ব্লগ

সামাজিক মাধ্যমঃ সংযম-সদিচ্ছার পদচারণা কাম্য

post reference icon

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ

২১ নভেম্বর, ২০২৩

local library icon

২১৮৮

comment icon

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জীবনে অসামাজিক কিংবা আপনদের সমাজ ও সামাজিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উপাদানে রূপ নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মোহনীয় শ্লোগান ও পরিচিতির কথা বলা হলেও এ মাধ্যমের বদৌলতে আপন জগৎ ও আপন মানুষের সমাজ হয়ে গেছে অনেক দূরের। বয়স ও পেশা নির্বিশেষে সামাজিক মাধ্যমের আকর্ষণনিমগ্নতা ও এককেন্দ্রিকতা- এর সঙ্গে যুক্ত লোকদের জীবনে বিচ্ছিন্নতা ও বুঁদ হয়ে থাকার একটি অর্থহীন অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছে। কিছু এই নিমগ্নতার কারণে আর কিছু এই উপলক্ষ্যের বৈশিষ্ট্যের কারণে খুলে দিয়েছে আরো বহুবধি সংকট ও শঙ্কার দরজা।

কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও ঠিক যে মূলধারার গণমাধ্যম বা তথ্য বিনিময়-বিতরণ মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ-জটিলতার কারণে সামাজিক মাধ্যম অনেক সময় দরকারি তথ্য সামনে আনার একটি সুযোগ করে দেয়। উপলক্ষ্য তৈরি করে প্রভাব ও প্রতিপত্তির সহযোগিতায় জারি হওয়া বিচ্যুতি ও সংকটের বিপরীত চেহারাটা তুলে ধরার।

এজন্যই সামাজিক মাধ্যম/অনলাইন যোগাযোগ পরিধির বড় পরিসরটি নানারকম নেতিবাচক অবস্থা-আচার-অভ্যাসের চোরাই দরজা খুলে দিলেও ইতিবাচক কিছু পরিবেশন ও উপস্থাপনের পরিস্থিতিও তৈরি করে দিতে পারে। এ মাধ্যমের ব্যবহারকারীর সদিচ্ছা-সদ্ব্যবহার ও সংযমী পদক্ষেপ এসব ইতিবাচকতার পথ নির্মাণ করতে সাহায্য করে। তা না হলে রঙ-চমক ও উদ্ভ্রান্তির হাতছানি মিলিয়ে ডিজিটাল এই সামাজিক মাধ্যম মানুষকে নানারকম অকল্যাণকর জীবনাচারে যুক্ত করে দিয়ে থাকে। আর এর বড় রকম শিকার হতে পারে এবং হয়ে থাকে তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনা।

দুই.

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অথবা ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যমের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম মনে করা হয় ফেইসবুক-কে। এই মাধ্যমে যুক্ত হয়ে থাকার সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় হয় তা হচ্ছেএর সঙ্গে পড়ে থাকা। কৌতূহলসম্পৃক্ততাখোঁজখবর নেওয়ানিজের মতামত দেওয়াঅনেক রকম বিষয়-আশয়ের ভেতর-বাইরের প্রতিক্রিয়া দেখার একটি চক্রের মধ্যে পড়ে যাওয়ায় অনেকের ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় এভাবেই ফুরিয়ে যেতে থাকে। সময়ের বরকত ও জরুরত দুটোই নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। নিবিষ্ট মনে দরকারি দ্বীনী ও পার্থিব কোনো কাজই সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার আগ্রহ-সুযোগ থাকে না। দিনের পর দিন এভাবে পার হয়ে গেলেও সময় ও ফুরসতের এই সংকোচনের বিষয়টি অনুভূতই হতে চায় না। সময় ধ্বংসের এই চক্রের বাইরে থাকার চেষ্টা করাটা জরুরি। বহু মানুষ এমন আছেনএই চক্রে ঢোকেন নাঢুকলেও সীমিত সময়ের মধ্যে প্রয়োজন সম্পন্ন করে সরে আসেন। নিজের সময়ের দস্তরখানে অফলাইন ইতিবাচকতার সৌন্দর্য ও ব্যস্ততার পশরা সাজিয়ে রাখেন। আসলে সময়-গ্রাস ও সময়-ধ্বংসের এই অজগর থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ছোট-বড় সবারই করা উচিত

তিন.

অনলাইন এই যোগাযোগ মাধ্যম অনেককেই সংকোচহীন-নির্ভয় বানিয়ে দেয়- ফলে যে কোনো বিষয়ে অযাচিত মন্তব্যকটূক্তিঅশোভন কথা এবং বিশেষজ্ঞ মন্তব্য দেওয়ার অভ্যাস দাঁড়িয়ে যায়। এবং এটাকে একটি নিয়ম ও অধিকার মনে করা হতে থাকে। এভাবে গীবততোহমতবেয়াদবিঅসংযমযথেচ্ছাচারের পরিধি অনেক বড় হয়ে যায়। কোন্টা ন্যায্য প্রতিবাদকোন্টা উচিত সংশোধন এবং কোন্টা অন্যায় বেয়াদবি- এ বিষয়গুলির তমিজজ্ঞান না থাকায় সবকিছুকে নিজের মতো করে বিচার করার আসনে বসে গিয়ে রায় দেওয়ার মনোভাব সৃষ্টি হয়। আত্মভোলা পরচর্চার জগতে ঢুকে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। পরের বিষয়ে এই আক্রমণাত্মক অভ্যস্ততাঅনুশীলন ও চর্চা  কিছুতেই নিরাপদ নয়। এসব বিষয়ে অনেক বেশি সংযম ও সতর্কতা দরকার।

চার.

উন্মুক্ত বিচরণের রাস্তাটা খোলা থাকে ইন্টারনেটেঅনলাইনেসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এজন্য অসংযমী তারুণ্য কিংবা বয়সী জীবন এখান থেকে অশালীন জীবন ও বিনোদনের বিচিত্র অশুভ বারান্দায় উঁকিঝুকি-অনুপ্রবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। এ এক অন্ধকার ও জীবনবিনাশী পাপের জগৎ। মোহমোহাচ্ছন্নতা এবং গুনাহের  আবর্তনে ঘোরের মধ্যে অটকে যাওয়ার উপলক্ষ তৈরি হয় এতে। এরপর পাপের এই হাতছানি আরো দীর্ঘ হতে থাকেস্ফীত ও বড় হতে থাকে। অনেক সময় এসব অশুভ বিনোদনমুখী কৌতূহল থেকে নানারকম অযাচিত সম্পর্ক ও অসুস্থ যোগাযোগের ঘটনাও ঘটে। সভ্যতা ও সুস্থতা তখন প্রতারিত হয়প্রতারক হয় এবং বড় গুনাহ ও পার্থিব জটিলতার এক কঠিন চক্রে কেউ কেউ আটকে যায়। হাজারো ভুল ঘটনার মধ্যে মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমে এজাতীয় দু-চারটি ঘটনার খবর প্রকাশ করা হয়।

সর্বাত্মক উন্মুক্ততার এই জগৎটা তাই রেলিংহীন উন্মুক্ত ছাদের মতোছাদের জমিনে বিচরণ করা গেলেও তার চারপাশ দাপিয়ে বেড়ানো যায় না। কিনারা-কার্নিশের পতন এবং শ্যাওলায় পিচ্ছিলের ভয় নিয়ে সতর্ক বিচরণ করে চলতে হয়। আসলে সমস্ত কৌতূহল-বিনোদন ও মোহাচ্ছন্নতার চেয়ে গুনাহ থেকে দূরত্ব এবং অন্তর-জীবনের স্থিরতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

পাঁচ.

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে অত্যধিক যুক্ত থাকার আরেকটি অনিবার্য পরিণতি হলসাধারণ স্থির পাঠাভ্যাস  লোপ পাওয়া বা কমে যাওয়া। অনেক ঘটনাঅনেক অনুভূতিবিপরীতমুখী অনেক প্রতিক্রিয়ার টুকরো টুকরো চিত্র মগজের ময়দান দখল করায় দীর্ঘ-নাতিদীর্ঘউপকারী ও কল্যাণকর উপাত্তগুলোগ্রন্থ ও পৃষ্ঠাগুলো পড়ার আগ্রহ ফুরিয়ে যায়পাঠের দম হারিয়ে যায়। মোবাইল ফোনের ছোট্ট স্ক্রিনই হয়ে ওঠে ছবি-টেক্সটের আরাধ্য বই। সাদা-নীলের এই পাতায় চোখ ও মনযোগ আবদ্ধ হয়ে যায়। এটি মন ও মনস্তত্বের এবং মস্তিষ্ক ও রুচির নীরব সংকটযা সামাজিক মাধ্যমের হাত ধরে তারুণ্যের জীবনে ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করছে। এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেকেই এখন বইপত্র পড়ার সময় ডিভাইস দূরে সরিয়ে রাখেন। অনেকেই ডিভাইস ও নেট সংলগ্ন সময় কমিয়ে দেওয়ার উপায় গ্রহণ করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও নেট-ফোনে অতিরিক্ত নিমগ্নতার অনেক অসুখ ও সংকটের কথা এখনকার দিনে খোদ পশ্চিমের সমাজ-মানুষেরাই উঁচু গলায় বলছেন। এর সঙ্গে এ পর্যবেক্ষণও অনেকেই দিচ্ছেন যেএসবের ফলে স্বাস্থ্য ও মনোস্বাস্থ্যের নানারকম ক্ষতির ঘটনাও ঘটছে। চিন্তা-প্রবণতা বদলে যাচ্ছেধৈর্য্য ও গ্রহণক্ষমতা কমছে এবং চোখ-হাতঘাড়কোমড়সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও পড়ছে নানারকম অসুখের ছাপ। তাই সামাজিক মাধ্যমের নিমগ্নতা-সম্পৃক্ততায় মাত্রা ও সংক্ষিপ্ততা অবলম্বনের কোনো বিকল্প আসলে নেই।

ছয়.

অবশ্য প্রবল মূলধারার গণমাধ্যমের একপেশে ও আরোপিত ভূমিকার বাইরে সঠিক বক্তব্য ও বার্তার কিছু চিত্র তুলে ধরার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্লাটফর্মটি এখনও গুরুত্বপূর্ণভাবে ব্যবহৃত হতে পারেকিছু কিছু হচ্ছেও। এর পাশাপাশি চাপিয়ে দেওয়া পরিস্থিতি ও দমবন্ধ বিচ্যুতির সময়গুলোতে সংশোধনী প্রয়াসের জন্যও এ মাধ্যমটিকে কিছু মাত্রায় কাজে লাগানো যায়এবং প্রত্যাশিত কিছু কাজ এতে হচ্ছেও। প্রভাবশালী অঙ্গন ও গণমাধ্যমের সহযোগিতায় প্রচারিত কোনো বিচ্যুতিদ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে সংশোধন-কাম্য এমন জরুরি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে সত্য বক্তব্যটি ছড়িয়ে দেওয়া যায়। এর তাৎক্ষণিক সুফল বেশ ভালো। তবে এসব উপস্থাপনের ক্ষেত্রে গুজবঅতি আবেগঅসংযত গালাগালভুল তথ্য ও ভুয়া প্রচারণা বিষয়ে কঠোর সতর্কতা রক্ষা করা দরকার। দ্বীনজাতিমানুষ ও দেশের জন্য ইতিবাচক ও কল্যাণকর বিষয়গুলোর প্রচারে সামাজিক মাধ্যমের মধ্যস্থতা গ্রহণ করে সাধারণ নাগরিক সচেতনতা তৈরির কাজটি পারিকল্পিতভাবে করা যায়। দ্বীনঈমান ও দ্বীনী চেতনা এবং মুসলিম প্রধান সমাজের সামাজিক শৃঙ্খলার ওপর কোনো আঘাত এলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাল্টা প্রচারপ্রতিবাদজবাব ও সঠিক বক্তব্য তুলে ধরার যৌক্তিক ও জোরালো উদ্যোগ কার্যকর প্রভাব রাখতে পারেঅনেক সময় রেখেও থাকে। এসবের মধ্য দিয়ে ব্যাপক জনমত গঠন হলে সুফল ও সুপ্রভাবের ছাপ পড়ে প্রভাবক গণমাধ্যমে এবং নীতি-নিয়ন্ত্রক পর্যায়েও।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতি ব্যবহারঅসংযত ও ভুল ব্যবহারের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত ও কল্যাণকর ব্যবহারে চলতি তথ্যের অবগতি এবং দ্বীন ও ইতিবাচকতার প্রচারে একটি প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হতে পারে। এ ক্ষেত্রটিতে তাই প্রয়োজন সতর্কতাসচেতনতা এবং বাস্তব ইতিবাচকতার একটি যুথবদ্ধ মানসিক ও বাস্তব পদক্ষেপ-প্রস্তুতি। আল্লাহ তাআলা যোগাযোগ ও প্রচারের অসুস্থতা থেকে বেঁচে সুস্থতার পথে আমাদের পথচলার তাওফীক দান করুন।


মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ