প্রবন্ধ
মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান রহ. : যাঁকে পড়তে হবে সতর্কতার সঙ্গে
লেখক:মাওলানা যাইনুল আবিদীন
২২ জানুয়ারী, ২০২২
১০৪২ বার দেখা হয়েছে
০ মন্তব্য
মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান খুবই পণ্ডিত ব্যক্তি। জন্ম ১০ অক্টোবর ১৯২৫, মৃত্যুবরণ করেছেন ২০২১ সালের ২১ এপ্রিলে। প্রায় ৯৬ বছর দুনিয়াতে কাটিয়েছেন।
এরকম মানুষও বোধহয় খুব কম যে, একই সঙ্গে অনেক বড় বড় গুণের অধিকারী। তিনি লেখক, আলোচক হিসেবেও খুব খ্যাতিমান মানুষ, এবং চিন্তাবিদ। ‘আর রিসালাহ’ নামক পত্রিকার তিনি আমরণ সম্পাদক ছিলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁর লেখা আর ওয়াজ দিয়েই পত্রিকাটি বের হতো, এবং বিপুলভাবে পাঠকপ্রিয় একটা পত্রিকা ছিল এটি। শেষ সময়ে তিনি দিল্লিতে ইসলামিক সেন্টার নামে একটা প্রতিষ্ঠান করেন। তিনি এর মহাপরিচালক ছিলেন। ওই জায়গা থেকে তিনি তাঁর চিন্তা চেতনা বিতরণ করেছেন।
•
তাকে চেনবার প্রথম সূত্র ছিল মাওলানা মওদুদির চিন্তাধারাকে জানতে গিয়ে। আমাদের উস্তাদ মাওলানা নুর হোসাইন কাসেমী রহ. বলেছিলেন, ‘তাবির কি গলতি’ পড়ো। ‘তাবির কি গলতি’ হলো মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খানের অন্যতম রচনা। তিনি যৌবনে বন্ধু ছিলেন মাওলানা আবুল আলা মওদুদির।
জামায়াতে ইসলামীর রোকন ছিলেন। সম্ভবত শুরা সদস্যও ছিলেন। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্রে এসে মাওলানা মওদুদির সঙ্গে তার বিরাট বিরোধ হয়। কখনও সামনাসামনি বসে, কখনও পত্রালাপের মাধ্যমে দুজনের মধ্যে অনেক বিরোধ হয়। এসব বিরোধের পরে একটা সময় এসে মাওলানা মওদুদি তার সামনে আত্মসমর্পণ করেছেন যে, মাওলানা আমি আপনাকে বোঝাতে পারবো না, আপনার চিঠির জবাব দিতে পারবো না, আপনার মনে চাইলে থাকেন, আর মনে না চাইলে জামায়াতে ইসলামী থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারেন। এই পত্রাবলি ‘তাবির কি গলতি’র মধ্যে এসেছে।
•
মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খানের যে জটিলতার জায়গা সেটা একেবারে নির্দিষ্ট করে আমাদের উলামায়ে কেরাম ধরিয়ে দিয়েছেন। যেমন, ইবনে তাইমিয়ার রহ.-এর কিতাব ‘আস সা-রিমুল মাসলুল আলা শাতিমির রাসুল’ এর আলোচ্য বিষয় হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেউ যদি মন্দ বলে গালি দেয় তাহলে সে ওয়াজিবুল কতল। এটা উম্মতের সর্বসম্মত মত।
মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান এটাকে অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, শাতিমুর রাসুল (রাসুলকে গালিদাতা)-কে কতল করা যাবে না। একইভাবে মাওলানা মওদুদি সাহেব যেমন তাকলিদের অস্বীকারকারী, তিনিও তাকলিদের অস্বীকারকারী। তাকলিদের মুনকির না হলে তো ইচ্ছামতো কথা বলা যায় না। ইচ্ছা মতো কথা বলতে গেলে দেখা যায় ফুকাহায়ে কেরাম জায়গায় জায়গায় হালাল হারাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ফলে মাওলানা মওদুদি সাহেব যেমন ফুকাহায়ে কেরামকে মুখস্থ ধোলাই দিয়েছেন, এই ধোলাইয়ের কাজটি মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খানও করেছেন।
খুব মজার একটি বিষয় হলো, কোনো ব্যক্তি ভালো বলতে পারলে তার ভাষা ও কলম যদি চালু হয় এবং সেই সঙ্গে সে যদি তার সালাফকে অস্বীকার করতে পারে, তাহলে আধুনিক লোক তাকে খুব তাড়াতাড়ি গ্রহণ করে। হয়তো এটাও একটা কারণ যে, মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান সারা পৃথিবীতে এতোটা দ্রুত আদৃত হয়েছেন। গর্ভাচেভের হাত থেকে তিনি পুরস্কার পেয়েছেন।
ভারতের বেসামরিক সর্বোচ্চ পুরস্কার পদ্মভূষণ সেটাও পেয়েছেন। এমনিতে শান্তির জন্য ভারতের লোকাল এবং রাষ্ট্রীয় অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। এরপরও তার কিছু ইতিবাচক দিক আছে।
•
এজন্য আমি আমাদের তরুণ প্রজন্ম যারা মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খানকে একজন বিরাট চিন্তক ও লেখক হিসেবে অনেকেই হয়তো পড়েন। সেই পড়ার জায়গাটাতে আমি মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খানের রচনাকে তিন ভাগে ভাগ করি :
১.
একটা জায়গা হলো, যে রচনাগুলোতে তিনি ইসলামকে খালেস ধর্ম হিসেবে আলোচনার বিষয় বানিয়েছেন, সেই জায়গাগুলোতে একজন পরিপক্ক চিন্তা ও আদর্শের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ছাড়া কারও জন্য পড়া নিরাপদ না। তাহলে তিনি কখন যে গোমরাহির শিকার হয়ে যাবেন সেটা নিজেই হয়তো বলতে পারবেন না।
২.
আরেকটা জায়গা হলো, তিনি অন্যান্য জীবন-আদর্শ বিশেষ করে বিজ্ঞান ও আধুনিক আবিষ্কারের আলোকে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
এই জায়গাটায় আমি মনে করি তুলনামূলক ইসলামের সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠিত করবার এই যে ম্যাজিকটা পৃথিবীর অনেকেই ইতিমধ্যে দেখিয়েছেন এবং এর প্রতি মুসলিম পাঠকদেরও এক রকমের একটা আগ্রহ আছে। এর দ্বারা অনেক সময় দেখা যায়, একজন সাধারণ মুসলমানের দিলে বিশ্বাসটা আরও শক্তিশালী হয়ে ফুটে উঠে। তো এই রকমের জায়গায় আমি মনে করি, যারা মেধাবী তারা এবং যারা লেখেন বলেন, তারা তাঁকে পড়তে পারেন।
৩.
এমনিভাবে আরেকটা জায়গা হলো মাঝামাঝি। যেখানে তিনি তুলনামূলক আলোচনা করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ এটাকেও আলোচনার বিষয় হিসেবে নেননি, একেবারে খালেস ধর্ম বিশ্বাস ও আকিদাও আলোচনার বিষয় বানাননি। কিন্তু আলোচনার বিষয় বানিয়েছেন তাহজিব তামাদ্দুনকে।
এই জায়গায় এসে অনেক সময় দেখা গেছে ওই যে তার একটা ঐক্যপ্রচেষ্টা, ওই যে একটা শান্তিবাদ, এই জায়গায় এসে কখন যে বিশ্বাসটাকেও নামিয়ে নিয়ে গেছেন অন্যদের স্তরে এই জায়গাটা খুবই সূক্ষ্ম ও শঙ্কার। এর কারণ হলো তিনি তার লেখার হাত এতোটাই পাকাতে পেরেছিলেন যে, তার সময়কার ভারত উপমহাদেশে সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান। মাওলানা মওদুদিও তার কলমের কাছে এক রকমের হেরে গেছেন। এই জায়গাটায় এসে আমি মনে করি যে কারও পক্ষে তাঁকে পড়াটা নিরাপদ না।
ইসলামের মধ্যে একজন মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো বিশ্বাসের জায়গা। তো এখানে বিশ্বাস স্খলিত হওয়ার ভয় থাকে, এজন্য যে কারও জন্যে মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খানকে পড়া আমরা সমীচীন ও সঙ্গত মনে করি না।
•
তারপরও একজন লেখক হিসেবে মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান, তার গোত্রের মধ্যে আমরাও পড়ি, তার প্রতি তিনি যখন জীবিত ছিলেন তখন আমাদের শ্রদ্ধা ছিল। আমরা এখনও আল্লাহ তায়ালার কাছে এই দোয়া করব যে, তিনি জমহুরের পথ থেকে সরে গিয়ে যেসব কথা বলেছেন, যদি তিনি ভুল করে থাকেন তাহলে আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁকে মাফ করে দেন এবং উম্মতকে যেন তার ওই সমস্ত ভুলভ্রান্তি থেকে হেফাজত করেন। আমিন।
মূল : মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন।
(লেখক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস)
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
উসতাযুল উলামা আল্লামা কুতবুদ্দীন রাহ.
...
মাওলানা আতাউল কারীম মাকসুদ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১২৬৩ বার দেখা হয়েছে
ফিকহে হানাফীঃ কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক সূত্রবদ্ধ শরয়ী বিধানের সংকলিত রূপ
...
মাওলানা যাকারিয়া আব্দুল্লাহ
৯ নভেম্বর, ২০২৪
৫৫১১ বার দেখা হয়েছে
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহঃ কে যেমন দেখেছি
...
প্রফেসর গিয়াসুদ্দীন আহমদ
৮ নভেম্বর, ২০২৪
১১৫০ বার দেখা হয়েছে
ইমাম আবু হানীফা রহ. এর নির্ভরযোগ্য ও পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ
...
শাঈখুল ইসলাম হযরত আব্দুল মালেক
৮ নভেম্বর, ২০২৪
১৭৬১ বার দেখা হয়েছে