প্রবন্ধ
ধোঁকাবাজ ব্যক্তি নবীজীর উম্মত নয়
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত]
হামদ ও সালাতের পর...
এক বুযুর্গ বলেছিলেন, আল্লাহ তা'আলা কখন আমাকে স্মরণ করেন আমি তা বুঝতে পারি। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, কীভাবে বুঝতে পারেন? তিনি জবাব দিলেন, যখন আমার মনে আল্লাহর স্মরণ চলে আসে, আমি আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকি তখন বুঝে নেই যে, আল্লাহ আমাকে স্মরণ করছেন আর সেটারই প্রতিধ্বনি ও প্রতিবিম্ব আমার মনের উপর প্রতিফলিত হচ্ছে; ফলে আমিও আল্লাহকে স্মরণ করছি। কাজেই মূল ব্যাপারটি আল্লাহর তরফ থেকেই হয়। আল্লাহ তা'আলা প্রথমে তাওফীক দিয়েছেন, কবুল করেছেন তারই প্রতিক্রিয়ায় আমরা এখানে বসে আছি। এটা আল্লাহর খাছ মেহেরবানী। এ জাতীয় মাহফিলে বসতে পারা অনেক বড় ইবাদত। এই মাহফিলকে নিয়ে আল্লাহ তা'আলা ফেরেশতাদের মাহফিলে গর্ব করছেন। ফেরেশতাদের মাহফিলে কখনো গুনাহগারদেরকে নিয়ে গর্ব করা হয় না। কাজেই বোঝা গেল, আল্লাহ তা'আলা প্রথমে আমাদেরকে মাফ করে দিয়েছেন তারপর গর্ব করছেন।
আমের গুটি যেমন গাছের সঙ্গে লেগে থাকলে বাড়তে থাকে, বড় হয় এবং একসময় পাকে ও দামী হয় তেমনিভাবে যারা দীনী মেহনতে জুড়ে থাকে, লেগে থাকে তাদের রুহানী তারাক্কী হতে থাকে। আল্লাহর প্রতি ও রাসূলের প্রতি মহব্বত-ভালোবাসা তাদের দিলের মধ্যে বাড়তে থাকে। আমাদের দায়িত্ব হল, নিজেদের দিল ও ক্বলবকে উলামায়ে কেরামের খেদমতে পেশ করা। বাকিটা আমাদের হাতে নেই। ক্বলব হল কোন কিছু নেয়ার ও গ্রহণ করার পাত্র। উলামায়ে কেরাম ক্বলবের পাত্রে রুহানী নেয়ামত বিতরণ করেন। এই নেয়ামত পাওয়ার জন্য যারা নিজেদের ক্বলবকে পেশ করবে, ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ তাদের কাউকে মাহরূম করবেন না। তবে ইখলাছের সাথে আসতে হবে; লোক দেখানোর জন্য নয়। লোক দেখানোকে রিয়া বলে। তাই বলে যে কোন লোক দেখানোই কিন্তু রিয়া নয়। আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে মসজিদে যাই। লোকেরা আমাদেরকে দেখে। অনেক সময় আমাদের দিলেও এই খেয়াল আসে যে, মসজিদে গেলে অমুক অমুক ভাইয়ের সাথে দেখা হবে। তারাও আমাদেরকে দেখবে- এটা কি রিয়া হয়ে গেল? এটা রিয়া হয় না। আসলে রিয়া হল, আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে নিজের বড়ত্বের আকাঙ্ক্ষা করা। যেমন: কেউ ইবাদত করছে আল্লাহর কিন্তু আকাঙ্ক্ষা করছে যে, যারা আমাকে দেখছে তাদের দিলে আমার বড়ত্ব পয়দা হোক; তারা আমার সম্পর্কে এই ধারণা করুক যে, লোকটা নিশ্চয় কোন বুযুর্গ হবে; সবসময় তাকে ইমামের পিছনে প্রথম কাতারে দেখি, আমি তো পারি না- এই আকাঙ্ক্ষা হল রিয়া। আমল করলে মানুষ তো দেখবেই; নামায পড়লে দেখবে, যাকাত দিলে দেখবে, হজ্জ করতে গেলে দেখবে- তাহলে এসব কি রিয়া হয়ে যাবে? না, রিয়া তো হল ইচ্ছা করে গলদ নিয়ত করার নাম। এটা অনিচ্ছায় হয় না যে, আমি তো রিয়া করি নাই তারপরও এই মুসিবত আমার কাঁধে চেপে বসেছে! বরং রিয়া করতে হলে আপনাকে ইচ্ছাকৃত গলদ নিয়ত করতে হবে। কেউ প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ছে আর মনে মনে নিয়ত করছে, পিছনের লোকগুলো দেখুক আর বুঝুক, আমি একজন বিশেষ বুযুর্গ। অর্থাৎ তার খালেছ নিয়ত যে, মানুষের অন্তরে তার মূল্য বৃদ্ধি হোক। একটা খালেছ আল্লাহর জন্য, আরেকটা খালেছ বান্দার জন্য। কাজেই রিয়া নিজে নিজেই কারো কাঁধে চেপে বসে না। বরং ইচ্ছা করে তা পয়দা করতে হয়। মানুষের দিলে বড়ত্ব পয়দা করতে পারলে সবাই তাকে আগে আগে সালাম দিবে, কুরসি ছেড়ে দিবে, হাদিয়া পেশ করবে- মোটকথা অনেক লাভ। দুনিয়াবী লাভের জন্য সে এই রিয়া করছে। যে ব্যক্তি ইখলাছের সাথে আমল করে সে-ও হাদিয়া পায়, তার জন্যও কুরসি ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু ইখলাছওয়ালা সম্মান পায় বৈধ উপায়ে আর রিয়াকার পায় ধোঁকাবাজি করে। সে আল্লাহওয়ালাদের লেবাস ধারণ করে সম্মান হাসিল করার জন্য। এই ব্যক্তি কোন আল্লাহওয়ালা নয়। একজন আল্লাহওয়ালাদেরকে মহব্বত করে তাদের মত পোশাক পরেন, এটা প্রসংশনীয়। ইনি হাশরের ময়দানে তাদের সঙ্গে থাকবেন।
أحب الصالحين ولست منهم لعل الله يرزقني صلاحا
পক্ষান্তরে আরেকজন শুধু আল্লাহওয়ালাদের সম্মানটুকু পাওয়ার জন্য তাদের মত পোশাক পরেছে। দুনিয়াতে এই লেবাসের বরকতে সে সম্মান পাবে ঠিক; কিন্তু তার আখেরাত বরবাদ হয়ে গেছে। সে তো ধোঁকাবাজি করার জন্য আল্লাহওয়ালাদের ছূরত ধরেছে। মোটকথা দীনের দ্বারা কাউকে ধোঁকা দেয়া যাবে না। দীনের ছূরত ধারণ করে দুনিয়া কামানো যাবে না। দুনিয়া কামাতে হলে দুনিয়ার ছুরতই ধারণ করা হোক। হযরত জালালুদ্দীন রুমী রহ. মসনবী কিতাবে হযরত সুলাইমান আ.-এর যামানার একটা ঘটনা উল্লেখ করেছেন যে, কোন এক গাছে অনেকগুলো পাখি বসে ছিল। পাশের রাস্তা দিয়ে এক বুযুর্গ যাচ্ছিলেন। ঐ যামানায় বুযুর্গরা মোটা কাপড়ের গুদুড়ি পরতেন। গাছের পাখিরা ব্যাকুল হয়ে তাঁকে দেখতে লাগল যে, একজন আল্লাহওয়ালা যাচ্ছেন, তাঁকে দেখে আমরা ধন্য হই! বুযুর্গ লোকটা গাছের কাছাকাছি এসে আচানক গুদুড়ির ভিতর থেকে তীর ধনুক বের করে কিছু তীর ছুড়ে দিল। এতে একসঙ্গে বহু পাখি শিকার হল। বুযুর্গ ব্যক্তি পাখিগুলো কুড়িয়ে নিয়ে গেলেন। কিছু পাখি বেঁচে গিয়েছিল। তারা গিয়ে হযরত সুলাইমান আ.এর কাছে মামলা দায়ের করল যে, অমুক বুযুর্গ আমাদের এতগুলো পাখি হত্যা করেছে, আপনি এর বিচার করে দিন। সুলাইমান আ. বুযুর্গকে ডেকে বললেন, তোমার বিরুদ্ধে পাখিদের এই নালিশ; কৈফিয়ত দাও? বুযুর্গ বললেন, হুযুর! এই পাখিগুলো তো হালাল, আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এগুলো শিকার করার অনুমতি দিয়েছেন! সুলাইমান আ. বললেন, হে পাখিরা! বুযুর্গ যে কৈফিয়ত পেশ করলেন তোমরা তা খণ্ডন করো ? পাখিরা বলল, আমাদেরকে শিকার করা হালাল- এই পয়েন্টে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমাদের আপত্তি হল, তিনি আমাদেরকে শিকার করবেন ভালো কথা, তাহলে শিকারীর বেশ ধরেই আসতেন; আমরাও সতর্ক হওয়ার সুযোগ পেতাম। কিন্তু তিনি বুযুর্গের ছুরতে আসলেন কেন? আমরা তো তাঁর সোহবতে ধন্য হওয়ার জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে বসে ছিলাম। অর্থাৎ তিনি ধোঁকাবাজি করলেন কেন? বুযুর্গ এর কোন সদুত্তর দিতে পারলেন না। অতঃপর তার শাস্তিবিধান করা হল।
মোটকথা ধোঁকাবাজি করা যাবে না। তাবলীগ করতে গেছেন ভালো কথা, কিন্তু এই নিয়তে কেন যে, তাবলীগে গেলে অনেক ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় হবে, তাদের মাধ্যমে ব্যবসার অনেক লাইন খুলবে? আর পুরনো তাবলিগী হলে আরব টেন্টের খেদমত পাওয়া যাবে, আরবদের সাথে যোগাযোগ হলে হাদিয়া তোহফা হাসিল করার বিরাট রাস্তা খুলবে? এটা দীনের ছুরতে দুনিয়া। আকৃতিতে দীন, কিন্তু বাস্তবে দুনিয়া।
একলোক মনে মনে খেয়াল করছে, আগামী নির্বাচনে সে প্রার্থী হবে। এজন্য মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানায় দেদারসে দান-খয়রাত করছে। খুব চাল- ডাল বিলাচ্ছে। আবার দু'একটা মসজিদও বানিয়ে দিচ্ছে। সব জায়গায় তার প্রশংসা হচ্ছে- অনেক পয়সাওয়ালা দেখেছি, এমন দিল-দরিয়া তো দেখি নাই। এই ব্যক্তি এগুলো করছে নির্বাচনে জেতার জন্য। এটা ইবাদত হবে না বরং গুনাহ হবে। মসজিদ বানানো ইবাদত, তবে করতে হবে আল্লাহর জন্য। কিন্তু এই ব্যক্তি করছে ভোটে জেতার জন্য। ধোঁকাবাজির কত কিসিম আর রকমফের যে মানুষ আবিষ্কার করেছে! একেকজন ধোঁকাবাজির একেক পদ্ধতি বের করেছে। কিছু লোক তো সারাজীবনই নওমুসলিম থাকে, কখনও পুরানা হয় না। মসজিদে মসজিদে গিয়ে বলে, 'আমি একজন নওমুসলিম, আমাকে সাহায্য করুন।' আরে ভাই! নওমুসলিম হয়েছেন, আপনাকে মুবারকবাদ! আপনি অত্যন্ত মর্যাদাবান। কিন্তু কাজ-কাম করে জীবিকা নির্বাহ করুন। শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষাবৃত্তি করে কেন নিজেকে মর্যাদাহীন করছেন? একবার এক নওমুসলিম দাবীদার একই মসজিদে কয়েকবার চাঁদা তুলতে যাওয়ায় মুসল্লীদের সন্দেহ হয়েছে। যাচাই করে দেখা গেল, কিসের নওমুসলিম! সে আগেও মুসলমান ছিল, এখনও মুসলমান। মোটকথা, ধোঁকাবাজির অনেক ছুরত আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,من غشنا فليس منا যে ধোঁকার আশ্রয় নিল সে আমার উম্মত নয়। (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ১৬৪)
নবীজীর যামানায় কোন কোন লোক একই জামায় দু-দু'টো করে হাতা লাগিয়ে নিতো। নীচের হাতাটা বড় হতো, আর উপরেরটা কিছুটা ছোট। দেখে মনে হতো, একসঙ্গে দু'টি জামা পরেছে। এভাবে তারা সমাজের চোখে সম্মান পেতে চাইতো। লোকেরা ভাবতো, আমরা একটাই যোগাড় করতে পারি না, আর ইনি দেখি একই সঙ্গে দুটো হাঁকিয়েছেন! পরবর্তীতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা করতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। হাদীসে বর্ণিত আছে, كلابس ثوبي زور মিথ্যার দুই জামাধারী। (সহীহ বুখারী; হা. নং ৫২১৯) এই সমস্ত ধোঁকা থেকে আল্লাহ আমাদেরকে হিফাযত করুন। আমীন।
ইংরেজরা সরকারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে গেছে, এটাও একটা ধোঁকাবাজি। তারা আমাদেরকে বুঝাতে চেয়েছে, তোমরাও এ ধরণের মাদরাসা বানালে অনেক সওয়াব পাবে। এখানে তোমাদের ছেলে- মেয়েরা দুনিয়াও শিখবে, দীনও শিখবে। আসলে এ ধরনের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করলে কোন সওয়াবও হবে না, আর সেখানে পড়ে কেউ আলেমও হবে না। যেখানে যুবক-যুবতী একসঙ্গে পড়াশোনা করে, মিথ্যা কথা না বললে বেতন তোলা যায় না, নকল না করলে পরীক্ষায় পাশ করা যায় না, মোটকথা এদের সমস্ত কর্মকাণ্ডই ভুল এবং এর ভিত্তিই মিথ্যার উপর। এটা দীনের নামে প্রতারণা, ধোঁকাবাজি। ইংরেজরা বলে গেছে, আর পাবলিক সওয়াবের নিয়তে আলিয়া মাদরাসা বানাচ্ছে। আলিয়ায় পড়ে কী হয়? 'না ঘর কা, না ঘাটকা' দীনের কাজেও লাগে না, দুনিয়ার কাজেও না। মোটকথা, শরীয়তে ধোঁকার কোন অবকাশ নেই।
বেচাকেনার মধ্যেও যে কত রকমের ধোঁকা আছে! কেউ মাপে কম দিচ্ছে কেউ বাংলাদেশী পণ্যে 'মেড ইন জাপান' সিল মারছে। নানারকম ধোঁকাবাজি চলছে। এগুলোর সবই হারাম। ধোঁকাবাজ রাসূলের উম্মত নয়। এজন্য এব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা উচিত।
আজকাল বদদীন ডাক্তাররা রোগীকে ব্ল্যাকমেইল করে। রোগীর অজ্ঞতা ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অনেক টাকা- পয়সা কামায়। ডাক্তার ভালো করেই জানে যে, বাচ্চা যে পজিশনে আছে তাতে ডেলিভারী নরমালিই হয়ে যাবে; এর জন্য সিজারের কোনও প্রয়োজন নেই। তা সত্ত্বেও সে রোগীর অভিভাবককে রিপোর্ট দিচ্ছে- যদি ৩ ঘণ্টার মধ্যে সিজার না করেন তাহলে বাচ্চাও মারা যাবে, রোগীও মারা যাবে! ডাক্তারের এই রিপোর্টের পর তো বেচারা অভিভাবকের আর করার কিছু থাকে না। নিরুপায় অভিভাবক বাধ্য হয়েই সিজারের সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ পুরো ব্যাপারটাই এই বদদীন ডাক্তারের ধান্ধাবাজি।
আর কিছু ডাক্তার তো ব্ল্যাকমেইল না, সরাসরি ডাকাতি করে। দেখা গেছে, রোগীর টেস্টের কোন দরকার নেই, খামোখা দু'পাঁচটা টেস্ট লিখে দেয় এবং সেখান থেকে কমিশন খায়। ডাক্তার তো রোগী দেখা (যার মধ্যে প্রয়োজনে টেস্ট লেখাও অন্তর্ভুক্ত) বাবদ রোগীর কাছ থেকে একবার ভিজিট নিয়েই নিয়েছে, এখন টেস্টের প্রয়োজন হলে তাকে কোথাও পাঠাবে। কিন্তু সেখান থেকে আবার কমিশন খাবে কেন? দেখা গেছে, ডাক্তার যদি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন না নেয় তাহলে টেস্টের বিলও ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে আসে। ডাক্তার কমিশন খেলে যেখানে ১০,০০০ টাকা লাগতো এখন লাগবে মাত্র ৫,০০০ টাকা। এজন্য আল্লাহওয়ালা ডাক্তাররা পারতপক্ষে টেস্ট দেয় না, আর দিলেও কমিশন খায় না। এদের ব্ল্যাকমেইলটা পড়ে ধোঁকাবাজির মধ্যে, আর কমিশন খাওয়া পড়ে ডাকাতির মধ্যে।
সমাজে অনেক কিছু চালু আছে। যার কোনটা পড়ে ধোঁকার কাতারে, আর কোনটা পড়ে ডাকাতির কাতারে। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকার বদনাম আছে, তারা বিয়ের আগে ছেলেপক্ষকে মেয়ে দেখায় একটা আর বিয়ের দিন গছিয়ে দেয় অন্যটা- এটা ধোঁকাবাজি। আর ডাকাতি হলো, ছেলেপক্ষ মেয়ের বাপকে শর্ত দেয়, বিয়েতে আমার দুইশ' লোক আসবে। এ ধরনের দাওয়াত সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল বলেন, دخل سارقا وخرج مغيرا এই লোকগুলো চোর হয়ে ঢুকলো আর ডাকাত হয়ে বের হলো। (সুনানে আবূ দাউদ; হা. নং ৩৭৪১ ) খবরদার! মেয়েপক্ষের দাওয়াতে যাবেন না। ছেলেপক্ষ যদি ওলীমার দাওয়াত দেয় সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এখন তো আমাদের দেশের ওলীমাগুলোও খ্রিস্টানদের তরীকায় হয়। শুনেছি, খ্রিস্টানদের দাওয়াতে ফ্রি খাওয়ানোর কোন ব্যবস্থা নেই। তারা বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর পর তাদের হাতে একটা বিল ধরিয়ে দেয় যে, মেহমানদারী বাবদ আপনার এত টাকা বিল এসেছে, পেইড করে যাবেন। আরো আশ্চর্য হবেন, স্বামী স্ত্রী রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে খাওয়ার পর স্বামীর বিল দেয় স্বামী, আর স্ত্রীর বিল স্ত্রী! এমনকি এ-ও শোনা গেছে, মা-বাবা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খানা খাচ্ছে আর তাদের কন্যাটি না খেয়ে চুপচাপ তাদের খাওয়া দেখছে। কারণ ওর কাছে তখন খাওয়ার পয়সা নেই! ও খেলে বিলটা কে দেবে? যাহোক, তারা দাওয়াত খাওয়ানোর পর বিল ধরিয়ে দেয়, আর আমাদের দেশে কী হয়? ওলীমা অনুষ্ঠানের প্যান্ডেলের দোরগোড়ায় একটা টেবিল পাতা থাকে। সেখানে দু'এক জন লোক রেজিস্টার খাতা নিয়ে বসে থাকে। তাদের কাজ হল, আপনি কী নিয়ে ওলীমা খেতে এসেছেন- আংটি, ঘড়ি, চুড়ি, নাকি হার তা লিখে রাখা। যেন 'কিরামান কাতিবীন সাহেবেরা আপনার হাদিয়ানামা লিপিবদ্ধ করে রাখছে। আপনি খানা খেলেন দুইশ' টাকার আর দিতে হল পাঁচ হাজার টাকা। এটা ডাকাতিও হল সুদখোরিও হল। এর চেয়েও জঘন্য ব্যাপার হল, কোন কোন এলাকার কথা শোনা যায়, সেখানে আল্লাহর কোন বান্দা যদি লেনদেনমুক্ত ওলীমার আয়োজন করে তখন অনেকেই সে দাওয়াতে শরীক হয় না। উপরন্তু বলাবলি করে যে, 'ফয়তার দাওয়াতে আবার কে যায়?' অর্থাৎ কেউ হিম্মত করে সুন্নাতের অনুসরণ করলে তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। আল্লাহর পানাহ! আমরা এসব কী করছি! আসল কথা হল, আমরা অনেকেই এখন كلب الدنيا (দুনিয়ার কুকুর) হয়ে গেছি। আমাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তো ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই। ইসলাম কোথায় আর আমরা কোথায়?
বুযুর্গানে মুহতারাম! আমাদের ভুলের কোন শেষ নেই। ছেলে-মেয়ে বালেগ হয়ে গেলে পিতা-মাতার দায়িত্ব, দীনদার পাত্র-পাত্রী দেখে বিয়ে দিয়ে দেয়া। ছেলেদের দাড়ি গজানোর দ্বারা আর মেয়েদের মাসিক শুরু হওয়ার দ্বারা পিতা-মাতাকে বুঝানো হয় যে, ছেলে- মেয়ের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, আর দেরি করা যাবে না। এজন্য বালেগ হওয়ার দু'এক বছরের মধ্যেই ছেলে- মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। যদি না দেয়, আর ছেলে-মেয়ে কোন গুনাহ করে, কুদৃষ্টি করে, অন্য ছেলে-মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, প্রেমপত্র লিখে, ইন্টারনেটে নোংরা ছবি দেখে, তাহলে গুনাহের দায়দায়িত্ব পিতা-মাতার উপর বর্তাবে। আল্লাহর রাসূল বলে গেছেন, পিতা-মাতার উপর সন্তানের হক হল, সুন্দর নাম রাখা, আকীকা করা, দীন শিক্ষা দেয়া, বালেগ হয়ে গেলে বিয়ের দিয়ে দেয়া। (কিতাবুল বিররি ওয়াস্ সিলাই: হা. নং ১৫৫ )
বিয়ে-শাদী দেয়ার পর সন্তানের চারিত্রিক পদস্খলনের ব্যাপারে পিতা-মাতা অনেকটাই দায়মুক্ত।
অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, এদেশে যত এন.জি.ও. আছে সব ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের অর্থে পরিচালিত। এরা সরকারকে দিয়ে একটা আইন পাশ করিয়েছে যে, ১৮ বছরের আগে কোন মেয়ের বিয়ে দেয়া যাবে না। তাদের ভাষায় এটা হল বাল্যবিবাহ। অথচ মেয়েরা সাধারণত আরো চার/পাঁচ বছর আগেই বালেগা হয়ে থাকে। তখন বিয়ে দিলে তো এতদিনে সে মা হয়ে যেতো। মাঝখানে প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, এই আইনটা ১৬ বছরে করা হোক। কারণ মেয়েরা এতোটা সময় (১৮ বছর) বসে থাকে না। পারিপার্শ্বিকতাসহ বিভিন্ন কারণে তাদের পক্ষে চারিত্রিক পবিত্রতা ধরে রাখা সম্ভবপর হয় না। বন্ধু-বান্ধবের হাত ধরে চলে যায়, নানা অঘটন ঘটায়। কিন্তু এনজিওদের হৈচৈয়ের কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। এনজিওরা এই আইনটি পাশ করিয়েছে মূলত যিনা- ব্যভিচারকে ব্যাপক করার জন্য। এর জন্য তারা মুড়ি-মুড়কির মতো দেদারসে জন্মবিরতিকরণ ট্যাবলেটও সাপ্লাই দেয়। এর পরও কোন মেয়ে যদি বিপদে পড়ে যায়, পেটে অবৈধ সন্তান চলে আসে- এর জন্য তারা 'মেরী স্টোপস' প্রতিষ্ঠা করেছে। মুসলমানরা মনে করেছে, আমাদের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য সরকার কত রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এত রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার দেখে অনেকে খুশি হয়ে গেছে। অথচ আশংকা আছে! এগুলো আপনার আমার জন্য নয়। খুব তাড়াতাড়িই আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য কোন কুফরী শক্তি ক্ষমতায় আসবে,আর তাদের সুবিধার জন্য এগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছে!
এনজিওরা এক ভুত খাড়া করেছে যে, ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেয়া যাবে না। আর বাপ-মা খাড়া করেছে দুই ভুত। এক ভুত হল, দেখা যাচ্ছে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেটি বন্ধু-বান্ধবদের মাধ্যমে প্রস্তাব দিচ্ছে, আব্বা! আমি গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য বিয়ে করার দরকার মনে করছি। আর বাপ মা বলছে, তোর এখনো পড়াশোনাই শেষ হয়নি, বিয়ে করে বউকে খাওয়াবি কোত্থেকে? কেন, সে কি পড়াশোনার পাশাপাশি দু'একটা টিউশনি করে কিছু রোজগার করতে পারবে না? যদি না-ও পারে তাহলে আপনার প্রিয় রাসূল তো বলেই গেছেন, طعام الواحد يكفى الاثنين একজনের খাবার দু'জনের জন্য যথেষ্ট। দু'জনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট। (মুসলিম, হাদীস নং ২০৫৯) আপনার ফ্যামিলিতে দু'চারজন সদস্য অবশ্যই আছে। আরেকজন আসলে কি তার জন্য ব্যবস্থা হবে না? অবশ্যই হবে। তো পড়ালেখা শেষ হওয়ার দরকার নেই। বালেগ হলেই বিয়ে দিয়ে দেন, রিযিকের মালিক আল্লাহ।
বাপ মা আরেক ভুত খাড়া করেছে যে, এক ছেলে দীনদার, তাবলীগওয়ালা, আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে যায়। সে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু সিরিয়ালে সে তিন নম্বরে। অর্থাৎ তার আগে আরও দু'জন রয়ে গেছে; যারা দীন-ধর্ম মানে না, সারাদিন মেয়েদের সাথে আড্ডাবাজি করে, বিয়ের নামও নেয় না। তখন বাপ মা বলে, আরে! তোর আগে আরও দুইজন রয়ে গেছে না! তাদেরকে বাদ দিয়ে তোকে বিয়ে করাব কিভাবে? সিরিয়াল মতো আয়। ভাই! শরীয়তে কোন সিরিয়াল নেই। যার যখন পাত্র- পাত্রী পাওয়া যাবে, বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। এর বড় দলীল হল, হযরত মূসা আ. যখন ফেরাউনের রাজত্ব থেকে সঙ্গোপনে হযরত শুআইব আ.-এর দেশে হিজরত করলেন। আর শুআইব আ. তার কন্যাদের কাছ থেকে হযরত মূসা আ.- এর দীনদারির কথা শুনলেন যে, আসার সময় কন্যারা যখন তার আগে আগে চলে তাকে রাস্তা দেখাচ্ছিল তখন মূসা আ. তাদেরকে বলেছেন যে, তোমরা আমার পেছন পেছন আসো এবং পেছন থেকেই রাস্তা বাতলে দাও।
এতে হযরত শুআইব আ. বুঝতে পারলেন, এ ব্যক্তি ভবিষ্যতে বড় কিছু হবেন। তখন তিনি হযরত মূসা আ.-কে প্রস্তাব পেশ করলেন- দেখ, আমার দুই মেয়ের মধ্যে যাকে তোমার পছন্দ হয় তাকে তোমার সাথে বিয়ে দিব। (সূরা কাসাস- ২৭) দেখুন, তিনি বলেছেন- إحدى ابنتي هاتين 'আমার এই দুই মেয়ের কোন একজন।' একথা বলেননি যে, বড়জনকে বিয়ে দিব। বরং বলেছেন, দুজনের যাকেই তোমার পছন্দ হয়। অথচ আমাদের দেশে সিরিয়ালকে ফরয মনে করা হয়। সিরিয়াল ভেঙে কেউই ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। এভাবে সময় মতো বিয়ে-শাদী না দেয়ার কারণে ছেলে-মেয়েগুলো নষ্ট হয়ে যায়, বখে যায়, ইন্টারনেটে যত পাপাচার আছে সেগুলো দেখে দেখে স্বাস্থ্য-মন সব নষ্ট করে ফেলে। এজন্য ছেলে-মেয়েকে গুনাহ থেকে বাঁচান, ইন্টারনেট থেকেও বাঁচান, মোবাইলের ভি.ডি.ও থেকেও বাঁচান। তাদেরকে ইসলামী যিন্দেগী যাপনের সুযোগ করে দিন।
আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে স্বচ্ছ জীবন- যে জীবনে কোন ধোঁকাবাজি নেই, ফেরেববাজি নেই, মুনাফেকি নেই, এমন সহজ সরল ও ইখলাছওয়ালা যিন্দেগী যাপন করার তাওফীক দান করুন। আমীন
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
শিক্ষার জন্য শিক্ষকের বিকল্প নেই
আল্লাহ তা'আলা সকল নর-নারীর জন্য ইলম অর্জন ফরজ করেছেন। ইলম আল্লাহ তা'আলার একটি সিফাত। আল্লাহ ত'আলা তা...
দাওয়াত, হাদিয়া ও উপঢৌকন
হাদিয়া, উপঢৌকন ও দাওয়াত আদান- প্রদান ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল ও প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু...
মসজিদুল হারামের জুমার খুতবা থেকে......হে আল্লাহর বান্দারা! মা-বাবার প্রতি সদাচারী হোন
মা-বাবার প্রতি সদাচার একটি মহান মানবিক হক; যার মতো গম্ভীর ও মর্যাদাপূর্ণ হক আর নেই। এ হক আদায় করে খো...
মোয়াশারাঃ পারস্পরিক হক ও অধিকার
...