প্রবন্ধ
সাহাবায়ে কিরামের ভ্রাতৃত্ব, মতভেদ ও আদর্শিক আচরণ: একটি শিক্ষনীয় চিত্র
যাঁরা নবুওতের মহান শিক্ষাগারে শিক্ষা লাভ করেছিলেন সেই সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন:
বিভেদের মাধ্যমে কখনো কল্যাণ ও সৌভাগ্য লাভ করা যায় না। বরং মতানৈক্য জন্ম দেয় হিংসা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা, শত্রুতা এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ কাতারে বিভক্তি।
রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর প্রশিক্ষণের ফসল ছিলো,
সাহাবায়ে কিরামের জীবনে কয়েকটি সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য, বিশেষত মতভেদের ক্ষেত্রেও, নিচে তা উপস্থাপন করা হলো:
১) মতভেদ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন।
তাঁদের স্মরণে থাকত নবী করীম ﷺ -এর নির্দেশ:
"لا تختلفوا فتختلف قلوبكم"
“তোমরা মতভেদে জড়িও না, এতে তোমাদের হৃদয়ে ফাটল দেখা দেবে।”
(সহীহ মুসলিম)
২) যখন মতানৈক্য হতো, তখন তারা কুরআন ও সুন্নাহ-র দিকে ফিরে যেতেন।
কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন:
"فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ"
"তোমরা যদি কোনো বিষয়ে মতানৈক্যে পতিত হও, তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের নিকট ফিরিয়ে দাও।”
(সূরা নিসা: ৫৯)
৩) নিজস্ব মতকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দিতেন না।
প্রত্যেক সাহাবী নিজ নিজ মত প্রকাশ করলেও এ সচেতনতা বজায় রাখতেন যে, হয়তো তাঁর ভাইয়ের মতটিও সঠিক হতে পারে। এই মনোভাবের ফলেই তারা একে অপরকে সম্মান করতেন এবং গোষ্ঠীগত পক্ষপাত ও দ্বেষ হতে মুক্ত থাকতেন।
৪) ‘নফসানিয়াত’ বা ব্যক্তিগত খেয়াল-খুশি যাকে কুরআনে ‘هوي' বলা হয়েছে তা থেকে বেঁচে থাকতেন।
তাঁরা সর্বদা তাকওয়ার পথ অবলম্বন করতেন, যাতে মতভেদের মধ্যেও মূল লক্ষ্য থাকে সত্যের সন্ধান ও আল্লাহর সন্তুষ্টি, ব্যক্তিগত জয় নয়।
৫) তাদের বৈশিষ্ট্য ছিল: ‘নম্র ভাষা ও দৃঢ় অনুসন্ধান’।
তারা কখনো আক্রমণাত্মক, গালমন্দপূর্ণ বা বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতেন না। পরিশীলিত ভাষায়, নম্রভাবে মত প্রকাশ করতেন।
এগুলোই ছিল সাহাবায়ে কিরামের জীবনের মৌলনীতি—বিশেষত মতভেদ ও ভিন্ন মতের ক্ষেত্রে। এর বাস্তব উদাহরণ কিছুক্ষণের মধ্যেই তুলে ধরা হবে।
একটি ভ্রান্ত ধারণার প্রতিবাদ:
কিছু মুসলিম চিন্তাবিদ ও লেখকের লেখায় এমন বিভ্রান্তিকর ধারণা পাওয়া যায়—যা অনেক মুসলমানকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করেছে যে, এখন আর তেমন কোনো আদর্শিক উম্মত সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়।
এই চিন্তা ইসলামের প্রতি স্পষ্ট বিদ্বেষপূর্ণ সন্দেহ।
এতে যেন বলা হচ্ছে—সাহাবায়ে কিরামের যুগের পর কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামি জীবন গঠনের আর কোনো পথ খোলা নেই।
এমন বিশ্বাস একেবারে ভুল ও বাতিল।
কারণ,
যে কুরআন এবং যে সুন্নাহ সাহাবিদের একটি শ্রেষ্ঠ আদর্শ সমাজে রূপান্তর করেছিল, সেই কুরআন ও সুন্নাহ আজও অবিকৃত অবস্থায় আমাদের মাঝে রয়েছে।
সেগুলোর মাঝে আজও সেই একই প্রভাব, শক্তি ও আলো রয়েছে—যদি আমরা সাহাবায়ে কিরামের মতো তা অনুসরণ করি।
সর্বোচ্চ যা হারাতে পারি তা হলো—‘শরাফে সাহাবিয়্যাত’ (সাহাবি হওয়ার মর্যাদা)।
কিন্তু তাদের অর্জিত অন্যান্য সৌভাগ্য ও গুণাবলি—সেগুলো আজও অর্জন করা সম্ভব।
সাহাবিদের মধ্যে কিছু বাস্তব মতভেদের দৃষ্টান্ত:
প্রথম মতভেদ: রাসূল ﷺ -এর ইন্তেকালের সময়
রাসূল ﷺ -এর ইন্তেকালের পর সবচেয়ে প্রথম ও কঠিন মতানৈক্য দেখা দেয়।
সাহাবীদের হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল।
বিশেষ করে হযরত উমর (রাঃ) এর মতো দূরদর্শী ও দৃঢ়চেতা সাহাবীও এই সংবাদ মানতে পারছিলেন না।
তিনি তলোয়ার হাতে নিয়ে মদিনার রাস্তায় রাস্তায় বলছিলেন:
“যে বলবে রাসূল ﷺ ইন্তেকাল করেছেন, আমি তার মাথা কেটে ফেলব।”
এই অবস্থা দূর হয় তখন যখন আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রিয় সঙ্গী, সকলের শান্তি ও যুক্তির আশ্রয়, উঠে দাঁড়িয়ে কুরআনের দুটি আয়াত পাঠ করেন:
"إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ" (সূরা আল-জুমার: ৩০)
"وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ ... " (সূরা আলে ইমরান: ১৪৪)
এই আয়াতসমূহ শোনামাত্র উমর (রাঃ) বলেন:
“আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন এই আয়াত আজই প্রথম শুনলাম।”
তৎক্ষণাৎ তাঁর হাত থেকে তলোয়ার পড়ে যায়, ও তিনি ইন্তেকালের বাস্তবতা মেনে নেন।
(তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৪/৬৯, সীরাতে ইবনে হিশাম: ৪/৫৫)
এরপরের মতভেদ: খিলাফতের প্রশ্ন। রাসূল ﷺ -এর ইন্তেকালের পরপরই সাহাবীগণের মধ্যে খিলাফতের প্রশ্নে আলোচনা শুরু হয়। কেউ অগ্রাধিকার দেন মুহাজিরদের, কেউ আনসারদের। কিন্তু এসব মতানৈক্য অল্প সময়ের মধ্যেই সম্মানজনক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়ে যায়, এবং হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে সর্বসম্মতিক্রমে খলিফা নিযুক্ত করা হয়।
পরবর্তী ইখতিলাফ: যারা যাকাত দিতে অস্বীকার করে—তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
হযরত আবু বকর (রাঃ) মত দেন—তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে। হযরত উমর (রাঃ) প্রথমে দ্বিমত করেন, কিন্তু পরে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তিনি সম্মত হন।
এখানেও কোনো ‘তাহকির’ (অপমান), ‘তাকফির’ (অবিশ্বাসী বলা), এমনকি শত্রুতা পর্যন্ত হয়নি। বরং যুক্তি, কুরআন ও সৌজন্যের মাধ্যমে মতানৈক্য নিরসন হয়েছে।
আজ আমাদের মধ্যে কারো আচরণ পছন্দ না-ও হতে পারে। মতভেদ, মনমালিন্য বা দূরত্ব হতে পারে। কিন্তু ইসলামের আলোয়, সাহাবায়ে কিরামের উদাহরণে আমরা শিখি,
মতভেদ থাকলেও সম্মান বজায় রাখা, সম্পর্ক ছিন্ন না করা এবং সত্যের উপর দৃঢ় থাকা—এটাই ইসলামের পথ।
উল্লেখিত মতপার্থক্যের পাশাপাশি আরও বহু ফিকহি (ইসলামী আইনসংক্রান্ত) মতভেদের অধ্যয়ন থেকে এমন ঈর্ষণীয় ও বিস্ময়কর ভালোবাসার উদাহরণ সামনে আসে, যা আমাদের দেখায় তাঁরা একে অপরের প্রতি কীভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতেন।
উদাহরণস্বরূপ, মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) বন্দিনী নারীদের বিষয়ে হযরত আবু বকর ও হযরত উমর (র.) এর মধ্যে কঠোর মতপার্থক্য ছিল। এমনকি, হযরত উমর (র.) তাঁর খেলাফতের সময় নিজের মত অনুযায়ী কার্যকরও করেছিলেন। এই নারীদের ব্যাপারে হযরত উমরের মত ছিল তাঁদের মুক্ত করে তাঁদের স্বামীদের কাছে হস্তান্তর করা উচিত, কিন্তু হযরত আবু বকরের কাছে এ কৌশল যথাযথ ছিল না।
এছাড়াও, বিজিত ভূখণ্ডের মালিকানা নিয়েও উভয়ের মধ্যে ভিন্নমত ছিল। হযরত আবু বকর (র.) এগুলোকে ভাগ করে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন, আর হযরত উমর (র.) চেয়েছিলেন এই জমিগুলোকে ওয়াকফ (জনকল্যাণমূলক সম্পত্তি) ঘোষণা করে দেওয়া হোক।
অনুদান বণ্টনের ক্ষেত্রেও উভয়ের মধ্যে মতানৈক্য ছিল। হযরত আবু বকর (র.) সমতা-ভিত্তিক বণ্টনের পক্ষে ছিলেন, আর হযরত উমর (র.) পার্থক্য ও প্রাধান্য ভিত্তিক বণ্টনের পক্ষপাতী ছিলেন। তাই তিনি নিজের খেলাফতের সময় যোগ্যতার ভিত্তিতে অনুদান বণ্টন করেছিলেন।
হযরত আবু বকর (র.) তাঁর পরবর্তী খেলিফা হিসেবে হযরত উমর (র.) কে মনোনীত করেছিলেন, অথচ হযরত উমরের মতে এভাবে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া সঠিক ছিল না। এজন্যই তিনি (উমর) কাউকে সরাসরি মনোনীত করেননি।
এই মতপার্থক্যের বাইরে আরও বহু বিষয়ে তাঁদের মাঝে মতভেদ ছিল। তবুও তাঁদের পারস্পরিক ভালোবাসা ও আকিদাহ এত দৃঢ় ছিল, যে কেউ যখন হযরত আবু বকর (র.)-কে বলল, “আপনি আমাদের উপর উমরের মতো কঠোর ব্যক্তিকে খলিফা মনোনীত করছেন! কাল কেয়ামতের দিন আল্লাহ আপনাকে যদি এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তখন আপনি কী বলবেন?” তখন হযরত আবু বকর বললেন:
"أقول: اللهم إني استخلفت عليهم خير أهلك"
“আমি বলব, হে আল্লাহ! আমি আপনার বান্দাদের উপর আপনার সবচেয়ে উত্তম বান্দাকে খেলিফা নিযুক্ত করে এসেছি।”
একবার কেউ হযরত উমর (র.)-কে বলল, “আপনি হযরত আবু বকর (رضی الله عنه)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ।” তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং বললেন:
"والله لليلة من أبي بكر خير من عمر وآل عمر"
“আল্লাহর কসম! আবু বকরের একটি রাত, উমর এবং উমরের গোটা বংশের গোটা জীবনের চেয়ে উত্তম।”
উম্মতের এই দুই মহামানব শাইখাইন (আবু বকর ও উমর (র.) এর মধ্যে যেসব মতপার্থক্য ছিল, তা আমাদের এ শিক্ষা দেয় যে, মতভেদ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু হৃদয়গুলো ছিল একত্রিত, কারণ এই হৃদয়গুলো আসমানী রজ্জুর (আল্লাহর হুকুম ও হিদায়াতের) সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, তাই দুনিয়ার মাটির কোনো প্রভাব তাতে পড়েনি।
যেমন শাইখাইন (হযরত আবু বকর ও হযরত উমর (র.)-এর মধ্যে কিছু বিষয়ে মতভেদ ছিল, তেমনি হযরত উমর (رضی الله عنه) ও হযরত আলী (رضی الله عنه)-এর মাঝেও কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু এই মতপার্থক্য কখনো শত্রুতায় পরিণত হয়নি।
একবারের ঘটনা এক নারীর ঘরে অন্য পুরুষদের যাতায়াত ছিল, অথচ তার স্বামী ঘরে উপস্থিত ছিল না। এই পরিস্থিতিতে হযরত উমর (رضی الله عنه) এ ব্যাপারে বাঁধা দিলেন এবং ঐ নারীকে ডেকে পাঠালেন। যখন বার্তাবাহক (দূত) তাকে এই সংবাদ দিল, সে ভয় পেয়ে দারুল খিলাফার দিকে রওয়ানা হলো। পথে যেতে যেতে তার প্রসব বেদনা শুরু হলো, ফলে সে একটি বাড়িতে আশ্রয় নিল এবং সেখানে একটি মৃত সন্তান প্রসব করল।
এ ঘটনার পর হযরত উমর (رضی الله عنه) সাহাবায়ে কিরামদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন যে, এই ঘটনার দায়ভার কার ওপর বর্তায়? কেউ কেউ মত দিলেন: “আপনার উপর এর কোনো দায়িত্ব বর্তায় না, কারণ সমাজে শৃঙ্খলা ও সংশোধনের দায়িত্ব আপনার উপরই ন্যস্ত।”
এই আলোচনায় তখন পর্যন্ত হযরত আলী (رضی الله عنه) কিছু বলেননি। তখন হযরত উমর (رضی الله عنه) তাকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেন: “তোমার মত কী?” হযরত আলী (رضی الله عنه) বললেন: “যদি এই লোকেরা নিজেদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করে থাকে, তবে এই মত আমার দৃষ্টিতে সঠিক নয়। আর যদি কেবল আপনাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে এমন করে থাকে, তবে তারা আপনার প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী নয়। আমার মত হচ্ছে: আপনার উপর সেই সন্তানের 'দিয়াত' (রক্তপণ) আবশ্যক, কারণ আপনার হুকুম ও তৎপরতার কারণেই সেই শিশুর মৃত্যু হয়েছে।” এই কথায় খলিফা হযরত উমর (رضی الله عنه) সন্তুষ্ট হলেন এবং এই মত অনুযায়ীই আমল করলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (র.) সেই মহান সাহাবী ছিলেন, যাঁর রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাহচর্যে কুরআনুল কারিম ও সুন্নাহর গভীর জ্ঞান অর্জনের সৌভাগ্য হয়েছিল এবং স্বয়ং রাসূল ﷺ-এর মুখনিঃসৃত ভাষায় তিনি ফিকহ ও অন্তর্দৃষ্টি (তাফাক্কুহ) অর্জনের স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। সাহাবায়ে কিরামের দৃষ্টিতে তিনি আহলে কিতাবুল্লাহ তথা কুরআনের অন্যতম বড় আলেম হিসেবে গণ্য হতেন এবং অধিকাংশ সাহাবী তাঁকে আহলে বাইত তথা রাসূল ﷺ-এর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাঁর এবং হযরত উমর (رضی الله عنه)-এর মধ্যে বহু বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.)-এর মতে, এমন বিষয় একশটিরও অধিক, যেখানে এই দুই মহান সাহাবীর মধ্যে ভিন্নমত ছিল (ইলামুল মুআক্কিইন’, ২/২১৮)।
উদাহরণস্বরূপ:
১- নামাযের রুকুতে হযরত ইবনে মাসউদ (رضی الله عنه) নিজের দুই হাত হাঁটুর মাঝখানে রাখতেন, এবং হাঁটুর উপর রাখাকে নিরুৎসাহিত করতেন। বিপরীতে, হযরত উমর (رضی الله عنه) রুকুর সময় হাত হাঁটুর উপর রাখতেন এবং হাঁটুর মাঝখানে হাত রাখা থেকে নিষেধ করতেন।
২- কেউ যদি তার স্ত্রীকে বলে: “أنت عليّ حرام” (তুমি আমার জন্য হারাম),
হযরত ইবনে মাসউদের দৃষ্টিতে এটি শুধু একটি কসম (শপথ),
অথচ হযরত উমরের মতে এটি তালাক গণ্য হতো।
৩-কোনো পুরুষ কোনো নারীর সঙ্গে জেনার সম্পর্ক স্থাপনের পর তাকে বিবাহ করলে,
হযরত ইবনে মাসউদ (رضی الله عنه)-এর মতে, তারা এখনও জেনার অবস্থাতেই আছে,
অথচ হযরত উমর (رضی الله عنه) প্রথম অবস্থাকে ব্যভিচার এবং পরবর্তী অবস্থাকে বৈধ বিবাহ হিসেবে গণ্য করতেন।
এত অধিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাঁদের মাঝে ভালোবাসা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বিন্দুমাত্র কমে যায়নি।
হযরত ইবনে মাসউদের দৃষ্টিতে হযরত উমরের মর্যাদায় এতটুকুও হ্রাস আসেনি, এবং হযরত উমরও ইবনে মাসউদের উপর কখনো নিজের জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির প্রভাব খাটাননি।
বরং হযরত ইবনে মাসউদ (رضی الله عنه) হযরত উমরকে ইসলামি দুর্গ (হিসনে হাসীন) মনে করতেন এবং বলতেন:
“উনার (উমরের) চলে যাওয়ার মাধ্যমে ইসলামের একটি দৃঢ় দূর্গ ধ্বংস হয়ে গেল।”
(আল-আহকাম ৬/৬১)
হযরত উমরের পক্ষ থেকেও ইবনে মাসউদের প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়
একদিন যখন তিনি (ইবনে মাসউদ) তাঁর সামনে আসলেন, হযরত উমর বললেন:
“জ্ঞান ও ফিকহের এক বিশাল ভান্ডার চলে আসছে।”
(তাবকাত ইবনে সা’দ ৪/১৬১, হায়াতুস সাহাবা ৩/২৫৭/২১)
এই জ্যোতির্ময় প্রদীপসম সাহাবীদের জীবন থেকে পরবর্তী যুগের আলেমদের উচিত নিজ হৃদয়ের গহীনে আলো জ্বালানো।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ)— উভয়েই সাহাবায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠগণ (আকাবির)-এর অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ব্যাখ্যার মুখাপেক্ষী নয়।
এই দুই মহান সাহাবী ফিকহি (ইসলামী আইনসংক্রান্ত) অনেক বিষয়ে পারস্পরিক মতবিরোধে উপনীত হয়েছেন।
যেমন, ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতে:
যখন দাদা জীবিত থাকেন, তখন ভাই-বোনেরা এমনভাবে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হন, যেমনভাবে পিতা জীবিত থাকলে বঞ্চিত হন।
অন্যদিকে, যায়েদ (রাঃ)-এর মতে:
দাদার উপস্থিতিতে ভাই-বোনেরা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না।
ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিজের মতের ওপর এতটাই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তিনি একবার বলেছিলেন:
“আমি চাই, এই উত্তরাধিকারের বিষয়ে যারা আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে, তারা এবং আমি একত্রিত হই, তারপর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, কান্নাকাটি করি, এবং বলি যে মিথ্যা বলছে, আল্লাহ তার ওপর অভিশাপ বর্ষণ করুন।”(আদাবুল ইখতিলাফ ফীল ইসলাম, পৃ: ৬৭)
সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও তাঁদের পারস্পরিক ব্যবহার ও চারিত্রিক সৌন্দর্য কেমন ছিল, তা উপলব্ধির জন্য নিম্নোক্ত ঘটনা লক্ষ করুন:
একবার হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) দেখলেন, যায়েদ (রাঃ) উটে চড়ে আসছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে উটের পাদানিতে (পা রাখার জায়গা) হাত রাখলেন এবং তা ধরে হাঁটতে লাগলেন।
যায়েদ (রাঃ) অবাক হয়ে বললেন:
“হে আল্লাহর রাসূল ﷺ-এর চাচাতো ভাই! এটি ছেড়ে দিন!”
ইবনে আব্বাস (রাঃ) উত্তরে বললেন:
“আমাদের আলেমদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এটাই আদেশ ও নির্দেশ।”
এরপর যায়েদ (রাঃ) বললেন:
“তাহলে আপনার হাত দিন।”
ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন। যায়েদ (রাঃ) তা চুম্বন করে বললেন:
“আমাদেরকে আহলে বাইতের (নবীর পরিবারের) সঙ্গে এভাবেই আচরণ করতে বলা হয়েছে।” (হায়াতুস সাহাবা: ৩/৩১)
হযরত জায়েদ বিন সাবিত (رضي الله عنه)-এর ইন্তিকালের সময়, হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) অত্যন্ত অশ্রুসজল হয়ে বলেছিলেন:
“জ্ঞান এভাবেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।”
(ই’লামুল মুআক্কিইন, ১/৮১)
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি বলেছিলেন:
“আজ জ্ঞানের একটি বিশাল অংশ মাটির নিচে দাফন হয়ে গেল।”
(সুনান বাইহাকি, ৬/২১১; হায়াতুস সাহাবা, ৩/২৬৭)
সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে মতভেদ ও রায়ভিত্তিক পার্থক্য এত বিস্তৃত যে, তা যদি একত্র করে লিপিবদ্ধ করা হয়, তাহলে বহু খণ্ড বইও তার জন্য অপর্যাপ্ত হয়ে যাবে।
তবে এখানে কয়েকটি উদাহরণ কেবল এ উদ্দেশ্যে পেশ করা হয়েছে যেন উম্মত বুঝতে পারে, যে কুরআন ও সুন্নাহর তত্ত্বাবধানে সাহাবায়ে কিরাম গড়ে উঠেছিলেন সেই ঘরানায় ভিন্নমতের সৌন্দর্য ও শিষ্টাচার এতই পূর্ণ ছিল যে, তর্ক বা মতানৈক্য কখনোই শালীনতার সীমা অতিক্রম করতো না।
খিলাফতে রাশেদার শেষাংশে যেসব যুদ্ধ বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে তা যত জটিল ও কষ্টদায়ক হোক না কেন, সেই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতেও ঈমানি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন কখনো দুর্বল হয়নি।
এর এক উজ্জ্বল উদাহরণ হল,
হযরত আলী (رضي الله عنه) সম্পর্কে মারওয়ান ইবনে হাকাম-এর মন্তব্য, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন:
“আমি আলী (رضي الله عنه)-এর চেয়ে অধিক মর্যাদাবান (করিম) মানুষ আর দেখিনি। এমনকি জঙ্গে-জামাল-এর দিনেও, যখন তিনি আমাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তখনও তিনি আমাদের অভিভাবকই ছিলেন। তাঁর ঘোষক ঘোষণা দিচ্ছিলেন: ‘কোনো আহতকে হত্যা করা যাবে না।’”
অথচ ইতিহাসে সামান্য ধারণা রাখে এমন প্রত্যেক ছাত্রও জানে যে, জামাল যুদ্ধের ময়দানে হযরত আলী ও মারওয়ান পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।
জঙ্গে-জামাল (উহুদের পরে সংঘটিত সাহাবিদের মধ্যে একটি বড় লড়াই) শেষে ইমরান ইবন তলহা (রহঃ) হযরত আলী (রাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন।
হযরত আলী (রাঃ) তাঁকে স্বাগত জানালেন, নিজের পাশে বসালেন এবং বললেন:
“আমার আশা, আমি এবং তোমার পিতা (তলহা রাঃ) সেই সব লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবো, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন—
﴿وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِم مِّنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَىٰ سُرُرٍ مُّتَقَابِلِينَ﴾
অর্থাৎ: ‘আমি তাদের অন্তর থেকে হিংসা ও বিদ্বেষ দূর করে দেবো, এবং তারা ভাই-ভাই হয়ে সম্মানিত আসনে একে অপরের মুখোমুখি বসে থাকবে।’”(সূরা হিজর, আয়াত ৪৭)
এরপর হযরত আলী (রাঃ) ইমরান ইবন তলহা-কে তাঁদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের নাম ধরে ধরে খোঁজ-খবর নিতে লাগলেন।
এসময় মজলিসে এমন কিছু লোক উপস্থিত ছিলেন যারা সাহাবা (রাঃ)-এর মর্যাদা ও শান সম্পর্কে তেমন অবগত ছিলেন না— তাঁদের আশ্চর্য লাগল।
তাঁদের মধ্য থেকে দুই ব্যক্তি বলে উঠল:
“আপনারা তো গতকাল একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন, আর এখন বলছেন জান্নাতে ভাই ভাই হয়ে একত্রিত হবেন?”
এ কথা শুনে হযরত আলী (রাঃ) রাগান্বিত হয়ে বললেন:
“আমি আর তলহা (রাঃ) যদি জান্নাতে একত্রিত না হই, তাহলে আর কে হবে?!”
হায়াতুস সাহাবা: ও তাবকাতে ইবনে সাআদ: ৩/২২৪
জঙ্গে-জামালে বিরোধী পক্ষ সম্পর্কে কেউ সাইয়্যেদ মুর্তাজা (রহ.)-কে প্রশ্ন করলো:
“এরা কি মুশরিক?”
তিনি বললেন:
“من الشرك فروا”
অর্থাৎ, “তারা তো শিরক থেকে পালিয়ে এসেছে!”
আবার প্রশ্ন হলো: “তবে কি তারা মুনাফিক?”
উত্তরে বললেন:
“মুনাফিকরা তো আল্লাহর যিকির করে না।”
আবার জিজ্ঞাসা করা হলো: “তাহলে এরা আসলে কারা?”
উত্তরে বললেন:
“এরা আমাদের ভাই, যারা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।” (সূত্র: সুনান বায়হাকী ৮/১৭৩)
আবূ ইয়াসিরের পুত্র আম্মার (রাঃ), যিনি জঙ্গে-জামালে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা সিদ্দিকা (রাঃ)-এর মতের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁর সামনে কেউ যখন উম্মুল মু’মিনীন (রাঃ) সম্পর্কে কিছু কটু কথা বলল, তখন তিনি তিরস্কার করে বললেন:
“তুমি কি আল্লাহর রাসূল ﷺ-এর প্রিয় স্ত্রীকে কষ্ট দিচ্ছো?
তিনি তো জান্নাতে তাঁর ﷺ-এর স্ত্রী হবেন।
আল্লাহ আমাদের তাঁর মাধ্যমে পরীক্ষা করেছেন
আমরা তাঁর কথা মানি, না আল্লাহর।”
(কানজুল উম্মাল ৭/১৬৬; হায়াতুস সাহাবা ২/৪৬২)
এগুলি সেইসব সাহাবায়ে কিরামের অনন্য উদাহরণ, যাদের মধ্যে আল্লাহর ইচ্ছায় যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল,তবু নবুয়তের আলো তাঁদের অন্তরকে এমনভাবে আলোকিত করেছিল যে
• হিংসা ও বিদ্বেষের আঁধার সেখানে স্থান পায়নি,
• মতভেদ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা একে অপরের ভ্রাতা ছিলেন,
• এবং তাঁরা ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সর্বোচ্চ আদর্শ স্থাপন করেছেন।
فالحمد لله علی ذلک আল্লাহরই জন্য সমস্ত
প্রশংসা।
সাহাবায়ে কিরামের আচরণ থেকে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয় তা হলো:
(ক)
তাঁদের মতবিরোধ কখনো ব্যক্তিগত কামনা বা ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে ছিল না, বরং সত্য ও সঠিক পথের অনুসন্ধানের জন্য ছিল।
তাই যখনই সত্য স্পষ্ট হয়ে যেত,
তারা দেরি না করে তা গ্রহণ করতেন,
এবং তাতে নিজেদের অপমানিত মনে করতেন না।
(খ)
সব ভিন্নমতের মধ্যেও তাঁরা ইসলামি ভ্রাতৃত্বকে
ইসলামের মূল ভিত্তি বলে মনে করতেন।
তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল:
ভ্রাতৃত্ব ছাড়া ইসলামের স্থাপনাই সম্ভব নয়।
আর এই ভ্রাতৃত্ব, সব ধরনের মতপার্থক্যের উর্ধ্বে।
(গ)
কোনো সাহাবি যদি অপর সাহাবির কোনো ভুল ধরিয়ে দিতেন,
তাহলে তা সমালোচনা বা দোষারোপ নয়, বরং
“الدين النصيحة” — ‘দ্বীন হল উপদেশ’ এই নীতির আলোকে করতেন।
অন্যজন তা উপদেশ মনে করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করতেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন।
জমিরুল হাসান খান।
ভাষান্তর: শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
হাদীসের হাফেজগণও ফকীহগণের মুখাপেক্ষী ছিলেন
...
প্রসঙ্গ ইলমে দ্বীন; দ্বীনী প্রতিষ্ঠান কেন টিকিয়ে রাখা জরুরী?
...
ইমাম আবু হানীফার সাথে তাঁর ছাত্রদের মতানৈক্যের কারণ
আমাদের দেশের যেসব ভাইয়েরা ফিকহে হানাফীকে পছন্দ করেন না তাদের একটা বড়ো অভিযোগ হলো, খোদ আবু হানীফা রাহ...