আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

মসজিদে খাবার খাওয়া কি জায়েজ?

প্রশ্নঃ ৮৪৪৫. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, মসজিদে খাবার খাওয়া কি জায়েজ?,

১৩ জানুয়ারী, ২০২৪

Kolkata

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


মসজিদে খাবার গ্রহণের ব্যাপারে হাদিস শরিফে এসেছে, আবদুল্লাহ বিন হারেস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মসজিদে রুটি ও গোশত খেতাম।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বর : ২৬৬৯)।

অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক কর্তিত খেজুর থেকে ডালাসহ মিসকিনদের জন্য ১০ উসুক (১,৩০৪.১৬ কিলোগ্রাম) মসজিদে লটকিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর : ১৪৬৪)।

এ ছাড়া অসংখ্য হাদিস থেকে জানা যায়, আসহাবুস সুফফার শিক্ষার্থীরা মসজিদে থাকতেন। তাঁরা মসজিদে পানাহার করতেন। তা ছাড়া তাবুক যুদ্ধের পর তিন ব্যক্তিকে মসজিদে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তাঁদের জন্য মসজিদেই পানাহারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাঁদের ঘটনা সুরা তওবার ১১৭ ও ১১৮ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আর ইতিকাফের সময় তো মসজিদে খাওয়া-দাওয়া করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

এসব বিবরণ থেকে জানা যায়, মসজিদে প্রয়োজনে পানাহার করা যাবে। তবে সেটি শর্তহীন নয়। মসজিদে পানাহারের জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। সুতরাং আদব রক্ষা করে মসজিদে পানাহার করা যাবে। আর মসজিদে ইফতার বৈধ হওয়ার ব্যাপারে পৃথিবীর কোনো আলেমের দ্বিমত নেই। তবে হ্যাঁ, সেটাও করতে হবে মসজিদের আদব রক্ষা করে।

মসজিদে পানাহার করার শর্তসমূহ

১. দাঁড়িয়ে পানাহার করা যাবে না। হাদিস শরিফে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যেন দাঁড়িয়ে পান না করে...।’ (মুসলিম শরিফ)

২. মসজিদে দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু যেমন—পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি প্রবেশ করানো নিষিদ্ধ। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এই দুর্গন্ধযুক্ত বৃক্ষ (পেঁয়াজ, রসুন) থেকে খাবার গ্রহণ করবে, সে যেন আমার মসজিদে না আসে।’ (বুখারি, হাদিস : ৮৫৩)

৩. মসজিদে এমন শব্দ করে খাওয়া যাবে না বা এমন জোরে কথা বলা যাবে না, যার ফলে অন্যের নামাজ ও তাসবিহের ক্ষতি হয়। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর মসজিদে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং তাঁর বিনাশসাধনের চেষ্টা করে, তার চেয়ে বড় জালিম আর কে? অথচ ভয়-বিহ্বল না হয়ে তাদের জন্য মসজিদে প্রবেশ করা সংগত ছিল না। পৃথিবীতে তাদের জন্য লাঞ্ছনা ভোগ ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১১৪)

৪. মসজিদে খাবার খেতে গিয়ে মসজিদকে অপরিচ্ছন্ন করা যাবে না। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘরসমূহে (মহল্লায়) মসজিদ নির্মাণ করতে বলেছেন এবং সেগুলোকে পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধিযুক্ত রাখতে বলেছেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর : ৪৫৫; তিরমিজি, হাদিস নম্বর : ৫৯৪)

বিশিষ্ট তাবেয়ীদের অভিমত :
১. হারেস ইবনে আব্দুর রহমান রহ. বলেন, আমি সুলাইমান ইবনে ইয়াসার রহ. কে মসজিদে ঘুমানো সর্ম্পকে জিজ্ঞাসা করলাম । তখন তিনি বললেন, কিভাবে তুমি আমাকে এ সর্ম্পকে জিজ্ঞাসা করছো , অথচ আসহাবে সুফফারা মসজিদে ঘুমাতেন এবং সেখানেই নামাজ পড়তেন ।[মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা , হাদীস নং ৪৯৪৭]

২. ইউনুস রহ. বলেন, আমি ইবনে সীরীন রহ. কে মসজিদে ঘুমাতে দেখেছি ।[প্রগুক্ত হাদীস নং ৪৯৪৮]
৩.হাসান বছরী রহ. তার মসজিদে নামাজ পড়তেন এবং সেখানে ঘুমাতেনও ।[প্রাগুক্ত হাদীস নং ৪৯৪৯]
৪. ইবনে জুরাইজ রহ. বলনে , আমি আতা ইবনে আবি রবাহ রহ. কে জিজ্ঞাসা করলাম , আপনি কি মসজিদে ঘুমানো মাকরূহ মনে করেন ? তিনি বললেন, না বরং আমি তা পছন্দ করি ।[প্রাগুক্ত ,হাদীস নং ৪৯৫৩]
৫. মুগিরা ইবনে যিয়াদ রহ. বলেন , আমি মসজিদুল হারামে ঘুমাতাম । কিন্তু রাত্রে আমার একাধিকবার স্বপ্নদোষ হত । তাই আমি আতা ইবনে আবি রবাহ রহ. কে জিজ্ঞাসা করলাম , তখন তিনি বললেন, ঘুমাও , যদিও তোমার দশবার স্বপ্নদোষ হয় ।[প্রাগুক্ত , হাদীস নং ৪৯৫৭]
৬. সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ. কে মসজিদে ঘুমানো প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, তাহলে আসহাবে সুফফারা কোথায় ঘুমাতো ? র্অথাৎ মসজিদেই তো ঘুমাতো ।[প্রাগুক্ত , হাদীস নং ৪৯৫৮]
৭.ইবনে আবি নাজীহ রহ. বলনে , আমি মসজিদুল হারামে ঘুমালাম কিন্তু আমার স্বপ্নদোষ হলো , তাই আমি সাঈদ ইবনে জোবায়ের রা. কে জিজ্ঞাসা করলাম । তিনি বললেন, যাও গােসল করে আসো । র্অথাৎ তিনি নিষেধ করলেন না ।[প্রাগুক্ত , হাদীস নং ৪৯৫৯]
৮. ইমাম তাবারী রহ. হাসান বছরী রহ. থেকে র্বণনা করেন , তিনি বলেন‚ আমি উসমান ইবনে আফফান রা. কে একাকী মসজিদে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি , তার আশপাশে কেউ ছিলো না অথচ তিনি আমীরুল মু‘মিনীন ! তিনি বলেন, সালাফের একটি জামাত কোন প্রকার ওজর ছাড়াই মসজিদে ঘুমাতেন এবং সেখানে পানাহার , ঘুম ইত্যাদি সেরে নিতেন ।[উমদাতুল কারী :৩/৩৬২]

চার মাজহাবের দৃষ্টিতে মসজিদে পানাহারের প্রসঙ্গ

হাম্বলি মাজহাব মতে, মসজিদে পানাহারে কোনো অসুবিধা নেই। হাম্বলি মাজহাবের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘কাশশাফুল কানায়ি আন মাতনিল ইকনায়ি’ গ্রন্থে রয়েছে, ‘মসজিদে ইতিকাফকারী ও ইতিকাফহীন মানুষের জন্য পানাহার করা বৈধ। কেননা আবদুল্লাহ বিন হারেস (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে মসজিদে রুটি ও গোশত খেতাম।’ সুতরাং মসজিদে পানাহার করতে কোনো অসুবিধা নেই।

একইভাবে শাফেয়ি মাজহাব মতে, মসজিদে পানাহার করা বৈধ। এ বিষয়ে ইমাম নববী (রহ.) তাঁর ‘আল-মাজমু ফিল ফিকহিশ শাফেয়ি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মসজিদে খাওয়া, পান করা ও দস্তরখানা বিছানো বৈধ।’

তবে মালেকি মাজহাবে এ বিষয়ে পার্থক্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মসজিদে শুকনো খাবার খেতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে সাধারণ খাবার, তরল খাবার বা ভিজানো খাবার খাওয়া জায়েজ নেই।

ইমাম বাজি (রহ.) মুআত্তা ইমাম মালেকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আল-মুনতাকা’র ভেতর লিখেছেন, ‘মাবসুত’ নামক কিতাবে রয়েছে, ইমাম মালেক (রহ.) মসজিদে পানাহার করাকে মাকরুহ বলেছেন।

মালেকি মাজহাবের প্রসিদ্ধ আলেম ইবনুল কাসিম বলেন, মসজিদে শুকনো খাবার খেতে কোনো অসুবিধা নেই।

হানাফি মাজহাব মতে, মসজিদে ইফতার ও পানাহার বৈধ হলেও ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করে ইফতার ও পানাহার করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

হানাফি মাজহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল-ফাতাওয়াল হিন্দিয়া’য় (ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি) উদ্ধৃত হয়েছে, বিশুদ্ধ মত অনুসারে মুসাফির ও স্থানীয় সবার জন্যই মসজিদে পানাহার ও ঘুমানো জায়েজ। তবে উত্তম হলো বিনা প্রয়োজনে না ঘুমানো এবং না খাওয়া। বিষয়টি আরো বিস্তারিতভাবে অন্যত্র এভাবে এসেছে,

ইতিকাফের নিয়ত ছাড়া মসজিদে ঘুমানো ও খাওয়া-দাওয়া করা মাকরুহ। তাই যদি কেউ মসজিদে ঘুমাতে বা খাওয়া-দাওয়া করতে চায়, তার জন্য উচিত হলো ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করে ইচ্ছানুসারে আল্লাহর জিকির অথবা নামাজ পড়ে নেওয়া। এরপর অন্য কাজ করবে। (ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি)

হানাফি মাজহাবের অন্য কিতাবে এসেছে, শুধু খেজুর ও পানি দ্বারা ইফতার করাতে অসুবিধা নেই। (রদ্দুল মুহতার : ২/৪৪৯, আহসানুল ফাতাওয়া : ৬/৪৫)

এসব বিবরণ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে মসজিদে শর্তসাপেক্ষে পানাহার করা বৈধ।এর ওপর ভিত্তি করে র্বতমান গোটা বিশ্বে প্রচলিত তাবলিগী জামাতের ভাইদেরও মসজিদে পানাহার করা ও ঘুমানোর অবকাশ প্রমাণিত হয় ।মসজিদে ইফতার ও পানাহার করার ক্ষেত্রে অবশ্যই মসজিদের আদব রক্ষা করা জরুরি।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

১৩৫৮৯

হিন্দু হোটেলে খাবার খাওয়া কি জায়েজ?


২৭ অক্টোবর, ২০২৩

Dhaka ১২১২

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

২৪৬৬৩

মদের খালি বতল পরিষ্কার করে সেই বতল পরবর্তীতে পানী পান করা


২ নভেম্বর, ২০২২

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি মোহাম্মদ আমীর হোসাইন

১২৯৭৪

ফার্স্টফুড, জাঙ্ক ফুডের বিধান


২৯ নভেম্বর, ২০২৪

মাঝিরা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy