আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৫৩- বিবাহ-শাদী সম্পর্কিত অধ্যায়
৪৭২৯। আদম (রাহঃ) ......... উসামা ইবনে যায়দ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। মহানবী (ﷺ) বলেন, পুরুষের ওপরে স্ত্রীলোকের অপেক্ষা অন্য কোন বড় ফিতনা আমি রেখে গেলাম না।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
ফিতনা অর্থ পরীক্ষা। বলা হয়ে থাকে, فتنت الذهب والفضة (আমি সোনা-রুপা আগুনে দিয়ে তার ভালো-মন্দ পরখ করলাম)। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً (আমি পরীক্ষা করার জন্য তোমাদেরকে মন্দ ও ভালোতে লিপ্ত করি)।৩৬২ যা দ্বারা বান্দাকে পরীক্ষা করা হয় তাকেও ফিতনা বলা হয়ে থাকে। যেমন কুরআন মাজীদে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিকে ফিতনা বলা হয়েছে (দেখুন সূরা আনফাল : ২৮)। আল্লাহ তাআলার আযাব ও গযবকেও ফিতনা বলা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً ‘এবং সেই ফিতনাকে ভয় কর, যা বিশেষভাবে তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে কেবল তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না।৩৬৩ এছাড়াও আরও বিভিন্ন অর্থে শব্দটির ব্যবহার আছে। তবে লক্ষ করলে দেখা যায় সবগুলো অর্থের সঙ্গেই কোনও না কোনওভাবে পরীক্ষার সম্পর্ক আছে। এ দুনিয়া পরীক্ষাক্ষেত্র। ইহজীবনটাই পরীক্ষার জীবন। প্রতিটি বস্তু ও প্রত্যেক অবস্থা দ্বারা মানুষকে পরীক্ষা করা হয়। তাকে পরীক্ষা করা হয় যে, সে দুনিয়ার মোহে পড়ে আখেরাত ভুলে যায় কি না। তাকে যাচাই করে দেখা হয়, পার্থিব বস্তু-সামগ্রীর আসক্তিতে আল্লাহর বিধান পালনে অবহেলা করে, নাকি এসবের আকর্ষণ উপেক্ষা করে আল্লাহর হুকুম পালনকেই অগ্রাধিকার দেয়। পরীক্ষার উদ্দেশ্য হয় মহৎ। দুনিয়ার বিভিন্ন রকম পরীক্ষার দ্বারা মানুষের যোগ্যতা ও প্রতিভার ক্রমবিকাশ ঘটানো হয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলাও মানুষকে নানারকম পরীক্ষা দ্বারা তার আত্মার উন্নতি সাধন করেন এবং পর্যায়ক্রমে তাকে তাঁর সন্তুষ্টির পাত্র ও জান্নাতলাভের উপযুক্তরূপে গড়ে তোলেন। ফিতনামাত্রই মন্দ নয় সুতরাং সাধারণভাবে 'ফিতনা' শব্দটিকে নেতিবাচক অর্থে নেওয়া ঠিক নয়। অনেকেই এ শব্দটি শুনলেই মন্দ অর্থের দিকে চলে যায়। নারীকে ফিতনা বলা হয়েছে দেখে হয় নারীর প্রতি খারাপ ধারণা করে অথবা আপত্তি করে বসে যে, নারীকে কেন এরূপ বলা হবে। তাদের ধারণা এর দ্বারা নারীকে হেয় করা হয়েছে। এসবই ভুল ধারণা। না নারী আল্লাহর কোনও মন্দ সৃষ্টি, আর না ফিতনা বলে তাকে হেয় করা উদ্দেশ্য। ফিতনা অর্থ যখন পরীক্ষা, তখন নারীকে ফিতনা বললে সে ছোট হয়ে যাবে কেন? কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা এমন অনেক কিছুকেই পরীক্ষার বস্তু সাব্যস্ত করেছেন, মৌলিকভাবে যা মন্দ নয় এবং যা অর্জন করাও দূষণীয় নয়; বরং তা অর্জনে উৎসাহই দেওয়া হয়েছে। মন্দ হলে তা অর্জনে উৎসাহ দেওয়া হবে কেন? যেমন ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে وَاعْلَمُوا أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ (জেনে রেখ, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা)।৩৬৪ অর্থাৎ পরীক্ষা করা হয় যে, বান্দা এ মোহে পড়ে আল্লাহ তাআলাকে ভুলে যায়,নাকি অন্তরে তাঁর স্মরণ জাগ্রত রেখে তাঁর হুকুম মোতাবেক এতে লিপ্ত হয়? তো এ আয়াতে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিকে যেমন ফিতনা বলা হয়েছে, তেমনি বিভিন্ন আয়াত ও হাদীছে একে নিআমতও সাব্যস্ত করা হয়েছে। কোনও কোনও আয়াতে অর্থ-সম্পদকে 'আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ' নামে অভিহিত করা হয়েছে। এবং সে অনুগ্রহ অর্জনের জন্য আদেশ ও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এমনিভাবে বিবাহকে সুন্নত করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনও বলেছেন যে, সন্তান-সন্ততি বেশি হয় এমন নারীদের বিবাহ করবে। অতএব ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিকে ফিতনা বলার দ্বারা যেমন তা মন্দ হয়ে যায়নি, তেমনি নারীদের ফিতনা সাব্যস্ত করার দ্বারাও তারা ছোট হয়নি। মূলকথা হচ্ছে সন্তান-সন্ততি ও অর্থ-সম্পদ দ্বারা যেহেতু মানুষকে পরীক্ষা করা হয়, তাই তাদের ফিতনা তথা পরীক্ষা নামে অভিহিত করা হয়েছে। নারীদের বিষয়টাও এরকমই। নারীর মধ্যে আকর্ষণের আধিক্য ও তার কারণ আল্লাহ তা'আলা দুনিয়ার সবকিছু দ্বারাই বান্দাকে পরীক্ষা করেন। পরীক্ষা করেন বলে তার মধ্যে প্রচণ্ড আকর্ষণও রেখেছেন। সেইসঙ্গে তার প্রতি বান্দার অন্তরেও রেখেছেন ঝোঁক ও আসক্তি। যেমন ইরশাদ হয়েছে زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ 'মানুষের জন্য ওইসকল বস্তুর আসক্তিকে মনোরম করা হয়েছে, যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক অর্থাৎ নারী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত সোনা-রুপা, চিহ্নিত অশ্বরাজি, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামার।৩৬৫ যে বস্তুর চাহিদা ও প্রয়োজন যত বেশি, তার প্রতি আসক্তিও তত তীব্র। এ আসক্তির প্রয়োজনও ছিল। অন্যথায় মানবজীবন অচল হয়ে যেত। আসক্তি না থাকলে কে শুধু শুধু এসবের বোঝা বইত? কিংবা কে অহেতুক এসব অর্জনের জন্য কঠিন কঠিন ঝুঁকি গ্রহণ করত? বলাবাহুল্য, এর অর্জন থেকে বিরত থাকা বা এর বোঝা বহন থেকে দূরে থাকার পরিণাম কুমারব্রত পালন ও বৈরাগ্য জীবনযাপন। কুমারব্রত ও বৈরাগ্য জীবনের পরিণাম মানব প্রজন্মের সচলতা থেমে যাওয়া। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা কিয়ামত পর্যন্ত একে অব্যাহত রাখা। সে লক্ষ্যেই ওই আকর্ষণ ও আসক্তি। তবে কোনও কিছুরই সীমালঙ্ঘন কল্যাণকর নয়। আল্লাহ তাআলা পার্থিব সবকিছুর মধ্যে যে আকর্ষণ ও আসক্তি রেখেছেন, তাতেও সীমারক্ষা জরুরি। অন্যথায় লাগামহীন লিপ্ততা মানুষের ইহলোক বিপর্যয়ের কারণ হবে এবং পরকাল করবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত। সেই বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য দেওয়া হয়েছে শরীআতের ব্যবস্থা। যে আকর্ষণ ও আসক্তি শরীআত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেটাই সীমার মধ্যে থাকে। আর যা শরীআত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় তা সীমা হারায়। উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তা'আলা যেসব বস্তুর আসক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। তার প্রত্যেকটিই কল্যাণকর, যদি সে আসক্তিকে সীমার মধ্যে রাখা হয় তথা শরীআত দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অন্যথায় এর প্রত্যেকটিই বান্দার পক্ষে ক্ষতিকর। লক্ষণীয়, এ আয়াতে আকর্ষণ ও আসক্তির তালিকায় সবার আগে রাখা হয়েছে নারীকে। এর কারণ এগুলোর মধ্যে তার প্রয়োজনই সবচেয়ে বেশি। মানব প্রজন্মের সচলতায় তার ভূমিকাই সর্বাধিক। তার মধ্যে যদি আকর্ষণ না রাখা হত, তবে কেউ তার দিকে ঝুঁকত না। পরিণাম হত প্রজন্মের পরিসমাপ্তি। যেহেতু নারীর প্রয়োজন সর্বাপেক্ষা বেশি আর এ কারণে তার প্রতি আকর্ষণ ও আসক্তিও সবচেয়ে তীব্র, তাই এর পরীক্ষাও সবচেয়ে কঠিন। অনেকেই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়। ফলে অশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়, তারা অভাবনীয় কল্যাণের অধিকারী হয়। নারী-সম্পর্কিত পরীক্ষায় পুরুষদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ এ ভূমিকাটি যথাভাবে উপলব্ধি করতে পারলে হাদীছটির অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হবে। হাদীছটিতে ইরশাদ হয়েছে ما تركت بعدي فتنة هي أضر على الرجال من النساء. 'আমি আমার পরে পুরুষদের জন্য নারীদের চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর পরীক্ষার বিষয় কিছু রেখে যাইনি'। যেহেতু মানবপ্রজন্ম রক্ষার স্বার্থে দুনিয়ায় নারীর প্রতি সর্বাপেক্ষা বেশি আকর্ষণ ও আসক্তি রাখা হয়েছে, তাই তার দ্বারা বান্দার যে পরীক্ষা নেওয়া হয়, স্বাভাবিকভাবেই অন্যসব পরীক্ষার তুলনায় তা অনেক বেশি কঠিন। বেশিরভাগ মানুষই এতে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়। ফলে অধিকতর আসক্তির কারণে এর দ্বারা তারা ক্ষতিগ্রস্তও বেশি হয়। বলাবাহুল্য, তাদের সে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য দায়ী নারী নয়; বরং যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা নিজেরাই। নারীর প্রতি আসক্তি বেশি রাখা হয়েছে তাদেরই কল্যাণে। কিন্তু তারা শরীআত দ্বারা আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই ক্ষতির শিকার হয়েছে। দোষটা তো তারই হল। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষদের সাবধান করেছেন তারা যেন আসক্তির বেসামাল ব্যবহার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তারা যেন ভুলে না যায় যে, তাদের মনে নারীর প্রতি বেশি আসক্তি রাখার দ্বারা তাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। মানুষের ইতিহাসে নারীকে কেন্দ্র করে সর্বপ্রথম যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তা হচ্ছে কাবীল কর্তৃক হাবীলকে হত্যার ঘটনা। কাবীলই অন্যায়ভাবে তার যে বোনকে বিবাহ করা তার জন্য জায়েয ছিল না; বরং জায়েয ছিল হাবীলের জন্য, সে তাকে জবরদখল করে হাবীলকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল। এটা ছিল তার ইন্দ্রিয়পরবশতা। শেষপর্যন্ত সে হাবীলকে হত্যা করে। এ হত্যায় তার বোনের কোনও হাত ছিল না। সবটা দোষই ছিল কাবীলের। আমালেকা জাতির বিরুদ্ধে বনী ইসরাঈলের যে বিপর্যয় ঘটেছিল নারীদের ব্যবহার করার কারণে, তাতেও মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল বাল'আম বাউরা নামক এক প্রলুব্ধ পুরুষ। হাদীছে সে ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে فإن أول فتنة بني إسرائيل كانت في النساء. ‘বনী ইসরাঈলে সর্বপ্রথম যে বিপর্যয় ঘটেছিল, তা নারীদের কেন্দ্র করে ঘটেছিল।৩৬৬ ঘটনার সারসংক্ষেপ এরকম : বালআম ছিল ফিলিস্তিনের মাওআব অঞ্চলের এক প্রসিদ্ধ আবেদ ও সংসারবিমুখ (যাহেদ) ব্যক্তি। ফিরআউন ডুবে মরার পর হযরত মূসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলকে নিয়ে সে এলাকায় যেতে চাইলে সেখানকার মূর্তিপূজারী বাদশাহ বালআমকে ধরল। তাকে অনুরোধ করল সে যেন মূসা আলাইহিস সালামের বিরুদ্ধে বদ্দুআ করে। বাদশাহ তাকে মোটা অংকের উৎকোচ দিলে শেষ পর্যন্ত সে বদ্দুআ করতে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু তার বদদুআ কোনও কাজ করছিল না। শেষে বালআম বাদশাহকে পরামর্শ দিল, তার সৈন্যরা যেন তাদের নারীদেরকে বনী ইসরাঈলের তাঁবুতে পাঠিয়ে দেয়, যাতে তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তাদের প্রতি আল্লাহ তাআলা নারাজ হবেন। পরিণামে বনী ইসরাঈল তাঁর রহমত থেকে মাহরূম হয়ে যাবে এবং তাদের উপর আযাব নেমে আসবে। তারা তার এ পরামর্শমত কাজ করল। ফলে বনী ইসরাঈল ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়ল। আল্লাহ তাআলা শাস্তিস্বরূপ তাদের মধ্যে প্লেগের মহামারী ছড়িয়ে দিলেন। তাতে আক্রান্ত হয়ে তাদের বিপুল সংখ্যক লোক ধ্বংস হয়ে গেল। বাইবেলে এ ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে (দেখুন, শুমারী, পরিচ্ছেদ ২২-২৫ এবং ৩১:১৬)। এভাবে যুগে যুগে একদিকে অসংখ্য নারী পুরুষের লালসার শিকার হয়েছে, অন্যদিকে বিভিন্ন সময় তারা নিজেদের হীন স্বার্থ হাসিলের জন্য নারীদের ব্যবহার করে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে। নারীর প্রতি যে আকর্ষণ-আসক্তি রাখা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণার্থে, তার অসংযত ব্যবহার যুগে যুগে মানুষের হাজারও অনিষ্টের কারণ হয়েছে। আজও নারীস্বাধীনতা, নারীমুক্তি ইত্যাদি মুখরোচক নামের আড়ালে স্বার্থান্বেষী মহল নারীদের যথেচ্ছ ব্যবহার করছে আর এভাবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের দীন ও ঈমান ধ্বংস করছে। অস্বীকার করা যাবে না যে, অনেক সময় নারী নিজেও তার কল্যাণকর আকর্ষণী বৈশিষ্ট্যের অপব্যবহার করে তার নিজেরও সর্বনাশ ঘটায় এবং পুরুষদেরও দুনিয়া আখেরাত বরবাদ করে। তার শরীর-মনের আকর্ষণ দ্বারা তো কেবল পুরুষকেই নয়, তার নিজেকেও পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। সে তার মূল্যবান এ বৈশিষ্ট্যটির অপব্যবহারের কারণে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়। কাজেই হাদীছের এ সাবধানবাণী কেবল পুরুষের নয়; তারও স্মরণ রাখা জরুরি। নারী দ্বারা পুরুষের পরীক্ষা : বিবাহের আগে ও পরে উল্লেখ্য, নারীকে দ্বারা পুরুষকে পরীক্ষা করা হয় বিবাহের আগেও এবং পরেও। বিবাহের আগে তো এভাবে যে, দেখা হয় তারা নারীর প্রতি আসক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য বিবাহের বৈধ পন্থা অবলম্বন করে, না অবৈধ পথে ছোটে। আর বিবাহের পরে পরীক্ষা করা হয় এভাবে যে, এক তো দেখা হয় তারা নিজ স্ত্রীতেই ক্ষান্ত থাকে, না বহুগামিতার পথ ধরে। দ্বিতীয়ত দেখা হয়, তারা সম্পূর্ণ স্ত্রৈণ হয়ে পড়ে, নাকি পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীসহ সকল মানুষের হুকূক সম্পর্কে সচেতন থাকে। অধিকাংশ মানুষ বিবাহের আগে ও বিবাহের পরে উভয় অবস্থায় এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকে না। তারা খাহেশাতের পূজা ও ইন্দ্রিয়পরবশতার শিকার হয়ে যায়। ফলে চোখের গুনাহ থেকে শুরু করে চরম পর্যায়ের গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অর্থের অপচয় করে ও অবৈধ উপায়ে অর্থোপার্জনের চেষ্টা করে। তারা বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। পিতা-মাতা ও ভাই-বোনের হক নষ্ট করার পাশাপাশি মানুষের প্রতি নানাভাবে জুলুম করে। ইবাদত-বন্দেগীতে করে গড়িমসি। সুন্নত মোতাবেক জীবনযাপন থেকে পিছিয়ে থাকে। এভাবে নিজ দুনিয়া তো নষ্ট করেই, আখেরাতও বরবাদ করে ফেলে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন উম্মতের উপর সরাসরি তাঁর তত্ত্বাবধান ছিল। ফলে পুরুষ ও নারী উভয়ে সংযত জীবনযাপন করত। তখন নারী আকর্ষণ কারও পক্ষেই বিশেষ ক্ষতির কারণ হতে পারেনি। তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পর কালক্রমে উম্মতের উপর কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধান শিথিল থেকে শিথিলতর হতে থাকে। ফলে এ আকর্ষণ ক্রমান্বয়ে উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরবর্তীকালের মানুষের জন্য নারীসম্পর্কিত পরীক্ষাকে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর পরীক্ষা বলে সতর্ক করেছেন। যাদের অন্তরে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি মজবুত, তাদেরকে তো আল্লাহ তাআলা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তাওফীক দেন ও এর ক্ষতি থেকে হেফাজত করেন। পক্ষান্তরে যারা এ ক্ষেত্রে দুর্বল, তারা বিপদের শিকার হয়। তাকওয়াবিহীন নারীও পুরুষকে বিপদে ফেলে এবং তাকওয়াবিহীন পুরুষও নারীর সর্বনাশ ঘটায়। যে সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা চলছি, তা নারী-পুরুষ সম্পর্কিত পরীক্ষার এক চরম বিপর্যয়ের কাল। এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় তাকওয়া-আল্লাহভীতির চর্চা। সে চর্চাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই এর থেকে উত্তরণ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে তাকওয়া-চর্চার অর্থ অন্তরে আল্লাহর ভয় রেখে শরীআতপ্রদত্ত নির্দেশনা মেনে চলা। সে নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে নারীদের পর্দায় রাখা, পুরুষের চোখ সংযত রাখা, নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশা বন্ধ করা, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া পর নারী-পুরুষ কথাবার্তা না বলা, পুরুষের সঙ্গে কথা বলার সময় নারীদের সোজাসাপ্টা কথা বলা অর্থাৎ আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে না বলা, পরিতুষ্টির গুণ অর্জন করা অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যাকে যেমন স্ত্রী দিয়েছেন তাকে নিয়ে খুশি থাকা এবং তিনি প্রত্যেক স্বামীকে সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতার যে অবস্থায় রেখেছেন তাতে তার স্ত্রীর সন্তুষ্ট থাকা ইত্যাদি। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ নারীর প্রতি পুরুষমনের আকর্ষণ ও আসক্তি তাদের পক্ষে এক কঠিন পরীক্ষা। প্রত্যেক পুরুষের উচিত এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সে আকর্ষণ ও আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং এ ব্যাপারে শরীআতের নির্দেশনা মেনে চলা। ৩৬২. সূরা আম্বিয়া (২১), আয়াত ৩৫ ৩৬৩. সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৫ ৩৬৪. সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৮ ৩৬৫. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৪ ৩৬৬. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৭৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১১১৬৯; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯২২৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩৫২৩: শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪৩১

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন