আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫৩- বিবাহ-শাদী সম্পর্কিত অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৭২৪
আন্তর্জতিক নং: ৫০৯১

পরিচ্ছেদঃ ২৬৬১. স্বামী এবং স্ত্রীর একই দীনভুক্ত হওয়া।

৪৭২৪। ইবরাহীম ইবনে হামযা (রাহঃ) ......... সাহল (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর নিকট দিয়ে গমন করছিল, তখন তিনি (সাহাবায়ে কিরাম কে) বললেন, তোমাদের এর সম্পর্কে কী ধারণা? তারা উত্তর দিলেন, ‘‘যদি কোথাও কোন মহিলার প্রতি এ লোকটি শাদীর প্রস্তাব করে, তার সাথে বিয়ে দেয়া যায়। যদি সে সুপারিশ করে, তাহলে সুপারিশ গ্রহণ করা যায়, যদি কথা বলে, তবে কান লাগিয়ে শোনা উচিত। তারপর সেখান দিয়ে একজন গরীব মুসলমান অতিক্রম করতেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ ব্যক্তি সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা? তারা জবাব দিলেন, যদি এ ব্যক্তি কোথাও শাদীর প্রস্তাব করে, তো বিবাহ দেয়া ঠিক হবে না। যদি কারও সুপারিশ করে, তবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। যদি কোন কথা বলে, তবে তা শোনার প্রয়োজন নেই। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, সমস্ত পৃথিবীতে ঐ ব্যক্তির চেয়ে এ উত্তম (ধনীদের চেয়ে গরীবরা উত্তম)।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীনদারিতে অনগ্রসর এক অভিজাত ব্যক্তির সঙ্গে দীনদারিতে অগ্রগামী কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিতে গুরুত্বহীন এমন এক ব্যক্তির তুলনা করে জানাচ্ছেন যে, এই গুরুত্বহীন ব্যক্তি ওই অভিজাত ব্যক্তির মত দুনিয়াভরা মানুষ অপেক্ষাও উত্তম। এ হাদীছে ওই দুই ব্যক্তির কারওই নাম উল্লেখ করা হয়নি। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, অভিজাত ব্যক্তি ছিলেন উয়াইনা ইবনে হিস্‌ন আল-ফাযারী রাযি. অথবা আকরা ইবনে হাবিস আত্‌-তামীমী রাযি. । তারা দুজনই আপন আপন গোত্রের নেতা ছিলেন। কিন্তু তারা দীনদারীতে ছিলেন অনগ্রসর। তারা ছিলেন আল মুআল্লাফাতুল কুলূব অর্থাৎ ওইসকল লোকের অন্তর্ভুক্ত, যাদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করা হত। তাদেরকে ইসলামের উপর পরিপক্ক করে তোলার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন। তাদেরকে অপেক্ষাকৃত বেশি অর্থ-সম্পদ দান করতেন, যাতে উত্তম আচরণে প্রীত হয়ে তারা দীনের পথে এগিয়ে যেতে উৎসাহ বোধ করে। তাঁর এ প্রচেষ্টার সুফল পাওয়া গিয়েছিল। আগের চেয়ে তাদের পরবর্তী জীবনে উন্নতি লক্ষ করা গিয়েছিল। সামাজিক দৃষ্টিতে গুরুত্বহীন যে ব্যক্তির কথা এ হাদীছে বলা হয়েছে, কোনও কোনও রেওয়ায়েত দ্বারা জানা যায় তার নাম ছিল জু' আইল ইবনে সুরাকা আল গিফারী রাযি. । জু আইল রাযি. ছিলেন পরিপক্ক ঈমানদার। একবারকার ঘটনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উয়াইনা ইবনে হিসন রাযি. এবং আকরা ইবনে হাবিস রাযি.-কে একশ' করে উট দিয়েছিলেন। জু' আইল রাযি. ও উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তাকে কিছুই দেননি। প্রশ্ন করা হয়েছিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি উয়াইনা ও আকরাকে একশ' করে উট দিয়েছিলেন অথচ জুআইলকে কিছুই দিলেন না? তিনি বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ সেই আল্লাহর কসম করে বলছি, উয়াইনা ও আকরার মত পৃথিবীভরা মানুষ অপেক্ষাও একা এক জু'আইল ইবন সুরাকা উত্তম। আমি ওই দুজনের মনোরঞ্জন করছি আর জুআইলকে তার ঈমানের উপর সমর্পণ করছি। আলোচ্য হদীসে উভয়ের সামাজিক অবস্থান কেমন ছিল স্পষ্টভাবেই তার উল্লেখ আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সম্পর্কে মজলিসের একজনের কাছে তার অভিমত জানতে চেয়েছিলেন। সেই ব্যক্তি কে এ হাদীছে তার উল্লেখ নেই। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, তিনি ছিলেন হযরত আবূ যার্ রাযি.। প্রথমজন সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জিজ্ঞেস করলেন, তার সম্পর্কে তোমার অভিমত কী, তখন তিনি প্রথম মন্তব্য করলেন যে, তিনি একজন আশরাফ, একজন অভিজাত ব্যক্তি। তার আভিজাত্যের নিদর্শনস্বরূপ দুটি কথা বললেন। একটি হচ্ছে, তিনি কোথাও কোনও নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে সে নারীর অভিভাবকগণ তার সঙ্গে আত্মীয়তা করতে রাজি হয়ে যাবে। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, যদি কারও সম্পর্কে কারও কাছে সুপারিশ করে, তবে তার মর্যাদা রক্ষার্থে সেই সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। দুটো বিষয়ই এমন, যা মানুষের মর্যাদার পরিচয় বহন করে। বর্তমানকালেও এ কথা প্রযোজ্য। কোনও কোনও বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে, তিনি কোনও কথা বললে তা মনোযোগ দিয়ে শোনা হবে। কোনও বর্ণনায় আরও আছে, তিনি কারও কাছে কিছু চাইলে তাকে তা দেওয়া হবে এবং কোথাও উপস্থিত হলে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে। এসব দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য যে, তিনি সমাজের খুবই উঁচু স্তরের লোক। অপরদিকে যখন জু' আইল রাযি. সম্পর্কে অভিমত চাওয়া হল, তখন বলা হল এর সম্পূর্ণ বিপরীত কথা। তিনি একজন গরীব লোক। সামাজিক কোনও মর্যাদা নেই। ফলে না তার বিবাহের প্রস্তাব গৃহীত হবে, না সুপারিশ কবুল করা হবে। এমনকি সে কোনও কথা বললেও তা কেউ শুনতে চাবে না। তার মানে খুবই সাধারণ লোক, একদম গুরুত্বহীন। তবে তিনি ছিলেন বটে একজন পাক্কা ঈমানদার। তাঁর ঈমানের উপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এত আস্থা ছিল যে, তাকে অর্থ সম্পদ দিয়ে খুশি রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। কিছু না দিলেও যে তার মন খারাপ হবে না এ ভরসা পুরোপুরি ছিল। উল্লেখ্য, পাশাপাশি দুজনের একজনকে যদি অর্থ-সম্পদ ও হাদিয়া-তোহফা দেওয়া হয় আর অন্যজনকে না দেওয়া হয়, তবে যাকে দেওয়া হয়নি, দিল দেমাগ সম্পূর্ণ শুদ্ধ-পরিশুদ্ধ ও নির্মল-নির্মোহ না হলে তার মন একটু না একটু মলিন হবেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুভব-অনুভূতি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তিনি সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে তুলনামূলক আচরণের ক্ষেত্রে সবকিছু গভীরভাবে লক্ষ রাখতেন। কাজেই অন্যদের দেওয়া সত্ত্বেও হযরত জু'আইল রাযি.-কে কিছু না দেওয়াটা তাঁর অন্তরে হযরত জু'আইল রাযি.-এর উচ্চমাকাম ও সমুচ্চ ঈমানী অবস্থানের প্রমাণ বহন করে। বলা যায় এটা আল্লাহ তা'আলার কাছে তাঁর উচ্চ মর্যাদারই বহিঃপ্রকাশ। এ হাদীছে উয়াইনা ইবন হিসন রাযি. বা আকরা ইবনে হাবিস রাযি.-এর উপর হযরত জু' আইল রাযি.-এর যে শ্রেষ্ঠত্ব, তার ভিত্তি দীনদারী ছাড়া আর কিছুই নয়। দুনিয়ার দিক থেকে তাদের সঙ্গে হযরত জু'আইল রাযি.-এর তো কোনও তুলনাই আসে না। তা সত্ত্বেও তাঁকে তাদের মত দুনিয়াভরা লোক অপেক্ষাও উত্তম বলে সনদ দেওয়া হল। বোঝা গেল, দুনিয়ার অর্থবিত্ত ও ঠাটবাট আল্লাহ তা'আলার কাছে কোনও মূল্য রাখে না। দুনিয়ার জীবনই তো ধোঁকা প্রবঞ্চনার আধার। আল্লাহ তা'আলা বলেন وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ‘পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়। ২৪৮ সুতরাং দুনিয়াবী প্রতিষ্ঠাও প্রতারণাই বটে। প্রকৃত জীবন তো আখেরাতের জীবন। আল্লাহ তা'আলা বলেন وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ ‘বস্তুত আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন।২৪৯ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তো শ্লোগানই ছিল اللهم لا عيش إلا عيش الآخرة হে আল্লাহ! আখেরাতের জীবন ছাড়া নেই জীবন।২৫০ প্রকৃত জীবন যখন আখেরাতের জীবন, তখন সেই জীবনের প্রতিষ্ঠাই কাম্য। হযরত জু'আইল রাযি. সেই চেষ্টা করেছিলেন। সে কারণেই তাঁর এ মর্যাদা। যারা সে চেষ্টা থেকে বিমুখ থাকে, পার্থিব দিক থেকে তারা যতই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, হযরত জু’আইল রাযি.-এর মত দীনদারদের সঙ্গে তারা তুলনায় আসতে পারে না। সুতরাং কেউ অতি সাধারণ স্তরের বলে তাকে হেলা করো না। সমাজদৃষ্টিতে এমন বহু তুচ্ছ লোক আছে, আল্লাহর কাছে যাদের মর্যাদা দুনিয়ার বহু মান্যগণ্য লোকের চেয়ে অনেক বেশি। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছ দ্বারা ওইসকল লোকের উচ্চমর্যাদার প্রতি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন, বাহ্যচোখে যারা হীন হলেও অদৃশ্য তাকওয়ায় তাদের অন্তর পরিপূর্ণ। যে কারণে তারা আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাকেও তার সন্ধানী হতে উদ্বুদ্ধ করছেন। আর গাফেল দুনিয়াদারগণ যা নিয়ে মত্ত আছে এবং আখেরাতে মুক্তিলাভের মিথ্যা আশায় নিজেকে প্রতারিত করছে, তুমিও যাতে তাতে বিভোর না হয়ে পড়, সে ব্যাপারে তোমাকে সাবধান করছেন। তিনি তোমাকে অবহিত করছেন যে, সত্যিকারের সম্মান ও মর্যাদা তাকওয়ার মধ্যেই নিহিত, দুনিয়ার ধন-সম্পদ এবং পদ ও ক্ষমতার মধ্যে নয়। প্রকাশ থাকে যে, হযরত জু'আইল রাযি.-কে শ্রেষ্ঠ সাব্যস্ত করার দ্বারা এ কথা প্রমাণ হয়ে যায় না যে, দুনিয়ার সমস্ত গরীব সমস্ত ধনীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কোনও গরীব অপর কোনও ধনী বা গরীবের উপর শ্রেষ্ঠ সাব্যস্ত হয় তখনই, যখন সে তাকওয়া পরহেযগারীতে তাদের চেয়ে অগ্রগামী থাকে। তাকওয়াই আসল জিনিস, যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার কাছে মর্যাদা লাভ হয়। এ সম্পদ যার মধ্যে যতবেশি থাকবে আল্লাহ তাআলার কাছে তার মর্যাদাও ততবেশি হবে, তাতে সে দুনিয়ায় যত গরীব ও যত বিত্তহীনই হোক না কেন। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. দীনদারী ও তাকওয়াবিহীন নেতৃত্ব আল্লাহ তা'আলার কাছে কোনও মর্যাদা রাখে না। কাজেই কোনও মুমিনের সেরকম নেতৃত্ব কামনা করা উচিত নয়। খ. অন্তরে তাকওয়া না থাকলে পার্থিব অর্থবিত্ত মানুষকে প্রকৃত মর্যাদা দিতে পারে না। সুতরাং অর্থবিত্তের মধ্যে মর্যাদা খোঁজা মুমিনের কাজ হতে পারে না। গ. কোনও ব্যক্তি যতই গরীব হোক না কেন, দীন ও ঈমানে পরিপক্ক হলে ইসলাম তার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে। কাজেই এরূপ ব্যক্তিকে হেলা করতে নেই। ঘ. সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা পেয়ে কারও ধোঁকায় পড়া উচিত নয়। দীনদারীতে অগ্রগামী না হলে এ মর্যাদা মূল্যহীন। ঙ. এ হাদীছ আমাদেরকে দুনিয়ার মোহে মুগ্ধ না থেকে আখেরাতের সাফল্য যার উপর নির্ভরশীল সেই তাকওয়া পরহেযগারিতে অগ্রগামী থাকার উৎসাহ যোগায়। আমাদের উচিত অন্তরে পরিপূর্ণরূপে সে উৎসাহ লালন করা। ২৪৮. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত নং ১৮৫ ২৪৯. সূরা আনকাবূত (২৯), আয়াত নং ৬৪ ২৫০. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৯৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮০৫


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy