ব্লগ

ইলম-ঘনিষ্ঠ জীবনের সন্ধানে

post reference icon

মাওলানা ডাঃ মোহাম্মদ মাসীহ উল্লাহ

২১ নভেম্বর, ২০২৩

local library icon

১৮৩৫

comment icon

সিএনজি যোগে ছুটে চলেছি সোজা উত্তরে। আমি চেম্বারের উদ্দেশ্যে প্রতি সপ্তাহেই এই রোডে চলি। কিন্তু আজকের এ যাত্রা ইলমের তলবে। দাওরা শেষ করেছি গত বছর। উম্মুল মাদারিসের কোলেই কেটে গেছে জীবনের বেশ কিছু সময়। ‘তাখাস্সুস’ নামে দাওরা পরবর্তী আরও কিছু পড়াশুনা বাকী আছে। হুজুর পরামর্শ দিয়েছেন ‘ইফতা’ পড়ার। আমার কিছু উস্তাদের পরামর্শ যেন উলূমুল হাদীস পড়ি। যুগের চাহিদা ভাবনায় তাঁরা সেই পরামর্শ দিয়েছেন। হুজুরকে আমি সেই পরামর্শগুলোও শুনিয়েছি। আমার এই লেখায় ‘হুজুর’ শব্দটি খাস সম্বোধনে বার বার আসবে। আমার এমন হুজুর একজনই। আমার তলবে ইলমের “বিসমিল্লাহ” থেকে এই পর্যন্ত যাঁর পরামর্শ ও সহযোগিতা ছিলো আমার পথের আলো। তিনি মুফতি কিফায়াতুল্লাহ সাহেব হুজুর।
হুজুর বললেন, ‘ সবই পড়া দরকার। মাত্র দুয়েক বছর পড়ে কি হবে। পড়তে হবে আরও দশ-পনেরো-বিশ বছর। বুঝ পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য যা যা পড়ার সবই পড়তে হবে। বরং একজন আলিম তো সারা জিন্দেগীই পড়বেন। এই যে দাওরা পরবর্তী দশ-পনেরো-বিশ বললাম, তা তো নিজেকে গড়ার জন্য। দ্বীনের খেদমতের উপযুক্ত করে নিজেকে তৈরির জন্য। কোন বিশেষ শাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য। পড়তে হবে। সাথে কোন প্রকৃত মুরুব্বীর সংস্পর্শে থাকতে হবে।’

হুজুর আমার জন্য শুরুতে ‘ইফতা’ই নির্বাচন করলেন। বুঝ বিষয়টি তো ফিকহের সাথেই বেশি সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এই ‘ বুঝ’ বলতে যা বুঝায়, তার জন্য সবই জরুরী। হুজুর বললেন, ‘ এই আমরা এতদিন পর একটু একটু বুঝতে শুরু করেছি।’ হুজুর একটু একটু বুঝতে শুরু করেছেন! তাহলে আমি তো মিসকীন।
আমাকে আরও পড়তে হবে। অনেক পড়তে হবে। হে মাওলা! পড়তে পড়তেই যেন আমার জীবন-নিশি ভোর হয়। আমি যে ‘বুঝের’ কাঙ্গাল।
প্রথমে ইফতা পড়তে হবে। ইফতার সাথে জীবনের ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি। নিজের জন্যে, নিজের জীবনের জন্যেই পড়া দরকার। হুজুরের মতে, দাওয়াতের ময়দানে উম্মতের সঠিক রাহাবারির জন্যও আমার ইফতা পড়া দরকার। কিন্তু কোথায় পড়বো?

এখানে কিছু সমস্যা হয়ে গেছে। হাইয়াতুল উলিয়ার পরীক্ষাটাও আটকে গিয়েছিলো। আটকে গিয়েছিলো ‘প্রবেশপত্র ‘। হুজুর বাদে উম্মুল মাদারিসের প্রত্যেক উস্তাদের বরাবরে আমার বিরুদ্ধে বেনামী চিঠি দিয়েছে কেউ। ‘ আমার মতো আওয়াম কিভাবে মাদ্রাসায় পড়ে? যে কাউকে এভাবে সুযোগ দিলে তো উম্মুল মাদারিসের বদনাম হবে। উম্মুল মাদারিসকে কলঙ্কমুক্ত রাখার জন্য যেন আমার ভর্তি বাতিল করা হয়। সে সারাদিন ডাক্তারী করে বেড়ায়, পড়ে কখন? মওদুদীর মতো ফিতনা তৈরি করে কী লাভ? ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘
এর নেপথ্যে কে তা অনেকের কাছেই ছিলো স্পষ্ট। এর পেছনের কারণটি ভেতরের নয়, বাইরের। তা আজ এখানে নাই বা বলি। আল্লাহপাক সবাইকে হেদায়াত নসীব করুন।

আমার উস্তাদ, আমার শায়খ আল্লামা আহমদ শফী রহঃ এর মর্যাদা আল্লাহপাক বুলন্দ করুন। আমার সেই অসহায় মূহুর্তে আমার প্রায় সব উস্তাদের উৎকন্ঠা ও প্রচেষ্টার পরও যখন রুদ্ধ দরজার তালা খুলছিলো না, সেই মূহুর্তে হুজুরকে বিষয়টি শুনাতেই বলেছিলেন, ‘ কোন শয়তানের কারসাজি। আমি আজই উস্তাদদের নিয়ে মিটিং এ বসবো।’ হুজুর বসেছিলেন। আমার শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদগন মুফতিয়ে আজম আল্লামা আব্দুস সালাম সাহেব হুজুর, মুফতি নূর আহমদ সাহেব হুজুর, হজরত বাবুনগরী সাহেব হুজুর, মাওলানা ওমর সাহেব হুজুর আমার পক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করেছিলেন। শায়খুল ইসলাম রহঃ এর সেই পদক্ষেপে আমার ইলমী জিন্দেগী শেষ করে দেয়ার সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিলো। আলহামদুলিল্লাহ হাইয়াতুল উলিয়ার সেই চুড়ান্ত পরীক্ষায় ‘মুমতায’ হওয়ার সৌভাগ্য আল্লাহপাক আমাকে নসীব করেছিলেন।

আশা ছিলো হুজুরের নিগরানিতেই “তাখাস্সুস” পড়বো। কিন্তু এখানে…… । তাই আজ সিএনজি ‘উত্তরে’ ছুটছে। আমার ওজরগুলো তারা কবুল করবেন তো? আমার যে পেশাগত একটা জীবন আছে। সকালে ঘন্টাদুয়েক রোগী দেখতে হয়। এগারোটার মধ্যে শেষ করে উম্মুল মাদারিসে দারস ধরতাম। তা আমার জন্য সহজ ছিলো। কিন্তু এখন?
প্রথমেই নক করলাম ‘নানুপুরে’। এটি আমার নিজের এলাকা। এখানে আমার ওজরগুলো বুঝিয়ে বলতে হবে না। আমার খেলার সাথী, ছোটবেলার বন্ধু এবং উস্তাদ মুফতি লোকমান সাহেব কাসেমী এখানে আছেন। আর যারা আছেন, তাঁরা সবাই সহযোগিতা করবেন এই আশা আমার আছে।

ইফতার যিনি জিম্মাদার, মুহতারামকে আমার সব সীমাবদ্ধতার কথা বললাম। তিনি সব শুনেও রাজী হলেন। একজন পড়তে চায়, কেন তাকে পড়তে দেয়া হবে না? যোগ্যতা থাকলে তিনি অবশ্যই পড়বেন। কিন্তু এখানে দুই বছর। কিন্তু দুই বছর তো অনেক কম। হুজুরের মতে তো দাওরা পরবর্তী আরও দশ-পনেরো-বিশ। কিন্তু পরিবারের সদস্যগন আপত্তি জানালো। ‘দুই বছর আপনি প্রতিদিন এত দূরে আসা-যাওয়া করবেন? দুই বছর পর আপনাকে পাওয়া যাবে? এত কষ্ট করলে আপনি বাঁচবেন? ” স্ত্রীর সাথে মা’রও আপত্তি।

হুজুরকে আবার ফোন দিলাম। পরিবারের আপত্তির কথা জানালাম। হুজুর বললেন, ‘ঠিক আছে। নাজিরহাটে এক বছর, দূরত্বও অর্ধেক। পরিবারও এখানে আপত্তি করবে না। আমি মুফতি হাবীবুর রহমান কাসেমী সাহেব, মুফতি এরশাদ ও মুফতি রবিউল হাসানকে আপনার ওজরগুলো জানিয়ে দেবো। আশা করি, তাঁরা বিবেচনা করবেন। ‘শেষের দু’জন হুজুরের ছাত্র।
আসলেই তাখাস্সুস কি আর অন্যকিছুর সাথে হয়? একজন কি প্রফেশনাল ব্যস্ততার সাথে আবার ইফতাও পড়তে পারে? কোন প্রতিষ্ঠানই আসলে এই ওজর কবুল করার কথা নয়। কিন্তু আমাকে যে পড়তে হবে!

আমি সিএনজি ঘুরিয়ে নিয়েছি। এখন চলছি নাজিরহাট মাদ্রাসার দিকে। ওখানে কি আমার পড়ার ব্যবস্থা হবে? হে মাওলা! তুমি ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই! একটা ব্যবস্থা তো করো।হুজুর সাধারণত কারও জন্য সুপারিশ করেন খুবই কম। কারণ এই সময়ে সুপারিশের মর্যাদা রক্ষা করে খুব কম মানুষ। আর অযোগ্যের জন্য সুপারিশ করা তো অপরাধ। হুজুর তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ মুফতি এরশাদ সাহেব হুজুর ও মুফতি রবিউল হাসান সাহেব হুজুরের নিকট আমার ব্যাপারে সুপারিশ করলেন। ফতোয়া বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মুফতি হাবীবুর রহমান কাসেমী সাহেব হুজুর দেশে ছিলেন না। রবিউল হাসান সাহেব হুজুরকে ফোনে হুজুর যা বললেন তার সারমর্ম হলো, ডাক্তার সাহেব ইফতা পড়ার কতটুকু যোগ্য তা পরীক্ষা করে দেখো। আমি নিশ্চিত তুমি নিরাশ হবে না। কিছু বিশেষ কারনে আমি তোমাদের ওখানে পড়ার পরামর্শ দিয়েছি। তার সকালে কিছুক্ষণ রোগী দেখতে হয়। আর রাতে মাদ্রাসায় থাকা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। বাকী পড়াশুনা ও অন্যান্য কাজ যথানিয়মে করবে।
হুজুরকে তাঁর ছাত্রগন চিনেন। তিনি সাধারণত সুপারিশ করেন না। অযোগ্য কারও জন্য তো হুজুরের সুপারিশ কল্পনাও করা যায় না। মুফতি রবিউল হাসান সাহেব হুজুরই দারুল ইফতার জিম্মাদার। ভর্তি পরীক্ষা তিনিই নেন। হেদায়া ছালিছ থেকে নির্দিষ্ট জায়গা ই’রাবসহ লিখতে ও তরজমা করতে দেন। সংশ্লিষ্ট অংশটুকু থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর লেখান। এরপর আবার মৌখিক পরীক্ষা নেন। নির্দিষ্ট দিনে সবার এক সাথে পরীক্ষা হয় না। নিজে ছাত্রের যোগ্যতা দেখে সিদ্ধান্ত নেন সে আসলেই পড়ার যোগ্য কিনা।

পরদিন মুফতি রবিউল হাসান সাহেব হুজুরের কামরায় হাজির হয়েছি। হুজুরের আগাম ফোন পরিচয়পর্ব সহজ করলো। হুজুর বললেন, ” সম্ভবত আপনি হেদায়া ছালিছ পড়েন নি? বললাম, ‘ হুজুর, আমি হেদায়া আওয়ালাইন শেষে আখিরাইনও পড়েছি। ”
যদিও আখিরাইন না পড়ে মিশকাতে উঠে যাওয়ার সুযোগ ছিলো, কিন্তু হুজুর আমাকে আখেরাইন পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ এতে উপকার হয়েছে বেশ।
যথানিয়মে পরীক্ষা দিলাম। কতটুকুই বা লিখতে পারলাম কে জানে। মুফতি সাহেব হুজুর খুশি প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘আমি সর্বোচ্চ ষাট মার্কের বেশি দিই না। আপনাকেও তা দিলাম। মা শা আল্লাহ পড়াশুনা তো ভালোয় করেছেন। দারুল ইফতায় যান। মুতালাআ শুরু করুন। উমদাতুর রেয়াআহ এর মুকাদ্দিমা পড়তে থাকুন। আমাদের প্রথম তামরীন ফিকহের ‘মাবাদি’ নিয়ে।’
হুজুরকে নিয়মনীতির ব্যাপারে খুব কড়া মনে হলো। শুনেছি নিজেও খুব পরিশ্রম করেন, ছাত্রদেরও পরিশ্রম করান। ইলমের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। পুরো দারুল ইফতা হুজুরের মেহনতে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি দারুল ইফতায় ঢুকলাম। বেশ পুরোনো একটি বড় রুম। ছোট ছোট বেঞ্চে কিতাব রেখে ছাত্রগন মুতালাআ করছেন। পেছনে এবং বামপাশের পুরোটাতে শেল্ফ ভর্তি কিতাব। হাটহাজারীর দারসগাহগুলোর মতো টাইলস বিছানো নয়। সাদাসিধে মাদ্রাসা। সাদাসিধে উস্তাদের বসার জায়গা। কিছু সাথী আমার পরিচিত, আর কিছু অপরিচিত। দূরদূরান্তের মাদ্রাসা থেকে তাঁরা এখানে এসেছেন। কেউ নোয়াখালি থেকে, কেউ মাদারীপুর বা চাঁদপুর থেকে। বলতে গেলে দেশের সব প্রান্তের ছাত্র আছে এখানে।

প্রথমদিনের পুরোটা এখানেই কেটেছে। নিয়মিত দারস এখনও শুরু হয় নি। পিরিয়ড অনুসারে হাজিরা ঠিকই ডাকা হচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর পর মুফতি রবিউল হাসান সাহেব হুজুর দারসগাহে ঢুকে মুতালাআর কঠিন তাগাদা দিয়ে যান। একদিন পরই তামরীনের প্রশ্নপত্র দেয়া হবে। তামরীনে উল্লিখিত প্রশ্নগুলো গুছিয়ে লিখতে হবে। এরপর হবে পুরো তামরীনের উপর ধারাবাহিক আলোচনা। প্রত্যেককে নিজের অংশ উপস্থাপন করতে হবে। হুজুর প্রত্যেকের কাছ থেকে শুনতে চাইবেন। না পড়ে না শুনিয়ে কেউ পার পাবে না।
এশা শেষে আজকের মতো ছুটির জন্য গেলাম। হুজুর তাঁর পাশের রুমে আমার জন্য সিট বরাদ্দ দিলেন যেন দুপুরের খাবার ওখানেই খেতে পারি, প্রয়োজনে বিশ্রাম নিতে পারি। মেহমানখানার টয়লেট ব্যবহার করতে বললেন।

নাজিরহাট মাদ্রাসা বেশ পুরোনো। মাদ্রাসার ভেতর ঢুকলে খুব প্রশান্তি অনুভব হয়। উপরের দিকের প্রতিটি ক্লাসে পনেরো-বিশ তালেবে ইলম। দারুল ইফতাতেই কেবল সবচেয়ে বেশি ছাত্র। আশি নব্বই। মুতাফার্রিকা বিভাগ আলাদা, সেখানে অনেক বেশি ছাত্র। রয়েছে স্বতন্ত্র হিফয বিভাগ। সাথে মহিলা মাদ্রাসা আলাদা রয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ আজ থেকে আমি এই মাদ্রাসার ছাত্র। ভালোভাবে পড়াশুনা করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঝংকার মোড়ের দিকে হেঁটে চলেছি। ওখান থেকে হাটহাজারীগামী সিএনজি যোগে আমাকে বাসায় ফিরতে হবে। আজ থেকে এই পথ আমাকে প্রতিদিন দুইবার চলতে হবে। হে মাওলা! কবুল করো ইলমের জন্যে আমার প্রতিটি কদম। সর্বযুগের মকবুল তালেবে ইলমগনের সাথে আমার কদমগুলো মিলিয়ে দাও, যদিও আমি তাদের দলের নই।

আজ আমার দারুল ইফতায় প্রথম দিন। রোগী দেখার শিডিউলে সামান্য পরিবর্তন এনেছি। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় রোগী দেখা শুরু করবো, চেষ্টা করবো সাড়ে দশটার মধ্যে শেষ করার। ড্রাইভার আব্দুল মান্নান ভাই পৌনে এগারোটার মধ্যে সিএনজি নিয়ে হাজির থাকবেন। গৃহকর্ত্রী দুপুরের খাবারটা হট ক্যারিয়ারে রেডি রাখবেন। ব্যাগটা আগেই গুছানো থাকবে। রোগী শেষ হতেই আমি দেবো ভোঁ দৌড়। সিএনজি ইন শা আল্লাহ চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিটে পৌঁছে দেবে। যে কোন ভাবে অন্তত দ্বিতীয় ঘন্টা ধরার চেষ্টা। প্রথম ঘন্টাটি জাফর সাহেব হুজুরের। তিনি আদ্দুর্রুল মুখতার এর তাহারাত অংশ পড়ান। এর পরপরই মুফতি রবিউল হাসান সাহেব হুজুর আদ্দুর্রুল মুখতার থেকে কিতাবুল বুয়ূ পড়ান। তৃতীয় ঘন্টায় কাসেমী সাহেব হুজুরের আল-আশবাহ আর চতুর্থ ঘন্টায় মুহতামিম সাহেব হুজুরের তাফসীরে বায়যাবী। ইফতায় আবার তাফসীর? মুহতামিম সাহেব হুজুরের তাফসীরের দারসে একবার বসলে সে আর এ ব্যাপারে আপত্তি করবে না।
যোহরের বিরতির পর পরই আদ্দুর্রুল মুখতার থেকে কিতাবুন নিকাহ নিয়ে আসেন কাসেম সাহেব হুজুর। লাঠিতে ভর দিয়ে ঠকঠক করে আসেন। ৬ষ্ঠ ঘন্টায় শরুহু উকূদ পড়ান মুফতি এরশাদ সাহেব হুজুর। ৭ম ঘন্টাটি তামরীনের। আসর নামাজ শেষে মসজিদে তালীম হয়। দশ মিনিটের মেহনত শেষে সাথীরা খাবার নেয়ার জন্যে মাতবাখের ওখানে বালতি হাতে লাইন ধরে। আমি মাদ্রাসার তালেবে ইলমগনের সুশৃঙ্খল জিন্দেগী দেখতে থাকি।

মাগরিবের পর পরই ক্লাসে হাজিরা শুরু হয়ে যায়। এভাবে প্রতি ঘন্টায় হাজিরা হতে থাকে। পুরো দারুল ইফতায় বিরাজ করে অথৈ নীরবতা। যেন একদল গবেষক গবেষণারত। কিতাবের পাতায় আটকে আছে সবগুলো চোখ। এই পুরো নীরবতার মাঝে হঠাৎ দ্রুত উদয় হন মুফতি রবিউল হাসান সাহেব হুজুর। সেই মূহুর্তে নীরবতা আরও গভীরতা লাভ করে। হুজুর তীক্ষ্ণ চোখে ছাত্রদের অবস্থা দেখতে থাকেন। কখন কাকে তলব করেন বলা যায় না।
আসরের সময় কামালকে নিয়ে সিটের জন্য একটা বেড, একটা বেডসিট, একটা বালিশ কিনে এনেছি। কিতাব রাখার জন্য বানাতে দিয়েছি স্টীলের একটা আলমিরা।
কাসেমী সাহেব হুজুর এখনও সফর থেকে ফিরেন নি। মুহতামিম সাহেব ক্লাসে ঢুকতেই প্রথম বেঞ্চে আমাকে দেখে বলে উঠলেন, ” ডাক্তার মছীহুল্লাহ সাহেব না?” আমি দাঁড়িয়ে বললাম, জী হুজুর। হুজুর বললেন, ‘আমাকে রবিউল হাসান সাহেব বলেছেন। খুব ভালো, খুব ভালো। আমি খুব খুশি হয়েছি। ‘ হুজুর আমার পুরাতন রোগী। আমি যখন একসময় নাজিরহাটে চেম্বার করতাম, হুজুর আমার কাছে চিকিৎসার জন্য আসতেন। পরে ইলমের তলব যখন পেশাগত ব্যস্ততা কমানোর দাবী জানিয়েছে, তখন কিছু চেম্বার বাদ দিয়েছি। ফলে হুজুরের সাথে আর দেখা করার সুযোগ হয়ে উঠে নি।
এশার পর মসজিদে পরামর্শে বসি। আমাদের সময় এখানে দাওয়াতের কাজ নতুন জীবন লাভ করেছিলো। সংক্ষিপ্ত পরামর্শ শেষে আবার সেই নীরবতার সমুদ্রে। কখনও বাদায়ে’, কখনও বাহর, কখনও ফতহুল কাদীর, কখনও শামী। বাদায়ে’র সুন্দর উপস্থাপনা কখনও মোহিত করে, শামীর সব জমা করে ফাতাআম্মাল বলা কখনও ভাবনায় ফেলে দেয়। ইবনুল হুমামের ইস্তিদলাল কখনও বিস্ময় সৃষ্টি করে। ইলম-ঘনিষ্ঠ জীবন ও জীবন-ঘনিষ্ঠ ইলমের খোঁজে ফিরতে থাকি কিতাবের অলিগলি। কখনও কখনও ইমাম মুহাম্মাদ রহঃ এর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমিও বলি,
” আইনা আবনাউল মুলূক মিন হাযিহিল লাযযাত! ”

মুফতি রবিউল হাসান সাহেব হুজুর। এক আশ্চর্য মানুষ। বড় এক শারীরিক ব্যাধির সাথে হুজুর লড়ে চলেছেন। জায়ান্ট সেল টিউমার অব স্পাইন। এটি এক ধরনের এগ্রেসিভ বিনাইন টিউমার। হুজুরের ব্যাকপেইনের কমপ্লেইন ছিলো কিছুদিন থেকে। ডাক্তারগন প্রথমে কেউ টিউমারের কথা বলেন নি। সবাই কেবলই ব্যাকপেইন চিন্তা করে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। কিন্তু জায়ান্ট সেল টিউমারের ক্ষেত্রে টিউমার যত বড় হতে থাকে, নার্ভ রুট কম্প্রেশনের কারনে ব্যথা তত তীব্র হতে থাকে। অবশেষে ডায়াগনোসিস হলো এটি জায়ান্ট সেল টিউমার। হুজুর চলে গেলেন ইন্ডিয়ায়। ওখানেই হুজুরের অপারেশন হলো। আলহামদুলিল্লাহ তেমন কোন জটিলতা হয় নি। কিছু বিশেষ ধরনের অসুবিধা ছাড়া ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন।

জায়ান্ট সেল টিউমার পূনরায় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই প্রতি বছর ফলোআপ করতে হয়। যদি পূনরায় টিউমারের অস্তিত্ব ধরা পড়ে রেডিওথেরাপি দিতে হয়। বিশাল খরচেরও ব্যাপার। শারীরিক এই অবস্থার ভেতর দিয়েও হুজুর তার সব ধরনের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ফলে নাজিরহাট দারুল ইফতা বেশ খ্যাতিও লাভ করেছে।
হুজুর ফটিকছড়ির সুয়াবিল ইউনিয়নের এক প্রত্যন্ত গ্রামের সন্তান। শিরক ও বিদআতে নিমজ্জিত এক এলাকা। সেই ওখান থেকে শত বিরোধিতার মাঝে নিয়মিত পায়ে হেঁটে হুজুর নাজিরহাটে পড়াশুনা করেছেন। দাওরা শেষে হাটহাজারীতে ইফতা পড়েছেন। নাজিরহাট মাদ্রাসার প্রথম সারির ভালো ছাত্রদের একজন তিনি। মাদ্রাসার উস্তাদগন পড়াশুনা শেষ করামাত্র তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এক পর্যায়ে দারুল ইফতার জিম্মাদারী দিয়েছেন। হুজুর তাঁর উস্তাদগনকে নিরাশ করেন নি। নিজের সেই গ্রামে অনেক কষ্টে প্রতিষ্ঠা করেছেন মাদ্রাসা। নূরানী ও হিফযখানা, কিতাবখানা। বলতে গেলে একদম ফ্রীতে এলাকার গরীব ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যবস্থা করেছেন। নানা কৌশল ও প্রজ্ঞার সাথে শত বিরোধিতার মাঝেও আলো জ্বালানোর ফিকরে আছেন। হুজুরের সেই মাদ্রাসার নানা কাজে ইফতার ছাত্রদেরও অনেক অবদান। প্রতিটি ব্যাচের ছাত্ররা হুজুরের প্রতি ভালোবাসার কারনে ভালোবাসে হুজুরের মাদ্রাসাকেও। প্রয়োজনে সেখানে গিয়ে নিজের হাতে কাজ করতেও দ্বিধা করে না।
হুজুর বড় ছাত্রবান্ধব উস্তাদ। কিন্তু দারস ও তামরীনের সময় হুজুরের গাম্ভীর্য অন্যরকম। কারও ফাঁকি দেয়র সাহস হয় না। হুজুর প্রয়োজনে মারার অধিকারও রাখেন। প্রয়োজনে শাস্তিও দেন।
এই অধিকার হুজুর অর্জন করে নিয়েছেন।

তামরীনগুলো হুজুর বড় গুরুত্ব দিয়ে করান। তামরীনের প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার আগে সপ্তাহ খানেক মুতালাআর সময় পাওয়া যায়। আরবী কিতাবগুলো ভালো করে পড়তে হয়। তামরীনের প্রশ্নপত্র হাতে এলে দুই তিনদিন সময় দেন। এরপর হুজুর ধারাবাহিক আলোচনা শুরু করেন। প্রতিটি প্রশ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে থাকে। আলোচনার দায়িত্ব ছাত্রদের। প্রতিটি আলোচনা দলিলসমৃদ্ধ হতে হয়। আবার কিতাব ধরে ধরে ইবারতগুলো পড়ে শুনাতে হয়। ছাত্ররা এর সঠিক মতলব বুঝেছে কিনা হুজুর খেয়াল করেন। এরপর সংশ্লিষ্ট সমস্ত ফুরুঈ মাসায়েল জিজ্ঞেস করতে থাকেন। দলিলসহ উত্তর দিতে হয়। এভাবে এক একটা তামরীন নিয়ে লম্বাসময় আলোচনা হতে থাকে। আলোচনা শেষে খাতাগুলো জমা নেন। ভালো করে লেখাগুলো দেখেন। এক একটা তামরীন শেষ হলে পুরো অধ্যায় সম্পর্কে একটা ক্লিয়ার ধারণা গড়ে উঠে। কোন মাসআলা কোন কিতাবে আছে একটা গ্রস আইডিয়া মাথায় এসে যায়। সংশ্লিষ্ট ফিকহুন নাওয়াযিল আলাদা আলোচনা করেন। ছাত্রদের কাছ থেকে উত্তর জানতে চান। কার কি ভিউ, কে কিভাবে চিন্তা করে লক্ষ করেন। চিন্তার যোগসুত্র ঠিক করে দেন। হুজুরের তামরীনের এই আলোচনা বড় অসাধারণ মনে হতে থাকে।

মুফতি হাবীবুর রহমান কাসেমী। দামাত বারাকাতুহুম। হুজুর আমাদের আল আশবাহ পড়াতেন। হুজুর লম্বাসময় দেওবন্দে পড়েছেন। মুফতি মাহমুদ হাসান গঙ্গুহী রহঃ এর মতো বড় ব্যক্তিত্বের অধীনে ফতোয়ার কাজ করেছেন দীর্ঘ আট বছর। হুজুর ওখানকার বিভিন্ন ঘটনা শুনাতেন। হুজুর দারসে আমাদের সবচেয়ে জোর দিতেন উলূমুল হাদীসে দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে। এ জন্য হুজুর উলূমুল হাদীসের উপর সেমিনারও আয়োজন করিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন মাদ্রাসার উলূমুল হাদীস বিভাগের উস্তাদদের দিয়ে আলোচনা করিয়েছেন। সেমিনারে মুহতারাম উস্তাদ মুফতি আব্দুল্লাহ নাজীব সাহেব হুজুরের আলোচনা ছিলো অসাধারণ। সেখানে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। প্রায় সময় কিছু মানুষ উলূমুল হাদীসের ব্যাপারে ফুকাহাগনের দূর্বলতা বা সম্পর্কহীনতার অভিযোগ করে। অথচ এটি অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়। হুজুর বলেন, প্রথমে উসূলুল হাদীস সংক্রান্ত ফুকাহা-মুহাদ্দিসীনগনের মানহাজ যে ভিন্ন এটি তো বুঝতে হবে। এটি যারা বুঝে না, তারা উসূলুল হাদীস সংক্রান্ত মুহাদ্দিসগনের মানহাজ দিয়ে ফুকাহাগনের দলিলগুলোকে মাপে। এটি করতে গিয়ে তারা মোটা দাগে দুটি ভুল করে। এক, তারা প্রথমে মনে করে বসে উসূলে হাদীস সম্পর্কে ফুকাহাগনের কোন আইডিয়া বা মানহাজ নেই। দুই, তারা ফুকাহাগন তাঁদের ইস্তিমবাতকৃত মাসায়েলের পক্ষে যে সব হাদীস দ্বারা দলিল দিয়েছেন, সেগুলোকে মুহাদ্দিসগনের মানহাজ দিয়ে মাপতে গিয়ে যয়ীফ বা দলিল অযোগ্য সাব্যস্ত করে। অথচ এই দুটি কাজ পুরোই গলদ ।

এক তো ফুকাহাগন স্বয়ং মুহাদ্দিসীনও। এ জন্য তাঁদেরকে কেবল ফুকাহা না বলে ফুকাহা-মুহাদ্দিসীন বলা দরকার। দুই হলো উসূলে হাদীসের জন্য তাঁদের নিজস্ব মানহাজ রয়েছে। আর তাঁদের মানহাজ অনুসারে তাঁদের হাদীসগুলো দলিলযোগ্য। কাজেই তাঁদের হাদীসকে আপনি কেন মুহাদ্দিসীনগনের মানহাজ দিয়ে মাপবেন? আপনি কি কখনও হানাফী মাজহাবের মাসায়েলকে শাফেয়ী মাজহাবের উসূল দিয়ে মাপা বৈধ মনে করেন? এটিও তো তেমনই একটি বিষয়। হুজুর বলেন উসূলে ফিকহের কিতাবগুলোতে সুন্নাহ শিরোনামে যে সব উসূল বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলোই তো ফুকাহাগনের মানহাজ অনুসারে বর্ণিত উসূলে হাদীস। হুজুরের এই এক আলোচনা আমার অনেক কনফিউশন দূরীকরণে সাহায্য করেছে আলহামদুলিল্লাহ।
মুফতি আব্দুল্লাহ নাজীব সাহেব হুজুরের যে দ্বিতীয় আলোচনা আমার খুব উপকার করেছে সেটি হচ্ছে ফিকহ অধ্যয়নের ধারাবাহিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কিত আলোচনা। হুজুর ফিকহ অধ্যয়নের তিন স্তর আলোচনা করেন। আল ফিকহুল মুজার্রাদ, আল ফিকহুল মুদাল্লাল, আল ফিকহুল মুকারান। বলাবাহুল্য প্রতিটি স্তরের অধ্যয়নের সম্পর্ক যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয়তা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের। প্রতিটি স্তর অধ্যয়নের আলাদা যোগ্যতা রয়েছে। যারা একদম সাধারণ মানুষ, দলিল বুঝার যোগ্যতা যাদের নেই, তাদের সামনে দলিলনির্ভর ফিকহ বর্ণনা করতে গিয়ে কিছু মানুষ যে বেইনসাফীর পরিচয় দিয়েছে এবং মুজতাহাদ ফী মাসআলায় নিজেদের ইজতিহাদকে অকাট্য হিসেবে পেশ করে তাকেই একমাত্র সহীহ হাদীসের অনুসরণ বলে চালিয়ে দিয়েছে এর দ্বারা যে উম্মতের ঐক্য কি পরিমাণ নষ্ট হয়েছে তা অকল্পনীয়। একজন প্রকৃত আহলুল ইলম কখনোই এমন খেয়ানত করতে পারেন না।

প্রতিদিন সকালে দ্রুত চেম্বার শেষ করে নাজিরহাটের দিকে ছুটি। রাতে মুতালাআ শেষে যখন দারুল ইফতা থেকে বিদায় নিই, তখন কখনও দশটা, কখনও দশটা ত্রিশ। রিক্সাযোগে নাজিরহাট বাজার থেকে যখন ঝংকার অভিমুখে চলি, তখন সেখান থাকে শুনশান নীরবতা। ঝংকার মোড় থেকে হাটহাজারীর দিকে চলতে থাকা কোন সিএনজি-যোগে যখন বাসায় পৌঁছি, তখন এগারোটা কিংবা কখনো বারোটা। এক জোড়া চোখ বাসার ব্যালকনি থেকে বাড়ির গেইট অভিমুখে কেবলই তাকিয়ে থাকে। কখনও কখনও পথের মাঝেই মোবাইল বেজে উঠে, ‘ কোথায় আপনি?’ একজনের বুড়ো বয়সের পড়াশুনার সমস্ত নেকীতে এভাবেই শরীক হতে থাকে অন্যজন। সর্বযুগে এরা বুঝি এমনই। সহধর্মিণী!

এক বছরের ইফতা। কিন্তু এমন টাইট শিডিউল নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই। সবসময় জোঁকের মতো লেগে আছেন রবিউল হাসান সাহেব হুজুর। এক তামরীনের উপর আলোচনা শেষ হওয়ার আগেই দ্বিতীয় তামরীনের পড়াশুনা শেষ করার তাগাদা দিচ্ছেন। দুই-তিনদিন যেতে না যেতেই তামরীনের প্রশ্নপত্র হাতে এসে যাচ্ছে। উত্তর লেখা শেষ করতে না করতেই আলোচনা শুরু। কখনও কখনও সেমিনার। সাথে প্রতিদিনের ছয়টি দারস আছেই। ইফতাতেও বুঝি এমন টানা দারস হয়?
মুহতামিম সাহেব হুজুর ( রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) যোহরের আগে বায়যাবী পড়ান। হুজুরের দারস অসম্ভব সুন্দর। আকাবিরে হাটহাজারীর নান উপাখ্যান অসাধারণ দক্ষতায় হুজুর আমাদের শুনিয়ে যান। এখানে তাফসীর চলছে, নাকি তাসাউফ? জোহরের নামাজে এর আছর টের পাওয়া যায়। ইমাম বায়যাবী এই তাফসীর লেখার সময় তাঁর এক শায়খের অধীনে তখন আধ্যাত্মিক সাধনায় রত ছিলেন। তাই তাফসীরের ফাঁকে ফাঁকেই তাসাউফের রঙ। আর হুজুরও এই ময়দানের সাহসী ঘোড়সওয়ার।
আমরা ইজতিহাদ-মাজহাব-তাকলীদ, আকাইদ-ফিরাকে বাতেলা-নাস্তিকতাসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে সেমিনার করেছি। ইসলামী অর্থনীতি, ফিকহুল নাওয়াযিল, জন্মনিয়ন্ত্রণ, টেস্টটিউব বেবি, এমএলএমসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতারণামূলক অর্থনৈতিক কার্যক্রম ইত্যাদি সব বিষয়েই তামরীন হয়েছে। ইফতা পড়তে এসে লক্ষ করলাম, আমি একদম শিশু শ্রেণী থেকে এমবিবিএস পর্যন্ত যা যা পড়েছি সবই ফিকহের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগে। জীবন ঘনিষ্ঠ ইলমের দাবীও তো তাই।
এভাবেই প্রতিদিনের আসা-যাওয়া, টানা দারস, মন খারাপ করা উদাস বিকেল, সহপাঠীদের হাস্যরস, মিষ্টি তর্ক, ফতোয়ায় সিগনেচার নেয়ার লম্বালাইন, হুজুর ও ছাত্রদের চিকিৎসা, রাতে দেরিতে বাসায় ফেরা, একজন মানুষের চুপচাপ অপেক্ষার মধ্য দিয়ে একদিন আমাদের ইফতা শেষ হয়ে যায়। যথারীতি চুড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহন করি। কিভাবে যেন পাশও করে ফেলি।
এক বছরের ইফতা শেষ হলে কী হবে! আমার যে তাখাস্সুস এখনও শেষ হয় নি। এক বছর পড়েই বা আর কতটুকু হয়। যথারীতি হুজুরের কাছে ফিরে এলাম। হুজুর ইফতার নতুন নাহজ ঠিক করে দিলেন। বললেন এখন প্রয়োজন আরও বিস্তৃত ও গভীর মুতালাআ। মুসতালাহুল ফিকহ, তারীখু তাদবীনিল ফিকহ, তারাজিমুল ফুকাহা, উসূলে ফিকহ, মাসায়েলে ফিকহ, দালায়েলে ফিকহ, কাওয়ায়িদে ফিকহ, উসূলুল ইফতা, ফিকহুল নাওয়াযিল, বিবিধ এই দশ শিরোনামে লম্বা মুতালাআ করতে হবে। এতদিন আমার তাখাস্সুস ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক, এখন আমার অপ্রাতিষ্ঠানিক তাখাস্সুস শুরু হলো। আরম্ভ হলো নতুন আন্দাযে পড়াশুনা। সাথে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ফতোয়ার তামরীন করতে দেন হুজুর। গত বছরও তামরীনুল ফতোয়ার অংশ হিসেবে অনেক অনেক ফতোয়া লিখতে হয়েছে। কিন্তু হুজুরের দেয়া কাজগুলো একটু ব্যতিক্রম। এক একটা ফতোয়া সমাধান করতে অনেক অনেক পড়াশুনা এবং অনেক অনেক চিন্তা করতে হয়। একটা উত্তর রেডি করে হুজুরের কাছে পেশ করলে হুজুর ওখান থেকেই নতুন ইশকাল বের করেন। একজন ফকীহর মেধা কত সুইফট এবং তীক্ষ্ণ তা উস্তাদে মুহতারাম মুফতি সাহেব হুজুরের এই প্রশ্নগুলো শুনলে উপলদ্ধি হয়। সেই ইশকালের আবার জবাব বের করতে হয়। একটা ফতোয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সর্বদিক পরিপূর্ণ না বুঝা পর্যন্ত হুজুরকে সন্তুষ্ট করা যায় না। এতে চিন্তার নতুন নতুন দিগন্ত সামনে আসতে থাকে। নতুন টপিক এলে হুজুর বড় মজার সাথে এতে উঠেপড়ে লাগেন। বিষয়টির সংশ্লিষ্ট সবদিক ক্লিয়ার না হওয়া পর্যন্ত হুজুর ছাড়েন না। তাবলীগের হালতের সময়ও এই অবস্থা দেখেছি। এরপর দেখলাম করোনোর সময়ে। প্রতিটি নতুন বিষয়ে হুজুর পরিপূর্ণ ইতকান ও ইতমিনান চান। এই করোনার সময়ে যত লেখা লিখেছি সব হুজুরের হুকুমে। এটি ছিলো আমার ভিন্ন ধরনের তামরীন। প্রতিদিন বলতে গেলে ঘন্টার পর ঘন্টা হুজুরের সাথে ফোনে কথা বলেছি। পড়াশুনাও করতে হয়েছে প্রচুর। এরপর পুরোটা হুজুর দেখেছেন, সম্পাদনা করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ এতে আমার অনেক উপকার হয়েছে। সবব ‘মাজহুল’ হওয়া আর ‘মাওহুম’ হওয়ার মাঝে যে অনেক তফাৎ বিষয়টি হুজুর অনেক স্পষ্ট করে বুঝিয়েছেন। একই বিষয়ে বিভিন্ন জনের ফতোয়া বিভিন্ন রকম হওয়ার কারণও এটিই । হুজুর এই সময়ে আরেকটি বিষয় বুঝিয়েছেন । একটি নিতান্তই শাখাগত মাসায়েলকে আকাইদ বানিয়ে পেশ করলে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়। জনসাধারণ এতে মারাত্মক কনফিউশনে পড়ে। যে কোন বিষয়েই উসূল এবং ফুরু’র মাঝে পার্থক্য সুস্পষ্ট হওয়া জরুরী। এই সময়ের বেশিরভাগ ইখতিলাফ ও দ্বন্দের দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তাবলীগের সমস্যাটিরও গোড়া হুজুরের মতে ওয়াসায়িল ও মাকাসিদে পার্থক্য করতে না পারা। এটিও উসূল ও ফুরু’ না বুঝার একটি প্রকার।
এই বিষয়টি নিয়ে হুজুর এত ভেবেছেন যে, এই উসূল এবং ফুরু’ ( মূল এবং শাখা) নিয়েই হুজুর দারুল ইফতায় পঞ্চাশের অধিক দারস দিয়েছেন। যেন তালেবে ইলমগন এই বেসিক বিষয়ে ভুল না করে।
হুজুর বলেন, কেউ যদি ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ এবং ‘এহইয়াউ উলূমুদ্দীন’ না পড়ে, সে আলিম হয় কি করে। ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ শরীয়তের বিধানাবলীর রহস্য ও মাকাসিদ বুঝার জন্য। আর ‘এহইয়া’ নিজের ভেতর ও বাহিরকে ইলম ও আমলের রঙে সাজানোর জন্য।

হুজুরই ছিলেন আমার ইলমের পথে প্রথম অভিভাবক, প্রথম রাহবার। সেই শুরু থেকে এই পর্যন্ত যা সামান্য অর্জন তা হুজুরের দিকনির্দেশনারই বরকত। ইলম অর্জনের আসল যে গন্তব্য তাফাক্কুহ ফিদ্দীন এবং রুসুখ ফিল ইলম তা থেকে আমি যে এখনও যোজন যোজন দূরে। স্বাভাবিকভাবেই আমি তাখাস্সুস এখনও শেষ করতে পারি নি। শেষ কি আদৌ সম্ভব হবে?
হে মাওলা! তোমার দয়া চাই, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অফুরন্ত দয়া। তুমিই তো প্রকৃত দাতা। আমার এই অসম্পূর্ণতা, আমার এই অপারগতা এ যে আমার দোষ, আমার দূর্বলতা। আমার পাত্রটি যে বড়ো ছোট। তারপরও কাঙাল আমি, তুমি আমাকে আরও অনেক অনেক দাও। আমি ফাহুম ও বুঝের প্লাবন চাই। রব্বি যিদনী ইলমা।
আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ঈমানান কামিলা, ওয়া ক্বলবান খাশিআ, ওয়া ইলমান নাফিআ’, ওয়া আ’মালান সালিহাম মুতাক্বব্বালাহ……


প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ