আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

সকল সাহাবীদের গালি দেওয়া ও কতল করা কি কুফুরি নয়?

প্রশ্নঃ ৭১৬৫. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, এক আহলে হাদিসের ভাই একথা লিখে বিভ্রান্ত করছে যে, সকল সাহাবীদের গালি দেওয়া ও কতল করা কুফুরি নয়। ফিকহুল আকবার ৮৬। উপরক্ত কথার সত্যতা ও ব্যাখ্যা জানালে উপকৃত হব। জাযাকুমুল্লাহু খাইর।,

২৩ মে, ২০২৪

Libya

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


প্রশ্নে প্রদত্ত হাওয়ালাটি সুস্পষ্ট নয়। আপনি অনুগ্রহ করে এর স্ক্রিনশট আমাদের namajerSomoy.com এর মেসেঞ্জারে পাঠান।

আল-ফিকহুল আকবার কিতাবটি ইমামে আযম আবু হানীফা রহঃ এর আকীদা বিষয়ক রচনা। বিগত ১২০০ বছর থেকে উম্মতের সকল মাযহাবের ইমাম উলামাগন এ কিতাবকে আকায়েদ বিষয়ক শীর্ষ কিতাব হিসেবে মুল্যায়ন করে গেছেন।
আকীদাতুত তাহাবী কিতাবের (যেটির প্রশংসা ও হাওয়ালা সব সালাফী আলেমদের মুখে মুখে থাকে) অন্যতম বুনিয়াদ হলো আল-ফিকহুল আকবার কিতাবটি।
এটা অসম্ভব যে, এতো মারাত্মক একটি আকীদা এ কিতাবে থেকে যাবে আর উলামায়ে কিরাম এ বিষয়ে খামুশ থাকবেন।

উপরন্ত সালাফী আলেমগন এ দুটি কিতাবেরই তাহকীকের কাজ করেছেন, অথচ তাদের তাহকীকেও এমন মারাত্মক আকীদার কোন উল্লেখই নেই, রদ্দ করা তো পরের বিষয়।

الشرح الميسر على الفقهين الأبسط والأكبر المنسوبين لأبي حنيفة تأليف محمد بن عبد الرحمن الخميس

আকীদাতুত তাহাবীর তা'লীক শাঈখ বিন বায ও আলবানী সাহেবের রয়েছে, তারা কিছু বলেন নি কেন?
তথাপি আমরা আল-ফিকহুল আকবার কিতাবটি ঘেটে ঘেটে দেখেছি কিন্ত এরকম বা এর সদৃশ কোন আকীদার উল্লেখও পাইনি।
এটা সুস্পষ্ট মিথ্যাচার ইমামে আযমের নামে।
আল্লাহ্‌ যারা এসব রটাচ্ছেন তাদের যবানকে বন্ধ করে দিন এবং উপযুক্ত শিক্ষা দিন।

এ পর্যায়ে আমরা ইমামে আযম রহঃ বিরচিত আল-ফিকহুল আকবার থেকে সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কিত আকীদাসমূহ পেশ করছি,যা কেবল ইমামে আযমেরই নয় বরং আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত আকীদা।
الفقه الأكبر (ص: 41)
وأفضل الناس بعد النبيين عليهم الصلاة والسلام أبو بكر الصديق ثم عمر بن الخطاب الفاروق ثم عثمان بن عفان ذو النورين ثم علي بن أبي طالب المرتضى رضوان الله عليهم أجمعين
عابدين ثابتين على الحق ومع الحق نتولاهم جميعا ولا نذكر أحدا من أصحاب رسول الله إلا بخير

অনুবাদ ও ব্যাখ্যাঃ

কুরআন ও হাদীসের এ সকল নির্দেশনার আলোকে সাহাবীগণের বিষয়ে মুসলিমগণ নিম্নরূপ আকীদা পোষণ করেন:

(১) মানব জাতির মধ্যে নবীগণের পরেই সাহাবীগণের শ্রেষ্ঠত্ব এবং সাহাবীগণের মধ্যে খুলাফায়ের রাশেদীনের শ্রেষ্ঠত্ব।

(২) খুলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য তাঁদের খিলাফাতের দায়িত্বের ক্রম অনুসারে।
তথাঃ
১.হযরত আবু বকর (রাঃ),
২.হযরত উমর (রাঃ),
৩.হযরত উসমান (রাঃ),
৪.হযরত আলী (রাঃ)।

(৩) অন্য সকল সাহাবীও মহান মর্যাদার অধিকারী। কোনো সাহাবীকেই কোনো মুমিন সামান্যতম অমর্যাদা বা অবজ্ঞা করেন না। তাঁদের কারো বিষয়েই কোনো অমর্যাদাকর কথা কোনো মুমিন কখনো বলেন না।

(৪) সাহাবীগণের মধ্যে মতভেদ হয়েছে এবং কখনো কখনো যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে। ভুল বুঝাবুঝি, সামাজিক প্রেক্ষাপট, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে দুজন সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তির মধ্যে বিরোধ, মামলা বা যুদ্ধ হতে পারে। শুধু যুদ্ধ বা বিরোধের কারণে কাউকে অপরাধী বলা যায় না।

যুদ্ধবিগ্রহ ঐতিহাসিক সত্য। তবে সেগুলিতে কার কি ভূমিকা ছিল সে বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ক ইতিহাস লেখা হয়েছে ঘটনার প্রায় ২০০ বৎসর পর শীয়া মতবাদ প্রভাবিত আববাসী শাসনামলে শীয়াগণের বর্ণনার উপর নির্ভর করে। কুরআন ও হাদীস সাহাবীগণের মর্যাদা ও সততা নিশ্চিত করেছে। এ সকল যুদ্ধবিগ্রহের অযুহাতে তাঁদের কারো নামে কুৎসা রটনা বা বিদ্বেষ পোষণ করার অর্থ কুরআন ও হাদীসের অগণিত নির্দেশনা জনশ্রুতির কারণে বাতিল করে দেওয়া।

কোনো কোর্টে যদি কোনো দলের নেতৃস্থানীয় কাউকে অপরাধী বলে রায় দেওয়া হয় তবে সে দলের অনুসারীরা রায়কে মিথ্যা বলবেন কিন্তু নেতার সততায় বিশ্বাস হারাবেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ অতি-সাম্প্রতিক বিষয়। তারপরও সকলেই শুধু ইতিহাস বিকৃতির কথা বলেন। ঐতিহাসিকরা যদি কোনো নেতার অপরাধের অনেক তথ্য পেশ করেন তবুও তার অনুসারীরা সে তথ্য বিশ্বাস করবেন না। তাহলে মুমিন কিভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সহচরদের বিষয়ে কুরআন প্রমাণিত সততার সাক্ষ্যের বিপরীতে ইতিহাসের বর্ণনার উপর নির্ভর করবেন?

আমরা শুধু এতটুকুই বলব যে, যুদ্ধ বিগ্রহ ঘটেছে, কিন্তু কার কী ভূমিকা তা আমরা এতদিন পরে ইতিহাসের বর্ণনার উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করতে পারব না। তবে কুরআন ও হাদীসের বর্ণনার উপর নির্ভর করে আমরা তাঁদের পরিপূর্ণ সততা ও বেলায়াতে বিশ্বাস করি। আমরা মনে করি যে, তাঁদের যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি ভুল বুঝাবুঝি ও ইজতিহাদী মতপার্থক্যের কারণেই ঘটেছে। এতে তাঁদের তাকওয়া ও বেলায়াত (আল্লাহর ওলী হওয়ার মর্যাদা) ক্ষতিগ্রস্থ হয় নি।

উপরের বিষয়গুলোই ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর ‘‘আল-ওয়াসিয়্যাহ’’ পুস্তিকায় এ বিষয়ে আরো বলেন:


وَنُقِرُّ بِأَنَّ أَفْضَلَ هَذِهِ الأُمَّةِ بَعْدَ نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ ﷺ أَبُوْ بَكْرٍ الصِّدِّيْقُ، ثُمَّ عُمَرُ، ثُمَّ عُثْمَانُ، ثُمَّ عَلِيٌّ، رِضْوَانُ اللهِ عَلَيْهِمْ أَجْمَعِيْنَ؛ لِقَوْلِهِ تَعَالَى: "وَالسَّابِقُوْنَ السَّابِقُوْنَ أُولَئِكَ الْمُقَرَّبُوْنَ فِيْ جَنَّاتِ النَّعِيْمِ"، وَكُلُّ مَنْ كَانَ أَسْبَقَ فَهُوَ أَفْضَلُ، وَيُحِبُّهُمْ كُلُّ مُؤْمِنٍ تَقِيٍّ، وَيُبْغِضُهُمْ كُلُّ مُنَافِقٍ شَقِيٍّ.


‘‘এবং আমরা স্বীকার ও বিশ্বাস করি যে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পরে এ উম্মাতের শ্রেষ্ঠতম আবূ বাকর সিদ্দীক, অতঃপর উমার, অতঃপর উসমান, অতঃপর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম; কারণ আল্লাহ বলেছেন: ‘‘এবং অগ্রগামীগণ অগ্রবর্তীগণই তো অগ্রবর্তী, তারাই তো নৈকট্যপ্রাপ্ত, নিয়ামতপূর্ণ জান্নাতসমূহে’’। আর (সাহাবীগণের মধ্যে ইসলামগ্রহণে) যে যত বেশি অগ্রবর্তী তাঁর মর্যাদা তত বেশি। আর প্রত্যেক মুত্তাকী মুমিন তাঁদেরকে ভালবাসে এবং প্রত্যেক হতভাগা মুনাফিক তাঁদেরকে বিদ্বেষ করে।’’

অনেক সময় আবেগ-তাড়িত মুমিন পরবর্তী প্রজন্মের কোনো একজন প্রসিদ্ধ বুজুর্গের নেককর্মের আধিক্য দেখে তাকে কোনো সাহাবীর চেয়ে অধিক মর্যাদাশালী বলে মনে করতে থাকেন। এভাবে শীয়াগণ ও অন্য অনেকে তাবিয়ী উমার ইবন আব্দুল আযীয (রাহ)-কে সাহাবী মুআবিয়া ইবন আবী সুফিয়ান (রা) থেকে উত্তম বলে মনে করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান ও ভালবাসার দুর্বলতা থেকে এরূপ ধারণার জন্ম হয়। মুমিনের ঈমানের দাবি যে, তিনি কোনোভাবেই রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাহচর্যের সাথে কোনো নেককর্মের তুলনা করতে পারেন না। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহচর্য, ঈমানের সাথে দু চোখ ভরে তাঁকে দেখা, তাঁর মুখের কথা শোনার বা তাঁর সাথে জিহাদে অংশ নেওয়ার চেয়ে অধিক মর্যাদার কর্ম কি আর কিছু হতে পারে? তাঁর সাহচর্যের মাধ্যমে ঈমান, তাকওয়া ও বেলায়াতের যে গভীরতা অর্জন হয় তা কি আর কোনোভাবে সম্ভব? আর মুমিনের আমলের মর্যাদা শুধু বাহ্যিক পরিমাপ দ্বারা হয় না, বরং ঈমান ও তাকওয়ার গভীরতাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: পরবর্তীদের উহুদ পাহাড় পরিমাণ বা লক্ষ লক্ষ টন সম্পদ দান সাহাবীগণের অর্ধ মুদ্দ বা ২০০/৩০০ গ্রাম সম্পদ দানের সমকক্ষ হতে পারে না। আর এজন্যই পরবর্তী কোনো বুজুর্গ অনেক বেশি আমল করলেও মর্যাদায় কোনো অতি সাধারণ সাহাবীর সমকক্ষ হতে পারেন না। পরবর্তী কোনো প্রজন্মের কোনো বুজুর্গকে কোনো সাহাবীর সমকক্ষ বা উত্তম বলে মনে করলে মূলত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর এবং তাঁর সাহচর্যের অবমূল্যায়ন করা হয়।

এজন্য ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) কোনো তাবিয়ীকে বা অন্য কোনো বুজুর্গকে মুআবিয়া (রা) বা কোনো সাহাবীর সাথে তুলনা করার প্রবণতার প্রবল বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন:


مقام أحدهم مع رسول الله ﷺ ساعة واحدة، خير من عمل أحدنا جميع عمره، وإن طال


‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে একজন সাহাবীর এক মুহূর্তের অবস্থান আমাদের আজীবনের আমলের চেয়েও উত্তম, আমাদের জীবন যতই দীর্ঘ হোক না কেন।’’

এ অর্থে অন্য এক বুজুর্গ বলেন:


غبار دخل في أنف معاوية مع رسول الله ﷺ أفضل من عمل عمر بن عبد العزيز


‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহচর্যে মুআবিয়ার নাকের মধ্যে যে ধুলা প্রবেশ করেছে তাও উমার ইবন আব্দুল আযীযের আমলের চেয়ে উত্তম।’’

ইমাম আবূ হানীফার আকীদা বর্ণনা প্রসঙ্গে চতুর্থ-পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ বিচারপতি সায়িদ নাইসাপূরী (৩৪৩-৪৩২ হি) বলেন:


روي عن ابن المبارك رحمه الله قال: كنت عند أبي حنيفة - رضي الله عنه - مع نوح بن أبي مريم، فقام، فقال: يا أبا حنيفة! إني قد كتبتُ هذه الكتبَ، وأريد أن أكتب من الآثار، فعمَّنْ أحمل؟ فقال: عن كل عدل في هواه إلا الرافضة، فإن أصل عقدِهم تضليلُ أصحاب النبي ﷺ. فَضِّلْ أبا بكر وعمر، وأحِبّ عليّا وعثمانَ، ولا تحمِلِ الآثار عمن لا يُحبّهم.


‘‘আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রাহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আবূ হানীফা (রাদি)-এর নিকট ছিলাম। আমার সাথে নূহ ইবন আবী মরিয়ম ছিলেন। তিনি দাঁড়িয়ে বললেন: হে আবূ হানীফা, আমি তো এ সকল (ফিকহী) কিতাব লেখাপড়া করলাম। এখন আমি হাদীস শিক্ষা করতে চাই। কার নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা করব? আবূ হানীফা বলেন: সকল সৎ-বিশ্বস্ত মুহাদ্দিস থেকে হাদীস শিখবে, যদিও তার মধ্যে কিছু বিদআত থাকে। তবে শীয়া-রাফিযীদের থেকে কিছুই লেখা যাবে না। কারণ তাদের মতবাদের মূল ভিত্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণকে বিভ্রান্ত বলে দাবি করা। তুমি আবূ বকর (রা) ও উমার (রা)-কে সাহাবীগণের মধ্যে সর্বোত্তম বলে বিশ্বাস করবে এবং আলী (রা) ও উসমান (রা)-কে ভালবাসবে। যারা তাঁদেরকে ভালবাসে তারা ছাড়া আর কারো নিকট থেকে হাদীস শিখবে না।’’

সম্মানিত পাঠক, ইমাম আবূ হানীফার এ কথাটি অনুধাবনের জন্য একটি বিষয় চিন্তা করুন। যদি ইহূদীদেরকে প্রশ্ন করা হয়: শ্রেষ্ঠ মানুষ কারা? তারা একবাক্যে বলবেন: আমাদের নবী মূসার (আ) সহচরগণ। যদি খৃস্টানদেরকে প্রশ্ন করা হয়: শ্রেষ্ঠ মানুষ কারা? তারা একবাক্যে বলবেন: আমাদের নবী ঈসার (আ) হাওয়ারী-সহচরগণ। আর যদি শীয়াদেরকে প্রশ্ন করা হয় নিকৃষ্ট-ঘৃণ্যতম মানুষ কারা? তবে তারা একবাক্যে বলবেন: আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সহচরগণ!!

শীয়াদেরকে প্রশ্ন করুন: সবচেয়ে ভাল মানুষ কারা? তারা বলবেন: আলী (রা)-এর সাথীগণ। তাদেরকে প্রশ্ন করুন: সবচেয়ে খারাপ মানুষ কারা? তারা একবাক্যে বলবেন: মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সাথীগণ!!

সম্মানিত পাঠক, কাউকে ভালবাসার অতি স্বাভাবিক প্রকাশ তার সাথে জড়িত সকলকে ভালবাসা ও সম্মান করা। এমনকি তাদের কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলেও অজুহাত খুঁজে তা বাতিল করতে চেষ্টা করা। কারণ প্রিয়তমের সাথীদেরকে খারাপ কল্পনা করতে মন মানে না। আর কারো সঙ্গীসাথীকে সর্বোচ্চ ঘৃণা করার সুনিশ্চিত অর্থ ঐ ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা না থাকা। কাজেই মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সাথীদেরকে পথভ্রষ্ট প্রমাণ করা ও তাঁদেরকে ঘৃণা করা যাদের ধর্মের মূল ভিত্তি তাঁদের থেকে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর হাদীস বা দীন শিক্ষা করা কি সম্ভব?

সাহাবীগণ বিষয়ে ইমাম আযমের আকীদা ব্যাখ্যা করে ইমাম তাহাবী বলেন:


وَنُحِبُّ أَصْحَابَ رسُولِ الله ﷺ، وَلاَ نُفْرِطُ في حُبِّ أَحَدٍ مِنْهُم؛ وَلاَ نَتَبَرَّأُ مِنْ أَحَدٍ مِنْهُم، وَنُبْغِضُ مَنْ يُبْغِضُهُم، وَبِغَيْرِ الخَيْرِ يَذْكُرُهُم، ولا نُذْكُرُهُم إِلاَّ بِخَيْرٍ, وَحُبُّهُم دِينٌ وإيمَانٌ وإحْسَانٌ، وَبُغْضُهُم كُفْرٌ ونِفَاقٌ وطُغْيَانٌ. وَنُثْبِتُ الْخِلافَةَ بَعْدَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ أَوَّلاً لأَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ َفْضِيلاً لَهُ وَتَقْدِيمًا عَلَى جَمِيعِ الأُمَّةِ، ثُمَّ لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ ، ثُمَّ لِعُثْمَانَ ، ثُمَّ لِعَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ ، وَهُمُ الْخُلَفَاءُ الرَّاشِدُونَ وَالأَئِمَّةُ الْمَهْدِيُّونَ. وَإِنَّ الْعَشَرَةَ الَّذِينَ سَمَّاهُمْ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ وَبَشَّرَهُمْ بِالْجَنَّةِ، نَشْهَدُ لَهُمْ بِالْجَنَّةِ عَلَى مَا شَهِدَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ، وَقَوْلُهُ الْحَقُّ، وَهُمْ: أَبُو بَكْرٍ، وَعُمَرُ، وَعُثْمَانُ، وَعَلِيٌّ، وَطَلْحَةُ، وَالزُّبَيْرُ، وَسَعْدٌ، وَسَعِيدٌ، وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ عَوْفٍ، وَأَبُو عُبَيْدَةَ بْنُ الْجَرَّاحِ وَهُوَ أَمِينُ هَذِهِ الأُمَّةِ . وَمَنْ أَحْسَنَ الْقَوْلَ فِي أَصْحَابِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ وَأَزْوَاجِهِ الطَّاهِرَاتِ مِنْ كُلِّ دَنَسٍ، وَذُرِّيَّاتِهِ الْمُقَدَّسِينَ مِنْ كُلِّ رِجْسٍ؛ فَقَدْ بَرِئَ مِنَ النِّفَاقِ. وَعُلَمَاءُ السَّلَفِ مِنَ السَّابِقِينَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ مِنَ التَّابِعِينَ -أَهْلُ الْخَيْرِ وَالأَثَرِ، وَأَهْلُ الْفِقْهِ وَالنَّظَرِ-، لا يُذْكَرُونَ إِلاَّ بِالْجَمِيلِ، وَمَنْ ذَكَرَهُمْ بِسُوءٍ فَهُوَ عَلَى غَيْرِ السَّبِيلِ.


‘‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণকে ভালবাসি। তাঁদের কারো ভালবাসায় সীমালঙ্ঘন করি না এবং তাঁদের কারো প্রতি অভক্তি বা সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করি না। যারা সাহাবীগণকে বিদ্বেষ করে বা ঘৃণা করে বা ভালভাবে ছাড়া তাঁদের উল্লেখ করে আমরা তাদেরকে ঘৃণা করি। আমরা তাঁদেরকে ভাল কথা ছাড়া উল্লেখ করি না। তাঁদেরকে ভালবাসা দীন, ঈমান ও ইহসান। আর তাঁদেরকে বিদ্বেষ করা বা ঘৃণা করা কুফর, নিফাক ও অবাধ্যতা। আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পর আবু বাকর সিদ্দিক (রা)-এর খিলাফত স্বীকার করি এবং তা সমগ্র উম্মতের উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও শীর্ষস্থানীয় হওয়ার কারণে। তারপর উমার ইবন খাত্তাব (রা), তারপর উসমান (রা) এবং তারপর আলী (রা)-এর খিলাফত স্বীকার করি। এরাই হলেন খুলাফায়ে রাশেদীন, (সুপথপ্রাপ্ত খলীফাবৃন্দ) ও আয়িম্মাহ মাহদিয়ীন (মাহদী ইমাম বা হিদায়াতপ্রাপ্ত ইমামবৃন্দ)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে দশজন সাহাবীর নাম উল্লেখ করে তাঁদের জান্নাতবাসী হওয়ার সুসংবাদ দান করেছেন আমার তাঁর এ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাঁদের জান্নাতবাসী হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান করি। কেননা, তাঁর উক্তি সত্য। এরা হলেন: আবু বাকর, উমার, উসমান, আলী, তালহা, যুবায়ের, সা’দ (ইবন আবী ওয়াক্কাস), সাঈদ (ইবন যাইদ ইবন আমর), আব্দুর রহমান বিন আ’ওফ এবং আবু উবায়দাহ বিন জাররাহ (রাঃ)। আর এ শেষোক্তজন এ উম্মতের আমীন (বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি) হিসেবে আখ্যায়িত। আল্লাহ্ তাআলা তাঁদের সবাইর উপর সন্তুষ্ট হোন। যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ, তাঁর নিষ্কলুষ সহধর্মিনী ও পূত-পবিত্র নির্মল বংশধরগণ সম্পর্কে উত্তম মন্তব্য করলো সে নিফাক থেকে মুক্ত হলো। প্রথম যুগের ‘সালাফ সালিহীন’ (নেককার পূর্ববর্তীগণ) ও তাঁদের অনুসারী পরবর্তীকালের কল্যাণময় আলিমগণ, মুহাদ্দিস ও হাদীস অনুসারীগণ এবং ফকীহ-মুজতাহিদ ও ফিকহ-অনুসারীগণ, তাঁদের সকলকেই যথাযোগ্য সম্মান ও প্রশংসার সাথে স্মরণ ও উল্লেখ করতে হবে। আর যে ব্যক্তি তাঁদের সম্পর্কে কটুক্তি বা বিরূপ মন্তব্য করে সে ভ্রান্ত পথের অনুসারী।’’
সুত্রঃ আল-ফিকহুল আকবার (অনুবাদঃ ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.))
হানাফী আলেমদের উদৃতি তো উনাদের ভালো লাগবে না তাই উনাদের ঘরানার শীর্ষ ব্যক্তির অনুবাদ থেকেই নিয়েছি।

আমরা জানি, ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ. সালাফী আলেম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে তার লেখনী ও চিন্তাধারা ভারসাম্যপূর্ণ এবং উপকারী।
তিনি আহলে হাদীস ঘরানার হয়ে ফিকহুল আকবারের অনুবাদ করলেন কিন্ত কোথাও সেই আহলে হাদীস ভাইয়ের আপত্তির দেখা মিলল না, এটা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল-ফিকহুল আকবার কিতাবে এধরনের অবান্তর ও বিভ্রান্ত আকীদার চিহ্ন মাত্রও নেই।
তথাপি আপনি সেই ভাইয়ের এহেন অবান্তর ও বিভ্রান্ত আকীদার একটি স্ক্রিনশট আমাদের namajerSomoy.com এর মেসেঞ্জারে পাঠান।
আমরা বুঝে নিয়ে সেটার রদ্দ বা ব্যাখ্যা দিয়ে দিবো ইনশাআল্লাহ।

আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় এখানে সংক্ষিপ্তাকারে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা ও সাহাবা সমালোচকদের পরিণতি সম্পর্কে কিছুটা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবাগণের মর্যাদা ও ফযীলত কুরআন ও হাদীসের মাঝে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআন বা হাদীসে কোথাও সাহাবাগণের মাঝে ভাল মন্দের কোন পার্থক্য করা হয়নি। বরং সকলকেই হক ও হক্কানিয়্যাতের প্রতিচ্ছবি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এখানে সংক্ষিপ্তাকারে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা ও ফযীলত সম্পর্কে উল্লেখ করা হচ্ছেঃ



عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي، لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي، فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا، مَا أَدْرَكَ مُدَّ أَحَدِهِمْ، وَلَا نَصِيفَهُ»

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা আমার সাহাবীগণের সমালোচনা করো না। তোমরা আমার সাহাবীগণের সমালোচনা করবে না। সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন, যদি তোমাদের মধ্যে কেউ উহুদ পাহাড় বরাবর স্বর্ণ ব্যয় করে তাহলেও তাঁদের কারোর এক মুদ অথবা অর্ধ মুদ্দের সমান হবে না। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৫৪০] এ হাদীস পস্কিার প্রমান করে, সাহাবাগণ আল্লাহর কাছে কত মর্যাদাবান। কত শ্রেষ্ঠ। অন্যরা উহুদ পাহাড় পরিমাণ নেক কাজ করলেও সাহাবাগণের অর্ধেক মুদ পরিমাণ নেক কাজের মুকাবিলা করতে পারে না।



عَنْ ثَوْبَانَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِذَا ذُكِرَ أَصْحَابِي فَأَمْسِكُوا

হযরত সাওবান রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন। যখন আমার সাহাবীদের আলোচনা আসে, তখন [তাদের ব্যাপারে সমালোচনা করা থেকে] নিজেকে বিরত রাখো। [আলমু’জামুল কাবীর লিততাবরানী, হাদীস নং-১৪২৭]

জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহঃ এ হাদীসকে হাসান বলেছেন। [আলজামেউস সাগীর, বর্ণনা নং-৬১৩]

فقد روى هذا الحديث عن ثلاثة من الصحابة واسانيده وان كان فيها مقال كما ذكره فى فيض القدير ولكنه اعتضد بتعدد الروايات فلذالك رمز السيوطى عليه برمز الحسن وعد هذا الحيدث حسنا (احكام القرآن لمفتى شفيع-4/273)



رِيَاحُ بْنُ الْحَارِثِ، قَالَ: كُنْتُ قَاعِدًا عِنْدَ فُلَانٍ فِي مَسْجِدِ الْكُوفَةِ وَعِنْدَهُ أَهْلُ الْكُوفَةِ، فَجَاءَ سَعِيدُ بْنُ زَيْدِ بْنِ عَمْرِو بْنِ نُفَيْلٍ فَرَحَّبَ بِهِ وَحَيَّاهُ وَأَقْعَدَهُ عِنْدَ رِجْلِهِ عَلَى السَّرِيرِ، فَجَاءَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْكُوفَةِ، يُقَالُ لَهُ قَيْسُ بْنُ عَلْقَمَةَ فَاسْتَقْبَلَهُ فَسَبَّ وَسَبَّ، فَقَالَ سَعِيدٌ: مَنْ يَسُبُّ هَذَا الرَّجُلُ؟ قَالَ: يَسُبُّ عَلِيًّا، قَالَ أَلَا أَرَى أَصْحَابَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُسَبُّونَ عِنْدَكَ ثُمَّ لَا تُنْكِرُ، وَلَا تُغَيِّرُ، أَنَا سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ وَإِنِّي لَغَنِيٌّ أَنْ أَقُولَ عَلَيْهِ مَا لَمْ يَقُلْ فَيَسْأَلَنِي عَنْهُ غَدًا إِذَا لَقِيتُهُ: «أَبُو بَكْرٍ فِي الْجَنَّةِ، وَعُمَرُ فِي الْجَنَّةِ» وَسَاقَ مَعْنَاهُ ثُمَّ قَالَ: «لَمَشْهَدُ رَجُلٍ مِنْهُمْ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَغْبَرُّ فِيهِ وَجْهُهُ، خَيْرٌ مِنْ عَمَلِ أَحَدِكُمْ عُمُرَهُ، وَلَوْ عُمِّرَ عُمُرَ نُوحٍ»

রিয়াহ ইবনুল হারিস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি অমুক লোকের নিকট কুফার মাসজিদে বসা ছিলাম এবং তার নিকট কুফার লোকজনও উপস্থিত ছিলো। এ সময় সাঈদ ইবনু যায়িদ আমর ইবনু নুফাইল (রাঃ) এলে তিনি তাকে সাদর সম্ভাষণ ও সালাম জানিয়ে খাটের উপর নিজের পায়ের কাছে বসালেন। অতঃপর কায়িস ইবনু আলকামাহ নামক জনৈক কুফাবাসী এলে তাকেও অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর সে গালাগালি করতে লাগলো। সাঈদ (রাঃ) বললেন, এ ব্যক্তি কাকে গালি দিচ্ছে? তিনি বললেন, সে আলী (রাঃ)-কে গালি দিচ্ছে। তিনি বললেন, আমি দেখতে পাচ্ছি, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীকে আপনার সম্মুখে গালি দিচ্ছে অথচ আপনি তাকে নিষেধ করছেন না আর থামাচ্ছেনও না!
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছিঃ আমি তাঁর সম্পর্কে এমন উক্তি করা থেকে মুক্ত যা তিনি বলেননি। অতঃপর কিয়ামাতের দিন যখন তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে তখন এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। আবূ বাকর (রাঃ) জান্নাতী, উমার (রাঃ) জান্নাতী। বর্ণনাকারী অতঃপর অনুরূপ অর্থের বর্ণনা করলেন এবং তিনি বললেন, তাদের কোনো একজনের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সাহচর্য লাভ, যে সাহচর্যে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না তাও তোমাদের কোনো ব্যক্তির সারা জীবনের আমলের চেয়ে উত্তম, যদিও সে নূহ (আঃ)-এর মতো দীর্ঘ আয়ু পায়। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৬৫০]

এ হাদীসে সমস্ত সাহাবাগণের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। একজন সাহাবী যিনি নবীর সাহচর্য পেয়েছেন, যদিও তার সাহচর্যে নবী সন্তুষ্ট নাও হয়ে থাকেন, তবু সেই সাহাবী সাড়ে নয়শত বছর যাবত ইবাদতকারী ব্যক্তি থেকে উত্তম।



ابْنُ عُمَرَ يَقُولُ: «لَا تَسُبُّوا أَصْحَابَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمُقَامُ أَحَدِهِمْ سَاعَةً، خَيْرٌ مِنْ عَمَلِ أَحَدِكُمْ عُمُرَهُ

ইবনে উমর রাঃ বলেন, তোমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণের সমালোচনা করো না, তাদের এক মুহুর্তের সৎকাজ তোমাদের সারা জীবনের সৎকাজের চেয়ে উত্তম। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৪৬, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৩৩০৮২]



عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: «أُمِرُوا بِالِاسْتِغْفَارِ لِأَصْحَابِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَبُّوهُمْ

হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণের ব্যাপারে ক্ষমা প্রার্থনার আদেশ করা করা হয়েছে, অথচ লোকেরা তাদের সমালোচনা করছে। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৩৩০৮৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৩০২২, মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন, হাদীস নং-৩৭১৯]

উপরোক্ত হাদীস দ্বারা একথা পরিস্কার প্রমাণিত যে, সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে সমালোচনা বা খারাপ মন্তব্য নয়, বরং তাদের জন্য ইস্তিগফার এবং প্রশংসনীয় মন্তব্য করাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তামান্না ছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা অনেকেই তা লঙ্ঘণ করছি। আল্লাহ হিফাযত করুন।



عَنْ عَطَاءٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ سَبَّ أَصْحَابِي فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ

হযরত আত্বা রহঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার সাহাবীর সমালোচনা করে, তার উপর আল্লাহর লানত। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৩৩০৮৬]

সাহাবা সমালোচনা এবং তাদের প্রতি কু-ধারণা পোষণকারীর হুকুম!



وَقَالَ الْمَيْمُونِيُّ قَالَ لِي أَحْمَدُ بْنُ حَنْبَلٍ: يَا أَبَا الْحَسَنِ إِذَا رَأَيْتَ رَجُلًا يَذْكُرُ أَحَدًا مِنَ الصَّحَابَةِ بِسُوءٍ فَاتَّهِمْهُ عَلَى الْإِسْلَامِ.

মাইমুনী রহঃ বলেন, আমাকে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ বলেছেন, হে আবুল হাসান! যখন তুমি দেখবে কোন ব্যক্তি সাহাবাগণের মাঝে কোন সাহাবীর ব্যাপারে সমালোচনা করছে, তাহলে তুমি বুঝে নিও তার ঈমান ও ইসলামে খাদ আছে। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/১৪৮, ১৪৯, ইফাবা-৮/২৬৫]



وَقَالَ الْفَضْلُ بن زياد: سمعت أبا عبد الله يسأل عَنْ رَجُلٍ تَنَقَّصَ مُعَاوِيَةَ وَعَمْرَو بْنَ الْعَاصِ أيقال له رافضي؟ فقال: إنه لم يجترئ عَلَيْهِمَا إِلَّا وَلَهُ خَبِيئَةُ سُوءٍ، مَا انْتَقَصَ أحد أحداً من الصحابة إِلَّا وَلَهُ دَاخِلَةُ سُوءٍ.

ফজল বিন যিয়াদ হযরত ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল রহঃ থেকে শুনেছেন। তাকে একজন প্রশ্ন করল এমন ব্যক্তির ব্যাপারে, যে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এবং হযরত আমর বিন আস রাঃ এর ব্যাপারে মন্দ বলে। লোকটিকে কি রাফেজী বলা হবে?
তখন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ বললেন, অন্তর কলুষিত এবং খারাপ উদ্দেশ্য ছাড়া সে দু’জনের প্রতি এ দুঃসাহস দেখায়নি। আর অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ কোন সাহাবীর সমালোচনা করেনি। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/১৪৮, ১৪৯, ইফাবা-৮/২৬৫]



قَالَ: مَا رَأَيْتُ عُمَرَ بْنَ عَبْدِ الْعَزِيزِ ضَرَبَ إِنْسَانًا قَطُّ إِلَّا إِنْسَانًا شَتَمَ معاوية، فإنه ضرب أسواطاً.

ইবনুল মুবারক বলেন, মুহাম্মদ বিন মুসলিম থেকে, তিনি ইবরাহীম বিন মায়সারা থেকে তিনি বলেন, হযরত মুয়াবিয়ার সমালোচনাকারী এক ব্যক্তি ব্যতীত আমি উমর বিন আব্দুল আজীজকে কোন মানুষের গায়ে হাত উঠাতে দেখিনি। ঐ ব্যক্তিকে তিনি কয়েক ঘা চাবুক লাগিয়ে ছিলেন। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/১৪৮, ১৪৯ ইফাবা-৮/২৬৫, আলইস্তিআব-৩/৩৮৩]



وقال بعض السلف: بينما أَنَا عَلَى جَبَلٍ بِالشَّامِ إِذْ سَمِعْتُ هَاتِفًا يَقُولُ: مَنْ أَبْغَضَ الصِّدِّيقَ فَذَاكَ زِنْدِيقٌ، وَمَنْ أبغض عمر فإلى جهنم زمراً، وَمَنْ أَبْغَضَ عُثْمَانَ فَذَاكَ خَصْمُهُ الرَّحْمَنُ، وَمَنْ أبغض علياً فَذَاكَ خَصْمُهُ النَّبِيُّ، وَمَنْ أَبْغَضَ مُعَاوِيَهْ سَحَبَتْهُ الزبانية، إلى جهنم الحامية، يرمى به في الحامية الْهَاوِيَهْ

সালাফে সালেহীনদের একজন বলেন, যখন আমি শামের এক পাহাড়ে অবস্থান করছিলাম তখন এক (অদৃশ্য) ঘোষককে বলতে শুনলাম-সিদ্দীকের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী হল যিনদীক, ধর্মদ্রোহী। উমরের প্রতি বিদ্বেষীর ঠাঁই হল জাহান্নাম। উসমান বিদ্বেষীর প্রতিপক্ষ হলেন আল্লাহ। আলী বিদ্বেষীর প্রতিপক্ষ হলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর যে মুয়াবিয়ার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে (জাহান্নামের) ফেরেশতারা তাকে হেঁচড়ে নিয়ে যাবে। উত্তপ্ত জাহান্নামের দিকে এবং সে নিক্ষিপ্ত হবে উত্তপ্ত অগ্নি গহ্ববরে। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/১৪৮-১৪৯, ১৪৯-১৫০, ইফাবা-৮/২৬৫-২৬৬]


আব্দুল আজীজ বিন আহমাদ বিন হামেদ কুরাইশী রহঃ লিখেছেনঃ

فحُسن الظن والتأدب لجميعهم واجب على كل مسلم. فهذا مذهب السلف الصالح وأهل الحديث والأصول. ونسأل الله الثبات عليه.

সমস্ত সাহাবাগণের প্রতি সুধারণা রাখা এবং আদব রাখা সকল মুসলমানের উপর ওয়াজিব। সালাফে সালেহীন, আহলে হাদীস এবং আহলে উসূল (আহলে ফিক্বহ) এর এটাই মতাদর্শ। আর আমরা আল্লাহ কাছে এর উপরই অটল থাকার আর্জি জানাই। [আননাহিয়াহ আন তা’নি আমীরিল মু’মিমীনা মুয়াবিয়াহ-৬৭]



শামসুল আইয়িম্মাহ সারাখসী রহঃ লিখেনঃ

لِأَن الله تَعَالَى أثنى عَلَيْهِم فِي غير مَوضِع من كِتَابه كَمَا قَالَ تَعَالَى {مُحَمَّد رَسُول الله وَالَّذين مَعَه} الْآيَة وَرَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَصفهم بِأَنَّهُم خير النَّاس فَقَالَ خير النَّاس قَرْني الَّذين أَنا فيهم والشريعة إِنَّمَا بلغتنا بنقلهم فَمن طعن فيهم فَهُوَ ملحد منابذ لِلْإِسْلَامِ دواؤه السَّيْف إِن لم يتب

কুরআনে কারীমের একাধিক স্থানে আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরাম রাঃ এর প্রশংসা করেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন {مُحَمَّد رَسُول الله وَالَّذين مَعَه} الْآيَة এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় ইরশাদে সাহাবাগণকে খাইরুন্নাস তথা সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ হবার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। আর এ লোকেরা সেই জমানার শ্রেষ্ঠ মানুষ যে জমানায় আমি নবী রয়েছি। শরীয়তে ইসলামিয়া সাহাবাগণের মাধ্যমেই বর্ণিত হয়ে আমাদের পর্যন্ত এসেছে। [অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম ইসলামী শরীয়তের বিস্তারকারী] সুতরাং যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে সমালোচনা করবে সে মুলহিদ এবং বে-দ্বীন। ইসলামের দিকে পৃষ্ঠপ্রদর্শনকারী। যদি সে ব্যক্তি তওবা না করে তাহলে তার একমাত্র সমাধান তলোয়ার। [উসূলে সারাখসী-২/১৩৪]



আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ লিখেছেনঃ

ثم أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم بعد هؤلاء الأربعة خير الناس لا يجوز لأحد أن يذكر شيئا من مساويهم ولا يطعن على أحد منهم بعيب ولا نقص فمن فعل ذلك فقد وجب على السلطان تأديبه وعقوبته ليس له أن يعفو عنه بل يعاقبه ويستتيبه فإن تاب قبل منه وإن ثبت أعاد عليه العقوبة وخلده الحبس حتى يموت أو يراجع

চারজন খলীফায়ে রাশেদের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমস্ত সাহাবা রাঃ খাইরুন নাস। তাদের ব্যাপারে সামান্য খারাবী বর্ণনা করাও কারো জন্য জায়েজ নয়। কোন একজন সাহাবীর দোষ এবং ত্রুটি বর্ণনা করার সুযোগ নেই। যদি কোন ব্যক্তি এ কাজ করে, তাহলে শাসকের দায়িত্ব হল, তাকে শিক্ষা দেয়া এবং তাকে শাস্তি দেয়া। তাকে ক্ষমা করা যাবে না, বরং তাকে শাস্তি দিতে হবে। যদি সে তওবা করে, তাহলে তার তওবা গ্রহণ করা হবে। যদি সে তওবা না করে সমালোচনার উপর অটল থাকে, তাহলে তাকে দ্বিতীয়বার আবার কড়া শাস্তি দিতে হবে এবং তাকে আজীবনের জন্য বন্দী করবে যতক্ষণ না সে মারা যায় বা তওবা করে। [আসসারেমুল মাসলূল আলা শাতিমির রাসূল-৫৭৩, ৫৬৮]

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আমরা বুঝতে পারলামঃ



সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম রাঃ এর ব্যাপারে সুধারণা রাখতে হবে। কুধারণা করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।



সাহাবায়ে কেরাম রাঃ এর ব্যাপারে যে ব্যক্তি খারাপ মন্তব্য করবে বা সমালোচনা করবে তার ইসলাম সন্দেহযুক্ত, শরীয়তে তার দ্বীনের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।



হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ এবং আমর বিন আস রাঃ এর ব্যাপারে সমালোচনাকারী ব্যক্তি কুধারণার স্বীকার এবং তার অন্তর নোংরামীতে ভরপুর।



হযরত উমর বিন আব্দুল আজীজের মত ন্যায়পরায়ন শাসক পর্যন্ত হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর ব্যাপারে সমালোচনাকারীকে চাবুক মারতেন। যেন উক্ত ঘৃণিত কাজ থেকে ফিরে আসে এবং ভবিষ্যতে একাজ করার সাহস না পায়।



যে কোন সাহাবীর ব্যাপারে খারাপ মন্তব্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাকে তওবা করানো হবে। যদি তওবা না করে তাহলে তাকে আজীবনের জন্য বন্দী করা হবে। তওবা করলে মুক্তি মিলবে নতুবা মৃত্যু পর্যন্ত বন্দীত্বের শাস্তি ভোগ করতে হবে।

আল্লাহ্‌ আমল করার তাওফীক দান করেন।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৪১২২৭

নাপাক অবস্থায় নামাজ পড়লে কি মানুষ মুরতাদ হয়ে যায়?


২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

আশুলিয়া

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৪১৩৩৪

ব্যাংকের অনুদান গ্রহণ করা জায়েজ?


৩ অক্টোবর, ২০২৩

শ্রীনগর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি জাওয়াদ তাহের

৩৭৫২৮

পালক পিতা-মাতার হক


৯ আগস্ট, ২০২৩

রংপুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৫৩৮১১

বাজি ধরে ক্রিকেট খেলা


১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

গফরগাঁও - টোক সড়ক

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী মুহাম্মাদ রাশেদুল ইসলাম

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy