প্রবন্ধ

জুলুম নির্যাতনের নতুন রূপ লাউড স্পিকারের বেপরোয়া ব্যবহার

লেখক:শাঈখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী
১১ জানুয়ারী, ২০১৬
৩৭৩০ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

জুলুম বলতে আমরা বুঝি অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ হরণ করা বা কাউকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়া। কিন্তু আরবী ভাষায় জুলুমের সংজ্ঞা হল, কোন জিনিসকে অপাত্রে ব্যবহার করা। যেহেতু কোন জিনিস অপাত্রে ব্যবহার করলে নিঃসন্দেহে কারো না কারো কষ্টের কারণ হয়, তাই প্রতিটি বস্তুর অন্যায্য ব্যবহারই জুলুম বলে গণ্য হবে। আর যদি এর দ্বারা কোন মানুষ সরাসরি কষ্ট পায়, তাহলে শরয়ী দৃষ্টিতে সীমালঙ্ঘনকারীর কবীরা গুনাহ হবে। বর্তমান সমাজে এমন বহু কবীরা গুনাহের প্রচলন রয়েছে, যার গুনাহ হওয়ার অনুভূতিও কারো মনে উদিত হয় না। মানুষকে কষ্ট দেয়ার এ সকল কাজের মধ্যে চরম পীড়াদায়ক হল ‘লাউড স্পিকারের লাগামহীন ব্যবহার। ক'দিন আগে এক ইংরেজি দৈনিকে জনৈক ভদ্রলোক অভিযোগ করে লিখেছেন, আজকাল প্রায় বিয়ে- শাদীতেই গভীর রাত পর্যন্ত লাউড স্পিকারে লাগাতার গান-বাদ্য চলতে থাকে। অথচ আশেপাশের বাড়ি-ঘরে বসবাসকারী মানুষজন তখন বিরক্তি ও অস্থিরতায় কাতরাতে থাকে। কোন বিবাহ অনুষ্ঠানের আওয়াজ নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকা তো দূরের কথা! এর আয়োজকরা একবারও ভেবে দেখেন না, আশ-পাশের দুর্বল ও রুগ্ন ব্যক্তিদের কী দশা হচ্ছে? তাদের প্রতি দয়ার্দ্র হয়ে আওয়াজের সীমিত ব্যবহার হোক। কারণ তারা তো এ অনুষ্ঠানের আওয়াজ শুনতে মোটেও আগ্রহী নন। গান-বাদ্যের ব্যাপার তো আরো মারাত্মক। উঁচু আওয়াজে গান-বাজনা প্রচারে তো দ্বিগুণ গুনাহ হয়। বরং খালেস দীনী ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও স্পিকারের মাধ্যমে ঘর- বাড়িতে অবস্থানকারী সকলকে জোরপূর্বক শ্রবণে বাধ্য করাও শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েয।

আফসোস! আমাদের সমাজে ধর্মীয় মাহফিল ও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের আয়োজকরা শরীয়তের এমন গুরুত্বপূর্ণ বিধানের প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করেন না। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মাহফিলে দূর দূরান্ত পর্যন্ত লাউড স্পিকার লাগানো হয়। ফলে বাড়ি-ঘরে না কেউ বিশ্রাম নিতে পারে, না একাগ্রচিত্তে ব্যক্তিগত কাজ সারতে পারে। আযানের ধ্বনি তো দূর-দূরান্তে পৌঁছানো জায়েয। কিন্তু মসজিদে অনুষ্ঠিত ওয়ায-নসীহত, যিকির- তিলাওয়াতের আওয়াজ সকলের বাড়িতে পৌঁছানোর কোন বৈধতা নেই। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, মসজিদে গুটিকয়েক লোক ওয়ায শুনছেন, হয়তো সেখানে স্পিকারের প্রয়োজনই নেই, কিংবা ভিতরে প্রয়োজন থাকলেও বাইরের মাইক ব্যবহারের বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারপরও ভেতরে বাইরে পুরোদমে মাইক চলছে। ফলে ঘরে অবস্থানকারী নারী-শিশু, রোগী- বৃদ্ধ কারও পক্ষেই এই তাণ্ডবে কান না দিয়ে উপায় নেই।

মনে পড়ে, কোন কাজে একবার লাহোর গিয়েছিলাম। যে বাড়িতে আমি মেহমান ছিলাম, তার কাছাকাছি তিন দিকে তিনটি মসজিদ ছিল। জুমুআর দিন। ফজরের নামাযের পর হঠাৎ মসজিদগুলোর বড় মাইকে পাঠদান শুরু হল। এরপর শিশু-কিশোরদের ক্রমাগত তিলাওয়াত। অতঃপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কবিতা ও গজলের অবিরাম বর্ষণ চলতে থাকল। ফজর থেকে জুমু'আর আগ পর্যন্ত ধর্মীয় এ অনুষ্ঠান বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে। এ সময় বাসা-বাড়িতে কারো সাধারণ আওয়াজ তো দূরের কথা, চিৎকার চেঁচামেচি শোনাও দুরূহ হয়ে পড়েছিল। আল্লাহ তা'আলার মেহেরবানী, কেউ তখন অসুস্থ ছিল না। ভাবছিলাম, আল্লাহ না করুন কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তো তার শান্তি মতো ঘুমানোর উপায় ছিল না। অনেক মসজিদের ব্যাপারে শোনা যায়, জনশূন্য মসজিদে বড় মাইকে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে দেয়া হয়। মসজিদে কোন শ্রোতা নেই অথচ পুরো মহল্লায় সেই রেকর্ড ধ্বনিত হতে থাকে। দীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন আলেম যে দৃষ্টিভঙ্গিরই হোন না কেন কখনো এমন গর্হিত কাজ করতে পারেন না। এই কর্মকাণ্ড ঐ সকল মসজিদেই হয় যার ব্যবস্থাপনা দীনী ইলম সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিদের হাতে ন্যস্ত। অধিকাংশ সময় তারা নেক নিয়তেই এমনটি করে থাকেন। এই কাজকে দীন প্রচারের মাধ্যম ও দীনের খেদমতও মনে করেন। কারণ আমাদের সমাজে এ ভুল নীতিটি ব্যাপক প্ৰসিদ্ধ যে, ‘নেক নিয়তের ফলে নিষিদ্ধ কাজও সিদ্ধ ও বৈধ হয়ে যায়।' অথচ বাস্তবতা এর বিপরীত। কোন কাজ সঠিক হওয়ার জন্য কেবল সদিচ্ছা বা নেক নিয়তই যথেষ্ট নয় বরং তার পদ্ধতিটিও শুদ্ধ হওয়া জরুরী। আর লাউড স্পিকারের বেপরোয়া ব্যবহার শুধু দীন প্রচারের নীতি বিরোধীই নয়, অনেক সময় এর প্রতিক্রিয়াও নেতিবাচক হয়ে থাকে। যে সকল বন্ধুরা এ বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার, তাদের জন্য পূর্ণ সহমর্মিতা ও মনস্তাপের সঙ্গে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি-

(১) প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস উমর ইবনে শাব্বাহ রহ. মদীনা মুনাওয়ারার বিস্তারিত ইতিহাস সম্বলিত চার খণ্ডের একটি কিতাব লিখেছেন। মদীনা শরীফ সংশ্লিষ্ট আলোচনায় বড় বড় উলামায়ে কেরাম এ কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। এ কিতাবে তিনি নিজ সূত্রে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন, জনৈক বক্তা হযরত আয়িশা রাযি. -এর হুজরার সামনে উঁচু আওয়াজে ওয়ায করতেন। তখন তো আর লাউড স্পিকারের ব্যবস্থা ছিল না, এমনিতেই সে লোকের আওয়াজ এতো উঁচু ছিল যে হযরত আয়িশা রাযি. এর ইবাদতের একাগ্রতায় ব্যাঘাত ঘটত। ঘটনাটি হযরত উমর রাযি, এর খেলাফতকালের। তিনি খলীফা উমরের কাছে অভিযোগ করলেন, এই লোক আমার ঘরের সামনে ওয়ায করার কারণে আমার কষ্ট হয় এবং তার বিকট আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। হযরত উমর রাযি. বক্তা সাহেবকে ডেকে এনে সেখানে ওয়ায করতে নিষেধ করে দিলেন। কিন্তু ক'দিন যেতে না যেতেই লোকটি আবার সেখানে ওয়ায করতে আরম্ভ করল। খলীফা উমর সংবাদ পেয়ে সশরীরে সেখানে উপস্থিত হন এবং তাৎক্ষণিক তাকে শাস্তি প্রদান করেন। (আখবারুল মাদীনা- ১/১৫)

(২) ব্যাপারটা শুধু এতোটুকুই ছিল না যে, হযরত আয়েশা রাযি. নিজের কষ্ট দূর করতে চেয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ইসলামী সামাজিকতার মূলনীতি স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন যে, কেউ যেন কারো আচরণে কষ্ট না পায়। সেই সঙ্গে দীনের প্রচার ও তাবলীগের প্রকৃত পদ্ধতিও শেখাতে চেয়েছেন। যেমন, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. স্বীয় হাদীস সংকলন ‘আল মুসনাদ’-এ বর্ণনা করেন, একদা আম্মাজান হযরত আয়িশা রাযি. মদীনা মুনাওয়ারার এক বক্তাকে ওয়ায ও দীন প্রচারের বিস্তারিত আদব শিখিয়েছেন। তন্মধ্যে এটাও ছিল যে, 'নিজের আওয়াজ ঐ সকল লোকদের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখো যারা তোমার মজলিসে উপবিষ্ট আছেন। ততোক্ষণ পর্যন্ত দীনের কথা শোনাও যতক্ষণ তোমার প্রতি তারা মনোযোগী থাকে। যখন তারা এদিক সেদিক তাকাতে শুরু করবে তুমিও ওয়ায বন্ধ করে দিবে। এমন যেন না হয়, লোকেরা পরস্পরে কথা বলছে, আর তুমি তাদের কথা বন্ধ করে নিজের কথা শুরু করে দিয়েছো, বরং তুমি এ সময় চুপ থাকবে। অতঃপর যখন তারা অনুরোধ করবে তখন তাদেরকে দীনের কথা শোনাবে। (মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৯১) 

(৩) হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. উঁচু স্তরের তাবেয়ী ছিলেন। ইলমে তাফসীর ও ইলমে হাদীসে তাঁর পাণ্ডিত্য সর্বজন স্বীকৃত। তাঁর একটি চমৎকার উক্তি হল, আলেমের উচিৎ তার আওয়াজ যেন মজলিস অতিক্র না করে। (আদাবুল ইমলা ওয়াল ইসতিমলা; পৃষ্ঠা ৫) 

(৪) প্রকৃতপক্ষে এ সকল আদব দোজাহানের সরদার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় কথা ও কাজের মাধ্যমে উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। প্রসিদ্ধ ঘটনা। একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমর রাযি. এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হযরত উমর তখন তাহাজ্জুদের নামাযে উঁচু আওয়াজে তিলাওয়াত করছিলেন। নবীজী তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে হযরত উমর রা. উত্তর দিলেন, 'ঘুমন্তদের জাগাই, শয়তানকে ভাগাই' নবীজী তাকে বললেন, তোমার আওয়াজ কিছুটা নিচু করে দাও। (মিশকাত মাসাবীহ ১/১০৭)

হযরত আয়িশা রাযি. হতে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাহাজ্জুদ আদায়ের জন্য ঘুম থেকে জাগ্রত হতেন তখন খুব আস্তে করে বিছানা থেকে নামতেন। (যেন ঘুমন্তদের ব্যাঘাত না ঘটে)।

(৫) উপর্যুক্ত হাদীসসমূহ ও বরেণ্যদের উক্তির আলোকে উম্মতের ফক্বীহগণ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, এতো উঁচু আওয়াজে তাহাজ্জুদের নামায পড়া বৈধ নয়, যার দ্বারা কারো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। ফকীহগণ লিখেন, যদি কোন ব্যক্তি জনসাধারণের ঘুম ও আরামের সময় নিজ বাড়ির ছাদে উঁচু আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করে তাহলে তিলাওয়াতকারী গুনাহগার হবে। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/১০৩)

একবার এক ভদ্রলোক আমাদের ফাতাওয়া বিভাগে প্রশ্ন করেছিলেন, অনেক মসজিদে তারাবীহ নামাযের কিরাআত লাউড স্পিকারে এতো উঁচু আওয়াজে প্রচার করা হয় যে, মহল্লার মহিলাদের ঘরে নামাজ পড়া কষ্টকর হয়ে যায়। ঠিক তেমনি যারা অসুস্থ, দুর্বল, যাদের জন্য স্বাস্থ্য রক্ষায় তাড়াতাড়ি ঘুমানো জরুরী তারাও ঘুমাতে পারে না। এছাড়া বাইরের লোকদেরও কুরআন শরীফের আদবের প্রতি লক্ষ্য রেখে তিলাওয়াত শ্রবণ করা সম্ভব হয় না। সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করলে শ্রোতাদের উপর সিজদা ওয়াজিব হয়। অথচ তারা বুঝতেই পারে না যে, পঠিত আয়াত শ্রবণে তাদেরকে সিজদা করতে হবে। অথবা বুঝতে পারলেও কখনো তারা উযূ না থাকার কারণে সিজদা করতে পারে না এবং পরবর্তীতে ভুলেও যায়। এমতাবস্থায় তারাবীহ চলাকালীন মসজিদের বাইরের স্পিকার চালিয়ে রাখা কতটা শরীয়তসম্মত?

প্রশ্নটি বিভিন্ন উলামায়ে কেরামের নিকট পাঠানো হয়েছিল। সকলে একমত হয়ে এই উত্তরই দিয়েছেন যে, বর্ণিত অবস্থায় তারাবীহর তিলাওয়াত প্রয়োজনের অতিরিক্ত লাউড স্পিকারের মাধ্যমে বাইরে প্রচার করা নাজায়েয। এ ফাতওয়া মাসিক আল বালাগে (মুহররম ১৪০৭ হি. সংখ্যায়) প্রকাশিত হয়েছে। আর বাস্তবতা হল, এটা কোন মতবিরোধপূর্ণ মাসআলা নয়। এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত।

কাজেই সকল ইবাদাত এমনভাবে সম্পাদন করা উচিত, যেন কারো কষ্ট না হয়। নাজায়েয পদ্ধতিতে আদায়ের কারণে আমরা যেন ইবাদাতের অমূল্য সওয়াব থেকে যেন বঞ্চিত না হই। লাউড স্পিকারের ব্যবহার যেন প্রয়োজনের সময় প্রয়োজন অনুপাতেই করা হয়, কিছুতেই যেন সীমালঙ্ঘন না হয়।

উপর্যুক্ত আলোচনা দ্বারা একথা সহজেই অনুমেয় যে, শরীয়ত সকলকে কষ্ট থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বারোপ করেছে। যখন কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত এবং ওয়ায- নসীহতের ন্যায় পুণ্যের কাজে শরয়ী দিক-নির্দেশনা এই যে, এর আওয়াজ যেন প্রয়োজনীয় স্থান অতিক্রম না করে। তাহলে গান-বাদ্য ও অন্যান্য অনর্থক কাজে লাউড স্পিকারের বেপরোয়া ব্যবহারের গুনাহ কতটা ভয়াবহ, এমনিতেই অনুমান করা যায়।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ