আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

গর্ভবতী মহিলাদের জন্য করণীয়

প্রশ্নঃ ২৫০১৬. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণের সময় গর্ভবতী মহিলাদের জন্য করণীয় কি কি?? কেননা আমাদের সমাজে সূর্য গ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে অনেক কুসংস্কার আছে, এবং দেখা যায় অনেক সময় এগুলো সত্যি হয়ে যায়। আবার খাওয়া সম্পর্কে ও অনেকে অনেক কিছু খেতে নিষেধ করে। তো এখন একজন গর্ভবতী মেয়ের জন্য এই সময় করণীয় কি কি?? আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু।,

৯ নভেম্বর, ২০২২

চট্টগ্রাম

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


শরীয়তে এধরনের কথার কোনো ভিত্তি নেই তেমনি বিবেক-বুদ্ধিও এ ধরনের অলীক ধারণা সমর্থন করে না। যেমন, মানুষ বলে থাকে ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি আসে,ডান হাত চুলকালে টাকা আসে, এধরনের কথা কুসংস্কার ছাড়া অন্য কিছু নয়। এছাড়াও সন্তান সুস্থ্য ও ত্রুটিপূর্ণ হবার সাথে সূর্য বা চন্দ্রগহণের এবং কোনো কিছু খাওয়ার কোন হাত নেই।

অতএব এ ধরনের বিশ্বাস পোষণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

যেমন- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ وما مِنَّا إلا وَلَكِنَّ اللَّهَ يُذْهِبُهُ بِالتَّوَكُّلِ

শুভ-অশুভ নির্ণয় শিরক, শুভ-অশুভ নির্ণয় শিরক, শুভ-অশুভ নির্ণয় শিরক। আমাদের প্রত্যকেরই মনে কোনো না কোনো অসুবিধা দেখা দেয়, তবে আল্লাহ তাআলা তাওয়াক্কুলের বদৌলতে তা দূর করে দেন। (আবু দাউদ ৩৯১০)



* সূর্য বা চন্দ্রগহণের সময় করণীয় *


عن حماد، عن إبراهيم، عن علقمة، عن عبد الله رضي الله عنه، قال: انكسفت الشمس يوم مات إبراهيم بن رسول
الله صلى الله عليه وسلم، فخطب فقال: " إن الشمس والقمر آيتان من آيات الله، لا ينكسفان لموت أحد ولا لحياته، فإذا رأيتم ذلك فصلوا، واحمدوا الله وكبروه، وسبحوه حتى ينجلي: أيهما انكسف، ثم نزل رسول الله صلى الله عليه وسلم، وصلى ركعتين

হযরত আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পুত্র হযরত
ইবরাহীমের মৃত্যুর দিন সূর্যগ্রহণ হয়। তখন তিনি দাঁড়িয়ে খুতবা প্রদান করে বলেনঃ সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর চিহ্নসমূহের মধ্যে একটি চিহ্ন। এতে কারো মৃত্যু বা কারো জন্মের কারণে গ্রহণ লাগে না। সুতরাং যখন তোমরা এতে গ্রহণ লাগতে দেখ, তখন নামায পড়, আল্লাহর হাম্দ বর্ণনা কর,
তাকবীর বল, তাসবীহ পড়, যার ফলে গ্রহণ দুরীভূত হয়ে যাবে। অতঃপর তিনি মিম্বর থেকে অবতরণ করেন এবং দু'রাকাআত (কুসুফের নামায) আদায় করেন।

মুসনাদে আবু হানীফা রহঃ
হাদিস নং ১৬৬



* গর্ভবতী মহিলাদের জন্য করণীয় *


এক- গোনাহ থেকে বিরত থাকুন: প্রিয় গর্ভবতী মা! গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ইবাদতের ফিকিরের চাইতে গোনাহ ছেড়ে দেয়ার ফিকির অধিক করাটাই হবে আপনার বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। আর এটা করতে হবে, আপনার ভেতরে বেড়ে ওঠা সন্তানের জন্যই। যেমন, নাটক-সিরিয়ালপ্রীতি বর্জন করবেন, কণ্ঠস্বরকে সংযত করবেন, বিশেষ প্রয়োজন দেখা না দিলে ঘর হতে বের হবেন না। আপনার যে সকল গায়রে মাহরাম আত্মীয় রয়েছে, তাদেরকে আপনার সাথে দেখা সাক্ষাতের কিংবা পর্দা লংঘনের জন্য অনুমতি দেবেন না। এভাবে চলতে পারলে পবিত্র কোরআনের সুসংবাদ গ্রহণ করুনإنَّ مَعَ العُسْرِ يُسْراً— কষ্টের সাথেই আছে সুখ। (সূরা আলাম-নাশরাহ: ৬)

এই যে আরেকটি আয়াত দেখুন, যা আপনার জন্যও প্রযোজ্য—

إِن تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُم مُّدْخَلًا كَرِيمًا
যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে যদি তোমরা সেসব বড় গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পার। তবে আমি তোমাদের (ছাট) গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং সম্মানজনক স্থানে তোমাদের প্রবেশ করাব। (সূরা নিসা: ৩১)

দুই- ধৈর্য্য ধারণ করুন: অসুস্থতা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে ধৈর্য্যহারা হবেন না। এভাবে ভাবুন, ‘এই সময়টার প্রতিটি মুহূর্ত আপনার জন্য জিহাদতূল্য ইবাদত’। এতে ধৈর্য্য ধারণ করা আপনার জন্য সহজ হবে। আপনার কষ্ট শক্তিতে পরিণত হবে। নবীজী ﷺ চমৎকার বলেছেন, الصَّبْرُ ضِيَاءٌ সবর হল জ্যোতি। (মুসলিম: ২২৩)

তিন- সময় মত নামাজ আদায় করুন: এসময়ে অস্থিরতা বেশি কাজ করে। আর যথাসময়ে নামাজ অন্তরকে প্রশান্ত রাখে। এজন্যই নামাজের সময় হলে নবীজী ﷺ বেলাল রাযি.কে বলতেন, أَقِمِ الصَّلاةَ، أَرِحْنا بِهَا নামাজের ব্যবস্থা কর এবং তার মাধ্যমে আমাকে তৃপ্ত কর। (আবু দাউদ: ৪৩৩৩)

চার- জিকির করুন: অস্থিরতা দূরীকরণের কোরআনি-ব্যবস্থাপনা এটি। এটা আপনাকে ও আপনার গর্ভের সন্তানকে শান্ত রাখতে সহায়ক হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের মন প্রশান্ত হয় ; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই মন প্রশান্ত হয়। (সূরা রাদ : ২৮)

পাঁচ- শোকর আদায় করুন: দেখুন, মা হওয়ার মাঝেই নারীজন্মের স্বার্থকতা। কত নারী এমন আছে,গর্ভবতী হওয়ার জন্যে বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করছে কিন্তু তাদের ভাগ্যে এই নেয়ামত জুটছে না। এজন্য যখনি মা হওয়ার আনন্দে পুলকিত হবেন তখনি আল্লাহর শোকর আদায় করুন। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَٱشْكُرُواْ لِى وَلَا تَكْفُرُونِ আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (সূরা বাকারা: ১৫২)

ছয়- বেশি রাত পর্যন্ত জাগ্রত থাকা থেকে বিরত থাকুন: গর্ভাবস্থায় রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম না হলে স্বাস্থ্যহানী ঘটে। তাই ইশার নামাজ সময়ের শুরুতে পড়ে নিন। তারপর প্রয়োজনীয় কাজ সেরে যত দ্রুত সম্ভব ঘুমিয়ে পড়ুন। দেরি করে ঘুমোতে যাবেন না। অন্তত এতটা আগে রাতের বিছানায় যেতে হবে যাতে করে কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিন্তে যাওয়া যায় এবং ফজর যথাসময় পড়া যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا আর আমি তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। (সূরা নাবা: ৯)

সাত- ওযু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করুন: কেননা দৈহিক সুস্থতা ও আত্মিক প্রশান্তির ক্ষেত্রে ওযুর ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষত, ঘুমানোর আগে ওযু করে নিবেন। এতে অনিদ্রার বিড়ম্বনা থেকে বাঁচা সহজ হবে। নবীজী ﷺ বলেছেন, إِذَا أَتَيتَ مَضْجَعَكَ فَتَوضَّأْ وضُوءَكَ لِلصَّلاةِ যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন নামাযের ওযুর মত ওযু করবে। (মুসলিম : ৪৮৮৪)

আট- আপনার সন্তানের জন্য কোরআন তেলাওয়াত করুন: প্রায় ২০ তম সপ্তাহে গর্ভের বাচ্চা শোনার সক্ষমতা অর্জন করে। মা প্রতিদিন কিছু কোরআন তেলাওয়াত করে বাচ্চার মাঝেও কোরআনের মাঝে সম্পর্ক জুড়ে দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. বলেন,

عَلَيْكُم بِالْقُرْآَن ، فَتَعَلَّمُوه وَعَلَّمُوه أَبْنَائِكُم ، فَإِنَّكُم عَنْه تُسْأَلُوْن ، وَبِه تُجْزَوْن

কোরআনের বিষয়ে তোমাদের উপর অবশ্য পালনীয় এই যে, কোরআন শিক্ষা করা এবং তোমাদের সন্তানদের কোরআন শিক্ষা দেয়া। কেননা এ বিষয়ে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে এবং তার প্রতিদানও দেয়া হবে। (শরহে সহীহ বুখারী, ইবন বাত্তাল : ৪৬)

এক্ষেত্রে অনেকে জানতে চান, কোন সূরা পড়ব? উত্তর হল, গর্ভাবস্থার জন্য মূলত নির্দিষ্ট কোনো সূরা নেই। তবে কোনো বুজুর্গ সূরার বিষয়বস্তুর প্রতি লক্ষ রেখে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এভাবে—

প্রথম মাসে সূরা-আল ইমরান পড়লে সন্তান দামী হবে।

দ্বিতীয় মাসে সূরা-ইউসুফ পড়লে সন্তান সুন্দর হবে।

তৃতীয় মাসে সূরা মারিয়াম পড়লে সন্তান সহিষ্ণু হবে।

চতুর্থ মাসে সূরা-লোকমান পড়লে সন্তান বুদ্ধিমান হবে।

পঞ্চম মাসে সূরা-মুহাম্মদ পড়লে সন্তান চরিত্রবান হবে।

ষষ্ঠ মাসে সূরা-ইয়াসিন পড়লে সন্তান জ্ঞানী হবে।

সপ্তম, অষ্ঠম, নবম ও দ্বশম মাসে সূরা-ইউসুফ, মুহাম্মদ এবং ইব্রারাহিম কিছু কিছু পড়বে।

ব্যাথা উঠলে সূরা-ইনশিকাক পড়ে পানিতে ফুক দিয়ে পান করলে ব্যথা কমে যাবে।

তাছাড়া ঘুমের পূর্বে অবশ্যই চার কুল তথা সূরা কাফিরূন, সূরা ইখলাস ও সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ে হাতের তালুতে ফু দিয়ে সারা শরীরে হাত বুলিয় নিলে বহুবিধ ফায়দা পাওয়া যায়। এভাবে তিনবার করবেন।

নয়- দোয়ার অভ্যাস করুন: গর্ভকালীন সময়ে মাঝে মাঝে অসহায়বোধ হয়। এমনও মনে হয়, না-জানি এবার আমি মরে যাব কিনা! তাই গর্ভকালীন সময়ে দোয়ায় বেশি লিপ্ত হতে হয়। কেননা এসময়ের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ বলেন,

أَمَّن يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ

বলো তো কে নিঃসহায়ের ডাকে সাড়া দেন যখন সে ডাকে এবং কষ্ট দূরীভূত করেন। (সুরা নামল ৬২)

তাছাড়া আপনি আপনার সন্তানের মা। আর মায়ের দোয়া কবুল হয়। সুতরাং নেক, সুস্থ ও সুন্দর সন্তান কামনা করে বার বার দোয়া করুন। এক্ষেত্রে কোরআনের বর্ণিত দোয়াগুলোকে অগ্রাধিকার দিন। যেমন, এ দোয়াটি মুখস্থ করে নিতে পারেন—

رَبِّ هَبْ لِىْ مِنْ لَّدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً‌ۚ اِنَّكَ سَمِيْعُ الدُّعَآءِ

হে আমার পালনকর্তা! আপনার পক্ষ থেকে আমাকে পুত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী। (আল ‘ইমরান: ৩৮)

পুত্র-সন্তান লাভের জন্য পড়তে পারেন—رَبِّ هَبْ لِىْ مِنَ الصّٰلِحِيْنَ হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দান করুন। (আস-সাফফাত: ১০০)

দশ- আল্লাহর এ দু’টি গুণবাচক নাম পড়ুন: কোনো গর্ভবর্তী মহিলা যদি আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নাম (اَلْمُتَعَالِىْ) ‘আল-মুতাআ’লি’ এবং (اَلْمُبْدِئُ) ‘আল-মুবদিয়ু’ পড়তে থাকে তবে ওই মহিলা তার গর্ভকালীন কষ্টক্লেশ থেকে মুক্তি পায়।

উক্ত দশ পরামর্শ মেনে চললে গর্ভবতী মা যেমন মহান আল্লাহর কাছে প্রিয় হয়ে ওঠবে, অনুুরূপভাবে তার ভেতরে বেড়ে ওঠা সন্তানও ‘নেক’ হবে। ইনশাআল্লাহ্।

আল্লাহ তাআলা তাওফিকদাতা।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী আরিফুর রহমান
'মুসলিম বাংলা' ফাতওয়া বিভাগ।

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

২৬৩৪৯

নব ভূমিষ্ঠ বাচ্চার কানে মহিলা আযান দেয়া


১২ ডিসেম্বর, ২০২২

আলফাডাঙ্গা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী সিরাজুল ইসলাম

২৬১৭৯

এক মাসের ভ্রুন নষ্ট করা যাবে কি?


১০ ডিসেম্বর, ২০২২

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

২০৬৮৩

গর্ভাবস্থার কুরআন-সু্ন্নাহয় বর্ণিত ধারাবাহিক কোনো আমল আছে কি?


৫ ডিসেম্বর, ২০২৩

লক্ষ্মীপুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ ইসহাক মাহমুদ

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy