আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

কুরআনে মোট কতটি ভাষার নাম উল্লেখ করা হয়

প্রশ্নঃ ৯০৫৬২. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, কুরআনে মোট কতটি ভাষার নাম উল্লেখ করা হয়,

২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

চাটখিল

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


প্রাচীনকালে আরবরা মূলত বেদুইন জীবনযাপন করত এবং তখন তারা সভ্যতা সম্পর্কে তেমন কিছু জানত না। এ কারণেই আরবি ভাষায় তলোয়ারের জন্য আশি-টিরও বেশি নাম রয়েছে, কিন্তু "هندسة" শব্দটির কোনো সরাসরি প্রতিশব্দ নেই, কারণ এটি ফারসি ভাষা থেকে গৃহীত হয়েছে। একইভাবে, "ترجم" অর্থবোধক কোনো আরবি ক্রিয়া নেই, এটি সিরিয়াক/সুরিয়ানী ভাষা থেকে ধার করা হয়েছে।

এ কারণে আরবরা প্রায়ই সভ্য জাতিগুলোর ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করত এবং সেগুলোকে আরবি উচ্চারণ ও রীতির সাথে মানানসই করে নিত।

কুরআনে অনারবী শব্দের উপস্থিতি
কুরআন ছিল প্রথম আরবি গ্রন্থ, তবে এতে বহু অনারবী (ভিনদেশি) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু শব্দ আগে থেকেই আরবি ভাষায় ব্যবহৃত ছিল, আবার কিছু শব্দ এমন ছিল, যা তখনকার আরব মুসলমানরাও পুরোপুরি বুঝতে পারত না। এ নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিশাল বিতর্কের সৃষ্টি হয়, কারণ তখনকার আরবি ভাষাবিদরা একাধিক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন না, ফলে ভিনদেশি শব্দগুলোর উৎপত্তি চিহ্নিত করতে গিয়ে তারা বিভ্রান্ত হন।

অনেক ক্ষেত্রে ভাষাবিদরা সিরিয়াক শব্দকে ফারসি বলে ভুল করতেন, নাবাতীয় শব্দকে হাবশি (ইথিওপীয়) মনে করতেন বা গ্রীক শব্দকে হিব্রু মনে করতেন। এই বিভ্রান্তিগুলো আজকের ভাষাবিদরা এড়িয়ে চলতে পারেন।

কুরআনে ভিনদেশি শব্দ থাকা নিয়ে বিতর্ক:

ইসলামী পণ্ডিত ও ভাষাবিদদের মধ্যে কুরআনে ভিনদেশি শব্দের উপস্থিতি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
যেমন ইমাম শাফি এবং ভাষাবিদ ইবনু ফারিস মনে করতেন, কুরআনে কোনো ভিনদেশি শব্দ নেই। তারা এই বিশ্বাসের সমর্থনে নিম্নলিখিত আয়াত দুটি উল্লেখ করেন:
"নিশ্চয়ই আমি এটি আরবি কুরআন হিসেবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।" (সূরা ইউসুফ: ২)

যদি আমরা এটিকে ভিনদেশি ভাষায় অবতীর্ণ করতাম, তবে তারা বলত—এর আয়াতগুলো স্পষ্ট করা হয়নি, এটা কি ভিনদেশি ভাষায় এবং (একই সাথে) আরবি? (সূরা ফুসসিলাত: ৪৪)

অন্যদিকে, আরেকটি দল মনে করে যে কুরআনে ভিনদেশি শব্দের উপস্থিতি রয়েছে। এই মতবাদে অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), যিনি কুরআনের ভাষা নিয়ে প্রথম গবেষণা করেছিলেন। তার লেখা "اللغات في القرآن الكريم" শীর্ষক গ্রন্থে ফারসি, নাবাতীয়, হাবশি ইত্যাদি ভাষার শব্দের উল্লেখ রয়েছে।

- পরবর্তীতে ইমাম মুকাতিল ইবনু সুলায়মান, "الأقسام واللغات কিতাবে, হিশাম ইবনু মুহাম্মাদ আল-কালবি এবং আল-হাইসম ইবনু আদি এই বিষয়ে গবেষণা করেন।

বিখ্যাত ৪জন ভাষাবিদ আল-ফাররা, আল-আস্মাঈ, আবু জাইদ আল-আনসারি ও ইবনু দরীদ কুরআনে ভিনদেশি শব্দের তালিকা তৈরি করেন। ইবনু দরীদ তার গ্রন্থ "جمهرة اللغة" তে এই বিষয়ে একটি অধ্যায় সংযোজন করেন।

- **ইবনু কুতাইবা তার বিখ্যাত গ্রন্থ "أدب الكاتب" للحديث عن الدخيل في اللغة العربية এ আরবি ভাষায় ভিনদেশি শব্দের প্রবেশ নিয়ে আলোচনা করেন।

কুরআনের ভিনদেশি শব্দ সংকলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল "المعرب من كلام العرب على حروف المعجم’’ যা লিখেছেন ভাষাবিদ আবু মনসুর আল-জাওয়ালিকি।

আরও একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল "المهذب فيما وقع في القرآن من المعرب" এটি লিখেছেন বিখ্যাত ভাষাবিদ **জালালুদ্দিন আস-সুয়ুতি।

কুরআনে ব্যবহৃত কিছু ভিনদেশি শব্দ
১- হিব্রু ভাষার শব্দ:
হিব্রু ভাষা থেকে আগত কিছু শব্দ হল:
শয়তান (شيطان) হিব্রু: *সাতান* (שָׂטָן) → অর্থ: শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী।
তান্নুর (تنّور) হিব্রু: *তান্নুর* (תַּנּוּר) → অর্থ: ওভেন বা চুলা।
মালাক (ملاك) হিব্রু: *মালাখ* (מַלְאָךְ) → অর্থ: ফেরেশতা।
জিহান্নাম (جهنم) হিব্রু: *গেই বেন হিনম* (גֵיא בֶן-הִנֹּם) → অর্থ: জাহান্নাম বা দোজখ।

২- সিরিয়াক (আরামিক) ভাষার শব্দ
সিরিয়াক ভাষা থেকে নেওয়া কিছু শব্দ:
জান্নাত (جنة) সিরিয়াক: *জান্না* →অর্থ: উদ্যান বা বাগান।
রহমান (رحمن) সিরিয়াক: *রাহমানা* → অর্থ: দয়ালু।
রুহুল কুদুস (روح القدس) সিরিয়াক: *রুহ কুদশা* → অর্থ: পবিত্র আত্মা।

৩- গ্রীক ভাষার শব্দ
কিছু গ্রীক শব্দ:
ইবলিস (إبليس) গ্রীক: *Diabolos* → অর্থ: মিথ্যাবাদী, নিন্দুক।
কাফুর (كافور) গ্রীক: *Kafoura* → অর্থ: সুগন্ধি গাছের নির্যাস।
মরজান (مرجان) গ্রীক: *Margaron* → অর্থ: প্রবাল।

৪-লাতিন ভাষার শব্দ
কিছু লাতিন শব্দ:
রোম (روم) লাতিন: *Romanum* → অর্থ: রোমান সাম্রাজ্য।
দিনার (دينار) লাতিন: *Denarium* → অর্থ: প্রাচীন রোমান মুদ্রা।
সিরাত (صراط) লাতিন: *Strata* → অর্থ: রাস্তা বা পথ।

৫-ফারসি ভাষার শব্দ
কিছু ফারসি শব্দ:
সিজ্জিল (سِجِّيل) ফারসি: *সাঙ্গ-গিল* → অর্থ: পাথর ও কাদা।
মিসক (مسك) ফারসি: *মিসক* → অর্থ: সুগন্ধি।

৬- হাবশি (ইথিওপীয়) ভাষার শব্দ
কিছু হাবশি শব্দ:
মিশকাত (مشكاة) হাবশি: *মিশকাত* → অর্থ: জানালা।
হাওয়ারি (حواري) হাবশি: *হাওয়ারিয়া* → অর্থ: শিষ্য বা দূত।

৭- নাবাতীয় ভাষার শব্দ
কিছু নাবাতীয় শব্দ:
ইসর (إصر) নাবাতীয়: *অঙ্গীকার বা চুক্তি*।
কুব (كوب) নাবাতীয়: *কাপ বা পাত্র*।

তবে, এই ভাষাগুলোর অধিকাংশই পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে—যেমন, বিভিন্ন জাতির নাম, স্থানের নাম বা ঐতিহাসিক ঘটনার মাধ্যমে। কুরআনের মূল ভাষা আরবি হলেও এতে অন্যান্য ভাষা থেকে নেওয়া কিছু শব্দও পাওয়া যায়।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী
খতীব, রৌশন আলী মুন্সীবাড়ী জামে মসজিদ, ফেনী

প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৬১৩৪১

রাসুলুল্লাহ সা. কবে থেকে নবী?


১৯ মে, ২০২৪

ঢাকা ১২০৮

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী

৪০৫৮৫

রুকুতে কি উভয় পায়ের টাখনু মিলিয়ে রাখা সুন্নত?


১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পটুয়াখালী

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৬১৮০৮

কেউ বলল আমি যাকে বিয়ে করব সে তালাক তাহলে করণীয় কি?


২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী আবু সাঈদ

৬৬৪৩৬

তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে ফেললে!


৪ জুলাই, ২০২৪

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি জাওয়াদ তাহের

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy