আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

হত্যাকারীর তাওবা কবুল হবে কি ?

প্রশ্নঃ ২৮৬৩২. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমরা জানি যে, কেও তওবা করলে আল্লাহ সকল গুনাহ মাফ করেন। এমনকি কেউ যদি শির্ক করে আবার ইমান আনে আর তওবা করে তাহলে সেই শির্ক এর গুনাহ ও আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু একটা হাদিসে পরলাম কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কাওকে হত্যা করে তাহলে তার তওবা কবুল হবে না সাঈদ ইবন জুবায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি ইবন আব্বাস (রাঃ) -কে জিজ্ঞাসা করলাম, যে ব্যক্তি কোন মু’মিনকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করে তার তাওবা কবূল হবে কী? তিনি বললেনঃ না। আমি তার নিকট সূরা ফুরকানের আয়াত- [আরবি] তিলাওয়াত করলাম। অর্থঃ আর তারা আল্লাহর সাথে কোন ইলাহকে ডাকে না এবং আল্লাহ্ যার হত্যা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতীরেকে তাকে হত্যা করে না। (২৫:৬৮) এর পরে আছে, “তবে যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ্ তাদের পাপ পূণ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন”- (২৫:৭০) তিনি বলেন, এটি মক্কী আয়াত আর এ আয়াতকে মাদানী আয়াত [নিসা-৯৩] রহিত করেছে। সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪০০১ তার ঠিক পরের হাদিসে ইবনে আব্বাস (রা) এই হাদিসের বিপক্ষে অন্য কথা বলেন।। সাঈদ ইবন জুবায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আবদুর রহমান ইবন লায়লা আমাকে আদেশ করলেন, ইবন আব্বাস (রাঃ) -কে এই দুই আয়াত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করতে প্রথম আয়াত [আরবি] কেউ ইচ্ছাকৃত কোন মু’মিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম। আর দ্বিতীয় আয়াত [আরবি] যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহকে ডাকে না এবং আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না [আরবি] তবে যারা তওবা করে [আরবি]। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। প্রথম আয়াত সম্পর্কে তিনি বললেন, এটাকে কোন আয়াত রহিত করেনি। আর দ্বিতীয় আয়াত সম্পর্কে বললেন, এটি মুশরিকদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪০০২ । দুই হাদিসের রাবি একই ব্যক্তি। দুই হাদিসেই ইবনে আব্বাস (রা) এর মত বা রায় উল্লেখ করা।। কিন্তু কথা দুই রকম কেন এবং সঠিক মত কোনটা। আয়াত কি রহিত হইছে নাকি হয় নাই তওবা কবুল হবে নাকি হবে না।। একটু বিস্তারিত জানতে চাই,

১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

কালীগঞ্জ

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


হত্যাকারীর তাওবা কবুল হবে কিনা এ বিষয়ে কুরআন সুন্নাহর আলোকে উম্মাহর জমহুর সাহাবা,তাবিঈন ও উলামায়ে কিরামের মত হচ্ছে, হত্যাকারী যদি তাওবায়ে নাসূহা করে, তা কবুল হবে। এবং কবীরা গুনাহের ব্যাপারে 'তাওবা কবুল হবে না' নিশ্চিতভাবে বলার সুযোগ নেই।

সূরা আন নিসা ( আয়াত নং - ১১৬ )

اِنَّ اللّٰہَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِہٖ وَیَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَمَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰہِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا

অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এর নিচের যে-কোনও গুনাহ যার ক্ষেত্রে চান ক্ষমা করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরীক করে, সে (সঠিক পথ থেকে) বহু দূরে সরে যায়।
অর্থাৎ শিরক অপেক্ষা নিচের গুনাহ আল্লাহ তাআলা যারটা চান, বিনা তাওবায় কেবল নিজ অনুগ্রহে ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু শিরকের গুনাহ ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমা হতে পারে না যতক্ষণ না মুশরিক ব্যক্তি মৃত্যুর আগে খাঁটি মনে তাওবা করবে এবং ইসলাম ও তাওহীদ কবুল করে নেবে।


এবার আসি, এক্ষেত্রে ইবনে আব্বাস রাঃ এর ভিন্নমত আছে কিনা এবিষয়ে।
কথা হলো, ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে দুরকম মতই আছে।
১- খুনীর তাওবা কবুল হবেনা।
২- তাওবা কবুল হবে।

মূলতঃ দুটোর মাঝে বাহ্যত বৈপরীত্য বুঝা গেলেও আসলে কোনরূপ বৈপরীত্য নেই। সমন্বয় এভাবে যে, ইবনে আব্বাস রাঃ এর মতও অন্যসকলের মতো এই যে, তাওবা কবুল হবে কিন্ত তাওবা কবুল হবে না মর্মে তার যে বক্তব্য পাওয়া যায় তার উদ্দেশ্য হলো, যাজর তথা বিষয়টির কদর্যতা ও মারাত্মক পরিণতি বুঝানোর জন্য তাওবা কবুল হবে না এরকম কঠিন উক্তি করেছিলেন।
যার দলিল হলো নিম্নের এই বর্ণনাঃ

مصنف ابن أبي شيبة (عوامة) (14/ 249)
28326- حدثنا يزيد بن هارون , قال : أخبرنا أبو مالك الأشجعي ، عن سعد بن عبيدة ، قال : جاء رجل إلى ابن عباس فقال : لمن قتل مؤمنا توبة ؟ قال : لا ، إلا النار ، فلما ذهب قال له جلساؤه : ما هكذا كنت تفتينا ، كنت تفتينا أن لمن قتل مؤمنا توبة مقبولة ، فما بال اليوم ؟ قال : إني أحسبه رجلا مغضبا يريد أن يقتل مؤمنا ، قال : فبعثوا في أثره فوجدوه كذلك. (9/362).

ذخيرة العقبى في شرح المجتبى (31/ 267)
وذهب جماعة من العلماء منهم: عبد اللَّه بن عمر - رضي اللَّه عنه - وهو أيضًا مرويّ عن زيد بن ثابت، وابن عبّاس - رضي اللَّه تعالى عنهم - إلى أن له توبةً، روى يزيد بن هارون قال: أخبرنا أبو مالك الأشجعيّ، عن سعيد عبيدة، قال: جاء رجل إلى ابن عبّاس، فقال: ألمن قتل مؤمنًا متعمّدًا توبة؟ قال: لا إلا النار، قال: فلمّا ذهب قال له جلساؤه: أهكذا كنت تفتينا؟ كنت تفتينا أن لمن قتل توبةً مقبولة، قال: إني لأحسبه رجلاً مُغضبًا، يريد أن يقتُل مؤمنًا، قال: فبعثوا في إثره، فوجدوه كذلك.

এক ব্যক্তি ইবনে আব্বাস রাঃ এর নিকট খুনীর তাওবা কবুল হবে কিনা মর্মে জানতে চাইলে বললেনঃ
তার জন্য কেবলই জাহান্নাম অর্থাৎ তাওবা কবুল হবে না। সে চলে গেলে অন্যরা জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি তো তাওবা কবুল হবে মর্মে ফতোয়া দিয়েছিলেন, এখন ভিন্নমত কেন ? উনি প্রতুত্যরে বলেন, আমি তার মধ্যে খুন করার আলামত বুঝতে পেরে এরকম বলেছি... লোকেরা তালাশ করে ইবনে আব্বাস রাঃ এর কথার বাস্তবায়ন দেখতে পেলো।

এই বর্ণনা থেকে সুস্পষ্ট বুঝে আসে, ইবনে আব্বাস রাঃ এবং উম্মাহর জমহুর সাহাবা,তাবিঈন ও উলামায়ে কিরামের মতের মধ্যে বিভেদ নেই বরং সকলের মতো উনারও মত, তাওবা কবুল হবে।
কিন্ত একজন মুমিনের রক্তপ্রবাহিত করার গুরুতর পাপের ভয়াবহতা বুঝাতে গিয়ে ওরকম উক্তি করেছিলেন।

আর সুরা নিসার ঐ আয়াত রহিত হয়নি বরং তাওবা না করলে তার জন্য জাহান্নামের শাস্তির ওয়াদা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে তাওবা নাছুহা করলে তার তাওবা কবুল হবে এবং এটাই কুরআন সুন্নাহর আলোকে উম্মাহর উলামায়ে কিরামের সর্বগৃহীত সিদ্ধান্ত।

কুরআন থেকেঃ

{وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا (68) يُضَاعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيهِ مُهَانًا (69) إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُولَئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا (70) وَمَنْ تَابَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَإِنَّهُ يَتُوبُ إِلَى اللَّهِ مَتَابًا (71)} [الفرقان: 68 - 71]

এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে।
কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুন হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে। তবে কেউ তাওবা করলে, ঈমান আনলে এবং সৎকর্ম করলে, আল্লাহ এরূপ লোকদের পাপরাশিকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা ফুরকান-৬৮-৭১)

হাদীস থেকেঃ

باب قَبُولِ تَوْبَةِ الْقَاتِلِ وَإِنْ كَثُرَ قَتْلُهُ

حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، وَمُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، - وَاللَّفْظُ لاِبْنِ الْمُثَنَّى - قَالَ حَدَّثَنَا مُعَاذُ بْنُ هِشَامٍ، حَدَّثَنِي أَبِي، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ أَبِي الصِّدِّيقِ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَجُلٌ قَتَلَ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ نَفْسًا فَسَأَلَ عَنْ أَعْلَمِ أَهْلِ الأَرْضِ فَدُلَّ عَلَى رَاهِبٍ فَأَتَاهُ فَقَالَ إِنَّهُ قَتَلَ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ نَفْسًا فَهَلْ لَهُ مِنَ تَوْبَةٍ فَقَالَ لاَ . فَقَتَلَهُ فَكَمَّلَ بِهِ مِائَةً ثُمَّ سَأَلَ عَنْ أَعْلَمِ أَهْلِ الأَرْضِ فَدُلَّ عَلَى رَجُلٍ عَالِمٍ فَقَالَ إِنَّهُ قَتَلَ مِائَةَ نَفْسٍ فَهَلْ لَهُ مِنْ تَوْبَةٍ فَقَالَ نَعَمْ وَمَنْ يَحُولُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ التَّوْبَةِ انْطَلِقْ إِلَى أَرْضِ كَذَا وَكَذَا فَإِنَّ بِهَا أُنَاسًا يَعْبُدُونَ اللَّهَ فَاعْبُدِ اللَّهَ مَعَهُمْ وَلاَ تَرْجِعْ إِلَى أَرْضِكَ فَإِنَّهَا أَرْضُ سَوْءٍ . فَانْطَلَقَ حَتَّى إِذَا نَصَفَ الطَّرِيقَ أَتَاهُ الْمَوْتُ فَاخْتَصَمَتْ فِيهِ مَلاَئِكَةُ الرَّحْمَةِ وَمَلاَئِكَةُ الْعَذَابِ فَقَالَتْ مَلاَئِكَةُ الرَّحْمَةِ جَاءَ تَائِبًا مُقْبِلاً بِقَلْبِهِ إِلَى اللَّهِ . وَقَالَتْ مَلاَئِكَةُ الْعَذَابِ إِنَّهُ لَمْ يَعْمَلْ خَيْرًا قَطُّ . فَأَتَاهُمْ مَلَكٌ فِي صُورَةِ آدَمِيٍّ فَجَعَلُوهُ بَيْنَهُمْ فَقَالَ قِيسُوا مَا بَيْنَ الأَرْضَيْنِ فَإِلَى أَيَّتِهِمَا كَانَ أَدْنَى فَهُوَ لَهُ . فَقَاسُوهُ فَوَجَدُوهُ أَدْنَى إِلَى الأَرْضِ الَّتِي أَرَادَ فَقَبَضَتْهُ مَلاَئِكَةُ الرَّحْمَةِ " . قَالَ قَتَادَةُ فَقَالَ الْحَسَنُ ذُكِرَ لَنَا أَنَّهُ لَمَّا أَتَاهُ الْمَوْتُ نَأَى بِصَدْرِهِ .

পরিচ্ছেদঃ ৩৫. হত্যাকারীর তাওবা আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য; যদিও সে বহু হত্যা করে থাকে

৬৭৫২। মুহাম্মাদ ইবনে মুসান্না ও মুহাম্মাদ ইবনে বাশশার (রাহঃ) ... আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে এক লোক ছিলো। সে নিরানব্বই ব্যক্তিকে হত্যা করার পর জিজ্ঞাসা করল, এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় আলিম ব্যক্তি কে? তাকে এক রাহিবের সন্ধান দেওয়া হয়। সে তার কাছে এসে বলল, যে, সে নিরানব্বই ব্যক্তিকে হত্যা করেছো এমতাবস্থায় তার জন্য কি তাওবা আছে? রাহিব বলল, না। তখন সে রাহিবকেও হত্যা করে ফেলল। এবং এর (রাহিবের) হত্যা দ্বারা একশ পূর্ণ করল।

তারপর সে আবার প্রশ্ন করল এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় আলিম কে? তখন তাকে এক আলিম ব্যক্তির সন্ধান দেওয়া হল। সে আলিমকে সে বলল যে, সে একশ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, তার জন্য কি তাওবা আছে? আলিম ব্যক্তি বললেন, হ্যাঁ। এ তাওবার মধ্যে কে অন্তরায় হতে পারে? তুমি অমুক দেশে যাও। সেখানে কতিপয় লোক আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত আছে। তুমিও তাদের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদতে মশশুল হয়ে যাও। নিজের দেশে আর কখনো ফিরে যেয়ো না। কেননা এ দেশটি বড় মন্দ। তারপর সে চলতে লাগল। এমন কি যখন সে অর্ধ পথে পৌছে তখন তার মৃত্যু এল।

এরপর রহমতের ফেরেশতা ও আযাবের ফেরেশতার মধ্যে তার সম্পর্কে বিবাদ লেগে গেল। রহমতের ফেরেশতারা বললেন, সে অন্তরের আবেগ নিয়ে আল্লাহর দিকে তাওবার জন্য ধাবিত হয়ে এসেছে। আর আযাবের ফেরেশতারা বললেন, সে তো কখনো কোন নেক আমল করেনি। এ সময় মানুষের সুরতে এক ফেরেশতা এলেন। তারা তাকে তাদের মধ্যে মীমাংসাকারী নির্ধারণ করলেন।

তিনি তাদের বললেন, তোমরা দুই দেশের মধ্যবর্তী দূরত্ব মেপে নাও। দুই স্থানের মধ্যে যে স্থানের দিকে সে অধিক নিকটবর্তী হবে তাকে সে স্থানেরই গণ্য করা হবে। তারা মাপলেন। তখন তাঁরা তাকে উদ্দিষ্ট স্থানের অধিক নিকটবর্তী পেলেন। তখন রহমতের ফেরেশতা তাকে কবজ করে নিলেন। কাতাদা (রাহঃ) বলেন, হাসান (রাহঃ) বলেছেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করা হয়েছে যে, যখন তার মৃত্যু এল, তখন সে বুকের উপর ভর দিয়ে (কিছু এগিয়ে) গেল।

আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ (সহীহ মুসলিম)
হাদিস নং: ৬৭৫২
তাহকীকঃ তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
বর্ণনাকারীঃ আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)(মৃত্যুঃ ৭৪ হিজরী)
হাদিসের লিংকঃ https://muslimbangla.com/hadith/19075

হাদিসের ব্যাখ্যাঃ
তাওবা সম্পর্কে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ। আল্লাহ তা'আলা যে কত উপায়ে বান্দার তাওবা কবুল করেন, এ হাদীছে তা স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে জানানো হয়েছে একজন মানুষ যত বড় পাপীই হোক, তার তাওবা করার সুযোগ থাকে এবং সময়মত তাওবা করলে তা আল্লাহ কবূলও করেন। যেমন হাদীছে বর্ণিত লোকটি একজন ঘোরতর পাপী ছিল। একশ'জন লোকের হত্যাকারী। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তা'আলা তার তাওবা কবুল করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন।

ঘটনাটির সারমর্ম এই যে, আমাদের পূর্বের জাতি খুব সম্ভব খৃষ্টান জাতির মধ্যে এক ব্যক্তি এক এক করে ৯৯জন লোককে হত্যা করেছিল। নিশ্চয়ই তার এ পাপ অতি গুরুতর। কাজেই যখন তাওবার উদ্দেশ্যে কোনও রাহিবের কাছে আসল, তখন সে রাহিবও তার তাওবা করার সুযোগ আছে বলে মনে করেনি। তার কাছে মনে হয়েছে এমন ঘোরতর পাপীর আবার কিসের তাওবা!

মূলত এটা ছিল সে রাহিবের অজ্ঞতা। একজন পাপী, যে কিনা তাওবা করতে এসেছে, তাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করা কোনও জ্ঞানীজনের কাজ হতে পারে না। আল্লাহর রহমত তাঁর ক্রোধের উপর প্রবল। যত বড় পাপীই হোক না কেন সে যদি একবার অনুতপ্ত হৃদয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দেন। তাই এ ব্যক্তিকে নিরাশ করা রাহিবের উচিত হয়নি। এ অনুচিত কাজ করার “যে পরিণাম হওয়ার কথা তাই হয়েছে। এর ফলে তার মনে হতাশা দেখার পাশাপাশি প্রচণ্ড ক্রোধেরও সঞ্চার হয়েছে। হতাশ মনের লোক নির্দ্বিধায় যে-কোনও কাজ করে ফেলতে পারে। ক্রোধোন্মত্ত ব্যক্তিরও কোনও বিবেচনাবোধ থাকে না। ফলে যে-কোনও গর্হিত কাজ সে অনায়াসে করে ফেলে।

হাদীছে বর্ণিত ব্যক্তির মধ্যে সেই ক্রোধ ও হাতাশা- এ দুইই দেখা দিয়েছিল। ফলে তৎক্ষণাৎ সে রাহিবকে হত্যা করে আর এভাবে সে একশ'র কোটা পূর্ণ করে ফেলে। সর্বশেষ এ হত্যার পর তার মধ্যে আবারও অনুশোচনা জাগে। সুতরাং কিভাবে তার মুক্তিলাভ ও তাওবার ব্যবস্থা হতে পারে, তা জানার জন্য বড় কোনও আলেমের সন্ধান করল। তাকে এক আলেমের সন্ধান দেওয়া হল এবং সে তার কাছে চলে গেল।




এবারের ব্যক্তি যথার্থই আলেম ছিলেন। তিনি তাকে হত্যশ করলেন না; বরং এই বলে তার মনে আশার সঞ্চার করলেন যে, কে পাপী ব্যক্তি ও তাওবার মাঝখানে বাধার সৃষ্টি করতে পারে? আল্লাহ অসীম রহমতের মালিক। তাঁর কাছে তাওবার দুয়ার চির উন্মুক্ত। তিনি সকল পাপীকেই ক্ষমা করেন। তোমাকেও ক্ষমা করবেন। তবে হাঁ, পুনরায় যাতে পাপে লিপ্ত না হও, তাই তোমার আত্মসংশোধনের দরকার। সেই সংশোধনের জন্য প্রয়োজন সৎসঙ্গ। তাই নিজ এলাকা ছেড়ে তাকে এমন এক জনপদে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, যেখানে কিছু সংলোক বাস করে এবং আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীর ভেতর মশগুল থাকে। তাদের সাহচর্যে কিছুদিন কাটালে তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে। আল্লাহর হুকুমমত চলার মানসিকতা তৈরি হবে। নেক কাজের অভ্যাস গড়ে উঠবে। সবরকম বদ অভ্যাস দূর হয়ে যাবে। আর এভাবে ক্রমে সেও একজন সৎলোকে পরিণত হবে।

এই আলেমের পরামর্শ মোতাবেক পাপী লোকটি ওই নেককারদের কাছে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়ে গেল। যেতে যেতে যখন তার বাড়ি ও নেককারদের এলাকার মাঝ বরাবর পৌঁছল, তখন তার আয়ু ফুরিয়ে গেল। এখন কে তার জান কবজ করবে? রহমতের ফিরিশতা, না আযাবের ফিরিশতা? ফিরিশতাদের দুই দলই উপস্থিত হয়ে গেলেন। আযাবের ফিরিশতাদের কথা- সে একজন ঘোর পাপী। কখনও নেককাজ করেনি। আমরাই তার জান কবজ করব। রহমতের ফিরিশতাদের দাবি তারা জান কাবজ করবেন। কারণ সে পাপী হলেও এখন তো তাওবা করেছে এবং সংশোধনের ইচ্ছায় নেককারদের সাহচর্য নিতে চেয়েছে। উভয়েরই শক্ত যুক্তি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যে পরম দয়ালু। তিনি দয়ার আচরণ করলেন। একজন ফিরিশতার মাধ্যমে ফয়সালা নিলেন উভয়দিকের রাস্তা মেপে দেখা হোক। যেদিকের রাস্তা কম হবে, অর্থাৎ সে যেদিকের বেশি কাছে হবে তাকে সেই দিকেরই গণ্য করা হবে। যদি সে নেককারদের বেশি কাছে হয়, তবে তাকে নেককারদের একজন গণ্য করা হবে আর সে হিসেবে রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করবেন। অন্যথায় তার জান কবজ করবেন আযাবের ফিরিশতাগণ। সুতরাং পথ মাপা শুরু হল। ওদিকে আল্লাহ তা'আলা যমীনের প্রতি হুকুম জারি করলেন। নেককারদের দিকের ভূমিকে বললেন, সংকুচিত হয়ে যাও। আর ওদিকের ভূমিকে বললেন, প্রসারিত হয়ে যাও। ভূমি হুকুম পালন করল। ফলে মেপে দেখা গেল নেককারদের দিকে দূরত্ব এক বিঘত কম এবং সে তাদেরই বেশি কাছে। সুতরাং ফয়সালা মোতাবেক রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করলেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কারও দ্বারা যত বড় পাপই হোক না কেন, তাওবা কবুলের ব্যাপারে হতাশ হওয়া উচিত নয়। খাঁটি তাওবা করলে আল্লাহ তা'আলা বড় থেকে বড় পাপও ক্ষমা করেন।

খ. খাঁটি তাওবার একটা অংশ নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করা। নিজেকে সংশোধন করার প্রকৃষ্ট উপায় নেককার লোকদের সাহচর্যগ্রহণ।

গ. নেককার লোকদের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পথ চলাও এক মূল্যবান ইবাদত। এর অছিলায়ও আল্লাহ তা'আলা গুনাহ মাফ করেন।

ঘ. মানুষের ভালো-মন্দরূপে গড়ে উঠার পেছনে পরিবেশের ভূমিকা থাকে। তাই নিজের আমল-আখলাক তৈরি ও হেফাজতকল্পে মন্দ পরিবেশ পরিত্যাগ ও ভালো পরিবেশ অবলম্বন জরুরি।

ঙ. দীনী বিষয়ে সুযোগ্য আলেমের পরামর্শ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। এরূপ আলেম কাছে না পাওয়া গেলে শারীরিক চিকিৎসার্থে যেমন দূরে যাওয়া হয়, তেমনি এ ব্যাপারেও দূরের কোনও যোগ্য আলেমের কাছে যেতে হবে।

চ. অযোগ্য ও বেআমল আলেমের সাহচর্য ক্ষতিকর।

ছ. অন্যকে পরামর্শদানে, বিশেষত দীনী বিষয়ে সতর্কতা জরুরি। ভুল পরামর্শে অন্যের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

জ. যে বিষয়ে ভালো জানা নেই, সে বিষয়ে মাসআলা বলা ও ফতোয়া দেওয়া থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।

ঝ. পাপী ব্যক্তিকে হতাশ না করে তাকে তাওবার প্রতি উৎসাহিত করা ও আল্লাহর রহমত লাভে আশাবাদী করে তোলাই তার প্রকৃত কল্যাণকামিতা।

ঞ. নরহত্যা মহাপাপ। কুরআন মাজীদের ভাষ্যমতে যে-কোনও একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা জগতের সমস্ত মানুষকে হত্যা করার সমতুল্য।

ট. এ হাদীছ দ্বারা ইলমেরও ফযীলত জানা যায়। একজন পরহেযগার আলেম কেবল নিজেই ভ্রান্তপথ থেকে বেঁচে থাকে না। তার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা অপরাপর মানুষকেও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেন ও সুপথে পরিচালিত করেন। এ হাদীছে এ ছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। সংক্ষেপ করার তাগিদে এখানেই ক্ষান্ত করা হল।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৯৩২৮৩

বছরের শুরু শেষ নেসাব ঠিক ছিলো, মাঝে যে সম্পদ বেড়েছে তার যাকাতের জন্য বৎসর পূর্ণ হতে হবে?


৫ মার্চ, ২০২৫

Mahini

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী

৭৭৭৮৭

জিমেইল ফেসবুক আইডি বিক্রি প্রসঙ্গ


২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

গাজীপুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৮৩৬৫৯

কোন নামাজে কোন সূরা


৪ জানুয়ারী, ২০২৫

চাঁদপুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শফিকুল ইসলাম হাটহাজারী

৯০৫৮৩

ভিন্ন দেশ থেকে ৩০ রোযা রেখে বাংলাদেশে গেলে রোযা রাখতে হবে? রাখলে ৩১টা হয়ে যায়। করণীয় কি?


২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

대한민국 경기도 파주시 월롱면 통일로৬২০번길 ৮৯-৫৩ (KR)

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy