প্রবন্ধ

শানে রেসালাত; এই দুঃসাহস অসহ্য! এই ধৃষ্টতা অমার্জনীয়!!

লেখক:মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব
১৫ জানুয়ারী, ২০২২
১৬৭৬ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

চলতি বছরের ষোলই অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিস নগরীর শহরতলীতে গলা কেটে হত্যা করা হয় এক স্কুলশিক্ষককে। কুলাঙ্গার এই স্কুলশিক্ষকÑ আমাদের নয়নের মণি, হৃদয়ের স্পন্দন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে শ্রেণীকক্ষে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করেছিল। শিক্ষার্থী ও অভিভাবক কর্তৃক ন্যায়সঙ্গত আপত্তি-অভিযোগ সত্তে¡ও এই দুর্ভাগাÑ রাসূলের শানে গোস্তাখী অব্যাহত রাখে। সেক্যুলার স্কুল কর্তৃপক্ষও ব্যাপারটি আমলে নেয়নি। অবশেষে এক তরুণ রাসূলপ্রেমিক এই বেয়াদবের পাওনা চুকিয়ে দেয় এবং তাকে হত্যা করে। চেচেন বংশোদ্ভূত এই সাহসী রাসূল প্রেমিকের বয়স মাত্র ১৮ বছর! পুলিশ ঘটনাস্থলেই তাকে শহীদ করে দেয়।

ঘটনার পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নিহত শিক্ষকের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয় এবং নিজে উপস্থিত থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে। এরপর সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকটি ভবনে প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয় নবীজীর ব্যঙ্গচিত্র! ম্যাক্রোঁ ঘোষণা দেয়, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিতর্কিত কার্টুন ছাপানো নিয়ে তারা নিন্দা জানাবে না; বরং বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে তারা এর প্রদর্শনী অব্যাহত রাখবে। একইসঙ্গে নিহত শিক্ষকের হত্যাকাÐের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। ফলে স্থানীয় মুসলমান ও দীনী প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর শুরু হয় রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও ব্যাপক ধরপাকড়। 

ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষ ফ্রান্সের পুরনো পাপ

এটাই প্রথম নয়, ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি ফ্রান্সের রয়েছে মজ্জাগত আক্রোশ। বস্তুত ফ্রান্স কোনকালেই মুসলমানদের প্রতি বন্ধু-ভাবাপন্ন ছিল না। ক্রুসেড তথা মুসলিম ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিলো ফ্রান্স থেকে! ক্রুসেডের প্রথম ডাক এসেছিলো ফ্রান্স থেকে! ক্রুসেডের প্রথম বাহিনীটিও এসেছিলো ফ্রান্স থেকে! খ্রিস্টানদের হয়ে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি ক্রুসেডের নেতৃত্ব দেয় সে-ও ছিল ফরাসী; পোপ দ্বিতীয় আরবান। ১০৯৬ থেকে ১২৯১ ঈসায়ী পর্যন্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে চলমান অধিকাংশ ক্রুসেডে নেতৃত্ব দিয়েছে ফরাসীরা; গডফ্রে ও স¤্রাট অগাস্টাস এদের উল্লেখযোগ্য। ফরাসী সেনাপতি রেইনল্ড সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সঙ্গে সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে মুসলমানদের হজ্জ-কাফেলাগুলোর উপর হামলা করে তাদেরকে হত্যা করতো এবং অর্থ-সম্পদ লুট করে নিতো। এমনকি এই নরাধম কয়েকবার মক্কা-মদীনা শরীফ ধ্বংস করারও উদ্যোগ নিয়েছিল! হিত্তিনের যুদ্ধে সালাহুদ্দীন আইয়ূবী রহ.-এর কাছে যুদ্ধবন্দী হয় রেইনল্ডসহ বহু ফরাসী নেতৃবৃন্দ। সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী রহ. রেইনল্ডকে তার পূর্বের অন্যায়-অপকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা ও লজ্জিত হওয়ার সুযোগ দেন। কিন্তু সে ক্ষমা না চেয়ে উপস্থিত নবীজীর শানে কটূক্তি করতে থাকে। নবীপ্রেমিক সালাহুদ্দীন আইয়ূবী রহ. সঙ্গে সঙ্গে এই কুলাঙ্গারের ইহলীলা সাঙ্গ করে দেন এবং বলেন, ‘এক রাজা আরেক রাজাকে হত্যা করে না; কিন্তু সে সীমালঙ্ঘনকারী।’ ফ্রান্স গত শতাব্দীতে আফ্রিকান মুসলানদের সভ্য (?) বানানোর নামে আলজেরিয়া, মরক্কো, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, সেনেগাল, মালি, চাঁদ, নাইজার, লেবানন, মৌরিতানিয়া, গাম্বিয়া ও গিনিতে গণহত্যা চালায় এবং ৫০ লক্ষাধিক মুসলমানকে হত্যা করে। এসব ভূখÐ থেকে ফ্রান্স এখনো মুসলমানদের অর্থ-সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মালি, নাইজার, চাঁদ, টোগো, বেনিন ও কঙ্গোর খনিগুলো থেকে স্বর্ণ, ডায়মÐ, আয়রন ও পেট্রোলিয়ামসহ নানা রকম খনিজ সম্পদ একচেটিয়াভাবে উত্তোলন ও লুট করে নিচ্ছে ফ্রান্স। সাবেক ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেঁরা ১৯৫৭ সালে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলÑ আফ্রিকার (সম্পদের) উপর নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখতে না পারলে একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে ফ্রান্সের জায়গা থাকবে না। পাঁচ দশক পর আরেক প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাকও ২০০৮ সালে সেকথার পুনরাবৃত্তি করেছেÑ ‘আফ্রিকা (এর সম্পদ) না থাকলে ফ্রান্স তৃতীয় বিশে^র তালিকা থেকে ছিটকে পড়তো!’

ইসলামী ইতিহাসের সর্বশেষ খেলাফতব্যবস্থা উসমানী সালতানাতেরও অন্যতম শত্রæ ছিলো ফ্রান্স। উসমানী সালতানাত বিলুপ্তির পেছনে ফ্রান্সের ছিল সর্বাত্মক ভূমিকা। ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিম-হত্যাকাÐও ঘটিয়েছে ফ্রান্স। ইউরোপে সর্বপ্রথম নিকাব/হিজাব নিষিদ্ধকারী দেশও ফ্রান্স। ২০১৯ সালে ফ্রান্সেই সবচেয়ে বেশি ইসলামোফোবিয়া ও বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। বছর পাঁচেক আগেও ফ্রান্সের কুখ্যাত পত্রিকা শার্লি এবদো নবীজীর ব্যঙ্গকার্টুন প্রকাশ করে। তখনও মুসলিম উম্মাহর নিন্দা ও প্রতিবাদের পরোয়া না করে ফ্রান্স সরকার শার্লি এবদোর পক্ষ নেয়। মোটকথা, ফ্রান্স ইসলাম ও মুসলমানদের পুরনো শত্রæ। ফরাসীরা সর্বদাই ইসলাম ও মুসলমানদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এবং বর্তমানেও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আলজেরিয়ান শায়খ বশীর ইবরাহিমী রহ.-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্যÑ ‘ফ্রান্স তোমাদেরকে নিজেদের চিরশত্রæ বিবেচনা করে। তারা তোমাদের শত্রæতায় সারাক্ষণ নিমগ্ন থাকে। যদি এক হাজার বছর পরও তোমাদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান জানতে চাওÑ দেখবে, তারা সেই একই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে অটল, অবিচল; তোমাদেরকে এবং তোমাদের দীনকে মিটিয়ে দেয়াই তাদের প্রধান লক্ষ্য।’ 

মুসলিমবিশে^ নিন্দার ঝড়

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে কার্টুন প্রদর্শনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উক্ত অপকর্ম অব্যাহত রাখায় মুসলিমবিশে^ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ফ্রান্স সরকারের এই অমার্জনীয় ধৃষ্টতায় ফুঁসে উঠেছে মুসলিমবিশ^। দেশে দেশে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ ও নিন্দার ঝড়। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও জনসাধারণ নিজ নিজ অবস্থান থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তুরস্ক সরকার এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ফরাসী প্রেসিডেন্টের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ম্যাক্রোঁ নামের এই ব্যক্তির ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে সমস্যা কী? এই রাষ্ট্রনেতাকে মানসিক রোগী ছাড়া আর কী বলা যায়, যিনি বিশ্বাসের স্বাধীনতা বোঝেন না এবং তার দেশে বসবাসরত কয়েক মিলিয়ন ভিন্নবিশ^াসের অনুসারীদের সঙ্গে এমন আচরণ করেন? ওর আসলেই মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন।’ 

মালয়েশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহাথির মুহাম্মদ বলেছেন, ‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে চলমান ও পুরনো নানাবিধ অপরাধের প্রতিশোধ-স্বরূপ লক্ষ লক্ষ ফরাসীদের হত্যা করার অধিকার আছে মুসলমানদের।’

ওআইসির পক্ষ হতে বলা হয়েছে, ‘আমরা নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলাম ধর্মের প্রতীকসমূহের অবমাননা করে মুসলমানদের অনুভূতিতে ধারাবাহিক আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানাই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ধর্মীয় অনুভূতির অবমাননা ও কটূক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ ইসলাম অবমাননার পক্ষে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর নেয়া শক্ত অবস্থানেরও সমালোচনা করেছে ওআইসি। 

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও ম্যাক্রোঁর মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্যারিস থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিতে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাবও পাস করা হয়। এদিকে লেবাননের দারুল ইফতার মহাসচিব আমীন কুরদী এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর কটূক্তি মানুষের মধ্যে কেবল ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াবে।’

আরববিশে^র প্রথিতযশা আরেক আলেম আল্লামা শরীফ হাতেম বলেছেন, ‘ফ্রান্স সরকার মুসলমানদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। তারা যেন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে যে, হয় তোমরা তোমাদের নবীকে দেয়া গালি মেনে নাও আর নয়তো নিজেদেরকে সন্ত্রাসী স্বীকার করো! সত্য বলতে কি, ফ্রান্স আবারও মধ্যযুগে ফিরে যাচ্ছে; এবার খ্রিস্টধর্মের গির্জার কাঁধে ভর করে নয়, সেক্যুলারিজম নামক ধর্মের কাঁধে সওয়ার হয়েÑ যার বর্তমান পাদ্রী ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।’

ফ্রান্সে ক্রমবর্ধমান ইসলাম বিদ্বেষ নিয়ে কুয়েতেও নিন্দার ঝড় উঠেছে। ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন কুয়েতের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির প্রধান মারজুক আল-গানেম। এক সংবাদ সম্মেলনে ক‚টনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ইসলামসহ বিশে^র সব ধর্ম ও বিশ^াসের অবমাননা বন্ধে জরুরী উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান তিনি। বাকস্বাধীনতার নামে চরমপন্থা প্রতিরোধে মুসলিম-বিশে^র ক‚টনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির আহŸান করেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ আল-ফজল। ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের প্রতিবাদে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবীর প্রেক্ষিতে ২৫-২৯ অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য ‘ফ্রান্স-কাতার সাংস্কৃতিক সপ্তাহ’ পালন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে কাতার বিশ^বিদ্যালয়। পশ্চিমা-তাবেদার সৌদী প্রশাসনও সীমিত পরিসরে নিন্দা জানিয়ে দায়মুক্তির চেষ্টা করেছে।

পণ্য বর্জনের হিড়িক

শুধু মৌখিক নিন্দার মধ্যেই প্রতিবাদ সীমিত রাখেনি মুসলিমবিশ^। ফ্রান্সের সব ধরনের পণ্য বর্জন শুরু করেছে কাতারের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানী আল-মিরাহ কনজ্যুমার গুডস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় বড় মার্কেট ও শপিংমল থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে ফ্রান্সের পণ্যসামগ্রী। আরব দেশগুলোও ব্যাপকভাবে ফরাসীপণ্য বয়কট করেছে। কুয়েত ও জর্ডানের বেশিরভাগ দোকান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে ফরাসীপণ্য। লিবিয়া, সিরিয়া ও গাজা ভূখÐেও বিক্ষোভ-প্রতিবাদের পাশাপাশি ফরাসীপণ্য বিশেষত প্রসাধন-সামগ্রী ও সুগন্ধি বিক্রি করা হচ্ছে না; শপিংমল ও দোকানের তাকগুলো খালি করে দেয়া হচ্ছে। ‘আমি ফরসীপণ্য বর্জন করলাম আপনিও করুন’ লেখা ব্যানার-ফেস্টুন সবখানে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সৌদী আরবেও সাধারণ মানুষদের পক্ষ থেকে ডাক দেয়া হয়েছে পণ্যবয়কটের। 

মুসলিমবিশে^র বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ফরাসী পণ্যবর্জনের ডাক

বর্তমান পরিস্থিতিতে ফ্রান্স বিষয়ে বিশ^-মুসলিমের করণীয় সম্পর্কে বিখ্যাত উলামা ও ইসলামিক স্কলারগণ পণ্যবয়কটের আহŸান জানিয়েছেন। উদাহরণতÑ

আরববিশ্বের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা ইউসুফ কারযাবী লিখেছেন, ‘মুসলিম উম্মাহর পক্ষে এটি কখনো সম্ভব নয় যে, তারা তাদের নবীর হক আদায়ে গড়িমসি করবে। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে আমাদের সবকিছুর চেয়ে প্রিয়। আমি কিভাবে এমন জাতির পণ্য ক্রয় করবো, যারা আমার নবীকে অপমান করে? কিভাবে আমরা আমাদের সম্পদ তাদেরকে দিয়ে দিবো এবং কিভাবে আমাদের সম্পদ দ্বারা তাদেরকে লাভবান হতে দিবো? না, এটা কিছুতেই হতে পারে না। তাদের উৎপাদিত পণ্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে আমাদেরকে বিকল্প পণ্য ব্যবহার করতে হবে।’

বিশ^বিখ্যাত আলেম মুফতী তাকী উসমানী দা.বা. এক টুইটবার্তায় লিখেছেনÑ ‘দো-জাহানের বাদশাহ হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে ফ্রান্স এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে, তার পরেও কি কোনো মুসলমানের পক্ষে এটা সম্ভব যে, দেশটির (ফ্রান্সের) পণ্য কেনাবেচা বা আমদানী-রপ্তানী করবে! এই সম্পদপূজারীদের তখনই উচিত শিক্ষা হবে যখন ইসলামীবিশ^ তাদের পণ্য বয়কট করবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে এটা সর্বনি¤œ প্রতিক্রিয়া, যা আমরা এই মুহূর্তে দেখাতে পারি।’

বিশ^বিখ্যাত দাঈ ও আলেম মাওলানা তারিক জামিল তার টুইটবার্তায় লিখেছেনÑ ‘রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে বেয়াদবী করায় সব মুসলিমের হৃদয় ব্যথিত। আমি প্রত্যেক মুসলিম ভাইকে ফ্রান্সের পণ্য বর্জন করার আহŸান জানাচ্ছি। পণ্যবয়কট আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে এই বস্তুপূজারীদের ভোগবিলাসে আপনি একটা হলেও আঘাত করতে পারেন। নিজের সাধ্য অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলমান ফ্রান্সের পণ্য বয়কটকে নিজের জন্য আবশ্যক করে নিন।’

এ ছাড়াও ফ্রান্সের পণ্য বর্জনের আহŸান জানিয়েছেন তুরস্ক, সৌদী আরব, কাতার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, কুয়েত ও ইরানসহ মুসলিমবিশে^র বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও ইসলামিক স্কলারগণ।

পণ্যবর্জন এক কার্যকর হাতিয়ার

পণ্যবর্জনকে অনেকে হালকাভাবে দেখে থাকে। বাস্তবে পণ্যবর্জন হালকা কিছু নয়; বরং এক মারাত্মক হাতিয়ার। এর মাধ্যমে বস্তুবাদীদের অর্থনৈতিক প্রাসাদ ধ্বসিয়ে দেয়া সম্ভব। উদাহরণত ২০০৪ সালে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে মুসলিমবিশে^র পণ্যবয়কট তাদের অর্থনীতিতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে চলমান পণ্যবয়কট যদি কয়েক মাসও দীর্ঘ হয়, তাহলে এটা ওদের আস্ফালন দমিয়ে দিবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, প্রথম সপ্তাহের এই সীমিত পণ্যবয়কটে ফ্রান্সের শেয়ার বাজারে বিপর্যয় নেমে এসেছে; লোকসান হয়েছে ২৮ বিলিয়ন ডলার। ভেবে দেখুন, সমগ্র মুসলিম উম্মাহ যদি সচেনতার সঙ্গে ফরাসী পণ্য বয়কট অব্যাহত রাখে তাহলে ধৃষ্ট ফ্রান্স সরকার কতোটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে!

পণ্যবয়কট ঈমানের দাবী

পণ্যবয়কট ও এর কার্যকারিতার ইতিহাসও অনেক পুরনো। হযরত ছুমামা ইবনে উসাল রাযি.। ইসলামের ইতিহাসে ‘পণ্যবয়কটের জনক’ নামে পরিচিত। ইয়ামামা অঞ্চলের হানীফা গোত্রের সর্দার ছিলেন। যুদ্ধবন্দী হয়ে মদীনায় আসেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর নবীজীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে উমরা সম্পন্ন করতে মক্কা গমন করেন। মক্কাবাসীরা তাকে দেখে হৈ-হৈ করে ওঠেÑ আরে, তুমি তো বে-দীন হয়ে গেছো! তিনি বললেন, না; বরং আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আল্লাহর কসম! এখন থেকে ইয়ামামা হতে তোমাদের কাছে যবের একটা দানাও পৌঁছবে না, যতক্ষণ না আল্লাহর রাসূল অনুমতি দেন! (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪৩৭২) 

ইয়ামামা মক্কাবাসীদের খাদ্যভাÐার হিসেবে পরিচিত ছিল। হযরত ছুমামা রাযি. তাদের সঙ্গে বয়কটের ঘোষণা দিলেন। ইয়ামামা থেকে খাদ্যপণ্য আসা বন্ধ হয়ে গেল। আমদানী-নির্ভর মক্কায় খাদ্য-দ্রব্যের প্রচÐ অভাব দেখা দিলো। বাধ্য হয়ে মক্কার প্রতিনিধিদল মদীনায় এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সুপারিশ কামনা করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ছুমামাকে বয়কট প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন। ইসলামের সূচনালগ্নে হযরত ছুমামার এই পণ্যবয়কট কুরাইশ কাফেরদের ঝাঁজ কমিয়ে দিয়েছিল। বর্তমানে কুরাইশের ভূমিকায় অবতীর্ণ ফ্রান্সকেও পণ্যবয়কটের মাধ্যমে সমুচিত জবাব দেয়া মুসলিম উম্মাহর অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। 


পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ

ফ্রান্সের এই জঘন্য বেয়াদবী ও সীমাহীন ধৃষ্টতার নিন্দা-প্রতিবাদে পিছিয়ে নেই নবীপ্রেমিক বাংলাদেশও। ঘটনার পর থেকে সারাদেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে আশেকে রাসূলগণ। এসব বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করছেন দলমত নির্বিশেষে সকল মুসলমান। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় পালিত হয়েছে ফ্রান্স দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচী। বাধা-বিপত্তি ও রাষ্ট্রীয় অসহযোগিতা কোন কিছুই রাসূলপ্রেমিক জনতাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। একটি নমুনা পেশ করা যাকÑ

ইসলামপ্রিয় জনসাধারণের প্রিয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। ২ নভেম্বর সোমবার ফ্রান্স দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচী ঘোষণা করেছিল। কর্মসূচীটি ছিল ছোট পরিসরে ঢাকা মহানগর কেন্দ্রিক। ঈমানের দাবীর প্রতি সম্মান জানিয়ে শরীক হয়েছিল অগণন মানুষ। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের রাসূলপ্রেমিকগণ সকাল থেকেই ছুটতে শুরু করেছিলেন বাইতুল মুকাররম অভিমুখে। বেলা চড়তেই কানায় কানায় ভরে ওঠে বাইতুল মুকাররম, পল্টন, প্রেসক্লাস, বিজয়নগর, মতিঝিল, গুলিস্তানসহ আশপাশের প্রধান সড়ক ও অলিগলি। সকাল নয়টার আগেই ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপে দুই-তিন কিলোমিটার দূর থেকে রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। দুপুরের একটু আগে দূতাবাস ঘেরাও মিছিল শুরু হয়। মিছিল তো নয় যেন বাঁধভাঙা জোয়ার। যতদূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষ। তরঙ্গের মতো এগিয়ে চলছে। বিক্ষুব্ধ ও তেজোদীপ্ত। অদম্য ও অপ্রতিরোধ্য। যেন সব জঞ্জাল-আবর্জনা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এরা নবীপ্রেমিক, রাসূল-অনুরাগী। ছুটে চলেছেন নবীজীর ভালোবাসার প্রমাণ দিতে। নবীজীর সম্মান তাদের কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। পিতা মাতা, স্ত্রী-সন্তান এমনকি আপন প্রাণের চেয়েও। তাদের নিযুত কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিলÑ

নারায়ে তাকবীর; আল্লাহু আকবার

বিশ^নবীর অপমান; সইবেনারে মুসলমান

বিশ^নবীর স্মরণে; ভয় করি না মরণে

ফ্রান্সের দূতাবাস; বন্ধ করো, করতে হবে

ফ্রান্সের পণ্য; বর্জন করো, করতে হবে

সে এক মহাবজ্রধ্বনি, গণবিস্ফোরণ। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলা সেই মহাগর্জন যে শোনেনি, তাকে লিখে বোঝানোর সাধ্য নেই।

কুরআনে বর্ণিত গোস্তাখে রাসূলের শাস্তি

কুরআনুল কারীমে গোস্তাখে রাসূলের শাস্তি প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছেÑ (অর্থ:) ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেন। এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অপমানকর শাস্তি’। (সূরা আহযাব-৫৭)

পরবর্তী আয়াতে এসব অভিশপ্তদের পার্থিব শাস্তির বিবরণ দেয়া হয়েছেÑ (অর্থ:) ‘অভিশপ্ত অবস্থায় তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে, গ্রেফতার করা হবে এবং হত্যা করা হবে। যারা পূর্বে গত হয়ে গেছে, তাদের ব্যাপারেও এটাই ছিল আল্লাহর রীতি। আপনি আল্লাহর রীতিতে কখনও পরিবর্তন পাবেন না।’ (সূরা আহযাব-৬১, ৬২)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছেÑ (অর্থ:) আর তারা যদি চুক্তি সম্পন্ন করার পর নিজেদের প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করে এবং ‘তোমাদের দীনের নিন্দা করে’ তবে কুফরের এই নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তোমরা যুদ্ধ করবে। বস্তুত এরা এমন লোক যাদের প্রতিশ্রæতির কোন মূল্য নেই। (সূরা তাওবা-১২)

আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. স্বীয় তাফসীরগ্রন্থে ‘তোমাদের দীনের নিন্দা করে’ অংশের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আয়াতের এই অংশ দ্বারা যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দেয় বা ইসলামের ব্যাপারে অশালীন মন্তব্য করে, তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।’ (তাফসীরে ইবনে কাসীর; সংশ্লিষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)

হাদীসে বর্ণিত গোস্তাখে রাসূলের শাস্তি

হযরত আলী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনÑ (অর্থ:) ‘যে ব্যক্তি নবীকে গালি দেয়, তাকে হত্যা করো। আর যে সাহাবীকে গালি দেয়, তাকে বেত্রাঘাত করো।’ (দায়লামী; হা.নং ৫৬৮৮)

হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেনÑ (অর্থ:) ‘কাব ইবনে আশরাফের ব্যাপারটি কে দেখবে? সে-তো আল্লাহ ও তার রাসূলকে কষ্ট দেয়! তখন মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা রাযি. দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি চান আমি তাকে হত্যা করি? নবীজী বললেন, হ্যাঁ।’ (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪০৩৭)

হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তাঁর মাথায় শিরস্ত্রাণ রাখা ছিল। তিনি তা মাথা থেকে খুলে রাখলেন। এমন সময় একব্যক্তি এসে বলল, ইবনে খাতাল তো কাবার গিলাফ ধরে বসে আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে হত্যা করে দাও। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১৮৪৬)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে খাতালকে কাবার গিলাফ ধরা অবস্থায়ও কেন হত্যার নির্দেশ দিলেন? আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ফাতহুল বারী গ্রন্থে উক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে এর কারণ বলেছেন যে, ইবনে খাতাল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালমন্দ করতো। (ফাতহুল বারী ২/২৪৮)

ইবনে খাতালের দু’টি ক্রীতদাসী ছিল, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কুৎসামূলক কবিতা আবৃত্তি করতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন তাদেরকেও হত্যা করার নির্দেশ দেন। (আসাহ্হুর সিয়ার পৃ. ২৬৬, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৪/৪৯৮)

হযরত আলী রাযি. বলেন, এক ইয়াহুদী মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালাগাল করতো, মন্দ কথা বলতো। একব্যক্তি তার গলা চেপে ধরে, ফলে সে মারা যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই মহিলার রক্তপণ ‘বৃথা’ ঘোষণা করেন। (সুনানে আবূ দাঊদ; হা.নং ৪৩৬২)

গোস্তাখে রাসূলের ব্যাপারে উলামায়ে উম্মতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত

মুজতাহিদ ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত যে, যে কেউ আল্লাহর রাসূলের ব্যাপারে কটূক্তি করবে, গালাগালি করবে, অসম্মান করবে তার শাস্তি মৃত্যুদÐ। আবূ বকর ইবনুল মুনজির রহ. বলেন, সমস্ত আহলে ইলম একথার উপর একমত যে, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালাগাল করবে, বা মন্দ বলবে তাকে হত্যা করা ওয়াজিব। ইমাম মালেক ইবনে আনাস, ফকীহ আবূল লাইস, ইমাম আহমাদ এবং ইমাম ইসহাকও এ মতের প্রবক্তা। আর এটাই ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর মাযহাব। আল্লামা কাযী ইয়ায বলেন, একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন ইমাম আবূ হানীফা রহ., সুফিয়ান সাওরী ও আহলে কুফা। ইমাম আওযায়ী থেকেও গোস্তাখে রাসূলের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে যে, তাকে হত্যা করা হবে।

ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সুহনুন বলেন, উলামায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালাগালকারী ও তার কুৎসাকারীদের কাফের হওয়ার উপর ঐকমত্য ব্যক্ত করেছেন। এমন ব্যক্তির উপর আল্লাহর শাস্তি ও ধমক রয়েছে। আর যে ব্যক্তি এমন ব্যক্তির কাফের হওয়া এবং শাস্তিযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করবে সে-ও কুফরীতে লিপ্ত। ইমাম আবূ সুলাইমান খাত্তাবী বলেন, আমি এমন কোন মুসলমানের ব্যাপারে জানি না, যে কিনা গোস্তাখে রাসূলকে হত্যার আবশ্যকতার ব্যাপারে মতবিরোধ করে। (রাসায়েলে ইবনে আবেদীন ১/৪৮৬-৪৮৭)

প্রচলিত তাওরাত-ইঞ্জিলেও ধর্মদ্রোহীর শাস্তি মৃত্যুদÐ

শুধু ইসলামে নয় ইয়াহুদী ও খ্রিস্টধর্মেও মুরতাদ বা ধর্মদ্রোহীর রয়েছে মৃত্যুদÐের বিধান। নানা রকম হস্তক্ষেপ ও বিকৃতির পরও বর্তমানে তাওরাত, ইনজিল, বাইবেল ও কিতাবুল মোকাদ্দাস নামে যেসব গ্রন্থ পাওয়া যায়, সেগুলোতেও ধর্মদ্রোহীর কঠোর শাস্তি বিবৃত হয়েছে। 

প্রচলিত তাওরাতে ধর্মদ্রোহীর শাস্তি 

‘৬,৭: দুনিয়ার এক সীমানা থেকে অন্য সীমানা পর্যন্ত তোমার কাছে বা দূরের লোকেরা যে দেব-দেবীর পূজা করে, যারা তোমার এবং তোমার পূর্বপুরুষদের অজানা সেই সব দেব-দেবীর দিকে যদি তোমার নিজের ভাই কিংবা তোমার ছেলে বা মেয়ে কিংবা প্রিয় স্ত্রী কিংবা তোমার প্রাণের বন্ধু তোমাকে একা পেয়ে বিপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে, ‘চল আমরা গিয়ে দেব-দেবীর পূজা করি’। ৮: তবে তার ডাকে সাড়া দিও না বা তার কথায় কান দিয়ো না। তাকে কোন দয়া দেখাবে না। তাকে রেহাই দিবে না। কিংবা তাকে রক্ষা করবে না। ৯: তাকে হত্যা করতেই হবে। তাকে হত্যা করবার কাজ তুমি নিজের হাতেই শুরু করবে। তারপর অন্য সবাই যোগ দেবে। ১০: যিনি তোমাকে মিসর দেশের গোলামী থেকে বের করে এনেছেন তোমার সেই মাবুদ আল্লাহর দিক থেকে সে তোমাকে ফিরাবার চেষ্টা করেছে বলে তাকে তুমি পাথর ছুড়ে হত্যা করবে। ১১: তাতে বনি ইসরাঈল সকলে সেই কথা শুনে ভয় পাবে এবং তোমাদের মধ্যে কেউ আর এই রকম খারাপ কাজ করবে না।’ (বাংলা কিতাবুল মোকাদ্দাস-২৪২, তৌরাত, দ্বিতীয় বিবরণ ১৩: ৬-১)

খ্রিস্টধর্মেও মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদÐ। মুরতাদ হওয়া ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। হত্যা এবং যিনাকারীর স্থলাভিষিক্ত। (এনসাইক্লোপিডিয়া, রিলিজিওন অধ্যায়, ইÐিয়া এডিশন, ৬নং খÐ)

মোটকথা, ইসলামী শরীয়ত ও অন্যান্য আসমানী ধর্মমতে নবী-রাসূলের শানে বেয়াদবী ও কটূক্তিকারীর কোন নিরাপত্তা নেই; তাকে মৃত্যুদÐ দেয়া রাষ্ট্রের যেমন দায়িত্ব, তেমনি কোন মুসলমান যদি তাকে হত্যা করে তাহলে ইসলামী বিধানমতে তার জন্য কোন জবাবদিহিতা নেই।

শেষকথা

প্রিয় পাঠক! আমরা মুখে স্বীকার করিÑ পরমপ্রিয় মাতা-পিতা, কলিজার টুকরো সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রী এবং জানমাল, ইজ্জত-আব্রæর চেয়েও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত। কিন্তু আমাদের চলন-বলনে, আচরণ ও উচ্চারণে এককথায় যাপিত জীবনের সকল অঙ্গনে কি আমরা এর সত্যতা প্রমাণ করতে পারছি? আমরা কি পারছি জীবন-পরিক্রমার প্রতিটি ধাপে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে রাসূলের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দিতে? আমরা কি পারছি রাসূলের ভালোবাসায়, তার মর্যাদা ও ইযযত রক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করতে? যেমনটি করেছিলেন সাহাবী হযরত সাদ ইবনে রবী’ রাযি.Ñ

উহুদের রক্তাক্ত প্রান্তর। জায়গায় জায়গায় লাশের স্তূপ। আহতদের কাতরধ্বনিতে বিষণœ চারদিক। নবীজী ইরশাদ করলেন, সাদ ইবনে রবী’ কোথায়? তাকে পেলে আমার সালাম বলবে। এক সাহাবী জানালেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আল্লাহর রাসূল বললেন, শহীদানের স্ত‚পে খুঁজে দেখো। স্তূপীকৃত লাশগুলো একে একে সরানো হলো। নীচ থেকে বেরিয়ে আসল সাদ ইবনে রবী’র ক্ষতবিক্ষত দেহ। তিনি তখনো বেঁচে আছেন। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছেন। মুখে পানি দিয়ে বলা হল, আল্লাহর রাসূল তোমাকে সালাম বলেছেন, তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। শোনামাত্রই হযরত সাদের যন্ত্রণামলিন চেহারা ঝলমলিয়ে উঠলো। মনের শক্তিবলে উঠে বসতে চাইলেন কিন্তু দেহটি যমীনে পড়ে গেল। ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, রাসূলুল্লাহকে আমার সালাম দিয়ে বলবেÑ সাদ মৃত্যুমুখে পতিত; তবে সে জান্নাতের খোশবু পাচ্ছে। আর আমার স¤প্রদায় আনসারদের সমবেত করে বলবে, তোমাদের সর্দার মৃত্যুকালে তোমাদের ওসিয়ত করেছেনÑ হে আনসার স¤প্রদায়! তোমরা বেঁচে থাকতে যেন আল্লাহর রাসূলের শরীরে সামান্য আঁচড়ও না লাগে। নবীজীকে সাদ ইবনে রবী’র পয়গাম জানানো হল। নবীজীর চোখ অশ্রæসিক্ত হয়ে উঠল। আবেগঘন কণ্ঠে আল্লাহর রাসূল বললেন, আয় আল্লাহ! আমি সাদের প্রতি সন্তুষ্ট আছি, তুমিও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। বর্ণনাকারী বলেন, উহুদ যুদ্ধের কিছুদিন পর একবার দেখিÑ হযরত আবূ বকর রাযি. চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন। তার বুকের উপর একটি শিশু খেলা করছে। তিনি বারবার শিশুটিকে চুমু খাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, এতো আদর করছেন, কার সন্তান এটি? হযরত আবূ বকর রাযি. চিৎকার করে উঠলেনÑ তুমি জানো না! এটি সাদ ইবনে রবী’র ইয়াতীম সন্তান! সাদের সন্তান বলেই আমি তাকে চুমু খাচ্ছি, আদর করছি! সাদ মৃত্যুর সময় তার ইয়াতীম সন্তানের কথা উচ্চারণ করেনি, তার অসহায় স্ত্রীর কথা মুখে আনেনি; সে বলেছেÑ তোমরা বেঁচে থাকতে আল্লাহর রাসূলের যেন সামান্যও আঁচড় না লাগে!

প্রিয় পাঠক! এই ছিল সাহাবায়ে কেরামের রাসূলপ্রেম। এর থেকে আমাদের কি কিছুই শেখার নেই? সুদূর বাংলাদেশ থেকে ফ্রান্সের গলাটা চেপে ধরার ক্ষমতা হয়তো আমাদের নেই কিন্তু পণ্য বর্জনের মাধ্যমে নবীর দুশমনের ভোগবিলাসে আঁচড় কাটার সক্ষমতা তো অবশ্যই আছে! বস্তুত আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সাধ্য অনুপাতে দায়ভার অর্পণ করেন এবং সেই ভিত্তিতে হিসাব গ্রহণ করেন।

বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত কিছু ফরাসী পণ্যের তালিকা

টোটাল সিলিন্ডার গ্যাস, টোটাল ইঞ্জিন অয়েল (মবিল), লাফার্জ সিমেন্ট, বিক রেজার, বিক গ্যাসলাইট, বিক কলম, গার্নিয়ার ফেসওয়াস, স্কিনকেয়ার ও কসমেটিকস, লরিয়াল পারফিউম ও কসমেটিকস, সানোফি কোম্পানীর ওষুধ, ডাইওর কোম্পানীর কসমেটিকস, ঘড়ি ও জুয়েলারী, ইন্ডিয়ায় প্রস্তুতকৃত ফ্রান্সের হারমোনি সাবান ইত্যাদি।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

গীবত; একটি জঘন্য গুনাহ

...

শাঈখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২০০২৯ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →