আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৯- শপথ ও মান্নতের অধ্যায়
৬২৩৮। মুসাদ্দাদ (রাহঃ) ......... ইমরান ইবনে হুসাইন (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে আমার যমানার লোকেরাই সর্বোত্তম, এরপর তাদের পরবর্তী যমানার লোকেরা, এরপর তাদের পরবর্তী লোকেরা। ইমরান (রাযিঃ) বলেন, নবী (ﷺ) তার যমানা বলার পর দু’বার বলেছেন নাকি তিনবার তা আমার স্মরণ নেই। এরপর এমন সব লোকের আবির্ভাব হবে, যারা মান্নত করবে অথচ তা পূর্ণ করবে না। তারা খেয়ানত করবে, তাদের আমানতদার মনে করা হবে না। তারা সাক্ষ্য প্রদান করবে অথচ তাদেরকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য বলা হবে না। আর তাদের মাঝে হৃষ্টপুষ্টতা প্রকাশিত হবে।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এ হাদীছে তিনটি যুগকে যথাক্রমে শ্রেষ্ঠযুগ বলা হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- خيركم قرني (তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হল আমার যুগের মানুষ)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ বলতে তাঁর নবুওয়াতপ্রাপ্তি থেকে যে তারিখে সর্বশেষ সাহাবী ইন্তিকাল করেছেন, সেই পর্যন্ত সময়কালকে বোঝায়। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সবশেষে ইন্তিকাল করেছেন হযরত আবুত তুফায়ল আমের ইবন ওয়াছিলা রাযি। তিনি ১১০ হিজরী সনে ইন্তিকাল করেন। তারপর ইরশাদ করেন- ثم الذين يلونهم (তারপর যারা তাদের পরবর্তী যুগে আসবে)। অর্থাৎ তাবি'ঈদের যুগ। যারা ঈমানের সঙ্গে কোনও সাহাবীকে দেখেছেন। এই যুগ আনুমানিক হিজরী ১৫০ সন পর্যন্ত। ইমাম আবূ হানীফা রহ. হিজরী ১৫০ সনে ইন্তিকাল করেছেন। বিশুদ্ধমত অনুযায়ী তিনি একজন তাবিঈ ছিলেন। ثم الذين يلونهم (তারপর যারা তাদের পরবর্তী যুগে আসবে)। এ যুগ ছিল আনুমানিক ২২০ সন পর্যন্ত। এটা তাবে-তাবি'ঈনের যুগ। যারা তাবি‘ঈদের দেখেছেন। এর পর থেকেই দীনের মধ্যে নানা ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রকাশ থাকে যে, কোনও একটি যুগের মানুষকে শ্রেষ্ঠ বলার অর্থ এ নয় যে, সে যুগের প্রত্যেকেই পরবর্তী যুগের সকলের চেয়ে উৎকৃষ্ট। এটা বলা হয়েছে সাধারণ অবস্থার বিচারে। সুতরাং এর মধ্যে ব্যতিক্রম পাওয়া যেতেই পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের যুগের মানুষকে শ্রেষ্ঠতম মানুষ বলা হয়েছে। তার মানে এ নয় যে, সাহাবীগণ আগের নবী-রাসূলগণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ছিলেন। হাঁ, তাঁরা আগের যুগের সাধারণ মুমিনদের চেয়ে অবশ্যই উৎকৃষ্ট ছিলেন। এমনিভাবে তাবে-তাবি'ঈদের মধ্যে অনেকে এমন ছিলেন, যারা ঈমান, ইলম, আমল ও আখলাকের দিক থেকে তাবিঈদের যুগের অনেকের তুলনায় অগ্রগামী ছিলেন। তবে সামগ্রিক দৃষ্টিতে অবশ্যই তাবি'ঈগণ তাবে-তাবি'ঈদের তুলনায় উত্তম ছিলেন। এমনিভাবে আরও পরে জন্ম নেওয়া এমন অনেকেই আছেন, যারা ইবাদত-বন্দেগী, দীনের খেদমত, জিহাদ প্রভৃতি দিক থেকে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। বহু পরের হওয়া সত্ত্বেও তারা পূর্ববর্তী অনেককে টপকে গিয়েছেন। এটা এ যুগেও সম্ভব। তাই পরবর্তীকালীন হওয়ায় হতাশার কোনও কারণ নেই। নিজ ঈমান ও আমলে যত্নবান থাকলে পূর্ববর্তীকালীন আল্লাহওয়ালাদের কাতারে শামিল হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাওফীক দান করুন। এ হাদীছটির বর্ণনাকারী সাহাবী ইমরান রাযি. বলেন فما أدري قال النبي ﷺ مرتين او ثلاثا (আমার মনে নেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটি দু'বার বলেছেন না তিনবার)। অর্থাৎ এ বিষয়ে তাঁর সন্দেহ রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ثم الذين يلونهم (তারপর যারা তাদের পরবর্তী যুগে আসবে) কথাটি দুইবার বলেছেন না তিনবার। দুইবার বললে সাধারণ শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি তাবে-তাবি'ঈর যুগ পর্যন্তই শেষ হয়ে যায়। আর যদি তিনবার বলে থাকেন, তবে যারা তাবে-তাবি'ঈদের দেখেছেন ও তাদের আদর্শে চলেছেন তারা চতুর্থ স্তরে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হবেন। শ্রেষ্ঠ যুগসমূহ অতিক্রান্ত হওয়ার পর যে যুগ আসবে, তখনকার মানুষের চরিত্র কেমন হবে সে সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবগত করেন যে- ثم يكون بعدهم قوم يشهدون ولا يستشهدون، ويخونون ولا يؤتمنون، وينذرون ولا يوفون، ويظهر فيهم السمن (তাদের পর এমন সম্প্রদায় আসবে, যারা সাক্ষ্য দেবে, অথচ তাদের কাছে সাক্ষ্য চাওয়া হবে না। তারা খেয়ানত করবে। আমানত রক্ষা করবে না। তারা মানত করবে, কিন্তু তা পূরণ করবে না এবং তাদের মধ্যে শারীরিক স্থূলতা প্রকট হবে)। চারটি বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সে কালে এ বিষয়গুলো খুব বেশি দেখা দেবে। তার মধ্যে প্রথম হল সাক্ষ্য না চাইতেই সাক্ষ্য দেওয়া। বোঝা গেল এটা একটা মন্দ কাজ। সাক্ষ্য দিতে হবে কেবল তখনই, যখন তা চাওয়া হয়। কিন্তু অপর এক হাদীছে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ألا أخبركم بخير الشهداء؟ الذي يأتي بالشهادة قبل أن يسألها শ্রেষ্ঠ সাক্ষী কে, তা কি তোমাদের জানাব না? যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় সাক্ষ্য চাওয়ার আগেই। বাহ্যত উভয় হাদীছের মধ্যে বিরোধ মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই। কেননা দুই হাদীছ দুই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাক্ষ্য না চাইতেই সাক্ষ্য দেওয়া মন্দ সেই ক্ষেত্রে, যখন সাক্ষ্য দেওয়াকে কেউ নিজের অভ্যাস বানিয়ে ফেলে। অথচ সাক্ষী হওয়ার মত যোগ্যতা তার নেই। পক্ষান্তরে কেউ যদি কারও হক নষ্ট হতে দেখে আর সে মনে করে সে আগে বেড়ে সাক্ষ্য না দিলে ওই ব্যক্তি তার হক থেকে বঞ্চিত হবে, তখন তার হক রক্ষার খাতিরে নিজে উদ্যোগী হয়ে সাক্ষ্য দেওয়াই চাই। এরূপ সাক্ষীকেই হাদীছে শ্রেষ্ঠ সাক্ষী বলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিষয় হল আমানতের খেয়ানত। ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, শ্রেষ্ঠ তিন কালের পর এটা বেড়ে যাবে। আমানতের খেয়ানত করা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। সহজে আমানত রক্ষা করবেই না। তৃতীয় বিষয় হল মানত পূরণ না করা। মানত করলে তা আদায় করা জরুরি। আদায় না করাটা আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে ওয়াদাখেলাফি। যেমন কেউ বলল, আমার অমুক প্রিয় ব্যক্তি আরোগ্য লাভ করলে আমি আল্লাহর পথে এত টাকা দান করব। অথবা বলল, আমার এই উদ্দেশ্য পূরণ হলে আমি একটি উমরা আদায় করব। এটা আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে একটা ওয়াদা হল। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা যদি তার উদ্দেশ্য পূরণ করেন, তা সত্ত্বেও সে কথা না রাখে, তবে এটা তো পরিষ্কার যে সে আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করল। এমনিতেই ওয়াদা ভঙ্গ করা কবীরা গুনাহ। এটা তো আরও মারাত্মক। তাই কেউ কোনও মানত করলে তা অবশ্যই পূরণ করা চাই। অবশ্য যে বিষয়ে মানত করা হয়েছে তা যদি সৎ না হয়, তবে সে ক্ষেত্রে মানত করাই জায়েয নয়। যেমন এক ব্যক্তি জেনেশুনে মিথ্যা মামলা করল। তারপর মানত করল, যদি আমি এ মামলায় জিততে পারি, তবে এক হাজার টাকা আল্লাহর পথে দান করব। এটা আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে ধৃষ্টতা। এমনিই মিথ্যা মামলা করে গুনাহ করছে, তারপর আবার তাতে জেতার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাচ্ছে! পাপের উপর পাপ। এমনিভাবে যে কাজটি করবে বলে মানত করে সেটা যদি নাজায়েয হয়, যেমন বলল, আমি পরীক্ষায় পাস করলে খাজা বাবার দরগায় শিরনী দেব, তবে এরূপ মানত করাও জায়েয নয় এবং করলে তা পূরণ করাও জায়েয নয়। কেননা এটা শিরকী কাজ। এর থেকে বিরত থাকা অতীব জরুরি। চতুর্থ বিষয় শারীরিক স্থূলতা প্রকাশ পাওয়া। শারীরিক স্থূলতা এক হল জন্মগত বা অনিচ্ছাকৃত। আল্লাহ তা'আলা কাউকে বানিয়েছেনই মোটা করে। সে বিশেষ কিছু না খেলেও মোটা হয়ে যায়। এরূপ প্রকৃতিগত স্থূলতা দোষের নয়। হাদীছে যে স্থূলতাকে দোষের বলা হয়েছে তা হল শারীরিক স্থূলতা। অর্থাৎ এক ব্যক্তি অতিরিক্ত পানাহার করে। পানাহার তার বিলাসিতা। শুধু ভালো ভালো খাবার খায়। আর বেশি বেশি খায়। সে খাওয়ার লোভী। এটাই তার মোটা হওয়ার কারণ। এটা নিন্দনীয়। হাদীছে এরই নিন্দা করা হয়েছে। কেননা এরূপ ব্যক্তি অলস হয়ে যায়। ইবাদত-বন্দেগীতে তার উৎসাহ থাকে না। তাছাড়া খাওয়ার লোভ মেটানোর জন্য সে নাজায়েয পন্থা অবলম্বন করে। হারাম খেতে দ্বিধাবোধ করে না। তাই আমাদের দীন পরিমিত খাবারের নির্দেশনা দিয়েছে। ক্ষুধা মেটানোর জন্য যতটুকু প্রয়োজন ব্যস ততটুকুই খাবে। তার বেশি নয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন- وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ এবং খাও ও পান করো, কিন্তু সীমালঙ্ঘন করো না। আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পসন্দ করেন না। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. প্রথম তিন কালের মুসলিমগণ শ্রেষ্ঠ। তাদের মর্যাদা স্বীকার করতে হবে। তাদের ভালো ভালো কাজকে আদর্শরূপে গ্রহণ করতে হবে। তাদের দ্বারা ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে গেলে তার সমালোচনা হতে বিরত থাকতে হবে। খ. অপ্রয়োজনে স্বউদ্যোগী হয়ে সাক্ষ্য দেওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। গ. আমানতের খেয়ানত করা কঠিন পাপ ও মন্দ লোকের কাজ। ঘ. বৈধ কাজে বৈধ মানত অবশ্যই পূরণ করা চাই। পূরণ না করা কঠিন গুনাহ। ঙ. পানাহারে বিলাসিতা করা ও ইচ্ছাকৃতভাবে মোটা হওয়া বাঞ্ছনীয় না।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন