আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

এক বছর কুরবানী না করলে তিন বছর কুরবানী করা যাবে না?

প্রশ্নঃ ১০৩৬০৭. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, । এমন একটা কথা প্রচলিত আছে বা শোনা যায় যে, কোনো ব্যাক্তি যদি একবার কোরবানি না করে, তাহলে আগামী তিন বছর আর কোরবানি করতে পারবে না। এটা কতটুকু সত্য? কুরআনে কি বলা আছে এই সম্পর্কে?,

১৭ মে, ২০২৫

Kayempur - Dohosoho School Rd

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


প্রচলিত কথা: "একবার কোরবানি না করলে তিন বছর কোরবানি করার সুযোগ থাকে না"
এই কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং শরীয়ত-বিরোধী। কুরআন, সহীহ হাদীস, কিংবা প্রামাণ্য ফিকহগ্রন্থে এমন কোনো নির্দেশনা বা শাস্তির কথা উল্লেখ নেই যে এক বছর কেউ কুরবানি না করলে পরের তিন বছর কুরবানি করতে পারবে না। এটি কেবল লোকমুখে প্রচলিত একটি বেদআতি ও কুসংস্কারমূলক কথা, যা ইসলামি শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

কুরবানীর বিধান
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ.
সুতরাং আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন। -সূরা কাওসার (১০৮) : ২

তাফসীরবিদগণ বলেন, এ আয়াতে ‘নাহর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল ঈদের নামায-পরবর্তী কুরবানী।

ইমাম কুরতুবী রাহ. বলেন, فَصَلِّ -এর একটি তাফসীর এ-ও যে, আপনার রবের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাত আদায় করুন। তিনজন তাবেয়ী ইমাম- কাতাদাহ রাহ., আতা রাহ. ও ইকরিমা রাহ. বলেন, আপনার রবের উদ্দেশ্যে নাহরের (কুরবানী) দিনে ঈদের নামায আদায় করুন।

وَانْحَرْ অর্থাৎ আপনার কুরবানীর পশু যবাই করুন। -তাফসীরে কুরতুবী ২০/১৪৮

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ اِنَّ صَلَاتِيْ وَ نُسُكِيْ وَ مَحْيَايَ وَ مَمَاتِيْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ، لَا شَرِيْكَ لَهٗ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ.

আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার ইবাদত (কুরবানী) ও আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। তাঁর কোনো শরীক নেই। আর আমি এরই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলমান। -সূরা আনআম (৬) : ১৬২-১৬৩

উপরোক্ত প্রথম আয়াতে وَانْحَرْ শব্দটি আদেশসূচক পদ। উসূলে ফিকহের একটি স্বতঃসিদ্ধ মূলনীতি হল, আদেশসূচক শব্দ ওয়াজিব তথা আবশ্যকীয় বোঝায়।

আর দ্বিতীয় আয়াতে আছে, وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ (আর আমি এ বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছি।)

বলাবাহুল্য যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার আদিষ্ট হয়েছেন তা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্যও ওয়াজিব। যদি আদেশটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বিশিষ্ট হওয়ার কোনো দলীল না থাকে।

সুতরাং উপরোক্ত আয়াতদুটি থেকে কুরবানীর বিধান ওয়াজিব তথা আবশ্যক হওয়া প্রমাণিত হয়।

আর হাদীস শরীফেও কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

من قدر على سعة فلم يضح فلا يقربن مصلانا.

কুরবানী করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮২৫৬

مسند أحمد، تحقيق : أحمد شاكر ١٦‏/١٢٠ : إسناده حسن، وأخرجه ابن ماجه (٢١٢٣)، وأحمد (٨٢৫৬) واللفظ له.

আবু হুরায়রা রা. থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

من كان عنده سعة فليضح، فمن لم يضح فلا يقربن مسجدنا.

কারো সামর্থ্য থাকলে সে যেন কুরবানী করে। এর পরও কেউ কুরবানী না করলে সে যেন আমাদের মসজিদের কাছেও না আসে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৬০; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ৯/২৬০

উভয় রেওয়ায়েত সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের একটি মত এ-ও রয়েছে যে, এটি মারফূ হাদীস নয়; মূলত সাহাবী আবু হুরায়রা রা.-এর বক্তব্য। পরবর্তী বর্ণনাকারী ভুলবশত এটিকে মারফূ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সাহাবীর ফতওয়াও শরীয়তে দলীলের মান রাখে।

مع احتمال قوي أن يكون مرفوعا حكميا.

যাইহোক, এই রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, কেউ যদি কুরবানী না করে তাহলে সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। এর বাহ্যিক অর্থ দ্বারাও কুরবানী আবশ্যক হওয়া প্রতীয়মান হয়। কেননা, এর দ্বারা ঈদগাহে উপস্থিত হওয়া ও নামায পড়তে নিষেধ করা উদ্দেশ্য নয়। -শরহু মুখতাসারিত তহাবী ৭/৩১১

قال الطحاوي في مختصره :৭/৩১১ : والثاني : قوله : فمن لم يضح فلا يقربن مصلانا، والمعقول من ظاهر هذا اللفظ الوجوب، لأنه معلوم أنه لم يرد به نهيه عن الصلاة، وحضور المسجد، وإنما المراد والله أعلم : على غير سبيلنا، وبمنزلة من خالف سنتنا، أو ما جرى مجرى ذلك.

মিখনাফ ইবনে সুলাইম রা. বলেন-

كُنّا وُقُوفًا مَعَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِعَرَفَاتٍ، فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ: يَا أَيّهَا النّاسُ، عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيّةٌ.

আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আরাফায় অবস্থান করছিলাম। তখন তাঁকে বলতে শুনেছি, হে লোকসকল! প্রত্যেক ঘরওয়ালার উপর প্রতি বছর কুরবানী আবশ্যক। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫১৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৪৭৮৬

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর কুরবানী করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-

أَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِالمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلّ سَنَةٍ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় দশ বছর ছিলেন। প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৯৫৫

এই হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিয়মিত কুরবানী করার কথা আছে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো কাজ নিয়মিত করাই কাজটির ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ। -তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ৩/৫৪৯

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসের আলোকে ইমাম আবু হানীফা রাহ. বলেন, সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।

ইমাম রাবীয়াহ রাহ., আওযায়ী রাহ., লাইস ইবনে সা‘দ রাহ., ছাওরী রাহ., নাখায়ী রাহ. প্রমুখের অভিমতও অনুরূপ।

ইমাম মালেক রাহ.-এরও একটি মত এরূপ। তাছাড়া মুজাহিদ রাহ., মাকহূল রাহ. ও শা’বী রাহ. প্রমুখ থেকেও এমনটি বর্ণিত আছে। -শরহু মুখতাসারিত তহাবী ৭/৩০৭; আলমুগনী, ইবনে কুদামা ১৩/৩৬০; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৩; তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ৩/৫৪৮

সারকথা, কুরবানী ইসলামের শিআর এবং জরুরি ইবাদত। এতে ইমামদের মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। ইখতিলাফ শুধু এতটুকু যে, অনেক ইমাম একে ওয়াজিব বলেন। আর আমাদের নিকট এই বক্তব্যের দলীলই শক্তিশালী। আর ইমাম শাফেয়ী রাহ.-সহ অনেক ফকীহ একে সুন্নত বলেন। তবে সুন্নত দ্বারা তাদের অনেকের উদ্দেশ্য সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। আর সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ জরুরি আমলেরই অন্তর্ভুক্ত।

উল্লেখ্য, আজকাল কাউকে দেখা যায়, তারা কুরবানী সুন্নত বা মুস্তাহাব হওয়ার বক্তব্য ঢালাওভাবে প্রচার করতে থাকেন। এই আমলটি যে ইসলামের শিআর এবং জরুরি ইবাদত- তা তারা এড়িয়ে যান। এটি সংশোধনযোগ্য।
#মাসিক আল কাউসার, জুলাই ২০২৩

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী
খতীব, রৌশন আলী মুন্সীবাড়ী জামে মসজিদ, ফেনী
জিম্মাদার, 'মুসলিম বাংলা' ইফতা বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৮১৭৯৯

অমুসলিমের সাথে বর্গা চুক্তি করলে উশর নাকি খারাজ দিবে?


২০ ডিসেম্বর, ২০২৪

নামবিহীন রাস্তা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী

৯৩২৮৩

বছরের শুরু শেষ নেসাব ঠিক ছিলো, মাঝে যে সম্পদ বেড়েছে তার যাকাতের জন্য বৎসর পূর্ণ হতে হবে?


৫ মার্চ, ২০২৫

Mahini

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী

৭৭৭৮৭

জিমেইল ফেসবুক আইডি বিক্রি প্রসঙ্গ


২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

গাজীপুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৮৫৯৭৬

স্ত্রীর সাথে কথা বন্ধ রাখা


২২ জানুয়ারী, ২০২৫

১৭০২

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী আবু সাঈদ

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy