আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

কতিপয় ‍রুসম রেওয়াজ

প্রশ্নঃ ৭২৬০. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, সাম্প্রতিক একটি পোস্টের কারনে আমি এবং আমার সহপাঠীরা প্রবল দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছি। সেখানে বিদআতের কিছু লিস্ট দেয়া হয়েছে, এবং বলা হয়েছে যে বিদআত করলে ভবিষ্যৎ ইবাদত কবুল হয়না।তো লিস্টের মধ্যে এমন কিছু পয়েন্ট ছিলো,যেগুলা আমাদের মানতে কষ্ট হচ্ছে,কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিনা রেফারেন্স ছাড়া। সবগুলো কে ঠিক ও মনে হচ্ছেনা আবার এড়িয়ে যেতেও মনে ভয় হচ্ছে। ওই লিস্টের কিছু পয়েন্ট আমি উল্লেখ করছি, সেগুলো কি সঠিক না ভুল আমাকে একটু জানান। যদি সহিহ হয় তাহলে রেফারেন্স গুলোও উল্লেখ করে দিয়েন। হয়তো লিস্টটা একটু লম্বা হবে,তাও আশা করি সবগুলোর ই উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবেন।প্রচলিত বিদয়াতঃ১.নতুন বাড়ি/ গাড়ি /অফিস বা এধরনের কিছুকে কেন্দ্র করে মিলাদ মাহফিল/কুরআন খতম/খতমে গাউসিয়া পড়ানো।২.আজানের পূর্বে সালাত ও সালাম পেশ করা৩.সালাত শুরুর পূর্বে 'ইন্নি ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়ালিল্লাজি' দোয়া অর্থাৎ জায়নামাজের দোয়া পাঠ করা।৪.মুখে নিয়্যাত উচ্চারণ করে পড়া।৫.রোজার নিয়্যাত মুখে মুখে বলা।৬.শবে বরাত ও শবে মেরাজের বিশেষ সালাত পড়া ৭.তসবিহ দিয়ে তাসবীহ গণনা করা। আঙুল দিয়ে করা সুন্নত। ৮.মিলাদ-কীয়াম করা৯.কুলখানি/চল্লিশা/মৃতের উদ্দেশ্যে খাবার খাওয়ানো১০.কুরআন নিচে পরে গেলে লবণ কাফফারা দেয়া,সালাম করা, কপালে লাগানো১১.মৃত ব্যাক্তির কাজা নামাজের কাফফারা দেয়া।১২.ওজুতে ঘাড় মাসহ করা। এগুলো নাকি সুন্নতের নামে বিদয়াত। আশা করি সঠিকটা/ এগুলোর রেফারেন্স খুব শীঘ্রই পাবো। জাযাকাল্লাহু খাইরান।,

৮ নভেম্বর, ২০২৩

ঢাকা

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


মুমিনের প্রতিটি কাজ হওয়া চাই সুন্নাহসম্মত পন্থায়। নবীজীর পবিত্র সীরাত হওয়া উচিত তার কাজের আদর্শ। যে কাজে থাকে আদ্যোপান্ত নববী সুন্নাহ ও আদর্শের উপস্থিতি তা রূপে-রসে হয়ে ওঠে অপূর্ব। তার নূর ও খায়ের-বরকত হয় অনন্য।
আর যে কাজ করা হয় মনগড়া ও নবউদ্ভাবিত পন্থায় এবং যার অনুপ্রেরণা হয় প্রচলিত রীতি-রেওয়াজ সেটা হয় নিষ্প্রাণ। তাতে কোনো খায়ের ও বরকত থাকে না। তদুপরি তা বহু রকমের উদ্বেগ, জটিলতা ও সংকীর্ণতার কারণ হয়।
এজন্য হাদীস শরীফে সুন্নাহ্র অনুসরণ আর নবউদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকার জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ، وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة، وإن كل بدعة ضلالة.
তোমরা আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহকে মজবুতভাবে ধরে রেখো। আর সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থেকো। কারণ সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় বিদআত আর সকল বিদআত গোমরাহী। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭১৪৫
একটি কথা খেয়াল রাখতে হবে, শরীয়াতের প্রতিটি বিষয়কে তার নিজস্ব অবস্থানে রাখতে হবে।
নবউদ্ভাবিত বিষয় বা বিদআত প্রতিরোধ করতে যেয়ে আমার দ্বারা যেন শরীয়াতের প্রমাণসিদ্ধ কোন বিষয়ের ইনকার বা অস্বীকৃতি না হয়ে যায়, তখন আমিও গোমরাহীর শিকার হবো।

আল্লাহ্‌ তাআলা দ্বীন বুঝে আমল করার তাওফীক দিন।

আপনার প্রশ্নাবলীর ধারাবাহিক উত্তরঃ

১- এসবের জন্য মিলাদ ইত্যাদি করা যাবে না। মিলাদ মাহফিল বিদআত।
হ্যাঁ, খতমে কুরআন বা অন্য কোনো দুআ-দরূদের খতম ইত্যাদি আল্লাহ্‌র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় স্বরূপ করা যেতে পারে। সেটা বিদআত হবে না।

২- এটা বিদআত।

আযানের সময় মুয়াযযিন মাইকে তাসবীহ, দুআ, না’ত বা অন্তত দরূদ শরীফ পাঠ করেন। এরপর আযানের তাকবীর বলেন। সাধারণত মাগরিবের আযানে এমনটি শোনা যায়, কোথাও ফজরের আযানেও শোনা যায়।

এটি একটি নবউদ্ভাবিত নিয়ম। খায়রুল কুরূনের তিন যুগের কোনো যুগে; বরং এরপরও কয়েক শত বছর পর্যন্ত এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, আযানের শুরু হল তাকবীর-আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার।

নবী-যুগ থেকে এ পদ্ধতিই চলে আসছে। হাদীস শরীফে আযানের জবাব দেওয়া, আযান শেষে দরূদ পড়া, এরপর দুআ পড়া-এই তিনটি আমলের কথা উল্লেখ আছে। এগুলো ব্যক্তিগত আমল। মুয়াযযিনও আযান শেষ করে দরূদ ও দুআ পড়বে। তবে একাকী ও নিম্নস্বরে। উচ্চস্বরেও নয়, মাইকেও নয়।

হাদীস ও মুতাওয়ারাছ সুন্নাহ অনুযায়ী আমল ত্যাগ করে এই নবউদ্ভাবিত পদ্ধতি গ্রহণ করা ভুল। এটা বিদআতের শামিল। আযান হল ইসলামের শিআর ও নিদর্শন। আর শিআর ও নিদর্শনের মাঝে পরিবর্তন-পরিবর্ধন অত্যন্ত গর্হিত বিষয়।

বেরেলভী ভাইদের কোনো কোনো এলাকায় দেখা যায়, তারা সব আযান দরূদ শরীফের মাধ্যমে শুরু করে। আর দরূদের শব্দ হল-আসসালাতু ওয়াস সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ। এই দরূদ রওযায়ে আতহার যিয়ারতের সময় অনুমোদিত হলেও সাধরণ অবস্থায় পড়ার জন্য নয়। একদিকে তারা নিজেদের পক্ষ থেকে আযানের সাথে দরূদ শরীফকে যুক্ত করেছে। অন্যদিকে এমন দরূদ যুক্ত করেছে, যা সব অবস্থায় পড়ার দরূদ নয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রাসূলের মুহববতের সাথে সাথে রাসূলের সুন্নাহ অনুসরণের সৌভাগ্য দান করুন। প্রিয়তমের সুন্নাহ ও আদর্শের পরিবর্তে কোনো নবউদ্ভাবিত পন্থাই যদি পছন্দ হয় তাহলে তা কেমন মুহববত?!

৩- জায়নামাযের কোনো দুআ নেই। কোনো কোনো মহলে ‘ইন্নি ওয়াজ্জাহাতু’ দুআটি জায়নামাযের দুআ নামে পরিচিত। কিন্তু এটি ঠিক নয়। এটি জায়নামাযের দুআ নয়; বরং হাদীস শরীফে নামায শুরু করার পর ছানা হিসেবে এ দুআ পড়ার কথা আছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৭১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭৬০; রদ্দুল মুহতার ১/৪৮৮; ইমদাদুল ফাতাওয়া ১/১৫১।

৪-
নামাযের মধ্যে নিয়ত করা ফরজ। নিয়ত ছাড়া নামায পড়লে নামায হবে না।

মুখে নিয়ত করা জরুরী নয়। কিন্তু অনেক মানুষই নিয়ত না করেই নামায শুরু করে দেন। তাই তাদের জন্য ফুক্বাহায়ে কেরাম বলেছেন, মুখে নিয়ত করার অভ্যাস করতে। যাতে করে নিয়ত ছাড়া নামায পড়া থেকে রক্ষা পেতে পারে। কারণ, মুখে বলার পাবন্দ হলে, কখনো নিয়ত ছাড়া নামায পড়া হবে না।

কিন্তু মুখে নিয়তের পাবন্দ না হলে, অনেক মানুষই দৌড়ে এসে নামাযে দাড়িয়ে যায়, কিন্তু নামাযের নিয়ত মনে মনেও স্থির করে না। তখন তাদের নামায হয় না।

মূল কথা হল, নিয়ত হল, কোন নামায পড়ছে? কত রাকাত পড়ছে? ইমামের পিছনে পড়ছে কি না? তা মনের মাঝে নির্ধারণ করে নেয়া। মুখে বলা জরুরী নয়। আরবীতে বলাও জরুরী নয়।

কিন্তু যাদের নিয়ত ভুল করার সম্ভাবনা আছে, তারা মুখে নিয়ত করে নিতে পারে।

তবে মুখে নিয়ত করাকে জরুরী মনে করলে তা বিদআত হবে। এ ব্যপারে কড়াকড়ি করা যাবে না। এক্ষেত্রেও সতর্কতা জরুরী।

عَلْقَمَةَ بْنَ وَقَّاصٍ اللَّيْثِيَّ، يَقُولُ: سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَلَى المِنْبَرِ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا، أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ»

আলকামা ইবনু ওয়াক্কাস আল-লায়সী (রহঃ) থেকে বর্ণিত, আমি উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সেই উদ্দেশ্যেই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১]

৫- নিয়ত মনের ইচ্ছার নাম, এক্ষেত্রে মুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয়। তবে কেউ মুখে নিয়্যাত উচ্চারণ করলে এটাকে বিদআত বলা যাবে না। হ্যা, অযথা তাগাদা দেওয়া যাবেনা। 'মুখে না বললে নামায-রোযা হবে না' এসব বলা যাবে না। মুখে নিয়ত করাকে জরুরী মনে করলে তা বিদআত হবে। এক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরী।

৬-

ক- ২৭ শে রজব : লাইলাতুল মিরাজ

এ রাতকে লাইলাতুল মিরাজ বা শবে মিরাজ বলা হয়ে থাকে। কোনো কোনো পুস্তক-পুস্তিকায় স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে এবং সাধারণ জনগণের মাঝে তা প্রসিদ্ধ যে, মিরাজের ঘটনা রজব মাসের ২৭ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল। এ কথাটি শুধু ইতিহাসের একটি বর্ণনার ভিত্তিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যার সনদ সহীহ নয়। অন্যথায় এটি কোনো নির্ভরযোগ্য ইতিহাস দ্বারাও প্রমাণিত নয়, হাদীস শরীফ কিংবা কোনো সাহাবীর উক্তি দ্বারা তো নয়ই। নির্ভরযোগ্য সূত্রে শুধু এটুকুই পাওয়া যায় যে, মিরাজের ঘটনা হিজরতের এক বা দেড় বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু মাস, দিন, তারিখের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল নেই।

অনেক আলেম বলেছেন, মিরাজের রাত নিঃসন্দেহে একটি বরকতময় রাত ছিল কিন্তু এই রাতে যেহেতু বিশেষ কোনো আমল বা ইবাদত উম্মতের জন্য বিধিবদ্ধ হয়নি তাই এর দিন-তারিখ সুনির্দিষ্টভাবে সংরক্ষিত থাকেনি। -আলমাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ ও শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাহ ৮/১৮-১৯; আলবিদায়া ওয়াননিহায়া, ইমাম ইবনে কাছীর ২/৪৭১; লাতাইফুল মাআরিফ, ইমাম ইবনে রজব ১৩৪; ইসলাহি খুতুবাত, আল্লামা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী ১/৪৬-৪৮

রজব মাস যেহেতু কুরআনে বর্ণিত চার সম্মানিত মাসের একটি সুতরাং এর পুরোটাই বরকতময়। তাই এ মাসের সবকটি দিন ও সবকটি রাতেই ইবাদাত বন্দেগীর ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিৎ। কিন্তু এর ২৭ তারিখ যেহেতু শবে মিরাজ হিসেবে প্রমাণিত নয় তাই এ রাতকে বিশেষ ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট না করা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট রসম রেওয়াজও ত্যাগ করা উচিত।

খ- ১৫ই শাবান : লাইলাতুল বরাত

১৫ই শাবান অর্থাৎ ১৪ই শাবান দিবাগত রাত। হাদীস শরীফে এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান’ বলা হয়েছে। এর ব্যাপারে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হল, এ রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোনো রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদযাপনের বিশেষ কোনো পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মত মনে করা এবং এ রাতের ফযীলতের ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে তার সবগুলোকে ‘মওযূ’ বা ‘যয়ীফ’ মনে করা যেমন ভুল তেমনি এ রাতকে শবে কদরের মত বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করাও একটি ভিত্তিহীন ধারণা। বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ি কোনটিই উচিত নয়। যতটুকু ফযীলত প্রমাণিত এ রাতকে ততটুকুই গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং এ কেন্দ্রিক সকল রসম-রেওয়াজ পরিহার করা উচিত।

এ রাত ও তার আমল সম্পর্কে হাদীসের নির্ভরযোগ্য বর্ণনা নিম্নরূপ :

১.

عن مالك بن يخامر عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن، رواه ابن حبان وغيره ورجاله ثقات وإسناده متصل على مذهب مسلم الذي هو مذهب الجمهور في المعنعن ولم يجزم الذهبي بأن مكحولا لم يلق مالك بن يخامر كما زعم وإنما قاله على سبيل الحسبان، راجع : سير أعلام البلاء.

মুআয ইবনে জাবাল রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির প্রতি (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে মাফ করে দেন।’’- সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৫৬৬৫

এই হাদীস দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে যে, এ রাতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাতের দ্বার ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত হয়। কিন্তু শিরকী কাজকর্মে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী মানুষ এই ব্যাপক রহমত ও সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত থাকে।

হাদীসটির সনদ সহীহ। এজন্যই ইমাম ইবনে হিববান একে ‘কিতাবুস সহীহ’এ বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ হাদীসটিকে পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘হাসান’ বলেছেন; কিন্তু হাসান হাদীস সহীহ তথা নির্ভরযোগ্য হাদীসেরই একটি প্রকার।

ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, নূরুদ্দীন হাইসামী, কাসতাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন। দেখুন, আততারগীব ওয়াততারহীব ২/১১৮, ৩/৪৫৯; লাতায়েফুল মাআরিফ ১৫১; মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৬৫; শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা ১০/৫৬১

বর্তমান সময়ের প্রসিদ্ধ শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. ‘‘সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহা’’ ৩/১৩৫-১৩৯-এ এই হাদীসের সমর্থনে আরো আটটি হাদীস উল্লেখ করার পর লেখেন-

وجملة القول أن الحديث يمجموع هذه الطريق صحيح بلا ريب والصحة تثبت بأقل منها عددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث.



‘‘এ সব রেওয়ায়াতের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ প্রমাণিত হয়।’’ এরপর শায়খ আলবানী রাহ. ওই সব লোকের বক্তব্য খন্ডন করেন যারা কোনো ধরনের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, শবে বরাতের ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদীস নেই।

২. ‘‘হযরত আলা ইবনুল হারিস রাহ. থেকে বর্ণিত, আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন্ রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন-

هذه ليلة النصف من شعبان إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هم.

‘‘এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’’-শুয়াবুল ঈমান, বাইহাকী ৩/৩৮২-৩৮৩

ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন-

هذا مرسل جيد

এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য। তবে মনে রাখতে হবে যে, অনেক অনির্ভরযোগ্য ওযীফার বই-পুস্তকে নামাযের যে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন লেখা আছে অর্থাৎ এত রাকাআত হতে হবে, প্রতি রাকাআতে এই সূরা এতবার পড়তে হবে-এগুলো ঠিক নয়, হাদীস শরীফে এসব নেই; এগুলো মানুষের মনগড়া পন্থা। সঠিক পদ্ধতি হল, নফল নামাযের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দুই রাকাআত করে যত রাকাআত সম্ভব হয় এবং যে সূরা দিয়ে সম্ভব হয় পড়তে থাকা। কুরআন কারীম তেলওয়াত করা। দরূদ শরীফ পড়া। ইসতেগফার করা। দুআ করা এবং কিছুটা ঘুমানোর প্রয়োজন হলে ঘুমানো। এমন যেন না হয় যে, সারা রাতের দীর্ঘ ইবাদতের ক্লান্তিতে ফজরের নামায জামাআতের সাথে পড়া সম্ভব হল না।

৭- তাসবীহ ব্যবহার জায়েয, বেদআত নয়। কারণ সহীহ হাদীস এবং সাহাবীদের আমল থেকে অঙ্গুলি ছাড়া ভিন্ন বস্ত্ত দ্বারাও তাসবীহ গণনার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। হযরত সায়াদ ইবনে আবী ওক্কাস [রা.] সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি খেজুরের বিচি ও পাথরকুচি দ্বারা তাসবীহ জপতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২/২৮২

এ ছাড়া তাসবীহ ব্যবহারের ব্যাপারে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা থেকেও সমর্থন পাওয়া যায়। হযরত সায়াদ ইবনে আবী ওক্কাস [রা.] বর্ণনা করেন, একদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মহিলার গৃহে প্রবেশ করে দেখলেন, তার সামনে কিছু পাথরকুচি অথবা খেজুরের বিচি রয়েছে। সে তা দিয়ে তাসবীহ জপছে। নবীজী তাকে বললেন, আমি কি তোমাকে এর চেয়ে সহজ কোন পন্থা বলব? এরপর তিনি তাকে ফযীলতপূর্ণ একটি দুআ শিখিয়ে দিলেন। -জামে তিরমিযী ২/১৯৭

উল্লেখিত হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাটিকে পাথরকুচি দিয়ে তাসবীহ জপতে নিষেধ করেননি। কাজটি যে শরীয়তপরিপন্থী নয় তা প্রমাণের জন্য এটিই যথেষ্ট। -বাযলুল মাজহুদ ২/৩৫৫

সুতরাং তাসবীহ ব্যবহারকে বেদআত বলা ভুল। বরং এটি একটি মুবাহ তথা জায়েয পন্থা। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া [রহ.] বলেন, ‘অঙ্গুলি দ্বারা তাসবীহ গণনা করা সুন্নত। আর খেজুরদানা এবং পাথর টুকরো বা এ জাতীয় বস্ত্ত দ্বারা গণনা করা ভাল। সাহাবীদের কেউ কেউ এমন করতেন।’

-মাজমূআ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২২/৫০৬, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২/২৮২, জামে তিরমিযী ২/১৯৭, বাযলুল মাজহুদ ২/৩৫৫, রদ্দুল মুহতার ১/৬৫০-৬৫১, আল বাহরুর রায়েক ২/২৯, নুযহাতুল ফিকর ফী সাবহাতিয যিকর ...

৮- মিলাদ-কীয়াম করা বিদআত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করা, তার প্রশংসা করা, ইত্যাদি খুবই সওয়াব ও পূণ্যের কাজ। এতে কোন সন্দেহ নেই। আর দরূদ পড়াও অনেক সওয়াবের কাজ।

কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতির মিলাদ মাহফিল এবং তাতে বিশেষ মুহুর্তে বিশেষ পদ্ধতিতে দাঁড়ানো কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। সেই সাথে খাইরুল কুরুনেও এর কোন নজীর নেই। তাই এভাবে বিশেষ পদ্ধতির মিলাদ মাহফিল করা এবং তাতে দাঁড়িয়ে কিয়াম করা জায়েজ নয়। বরং এটা সুস্পষ্ট বিদআত। এটা পরিহার করা চাই।

وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدِثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ شَرَّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا، وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ، (سنن ابن ماجه، رقم-46)

والاحتفال بذكر الولادة الشريفة إن كان خاليا من التدعات المروجة فهو جائز بل مندوب كسائر أذكاره صلى الله عليه وسلم والقيام عند ذكر ولادة الشريفة حاشا لله أن يكون كفرا (امداد الفتاوى-6\312)

وَنَظِير ذَلِك فعل كثير عِنْد ذكر مولده صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَوضع أمه لَهُ من الْقيام وَهُوَ أَيْضا بِدعَة لم يرد فِيهِ شَيْء على أَن النَّاس إِنَّمَا يَفْعَلُونَ ذَلِك تَعْظِيمًا لَهُ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فالعوام معذورون لذَلِك بِخِلَاف الْخَواص (الفتاوى الحديثية لابن حجر الهيتمى-1\

৯- মৃত ব্যক্তির মাগফিরাতের জন্য দুআ করা এবং বিভিন্ন নফল ইবাদত যেমন-দান-সদকা, তাসবীহ-তাহলীল, তেলাওয়াত ইত্যাদি করে তার সওয়াব মৃতকে পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল, যা হাদীস শরীফের বহু দলীল দ্বারা প্রমাণিত। তবে এটি একটি ব্যক্তিগত আমল। কোনো দিন-তারিখ ও আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই যখন ইচ্ছা তখনই এ আমল করা যায়।

কিন্তু বর্তমানে এই সহজ আমলটিকে আনুষ্ঠানিক রূপ দান করে অনেক ক্ষেত্রেই তাকে সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহের কাজে রূপান্তর করা হয়ে থাকে। যেমন-

১. তিন দিনা, সাত দিনা,একইশা, চল্লিশা এ সকল নামে এ অনুষ্ঠান যথাক্রমে মৃত্যুর ৩য়, ৭ম, ২১ শ ও ৪০ তম তারিখে করাকে জরুরি মনে করা হয় বা কমপক্ষে এরূপ ধারণা রাখা হয় যে, এ তারিখগুলোর বিশেষত্ব রয়েছে। অথচ শরয়ী দলীল-প্রমাণ ছাড়া বিশেষ দিন-তারিখ নির্ধারণ করে নেওয়া বিদআত ও নাজায়েয।

২. ঈসালে সাওয়াবের প্রচলিত পন্থায় আরেকটি বড় আপত্তিকর দিক হল এতে যিয়াফত তথা আড়ম্বরপূর্ণ দাওয়াত অনুষ্ঠানকেই ঈসালে সওয়াবের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। অথচ শরীয়র্তে যিয়াফতের আয়োজনের কথা তো আছে আনন্দের মুহূতে, মুসিবতের মুহূর্তে নয়। হাদীস শরীফে এসেছে-হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ আলবাজালী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (তরজমা) ‘আমরা (সাহাবাগণ) দাফনের পর মৃতকে কেন্দ্র করে সমবেত হওয়া ও খাবারের আয়োজন করাকে ‘নিয়াহা’ বলে গণ্য করতাম।’ (মুসনাদে আহমদ ২/২০৪; ইবনে মাজাহ ১৬১২)

কোনো দিন-তারিখ নির্ধারিত না করে গরীব-মিসকীনদেরকে খানা খাওয়ানোটাও ঈসালে সাওয়াবের একটি বৈধ পন্থা। কিন্তু এমন যিয়াফতের আয়োজন করা যাতে অনেক ক্ষেত্রে সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এটি আদৌ ঈসালে সাওয়াবের গ্রহণযোগ্য পন্থা নয়।

৩. হাফেযদের দ্বারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কুরআন খতম করা হয়। অথচ এক্ষেত্রে কুরআন পড়ার বিনিময় দেওয়া-নেওয়া নাজায়েয।

৪. অনেক ক্ষেত্রেই এর ব্যয়ভার নির্বাহ করা হয় মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া এজমালী সম্পদ থেকে, ওয়ারিশদের মাঝে কোনো নাবালেগ থাকলেও তার সম্পদ বাদ দেওয়া হয় না। অথচ নাবালেগের সম্পদ তার অনুমতি নিয়েও খরচ করা নাজায়েয। এমনিভাবে বালেগ ওয়ারিশদের ক্ষেত্রেও এটা লক্ষ রাখা হয় না যে, তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি আছে কি না।

৫. এ ধরনের অনুষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রেই লোক দেখানোর জন্য বা সামাজিক রেওয়াজে প্রভাবিত হয়ে করা হয়। এটাও নাজায়েয। শরীয়ত বিরোধী এ জাতীয় আরো কর্মকান্ড এসব অনুষ্ঠানে হয়ে থাকে। ফলে এর দ্বারা মৃত ব্যক্তির উপকার হওয়া তো দূরের কথা উল্টো ব্যবস্থাকারীগণ গুনাহগার হয়ে থাকে।

সুতরাং ঈসালে সাওয়াবের প্রশ্নোক্ত পন্থা সম্পূর্ণরূপে পরিহারযোগ্য। মৃতের মাগফিরাত কামনা ও তাকে সাওয়াব পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগতভাবে দান-সদকা, তেলাওয়াত, যিকির-আযকার ও নফল ইবাদতই যথেষ্ট এবং এটাই করণীয়। আর নির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখের অপেক্ষা না করে নিজ নিজ তাওফীক অনুযায়ী এগুলো মাঝে মধ্যেই করা দরকার। দান-সদকা করার ক্ষেত্রে গরীব দুঃখীদেরকে নগদে প্রদান করা ভালো এবং সদকায়ে জারিয়া হয় এমন খাতে ব্যয় করা উত্তম।

-মুসনাদে আহমদ ২/২০৪; ইবনে মাজাহ পৃ. ১১৭; মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/১৭০; শিফাউল আলীল ১/১৭৫; ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ১/৮১; রদ্দুল মুহতার ২/২৪০


১০- কুরআনে কারীমের মত পবিত্র কিতাব হাত থেকে পড়ে গেলে মন খারাপ হওয়া, অনুতপ্ত ভাব আসা ভাল লক্ষণ।

তবে এক্ষেত্রে কুরআনে কারীমে সালাম করা বা চুমু খাওয়া, লবণ কাফফারা দেয়া বা কুরআনে কারীম কপালে লাগানোর কোন বিধান নেই। এটা আবশ্যক মনে করলে বিদআত হবে।

তবে যদি কেউ সুন্নত বা শরীয়তের বিধান মনে না করে এমনিতে সম্মানার্থে কুরআনে কারীম চুম্বন করে, তাহলে কোন সমস্যা নেই।

فى رد المحتار-رُوِيَ عَنْ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّهُ كَانَ يَأْخُذُ الْمُصْحَفَ كُلَّ غَدَاةٍ وَيُقَبِّلُهُ وَيَقُولُ : عَهْدُ رَبِّي وَمَنْشُورُ رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ وَكَانَ عُثْمَانُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ يُقَبِّلُ الْمُصْحَفَ وَيَمْسَحُهُ عَلَى وَجْهِهِ (رد المحتار–كِتَابُ الْحَظْرِ وَالْإِبَاحَةِ، بَابُ الِاسْتِبْرَاءِ وَغَيْرِهِ

হযরত ওমর রাঃ এ ব্যাপারে বর্ণিত। তিনি কুরআনে কারীম প্রতিদিন সকালে নিয়ে চুমু খেতেন। আর বলতেন-এটা আমার রবের নির্দেশনা, এবং আল্লাহর প্রেরিত। এমনিভাবে হযরত উসমান রাঃ ও কুরআনে কারীমকে চুমু খেতেন এবং চোখে বুলাতেন। {রাদ্দুল মুহতার-৫/২৪৬, তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ-২৫৯, ফাতওয়ায়ে মাহমুদিয়া-৭/১৪৭}


১১- মৃত ব্যাক্তির কাজা নামাজের কাফফারা দেয়াকে বিদআত বলা যাবে না। এটা বিদআত নয়।

যদি মৃত ব্যক্তি তার সম্পদ থেকে তার নামাযের কাফফারা আদায়ের জন্য অসিয়ত করে যায়, আর তার নিজের মালও ছিল। তাহলে তার এক তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে কাফফারা আদায় করতে হবে।

আর যদি তার কোন সম্পদ না থাকে, বা সে মাল রেখে গেছে কিন্তু কোন কাফফারা আদায়ের অসিয়ত করে যায়নি। তাহলে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কাফফারা আদায় করা আত্মীয়দের উপর জরুরী নয়। তবে স্বজনদের কাফফারা আদায় করে দেয়াই উত্তম। এর দ্বারা মৃত ব্যক্তি শান্তি পায়।

কাফফারার পরিমাণ হল, প্রতিদিন বিতরসহ ছয় ওয়াক্ত নামায হিসেব করে প্রত্যেক ওয়াক্তের জন্য পৌনে দুই সের গম বা আটা অথবা এর বাজার মূল্য গরীব মিসকিনকে মালিক বানিয়ে দিতে হবে। অথবা প্রতি ওয়াক্তের বদলে একজন গরীবকে দুই বেলা তৃপ্তি সহকারে খানা খাওয়াতে হবে। {ফতাওয়া শামী-২/৭২}

(وَلَوْ مَاتَ وَعَلَيْهِ صَلَوَاتٌ فَائِتَةٌ وَأَوْصَى بِالْكَفَّارَةِ يُعْطَى لِكُلِّ صَلَاةٍ نِصْفَ صَاعٍ مِنْ بُرٍّ) كَالْفِطْرَةِ (وَكَذَا حُكْمُ الْوِتْرِ) وَالصَّوْمِ، وَإِنَّمَا يُعْطِي (مِنْ ثُلُثِ مَالِهِ) (الدر المختار-2/72)

وَأَمَّا إذَا لَمْ يُوصِ فَتَطَوَّعَ بِهَا الْوَارِثُ فَقَدْ قَالَ مُحَمَّدٌ فِي الزِّيَادَاتِ إنَّهُ يُجْزِيهِ إنْ شَاءَ اللَّهُ تَعَالَى، (رد

১২- ওজুতে ঘাড় মাসহ করা বিদআত নয়।

এটা অনেকে না জানার কারণে বলে থাকেন। হাদীসে এ সংক্রান্ত বিধান এসেছে। বাকি এটি কোন জরুরী বিষয় নয়। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা মোটেও উচিত নয়।

গর্দান বা ঘাড় মাসাহ করা মুস্তাহাব।



عَنْ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: “مَنْ تَوَضَّأَ وَمَسَحَ بِيَدَيْهِ عَلَى عُنُقِهِ وُقِيَ الْغُلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ”

হযরত ইবনে উমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অজু করে এবং উভয় হাত দিয়ে গর্দান মাসাহ করে, তাহলে তাকে কিয়ামতের দিন [আযাবের] বেড়ি থেকে বাঁচানো হবে।

ইমাম আবুল হাসান ফারেছ রহঃ বলেছেনঃ

وَقَالَ هَذَا إنْ شَاءَ اللَّهُ حَدِيثٌ صَحِيحٌ

ইনশাআল্লাহ হাদীসটি সহীহ। [তালখীসুল হাবীর-১/৯৩, দারুল কুতুব প্রকাশনী-১/২৮৮,মুআসসা কুরতুবিয়্যাহ প্রকাশনী-১/১৬৩]

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বলেন-বর্ণনাটি সম্পর্কে একথা বলা যায় যে, যদিও তা একজন তাবেয়ীর কথা হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তা রাসূলুল্লাহ সাঃ এর হাদীস গণ্য হবে। কেননা, তিনি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এমন সংবাদ দেওয়া সম্ভব নয়। {আত তালখীসুল হাবীর-১/৯২, হাদীস নং-৯৭}



عَنِ ابْنِ عُمَرَ ” أَنَّهُ كَانَ إِذَا مَسَحَ رَأْسَهُ مَسَحَ قَفَاهُ مَعَ رَأْسِهِ “

হযরত ইবনে উমর রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি যখনি মাথা মাসাহ করতেন, তখন মাথা মাসাহের সাথে গর্দানও মাসাহ করতেন। [সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-২৭৯]



عَنْ طَلْحَةَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، قَالَ: «رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَوَضَّأَ فَمَسَحَ رَأْسَهُ هَكَذَا، وَأَمَرَّ حَفْصٌ بِيَدَيْهِ عَلَى رَأْسِهِ حَتَّى مَسَحَ قَفَاهُ

হযরত তালহা তিনি তার পিতা, তিনি তার দাদারসূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি অজু করছেন। তখন তিনি এভাবে মাথা মাসাহ করেছেন। উভয় হাতকে জমা করে পাস কাটিয়ে তা দিয়ে গর্দান মাসাহ করতেন। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-১৫০]

এছাড়া আল্লামা বাগাভী রহঃ, ইবনে সাইয়িদুন্নাস রহঃ,লা-মাযহাবী, আহলে হাদীস ভাইদের কাছে মান্যবর ইমাম শাওকানী রহঃ প্রমূখও অযুতে গর্দান মাসাহ করার কথা বলেছেন। {নাইলুল আওতার-১/২০৪}

কথিত আহলে হাদীসদের বড় ইমাম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান এ মতকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন-গর্দান মাসাহ করাকে বিদআত বলা ভুল। আত তালখীসুল হাবীর গ্রন্থের উপরোক্ত বর্ণনা ও অন্যান্য বর্ণনা এ বিষয়ের দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া এর বিপরীত বক্তব্য হাদীসে আসেনি। {বুদূরুল আহিল্যাহ-২৮}

সুতরাং গর্দান মাসাহকে প্রমাণহীন, ভিত্তিহীন বলার কোন সুযোগ নেই।

আশা করি আপনার বিস্তারিত প্রশ্নাবলীর সবিস্তার উত্তর পেয়ে গেছেন।
আমাদের কথাবার্তায় বিশেষত দীনী বিষয়াদীতে আরো বেশী সতর্কতা কাম্য।
জানা না থাকলে জেনে বলি, তবুও ভুল ও অসত্য না বলি। বিদআতকে সুন্নাহ না বলি এবং সুন্নাহকে বিদআত বলে দ্বীন থেকে খারিজ না করি। এদুটোই প্রান্তিকতা ও গুমরাহী। আল্লাহ সহীহ দ্বীন জেনে আমল করার তাওফীক দিন।

বিঃদ্রঃ একাধিক বিষয়ে প্রশ্ন এলে অসুবিধা হয়।
প্রশ্নের উত্তর বড় হয়ে যায়।
আমাদের প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ক্যাটাগরি সিলেক্ট করতে হয়।
আপনি আলাদা করে বারবার প্রশ্ন করুন কিংবা একই বিষয়ক একাধিক প্রশ্ন করুন। ধন্যবাদ।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৩৪৬৭৯

বিদআতি ইমাম কুরবানীর পশু জবাই করতে পারবে?


২৮ জুন, ২০২৩

শ্রীপুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

২৭৩০০

স্বামী মারা গেলে মহিলার সাদা কাপড় পরিধানের বিধান


৮ জানুয়ারী, ২০২৩

বিশ্বনাথ

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

১৯০৪৪

নামাজের পর সম্মিলিত মুনাজাত


২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

ঢাকা ১২১২

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী মুহাম্মাদ রাশেদুল ইসলাম

৫৯৭০৬

আকিদা


২৬ মে, ২০২৪

বরিশাল

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি মোহাম্মদ আমীর হোসাইন

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy