আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

স্বদেশ প্রেম: ইসলামী দৃষ্টিকোণ

প্রশ্নঃ ১০৫২৮১. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ইসলামের দৃষ্টিতে "স্বদেশ প্রেম" সম্পর্কে বলুন? বলা হয় “স্বদেশ প্রেম” ঈমানের অঙ্গ এটা কি ঠিক? অনেকে আবার এটাকে ধর্মের উপর স্থান দিয়ে থাকে! একজন মুসলিম হিসাবে দেশকে ভালবাসার পরিধি কতটুক? দয়া করে সহজ ভাবে বিস্তারিত বলবেন? আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিন আমীন,

২৮ মে, ২০২৫

Dhaka, Bangladesh

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


প্রসঙ্গ দেশপ্রেম
রাইয়ান ইবনে লুৎফুর রহমান
মাসিক আলকাউসার থেকে সংগৃহিত

এটা অবধারিত সত্য যে, একজন মানুষ যখন পৃথিবীর বিশাল ভূখন্ডের কোনো এক অংশে জন্মলাভ করে, সেখানকার আলো-বাতাস গ্রহণ করে, সেখানে বেড়ে ওঠে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার মাটি-মানুষের প্রতি অন্যরকম হৃদ্যতা ও আপনত্ব অনুভব করে। জন্মভূমির প্রতি মানুষের এই স্বভাবজাত আকর্ষণকে ইসলাম মূল্যায়ন করেছে।

পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, ‘‘ভূখন্ড হিসেবে তুমি কতই না উত্তম, আমার কাছে তুমি কতই না প্রিয়। যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিতো তবে কিছুতেই আমি অন্যত্র বসবাস করতাম না।’’ (জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩৯২৬)

মক্কা নগরী তো শুধু আল্লাহর রাসূলের জন্মভূমিই ছিল না, এ তো ঐ পবিত্র ভূখন্ড, যেখানে আল্লাহর ঘর প্রতিষ্ঠিত।

পরবর্তীতে যখন তিনি মদীনা মুনাওয়ারাকে স্থায়ী আবাসভূমি হিসেবে গ্রহণ করেন, তখন বিভিন্ন সময়ে

বিভিন্নভাবে মদীনার প্রতি তার হৃদয়ের অনুরাগ প্রকাশ করতেন।

এক হাদীসে হযরত আনাস রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, দূর থেকে মদীনার জনপদ নজরে আসতেই তিনি তাঁর উটনীর গতি বাড়িয়ে দিতেন, অথবা কোনো চতুষ্পদ জন্তুর উপর থাকলে তাকে নাড়াতে থাকতেন। বস্ত্তত মদীনার প্রতি ভালবাসার দরুনই তিনি এমনটি করতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮০২)

আরেক হাদীসে হযরত আনাস রা. বলেন, ‘আমি খেদমতের নিয়তে রাসূলের সাথে খায়বার অভিযানে গেলাম। অতঃপর যখন অভিযান শেষে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে এলেন, উহুদ পাহাড় তাঁর দৃষ্টিগোচর হল তিনি বললেন, এই পাহাড় আমাদেরকে ভালবাসে, আমরাও একে ভালবাসি। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ২৮৮৯)

মোটকথা, স্বদেশের প্রতি মানবমনের এই স্বভাবজাত অনুরাগকে ইসলাম সমর্থন করে। কিন্তু এই দেশপ্রেম যদি সীমা অতিক্রম করে আত্মঅহমিকা কিংবা আত্মকেন্দ্রিকতার জন্ম দেয়, অথবা যদি মানুষকে অন্ধত্ব ও উগ্রতার দিকে নিয়ে যায় এবং আল্লাহর সৃষ্টি অন্য কোনো দেশ বা ভূখন্ডের বিরুদ্ধে অন্যায় বিদ্বেষের জন্ম দেয়, তাহলে ইসলাম কখনোই তা সমর্থন করে না।

নিজের দেশের প্রতি ভালবাসার বিষয়টি যথাস্থানে ঠিকই আছে। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, ভৌগোলিক পরিচয়কে ইসলাম সম্মান-মর্যাদার মানদন্ড গণ্য করেনি। ইসলামের কাছে মর্যাদার মানদন্ড হচ্ছে তাকওয়া ও খোদাভীতি। এই তাকওয়ার গুণে যে ভূষিত হবে সেই সম্মান-মর্যাদার অধিক উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। চাই সে কোনো অখ্যাত দেশের বাসিন্দাই হোক না কেন।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেন : (অর্থ) নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। আর তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচে মর্যাদাবান সে যে আল্লাহকে সর্বাধিক ভয় করে। (সূরা হুজুরাত, আয়াত : ১২)

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায়হজ্বের ভাষণে বলেন, ‘‘হে লোকসকল! জেনে রেখো তোমাদের প্রতিপালক একজন, তোমাদের পিতা একজন। জেনে রেখো, অনারবের উপর আরবের, আরবের উপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার উপর কালোর, কালোর উপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে একজন আরেকজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারবে।’’ (মুসনাদে আহমদ, ৫/৪১১; বাইহাকীর সূত্রে দুররে মানসুর ৬/১২২)

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, ‘‘আমার নিকটবর্তী লোক তো তারাই যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তারা যেমনই হোক, যেখানেই থাকুক।’’ (মুসনাদে আহমদ ৫/২৩৫)

হযরত আবুদ দারদা রা.-এর এক চিঠির উত্তরে সালমান রা. লিখেছিলেন, ‘‘কোনো ভূখন্ড কাউকে পবিত্র করে না। মানুষকে পবিত্র করে তার আমল।’’ (মুয়াত্তা মালিক, পৃষ্ঠা : ৩২২)

দেশপ্রেম মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। ইসলাম সেটাকে গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু ন্যায় ও ভারসাম্যের ধর্ম ইসলামে অন্য সকল বিষয়ের মতো এ বিষয়েও নীতি ও বিধান দান করেছে, যা মুমিনকে

সকল সীমালঙ্ঘন ও প্রান্তিকতা থেকে রক্ষা করে।

ভূখন্ড তো মানবের সেবক, সৃষ্টিকর্তা নয়, ইলাহ ও উপাস্যও নয়। সৃষ্টিকর্তা তো আল্লাহ, ইলাহও একমাত্র তিনিই। বন্দেগী ও উপাসনার একমাত্র অধিকারী তিনি। চূড়ান্ত ভক্তি-ভালবাসা ইতাআত ও আনুগত্যও একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। অন্য সকল ভক্তি ও আনুগত্য তাঁরই বিধানের অধীন।

মানবের ভূখন্ড তো মানবের চেয়ে বড় নয়, ভ্রাতৃত্বের সম্প্রীতি ও আদর্শের চেয়েও বড় নয়। তাহলে ভূখন্ডের কথা বলে কীভাবে মানুষ শিরক ও পৌত্তলিকতায় লিপ্ত হতে পারে? আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হতে পারে?

দেশের সীমানাকে কেন্দ্র করে ভাই তার ভাইকে ভুলে যাবে, একে অপরের প্রতি জুলুম করবে ইসলাম কখনোই তা সমর্থন করে না। আফসোস, যেদিন থেকে মুসলিম উম্মাহ নিজের ভৌগোলিক পরিচয়কে আসল পরিচয় জ্ঞান করতে শুরু করেছে সেদিন থেকে তাদের দুর্ভোগও শুরু হয়েছে। আজ আমরা ভৌগোলিক পরিচয়ে এমনি বুঁদ হয়ে আছি, পাশ্ববর্তী রাজ্যের মুসলমানরা নিপীড়ণের শিকার হলেও আমরা ‘সেদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ বলে ‘দায়মুক্ত’ থাকার মিথ্যা চেষ্টা কররি। অথচ হাদীস শরীফে এসেছে, ‘‘সব মুসলিম এক শরীরের ন্যায়। এর কোনো একটি অঙ্গ আক্রান্ত হলে অন্য সকল অঙ্গ তার ব্যাথায় ছটফট করবে।’

সুতরাং ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বদেশের প্রতি ভালবাসা থাকবে। সঙ্গে অপর মুসলিম দেশের প্রতিও হীতাকাঙ্খা থাকতে হবে। নিজ দেশের মুসলিম ভাইদের আপন মনে করতে হবে। অমুসলিম নাগরিকেরও হক্ব রক্ষা করতে হবে। অপর দেশের মুসলিম ভাইদেরও পর মনে করা যাবে না। ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বোধ দেশের ভেতরে যেমন, দেশের বাইরেও তেমনি সব মুসলমানের প্রতি সম্প্রসারিত থাকবে।

আল্লাহ সাবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি
উস্তাজুল ইফতা, জামিয়া ইমাম বুখারী, উত্তরা, ঢাকা।

প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৩৩০৫৪

ইসলামের মৌলিক আকিদা


১১ মে, ২০২৩

Adoar

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি জাওয়াদ তাহের

২৪৭১১

সংসারে বরকত হওয়ার আমল


৩ নভেম্বর, ২০২২

Dhaka, Bangladesh

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি মোহাম্মদ আমীর হোসাইন

২১৮৪৭

বিড়াল পোষা কি জায়েজ?


৭ ডিসেম্বর, ২০২৩

Bogura District, Rajshahi, Bangladesh

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মোহাম্মদ আমীর হোসাইন, মুফতি ও মুহাদ্দীস,

২০৬৫৩

খুশির খবরে শুকরিয়াস্বরূপ মিষ্টি খেতে চাওয়া কি জায়েজ?


৭ ডিসেম্বর, ২০২৩

দাশুড়িয়া

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy