প্রবন্ধ
নারীর দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক এ মানব সম্প্রদায়। যাদের উপর মহান আল্লাহ তা'আলা তাঁর বন্দেগী আবশ্যক করেছেন। এ মানব সম্প্রদায়কে মহান রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন সাধারনত দুই ভাগে: (১) পুরুষ (২) মহিলা। এর মধ্যে মহান আল্লাহ তা’য়ালা যেভাবে পুরুষকে দিয়েছেন ক্ষেত—খামার, চাকরি—বাকরি, ব্যবসা—বাণিজ্য, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন রকমের দায়িত্ব। তেমনিভাবে মহিলাদেরকেও দিয়েছেন— সন্তান গর্ভে ধারণ করা, লালন—পালন করা, ঘরোয়া বিভিন্ন রকমের কাজ—কর্মগুলো আঞ্জাম দেওয়ার মাধ্যমে পুরুষকে সহযোগিতা করার দায়িত্ব।
তবে দৈহিক এবং মানসিক ভিন্নতার কারণে দুনিয়াতে চলার ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও কর্মের কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে বান্দেগীর ক্ষেত্রে সকলেই সমানভাবে আদিষ্ট। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে—
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ.
অর্থ: আর আমি জিন ও মানবজাতিকে কেবল আমার ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।
অর্থাৎ— ইবাদত বন্দেগী পালনে মহান রবের পক্ষ থেকে নারী—পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই সমানভাবে আদিষ্ট। আর আমরা জানি, ইবাদাত বন্দেগী পূর্ণভাবে আদায়ের জন্য ইলমে দ্বীন শিক্ষা অপরিহার্য। অর্থাৎ— যেটুকু না শিখলে ফরজ ইবাদাতগুলো পালন করা সম্ভব নয়, ততটুকু ইলম অর্জন করা প্রত্যকরে জন্য ফরয। যেহেতু ইবাদাতের ব্যাপারে নারী—পুরুষ উভয়েই আদিষ্ট, সেহেতু বিদ্যার্জনের ক্ষেত্রেও অবশ্যই উভয়ের রয়েছে সমান অধিকার, অশগ্রহণের শরীয়ত সম্মত সুযোগ ও আবশ্যকীয়তা। যেমনিভাবে হাদিসে পাকে ইরশাদ হচ্ছে—
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ
অর্থাৎ— প্রত্যেক মুসলমান নর—নারীর জন্য দ্বীনি ইলম শিক্ষা করা ফরজ। (সুনানে ইবনে মাজাহ—১/৩৫৭পৃঃ)
ইসলাম নারী শিক্ষার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে, যা কোরআন হাদিসের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا...
অর্থ: হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং আপন পরিবার—পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। (সূরা—তাহরীম,আয়াত—৬)
উক্ত আয়াতে কারীমায় মহান রাব্বুল আলামীন— ‘বান্দা নিজেকে এবং সাথে সাথে পরিবার—পরিজন’ (তথা—মা—বোন, স্ত্রী—সন্তানদের)কেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্যে তাগিদ দিযেছেন। জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই আল্লাহ তা'আলার ইবাদত—বন্দেগী করতে হবে, আর আল্লাহর বন্দেগী করতে হলে অবশ্যই বান্দেগীর জন্য ইলমে দ্বীনের শিক্ষা অপরিহার্য। স্পষ্টতই নারীর দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম ।
এমনিভাবে শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, হাদিসে আছে—
عن الشفاء بنت عبد الله قالت: دخل علي رسول الله صلى الله عليه وسلم وانا عند حفصة فقال لي: ألا تعلمين هذه رقية النملة كما علمتيها الكتابة
অর্থ: একবার নবীজী সা. আমার কাছে আসলেন, আর আমি তখন হাফসা (রা.)এর নিকটে ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি তাকে যেভাবে লিপিবিদ্যা শিখিয়েছো সেভাবে খুঁজলি—পাচড়ার চিকিৎসা পদ্ধতিও কেন শিখিয়ে দিচ্ছো না? (আবু দাউদ—৩৮৮৭)
উক্ত হাদিসে হযরত শিফাকে লক্ষ্য করে রাসূল (স.)এর উক্তি ‘কেন শিখিয়ে দিচ্ছো না?’ থেকেই ইসলামে নারী শিক্ষার সর্বোচ্চ গুরুত্বের বিষয়টি প্রতিয়মান হয়।
ইসলামে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিহার্য, যেমনিভাবে পুরুষের জন্য অপরিহার্য। তবে উভয়ের জন্য শিক্ষার পরিবেশ হতে হবে ভিন্ন এবং উভয়ের উপযোগী শিক্ষা সিলেবাস হবে ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন। তবে উভয়ের শিক্ষার ভিত্তি হবে এক’ই। আর তা হলো— তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত। কেননা দুনিয়াতে ভূমিষ্ট হবার পর সে ছেলে হোক বা মেয়ে, উভয়কেই প্রথমে জানতে হবে তার ‘রব’ সম্পর্কে। অতঃপর জানতে হবে, তার ‘রব’ তাকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তাঁর দাসত্বের জন্যেই। তাকে জানতে হবে দুনিয়াতে তার রবের পক্ষ থেকে তার উপর দেয়া দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে।
নারী—পুরুষ, উভয়ের আবেগ—অনুভূতি ভিন্ন। তাই দু’বছরের শিশুর মধ্যেও দেখা যায় যে, তাদের খেলনা পৃথক, পোষাক পৃথক ও খেলার সাথীও পৃথক। লক্ষ্য করলে আরো দেখা যায় যে, তাদের রুচি, দাবী ও মানসিকতাও ভিন্ন। কন্যা শিশু বাইরে যেতে চায় না, সে হাড়ি—পাতিল নিয়ে খেলা করে। ছেলে শিশু ঘরে থাকতে চায় না, সে বাস—ট্যাক্সির খেলনায় মেতে থাকে। মেয়ে শিশু বাপের বেশী আদরের হ’লেও মায়ের কোলে ঘুমাতে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সুতরাং প্রাকৃতিকভাবেই যেহেতু নারী পুরুষের আবেগ—অনুভূতি, রুচি ও মানসিকতা ভিন্ন ভিন্ন । তাই ছোট থেকেই তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও করতে হবে তাদের রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী। তাদেরকে দিতে হবে তাদের রুচি, দাবি ও মানসিকতার অনুকূল পরিবেশ।
কেননা মাছ যেভাবে পানির বাহিরে নিরাপদ নয়, ঠিক তেমনিভাবে নারীও পর্দার বাহিরে নিরাপদ নয়। ছেলে ও মেয়ে উভয়ের মাঝে রয়েছে নিজস্ব স্বাতন্ত্রতা ও স্বকীয়তা। যার থেকে বিপরীত পরিবেশে গেলেই সে বিব্রত বোধ করে। এমনিভাবে টাইট—ফিট, অর্ধনগ্ন পোশাক, বদ্বীনি ও বেপর্দার পরিবেশে তাদের উভয়ের মন—মস্তিষ্ক অবশ্যই সংকুচিত হবে। অপরদিকে সুস্থ—সুন্দর ও পর্দার পরিবেশে উভয়ের মন—মস্তিষ্ক হবে সুপ্রসন্ন। এর বিপরীত কিছু করতে গেলেই সেটা হয়ে থাকে তাদের স্বভাব বিরুদ্ধ, যাতে ঘটে নানা বিপত্তি। ইসলাম নারী ও পুরুষের এই স্বভাবগত প্রবণতাকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং তাদের জন্য পৃথক শিক্ষা পরিবেশ ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।
ইসলামে নারীর মূল্যায়ন:
পৃথিবীতে সব কিছুই আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ হতে এক একটা সম্পদ। আর এ সম্পদের মধ্য হতে সেরা সম্পদ হলো— নারী। রাসূলে কারিম (সাঃ) ইরশাদ করেন —
الدنيا كلها متاع وخير متاع الدنيا المرأة الصالحة
অর্থাৎ—দুনিয়া পুরোটাই সম্পদ, আর দুনিয়ার সেরা সম্পদ হলো পূর্ণশিলা নারী।(মুসলিম শরীফ, হাদিস নং—১৪৬৭)
যে জিনিস যত বেশি মূল্যবান, তা রাখতে হয় ততটা সযত্নে ও সংগোপনে এবং তার ব্যবহারও করতে হয় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। মূল্যবান সম্পদকে কেউ অবমূল্যায়ন করে এখানে—সেখানে যেভাবে ফেলে রাখে না, যে কারো সামনে প্রকাশ করে না, যেন—তেনভাবে অবহেলা করে এটাকে ব্যবহার করে না। ঠিক তেমনিভাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ নারীকেও বেপর্দাভাবে বাইরে বের হওয়া, যথেচ্ছায় এদিক সেদিক যাওয়া, যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো, যার তার সাথে দেখা—সাক্ষাৎ করা সবগুলোই তার অবমূল্যায়নের বহিঃপ্রকাশ।
মূল্যবান সম্পদ যেভাবে সংরক্ষণে অবহেলা হলে অথবা ব্যবহারে ত্রুটি হলে ঘটে অনিষ্টতা, ঠিক তেমনিভাবে নারীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং মূল্যবান জিনিসের মতো অতি মূল্যবান নারীকেও থাকতে হবে তার নির্দিষ্ট বলয়ে। হীরা, মুক্তাকে মানুষ কখনো যত্রতত্র ফেলে রাখে না, কোন ব্যক্তি যদি হীরা—মুক্তার মতো মূল্যবান জিনিসকে যত্রতত্র ফেলে রাখে তাকে কেউ জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান বলে না, বরং সকলের দৃষ্টিতে সে প্রমাণিত হবে নির্বোধ হিসেবে। নারী হীরা—মুক্তার চেয়েও বহুগুণ দামী। সুতরাং স্বাধীনতা, আধুনিকতা বা অধিকারের নামে তাকে যত্রতত্র ছেড়ে দেওয়া নির্বুদ্ধিতারই বহিঃপ্রকাশ।
সুতরাং নারীর জন্য যেভাবে শিক্ষা জরুরী, ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষা দানের পরিবেশ ও পদ্ধতিও হতে হবে শরীয়ত সম্মত, নববী মানহাজ অনুযায়ী। শিক্ষার কারিকুলাম হতে হবে এমন যেখানে একজন নারী বাস্তবিক অর্থে’ই পরিণত হবে পৃথিবীর সেরা সম্পদে।
তার শিক্ষার ভিত্তি হবে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত ভিত্তিক এমন এক মানহাজ, যাতে সে মন থেকেই শরীয়তের পূর্ণ অনুসারি হবে, তার জবান হবে সংযত, সে হবে শরয়ী পর্দায় অভ্যস্ত, স্বামীর অনুগত, হবে সন্তান লালন—পালনে আন্তরিক, রান্না—বান্নাসহ ঘরোয়া কাজকর্মে সুদক্ষ এবং সন্তান প্রতিপালনসহ তার এবাদত বন্দেগিগুলোর শরযী বিধান সম্পর্কে সে হবে পূর্ণ জ্ঞাত।
আদর্শ জাতি গঠনে নারীর ভূমিকা:
একটি সন্তান মায়ের কাছ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ের যে সুশিক্ষা পেয়ে থাকে সেটাই তার জীবনে আদর্শের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য মূল ভিত্তি হয়ে থাকে। আর একজন মা তার সন্তানকে তখন’ই প্রাথমিক পর্যায়ের সুশিক্ষা ও আদব—কায়দা শিক্ষা দিতে সক্ষম হয় যখন দ্বীন সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞানগুলো যথা— সন্তান লালন—পালন, নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিধানগুলো তার জানা থাকে। একজন নারী দ্বীনের আহকামগুলো না জানার কারণে নিজে যেভাবে দুনিয়া—আখেরাত উভয় জাহানে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তেমনিভাবে তার অভিভাবক ও অধীনস্তরাও তার কারনে দুনিয়াতে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা ও আখেরাতে ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হয়। অপরদিকে একজন আদর্শ নারীর কারণে যেমনিভাবে তার অভিভাবকরা হয় দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত, তেমনিভাবে তার অধীনস্থরাও হয়ে থাকে উন্নত আদর্শে আদর্শিত।
কেননা একটি আদর্শ জাতি গড়ার ক্ষেত্রে আদর্শ মানুষের বিকল্প নেই, আর আদর্শ মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে একজন আদর্শ মায়ের বিকল্প নেই। আল্লামা নুরুল ইসলাম আদীব সাহেব(দা.বা.) এক বয়ানে বলেন— একটি সন্তানের দৈহিক গঠনের প্রায় ৯০ শতাংশই গঠিত হয় তার মায়ের দেহের নির্যাস মিশ্রিত পদার্থ দ্বারা। বাবার ওরশ থেকে যখন সন্তান মায়ের গর্ভে স্থানান্তরিত হয়, সন্তান গর্ভে আসার সাথে সাথেই আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন মায়ের দেহের রক্তের মাধ্যমে সন্তানের দেহ গঠিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এমনিভাবে সন্তান পৃথিবীতে আসার পর অন্ততপক্ষে দুই বছর পর্যন্ত যে দুধ পান করে থাকে সেটাও মায়ের দেহ নিঃসৃত। তথা এই সন্তানের দেহের প্রায় ৯০ শতাংশই গঠিত হয় মায়ের শরীরের অংশ দ্বারা। সুতরাং বাচ্চার দেহ গঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু মায়ের দেহ মিশ্রিত পদার্থের প্রভাব বেশি। তাই মায়ের স্বভাব, চরিত্র, প্রকৃতি বাচ্চার উপর স্বাভাবিকভাবেই খুব বেশি’ই প্রভাব বিস্তার করবে। আর এটাই স্বাভাবিক।
দ্বীন শিক্ষা না করার ক্ষতি:
বর্তমান সময়ে অধকিাংশ অভিভাবকই শংকিত তার সন্তানকে নিয়ে। কেননা সুশিক্ষার অভাবে আজ ছেলে বাবার কথা শুনছে না, মেয়ে মায়ের কথা মানছে না। পশ্চিমা ভাবধারায় চলতে গিয়ে তারা আজ নিজেদেরকে ঠেলে দিচ্ছে শৃংখলহীন এমন এক জীবনের দিকে, যেখানে পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, মানুষের বংশপরিচয় বিলুপ্তির পথে, পিতৃপরিচয়হীন সন্তানের সংখ্যা বেড়ে চলছে, যিনা—ব্যভিচারের ফলে ব্যাপক হারে বাড়ছে নতুন নতুন রোগ—ব্যাধি, লজ্জা—শরমের মতো চারিত্রিক মহাসম্পদ সমাজ থেকে ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে।অবশেষে বয়স বাড়ার পর মহিলাদের জীবন নিজের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
পশ্চিমা সভ্যতা, যাদেরকে আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশ এবং সুখী মানুষ বলে মনে করি, যেখানে যেতে পারা, বসবাস করতে পারা অথবা সেখানে যেতে না পারলেও অন্ততপক্ষে নিজের দেশে থেকে তাদের সাংস্কৃতি অনুযায়ী চলতে পারাকে আমরা অনেকেই নিজেদের জাগতিক সফলতার চাবিকাঠি মনে করে থাকি। অথচ তাদের জীবনের সচরাচর বাস্তব অবস্থা হলো এমন, যা আমি সংক্ষিপ্তাকারে উপরে উল্লেখ করেছি।
অপরদিকে ইসলামি সভ্যতার ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া লোকগুলোর জীবন আচার, চলাফেরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। দ্বীনের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়ার ফলে একটা গরীব থেকে গরিব লোকও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে প্রাণ ভরে, কোরআন—হাদিসের পড়শে তার জাগতিক জীবনে সে অনুভব করে এক অনাবিল প্রশান্তি। আর এটা, যে যতটুকু কোরআন—হাদিস অনুযায়ী চলে, যে দ্বীনের ছায়াতলে যতটুকু আশ্রয় নেয় এবং যে যতটুকু কোরআন—হাদিস অনুযায়ী নিজের জীবন পরিচালনা করে, সে ততটুকু অনুভব করতে পারে।
সুতরাং একটা পরিবারকে দ্বীনের সুশীতল ছায়াতলে আনার জন্য, সেই পরিবারকে ইসলামিক পরিবার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, নারীর কোন বিকল্প নেই। অপরদিকে কোন নারী যদি নৈতিকতাহীনভাবে সমাজে চলাফেরা করে, তাহলে তার একজনের ক্ষতি আরও দশটা নীতিহীন পুরুষের ক্ষতির চেয়েও অনেকগুণ বেশি হয়ে থাকে। তাই ফিতনামুক্ত দ্বীনি পরিবেশের সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে নারীর জন্য দ্বীনি শিক্ষার বিকল্প নেই ।
কেননা যে পথে বিপর্যয় আসে সে পথেই তা রোধ করতে হয়। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, সেদিকে আমরা তেমন একটা মনোযোগ দেইনি। ইসলামের শুরু যুগে শিক্ষা ও দাওয়াতের কাজে নারীসমাজের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাফসীর, হাদীস, ফিক্হ, সাহিত্য ও ইসলামের প্রচার—প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখত তারা। অথচ বর্তমানে আমাদের মানসিকতা এমন হয়েছে যে, কেবল রান্না—বান্না করা, স্বামীর খেদমত করা ও সন্তানের লালন—পালন করা, অনেকে আবার আধুনিকতা ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নামে অফিস—আদালত, রেস্টুরেন্ট বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পাড়াকে’ই মহিলাদের কাজ মনে করে থাকে।
অবশ্য মহিলারা যদি উপরোক্ত কাজসমূহ শরয়ী বিধান অনুসারে করে থাকে, তাহলে অবস্থাভেদে এগুলোও তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও সাওয়াবের কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু শরয়ী বিধান অনুসারে কোন কাজ করতে হলে তো তাকে আগে শরয়ী বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে, অথচ সেদিকে আমাদের কোন গুরুত্ব’ই নেই।
উত্তরণের পন্থা ও করণীয়:
নারীর উপর দ্বীনি ইল্ম শিক্ষা করার এই ফরয আদায় করার বিভিন্ন পন্থার সাথে সাথে যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে বর্তমানে মেয়েদের জন্য মহিলা মাদরাসায় অধ্যয়ন করাও সহজ একটা মাধ্যম। কেননা যদিও আমাদের পূর্বসূরীদের পন্থা ছিল যে, তারা নিজেদের মেয়েদেরকে ঘরেই তালিম দান করত এবং নিজেরাই শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতো। কিন্তু যুগ পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বর্তমান বাবা—মায়েদের জন্য সেই ফুরসত হয়ে ওঠেনা, তাছাড়া বর্তমান বাবা—মায়েদেরও ঐরকম দ্বীনি জ্ঞান না থাকার কারণে তারা নিজেরাই থাকে দিকভ্রান্ত। এহেন পরিস্থিতিতে দ্বীনের উপর চলার জন্য যে ইলম অর্জন করা জরুরি, তার জন্য বর্তমানে মহিলা মাদরাসাগুলোর ভূমিকা অপরসীম।
বর্তমানে এই মাদরাসাগুলো নারীদের দ্বীনি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সারা দেশে এর শাখা—প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে এবং এগুলোর মাধ্যমে মুসলমানদের মেয়েরা দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে, আলহামদুলিল্লাহ।
কিন্তু বর্তমানে নারী জনসংখ্যার তুলনায় মাদরাসায় পড়–য়া নারীদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। অপরদিকে বিশাল এক সংখ্যা রয়ে যাচ্ছে যারা স্কুল, কলেজ—ভার্সিটিসহ বিভিন্ন ধরণের সহশিক্ষা ও সহাবস্থানের পরিবেশে পড়াশোনা বা অবস্থান করছে। তারা যদিও বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি ও দুনিয়াবি উন্নতি অর্জন করছে, কিন্তু দ্বীনি বিষয়ে এতটা অনবগত যে, দেখে দেখে কোরআন পড়তেও অক্ষম এবং নিজেদের একান্ত প্রয়োজনীয় মাসায়িলগুলো সম্পর্কেও সম্পূর্ণ অনবগত। এমন নারীদের জন্যেও দ্বীনি শিক্ষার ব্যবস্থা করা অত্যান্ত জরুরি। চাই তা রাষ্ট্রীয়ভাবে হোক বা তাদের অধ্যয়নরত প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে, অথবা কারো ব্যক্তিগত উদ্যোগে। যেভাবেই হোক না কেন, প্রতিটি স্তরের প্রতিটি বয়সের, প্রতিটি নারী—পুরুষের জন্য দ্বীনি শিক্ষার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।
তবে আশার বাণী হচ্ছে এই যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে না হলেও, সামাজিক বা ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন এলাকায় মসজিদ বা বাসা কেন্দ্রিক নারী—পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দ্বীনি শিক্ষার জন্যে উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে এটা আরো ব্যাপক ও সুশৃংখলতার সহিত হওয়া উচিত। বিশেষ করে সহীহ পদ্ধতি অবলম্বন করে স্কুলগুলোতেও দ্বীনি শিক্ষার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি। যতদিন পর্যন্ত খেলাফত পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে দেশে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত অন্তত দ্বীনকে টিকিয়ে রাখতে, মানুষের মধ্যে দ্বীনী ইলম বিস্তার করার ক্ষেত্রে সামাজিক বা ব্যক্তিগত এসব উদ্যোগের বিকল্প নেই।
পরিশেষে সকলের প্রতি আহ্বান করবো— আসুন! যেখানে যেখানেই এভাবে ছোট—বড় পরিসরে দ্বীনি শিক্ষাদানের কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়, সেখানেই আমরা সকলেই এগিয়ে আসি এবং নিজের যোগ্যতা, অবস্থান ও সাধ্য অনুযায়ী তাতে সহযোগি হই। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সকলকে দ্বীনি ইলম প্রচার—প্রসারের খেদমতে শামিল হওয়ার তাওফিক দান করুন, আমিন, ইয়া রাব্বাল আলামিন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
দ্বীনরক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি ব্যয় করা
...
বালা-মুসীবতের কারণ ও প্রতিকার
মহান রব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন- وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَع...
আলেমদের প্রতি আস্থাহীনতা গোমরাহীর প্রথম সোপান
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আলেমগণের মর্যাদা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পবিত্র ঘোষনা, এক. إِنَّمَا يَخْشَى الل...
দা'য়ীর সাথে আল্লাহ তা'আলা আছেন
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] হামদ ও সালাতের পর... আহলে ইলমের ওয়াদা রূহের জগতে আল্লাহ তা'আলা সাধারণ ল...