প্রবন্ধ
নির্বাচিত উক্তি
লেখক:আরিফ আজাদ
২৯ জানুয়ারী, ২০২২
২৯৫৯ বার দেখা হয়েছে
০ মন্তব্য
১-
'গুনাহ করার পর যদি আপনি ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হোন, অনুতপ্ত হোন, অনুশোচনায় যদি কাতর হয়ে উঠে আপনার তনুমন, তাহলে জানুন— আপনার অন্তরের কোথাও এখনও জিইয়ে আছে একটুকরো সবুজ। সেই সবুজকে বাড়তে দিলে তা একদিন ঘন অরণ্যে পরিণত হবে। তাতে যদি পানি দেওয়া হয়, পরিচর্যা করা হয়, সেই সবুজের অরণ্যে মহীরুহের মেলা বসবে একদিন।
কোন গুনাহের পরে 'আল্লাহর সামনে কিভাবে দাঁড়াবো' এই ভয়ে যদি প্রকম্পিত হয় অন্তর, তাহলে নিশ্চিত হোন— আপনার হৃদয়ের কোথাও এখনও মিটিমিটি করে জ্বলছে একটুকরো আলো। আলোটাকে নিভতে না দিয়ে যদি আরো ভালোভাবে জ্বলে উঠার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে অন্ধকার হৃদয় একদিন আলো ঝলমলে এক উঠোনে পরিণত হবে।
গুনাহের পরও আল্লাহ আপনাকে সুযোগ দেন। অনুতপ্ত হবার সুযোগ, অনুশোচনা করার সুযোগ। সুযোগগুলো লুফে নিন। কখনো হেলায় হারাবেন না।'
২-
(১)
মাদইয়ানে মুসা আলাইহিস সালামের সাথে দুজন রমনীর সাক্ষাতের ঘটনাটা আমাদের প্রায় সকলেরই জানা।
একটা কূপ থেকে নিজেদের বকরীকে পানি খাওয়াতে এসেছিলো তারা। কূপের কাছে এসে দেখলো— অনেকগুলো পুরুষ মানুষ কূপ থেকে পানি উঠাচ্ছে নিজ নিজ প্রয়োজনে। যেহেতু কূপের কাছে অনেকগুলো পুরুষ মানুষের আনাগোনা, তাই রমনীদ্বয় তখন কূপের কাছে না গিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাটাকেই শ্রেয় মনে করলো। পুরুষেরা চলে গেলেই কূপের কাছে যাবে— এমনটাই স্থির করলো তারা।
কিন্তু সময় গড়ায় ঠিকই, পুরুষদের উপস্থিতি কমে না। রমনীদ্বয়ও ঠাঁই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
ব্যাপারটা চোখে লাগলো মুসা আলাইহিস সালামের। পুরুষদের আনাগোনার কারণে মেয়ে দুটো যে কূপের কাছে আসছে না সেটা তিনি বুঝতে পারলেন। আবার— তারা যে বেশ অনেকটুকু সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে, সেটাও বুঝতে বাকি থাকলো না৷ এমতাবস্থায় তাহলে কী করা যায়?
মুসা আলাইহিস সালাম স্থির করলেন— রমনীদ্বয়ের বকরীগুলোকে বরং তিনিই পানি খাইয়ে আনবেন। এতে করে তাদেরকে পুরুষদের মাঝেও আর আসতে হবে না, দূরে দাঁড়িয়ে গুনতে হবে না অপেক্ষার প্রহরও।
যেই ভাবা সেই কাজ। মুসা আলাইহিস সালাম তাদের বকরীগুলোকে নিজ দায়িত্বে পানি খাইয়ে এনে দিলেন।
পরের ঘটনাটুকুও আমাদের জানা— মুসা আলাইহিস সালামের সাহায্যের গল্প মেয়েরা তাদের বাবার কাছে এসে করতে ভুলেনি। এমন পরোপকারী আল্লাহর বান্দাকে মেয়েদের বাবা পুরস্কৃত করতে চাইলেন৷ তিনি ডেকে পাঠালেন মুসা আলাইহিস সালামকে।
মেয়েদের বাবার সামনে আসবার পরে মেয়ে দুটোর একজন তাদের বাবাকে বললো, 'পিতা, আপনি বরং এই লোককে কাজে নিযুক্ত করুন। এমন লোককেই তো আপনার কাজে নিযুক্ত করা উচিত যে কি-না শক্ত-সামর্থ্য আর বিশ্বস্ত'। - সুরা আল কাসাস, আয়াত- ২৬
মুসা আলাইহিস সালামের সাথে মেয়ে দুটোর সাক্ষাত কিন্তু একেবারে ক্ষণিকের। কোন পূর্ব পরিচয় ছাড়া, এতো অল্প সময়ে কীভাবে তারা বুঝতে পারলো যে মুসা আলাইহিস সালাম শক্ত-সামর্থ্য আর বিশ্বস্ত লোক?
তাফসিরে এর সুন্দর একটা ব্যাখ্যা এসেছে। যে কূপ থেকে মুসা আলাইহিস সালাম মেয়ে দুটোর বকরীগুলোকে পানি খাইয়েছেন, সেই কূপের মুখে ভারি লোহার একটা ঢাকনা ছিলো। সেই ঢাকনা দশজন লোকে মিলে সরাতে মুশকিল হয়ে যেতো। কিন্তু, মেয়ে দুটো দেখেছে মুসা আলাইহিস সালাম কী অবলীলায় সেই ভারি ঢাকনাটা একাই সরিয়ে পানি তুলেছেন! এটা দেখেই তারা বুঝতে পারলো যে এই লোক অবশ্যই শক্ত-সামর্থ্য একজন।
তবে, তিনি যে বিশ্বস্ত তা কীভাবে বুঝলো?
তাফসিরকারকগণ আরো বলেছেন— মেয়েদের গৃহে যাওয়ার পথে মুসা আলাইহিস সালাম মেয়ে দুটোকে বললেন, 'আমি আগে আগে হাঁটি, আপনারা আমার পেছন পেছন আসুন৷ যদি আমি ভুল পথে চলতে শুরু করি, আপনারা একটা পাথর নিক্ষেপ করে আমাকে সঠিক পথটা বাতলে দিবেন শুধু'।
কেনো মুসা আলাইহিস সালাম মেয়েদের আগে আগে হেঁটে যেতে চাইলেন জানেন? কারণ— তিনি যদি মেয়েদের পেছনে পেছনে আসেন, তাহলে শয়তান তাঁর দৃষ্টিকে বারংবার মেয়েদের দিকে নিবদ্ধ করতে চাইবে। শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে বাঁচতে এবং নিজের দৃষ্টির হেফাযত করতেই মুসা আলাইহিস সালাম সেদিন আগে আগে হাঁটতে চাইলেন, যদিও তাদের গৃহের পথ তিনি আদৌ চিনেন না।
যে লোক নিজের চরিত্রকে, নিজের দৃষ্টিকে হেফাযতে এতোখানি তৎপর, যিনি একাকিনী রমনীদের কাছ থেকেও নিজের দৃষ্টিকে এভাবে আড়াল করেন, তিনি তো বিশ্বস্ত হবেন-ই। সুতরাং, রমনীদের চিন্তা একটুও অমূলক ছিলো না।
(২)
আমি ভাবি— বর্তমানের শো-অফের দুনিয়ায় মুসা আলাইহিস সালাম আমাদের জন্য কী চমৎকার দৃষ্টান্তই না রেখে গেলেন!
আজকাল আমরা অন্যকে দেখানোর জন্য, অন্যের কাছে নিজের গুণ জাহির করার জন্য কতো চেষ্টাই না করি! আমি এমন অনেক ছেলেকে চিনি যারা নিজের গার্লফ্রেণ্ডকে ইমপ্রেস করার জন্য দামী কাপড়চোপড় পরে, দামী মডেলের বাইক কিনে, দামী রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। এমন অনেক মেয়েও আছে যাদের সারাদিনের চিন্তার সারমর্ম একটাই— কীভাবে বয়ফ্রেণ্ডকে বেশি করে ইমপ্রেস করা যায়, কীভাবে তাকে আরো বেশি মুগ্ধ, আরো বেশি মজিয়ে রাখা যায় তার রূপ আর গুণের কাছে। এমনও গল্প শুনেছি— ছেলেটা জিমে গিয়ে খুব পরিশ্রম করে সিক্স প্যাক বডি বানানোর জন্যে, কারণ তার গার্লফ্রেণ্ডের সিক্স প্যাক বডি পছন্দ।
অথচ— মুসা আলাইহিস সালাম মেয়ে দুটোকে ইমপ্রেস করতে কিন্তু তাদের বকরীগুলোকে পানি খাওয়াতে ছুটে যাননি। তিনি ইমপ্রেস করতে চেয়েছিলেন কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালাকে। নিজের দৃষ্টি হেফাযতকে তিনি আল্লাহর বিধান হিশেবে মেনে চলেছেন। মেয়ে দুটোকে সামনে চলতে দিলে তার দৃষ্টি হেফাযতে সমস্যা হতে পারে, শয়তানের ওয়াসওয়াসায় তিনি পরাস্ত হতে পারেন— এই ভয় থেকেই তিনি আগে আগে চলতে চেয়েছেন।
এই যে কেবল আল্লাহকে ইমপ্রেস করার জন্যেই কাজ করা, আল্লাহর বিধানকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরা, তা পালনে সর্বদা সচেষ্ট থাকা— এসবের বিনিময় হিশেবে মুসা আলাইহিস সালাম কী পেলেন?
মাদইয়ানে তিনি এসেছিলেন একেবারে অসহায় অবস্থায়। না ছিলো কোন আশ্রয়, না ছিলো কোন খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত। অথচ— এই একটা ঘটনার জের ধরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা তাঁকে আশ্রয় দিলেন একজন নেককার বান্দার গৃহে। কোন কোন তাফসিরকারকের মতে— ওই মেয়ে দুটোর বাবাও আল্লাহর একজন নবি ছিলেন। মুসা আলাইহিস সালাম শুধু যে আশ্রয় পেলেন তা কিন্তু নয়, ওই মেয়ে দুটোর একজনকে তিনি নিজের জীবনসঙ্গিনী হিশেবেও পেয়েছিলেন।
তাঁর শক্তিমত্তা তিনি কাজে লাগিয়েছেন মানুষের উপকারে। এই উপকার তিনি করেছেন শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্যেই। নিজের অসহায়, ছন্নছাড়া অবস্থাতেও তিনি তার চরিত্র, তার দৃষ্টির হেফাযতের কথা ভুলে যাননি। এসবের পুরস্কার হিশেবে তিনি লাভ করেছেন একটা উত্তম আশ্রয়, একজন উত্তম জীবনসঙ্গীনি আর একজন উত্তম অভিভাবক (তাঁর শ্বশুর)।
শো অফের দুনিয়ায়, আমরা যারা অপরকে মুগ্ধ করার জন্যে খেটেখুটে মরি, আমরা আসলে কী পাই দিনশেষে? আর মুসা আলাইহিস সালাম, যাঁর ব্রত-ই ছিলো কেবল আল্লাহকে মুগ্ধ করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা, তিনি কী পাননি বলুন তো?
'কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ-০৯'
৩-
সুরা আল ফালাকে আমরা বহুবিধ জিনিসের অনিষ্টতা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই এবং তন্মধ্যে একটা হলো— আচ্ছন্ন হয়ে আসা রাত্রির অনিষ্টতা।
'(আর আমি আশ্রয় চাইছি) রাতের অনিষ্টতা থেকে যখন তা আচ্ছন্ন হয়ে আসে।'- আল ফালাক, আয়াত-০৩
তাফসিরকারকগণ এটার বেশ কয়েকটা ব্যাখ্যা করেছেন। এমনিতে রাত থেকে পানাহ চাওয়ার কোন সঙ্গত কারণ নেই যদিও, তথাপি এখানে 'আচ্ছন্ন হয়ে আসা রাতের অনিষ্টতা' বলতে তারা যে কয়েকটা বিষয় সামনে এনেছেন তা হলো— রাতে ক্ষতিকর প্রাণী এবং পোঁকা-মাকড়ের বিচরণ বেড়ে যায় বলে এখানে সেসব থেকে পানাহ চাওয়া হয়েছে। রাতে ক্ষতিকর আত্মারা, অর্থাৎ যে-সমস্ত খারাপ জ্বীন মানুষের অপকার সাধন করে, তাদের বিচরণও বাড়ে বলে এখানে সেসব থেকেও পানাহ চাওয়া হয়েছে। এছাড়া, যে-সকল মানুষের মনে খারাপ অভিসন্ধি কাজ করে, যারা খুব অপরাধ-প্রবণ, খুন-খারাবি, ডাকাতি-রাহাজানির সাথে জড়িত, তারাও তাদের জন্য উপযুক্ত সময় হিশেবে রাতকে বেছে নেয় বলে এখানে রাতের সে-সমস্ত খারাপি থেকে পানাহ চাওয়া হয়েছে।
এ-সকল ব্যাখ্যা তো আছেই, সেসবের সাথে কেউ কেউ আরো একটা ব্যাপার যোগ করেছেন আর তা হলো— রাত নামলে শয়তান তার ওয়াসওয়াসা নিয়ে মানুষের মনে জোরালোভাবে প্রবেশ করে এবং তাকে নিমজ্জিত করায় নানাবিধ পাপে। তাই, অন্ধকার রাতে এ-সমস্ত শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে এখানে সাহায্য চাওয়া হয়েছে।
চিন্তা করলে দেখবেন— আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোনগুলো যেন সে-সকল শয়তানদের জন্য 'মেঘ না চাইতে জল'- এ পরিণত হয়েছে যারা রাতের বেলা মানুষকে ওয়াসওয়াসা দিয়ে বেড়ায়।
আজকালকার দিনে পর্ণোগ্রাফিতে, অশ্লীল জিনিসে যারা জড়িয়ে আছে তাদের এ-সকল কাজের পেছনে একশো ভাগ যে জিনিসটা ভূমিকা রাখে সেটা হলো স্মার্টফোন। রাতে সাধারণত মানুষের তেমন কাজ থাকে না। কাজ না থাকাটাই এখন যেন সবচেয়ে বড় কাজ৷ ইন্টারনেটের এ-গলি ও-গলি ঘুরতে ঘুরতে শয়তান কখন যে তাকে নিষিদ্ধ জিনিসে ডুবিয়ে ছাড়ে সেটা অনেকসময় সে টেরও পায় না।
এ-সকল কাজে যারা ডুবে যায়, তাদের মনে একটা তাড়না কাজ করে কখন রাত নামবে আর কখন সে ডুব দেবে নিত্যদিনকার দুনিয়ায়। শয়তান তাকে এমনভাবে শৃঙখলবন্দী করে রাখে যে— এই শৃঙখল ভাঙার ব্যাপারে তার ভেতর কোন তাড়নাই কাজ করে না।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা সেই অন্ধকার রাতের অনিষ্টতা থেকে পানাহ চাওয়া শিখিয়েছেন যে অন্ধকার রাতে মানুষ ডুব দেয় তার চাইতেও গাঢ় অন্ধকারে। ঘরজুড়ে অন্ধকার, কিন্তু কোন এক কোণায় ফোন থেকে বিচ্ছুরিত একটুকরো নীল আলো। সেই নীল আলো যেন আমাদেরকে নীল অন্ধকারে নিক্ষেপ না করতে পারে আল্লাহর কাছে করজোড়ে সেই প্রার্থনা।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
সালাফে সালিহিনদের আমল
...
মাওলানা আইনুল হক ক্বাসেমি
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৩৫৮৪ বার দেখা হয়েছে
ফিরাঊনের লাশ; আমাদের শিক্ষা
...
বিবিধ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২১২১ বার দেখা হয়েছে
خطبۂ صدارت ! حضرت شیخ الہند مولانا محمود حسن رحمۃ اللہ علیہ بموقع اجلاسِ تاسیسی مسلم نیشنل یونیورسٹی، علی گڑھ ،۲۹ /اکتوبر ۱۹۲۰ء
پسِ منظر ’’برطانیہ نے بیسویں صدی کے شروع میں خلافتِ عثمانیہ ترکی کو کمزور اور پھر ختم کرنے کی خوفنا...
শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১২২১ বার দেখা হয়েছে
পতনের যুগে বিশ্বাসের পথে
...
আল্লামা ইকবাল
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২৭৭৮ বার দেখা হয়েছে