আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

প্রশ্নঃ ৭২৮০. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আসসালামু আলাইকুম। আমার প্রশ্ন হলো, আমরা নামাজের ভিতরে সূরা, আত্তাহিয়াতু , দোয়ায় কুনুত, দোয়ায় মাসুরা , সানা, এবং নামাজের শেষে যেই তাকবির বলি যেমন : আল্লাহু আকবার (৩৪), সুবহানাল্লাহ (৩৩), আলহামদুলিল্লাহ (৩৩) আাবার আয়তুল কুরসি, সাইয়েদুল ইস্তেগফার, হাশরের শেষ তিন আয়াত এগুলো যে পড়ি। এগুলোর অর্থ না জেনে পড়লেও কি সওয়াব পাওয়া যাবে নাকি গুনাহ হবে? যদি বিস্তারিত জানাতেন।,

১৭ জুলাই, ২০২১

ঢাকা

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم






কুরআনুল কারীমের আয়াত ও হাদীসে শেখানো দোয়া বুঝে পড়লে যেমন উপকার রয়েছে, সওয়াব রয়েছে, না বুঝে পড়লেও সওয়াব এবং উপকার হয়েছে।

নবী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্যগুলো:
কোরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা নবী করিম (সা.)-কে পৃথিবীতে প্রেরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ মুমিনদের ওপর বড়ই অনুগ্রহ করেছেন যে তিনি তাদের থেকেই একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতগুলো তিলাওয়াত করেন, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। যদিও তারা এর আগে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৪)

উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী প্রেরণের চারটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন :
১. ‘তিনি তাদের কিতাব ও আয়াতগুলো পড়ে শোনান।’
২. ‘তাদের পবিত্র করেন।’ অর্থাৎ তাদের চরিত্র পূতঃপবিত্র ও সুন্দর করেন।
৩-৪. ‘তাদের কিতাব ও হিকমতের তালিম দেন।’ এ চারটি উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলা কোরআনের চার স্থানে উল্লেখ করেছেন। এতে এগুলোর প্রতিটির স্বতন্ত্র গুরুত্ব বোঝা যায়। কোরআন শরিফের আয়াতের তেলাওয়াত নবী প্রেরণের পৃথক ও স্বতন্ত্র্য একটি উদ্দেশ্য বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর কোরআন বোঝাও আলাদা আরেকটি উদ্দেশ্য।


শুদ্ধ ও সুন্দর কণ্ঠে তিলাওয়াত শিক্ষার ফজিলত
আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যারা সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াত করে, তারা নেককার সম্মানিত ফেরেশতাদের সমতুল্য মর্যাদা পাবে। আর যারা কষ্ট সত্ত্বেও কোরআন শুদ্ধভাবে পড়ার চেষ্টা ও মেহনত চালিয়ে যায়, তাদের জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৫৪)

তদ্রূপ কোরআন শরিফ মধুর কণ্ঠে পড়াও প্রশংসনীয়। হাদিস শরিফে সুন্দর কণ্ঠে পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে। বারা ইবনে আজেব (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সুললিত কণ্ঠে কোরআন পড়ো, কেননা তা কোরআনের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়।’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ২১৪১)

কোরআন শরিফ না বুঝে পড়লেও লাভ রয়েছে:

উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসগুলোর দ্বারা এ ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে বলে আশা করি, যারা বলেন—মক্তবে বাচ্চাদের তোতাপাখির মতো কোরআন মুখস্থ করানো হয়। তারা অর্থ ও ব্যাখ্যা না বুঝলে তাদের কী ফায়দা হবে? কোরআনের এ আয়াত ও উক্ত হাদিসগুলো ওই সব লোকের ভুল বোঝাবুঝির অবসান করে ঘোষণা দিচ্ছে যে কোরআনের তিলাওয়াত স্বয়ংসম্পূর্ণ পৃথক একটি উদ্দেশ্য। কোরআন মাজিদ হচ্ছে হেদায়েতের ব্যবস্থাপত্র, যা সাধারণ ডাক্তার বা হেকিমদের ব্যবস্থাপত্রের মতো নয়। কারণ তাদের ব্যবস্থাপত্র বুঝতে না পারলে কোনো উপকারে আসে না। আর কোরআন শরিফ হচ্ছে হেদায়েতের এমন ব্যবস্থাপত্র, যা পাঠ করলেই ঈমান বাড়ে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তাদের সামনে কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়। (সুরা : আনফাল, আয়াত : ২) কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। একেকটি অক্ষর পাঠ করলে দশ-দশটি নেকি পাওয়া যায়। এ সওয়াব পাওয়ার জন্য অর্থ বোঝার শর্ত হাদিসে উল্লেখ নেই। হজরত উসমান (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআনের একটি হরফ পড়বে, সে একটি নেকি পাবে, আর প্রতিটি নেকি দশ গুণ করে বৃদ্ধি করে দেওয়া হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৯১০)

আর কোরআনের অর্থ বোঝার জন্য কোরআনের আয়াতগুলো সঠিকভাবে উচ্চারণ করা ও পড়া প্রথম শর্ত। কেউ সহিহশুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াত করতে না পারলে সে কী করে কোরআন বুঝবে? তা ছাড়া কোরআনের তিলাওয়াত হচ্ছে পৃথক একটি উদ্দেশ্য। তাই কেউ এ কথা মনে করা ভুল যে কোরআন পাঠ শেখা ও শেখানো বৃথা। নাউজুবিল্লাহ।

একটি চিন্তার বিষয়:

একটি সরল বোঝার বিষয় হলো যে কোরআন শরিফের কিছু শব্দ রয়েছে, যেগুলোর অর্থ কোনো মুসলমানই জানে না। সেগুলোকে ‘হরুফে মুকাত্তাআত’ বলা হয়। এসব শব্দের ব্যাখ্যায় মুফাসসিররা সাধারণত বলে থাকেন, ‘এগুলোর অর্থ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক জ্ঞাত।’ যারা এসব শব্দের অর্থ বোঝার পেছনে লেগে পড়ে, কোরআনের একটি আয়াতে তাদের ব্যাপারে তিরস্কারও করা হয়েছে। এখন যারা বলেন, না বুঝে পড়লে কোনো ফায়দা নেই, তারা কি ‘হরুফে মুকাত্তায়াত’ও বুঝে পড়েন, নাকি না বুঝে পড়েন? এগুলোর অর্থ তো দুনিয়ায় কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তাহলে কি ‘হরুফে মুকাত্তায়াত’ পাঠ করার দ্বারা কোনো লাভ নেই? রাসুল (সা.) তো বলেছেন, এগুলো পাঠ করলেও প্রতি হরফে দশ নেকি। বরং তিরমিজি শরিফের হাদিসে তো কোরআনের সর্বপ্রথম ‘হরুফে মুকাত্তায়াত’ আলিফ-লাম-মিম দিয়ে প্রতি হরফে দশ নেকি পাওয়ার উদাহরণও দেওয়া হয়েছে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৯১০)

আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর বক্তব্য:

ঐ আলোচনায় বোঝা গেল, কোরআন বোঝা যদিও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তবে শুধু শব্দ শেখাও একটি মৌলিক কাজ। হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) এ ব্যাপারে সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন—‘এক. যারা শুধু অর্থের গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে তিলাওয়াতের গুরুত্ব উপেক্ষা করেছে, তাদের অনুধাবন করা উচিত, অর্থ বোঝা শব্দ পাঠের অনুগামী। প্রথম হলো শব্দের জ্ঞান। আর নীতি হলো, প্রয়োজনীয় বিষয়ের সূচনাও প্রয়োজনীয় হয়ে থাকে। তাই ‘শাব্দিক তিলাওয়াত লাভহীন’। এ ধারণা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

দুই. কোরআন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে শব্দাবলির হিফাজতের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই অর্থ ছাড়া শব্দাবলিও হিফাজত করা আবশ্যক। আল্লাহ না করুন, কোনো জালিম সরকার লিখিত সব কোরআন জ্বালিয়ে দিলেও একজন হাফিজে কোরআন তার স্মরণে রক্ষিত কোরআন দ্বারা আবার লিখতে পারবে। এ ক্ষেত্রে ছোট একজন হাফিজ শিশুই যথেষ্ট। বড়দেরও প্রয়োজন নেই। এখন কোরআন পাঠ শেখানোর প্রচলন বন্ধ করে দিলে পরিণামে দুনিয়া থেকে হাফিজে কোরআনের ধারা বন্ধ হয়ে যাবে। তিন. রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরআনের শব্দের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি শব্দের প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে ওহি অবতরণকালে জিবরাঈল (আ.)-এর সঙ্গে দ্রুত আবৃত্তি করতেন। অথচ তাঁর স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। এ থেকে তাঁর শব্দের প্রতি অসাধারণ আগ্রহ অনুধাবন করা যায়। এ ছাড়া রাসুল (সা.)-এর শব্দের প্রতি এত ব্যাকুল হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হলো, তিনি নিজে তিলাওয়াতের পাশাপাশি অন্যের তিলাওয়াতও শুনতেন। একবার ইবনে মাসউদ (রা.)-কে বললেন, আমাকে কোরআন শোনাও। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমি আপনাকে শোনাব! অথচ আপনার ওপরই কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে? নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমি অন্যের কাছ থেকে কোরআন শুনতে ভালোবাসি।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০৪৯)

চার. কোরআনের শব্দাবলি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রথম ধাপ। তাঁর পক্ষ থেকে প্রথমত, শব্দাবলিই এসেছে, তারপর অর্থ এসেছে শব্দের অনুগামী হয়ে। এ সূত্রেই শব্দাবলি যদি দুর্বোধ্য ভাষায়ও অবতীর্ণ হতো, তবুও সেটাই যথেষ্ট হতো। প্রিয়জনকে খাবারের কিছু দেওয়া হলে তাতে দুটি আকর্ষণীয় বস্তু থাকে। একটি প্রেমাস্পদের হাতের ছোঁয়ার স্বাদ, অপরটি ভক্ষণের স্বাদ। প্রেমের রীতি অনুসারে প্রিয়জনের হাতের ছোঁয়াযুক্ত বস্তু নাগালে পাওয়াটাই আনন্দের একটি উপলক্ষ। অনেক সময় প্রিয়জনের স্পর্শমাখা বস্তুটি ব্যবহার না করে স্মৃতিস্বরূপ রেখে দেওয়া হয়। অতএব, আল্লাহপ্রেমিকদের আনন্দের উপলক্ষ হওয়ার জন্য কোরআনের শব্দাবলিই যথেষ্ট ছিল। সুতরাং অর্থের স্বাদ উপভোগের ছুতা দিয়ে শব্দের স্বাদ পরিত্যাগ করা অযৌক্তিক। (দেখুন : তালিমুল কোরআন, পৃষ্ঠা : ৪-৫)

ঐ আলোচনায় স্পষ্ট হলো যে কোরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত এমনই এক শক্তি, যা যেকোনো মানুষকেই প্রভাবিত করতে সক্ষম।

স্মর্তব্য, এ আলোচনার দ্বারা এটা বোঝানো হয়নি যে কোরআনের মর্ম বোঝার প্রয়োজন নেই। বরং তার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাই মর্ম উপলব্ধি করে কোরআন পড়া আরো ভালো, অর্থ বুঝে কোরআন পড়া উত্তম। তবে এর অর্থ এ নয় যে অর্থ না বুঝে পড়লে কোনো লাভ নেই। না বুঝে কোরআন পড়লেও সওয়াব হবে।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ ইসহাক মাহমুদ
মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিআ মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া, মোহাম্মদপুর

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

২৮২২৯

কালিমার মাধ্যমে দুআ শেষ করা


৩১ জানুয়ারী, ২০২৩

মাদারীপুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

২৭৯৪৬

অজু ছাড়া দরূদ পড়া যাবে কি?


১২ জানুয়ারী, ২০২৩

ঢাকা ১৩৬১

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

২৭৭৫৮

কীভাবে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী হিসেবে গড়ে তুলব?


১২ জানুয়ারী, ২০২৩

চট্টগ্রাম

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

৯০৭৩৭

ফরয নামাযের সিজদায় অতিরিক্ত দু‘আ করা


২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

মনাইর কান্দি

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী মাহমুদুল হাসান

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy