা সময় কিতাবের পোকা হয়ে থাকতে হয়। তখন ইলমে দীনে পরিপক্কতা ও পূর্ণতা সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে এ পর্যায়ে পৌঁছলে একজন ব্যক্তিকে আলেম বলা সাজে। তো বলছিলাম একজন তালিবে ইলম প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করে যখন আলেম হওয়ার স্তরে পদার্পণ করবে তখন তাকে একটি লাইনই অনুসরণ করতে হবে। তখন আর দুই নৌকায় পা রেখে চলা সম্ভব নয়। অন্যথায় ধোপার কুকুরের অবস্থা হবে। যে কিনা ঘরেরও নয়, ঘাটেরও নয়। ঘরের লোকেরা এ মনে করে খাবার দেয় না যে, ঘাটে খেয়ে নিয়েছে। আর ঘাটের লোক এই মনে করে খাবার দেয় না যে, ঘরে খেয়ে এসেছে।
যারা চায়, মাদরাসায় আধুনিক জ্ঞান- বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা হোক, তাদের এই দাবী-দাওয়া প্রাইমারী স্তর পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু শেষ স্তর পর্যন্ত উভয় ইলম একসঙ্গে চলা কিছুতেই সম্ভব নয়। অন্যথায় মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। মাদরাসা তখন জেনারেল শিক্ষার কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। মকতবে এতসব বাধ্য-বাধকতা নেই । স্কুলেও এমন। স্কুলে নিচের স্তরে অনেক বিষয় পড়ানো যেতে পারে। বরং দীনী ইলম ও আধুনিক শিক্ষা একসঙ্গে চলতে পারে। কিন্তু যখন কলেজের প্রসঙ্গ আসবে তখন এক লাইন আঁকড়ে ধরতে হবে। এক লাইনে চলতে হবে। উভয় লাইনে একসঙ্গে চলা যাবে না। কারণ এখন এক বিষয়ই এত ভারী যে, সামাল দেয়া কঠিন। এ অবস্থায় যদি সব একসাথে চাপিয়ে দেয়া হয় তবে সে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে মরবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
অনুবাদ: মাওলানা আব্দুল হান্নান
মুদাররিস, জামি'আ বাইতুল আমান মিনার মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র, তাজমহল রোড, মুহাম্মদপুর, ঢাকা।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
ইসলামই পৃথিবীর ভবিষ্যত
...
ঈমান-আমল সুরক্ষিত রাখতে হক্কানী উলামায়ে কেরামের সঙ্গে থাকুন, অন্যদের সঙ্গ ছাড়ুন
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] হামদ ও সালাতের পর... قال الله تعالى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتّ...
ঝাড়ফুঁক-তাবীয : একটি দালীলিক বিশ্লেষণ (১ম পর্ব)
...
ঈমানের মেহনত : পরিচয় ও পদ্ধতি
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] হামদ ও সালাতের পর.. মুহতারাম হাযেরীন! আল্লাহ তা'আলা বান্দাদের জন্য চারট...