আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

মালাকুল মউত কি শুধু মানুষের জান কবজ করে?

প্রশ্নঃ ৯০৬৩৮. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আসসালামু আলাইকুম,মালাকুল মাউত কি শুধু মানুষের জান কবজ করে থাকেন নাকি পশু-পাখিরও কবজ করেন।কেননা আমার একটি বিড়াল কঠিন অসুস্থথায় ভোগে মারা যায় এজন্যই আমি জানতে চাচ্ছি তাদের কোনো হিসাব-নিকাশ,পুরুষ্কার-আযাব,জান্নাত-জাহান্নামের বিধান রয়েছে কি তাদের সাথে পরকালের সাক্ষাতের সুযোগ আছে আমাদের দয়া করে জানাবেন?,

২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

Sylhet, Bangladesh

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


১নং উত্তর:
কিছু গ্রন্থ থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, সমস্ত জীবিত প্রাণীর আত্মা কব্জা করার দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা মালাকুল মউতকে (মৃত্যুর ফেরেশতা) দিয়েছেন। এক হাদিসে বর্ণিত আছে যে, একবার মালাকুল মউত নবী করিম ﷺ-কে বললেন: "আমি আল্লাহর অনুমতি ছাড়া এমনকি একটি মশার প্রাণও নিজ ইচ্ছায় গ্রহণ করতে পারি না।"

ইমাম কুরতুবি (রহ.) এই প্রসঙ্গে বলেন: "এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, প্রত্যেক জীবের প্রাণ গ্রহণ করার দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা মালাকুল মউতকে দিয়েছেন।"

এছাড়া, ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: "মশার প্রাণও কি মালাকুল মউত কবজা করেন?" তিনি পাল্টা জিজ্ঞাসা করলেন: "এতে কি প্রাণ আছে?"
উত্তর দেওয়া হলো: "জি হ্যাঁ।"
তখন তিনি বললেন: "তাহলে এর প্রাণও মালাকুল মউতই কব্জা করেন, কারণ কুরআনে এসেছে:
{اللّٰه یتوفی الانفس حین موتها}
"আল্লাহ আত্মাকে তার মৃত্যুর সময় কবজা করেন।" (সূরা আজ-জুমার: ৪২)


الفتاوى الحديثية لابن حجر الهيتمي (ص: 8):
"الذي دلت عليه الأحاديث أن ملك الموت يقبض جميع أنواع الحيوانات من بني آدم وغيرهم من ذلك قوله مخاطباً لنبينا صلى الله عليه وسلم: "والله يا محمد! لو أني أردت أقبض روح بعوضة ما قدرت على ذلك حتى يكون الله هو الآمر بقبضها". قال القرطبي : وفي هذا الخبر ما يدل على أن ملك الموت هو الموكل بقبض كل ذي روح، وأن تصرفه كله بأمر الله عز وجل وبخلقه واختراعه. ومن ذلك ما في خبر الإسراء عن بن عباس رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال عن نفسه: "فقلت: يا ملك الموت! كيف تقدر على قبض أرواح جميع من في الأرض برها وبحرها؟... " الحديث. وذكر أبو نعيم عن ثابت البناني قال: "الليل والنهار أربع وعشرون ساعةً ليس منها ساعة تأتي على ذي روح إلا وملك الموت قائم عليها فإن أمر بقبضها قبضها وغلا ذهب". قال القرطبي أيضاً: وهذا عام في كل ذي روح ومن ثم لما سئل مالك رضي الله عنه عن البراغيث أن ملك الموت هل يقبض أرواحها؟ أطرق ملياً، ثم قال: ألها نفس؟ قيل: نعم! قال: ملك الموت يقبض أرواحها؛ {الله يتوفى الأنفس حين موتها}".

২নং উত্তর:
প্রাণীদেরকে কিয়ামতের দিনে পুনরায় জীবিত করা (অর্থাৎ হাশর) সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এই হাশর হিসাব-নিকাশ এবং জান্নাত-জাহান্নামের সিদ্ধান্তের জন্য হবে না (যেমনটি দায়িত্বশীল সৃষ্টির অর্থাৎ মানব ও জিনদের ক্ষেত্রে হবে)। বরং এর অন্যান্য হিকমত (জ্ঞাত বা গোপন উদ্দেশ্য) রয়েছে।

এর মধ্যে একটি বড় হিকমত হলো— দায়িত্বশীল সৃষ্টির (মানব ও জিন) সামনে স্পষ্ট করে দেওয়া যে, কিয়ামতের দিন এমন এক ন্যায়বিচারের দিন হবে যেখানে পশুদের মাঝেও সুবিচার করা হবে। তাহলে দায়িত্বশীল সৃষ্টির (যারা হিসাবের জন্য উপযুক্ত) বিচার-প্রক্রিয়ায় কীভাবে অবিচার হতে পারে?

আল্লাহ তা'আলা বলেন,
সূরাঃ আল আনআম - আয়াত নংঃ ৩৮

وَمَا مِنۡ دَآبَّۃٍ فِی الۡاَرۡضِ وَلَا طٰٓئِرٍ یَّطِیۡرُ بِجَنَاحَیۡہِ اِلَّاۤ اُمَمٌ اَمۡثَالُکُمۡ ؕ مَا فَرَّطۡنَا فِی الۡکِتٰبِ مِنۡ شَیۡءٍ ثُمَّ اِلٰی رَبِّہِمۡ یُحۡشَرُوۡنَ

অর্থ: এবং পৃথিবীতে চলমান সকল প্রাণী এবং দুই ডানা দিয়ে উড়ন্ত সকল পাখির মধ্যেও এমন কোনো প্রকার নেই, যারা তোমাদের মতোই বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত নয়। আমরা লওহে মাহফুজে কোনো কিছুই বাদ দেইনি (সব কিছু লিপিবদ্ধ করেছি)। তারপর সবাই তাদের প্রতিপালকের নিকট সমবেত হবে।" (বায়ানুল কুরআন)

তাফসীরঃ
১৫. এর অন্য অর্থ হয়, ‘আমি কুরআনে কিছুমাত্র ত্রুটি রাখিনি,’ অর্থাৎ পার্থিব জীবনে মানুষের যত রকম দীনী নির্দেশনার দরকার ছিল মৌলিকভাবে সবই কুরআন মাজীদে আছে। হাদীস ও সুন্নাহ তারই তাফসীর। -অনুবাদক

১৬. এ আয়াত জানাচ্ছে, মৃত্যুর পর মানুষই পুনরুজ্জীবিত হবে না; বরং কিয়ামতের পর অন্যান্য জীব-জন্তুকেও পুনরুজ্জীবিত করা হবে। ‘তোমাদেরই মত সৃষ্টির প্রকার’ বলে বোঝানো হয়েছে, তোমাদেরকে যেমন পুনরুত্থিত করা হবে, তেমনি তাদেরকেও তা করা হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীসে ইরশাদ করেন, জীব-জন্তুরা দুনিয়ায় একে অন্যের প্রতি যে জুলুম করে থাকে, তজ্জন্য হাশরের ময়দানে মজলুম জীবকে জালিমের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দেওয়া হবে। অতঃপর দুনিয়ায় তাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার হক সংক্রান্ত বিধি-বিধান না থাকায় পুনরায় তাদের মৃত্যু ঘটানো হবে। এস্থলে এ বিষয়টা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য বাহ্যত এই যে, আরব অবিশ্বাসীগণ মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবনকে অসম্ভব মনে করত। তারা বলত, যে সকল মানুষ মরে মাটি হয়ে গেছে তাদেরকে পুনরায় একত্র করা কিভাবে সম্ভব? আল্লাহ তাআলা বলছেন, কেবল মানুষকেই কি, অন্যান্য জীব-জন্তুকেও জীবিত করা হবে, অথচ তাদের সংখ্যা মানুষের চেয়ে কত বেশি। বাকি থাকল এই প্রশ্ন যে, দুনিয়ার শুরু হতে শেষ পর্যন্তকার অসংখ্য মানুষও জীব-জন্তুর গলে-পচে যাওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সনাক্ত করা হবে কিভাবে? পরের বাক্যে এর জবাব দেওয়া হয়েছে যে, লাওহে মাহফুজে সবকিছু লিপিবদ্ধ আছে। তা এমনই এক রেকর্ড, যাতে কোনও রকম ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। সুতরাং আল্লাহ তাআলার পক্ষে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের কোনওটিকেই পুনরুজ্জীবিত করা কঠিন হবে না।
(তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন)


عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " لَتُؤَدُّنَّ الْحُقُوقَ إِلَى أَهْلِهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُقَادَ لِلشَّاةِ الْجَلْحَاءِ مِنَ الشَّاةِ الْقَرْنَاءِ " .
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক পাওনাদারকে তার পাওনা চুকিয়ে দিতে হবে। এমনকি শিং বিশিষ্ট বকরীর নিকট থেকে শিং বিহীন বকরীর জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:
জুলুমের প্রতি নিষেধাজ্ঞা এবংজুলুমের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ ফেরত দেওয়ার হুকুম

‘জুলুম'-এর শাব্দিক অর্থ কোনও বস্তু এমন স্থানে রাখা, যা তার প্রকৃত স্থান নয়। শরী'আতের পরিভাষায় জুলুম বলা হয় অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা বা অন্যের হক নষ্ট করা ও অনধিকার চর্চাকে। শরী'আত যে বস্তুর যে সীমা স্থির করে দিয়েছে, তা লঙ্ঘন করাকেও জুলুম বলা হয়। সুতরাং অন্যের জমি দখল করা, অন্যের টাকা-পয়সা কেড়ে নেওয়া, সম্মানী ব্যক্তিকে সম্মান না করা, অন্যায়ভাবে কাউকে তার পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সবই জুলুমের মধ্যে পড়ে।
জুলুম প্রথমত দুই প্রকার। এক জুলুম হচ্ছে হাক্কুল্লাহর ক্ষেত্রে, আরেক জুলুম হাক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রে। আল্লাহর হক বলতে – তাঁকে এক জানা ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা-সহ–তাঁর সম্পর্কিত যাবতীয় আকীদা-বিশ্বাস অন্তরে লালন করা এবং তাঁর দেওয়া শরী'আত মেনে চলাকে বোঝায়। সুতরাং ঈমান ও আকীদায় যে-কোনও ত্রুটি এবং আল্লাহর যে-কোনও আদেশ-নিষেধ অমান্য করা জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। হযরত আদম আলাইহিস সালাম তো তাঁর ইজতিহাদভিত্তিক ভুলকেও 'জুলুম' নামে অভিহিত করেছেন, যা কিনা গুনাহর মধ্যেই পড়ে না। সুতরাং তিনি ও তাঁর স্ত্রী হযরত হাওয়া আলাইহিমাস সালাম সে ভুলের পর এই বলে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করেছিলেন যে- قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজ সত্তার ওপর জুলুম করে ফেলেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন ও আমাদের প্রতি রহম না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অকৃতকার্যদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।

হাক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রে জুলুমকে মৌলিকভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
ক. অন্যের জানের প্রতি জুলুম;
খ. অন্যের মালের ওপর জুলুম এবং
গ. অন্যের ইজ্জতের ওপর জুলুম।
তা এভাবে যে, মানুষের মূল সম্পদ হচ্ছে তিনটি তার জান, তার মাল ও তার ইজ্জত। সুতরাং এ তিন বস্তুর নিরাপত্তা লাভ প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার। অন্যায়ভাবে এর কোনওটিতে আঘাত করা জায়েয নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জের দিন ঘোষণা করেনঃ- فإن دماءكم وأموالكم وأعراضكم بينكم حرام كحرمة يومكم هذا في شهركم هذا في بلدكم هذا “তোমাদের এই (মক্কা) নগরে এই (হজ্জের) মাসে আজকের এই দিনটির যেমন মর্যাদা, তোমাদের পরস্পরের মধ্যে তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের ইজ্জতের মর্যাদা তেমনই।
অর্থাৎ প্রত্যেকের কর্তব্য অন্যের এ তিনটি বিষয়ের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষা করা।এমন কোনও কাজ করা জায়েয নয়, যা দ্বারা অন্যের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। যদি তা করা হয়, তবে সে কাজটি জুলুমরূপে গণ্য হবে।
সুতরাং কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, অঙ্গহানি করা, মারধর করা এবং যে কোনওভাবে শারীরিক কষ্ট দেওয়া হচ্ছে তার জানের ওপর জুলুম।
কারও বাড়িঘর ও জমি-জায়েদাদ দখল করা, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি করা, টাকা পয়সা কেড়ে নেওয়া এবং যে-কোনও রকম বৈষয়িক ক্ষতি করা তার মালের ওপর জুলুম বলে বিবেচিত হবে।
কারও নামে অপবাদ দেওয়া, তার গীবত করা, তাকে গালাগাল করা এবং তার প্রতি মানহানিকর যে-কোনও আচরণ করা ইজ্জতের ওপর জুলুম করার অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম এর প্রত্যেকটিকেই কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং যে-কোনও প্রকার জুলুমকে কঠিন পাপ ঘোষণা করেছে।
চিন্তা করলে বোঝা যায় 'হাক্কুল ইবাদ' জাতীয় জুলুম হাক্কুল্লাহ'র ক্ষেত্রে জুলুম অপেক্ষাও কঠিন। কেননা হাক্কুল ইবাদ আদায় করাও আল্লাহ তা'আলা হুকুম। কাজেই এটা লঙ্ঘন করলে যেমন বান্দার হক নষ্ট করার জুলুম হয়, তেমনি আল্লাহর হক নষ্ট করারও জুলুম হয়ে যায়। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য এর থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা।অন্যথায় আখিরাতে এর জন্য কঠিন শাস্তির সম্মুখীন তো হতেই হবে, দুনিয়ায়ও এর অশুভ পরিণাম ভোগ করার আশঙ্কা আছে।
ইতোমধ্যে কারও দ্বারা যদি কোনও প্রকার জুলুম হয়ে থাকে, তবে তার কর্তব্য এখনই সে ব্যাপারে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া। পরিষ্কার হওয়ার উপায় হচ্ছে, হালুল্লাহর ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলার কাছে তাওবা করা এবং হাক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রে তাওবার পাশাপাশি সে যার ওপর জুলুম করেছে তার থেকে দায়মুক্তি লাভ করা। অর্থাৎ যদি তার জানের ওপর আঘাত করে থাকে বা কোনওভাবে তার মানহানি করে থাকে, তবে তার কাছে সরাসরি ক্ষমা চাওয়া এবং আন্তরিকভাবে তার কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করে নেওয়া। যদি তার মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে তার ওয়ারিশদের প্রতি সদাচরণ করা, তাদেরকে খুশি করার চেষ্টা করা এবং সেই মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দু'আ করতে থাকা। এতে আশা করা যায় আল্লাহ তা'আলা তার পক্ষ থেকে ক্ষমার ব্যবস্থা করে দেবেন।
আর যদি অর্থ-সম্পদ সংক্রান্ত জুলুম হয়ে থাকে, তবে সে যদি জীবিত থাকে এবং তাকে পাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তার যে পরিমাণ অর্থ সে আত্মসাৎ করেছে তা তাকে ফেরত দেবে। যদি সে মারা গিয়ে থাকে, তবে তার ওয়ারিশদের কাছে ফেরত দেবে। যদি তাকে বা তার ওয়ারিশদের কাউকেই না পাওয়া যায়, তবে তার নামে তা দান সদাকা করে দেবে। অর্থাৎ এই নিয়ত রাখবে যে, এর ছাওয়াব যেন সে ব্যক্তি পায়। এর বিস্তারিত মাসাইল বিজ্ঞ আলেমদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া চাই।
উল্লেখ্য, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের ওপরও নিজের হক আছে। যেমন এক হাদীছে বলা হয়েছেঃ- وإن لنفسك عليك حقا “নিশ্চয়ই তোমার ওপর তোমার নিজেরও হক আছে।
সুতরাং বান্দার হকের মধ্যে নিজের হকও শামিল। এ ক্ষেত্রে অবহেলাও জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। এমন কোনও কাজ করা জায়েয হবে না, যা দ্বারা নিজ জান, মাল ও ইজ্জত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর সর্বপ্রকার জুলুমই শেষটায় নিজ সত্তার ওপরই জুলুম। কেননা তাতে যে পাপ হয় তার খেসারত তো নিজেকেই দিতে হয়। তাই অন্ততপক্ষে নিজের ক্ষতি চিন্তা করেও সবরকম জুলুম থেকে বিরত থাকা উচিত।

এ হাদীছ দ্বারা হুকুকুল ইবাদ যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা অনুমান করা যায়। এখানে لتؤدن -এর আগে والله (আল্লাহর কসম) উহ্য আছে। এ কারণেই لتؤدن -এর শুরুতে তাকীদের ل (লাম) (যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা'আলার কসম করে বলছেন যে, কিয়ামতের দিন অবশ্যই আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেকের হক আদায় করিয়ে দেবেন। সেদিন কারও হক অনাদায় থাকবে না। দুনিয়ায় যদি কেউ কারও হক নষ্ট করে থাকে, তবে আখিরাতে তাকে তার বদলা দিতেই হবে। যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে তার পুরোপুরি বদলা পেয়ে যাবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আখিরাতে তো কোনও টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদের কারবার নেই, যারা মারা যায় তারা এর সবকিছুই দুনিয়ায় রেখে যায়, তাহলে সেদিন একে অন্যের হক কিভাবে আদায় করবে?
এর জবাব অন্য এক হাদীছে আছে। তাতে জানানো হয়েছে, সেদিন পরস্পরের পাওনা আদায় হবে প্রথমত নেকীর দ্বারা, তারপর পাপ দ্বারা। অর্থাৎ প্রথমত হকদারকে তার হকের বদলে হক নষ্টকারীর নেকী দিয়ে দেওয়া হবে। এভাবে হকদারদের হক আদায় করতে করতে যখন তার নেকী শেষ হয়ে যাবে, তখন তাদের হকের বদলে তাদের পাপ এ ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। এভাবে নিজের পাপের সাথে অন্যের পাপের বোঝা যোগ হয়ে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে যে, তার আর মুক্তির কোনও উপায় থাকবে না। ফলে জাহান্নামই হবে তার অবধারিত গন্তব্য।

মজলুমদের জন্য আশ্বাসবাণী

এটা যেমন হক নষ্টকারীর জন্য এক কঠিন সতর্কবাণী, তেমনি যাদের হক নষ্ট করা হয় সেই মজলূমদের জন্য এক আশ্বাসবাণীও বটে। কেননা দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। একদিন না একদিন শেষ হবেই হবে। কারও হক কোনওভাবে নষ্ট করা না হলে সে যে অনন্ত জীবন লাভ করবে এমন তো নয়। হাঁ এতটুকু কথা যে, হকসমূহ নষ্ট করা না হলে যতদিন বাঁচত ততদিন তার সুবিধা হত। হক নষ্ট হওয়ার ফলে সেই সুবিধাটুকু তার হল না। কিন্তু হক নষ্ট হওয়ার দ্বারা তার যে লাভ হবে, সে তুলনায় দুনিয়ার এ সুবিধা কিছুই নয়। কেননা তার যত হক নষ্ট করা হয়েছে, আখিরাতে এর বিনিময়ে সে বলতে গেলে প্রায় মুফতেই বিপুল ছাওয়াব পেয়ে যাবে। অসম্ভব নয় হয়তো তার নেকীর পাল্লায় কিছুটা টান ছিল, আর এ মুফতে পাওয়া নেকীর দ্বারা সেই টান পূর্ণ হয়ে গেল এবং এভাবে তার মুক্তির ব্যবস্থা হয়ে গেল। ভাবা যায় এটা কত বড় লাভ? এজন্যই কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, আখিরাতে পাওনাদারগণ আফসোস করে বলবে, আহা, দুনিয়ায় তার কোনও পাওনা যদি পরিশোধ না-ই করা হত!

হাশরে পশুদের পারস্পরিক জুলুমের বিচার

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হক আদায়ের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আমাদের জানান যে, মানুষ তো মানুষ, আখিরাতে এমনকি পশুদের মধ্যেও তাদের পারস্পরিক জুলুমের বিচার করা হবে। তাদেরও একের থেকে অন্যের হক আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে। দুনিয়ায় এক পশু যদি অন্য পশুর ওপর জুলুম করে থাকে, তবে সেদিন সেই জুলুমেরও প্রতিশোধ নিয়ে দেওয়া হবে।
হয়তো এক শিংওয়ালা ছাগল শিংবিহীন ছাগলকে খামোখা গুঁতো মারল । শিং না থাকায় দুর্বল ছাগলটি তার বদলা নিতে পারল না। এ অবস্থায় আখিরাতে শিংবিহীন ছাগলটিকে শিং দিয়ে দেওয়া হবে আর বলা হবে, তোমাকে যেমন গুঁতো মেরেছিল। তেমনি তাকেও গুঁতো মেরে দাও। সে সমযাত্রার গুঁতো তাকেও মারবে। তারপর তাদেরকে মাটি করে ফেলা হবে। এভাবেই তাদের বিচার শেষ হবে। তাদের জন্য জান্নাত-জাহান্নাম নেই। মানুষের বেলায় যেহেতু জান্নাত-জাহান্নাম আছে, তাই তাদের বদলা আঘাত ও প্রত্যাঘাতের দ্বারা হবে না; বরং তা হবে পাপ-পুণ্যের বিনিময় দ্বারা।
উল্লেখ্য, পশুপাখির এ বিচার পুরস্কার-শাস্তিদান হিসেবে নয়; বরং কিসাস ও বদলা হিসেবে করা হবে।
এর দ্বারা বোঝা গেল হাশর কেবল মানুষেরই হবে না; বরং পশু-পক্ষীরও হবে।
মৃত্যুর পর মানুষসহ সব প্রাণীকেই পুনর্জীবিত করে হাশরের ময়দানে একত্র করা হবে।তারপর বিচারকার্য সম্পন্ন করে অন্য সকলকে মাটিতে পরিণত করা হবে এবং মানুষ ও জিনদেরকে জান্নাত ও জাহান্নামের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এই যে পশুপাখির হাশর ও পুনরুত্থানের কথাটি বলা হল, এটি কুরআন মাজীদে সুস্পষ্টভাবেই জানানো হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ- وَإِذَا الْوُحُوشُ حُشِرَتْ ‘এবং যখন বন্য পশুসমূহ (হাশরে) একত্র করা হবে।
কুরআন-হাদীছ দ্বারা যখন স্পষ্টভাবেই তাদের হাশরের বিষয়টি জানা গেল, তখন এতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা বান্দার হক আদায়ের বিষয়টি যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা অনুমান করা যায়। সুতরাং আমরা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করব।

খ. যাদের কোনও হক কারও দ্বারা নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের উচিত আখিরাতে পুণ্য লাভের আশায় এ ব্যাপারে নমনীয়তা অবলম্বন করা।

গ. এ হাদীছ দ্বারা আখিরাত, পুনরুত্থান ও হাশরে বিচার সংঘটিত হওয়ার সত্যতা জানা যায়, যা ইসলামের একটি মৌলিক আকীদা।

ঘ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, আল্লাহ তা'আলা ন্যায়বিচারক। দুনিয়ায় কেউ কাউকে ঠকিয়ে নিস্তার পেলেও আখিরাতে সে বাঁচতে পারবে না। আল্লাহ তা'আলার আদালতে তাকে ন্যায়বিচারের সম্মুখীন হতেই হবে।

ঙ. আখিরাতে পশু-পাখিরও পুনরুত্থান ও বিচার হবে।

مرقات شرح مشکات :
"قال النووي: الجلحاء بالمد هي الجماء التي لا قرن لها، والقرناء ضدها، وهذا تصريح بحشر البهائم يوم القيامة وإعادتها كما يعاد أهل التكليف من الآدميين والأطالل والمجانين، ومن لم تبلغه دعوة، وعلى هذا تظاهرت دلائل القرآن والسنة. قال تعالى جل جلاله ولا إله غيره: {وإذا الوحوش حشرت} [التكوير: 5] وإذا ورد لفظ الشرع ولم يمنع من إجرائه على ظاهره شرع ولا عقل وجب حمله عن ظاهره قالوا: وليس من شرط الحشر والإعادة في القيامة المجازاة والعقاب والثواب، وأما القصاص من القرناء للجلحاء، فليس من قصاص التكليف، بل هو قصاص مقابلة اهـ. وفي كونه قصاص مقابلة نظر لا يخفى، مع أن قصاص المقابلة نحن مكلفون به أيضا.

قال ابن الملك أي: لو نطح شاة قرناء شاة جلحاء في الدنيا، فإذا كان يوم القيامة يؤخذ القرن من القرناء ويعطى الجلحاء حتى تقتص لنفسها من الشاة القرناء، فإن قيل: الشاة غير مكلفة، فكيف يقتص منها؟ قلنا: إن الله تعالى فعال لما يريد ولا يسأل عما يفعل، والغرض منه إعلام العباد بأن الحقوق لا تضيع، بل يقتص حق المظلوم من المظالم اهـ. وهو وجه حسن وتوجيه مستحسن إلا أن التعبير عن الحكمة بالغرض وقع في غير موضعه، وجملة الأمر أن القضية دالة بطريق المبالغة على كمال العدالة بين كافة المكلفين، فإنه إذا كان هذا حال الحيوانات الخارجة عن التكليف، فكيف بذوي العقول من الوضيع والشريف والقوي والضعيف؟ (رواه مسلم) : وفي الجامع بزيادة تنطحها. رواه أحمد ومسلم والبخاري في الأدب والترمذي."

(كتاب الآداب، باب الظلم، ج8، ص3203، دار الفكر)

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী
খতীব, রৌশন আলী মুন্সীবাড়ী জামে মসজিদ, ফেনী

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

১২৮৬৬

চা পাতা দিয়ে মেহেদী ব্যবহার করা


৯ জুলাই, ২০২৪

Chattogram

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৩৬০৬৯

অমুসলিমরা কি জাহান্নামে চিরকাল থাকবে?


৯ জুলাই, ২০২৩

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

২৮৮৪৪

دقائق الأخبار في ذكر الجنة والنار কিতাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা


১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

চট্টগ্রাম

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

১৪৬২৭

আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, Assalamuyalaikum, জান্নাতে কি ফাতিমা (রাঃ) কে দেখার সুযোগ হবে?

১৭ আগস্ট, ২০২২

Sydney

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy