ব্লগ
নিভৃতচারী আল্লাহওয়ালাদের খোঁজে

মাওলানা ডাঃ মোহাম্মদ মাসীহ উল্লাহ
২১ নভেম্বর, ২০২৩

১৮১২

০
হজরতের গড়া ছোট্ট, অথচ সুন্দর মাদ্রাসা। মাদ্রাসা থেকে এক ছাত্রকে রাহবার হিসেবে সাথে নিয়ে যখন হজরতের বাড়ির দিকে চললাম, তখন সাতটা চল্লিশ। মোবাইলটা বেজে উঠতেই কানে বাজলো হজরতের স্নেহপূর্ণ সম্বোধন।
-” বা-জি আইসতে লাইগ্গো, না?”
-” জী হুজুর! আইর। আর কয়েক মিনিট লাগিবো।”
হুজুরের নম্বর আমার কাছে ছিলো না। আমতলি মাদ্রাসার ক্বারী মঈনুদ্দীন সাহেবকে বলেছি হজরতের কাছ থেকে এপয়েন্টমেন্ট নিতে। হজরত শুনে এখন নিজেই ফোন দিলেন।
ফেতনার সমুদ্রে এখন হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা। ফেতনা দ্বীনি মহলগুলোতেও হানা দিতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় নিজেকে হিফাজতের সম্বল মাত্র দুটি, এক হচ্ছে ইলম, দুই মুখলিস আল্লাহওয়ালাগনের সোহবত। এ কথা খুবই অন্তর থেকে অনুভব করছি। এ উদ্দেশ্যেই আমরা ক’জন মিলে নিভৃতচারী আল্লাহওয়ালাদের তালাশ করে বেড়াচ্ছি। যারা প্রসিদ্ধ নন, অথচ ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাতের অলংকার তাঁদের সজ্জ্বিত করে রেখেছে। হাদীসে ইনাদেরকেই বলা হয়েছে হিদায়াতের চেরাগ, যাদের ওসীলায় ফিতনা মিটে যায়।
হজরত বাড়িতেই থাকেন। নিজের সবকিছু সন্তানদের মধ্যে বন্টন করে দিয়ে অনেক দিন ধরে আখিরাতের সফরের অপেক্ষায় আছেন।
হজরত প্রথমে ডিগ্রী পাশ করেছেন, এরপর মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছেন। লালবাগে পড়াশুনা কালে তাবলীগের কাজে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন। কিভাবে তাবলীগের সাথে লাগলেন তা এভাবেই আমাদের শুনাচ্ছিলেন।
-” সদর সাহেব হুজুর ( আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহঃ) একদিন আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ ইউসুফ! তুমি কাকরাইলে যাও না?’
আমি বললাম, ‘ হজরত তাদের কথা আমার একদম ভালো লাগে না। আমরা তো এক বিষয়ের উপর ঘন্টা দুই ঘন্টা আলোচনা করি। আর তারা কতক্ষণ ঈমান, এরপর অল্পক্ষণ নামাজ, অতঃপর ইলম ও যিকর… ‘ হুজুর বললেন, ‘ না না ইউসুফ! তুমি কাকরাইলে যাও। তাঁরা ঈমানের উপর সুন্দর সুন্দর আলোচনা করেন, তোমার ভালো লাগবে।’
সেই থেকে আমার কাকরাইলে যাওয়া- আসা শুরু। তখন শবগুজারিতে সর্বোচ্চ শত দেড়শ’ মানুষ হয়।
একদিন এরশাদ ভাই আমাকে বললেন, ইউসুফ ভাই! মুরুব্বীরা বলেন, দাওয়াত ছে ঈমান আ-তা হ্যায়, হিজরত ছে ইয়াকীন আ-তা হ্যায়। জা-নি হিজরত ছে আল্লাহ ছে হু-নে কা ইয়াকীন, মা-লি হিজরত ছে গাইরুল্লাহ ছে না হু-নে কা ইয়াকীন আ-তা হ্যায়।
মুজাহাদা ছে নামাজ আ-তা হ্যায়, যিকর ছে ইলম আ-তা হ্যায়, ফিকর ছে যিকর আ-তা হ্যায়, মহব্বত ছে ফিকর আ-তা হ্যায়। ছোট কি খিদমত ছে ইকরামুল মুসলিমীন আ-তা হ্যায়, বড় কি খিদমত ছে রিয়া ও কিবর আ-তা হ্যায়। দুনিয়া কি বেরগবতি ছে ইখলাস আ-তা হ্যায়, কুরবানি ছে তাবলীগ আ-তা হ্যায়। গাই বাহিষ জবাহ করনে কা নাম কুরবানি নেহি, দ্বীন কি তাকাজা পর লাব্বাইক কেহ না কা নাম কুরবানি হ্যায়।’
শুনে মনে মনে বললাম, এখানে তো সব এসে গেলো। তবলীগের বারো উছুল ছয় সিফাত আনার জন্যেই। যদি বারো উছুলের উপর জিন্দেগি না উঠে, ছয় সিফাত জীবনে কখনও আসবে না। “
হজরত এভাবে ঘন্টা খানিক শুনিয়ে গেলেন। বললেন, এখন তো সময় বেশি দিতে পারি না। বয়স ছিয়াত্তর হতে চললো, সাথীরা এখানে জামাত পাঠিয়ে দেয়, তাদের সাথে সময় কাটাই। আর মসজিদ আবাদের মেহনত করি। শায়খুল হাদীস জাকারিয়া সাহেব রহঃ এর খলিফা মৌলানা যোবায়ের আহমদ মজিআ দাওয়াতের মেহনত উছুলের সাথে করতে থাকবো এই হিদায়াতের উপর অধমকে ইজাজত দিয়েছিলেন। এখনও তার উপরই আছি।”
ইনি হজরত আল্লামা মুহম্মাদ ইউসুফ শাহনগরী হাফিজাহুল্লাহ। নানুপুরের হজরত আল্লামা জমির উদ্দীন রহঃ এর খলিফা।
হজরত বললেন, মাওলানা ইলিয়াস রহঃ তাসাউফের সারমর্ম বারো উসুল তাবলীগে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এই উদ্দেশ্যে, যেন সহজে ছয় সিফাত হাসিল হয়ে যায়। কিন্তু আমরা এই বারো উসুলের হাকীকত বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। নিজেরা ইচ্ছেমতো তাতে পরিবর্তন এনেছি। ফলে যা হবার তাই হতে লাগলো। তরবিয়ত বন্ধ হতে শুরু হলো।
মানুষ বাড়া, বড় বড় ইজতিমা হওয়া এগুলোকে আমরা তরক্কীর আলামত বুঝি। বাস্তবে বেলা যত বাড়ে, সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় তত নিকটে আসে। সূর্য পূবাকাশ থেকে মধ্য আকাশে আসা পর্যন্ত আমরা বলি, সূর্য উঠছে। আসলে কি উঠছে? বরং ক্রমাগত তা ডুবার দিকে আগাচ্ছে। যেদিন আল্লাহর রাসুলের ইন্তিকাল হলো, সেদিন থেকেই ইসলামের সূর্য ডুবার দিকে এগুচ্ছে।
তো, বারো উসুল ছিলো তরবিয়তের জন্য। আমরা আজ সেগুলির আলোচনা করি, কিন্তু উদ্দেশ্য বুঝি না। ফলে আমলের চর্চা হয় না, উপকারও হয় না।
দাওয়াত, তালীম, ইবাদত, খিদমত -এ চার কাজে ব্যস্ত থেকে জিন্দেগির তরতীব বানানো উচিত ছিলো। খিদমতের মধ্যে কামাই -রোজগার, বিবি-বাচ্চার খিদমত সব দাখিল। তবে তা চার নম্বরে। দাওয়াত, তালীম, ইবাদত এর পরে খিদমত।যেমন হাদীসে এসেছে,
طلب كسب الحلال فريضة بعد الفريضة.
হালাল রুজি তলব করা ফরজের পরে ফরজ।
প্রথম ফরজগুলো কি? ঐ তিন জিনিস- দাওয়াত, তালীম, ইবাদত। দাওয়াত- তালীম- ইবাদতের তাকাজাকে প্রাধান্য দেয়া, যেমন সাহাবারা করতেন।
এরপর কম খাওয়া, কম ঘুমানো, কম কথা বলা, জরুরতে কম সময় দেয়া তো তাসাউফের বুনিয়াদী উসুল। আজ আমরা সেগুলি পরিবর্তন করে নিয়েছি। আমরা ভেবেছি, কম খাওয়ার কথা বললে মানুষ আসবে না। তাই পরিবর্তন করে বলছি, খাওয়ার মধ্যে কম সময় লাগানো। নতুনরা তো এসবের হাকীকত একদম বুঝছে না, ফলে সাথীরা সময় লাগিয়ে আসে, বাহ্যিক কিছু পরিবর্তন ছাড়া ভেতরগত ইসলাহ আগের মতো হচ্ছে না। আলিমগন সাল লাগিয়ে আসে, আগের মতো পরিবর্তন নেই। আমরা তো তবলীগে প্রথম তিনদিন লাগানো থেকেই জিন্দেগির তরতীব করে নিয়েছি। ডাক্তারগন যখন আমাকে কম খাওয়ার কথা বলে, বলি, ভাই! আমরা তো সে কবে থেকেই তা তরতীব বানিয়ে রেখেছি। আগে মুজাকারা হতো, পেটকে তিনভাগ করা, একভাগ খাবার, একভাগ পানি, একভাগ যিকর। আজকাল সে আলোচনা শুনা যায় না।
হজরত আরও বললেন, “
শেষবার যখন পুরোনোদের জোড়ে গেলাম, বৃষ্টির কারণে দ্বিতীয় দিন দোয়া হয়ে গেলো। ভাবলাম, আর আসতে পারি না পারি, মাঠটা একটু ঘুরে যাই। আরেক সাথীসহ ছাতা নিয়ে ঘুরলাম। দেখে ব্যথিত হলাম। খাবারের বিলাসী আয়োজন। বৃষ্টির মাঝে বিরাণী, গোশত, ইলিশ পাক হচ্ছে, আর বাকী সাথীরা একটা জায়গায় কোন মতে বিছানাগুলো জমা করে খাবারের অপেক্ষায় বসে আছে। মাঠের সর্বত্র একই চিত্র। আফসোস করলাম। মাত্র কয়েকটা দিন সাদাসিধে খেয়ে কি কাটানো যায় না? যেন সবাই আয়েসি খাওয়া-দাওয়ার উদ্দেশ্যে এখানে জমা হয়েছে।
হুজুর আরও বললেন,
চারিয়া ইজতিমা মাঠে খুব দোয়া করেছি। হে আল্লাহ! মক্কা-মদীনায় যাওয়া মার্কেটিং-এ পরিণত হয়েছে, মাদ্রাসার সভাগুলোও বাজারে পরিণত হয়েছে, তাবলীগের ইজতিমাগুলোও কি তবে মেলা হয়ে যাবে? হে মাওলা! তুমি তা করো না!
কী আশ্চর্য! মানুষ হাটহাজারী মাদ্রাসার সভা থেকে এক কেজি বরই নিয়ে এসে বলে, সভার বরকত নিয়ে এলাম। ইজতিমার মাঠ থেকে কম্বল নিয়ে ফিরে। কি নিয়ে ফেরার কথা ছিলো, তার বদলে কী!”
কথা প্রসংগে হজরত শুনালেন কিছু হৃদয়গ্রাহী কারগুজারী। আপনারা সেগুলো হজরতের জবানেই শুনুন।
” একবার পটিয়ার শাহমীরপুরে তিনদিনের জামাত নিয়ে গেলাম। মসজিদে ঢুকার অনুমতি মিললো না। আমরা মসজিদের বাইরে বিছানা রাখলাম।
শাহমীরপুর বাজারে এলান হয়েছে আমাদের কাছে যেন কেউ কোন কিছু বিক্রি না করে। ফলে রান্নার জন্য কিছুই কেনা গেলো না। আমরা নিজেদের সাথে চাল নিয়ে গিয়েছিলাম। এরশাদ ভাই ( ইনি সেই এরশাদ ভাই যিনি মাওলানা ইনায়মুল হাসান রহঃ এর সাথে প্রতিযোগিতা করতেন, কে আগে হজরতজী ইউসুফ রহঃ এর জন্য পান রেডি করবেন, চট্টগ্রামে তাবলীগের ইতিহাসে এক কিংবদন্তী ছিলেন তিনি) মসজিদের আঙিনায় দস্তরখান বিছালেন। প্লেটে শুধু সাদা ভাত। আম গাছ থেকে পাতাসহ কিছু ডাল ছিঁড়ে ধুয়ে দস্তরখানে রাখলেন। আমরা আমপাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভাত দিয়ে খেতে লাগলাম। কি বলবো! এখনও যেন জিহ্বায় লেগে রয়েছে সেই খাবারের স্বাদ।
আর একবার চিল্লার জামাতে আমরা কাঁচামরিচ দিয়ে লাউ পাকালাম। আমাদের রান্নার সুগন্ধ পুরো পাড়া ছড়িয়ে পড়লো। এলাকার লোকজন ভিড় করতে লাগলো। এই সামান্য তরকারীর এমন সুগন্ধে তারা হতবাক। বললো, আপনাদের তরকারিটা আমাদের দিয়ে দেন। আপনাদের জন্য আমরা ব্যবস্থা করবো। আমাদের তরকারির বরকত তারা নিতে চাইলো। এক লাউয়ের সুগন্ধই তাদের প্রভাবিত করলো। দাওয়াতের কাজের আজমত তাদের অন্তরে আসন নিয়ে নিলো।
হজরত বললেন, আজ তো আমরা বিরিয়ানী পাকিয়ে মানুষ জমা করতে চাই। বিরিয়ানী খাইয়ে তাবলীগে লাগাতে চাই। কিন্তু লাউয়ের ছড়িয়ে পড়া সেই সুগন্ধের মুকাবিলায় রসনাপূজারী বিরিয়ানী কতটুকু কার্যকরী হবে। আজ সাথীরা গাশতের চেয়েও জড়ো করে বিরিয়ানী খাওয়ানোকে বেশি গুরুত্ব দেয়। আগের সেই মুজাহাদা কোথায় হারিয়ে গেলো!”
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
এক বটবৃক্ষের ছায়ায়
( মাসিক নেয়ামত, শাইখুল ইসলাম সংখ্যা, রজব-শাবান ১৪৪২ হিজরী, মার্চ ২০২১ এ প্রকাশিত) ২০০৬ সালের এক সকাল...

মাওলানা ডাঃ মোহাম্মদ মাসীহ উল্লাহ
১০ নভেম্বর, ২০২৪

১৬২২