প্রবন্ধ
ইমাম আবু হানীফার সাথে তাঁর ছাত্রদের মতানৈক্যের কারণ
আমাদের দেশের যেসব ভাইয়েরা ফিকহে হানাফীকে পছন্দ করেন না তাদের একটা বড়ো অভিযোগ হলো, খোদ আবু হানীফা রাহ. এর ছাত্ররাই এক তৃতীয়াংশ মাসআলায় তাঁর সাথে মতোবিরোধ করেছেন। এর দ্বারা বুঝা যায় তাঁর কথা কতোটুকু গ্রহণযোগ্য হবে। যেখানে নিজের ছাত্ররাই তাকে মান্য করে না সেখানে অন্যদের তাকে মান্য করাটা কতোটুকু যৌক্তিক? এই বিষয়টিকে সামনে এনে তারা এটাও দাবী করার চেষ্টা করে অনেক সময় যে, আবু হানীফা রাহ. এর সিদ্ধান্তগুলো সহীহ হাদীস অনুযায়ী ছিলো না বিধায় তার ছাত্ররা তা পরিহার করে। মানে, তার ফিকহী সমাধানগুলো সহীহ হাদীস সম্মত ছিলো না।
এসব কথা যে কতোটা অন্তঃসারশূন্য তা তো আগে থেকেই জানা ছিলো। তবে তাঁর ছাত্ররা কেন বহু মাসআলায় তার সাথে মতানৈক্য করেছেন এই বিষয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে পড়লেও গোছালো কোন আলোচনা আগে নজরে পড়েনি। সম্প্রতি ‘মানাহিজুত তাশরীয়িল ইসলামী’ পড়তে গিয়ে একটা অধ্যায়ে এই বিষয়ে গোছালো আলোচনা পেলাম। লেখক এই জাতীয় মাসআলাগুলোকে পর্যলোচনা করে এর কারণ হিসেবে মোটাদাগে চারটা কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রতিটা কারণ বর্ণনা করে তার অধীনে অনেকগুলো উদাহরণও পেশ করেছেন। আমি সংক্ষেপে কারণ চারটি তুলে ধরছি।
এক. হাদীসের প্রামাণিকতা ও অধিক নির্ভরযোগ্যতায় মতোভিন্নতা।
দেখা গেলো একটা মাসআলায় দুইরকম হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তো একটা আবু হানীফার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য, অন্যটা তার কোন ছাত্রের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য। ফলে সিদ্ধান্ত দিতে গিয়ে দুজনের মধ্যে মতোপার্থক্য তৈরি হয়ে যায়। এর একটা দৃষ্টান্ত দেই।
আবু হানীফার মত হলো রুকু থেকে উঠার পর মুক্তাদির মতো ইমাম সাহেব ‘রব্বানা লাকাল হামদ’ বলবে না। তার দলীল হলো, হাদীসে এসেছ, ‘ইমাম যখন সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ বলবে তখন তোমরা (মুক্তাদিরা) বলো- রব্বানা লাকাল হামদ।’ তো এখানে উভয়ের কাজ ভাগ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে কে কোনটা বলবে।
কিন্তু তাঁর দুই ছাত্র আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ বলেন, ইমামও মুক্তাদির মতো রব্বানা লাকাল হামদ বলবে। তাদের দলীল হলো আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীস। সেখানে আছে, ‘যখন তিনি (নবীজি) রুকু থেকে মাথা তুলতেন তখন বলতেন সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ রব্বানা লাকাল হামদ।’
প্রথম হাদীসটি আবু হানীফার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য আর পরেরটি তাঁর ছাত্রদ্বয়ের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। প্রত্যেকে তাই যার যার সিদ্ধান্তানুযায়ী মত প্রকাশ করেছেন।
দুই. সামাজিক প্রচলনের ভিন্নতা।
আবু হানীফার মৃত্যুর পরও তাঁর ছাত্রদ্বয় বেশ অনেক বছর জীবিত ছিলেন। ফলে সময়ের পালাবদলে সামাজিক রীতিনীতিতে এমন অনেক পরিবর্তন এসেছিলো, যা আবু হানীফার জীবদ্দশায় ছিলো না। তো যেসব মাসআলার মূল ভিত্তি হলো সামাজিক প্রচলন সেসব মাসআলাতে সামাজিক রীতির পরিবর্তনের কারণে তাঁর ছাত্রদ্বয়ের সিদ্বান্ত আর তাঁর সিদ্ধান্তের অনুরূপ থাকে নি। বরং তাতে পরিবর্তন আসে এবং উভয়ের মত ভিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
যেমন: কেউ কসম করলো, ‘আমি মাথা খাবো না’ তাহলে আবু হানীফার মত হলো এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে, ছাগল ও গরুর মাথা। কারণ কুফার বাজারে এই দুই প্রাণীর মাথাই আলাদাকরে বিক্রি হতো এবং মানুষ মাথা খাবে না বলতে এই দুই জন্তুর মাথাই বুঝতো। সুতরাং কেউ যদি পাখি বা মাছের মাথা খায় তবে সে কসমভঙ্গকারী বলে গণ্য হবে না। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর ছাত্রদ্বয় আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ বলেন, শুধু ছাগলের মাথার ক্ষেত্রেই এটা ধর্তব্য হবে। অন্য কোন মাথা খেলে কসমভঙ্গকারী হবে না। এই যে মতের পার্থক্য, এটা ঘটেছে সময়ের পরিবর্তনে মানুষের অভ্যাস ও সামাজিক রীতি পরিবর্তনের কারণে।
তিন. সাহাবীদের থেকে বর্ণিত বিভিন্ন মতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে গিয়ে সৃষ্টি হওয়া মতোভিন্নতা।
চার. একই মাসআলায় বুদ্ধিবৃত্তিক দিকের বিবেচনায় দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থেকে সৃষ্ট মতোভিন্নতা।
তো এমন সব মাসআলাকে সামনে রাখলে দেখা যায় সহীহ হাদীস পাওয়ার কারণে ইমাম আবু হানীফার প্রদত্ত মত থেকে তাঁর ছাত্রদ্বয় সরে এসেছেন এমন উদাহরণ হাতেগোণা কয়েকটা। বরং অধিকাংশই অন্য কারণে ঘটেছে। কিন্তু এই একাধিক কারণের মধ্যে মাত্র ছোট একটা কারণকে মূল বানিয়ে ব্যাপারটিকে অনেক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়।
শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী রাহ. এর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ কিতাবে পড়েছিলাম, ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ ছিলেন ইমাম শাফেয়ীর পর্যায়ের মুজতাহিদ। তবে ইমাম শাফেয়ীর মতো তাদের মতামতগুলো আলাদা মাযহাব হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি কারণ হলো, ইমাম আবু হানীফার সাথে তাদের মতগুলো একই কিতাবে লিপিবদ্ধ হয়ে এসেছে শুরু থেকে। ফলে তাদের মতগুলোও ফিকহে হানাফির মত হিসেবে গন্য হয় এবং আলাদাকরে মুহাম্মাদী মাযহাব বা ইউসুফী মাযহাব নামে আলাদা কোন মাযহাব আর সৃষ্টি হয়নি।
অন্যথায় দেখুন, ইমাম শাফেয়ী ছিলেন ইমাম মালেকের ছাত্র। অথচ বহু বহু মাসআলায় তিনি স্বীয় উস্তাদ ইমাম মালেকের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। আবার ইমাম আহমাদ ছিলেন ইমাম শাফেয়ীর ছাত্র। তিনিও তার উস্তাদ ইমাম শাফেয়ীর সাথে বহু মাসআলায় দ্বিমত পোষণ করেছেন। এসব দ্বিমতের উপর ভিত্তি করে শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাব সৃষ্টি হয়। এখন আপন উস্তাদের সাথে মতোভিন্নতা তৈরি হওয়া যদি কেবল তার সিদ্ধান্তসমূহ হাদীসবিরোধী ছিলো বলে ধরা হয় তবে ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়ীর ব্যাপারে কী বলা হবে?
দেখবেন যারা ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর ছাত্রদ্বয়ের মধ্যকার মতোপার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেন তারা উস্তাদ ইমাম মালেক ও তাঁর ছাত্র ইমাম শাফেয়ীর মধ্যকার মতোপার্থক্য এবং উস্তাদ ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর ছাত্র ইমাম আহমাদের মধ্যকার মতোপার্থক্যের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যায়। অথচ ব্যাপারটি এখানে হুবহু একই রকম। যে অভিযোগ তারা আবু হানীফার বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চান, হুবহু অভিযোগটি তো বাকি তিন ইমামের উপরও প্রযোজ্য হয়। সুতরাং বিবেচনা করা উচিত, মাসআলা নিয়ে উস্তাদের সাথে ছাত্রের মতানৈক্য অভিযোগ হিসেবে উপস্থাপিত হওয়ার যোগ্য কিনা।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
সাহাবায়ে কিরামের ভ্রাতৃত্ব, মতভেদ ও আদর্শিক আচরণ: একটি শিক্ষনীয় চিত্র
নবী করীম ﷺ গভীরভাবে এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতেন যে, উম্মতের টিকে থাকা ও অগ্রগতির একমাত্র উপায় হলো—পারস্...
ইয়াহুদী-খ্রিস্টানদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র মুসলিম উম্মাহর করণীয়
কুরআন-হাদীসে ইয়াহুদী-খ্রিস্টানের পরিচয় ইয়াহুদী জাতি পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতি। আল্লাহ তা'আলা হযরত নূহ আ...