আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

অন্যের ঘরে প্রবেশের জন্য অনুমতি গ্রহণ

প্রশ্নঃ ৬৬৫৩৫. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, জনাব হযরত মুফতি সাহেবের নিকট আমার একটি প্রশ্ন অন্যের ঘরে প্রবেশের সময় সালাম দিয়ে অনুমতি নেওয়া এটা কি ফরজ না সুন্নত? দয়া করে জানালে উপকৃত হতাম।,

৫ জুলাই, ২০২৪

ওয়েস্ট বেঙ্গল ৭০০১৩৫

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


অন্যের ঘরে প্রবেশের জন্য অনুমতি গ্রহণ
মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহমান
মাসিক আলকাউসার: সফর ১৪৩৮ হি. নভেম্বর ২০১৬ ইং


অন্ন-বস্ত্রের মত বাসস্থানও মানুষের একটি মৌলিক প্রয়োজন এবং আল্লাহ তাআলার এক অমূল্য নিআমত। এর আসল উদ্দেশ্য হল বিশ্রাম, শান্তি ও বসবাস।

প্রত্যেকে নিজ নিজ ঘরে তার একান্ত জীবনটি যাপন করে। এই জীবন যাপন যাতে নির্বিঘ্ন ও নিরুপদ্রব হয় সেজন্য ইসলাম কিছু নীতি ও বিধান দান করেছে, যার চর্চা ও অনুশীলন একটি সভ্য সমাজের জন্য অতি প্রয়োজন। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান, যা সরাসরি কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে, এ লেখায় শিরোনাম করা হয়েছে। অর্থাৎ অন্যের ঘরে প্রবেশের জন্য অনুমতি নেওয়া। বিধানটি যে সভ্যতা ও শান্তির এক বড় অনুষঙ্গ তা সাধারণ বুদ্ধিতেও বোঝা যায়।

একে অপরের ঘরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলে বহু রকমের বিব্রতকর ও বিরক্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যথা-

ঘরে কখনো একান্ত ব্যক্তিগত কাজ করা হয় যা অন্য কারো দৃষ্টিগোচর হওয়া ঘরের বাসিন্দার অপছন্দ।

কখনো একান্ত জরুরি কাপড় ছাড়া অন্য কাপড় খুলে রাখা হয় (বা খুলে যায়)। এ অবস্থায় বিনা অনুমতিতে কেউ প্রবেশ করে ফেললে সে বিব্রত বোধ করে।

আবার কখনো কোনো বিষয়ে গভীর মনোনিবেশ করা হয়। এক্ষেত্রে অকস্মাৎ কেউ এসে পড়লে সে চমকে উঠে; দিল-দেমাগের উপর চোট পড়ার আশংকা থাকে। এ সমস্যাগুলো কারো একান্ত কক্ষে বিনা অনুমতিতে প্রবেশের দ্বারা ঘটতে পারে।

তাছাড়া ঘরে-বাড়িতে হঠাৎ কেউ ঢুকে গেলে মাহরাম নয় এমন কোনো পুরুষ বা মহিলার উপর দৃষ্টি পড়ে যেতে পারে।

আরেকটি বিষয় হল কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে তাকে তো সাক্ষাতদানের জন্য অন্তত মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। আর সাক্ষাতের বাইরে অন্য কোনো প্রয়োজন থাকলে তো কথাই নেই।

মোটকথা অনুমতি ছাড়া কারো বাড়িতে বা ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশ হতে পারে পর্দা নষ্টের কারণ কিংবা বিরক্তি ও কষ্টের কারণ। তাই অন্যের ঘরে বা কক্ষে প্রবেশের জন্য অনুমতি নিতে হবে। বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা নাজায়েয এবং সাধারণ ভদ্রতা ও সুরুচিরও পরিপন্থী।

অনুমতির বিষয়টি কী গুরুত্বপূর্ণ তা এ থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিধান দেওয়া হয়েছে এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে তা শুধু মৌখিক ও আমলগতভাবেই শিক্ষা দেননি; বরং এক্ষেত্রে কারো ভুল হলে তৎক্ষণাৎ তাকে সতর্ক করেছেন। এখানে সেসব শিক্ষা-নির্দেশনার মধ্য থেকে জরুরি কিছু বিষয় আলোচনা করা হল, যেগুলো যথাযথ চর্চা ও অনুসরণ করা হলে আমাদের পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ হবে আনন্দপূর্ণ ও কল্যাণকর।



অনুমতি গ্রহণের পদ্ধতি

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُیُوْتًا غَیْرَ بُیُوْتِكُمْ حَتّٰی تَسْتَاْنِسُوْا وَ تُسَلِّمُوْا عَلٰۤی اَهْلِهَا ذٰلِكُمْ خَیْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ .

হে মুমিনগণ! নিজ ঘর ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না অনুমতি নাও এবং তার অধিবাসীদের সালাম দাও। এ পন্থাই তোমাদের জন্য উত্তম। হয়তো তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে। -সূরা নূর (২৪) : ২৭

এখানে দুটো কাজ করা ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। একটি হল ঘরের বাসিন্দার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া আর দ্বিতীয়টি সালাম দেওয়া। হাদীস ও খাইরুল কুরূনের আমল থেকে জানা যায়, উত্তম হল আগন্তুক বাইরে দাঁড়িয়ে আগে সালাম দিবে; তারপর প্রবেশের অনুমতি চাইবে।

কালাদা ইবনে হাম্বল রা. থেকে বর্ণিত, সাফওয়ান ইবনে উমায়্যাহ রা. তাকে দুধ, হরিণের বাচ্চা ও দুগবূস (একপ্রকার শস্য) দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠালেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি তাঁর কাছে গেলাম কিন্তু সালাম দেইনি এবং অনুমতিও নেইনি। তিনি আমাকে বললেন, তুমি বেরিয়ে সালাম দাও; তারপর বল, আমি কি প্রবেশ করব? -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭১০; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৭৬

অপর এক হাদীসে আছে, আমের গোত্রের এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুমতি চাইতে গিয়ে বলল, ‘আ-আলিজু’। (এ শব্দটি আরবীতে কোনো সংকীর্ণ স্থানে প্রবেশের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদেমকে বললেন, তুমি গিয়ে তাকে অনুমতি চাওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দাও। তাকে বল, তুমি সালাম দিয়ে বলবে, ‘আ-আদখুলু’- আমি কি প্রবেশ করব? লোকটি বাইরে থেকে তা শুনে সালাম দিয়ে বলল, ‘আ-আদখুলু’। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি দেন। তারপর সে প্রবেশ করে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৭৭



কলিংবেল দেয়া ও দরজায় নক করা

যদি মনে হয় সালাম ও অনুমতি প্রার্থনার আওয়ায ভেতর থেকে শুনবে না, তাহলে কলিংবেল থাকলে সেটা চাপবে অথবা দরজায় নক করবে। তারপর কেউ সামনে এলে সালাম দিয়ে অনুমতি চাইবে।

কলিংবেল দেয়া, দরজায় নক করা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অনেকের মাত্রাজ্ঞানের অভাব থাকে। বারবার বেল চাপতে থাকে বা খুব জোরে দরজায় আওয়ায করে, যা অনেক সময় ঘরের লোকদের চমকে ওঠার কারণ হয়। বেল চাপার পর অপেক্ষা করা উচিত, তেমনি দরজায় নক করার ক্ষেত্রে এটুকুই যথেষ্ট, যার দ্বারা যথাস্থানে আওয়ায পৌঁছে। বিশেষত আলেম-বুযুর্গ ও বড়দের কাছে গেলে এ বিষয়ে খেয়াল রাখা খুব জরুরি। দেখুন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের আদব কেমন ছিল। নবীজীর খাদেম আনাস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরজায় নখ দ্বারা আওয়াজ করা হত। (আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১০৮০) এ বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁদের উচ্চতর আদব, সম্মান ও মুহাব্বতের বহিঃপ্রকাশ।



নাম-পরিচয় উল্লেখ

কখনো তো সালাম ও অনুমতি প্রার্থনার আওয়ায থেকেই ঘরের বাসিন্দা অনুমতিপ্রার্থীকে চিনে ফেলে। কিন্তু সবসময় তা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে ভেতর থেকে নাম-পরিচয় জানতে চাইলে তা পরিষ্কারভাবে বলতে হবে। কারণ নাম-পরিচয় জানতে চাওয়ার অর্থই হল সালাম ও অনুমতি প্রার্থনার আওয়ায থেকে আগন্তুককে চেনা যায়নি। আর না চিনলে অনুমতি দিতেও দ্বিধা হয়। এজন্য উত্তম হল সালাম ও অনুমতি প্রার্থনার সাথেই নাম-পরিচয় বলে দেওয়া।

ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, উমর রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে সালাম দিয়ে বললেন, উমর কি প্রবেশ করবে? -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২৭৫৬

একদিন প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু মূসা আশআরী রা. উমর রা.-এর কাছে এসে সালাম দিয়ে বললেন, এ (আগন্তুক) আবদুল্লাহ ইবনে কায়েস। জবাব না আসায় দ্বিতীয়বার সালাম দিয়ে বললেন, এ আবু মূসা। এবারও জবাব না আসায় তৃতীয়বার সালাম দিয়ে বললেন, এ আশআরী। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৫৪

এখানে লক্ষণীয় যে, প্রথমবার তিনি শুধু নাম বলেছেন। কিন্তু জবাব না আসায় এ সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, ভেতর থেকে হয়তো চিনেনি। তাই দ্বিতীয়বার যে নামে বেশি প্রসিদ্ধ সেটা বললেন- আবু মূসা (উপনাম)। এবারও জবাব না আসায় আরো পরিচয় দেন- আশআরী।



আমি আমি করা অনুচিত

ঘরের বাসিন্দার জন্য এক বিরক্তিকর ব্যাপার হয়, যখন আগন্তুকের পরিচয় জানতে চাওয়ার পরও নাম-পরিচয় না বলে শুধু আমি আমি করে কিংবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আমি আমি করলে বা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে তো প্রশ্নের উত্তর হয় না। যখন সালাম ও অনুমতি প্রার্থনার আওয়াযে আগন্তুককে চেনা যায়নি তখন শুধু ‘আমি’ বললে কীভাবে চিনবে?

জাবির রা. থেকে বর্ণিত, একবার আব্বার করযের ব্যাপারে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরজায় এসে করাঘাত করলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কে? বললাম, আমি। তিনি অসন্তুষ্টির স্বরে বললেন, ‘আমি আমি।’ (অর্থাৎ জানতে চাওয়া হয়েছে, নাম-পরিচয় আর তুমি বলছ, ‘আমি’!) -সহীহ বুখরী, হাদীস ৬২৫০, সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৫৫



দরজায় দাঁড়ানোর নিয়ম

অনুমতি গ্রহণের ক্ষেত্রে একেবারে দরজা বরাবর দাঁড়ানো সমীচীন নয়, বরং ডানে-বামে কিছুটা সরে দাঁড়ানো কর্তব্য। দরজা-জানালা বা অন্য কোনোভাবে ঘরের ভেতর উঁকি দেওয়া তো খুবই আপত্তিকর। উঁকি দিলে বা দরজা বরাবর দাঁড়ালে অনাকাক্সিক্ষত কোনো কিছুর উপর দৃষ্টি পড়ে যেতে পারে।


আবদুল্লাহ ইবনে বুস্র রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কারো দরজায় আসতেন তখন একেবারে দরজা বরাবর দাঁড়াতেন না। বরং ডান দিকে বা বাম দিকে দাঁড়াতেন এবং সালাম দিতেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৮৬

সাহ্ল ইবনে সা‘দ রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কামরায় উঁকি দিল। তাঁর সঙ্গে তখন চিরুনি জাতীয় একটি জিনিস ছিল। তিনি বললেন,

لو أعلم أنك تنظر، لطعنت به في عينك، إنما جعل الاستئذان من أجل البصر.

‘আমি যদি জানতাম তুমি দৃষ্টি ফেলবে, তবে এটা দিয়ে তোমার চোখে খোঁচা মারতাম। অনুমতি চাওয়ার বিধান তো দৃষ্টির কারণেই।’ অর্থাৎ, যাতে অনাকাক্সিক্ষত কোনো কিছুর উপর দৃষ্টি না পড়ে যায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬২৪১

অপর এক হাদীসে এসেছে, কোনো মুসলিমের জন্য অনুমতি না নেওয়া পর্যন্ত অন্যের ঘরের ভেতর দৃষ্টি দেওয়া জায়েয নয়। যদি দৃষ্টি দেয়, তবে যেন ঢুকেই পড়ল। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৭



জবাব না এলে

একবার অনুমতি চাওয়ার পর ভেতর থেকে কোনো জবাব না এলে দ্বিতীয়বার চাওয়া যাবে। দ্বিতীয়বার না এলে তৃতীয়বারও চাওয়া যাবে। কিন্তু তৃতীয়বার জবাব না এলে ফিরে আসতে হবে।

তিনবার অনুমতি চাওয়ায় এটা তো মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ভেতরে আওয়ায পৌঁছেছে। কিন্তু ঘরে হয়তো কেউ নেই। অথবা থাকলেও এমন কোনো অবস্থায় আছে যে, অনুমতি দিতে পারছে না (যেমন নামায পড়ছে বা গোসল করছে) অথবা এ মুহূর্তে অনুমতি দেওয়া তার পছন্দ নয় কিন্তু সরাসরি অস্বীকৃতি জানাতে সংকোচ বোধ করছে কিংবা খবর পাঠানোর জন্য কাউকে পাচ্ছে না ইত্যাদি।

আর এ সকল অবস্থায় সে মাযূর ও অপারগ। সক্ষমতা-অসক্ষমতা মিলিয়েই মানুষের জীবন। কখনো সে অপারগ হয়, না বাইরে আসতে পারে, না আগন্তুককে ভেতরে ডাকতে পারে। তাই পরস্পরের ওযর-সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতে হবে এবং সহজভাবে নিতে হবে। এতে নারাজ হওয়া বা তা অগ্রাহ্য করা উচিত হবে না। সুতরাং তিনবার অনুমতি চাওয়ার পরও জবাব না এলে ফিরে আসতে হবে। আর সরাসরি ফিরে যেতে বললে তো কোনো কথাই নেই।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দ্ব্যর্থহীন ইরশাদ-

فَاِنْ لَّمْ تَجِدُوْا فِیْهَاۤ اَحَدًا فَلَا تَدْخُلُوْهَا حَتّٰی یُؤْذَنَ لَكُمْ وَ اِنْ قِیْلَ لَكُمُ ارْجِعُوْا فَارْجِعُوْا هُوَ اَزْكٰی لَكُمْ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِیْمٌ.

তোমরা যদি তাতে কাউকে না পাও, তবু যতক্ষণ না তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়া হয়, তাতে প্রবেশ করো না। তোমাদেরকে যদি বলা হয়, ফিরে যাও, তবে ফিরে যাও। এটাই তোমাদের জন্য উৎকৃষ্ট পন্থা। তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞাত। -সূরা নূর (২৪) : ২৮

আবু মূসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনবার অনুমতি চাওয়া যাবে। মঞ্জুর হলে (তো ভালো)। অন্যথায় ফিরে যাবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৫৪

এখানে দেখা-সাক্ষাতের ক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষার সৌন্দর্য ও ভারসাম্য লক্ষণীয়। সাক্ষাৎপ্রার্থীকে বলা হচ্ছে সে যেন যার সাক্ষাতে যায় পুরোপুরি তার সুবিধা-অসুবিধাকে প্রাধান্য দেয়- প্রবেশের আগে অনুমতি তলব করে, তা গৃহীত হলে প্রবেশ করে অন্যথায় খুশি মনে ফিরে আসে ইত্যাদি। অন্যদিকে যার সাক্ষাৎ কাম্য তাকে বলা হচ্ছে,

إِنَّ لِزَوْرِكَ عَلَيْكَ حَقًّا.

তোমার উপর তোমার সাক্ষাৎপ্রার্থীরও কিছু হক আছে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৭৫) যেমন তাকে ভেতরে ডাকা বা বাইরে এসে সাক্ষাৎ করা। তার সম্মান করা, কথা শোনা। বিশেষ ওযর ছাড়া অস্বীকৃতি না জানানো। কোনো প্রয়োজনে এলে সামর্থ্য থাকলে তা পূরণের চেষ্টা করা ইত্যাদি।



মাহরামের ঘরে গেলে

মাহরাম আত্মীয়দের (যাদের পারস্পরিক বিবাহ হারাম) পরস্পরের মধ্যে পর্দার বিধান না থাকলেও একে অপরের ‘সতর’ দেখা নাজায়েয। আর ব্যক্তিগত কাজ, অবস্থা ও অবস্থান তো প্রত্যেকেরই কমবেশি থাকে। এ কারণে প্রাপ্তবয়স্ক মাহরামদেরও একে অন্যের ঘরে গেলে সর্বদা অনুমতি নেওয়া উচিত। পিতা-মাতা, প্রাপ্তবয়স্ক ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে সকল মাহরামের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য।

তবে সাবালকত্বে পৌঁছেনি এমন শিশুরা যেহেতু সাধারণত ঘরে ছোটাছুটি করে তাই তারা শুধু ঐ সময়গুলোতে অনুমতি নিবে যে সময়গুলোতে বড়রা বিশ্রাম ও একান্তে অবস্থান করে। এছাড়া অন্য সময়ে তাদের অনুমতি নিতে হবে না। বড়দের কর্তব্য নিজেদের বিশ্রাম ও একান্তে অবস্থানের সময়গুলোতে শিশুদের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করার শিক্ষা দেওয়া ও উদ্বুদ্ধ করা। যাতে এ সময়গুলোতে তারাও অনুমতি ছাড়া বড়দের ঘরে প্রবেশ না করে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لِیَسْتَاْذِنْكُمُ الَّذِیْنَ مَلَكَتْ اَیْمَانُكُمْ وَ الَّذِیْنَ لَمْ یَبْلُغُوا الْحُلُمَ مِنْكُمْ ثَلٰثَ مَرّٰتٍ مِنْ قَبْلِ صَلٰوةِ الْفَجْرِ وَ حِیْنَ تَضَعُوْنَ ثِیَابَكُمْ مِّنَ الظَّهِیْرَةِ وَ مِنْۢ بَعْدِ صَلٰوةِ الْعِشَآءِ ثَلٰثُ عَوْرٰتٍ لَّكُمْ لَیْسَ عَلَیْكُمْ وَ لَا عَلَیْهِمْ جُنَاحٌۢ بَعْدَهُنَّ طَوّٰفُوْنَ عَلَیْكُمْ بَعْضُكُمْ عَلٰی بَعْضٍ كَذٰلِكَ یُبَیِّنُ اللهُ لَكُمُ الْاٰیٰتِ وَ اللهُ عَلِیْمٌ حَكِیْمٌ . وَ اِذَا بَلَغَ الْاَطْفَالُ مِنْكُمُ الْحُلُمَ فَلْیَسْتَاْذِنُوْا كَمَا اسْتَاْذَنَ الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ كَذٰلِكَ یُبَیِّنُ اللهُ لَكُمْ اٰیٰتِهٖ وَ اللهُ عَلِیْمٌ حَكِیْمٌ.

হে মুমিনগণ! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা এখনো সাবালকত্বে পৌঁছেনি সেই শিশুরা যেন তিনটি সময়ে অনুমতি গ্রহণ করে- ফজরের নামাযের আগে, দুপুর বেলা যখন তোমরা পোশাক খুলে রাখ এবং এশার নামাযের পর। এ তিনটি তোমাদের গোপনীয়তা অবলম্বনের সময়। এ তিন সময় ছাড়া অন্য সময়ে তোমাদের ও তাদের প্রতি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তোমাদের পরস্পরের মধ্যে তো সার্বক্ষণিক যাতায়াত থাকেই। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের কাছে তার আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে থাকেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তোমাদের শিশুরা সাবালক হয়ে গেলে যেন অনুমতি গ্রহণ করে, যেমন তাদের আগের বয়ঃপ্রাপ্তরা অনুমতি গ্রহণ করে আসছে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। -সূরা নূর (২৪) : ৫৮-৫৯

এখানে বিশেষ তিনটি সময়ে শিশুদেরকেও অনুমতি নিয়ে প্রবেশের আদেশ করা হয়েছে। কারণ, এ সময়গুলোতে সাধারণত মানুষ একটু খোলামেলা থাকতে পছন্দ করে। এ অবস্থায় হঠাৎ কেউ উপস্থিত হয়ে গেলে পর্দাহীনতার আশংকা থাকে আর আরাম-বিশ্রামের তো বিঘœ ঘটেই। কিন্তু অন্য সময়ে যেহেতু এসব ভয় থাকে না আবার তারা বেশি বেশি যাতায়াতও করে তাই তখন তারা বিনা অনুমতিতেও প্রবেশ করতে পারবে। কিন্তু সাবালকত্বে পৌঁছে যাওয়া ছেলে-মেয়ে এবং বড়দের অনুমতির বিষয়টি এ তিন সময়ে সীমাবদ্ধ না করে তাদেরকে সাধারণভাবে অনুমতি নেওয়ার আদেশ করা হয়েছে।

আলকামা থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি মায়ের কাছে গেলে অনুমতি নিব? বললেন, সব অবস্থায় তোমার তাকে দেখা পছন্দ হবে না। -আলআদাবুল মুফরাদ, বর্ণনা ১০৫৯

আতা ইবনে আবী রাবাহ থেকে বর্ণিত, আমি ইবনে আব্বাস রা.-কে জিজ্ঞাসা করলাম, বোনের কাছে গেলে কি আমি অনুমতি নিব? বললেন, হাঁ। বর্ণনাকারী বলেন, আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, আমার প্রতিপালনে দুটি বোন আছে, আমি তাদের দেখাশোনা করি এবং তাদের জন্য খরচ করি, তাদের কাছে গেলেও কি আমার অনুমতি নিতে হবে? বললেন, হাঁ। তোমার কি তাদেরকে বিবস্ত্র দেখা পছন্দ হবে? এরপর তিনি সূরা নূরের ৫৮ ও ৫৯ নং আয়াত পাঠ করে বলেন, সকলের জন্য অনুমতি নেওয়া জরুরি। -প্রাগুক্ত, বর্ণনা ১০৬৩



মহিলা মহিলার ঘরে গেলে

অন্য অনেক বিধানের মত এই বিধানও নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য। পুরুষ পুরুষের বা মহিলার ঘরে গেলে যেমন অনুমতি নিতে হবে, তেমনি মহিলা যদি পুরুষের বা মহিলার ঘরে যায় তাকেও অনুমতি নিতে হবে।



ডেকে পাঠালে

কখনো খাদেম বা অন্য কারো মাধ্যমে কাউকে ডাকা হয়। এক্ষেত্রে দূতের সাথে এলে কিংবা দেরি না হলে অনুমতি নিতে হবে না। ডেকে পাঠানোই অনুমতি হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু দেরিতে এলে অনুমতি নিতে হবে।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কারো কাছে দূতের আগমন তার জন্য অনুমতি গণ্য হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৮৯



পাবলিক নিবাস হলে

এ পর্যন্ত ব্যক্তিবিশেষের ঘরে প্রবেশের আদব আলোচিত হয়েছে যে, এতে প্রবেশের জন্য অনুমতি নেওয়া জরুরি। কিন্তু অনেক ঘর আছে, যা ব্যক্তিবিশেষের বাসস্থান নয়, বরং সাধারণভাবে তা যে কারো ব্যবহার করার অনুমতি আছে। যেমন গণ-মুসাফিরখানা, হাসপাতাল, ডাকঘর, পার্ক, মসজিদ, মাদরাসা ইত্যাদি। এধরনের ঘরে প্রবেশের জন্য অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। একইভাবে ব্যক্তিবিশেষের ঘরেও কোনো সময়ে নির্দিষ্ট কারো কিংবা সবার উন্মুক্ত সাক্ষাতের অনুমতি থাকলে সে সময়ে প্রবেশ করতে অনুমতি নিতে হবে না।[1]

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

لَیْسَ عَلَیْكُمْ جُنَاحٌ اَنْ تَدْخُلُوْا بُیُوْتًا غَیْرَ مَسْكُوْنَةٍ فِیْهَا مَتَاعٌ لَّكُمْ وَ اللهُ یَعْلَمُ مَا تُبْدُوْنَ وَ مَا تَكْتُمُوْنَ.

যে ঘরে কেউ বাস করে না এবং তা দ্বারা তোমাদের উপকার গ্রহণের অধিকার আছে, তাতে তোমাদের প্রবেশে কোনো গোনাহ নেই। তোমরা যা প্রকাশ্যে কর এবং যা গোপনে কর আল্লাহ তা জানেন। -সূরা নূর (২৪) : ২৯

স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের ঘরে গেলে

নিজ ঘরে (যে ঘরে ব্যক্তি একা থাকে) প্রবেশের ক্ষেত্রে ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বাধীন। আর যে ঘরে স্বামী-স্ত্রী একা থাকে সেটা তাদের নিজস্ব ঘর। এতে প্রবেশের জন্য তাদের পরস্পরের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে উত্তম হল অকস্মাৎ ঢুকে না পড়া, বরং গলা খাঁকারি, পায়ের আওয়াজ অথবা অন্য কোনো উপায়ে অবগত করে প্রবেশ করা।

যয়নব সাকাফী রা. (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর স্ত্রী) বলেন, আবদুল্লাহ যখন কোনো প্রয়োজন সেরে দরজায় এসে পৌঁছতেন তখন গলা খাঁকারি দিতেন এবং থুথু ফেলতেন। যাতে অকস্মাৎ আমাদেরকে এমন কোনো অবস্থায় দেখে না ফেলেন যা তার খারাপ লাগবে। -তাফসীরে তাবারী ১৭/২৪৫; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৬/৪১-৪২




[1] ১. তবে যেসব প্রতিষ্ঠানে অনুমতি-অধিকার সংরক্ষিত সেখানে অসংশ্লিষ্টদের জন্য অনুমতি নেওয়া জরুরি। (আবদুল মালেক)

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি
উস্তাজুল ইফতা, জামিয়া ইমাম বুখারী, উত্তরা, ঢাকা।

প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৫৮৯৮৩

শাওয়ালের ছয় রোযা


২৮ মার্চ, ২০২৪

West Bengal ৭৪৩৪২৮

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৪৯০৬৭

ঘুমানোর দুআ


১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

২PWJ+৩৩G

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী মুহাম্মাদ রাশেদুল ইসলাম

৬৫৫০৩

জানাযাহ নামায পড়ার নিয়ম


২৭ জুন, ২০২৪

ওয়েস্ট বেঙ্গল ৭০০১৪২

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ ইসহাক মাহমুদ

৪৭৮৯০

হজরত সালাবা রা. এর সম্পদ অর্জন এবং জাকাত আদায়ের সম্পূর্ণ ঘটনা


৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

৩৪৭৭+RMM

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy