প্রবন্ধ

রোযাকে ঢাল বানান,এই ঢালকে অক্ষুণ্ণ রাখুন

লেখক:শাঈখুল ইসলাম হযরত আব্দুল মালেক
২১ মার্চ, ২০২৩
১৪০৩ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

রমযানুল মুবারক বান্দার জন্য আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত। এই মাসের দিবস-রজনীকে আল্লাহ তাআলা খায়ের ও বরকত দ্বারা পূর্ণ করে রেখেছেন। তাকওয়া অর্জনের অনুশীলনের জন্য এবং ইবাদত-বন্দেগী ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সকল আমলের জন্য ভরা বসন্ত বানিয়েছেন। এ মাস শুধু একটি মাসই নয়; বরং গোটা বছরের এটা তাপকেন্দ্র। এ মাস থেকেই মুমিন গোটা বছরের তাকওয়া-তাহারাতের সঞ্চয় গ্রহণ করে। গোটা বছরের ঈমানী প্রস্ত্ততি এ মাস থেকেই গ্রহণ করে। হাদীস শরীফের ভাষায় :

আল্লাহ তাআলার ক্বসম! মুসলমানদের জন্য এর চেয়ে উত্তম মাস আর নেই এবং মুনাফিকদের জন্য এর চেয়ে ক্ষতির মাসও আর নেই। মুসলমান এ মাসে (গোটা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সঞ্চয় করে।

আরো বলেছেন, এ মাস মুমিনের জন্য গনীমত এবং মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ। -মুসনাদে আহমদ ২/৩৩০; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/১৪০

সহীহ ইবনে খুযাইমাতেও এই হাদীস (হাদীস : ১৮৮৪) শব্দের সামান্য ব্যতিক্রমের সঙ্গে বিদ্যমান রয়েছে।

উপরোক্ত হাদীস থেকে বোঝা গেল যে, রমযানের খায়ের ও বরকত থেকে বঞ্চিত থাকা মুনাফিকীর দলীল।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নিফাক থেকে রক্ষা করুন এবং মুমিনের মতো এ মাসের ইস্তেকবালের তাওফীক দান করুন এবং মুমিনের মতোই এই মূল্যবান সময়কে কাজে লাগানোর তাওফীক নসীব করুন।

আল্লাহ তাআলা যেমন রমযানকে খায়ের ও বরকত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের মওসুম বানিয়েছেন তেমনি গোটা বছরের ঈমানী কুওয়ত হাসিলের কেন্দ্র বানিয়েছেন। এরই সঙ্গে আরো অনুগ্রহ এই করেছেন যে, এ মাসে সৃষ্টিজগতে এমন অনেক অবস্থা ও পরিবর্তনের সূচনা করেন যা গোটা পরিবেশকেই খায়ের ও বরকত দ্বারা ভরপুর করে দেয়। হাদীস শরীফে এসেছে যে, এ মাসে আল্লাহর হুকুমে জান্নাতের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের সকল দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বড় বড় জ্বিন ও শয়তানকে বন্দী করা হয় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে-

يَا بَاغِيَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَ يَا بَاغِيَ الشَّرِّ أَقْصِرْ

হে কল্যাণ-অন্বেষী, অগ্রসর হও, হে অকল্যাণের পথিক, থেমে যাও।

এসবের প্রভাবে রমযান মাসে চেতনে বা অবচেতনে ভালো কাজের দিকে আগ্রহ হতে থাকে। সৌভাগ্যশালী ওইসব ব্যক্তি, যারা এই আসমানী প্রেরণাকে মূল্য দেয় এবং হিম্মতের সঙ্গে কর্মের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ে।

আমরা যদি রমযানের ফাযাইল সম্পর্কে অবগত হই তবে বুঝতে পারব যে, রমযান হল তিজারতের মওসুম। কিন্তু কোথাকার তিজারত? রমযান হল আখিরাতের তিজারতের মওসুম। যে তিজারতের মাধ্যমে মানুষ আখিরাতের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে, যে তিজারতের লভ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতুন নায়ীন, যে তিজারতে সফল হওয়া ছাড়া দুনিয়ার সকল তিজারতই শুধু ব্যর্থতা ও ব্যর্থতা।

রমযানে দুনিয়াবী তিজারত নিষিদ্ধ নয়, তবে এমনভাবে তাতে মগ্ন হয়ে পড়া যেন এ মাস এই তিজারতেরই জন্য এসেছে-এটা এই নেয়ামতের না- শোকরী ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশেষত ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে রমযানের শেষ দশকে যে অবস্থা আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত হয় তা তো খুবই বেদনাদায়ক। ব্যবসায়ীগণ তাদের পণ্য বিক্রিতে মশগুল, আর অন্যরা শুধু পণ্য ক্রয়ে নয়, মার্কেট ও বিপনী বিতানগুলোর পরিদর্শন ও প্রদক্ষিণে মগ্ন, না ফরয নামাযের জামাতের ইহতিমাম, না তারাবীর জামাতে উপস্থিতি, না পূর্ণ তারাবী পড়ার তাওফীক। তিলাওয়াত, তাসবীহ, দুআ ও রোনাযারীর তো প্রশ্নই অবান্তর। এরপর নগ্নতা ও নারী-পুরুষের সহবিচরণসহ অন্যান্য হারাম কাজগুলো তো রয়েছেই, যেগুলো লানত ও অভিশম্পাত ডেকে আনে।

মনে রাখা উচিত যে, প্রকৃত পক্ষে রমযান হল, আখেরাতের তিজারতের মওসুম। এ মাসের সময়গুলো খুব বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করা উচিত। অন্তত ফরয রোযা এবং সুন্নতে মুয়াক্কাদা তারাবীর সঙ্গে সেহরীর সময় তাহাজ্জুদ, কিছু পরিমাণে হলেও যিকির ও তেলাওয়াত প্রত্যেকেরই করা উচিত। বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যে এতখানি মগ্ন হওয়া উচিত নয় যে, ফরয নামাযের জামাত  ও তারাবী ছুটে যায়। এছাড়া তিজারতে ধোকাবাজি ও প্রতারণা এবং সুদ ও জুয়াসহ অন্য সকল হারাম কার্যকলাপ থেকে তো সারা বছরই বেঁচে থাকা ফরয, রমযান মাসে এর অপরিহার্যতা আরও বেড়ে যায়। কেননা, বরকতপূর্ণ সময়ের গুনাহও অত্যন্ত কঠিন ও ধ্বংসাত্মক হয়ে থাকে।

এই ঢালকে অক্ষুন্ন রাখুন

হাদীস শরীফে এসেছে- الصِّيَامُ جُنَّةٌ অর্থাৎ রোযা হল ঢাল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৪

রোযা গুনাহ থেকে রক্ষাকারী ঢাল। রোযার মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া পয়দা হয়। ঈমানী লজ্জা জাগ্রত হয়, যা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার অনেক বড় উপায়। রোযা কবরে, হাশরে এবং আখিরাতের সকল মনযিলে বান্দার জন্য ঢাল। সবশেষে জাহান্নামের আগুন থেকেও রক্ষাকারী ঢাল।

তবে এগুলো তখনই হবে যখন রোযা শুধু আইনী রোযা না হয়ে প্রকৃত রোযা হবে। আইনী রোযা বলতে উদ্দেশ্য  হল সঠিক নিয়তের সঙ্গে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রীমিলন এবং ওইসব কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা যা ফিকহ ও ফতোয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে রোযাকে বিনষ্ট করে। কোনো সন্দেহ নেই যে, এটুকুদ্বারা রোযার অপরিহার্যতা থেকে দায়মুক্ত হওয়া যায়, কিন্তু এটুকুদ্বারা রোযা ঢাল হয় না। রোযা তখনই ঢাল হয় যখন ঈমান ও ইহতেসাবের সঙ্গে তা আদায় করা হয় এবং রোযার সকল আদব রক্ষা করা হয়।

রোযার আদবগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে এভাবে বলা যায় যে, রোযার হালতে রোযাদার আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ওইসব কাজ পরিত্যাগ করে যা তার জন্য অন্য মাসগুলোতে হালাল ছিল এবং রমযানের রাতেও যা তার জন্য হালাল। এ বিষয়গুলো শুধু এজন্য পরিত্যাগ করে যে, রোযার হালতে এই কাজগুলো থেকে বিরত থাকার আদেশ আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। তাহলে যে সব মন্দ কাজ সব সময়ের জন্য আল্লাহ তাআলা হারাম ও নিষিদ্ধ করেছেন যথা গীবত, শেকায়েত, মিথ্যা, প্রতারণা, সুদ, জুয়া, খিয়ানত, আত্মসাৎ, ঝগড়া-বিবাদ,  হারাম  পানাহার, নামায না পড়া, সিনেমা, টিভি, ভিসিআর দেখা ইত্যাদি পরিহার করা কি অপরিহার্য নয়? মোটকথা রোযার আদব এটাই যে, হারাম কাজ ও হারাম বিষয়াদি থেকে বিরত থাকবে এবং শুধু দুই অঙ্গ নয়, শরীরের সকল অঙ্গের রোযা রাখবে। মুখ, কান, চোখ এবং হাত-পা সকল অঙ্গকে গুনাহ থেকে পবিত্র রাখবে। যাতে ওই  হাদীসের  অন্তর্ভুক্ত না হতে হয় যা ওই দুই মহিলা সম্পর্কে বলা হয়েছে, যারা রোযার হালতে অন্যের গীবত করেছিল। হাদীসটি এই-

إِنَّ هَاتَيْنِ صَامَتَا عَمَّا أَحَلَّ اللهُ لَهُمَا وَأَفْطَرَتَا عَلى مَا حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِمَا

এরা দুজন ওই কাজগুলো থেকে তো বিরত থেকেছে যা আল্লাহ তাআলা (অন্য সময়) তাদের জন্য হালাল করেছেন, কিন্তু ওইসব কাজ থেকে বিরত থাকেনি যা আল্লাহ তাআলা (সবসময়ের জন্য) হারাম করেছেন। -মুসনাদে আহমদ ৫/৪৩১

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই ইরশাদ রোযাদারের সর্বদা স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, যে মিথ্যা, মূর্খতাসূলভ আচরণ ও গুনাহ পরিত্যাগ করে না তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। -সহীহ বুখারী হাদীস ১৯০৩; ইবনে মাজাহ হাদীস ১৬৮৯১; সুনানে কুবরা, নাসায়ী হাদীস ৩২৪৫-৩২৪৮

তদ্রূপ এই ইরশাদও-

রোযা শুধু   পানা- হার ত্যাগের নাম নয়; বরং অশ্লীল ও অর্থহীন কাজ থেকেও বেঁচে থাকা জরুরি। অতএব কেউ যদি রোযাদারের সঙ্গে ঝগড়া করতে থাকে কিংবা মূর্খসূলভ আচরণ করতে থাকে তখন এ কথা ভেবে নিজেকে নিবৃত্ত রাখবে যে, আমি রোযাদার, আমি রোযাদার। -সহীহ ইবনে খুযায়মা হাদীস ১৯৯৬; সহীহ ইবনে হিববান হাদীস ৩৪৭০

হাদীস শরীফের মূল আরবী পাঠ এই-

لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الأَكْلِ وَالشُّرْبِ، إِنَّمَا الصِّيَامُ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ، فَإِنْ سَابَّكَ أَحَدٌ أَوْ جَهَّلَكَ عَلَيْكَ فَقُلْ إِنِّيْ صَائِمٌ إِنِّيْ صَائِمٌ

মনে রাখা উচিত যে, রোযা দুনিয়া  ও আখেরাতে ঢাল তখনই হবে যখন তাকে অক্ষুণ্ণ রাখা হবে। যদি একে বিদীর্ণ করে ফেলা হয় তবে তো এর মাধ্যমে আত্মরক্ষার সুফল পাওয়া যাবে না। হাদীস শরীফে এসেছে- 

الصِّيَامٌ جُنَّةٌ مَا لَمْ يَخْرِقْهَا

রোযা ঢাল, যে পর্যন্ত না তাকে বিদীর্ণ করা হয়। -সুনানে নাসায়ী হাদীস .. সহীহ ইবনে খুযায়মা হাদীস ১৮৯২

জিজ্ঞাসা করা হল, কীভাবে রোযা বিদীর্ণ হয়ে যায়? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

بِكَذِبٍ أَوْ غِيْبَةٍ

মিথ্যা বললে কিংবা গীবত করলে। -তবরানী, আওসাত, হাদীস ৭৮১০

ঈদের স্বরূপ ও উদযাপনের পদ্ধতি

ঈদুল ফিতর-এর তাৎপর্য হল মাহে রমযান লাভ করা এবং রোযার তাওফীকপ্রাপ্ত হওয়ার উপর আনন্দ প্রকাশ করা। আর এই মহা নেয়ামতের উপর আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারী ও তার বড়ত্ব বয়ান করাই হল এই আনন্দের মূলকথা। আনন্দ প্রকাশের পদ্ধতি শরীয়ত এই নির্ধারণ করেছে যে, গোসল করে পাক-সাফ হয়ে যাও। বেজোড় সংখ্যক খেজুর খাও কিংবা কোনো মিষ্টিদ্রব্য খাও। সদাকায়ে ফিতর আদায় কর। নিজের কাছে বিদ্যমান কাপড়গুলোর মধ্যে সর্বোত্তম কাপড় পরিধান কর, যা অবশ্যই পরিষ্কার হতে হবে। এরপর তাকবীর বলতে বলতে ঈদগাহের দিকে যাও। ইমামের পিছনে নামায আদায় কর এবং খুতবা শ্রবণ কর। ফেরার সময় সম্ভব হলে ভিন্ন রাস্তা দিয়ে ফিরে আস। আসা-যাওয়ার সময় এবং ঈদগাহে যাদের সঙ্গে সাক্ষাত হয় তাদেরকে সালাম কর। কারো সঙ্গে নতুন সাক্ষাত হলে মুসাফাহাও কর। একে অন্যকে কবুলিয়াতের দুআ দাও। এই সময় সাহাবায়ে কেরাম এই দুআ করতেন-

تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكُمْ

-ফাতহুল বারী ২/৫১৭

ঈদ মোবারক বলে শুভকামনা প্রকাশ করা যদিও মুবাহ, কিন্তু তা একটি রসমের মতো হয়ে গিয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় যে, সালামের পরিবর্তে এই শব্দটাই ব্যবহার করা হয়। মোটকথা, এ সময়ের মাসনূন দুআ ওইটাই যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই হল ঈদুল ফিতরের দিন ঈদ উদযাপন করে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায়ের পন্থা। এর বাইরে যে সব প্রচলিত বিষয় রয়েছে, যদি সেগুলোতে কোনো না-জায়েয বিষয় ও অশ্লীলতা না থাকে, তবে তা মোবাহ পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। ওগুলো ঈদের মাসনূন আমল নয়। ওগুলোকে যদি মাসনূন মনে না করা হয় এবং এত গুরুত্ব না দেওয়া হয় যে, পরিত্যাগ করা দোষণীয়, তবে তাতে অসুবিধা নেই। অন্যথায় ওগুলো পরিত্যাজ্য বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। আর যেসব নাজায়েয ও অশ্লীল কার্যকলাপ সমাজে প্রচলিত রয়েছে সেগুলো সর্বাবস্থাতেই নাজায়েয, ঈদের বরকতময় দিবসে সেগুলোতে লিপ্ত হওয়া আরো মারাত্মক না-জায়েয বলে গণ্য হবে।

প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →