আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

তাবলীগ জামাতের সাথে 3দিন বা চিল্লায় যাওয়া কি বিদআত?

প্রশ্নঃ ৮৪৬১. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমি একটা ওয়াজ শুনেছি যেখানে বাংলাদেশী একজন আলেম কে জিজ্ঞাসা করা হলো , তাবলীগ জামাতের সাথে তিনদিন বা চিল্লায় যাওয়া কি বিদআত? উনি উত্তরে বললেন যে হা বিদআত! কোনো আলেম ছাড়া কেউ সাধারণ মানুষ যাতে না যায় । আমার প্রশ্ন হলো এইটা কি আসলেই বিদআত? যদি বিদআত হয় তাহলে তাদের কোন কাজ গুলা বিদআত হয় টা বলবেন।,

১৮ অক্টোবর, ২০২৩

মেঘনা

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


তাবলীগ জামাতের সাথে ৩ দিন বা চিল্লায় যাওয়া মোটেও বিদআত হিসেবে গন্য হবে না।
আসলে তাবলীগ জামাতে চিল্লাকে কোন শরয়ী বিধান বলা হয় না। একথাও বলা হয় না যে, এটি রাসূল সাঃ থেকে প্রমানিত কোন সুন্নত। বরং এটি দ্বীনভোলা সাধারণ মুসলমানদের প্রশিক্ষণের জন্য নির্ধারিত একটি কোর্স মাত্র। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্বীন বা দুনিয়াবী শিক্ষা অর্জনের জন্য ১২বছর বা ১৪বছর এমন কোর্স চালু করা হয়েছে। এমনকি মাদরাসায়ও এমন পদ্ধতি প্রচলিত। গোটা বিশ্বের দ্বীনী প্রতিষ্ঠানেই এমন সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালার আলোকে পরিচালিত হয়। সুনির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করা বা অবস্থান নেয়া বা প্রশিক্ষণ নেয়ার দ্বারা ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার সার্টিফিকেট দেয়া হয়।

এসব কোনটিই রাসূল সাঃ থেকে প্রমানিত বিষয় নয়। আবার বিদআতও নয়। কারণ এসব পদ্ধতিকে কেউ সুন্নতও বলে না। সেই সাথে এই সংখ্যাটিতে সওয়াব জড়িতও বলা হয় না। বরং প্রশিক্ষণের সুবিধার্তে তা নির্ধারণ করা হয়েছে।

যদি তাবলীগের চিল্লা পদ্ধতি বিদআত হয়, তাহলে মক্কা মদীনা ভার্সিটিসহ পৃথিবীর সকল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দ্বীনী কোর্স সম্পন্ন করার সময়সীমাও বিদআত হবে। কিন্তু কোন ব্যক্তি কি এমন আহমকী প্রশ্ন করে? যদি না করে তাহলে তাবলীগের চিল্লা নিয়ে কেন এ অহেতুক প্রশ্ন?

ইসলামী দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ যোগ্যতা অর্জনের জন্য যে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এর কোন দূরতম প্রমাণও কুরআনও হাদীসের কোথাও নেই। অথচ তাবলীগের চিল্লার খানিক হলেও প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে।

তাবলীগ জামাতের চিল্লার হিকমত

চল্লিশ দিন পর্যন্ত লাগাতার কোন আমল করলে এর দ্বারা মানুষের আত্মিক অনেক পরিবর্তন সাধিত হয় মর্মে জানা যায়। সেই সাথে এই চল্লিশ সংখ্যাটিও ইসলামী শরীয়তে আলাদা বৈষিষ্টমন্ডিত। এ কারণে কোন সাধনার জন্য এ চল্লিশ সংখ্যাটি আলাদা বৈষিষ্টে রাখে। কয়েকটি দলীল-



الَ عَبْدُ اللَّهِ: حَدَّثَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ الصَّادِقُ المَصْدُوقُ، قَالَ: ” إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ فِي بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا، ثُمَّ يَكُونُ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يَكُونُ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يَبْعَثُ اللَّهُ مَلَكًا فَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ،

হযরত যায়দ বিন ওহাব রাঃ থেকে বর্ণিত। হযরত আব্দুল্লাহ রাঃ বলেন, সত্যবাদীরূপে স্বীকৃত রাসূল সাঃ আমাদের কাছে হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, নিশ্চয় তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপকরণ নিজ নিজ মাতৃগর্ভে চল্লিশ দিন পর্যন্ত বীর্যরূপে অবস্থান করে, এরপর তা জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়। অনুরূপভাবে চল্লিশ দিন অবস্থান করে। এরপর তা মাংসপিন্ডে পরিণত হয়ে [আগের মত চল্লিশ দিন] থাকে। এরপর আল্লাহ তাআলা ফিরিশতা প্রেরণ করেন। আর তাকে চারটি বিষয় নির্দেশ দেয়া হয়। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩২০৮, ৩০৩৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৬৪৩}

উক্ত হাদীসটিতে লক্ষ্য করুন। মানুষের শারিরিক গঠনপ্রণালীর এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় পরিবর্তিত হতে সময় নির্দিষ্ট হল ৪০দিন। অর্থাৎ এক সূরত থেকে আরেক সূরতে পরিবর্তন হয় ৪০দিনে। এভাবে তিনটি স্তর পেরোতে হয় ৪০দিন করে করে।

এর দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, ৪০দিনে একটি ব্যক্তির মানসিক পরিবর্তন হতে পারে। যেমন জন্মলগ্নের স্তরগুলোতে পরিবর্তিত হয়েছিল।

এমনিভাবে আরেক হাদীসে এসেছে-

عَنْ حُذَيْفَةَ بْنِ أَسِيدٍ الْغِفَارِيِّ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَوْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” يَدْخُلُ الْمَلَكُ عَلَى النُّطْفَةِ بَعْدَمَا تَسْتَقِرُّ فِي الرَّحِمِ بِأَرْبَعِينَ لَيْلَةً – وَقَالَ سُفْيَانُ مَرَّةً: أَوْ خَمْسٍ وَأَرْبَعِينَ لَيْلَةً – فَيَقُولُ: يَا رَبِّ، مَاذَا أَشَقِيٌّ أَمْ سَعِيدٌ؟ أَذَكَرٌ أَمْ أُنْثَى؟ فَيَقُولُ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى، فَيَكْتُبَانِ، فَيَقُولَانِ: مَاذَا؟ أَذَكَرٌ أَمْ أُنْثَى؟ فَيَقُولُ

মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৬১৪২, মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীস নং-৮৪৮, আলমুজামুল কাবীর, হাদীস নং-৩০৩৯}



আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা আঃ থেকে ৪০দিনের ওয়াদা নিয়েছিলে। ইরশাদ হচ্ছে-

وَإِذْ وَاعَدْنَا مُوسَى أَرْبَعِينَ لَيْلَةً

আর যখন তিনি মুসা থেকে চল্লিশ দিনের ওয়াদা নিলেন। {সূরা বাকারা-৫১}

ইমাম কুরতুবী রহঃ বলেন,

وبهذا استدل الصوفية على الوصال وان أفضله أربعون يوما الخ ((تفسيرالقرطبي ج ۱ ص ۳۹۶))



عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ صَلَّى لِلَّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا فِي جَمَاعَةٍ يُدْرِكُ التَّكْبِيرَةَ الأُولَى كُتِبَ لَهُ بَرَاءَتَانِ: بَرَاءَةٌ مِنَ النَّارِ، وَبَرَاءَةٌ مِنَ النِّفَاقِ.

হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি লাগাতার চল্লিশ দিন জামাতের সাথে তাকবীর উলার সাথে নামায পড়বে। তার জন্য দু’টি মুক্তির খোশখবরী রয়েছে। একটি হল জাহান্নাম থেকে মুক্তি আরেকটি হল মুনাফিকী থেকে মুক্তি। {সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৪১, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং-২০২৫৩}

কাছাকাছি বক্তব্য নির্ভর আরেক হাদীসে এসেছে-

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ: «مَنْ صَلَّى فِي مَسْجِدٍ جَمَاعَةً أَرْبَعِينَ لَيْلَةً، لَا تَفُوتُهُ الرَّكْعَةُ الْأُولَى مِنْ صَلَاةِ الْعِشَاءِ، كَتَبَ اللَّهُ لَهُ بِهَا عِتْقًا مِنَ النَّارِ»

সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৭৯৮, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-২৬১৬।

উল্লেখিত হাদীসের আলোকে একতা স্পষ্ট যে, চল্লিশ দিনের একটি আলাদা বৈশিষ্ট আছে মানুষের মন-মানসিকতা পরিবর্তনের উপর। যেহেতু দ্বীনভোলা মানুষগুলোর মন বিগড়ে গেছে। দিনের পর দিন গোনাহ করতে করতে মন গোনাহে নাপাক হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর ইবাদতের মজা মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে উঠে যেতে বসেছে। এ কারণে এসব আত্মভোলা দ্বীনভোলা মানুষকে চল্লিশ দিনের চিল্লায় পাঠিয়ে লাগাতার চল্লিশ দিন তাকবীরে উলার সাথে নামায পড়ানোর মাধ্যমে যেন তাদের মাঝে আত্মিক পরিবর্তন আসে। তাদের মাঝে যেন মানসিক পরিবর্তন আসে, এ কারণে চল্লিশ দিনের চিল্লা দেয়া হয়। এটিকে শরয়ী কোন দলীল মনে করে করা হয় না। কেবলি হাদীসে বর্ণিত বৈশিষ্টের কারণে ওসীলা হিসেবে তা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। আর নেক আমলের উসীলার বৈধতার প্রমাণ স্বতসিদ্ধ।

হাদীসের ভাষায় বিদআতঃ

عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ

হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-আমাদের দ্বীনের মাঝে যে ব্যক্তি নতুন বিষয় আবিস্কার করে যা তাতে নেই তাহলে তা পরিত্যাজ্য। {সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৬০৮, সহীহ বুখারী, হাদিস নং-২৫৫০, সহীহ মুসলিম-৪৫৮৯}

এই হাদিসে লক্ষ্য করুন কি কি শর্তে নব আবিস্কৃত বস্তুকে পরিত্যাজ্য বলেছেন নবীজী সাঃ।

১-সম্পূর্ণ নতুন বিষয়। যার কোন সামান্যতম প্রমাণ নবীযুগে বা সাহাবা যুগে নাই এমন বিষয় হতে হবে।
২-দ্বীনী বিষয় হতে হবে। সুতরাং দ্বীনী বিষয় ছাড়া যত নতুন বিষয়ই আবিস্কারই হোকনা কেন তা বিদআত নয়। যেমন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার। নতুন নতুন আসবাব ইত্যাদী। এসব বিদআত নয়। কারণ এসব দ্বীনী বিষয় নয়। বরং বৈষয়িক বিষয়।
৩-দ্বীনের মাঝে নতুন আবিস্কার হতে হবে। দ্বীনের জন্য হলে সমস্যা নাই। কারণ দ্বীনের মাঝে নতুন আবিস্কার মানে হল এটা সওয়াবের কাজ। সুন্নাত, ওয়াজিব ইত্যাদী। আর দ্বীনের জন্য হলে সেটা মূলত সওয়াবের কাজ নয়, বরং সওয়াবের কাজের সহায়ক। যেমন মাদরাসা শিক্ষা একাডেমিক পদ্ধতি নববী যুগে ছিলনা। পরবর্তীতে আবিস্কার করা হয়েছে। এই একাডেমিক পদ্ধতিটি দ্বীনের মাঝে নতুন আবিস্কার নয়, বরং দ্বীনী কাজের জন্য সহায়ক হিসেবে আবিস্কার হয়েছে। অর্থাৎ দ্বীন শিখার সহায়ক। আর দ্বীন শিখাটা সওয়াবের কাজ। কিন্তু সিষ্টেমটা মূলত সওয়াবের কাজ নয় বরং সহায়ক। তেমনি তাবলীগের বর্তমান পদ্ধতিটি ইলিয়াস রহঃ আবিস্কার করেছেন দ্বীন প্রচারের সহায়ক হিসেবে। তথা দ্বীনের জন্য আবিস্কার। দ্বীন মাঝে আবিস্কার নয়। তাই এটি বিদআত হওয়ার কোন সুযোগই নেই।
যারা বলেন এ পদ্ধতি বিদআত, তারা মূলত দ্বীন সম্পর্কে চূড়ান্ত অজ্ঞতার পরিচয় দেন এসব কথা বলে।

তাবলীগ জামাআতের কাজ যেহেতু রাসূল সাঃ ও পরবর্তী সাহাবায়ে কিরামের প্রচার করা দ্বীন প্রচারেরই একটি সুসংহত রূপ মাত্র। তাই তাবলীগ জামাআতের কাজের সাথে সেসব ফযীলত শামিল হবে যা কুরআন সুন্নাহে বর্ণিত দ্বীন প্রচারের ফযীলত।

তাবলীগের চল্লিশ দিনের চিল্লা বিদআত হলে প্রথমে বিদআত হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোর্সের দলীলহীন সময়সীমা নির্ধারণ। সেসব যদি বিদআত না হয়, তাহলে চল্লিশ দিনের আলাদা বৈশিষ্ট সম্বলিত হাদীসে পাকে দলীল থাকা সত্বেও চিল্লা কি করে বিদআত হয়?

আল্লাহ্‌ তাআলা আমাদের বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করেন।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

২৬৭৭১

নির্বাচন ও ভোটের শরঈ বিধান


১৯ ডিসেম্বর, ২০২২

বনপাড়া

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

১৮৫১৫

মুনকিরীনে হাদিস: প্রতারিত হবে না


২ মে, ২০২৪

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

১৪৬৯৮

আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, পাকপাঞ্জতন সম্পর্কে জানতে চাই, জানালে কৃতজ্ঞ থাকিব।

১২ মার্চ, ২০২২

N১০৫

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy