আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

ইসলামের পোশাকনীতি

প্রশ্নঃ ৭৯৫৭. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ছেলেদের ও মেয়েদের জন্য কোন কালার কাপড় পড়া হারাম?,

২১ নভেম্বর, ২০২৪

ঢাকা

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের দিক-নির্দেশনা রয়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয়েও ইসলামের মৌলিক দিক নির্দেশনা রয়েছে।
এখানে পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা করতে চাই। এ সম্পর্কে সমাজে যেসব ভুলভ্রান্তি ও শিথিলতা লক্ষ করা যায় তার পিছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় এই :

১. অজ্ঞতা ও অবহেলা

এ বিষয়ে শরীয়তের কী কী মূলনীতি ও বিধান রয়েছে সে সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই জানাশোনা নেই। উপরন্তু অনেকের এই ধারণাই নেই যে, পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কেও শরীয়তের বিধিবিধান থাকতে পারে। একে তারা পুরোপুরিই ইচ্ছা-স্বাধীনতার বিষয় মনে করে। এই ধারণা ঠিক নয়। শরীয়ত এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। কুরআন কারীম এবং হাদীস শরীফে এ সম্পর্কিত উসূল ও আহকাম তথা নীতি ও বিধান রয়েছে। একই সঙ্গে মানুষের রুচি ও স্বভাবের প্রতিও একটা পর্যায় পর্যন্ত শরীয়ত অনুমোদন দিয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে একেবারে উদাসীন থাকা, মনমতো চলা ভুল।

২. বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ ও ফ্যাশন-আসক্তি

পোশাক-আশাক ও সাজসজ্জার বিষয়ে সমাজে বিজাতীয় সংস্কৃতি ও ফ্যাশনের বড় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যখন যে ফ্যাশন বের হচ্ছে তখন নির্বিচারে অনুকরণকেই ‘আধুনিকতা’ মনে করা হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে অমুসলিম বা ফাসেক লোকদের রীতি-নীতিই অধিক অনুকরণীয় হতে দেখা যায়। এসবই ভুল। বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুকরণ শরীয়তের দৃষ্টিতে অত্যন্ত ঘৃণিত। হাদীস শরীফে এসেছে-‘যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখে সে তাদের দলভুক্ত।’ (সুনানে আবু দাউদ ২/৫৫৯)

‘মন ভালো হওয়াই যথেষ্ট’

যারা পোশাক ও সাজসজ্জার বিষয়ে মনমতো চলতে চায় কিংবা বিজাতীয়দের অনুকরণ করতে পছন্দ করে তারা তাদের দুর্বলতা ঢাকতে গিয়ে বলে থাকেন, ‘মন ভালো হওয়াই যথেষ্ট। বাইরের লেবাস-পোশাকে কী আসে যায়?’ এভাবে তারা ইসলামের শিক্ষাকে খাটো করতে চায়। অনেক সময় দেখা যায়, ইসলামী পোশাকধারী কোনো ব্যক্তির কোনো ভুল হয়ে গেলে তখন তারা এই সব কথা বড় গলায় বলতে থাকে। এসব ভুল।

ভিতর ও বাহির দু’টোর প্রতিই ইসলামে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কুরআন মজীদে এসেছে, ‘তোমরা প্রকাশ্য গুনাহ ছাড় এবং আভ্যন্তরীণ গুনাহ ছাড়।’ (সূরা আনআম : ১২০)

কারো মধ্যে যদি কোনো দোষ থাকে তাহলে অবশ্যই তা দোষ, কিন্তু একে ছুতো বানিয়ে তার গুণটাকে অস্বীকার করা তো ভালো নয়।

মোটকথা, ইসলামে লেবাস-পোশাকের গুরুত্ব কম নয়। পোশাক-পরিচ্ছদ যদিও বাহ্যিক বিষয়, মানুষের সকল ভালো-মন্দের দলীল এটা নয়, কিন্তু একথাও তো অনস্বীকার্য যে, লেবাস-পোশাকেরও একটি বড় প্রভাব মানুষের স্বভাব ও আচরণের উপর পড়ে থাকে। এটা কি অস্বীকার করা যাবে যে, কিছু পোশাক অন্তরে অহংকার ও আত্মগরিমা সৃষ্টি করে, অন্যদিকে কিছু পোশাক বিনয় ও নম্রতা জাগ্রত করে? কিছু পোশাক ভালো কাজে ও ভালো ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যদিকে কিছু পোশাক মন্দ ও অকল্যাণের দিকে আকর্ষণ করে?

দ্বীনদার শ্রেণীর পোশাককে ‘সম্প্রদায়িক’ পোশাক মনে করা

অনেকে ইসলামী পোশাককে সৌদী, পাকিস্তানী বা হুজুরদের ইউনিফর্ম মনে করে থাকে। ফলে নামায-রোযা ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগী করলেও তারা এই পোশাক গ্রহণ করতে পারেন না। তাদের এ ধারণা ভুল। সামান্য চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, ইসলামসম্মত পোশাক মানে কোনো সাম্প্রদায়িক বা আঞ্চলিক পোশাক নয়। হ্যাঁ, তা মুসলমানের পোশাক বটে।

পোশাক সম্পর্কে ইসলামী নীতিমালা

এই জ্ঞানের অভাবে অনেকে সঠিক পোশাক অবলম্বন করতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে কিছু নীতি ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা নারী-পুরুষ সকলের জন্য প্রযোজ্য। আবার কিছু স্বতন্ত্র বিষয়ও রয়েছে। প্রথমে সাধারণ কিছু নীতি উল্লেখ করছি।

১. সতর আবৃত করা

পোশাক এমন হতে হবে যা পুরোপুরি সতর আবৃত করে। পুরুষের জন্য নাভি থেকে হাটুর নিচ পর্যন্ত আর নারীর পুরো শরীর সতর। পোশাকের প্রধান উদ্দেশ্যই হল সতর ঢাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বনী আদম! আমি তোমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছি পোশাক, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং সৌন্দর্য দান করে।’ (সূরা আ’রাফ ২৬)

সুতরাং যে পোশাক এই উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ তা যেন শরীয়তের দৃষ্টিতে পোশাকই নয়। তা নাজায়েয পোশাক। এটা পরিত্যাগ করে পূর্ণরূপে সতর আবৃত করে এমন পোশাক গ্রহণ করা জরুরি। যেমন পুরুষের জন্য হাফ প্যান্ট পরা। মহিলাদের পেট-পিঠ উন্মুক্ত থাকে এমন পোশাক পরিধান করা।

২. অধিক পাতলা বা আঁটশাট না হওয়া

যে পোশাক পরিধানের পরও সতর দেখা যায় কিংবা সতরের আকৃতি পোশাকের উপরে ফুটে উঠে তা-ও সতর আবৃত না করার কারণে নাজায়েয পোশাকের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের পোশাক পরিধান করা হারাম।

৩. বিধর্মীদের পোশাক না হওয়া

বিধর্মীদের অনুকরণে পোশাক পরিধান করা নাজায়েয। যেমন ইহুদী-খৃষ্টান পুরোহিতদের পোশাক। হিন্দুদের ধুতি-লেংটি, মাজার পূজারীদের লালশালু এবং শিয়াদের অনুকরণে পূর্ণ কালো পোশাক ইত্যাদি। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই এটি কাফেরদের পোশাক। তোমরা তা পরিধান করো না।’ (সহীহ মুসলিম ৬/১৪৪; মুসতাদরাকে হাকেম ৪/১৯০)

অন্য এক হাদীসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তাদের পোশাক পরবে সে আমার দলভুক্ত নয়। (তবারানী আওসাত ৩৯২১; ফাতহুল বারী ১০/২৮৪)

৪. অহংকার-বড়ত্ব-রিয়া সৃষ্টিকারী পোশাক না হওয়া

এমন পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধ, যেগুলোকে শরীয়ত অহংকারীদের নিদর্শন সাব্যস্ত করেছে এবং তা পরিধান করতে নিষেধ করেছে। যেমন পুরুষের জন্য রেশমী কাপড় ব্যবহার করা। হযরত আবু মুসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-আমার উম্মতের পুরুষের জন্য রেশম এবং স্বর্ণ হারাম করা হয়েছে। আর মহিলাদের জন্য এগুলো হালাল করা হয়েছে। (জামে তিরমিযী ১/৩০২ হাদীস ২৭৯) তদ্রূপ টাখনু গিরার নিচে কাপড় পরিধান করা।

হযরত আবু জুরাই থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, টাখনু গিরার নিচে কাপড় পরিধান থেকে বিরত থাক। কেননা এটা অহংকারবশত হয়ে থাকে। আর আল্লাহ তাআলা অহংকারীকে ভালবাসেন না। (সুনানে আবু দাউদ ২/৫৬৪ হাদীস ২৭৫; মুসনাদে আহমদ ৫/৬৩ হাদীস ২৪১৯)

৬. প্রসিদ্ধির পোশাক না হওয়া

মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধি পাওয়ার লক্ষ্যে পোশাক নির্বাচন করা, পোশাকের ভিন্নতা ও চাকচিক্য এজন্য বেছে নেওয়া যেন লোকসমাজে সে প্রসিদ্ধি পায়। এককথায় মানুষের নিকট আলোচিত ও প্রসিদ্ধ হওয়ার নিয়তে পোশাক গ্রহণ করা জায়েয নয়। হাদীস শরীফে এ ব্যাপারে কঠিন ধমকি এসেছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধির পোশাক পরবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন। অতঃপর তাকে অগ্নিদগ্ধ করা হবে। (সুনানে আবু দাউদ ৪০২৯; আততারগীব ৩/১১২)

পুরুষের পোশাকের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য

ক) নারীর পোশাক বা নারীর পোশকের মতো পোশাক না হওয়া।

হাদীস শরীফে এসেছে-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন ঐ পুরুষকে যে মহিলার পোশাক পরে এবং ঐ মহিলাকে যে পুরুষের পোশাক পরে। (সুনানে আবু দাউদ ৪০৯৮; মুসনাদে আহমদ ২/৩২৫)

সুতরাং পুরুষের জন্য মেয়েদের পোশাক পরিধান করা হারাম।

খ) রেশমের কাপড় পরিধান না করা। কেননা রেশমের কাপড় পুরুষের জন্য হারাম।এটি পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য। নারীদের জন্য রেশমি কাপড় পরিধান করা বৈধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন : ‘আমার উম্মতের মধ্যে পুরুষদের জন্য রেশমি কাপড় এবং স্বর্ণ ব্যবহার করা হারাম; কিন্তু নারীদের জন্য তা হালাল।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৭২০)

গ) জাফরানী রংয়ের কাপড় না হওয়া। এটা পুরুষের জন্য নাজায়েয।

ঘ) কুসুম রং কিংবা গাঢ় লাল রং না হওয়া। কেননা কুসুম রং মাকরূহ তাহরীমী। আর লাল রং মাকরূহ।

নারীর পোশাকের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য

ক) পুরুষের পোশাক বা পুরুষের সদৃশ পোশাক না হওয়া। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না। একজন ঐ মহিলা, যে পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে।’

নারীর জন্য পুরুষের মতো পোশাক পরিধান করা হারাম। কিন্তু আজকাল এটি ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। মেয়েরাও প্যান্ট-শার্ট পরছে!

খ) পুরো শরীর ঢাকা পোশাক হওয়া।

গ) নারীদের জন্য রেশমী, লাল, হলুদ,নীল ইত্যাদি কালার জায়েয আছে। যেগুলো পুরুষের জন্য হারাম বা মাকরুহ।

পরিশেষে, মহিলাদের পোশাক এমন হওয়া চাই যাতে গোটা দেহ আবৃত থাকে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই এমন এমন স্টাইলের পোশাক বের হচ্ছে যাতে শরীরের বিভিন্ন অংশ খোলা থাকে। অর্থাৎ সতর আবৃত করার পরিবর্তে তা আরো প্রকাশিত করে তোলাই যেন পোশাকের উদ্দেশ্য। যেমন শাড়ি, নারীর জন্য ওড়না ছাড়া দুই পোশাক প্যান্ট-শার্ট বা প্যান্ট-গেঞ্জি। এগুলো ফ্যাশনের নামে নোংরামি। এ ধরনের ফ্যাশনে গা ভাসিয়ে দেওয়া স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদা বোধ না থাকারই দলীল। অনেক বিধর্মীও এমন রয়েছে যারা শালীন পোশাক পরিধান করে। ফ্যাশনের নামে যেসব কুরুচিপূর্ণ পোশাক তৈরি করা হয় তা তারা পরিহার করে চলে। অথচ আমাদের ধর্মে এত সুন্দর দিক-নির্দেশনা থাকার পরও ওইসব অশালীন ফ্যাশনের অনুগামী হয়ে যাওয়া কি দুঃখজনক নয়?

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৯১৩৮৬

প্রজেক্টর বা ডিজিটাল পর্দার মাধ্যমে বক্তাকে দেখা মহিলাদের কতটুকু শরীয়তসম্মত?


২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

নওগাঁ

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ আল কাউসার

৩১৮৪৭

রোজা রেখে আতর, পারফিউম ব্যবহার করা যাবে?


৩০ মার্চ, ২০২৩

৬২H৫+৫৯৭

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

২৬৪৯৬

মেয়েরা বাঁকা সিঁথি করতে পারবে কি?


১৪ ডিসেম্বর, ২০২২

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

৪০২০০

নবীজী কি সর্বদা কেবল জুব্বা পরিধান করেছেন ?


২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

নোয়াখালী

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy