প্রবন্ধ

নিজের দোষ নিজে খুঁজি, নিজের খুঁত নিজে দেখি

লেখক:মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
১৫ জুলাই, ২০২৫
২২৭০০ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

আজকাল আমাদের মধ্যে যখন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু আমাদের সমালোচনা করে, আমরা সেটা একদম সহ্য করতে পারি না। শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, আলেম হোক বা মুফতি—নিজের মত থেকে ভিন্ন মত কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। আর এ কারণেই আমাদের ইসলাহ বা সংশোধন অনেক সময় বাধাগ্রস্ত হয়।
মনে রাখবেন, যাদের দোষ-ত্রুটি কেউ বলবে না, তাদের জন্য বিপদ অপেক্ষা করে থাকে। জানা নেই, শয়তান কীভাবে তাদের ধ্বংস করে ফেলতে পারে। আমাদের আকাবির-আসলাফ শত্রুদের এমন সমালোচনাকে মিষ্টান্নের মতো গ্রহণ করতেন এবং নিজের সংশোধনের সুযোগ হিসেবে তা ব্যবহার করতেন।
তাদের এ প্রাণবন্ত দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকেও গ্রহণ করা উচিত। শত্রুর সমালোচনাকে হাসিমুখে গ্রহণ করে তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। কারণ, এটা হল নিজেকে সংশোধন করার এবং আত্মিক উন্নতির অন্যতম পথ।




اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ. بَلِ الْإِنسَانُ عَلَىٰ نَفْسِهِ بَصِيرَةٌ
بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيْمِ، وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ اْلآيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيْمِ. وجَعَلَنِيْ إِيَّاكُمْ مِنَ الصَّالِحِينَ. أَقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا أَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِيْنَ. فَاسْتَغْفِرُوْهُ، إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ.اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ.

হামদ ও সালাতের পর!
আল্লাহ তাআলা বলেছেন

بَلِ الْإِنسَانُ عَلَىٰ نَفْسِهِ بَصِيرَةٌ

বরং মানুষ নিজেই তার নিজের সম্পর্কে চক্ষুমান। [ সূরা কিয়ামাহ : ১৪]

মানুষ নিজের দোষ কখন দেখে?
আল্লাহ তাআলা যখন কোনো বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তখন তিনি তাকে তার ভুলগুলো ধরিয়ে দেন, তার ত্রুটিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। ফলে সে নিজের সংশোধনের পথ খুঁজে পায়। কিন্তু যাকে তিনি অপছন্দ করেন, তাকে তার দোষত্রুটি সম্পর্কে বেখবর করে দেন। সে ভাবে, আমি তো ঠিক আছি!— নিজের মধ্যে কোনো ভুলই দেখতে পায় না।
ডাক্তাররা বলেন, সবচেয়ে ভয়ংকর রোগ সেটাই, যা রোগী রোগ বলে মানে না। কারণ, যে বুঝেই না সে অসুস্থ, সে কখনো চিকিৎসার প্রয়োজনও অনুভব করে না। কিন্তু যখন উপলব্ধি আসে, তখন আর কিছু করার সময় থাকে না।
এভাবেই অনেক মানুষ নিজেদের ভুল বুঝতে পারে না। কখনো আল্লাহ বান্দার চোখে এমন পর্দা টেনে দেন যে, সে নিজের হাতেই নিজের সর্বনাশ করে, অথচ তা বুঝতে পারে না। সে দেখে, শুনে, জানে-তবু উপলব্ধি করে না। বরং নিজের মন্দ কাজকে ভালো মনে করে এবং ভাবে, সে তো সঠিক পথেই আছে!

নিজের স্ত্রীর সঙ্গে যিনাকারী
যেমন, কেয়ামতের আলামতের মধ্যে একটি হলো, যিনা-ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়বে। কীভাবে? মানুষ তালাক দেবে, কিন্তু তা নিয়ে কোনো চিন্তাই করবে না। আবার তালাক দেওয়ার পরও স্বামী-স্ত্রী আগের মতোই একসঙ্গে বসবাস করতে থাকবে, শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হবে, অথচ তারা হারাম সম্পর্কেই জড়িয়ে পড়ছে।
ইসলামের বিধান অনুযায়ী, যখন তালাক সম্পূর্ণ হয়ে যায়, তখন স্ত্রী স্বামীর জন্য হারাম হয়ে যায়। কিন্তু অনেকেই না জেনে কিংবা জেনে-শুনেও এই ভুল করে।
কেউ হয়তো রাগের মাথায় তালাক দিয়ে ফেলে, পরে ভাবে, আমি তো রাগে বলেছিলাম, তালাক কি সত্যিই হয়ে গেছে? অথচ তালাক সবসময়ই রাগের সময় হয়, কারণ খুশিতে কেউ তালাক দেয় না!
আবার কেউ বলে, আমি তালাক বলেছি ঠিকই, কিন্তু ইচ্ছে ছিল না! ভাই, কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলে সেটা রেকর্ড হয়ে গেছে। এখন তুমি কী চেয়েছিলে, সেটা নয়, বরং শরীয়তের বিধানই চূড়ান্ত।

আরেকটি ভয়ংকর সমস্যা
অনেকে না জেনে কিংবা অবহেলায় এমন কথা বলে ফেলে, যা তার ঈমান নষ্ট করে দেয়। অথচ সে তা বুঝতেও পারে না। তার বিয়ে বাতিল হয়ে যায়, কিন্তু সে স্ত্রীসহ আগের মতোই বসবাস করতে থাকে। এতে দুটি ভয়ংকর গুনাহ হয়—একটি হলো কুফর, আরেকটি হলো যিনা। অথচ সে ভাবে, সব ঠিক আছে!
একটি সাধারণ ভুল হলো, মানুষ মনে করে, কেবল নামায না পড়লেই গুনাহ হয়, কিন্তু কুফরি কথা বলা বা ইসলাম নিয়ে উপহাস করাও ঈমান নষ্ট করে দিতে পারে। অনেকেই বলে ফেলে এমন সব কথা, যা তার ইসলাম থেকে বের করে দেয়। যেমন—

আল্লাহ সম্পর্কে অবমাননাকর কথা
‘এত নামাজ-রোজা করে কী হবে? আল্লাহ কি এসে খাইয়ে দেবেন?’
‘আমার কপালে যা আছে, তাই হবে, নামাজ-রোজা করে কী লাভ?’
‘আল্লাহ যদি ন্যায়বান হতেন, তাহলে সবাইকে ধনী বানাতেন!’

ইসলামের বিধান নিয়ে বিদ্রূপ
‘এই সব হিজাব-নিকাব পুরনো যুগের নিয়ম, এখন এগুলো মানার দরকার নেই।’
‘জুমার নামাজ না পড়লে কী হবে? মুসলমানই তো আছি!’
‘এই শরীয়ত এত কঠিন কেন? সহজ হওয়া উচিত!’

কুরআন-হাদিসকে অবমাননা
‘কুরআন-কিতাবের কথা বাদ দাও, বাস্তবতা বোঝো!’
‘আল্লাহ যা বলেছে, সবকিছু কি এখনকার যুগে চলে?’

কুফরি শপথ ও বক্তব্য
‘আমি যদি মিথ্যা বলি, তবে মুসলমান না!’
‘আমার যা ইচ্ছা, তাই করব—আল্লাহ আমার কিছু করতে পারবে না!’
‘আমি যা বলছি, যদি ভুল হয়, তবে কেয়ামতে আমার কোনো হিসাব নেই!’

কুফর করলে বিয়ে ভেঙে যায়
এসব কথার মাধ্যমে মানুষ নিজের অজান্তেই ঈমান হারিয়ে ফেলে। কুফর করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায় এবং বিয়ে ভেঙে যায়। তাই যদি কেউ ভুলবশত এমন কিছু বলে ফেলে, তবে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে তওবা করতে হবে, নতুন করে কালিমা পড়তে হবে এবং বিবাহ পুনরায় করতে হবে। অন্যথায়, সে নিজের অজান্তেই হারাম সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে যাবে, যা মহা অপরাধ।
আমাদের উচিত নিজের মুখের কথার ব্যাপারে সতর্ক থাকা, যেন ভুল করে হলেও ঈমানহানির পথে না যাই।

নিজের কথার ব্যাপারে উদাসীনতা
কিন্তু বর্তমানে মানুষের মধ্যে উদাসীনতা এত প্রবল হয়ে গেছে যে, সে নিজের মুখ দিয়ে কী বলছে, তার হাত কী করছে— সেই বিষয়ে কোনো খেয়ালই রাখে না। এমনকি কখনো-কখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, সে যা বলছে বা করছে, তার ভালো-মন্দ সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকে না।
কেন এমনটা হয়? 

কারণ, আল্লাহ যার প্রতি অসন্তুষ্ট হন, তিনি তার দোষত্রুটিগুলো তার দৃষ্টির আড়াল করে দেন। ফলে সে নিজের ভুল দেখে না, কিন্তু অন্যের ভুল ধরতে সবসময় প্রস্তুত থাকে। সে নিজের ত্রুটিগুলো বুঝতে পারে না, অথচ অন্যের সামান্য ভুলও তার চোখে বড় হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে, আল্লাহ যখন কোনো বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তখন তিনি তাকে তার ভুলগুলো চিনিয়ে দেন, যাতে সে নিজেকে সংশোধন করতে পারে। এভাবেই সে নিজের ভুল স্বীকার করে, তওবা করে এবং ধীরে ধীরে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে ওঠে।
ইমাম গাজালী রহ. বলেন

إِعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ إِذَا أَرَادَ بِعَبْدٍ خَيْرًا بَصَّرَهُ بِعُيُوبِ نَفْسِهِ

জেনে রাখো, যখন আল্লাহ কোনো বান্দার জন্য কল্যাণ চান, তখন তিনি তাকে তার নিজের ভুল-ত্রুটি স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেন।

فَمَنْ كَانَتْ بَصِيرَتُهُ نَافِذَةً لَمْ تَخْفَ عَلَيْهِ عُيُوبُهُ فَإِذَا عَرَفَ الْعُيُوبَ أَمْكَنَهُ الْعِلَاجُ
যার দৃষ্টি প্রখর, সে নিজের খুঁত বুঝতে পারে, আর যখন ত্রুটি ধরা পড়ে, তখন তা সংশোধন করাও সহজ হয়।
وَلَكِنَّ أَكْثَرَ الْخَلْقِ جَاهِلُونَ بِعُيُوبِ أَنْفُسِهِمْ، يَرَى أَحَدُهُمُ الْقَذَى فِي عَيْنِ أَخِيهِ وَلَا يَرَى الْجِذْعَ فِي عَيْنِ نَفْسِهِ

কিন্তু দুঃখের বিষয়, অধিকাংশ মানুষ নিজেদের ভুল সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। তারা অন্যের চোখে সামান্য ধুলোকণাও দেখতে পায়, কিন্তু নিজের চোখে থাকা বিশাল গাছের গুঁড়িটিও দেখতে পারে না। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন : ৭/৩৪৮]

নিজের দোষ-ত্রুটি চেনার চার উপায়
গাছ যেমন নিজের ফলের ওজন টের পায় না, ঠিক তেমনই মানুষও নিজের দোষ ত্রুটি সহজে বুঝতে পারে না। তবে যখন কেউ আমাদের ভুল ধরিয়ে দেয়, তখনই আমরা তা সংশোধনের সুযোগ পাই।
ইমাম গাজালী রহ. বলেন, নিজের দোষ-ত্রুটি চেনার চারটি উপায় আছে।

১. শায়খের সান্নিধ্য
তার মধ্যে প্রথমটি হলো এমন এক শায়খের সান্নিধ্যে থাকা, যিনি নফসের ত্রুটি ও আত্মার গোপন রোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান রাখেন।
শায়খ মূলত আয়নার মতো। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ

মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ। [আবু দাউদ : ৪৯১৮]
যেভাবে আয়নায় নিজের চেহারা স্পষ্টভাবে দেখা যায়, তেমনি একজন কামিল শায়খের সান্নিধ্যে গেলে, তার দিকনির্দেশনায় আমাদের আত্মার কালিমা প্রকাশ পেতে শুরু করে। তিনি ভুল ধরিয়ে দেন, বোঝান, কখনো শাসনও করেন, যেন আমরা নিজেকে সংশোধন করতে পারি। যারা শায়খের কাছে নিজেদের আত্মশুদ্ধির জন্য সময় দেয়, তারা নিজেদের দোষ-ত্রুটি চিনতে পারে, নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং তা ঠিক করার সুযোগ পায়।
হিমসের গভর্নর সাঈদ ইবনু আমির আল-জুমাহী রাযি.
একজন কামিল শায়খ বা পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক শিক্ষক কেমন হন, তা বোঝার জন্য হযরত উমর রাযি.-এর একটি ঘটনা খুবই শিক্ষণীয়। উমর রাযি. ছিলেন সমগ্র মুসলিম উম্মাহর আমীরুল মুমিনীন তথা মুমিনদের শায়খ। তিনি তাঁর অধীনস্থ গভর্নরদের কাজকর্মের রিপোর্ট নিতেন এবং জনগণের কাছ থেকে সরাসরি তাদের সম্পর্কে জানতে চাইতেন। তিনি বলতেন, ‘বলো তো, যাকে আমি গভর্নর নিযুক্ত করেছি, সে কেমন লোক?’
একবার হযরত উমর রাযি. হিমস শহরে গেলেন এবং সেখানকার গভর্নর সাঈদ ইবনে আমির আল-জুমাহী রাযি. সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তখন জনগণ তাঁর কাছে গভর্নর সম্পর্কে চারটি অভিযোগ করল।
১. তিনি সকালে দেরি করে বের হন।
২. তিনি রাতে কারো ডাকে সাড়া দেন না।
৩. মাসে একদিন তিনি আমাদের কাছে আসেন না।
৪. তিনি মাঝে মাঝে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন—মূর্ছা যান।
উমর রাযি. চিন্তিত হয়ে সাঈদ রাযি.-কে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমার সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণ করো না! বলো, এসব অভিযোগ সত্যি কি না?’
সাঈদ রাযি. মাথা নিচু করে বললেন, ‘আমার পরিবারের জন্য কোনো চাকর নেই। সকালে রুটি আমিই বানাই, তারপর ওজু করে বের হই। তাই একটু দেরি হয়ে যায়।’
উমর রাযি. বললেন, ‘তাহলে রাতের সময় নিয়ে কী বলবে?’
সাঈদ রাযি. বললেন, ‘আমি দিনটাকে মানুষের জন্য রেখেছি, আর রাতটাকে আল্লাহর জন্য। তাই রাতে কারও ডাকে সাড়া দিতে পারি না।’
উমর রাযি. এবার তৃতীয় অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলেন।
সাঈদ রাযি. বললেন, ‘আমার একটিই কাপড়। মাসে একদিন সেটা ধুতে হয়, আর শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অতিরিক্ত কাপড় না থাকায় ওই দিন বাইরে বের হতে পারি না।’
শেষ অভিযোগ সম্পর্কে উমর রাযি. জানতে চাইলে সাঈদ রাযি. চোখে অশ্রু নিয়ে বললেন, ‘আমি খুবাইব রাযি.-এর নির্মম শাহাদাতের সাক্ষী ছিলাম। কুরাইশরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মৃত্যুর মুহূর্তেও তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল

أَتُحِبُّ أَنْ مُحَمَّدًا مَكَانَكَ؟

‘তুমি কি চাও, মুহাম্মদ ﷺ তোমার জায়গায় থাকুন?’
তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন

وَاللَّهِ مَا أُحِبُّ أَنِّي فِي أَهْلِي وَوَلَدِي وَأَنَّ مُحَمَّدًا ﷺ شِيكٌ بِشَوْكَةٍ

‘আল্লাহর কসম! আমি তো এটাও চাই না যে, আমি আমার পরিবার ও সন্তানদের মাঝে নিরাপদে থাকি, আর মুহাম্মাদ ﷺ কাঁটার আঘাতেও কষ্ট পান।’
আমি তখন কিছুই করতে পারিনি! এখন যখন সেই মুহূর্ত স্মরণ করি, ভাবি—আল্লাহ কি আমাকে ক্ষমা করবেন? এই চিন্তায় আমি মূর্ছা যাই।’
উমর রাযি. তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। গভীর আবেগে বললেন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমার সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণ করেননি!’
এরপর তিনি সাঈদ রাযি.-কে এক হাজার দিনার উপহার দিলেন এবং বললেন, ‘এটা নিয়ে তোমার প্রয়োজন মেটাও।’
সাঈদের স্ত্রী আনন্দে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! এখন তো আমাদের অভাব ঘুচবে!’
কিন্তু সাঈদ রাযি. বললেন, ‘আমরা কি এর চেয়েও ভালো কিছু করতে পারিনা?’
স্ত্রী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে তুমি কী করছ?’
সাঈদ রাযি. একজন বিশ্বস্ত লোককে ডাকলেন এবং বললেন, ‘এই টাকা বিধবা, ইয়াতিম, অসহায় ও অসুস্থদের মধ্যে বিলিয়ে দাও।’
সব টাকা বিলিয়ে দেওয়ার পর স্ত্রী বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘আমাদের জন্য অন্তত একজন চাকর কিনতে পারতে!’
সাঈদ রাযি. মৃদু হেসে বললেন, ‘যদি আমাদের জন্য তা জরুরি হতো, তাহলে আল্লাহই তা রেখে দিতেন!’ [হিলয়াতুল আউলিয়া: ১/২৪৫,২৪৬]

শায়খ ছাড়া আত্মশুদ্ধি অসম্ভব
যা হোক, বলতে চেয়েছিলাম—মানুষ কখনোই নিজের চিকিৎসা নিজে করতে পারে না। যেমন জটিল রোগ হলে ডাক্তার প্রয়োজন হয়, তেমনই আত্মার রোগ হলে একজন শায়খ বা মুরশিদের প্রয়োজন হয়।
প্রবাদের মতোই—

ہر آں کار کہ بے استاد باشد

یقین دانی کہ بے بنیاد باشد

‘যে-কোনো কাজ যদি ওস্তাদের দীক্ষা ছাড়া হয়, তবে তা নির্ঘাত ভিত্তিহীন ও দুর্বল হবে।’
যদি কেউ নিজের চিকিৎসা নিজে করতে চায়, তাহলে সে ধোঁকার শিকার হবে। শয়তান তাকে সহজেই পথভ্রষ্ট করবে।

একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত
বিষয়টিকে বুঝাতে গিয়ে আমাদের শায়খ ও মুরশিদ মাহবুবুল ওলামা হযরত পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী দা. বা. দৃষ্টান্ত হিসেবে বলেন, একবার এক ব্যক্তির শিশুসন্তান অসুস্থ হয়ে গেল। তার পেট খারাপ হয়ে গেলো। স্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডেকে আনুন!’
কিন্তু লোকটি একটু গোড়া টাইপের ছিল। বলল, ‘ডাক্তার ডেকে আনার দরকার কী? আমি নিজেই গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসি।’
সে ভেবেছিল, পেট নরম হয়ে গেছে, তাহলে নিশ্চয়ই শক্ত করার ওষুধ দিলেই ঠিক হয়ে যাবে!
সে গেল ওষুধের দোকানে। বলল, ‘ভাই! পেট শক্ত করার ওষুধ দিন।’
দোকানদার কিছু না বুঝেই ওষুধ দিয়ে দিল। লোকটি সন্তুষ্ট মনে বাসায় ফিরে এসে বাচ্চাকে ওষুধ খাইয়ে দিল। কিন্তু তারপর যা ঘটল, তা ভয়াবহ! রোগ তো কমল না, বরং আরও বেড়ে গেল! দু'দিনের মধ্যে শিশুর অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গেল যে, সে প্রায় মৃত্যুর মুখে পতিত হলো।
এবার বেচারী মা আর অপেক্ষা না করে নিজেই ছুটে গিয়ে ডাক্তার নিয়ে এলেন।
ডাক্তার এসে আগের ওষুধ বন্ধ করে নতুন ওষুধ দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ, বাচ্চা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল!
ডাক্তার তখন মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই ভয়ংকর অবস্থায় বাচ্চাকে এমন ওষুধ কে খাওয়াতে বলল?’
মা জবাব দিলেন, ‘তার বাবা নিয়ে এসেছিল।’
ডাক্তার এবার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন,‘আপনি কীভাবে এই ওষুধ দিলেন?’
বাবা মাথা নিচু করে বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম, যেহেতু পেট নরম হয়ে গেছে, তাই শক্ত করার ওষুধ দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। তাই ওষুধের দোকানে গিয়ে পেট শক্ত করার ওষুধ চেয়েছি, যা দিয়েছে তাই খাইয়েছি।’
ডাক্তার রাগ নিয়ে বললেন, ‘আপনি কী করেছেন, জানেন? আমাদের ডাক্তারদের নির্দিষ্ট কিছু পরিভাষা আছে। যখন কেউ আমাদের বলে— পেট শক্ত করার ওষুধ দিন; আমরা বুঝি, তার হয়তো কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে। তখন আমরা তাকে পেট পরিষ্কার করার ওষুধ দিই। কিন্তু আপনার বাচ্চার আসলেই ডায়রিয়া ছিল, অথচ তাকে আরও বেশি পায়খানা করার ওষুধ খাইয়েছেন! বলুন তো, এই শিশু বাঁচবে, না মরবে?
লোকটি তখন বুঝতে পারল, সে নিজের ভুল চিকিৎসা করতে গিয়ে কী মারাত্মক ক্ষতি করতে বসেছিল!
ঠিক এভাবেই, যে ব্যক্তি নিজেই নিজের আত্মিক চিকিৎসা করার চেষ্টা করবে, তারও পরিণতি এমনই হবে।
যদি আত্মার রোগ থেকে মুক্তি পেতে হয়, তবে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ রূহানী চিকিৎসকের দরকার। আর সেই চিকিৎসকের নামই ‘শায়খ’ বা ‘মুরশিদ’।

যৌবন-তারুণ্যের সৌভাগ্য
এ কারণে তাবিয়ী আইয়ূব সাখতিয়ানী রহ. বলতেন

إِنَّ مِنْ سَعَادَةِ الحَدَثِ أن يوفقَه اللَّهُ لِعالِمٍ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ

যৌবন বা তারুণ্যের সৌভাগ্য হলো, আল্লাহ তাআলা কোনো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আলেমের সাহচর্য লাভের তাওফীক দেওয়া। [আততালবীস : ১৭]
অর্থাৎ, তরুণ বয়সে একজন সুন্নাহ অনুসরণকারী আলেমের সান্নিধ্য পাওয়া এবং তার জ্ঞান ও আদর্শ থেকে উপকৃত হওয়াটা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এটি যুবকদের জন্য বড় সৌভাগ্যের বিষয়, কারণ ভালো আলেমের সঙ্গ মানুষকে সঠিক পথে রাখে, ঈমান দৃঢ় করে, এবং ভুল পথ থেকে বাঁচায়।

শায়খের সান্নিধ্যের বরকত
শাহ ইসমাইল শহীদ রহ. একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন, পরিপূর্ণ খুশু ও খুজুর সঙ্গে দুই রাকআত নামাজ পড়বেন। তিনি নামাজে দাঁড়ালেন, কিন্তু যতই চেষ্টা করেন, মন ঠিক রাখতে পারেন না। নানা ধরনের খেয়াল এসে একাগ্রতা নষ্ট করে দিচ্ছিল।
তিনি ভাবলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না মনোযোগ ধরে রাখতে পারছি, ততক্ষণ নামাজ পড়তে থাকব। এভাবে একের পর এক রাকআত পড়তে পড়তে তিনি ১০০ রাকআত নামাজ আদায় করলেন! কিন্তু তবু সেই কাঙ্ক্ষিত একাগ্রতা পেলেন না।
তিনি পেরেশান হয়ে সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ.-এর দরবারে গিয়ে তার পুরো অবস্থা খুলে বললেন, ‘আমি এত নামাজ পড়েও দুই রাকআত একাগ্রতার সঙ্গে আদায় করতে পারলাম না! আমি খুবই চিন্তিত। দয়া করে আমাকে কোনো সমাধান দিন।’
সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ. বললেন, ‘আজ রাতে তাহাজ্জুদের সময় তুমি আমার পাশে দাঁড়াবে।’
ইসমাইল শহীদ রহ. শায়খের নির্দেশ মতো তাহাজ্জুদের সময় তার পাশে দাঁড়ালেন।
প্রথম রাকআত শুরু হতেই তার ভেতর এক বিস্ময়কর পরিবর্তন অনুভূত হলো। তার হৃদয় কেঁপে উঠল, কান্নায় বুক ভেসে যেতে লাগল! নামাজ শেষে তিনি উপলব্ধি করলেন, এই তো সেই একাগ্রতা, যেটার জন্য তিনি এত পরিশ্রম করেছেন!
নিজে একশ’ রাকআত নামাজ পড়েও যে খুশু-খুজু অর্জন করতে পারেননি, শায়খের সোহবতে মাত্র দুই রাকআতেই তা পেয়ে গেলেন! এটাই শায়খের সংস্পর্শের বরকত, এটাই সোহবতের প্রভাব!

আল্লাহওয়ালাদের সোহবতের প্রভাব
মুফতী মুহাম্মাদ হাসান রহ. ছিলেন হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর অন্যতম খলিফা। তিনি বলেন, আমরা যখন হযরত থানভী রহ.-এর দরবারে বসতাম, তখন প্রত্যেকেই নিজেকে সবার চেয়ে ছোট মনে করত।
একবার আমার মনে এই অনুভূতি তীব্রভাবে জাগল, তাই আমি মাওলানা খায়ের মুহাম্মদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করলাম। তিনিও থানভী রহ.-এর খলিফাদের একজন ছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ভাই, হযরতের দরবারে যতক্ষণ থাকি, ততক্ষণ মনে হয়, আমি সবার চেয়ে নীচু, আমার জাহির ও বাতেন একরকম নয়। মনে হয়, অন্যরা সবাই আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে আছেন, আর আমি সবার থেকে পিছিয়ে আছি।
আমার কথা শুনে মাওলানা খায়ের মুহাম্মদ বললেন, আমারও তো একই অনুভূতি হয়! এই দরবারের অন্যদের দিকে তাকালে নিজেকে খুব তুচ্ছ ও গুনাহগার মনে হয়। তাহলে এক কাজ করি, দু’জনই হযরতের কাছে যাই এবং জিজ্ঞেস করি, এটা ভালো না মন্দ?
আমরা দু'জনই থানভী রহ.-এর কাছে গিয়ে সব খুলে বললাম। হযরত আমাদের কথা শুনে আশ্চর্যজনক এক উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, আসল কথা হলো, আমিও নিজেকে সবার চেয়ে ছোট মনে করি! মনে হয়, যেন আমি সবার চেয়ে বড় গুনাহগার!
সুবহানাল্লাহ! প্রকৃত আল্লাহওয়ালা তো এমনই হন—তারা যত বড় হন, ততই নিজেদের ছোট মনে করেন! আর এটাই আল্লাহওয়ালাদের সোহবতের প্রভাব। তাদের সান্নিধ্যে গেলে নিজের দোষ-ত্রুটি চোখে পড়ে, আত্মগরিমা দূর হয়। তখন নিজেকে সবার চেয়ে ছোট মনে হয়, আর অন্তরে সংশোধনের তীব্র আগ্রহ জাগে। ফলে সে ক্রমাগত আত্মসংশোধনের পথে এগিয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের আল্লাহওয়ালাদের সোহবত বেশি বেশি গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন—আমীন।

২. নেককার লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব
নিজের ভুল নিজে খুঁজে বের করা সহজ নয়। তাই নিজের ভুল খুঁজে বের করার দ্বিতীয় উপায় হলো— সৎ, বিচক্ষণ ও ধর্মপ্রাণ বন্ধু খুঁজে নেওয়া, যিনি আমাদের আচরণ ও অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করবেন এবং ভুলগুলো স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেবেন। কেননা, একজন সত্যিকারের নেককার বন্ধু কখনো তোষামোদ করবে না। বরং প্রয়োজন হলে বলবে, ‘ভাই, এটা এভাবে করবেন না, বরং এইভাবে করুন। এই অভ্যাস আপনার জন্য ভালো নয়, বরং এটা গ্রহণ করুন।’
এমন বন্ধুত্ব আমাদের জন্য নিরাপত্তার মতো। কারণ, তারা আমাদের খারাপ কাজ করতে দেবে না, ভুল পথে যেতে দেখলে সতর্ক করবে। এজন্যই নেককার লোকদের সঙ্গ গ্রহণ করা জরুরি, যেন আমরা সৎ পরিবেশে নিজেদের ঠিক রাখতে পারি।

ভালো বন্ধু খুঁজুন, যে জান্নাতে আপনাকে খুঁজবে!
ভালো বন্ধু কেমন হওয়া উচিত, তা দেখুন—তাবেয়ী হাসান বসরী রহ. একটি হৃদয়স্পর্শী ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এক ব্যক্তি জাহান্নামে চলে যাবে, অথচ দুনিয়ায় তার এক ভালো বন্ধু ছিল, যে জান্নাত লাভ করবে। সেই জান্নাতী বন্ধু জান্নাতে গিয়ে স্মৃতিচারণ করবে, পুরোনো দিনের কথা ভাববে, তখন হঠাৎ তার মনে পড়বে। সে ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করবে

مَا فَعَلَ صَدِيقِي فُلانٌ؟

‘আমি তো জান্নাতে আছি, কিন্তু আমার বন্ধু কোথায়? আমি তো তাকে এখানে দেখতে পাচ্ছি না!’
ফেরেশতারা বলবে, ‘সে তো জাহান্নামে!’
এ কথা শুনে সেই জান্নাতী বন্ধু কষ্টে ভারাক্রান্ত হয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করবে—‘হে আমার রব! আমি জান্নাতে এসেছি ঠিকই, কিন্তু আমার আনন্দ অপূর্ণ রয়ে গেছে। আমার সেই বন্ধুকে ছাড়া জান্নাতের সুখ উপভোগ করতে পারছি না!’
এবার বলুন, জান্নাতে কারো কোনো চাওয়া অপূর্ণ থাকবে? কখনো না! কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন

وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ

সেখানে তোমাদের যা ইচ্ছে করবে, তাই পাবে; যা চাইবে, তা-ই দেওয়া হবে। [সূরা হা-মীম সাজদা: ৩১]
তাই আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের আদেশ দেবেন, ‘তাড়াতাড়ি তার বন্ধুকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনো!’
দেখুন, এই ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেল না তার রাতভর ইবাদতের কারণে, না কুরআন তেলাওয়াতের কারণে, না সাদকা বা রোজার কারণে! বরং সে মুক্তি পেল একমাত্র তার জান্নাতী বন্ধুর ভালোবাসার উসিলায়!
এ ঘটনা দেখে জাহান্নামের অন্যান্য লোকেরা হতবাক হয়ে প্রশ্ন করতে থাকবে— ‘একে কী কারণে মুক্তি দেওয়া হলো? তার বাবা কি শহীদ ছিলেন? তার ভাই কি শহীদ ছিলেন? কোনো ফেরেশতা বা নবী কি তার জন্য সুপারিশ করেছেন?’
জাহান্নামীরা নানা প্রশ্ন করবে। কারণ, কোনো সুপারিশ ছাড়াই একজন জাহান্নামী মুক্তি পেয়ে গেল!
কিন্তু উত্তর আসবে— ‘না! বরং তার জান্নাতী বন্ধু তাকে স্মরণ করেছে, তাকে খুঁজেছে, আর আল্লাহ তার সেই জান্নাতী বান্দার আবদার কবুল করেছেন।’
এ কথা শুনে জাহান্নামীরা আফসোস করতে থাকবে

فَمَا لَنَا مِن شَافِعِينَ وَلَا صَدِيقٍ حَمِيمٍ

হায়! আমাদের তো কোনো সুপারিশকারী নেই! আমাদের জন্য তো কোনো ভালো বন্ধু নেই! [m~iv ï'Aviv: 100-101, তাফসীরে বগভি : ৩৭১]
ভালো বন্ধু কেন দরকার?
তাই বন্ধুত্ব কার সঙ্গে করছেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ! যাকে তাকে বন্ধু বানাবেন না। ভালো মানুষের সঙ্গে থাকুন, ভালো মানুষকে ভালোবাসুন, যেন সে জান্নাতে গিয়েও আপনাকে খোঁজে! আপনি যদি বেশি আমল করতে নাও পারেন, তবুও নেককারদের ভালোবাসুন, তাদের সঙ্গ নিন। তাহলে হয়তো আল্লাহ তাআলা আপনাকেও তাদের সঙ্গে রাখবেন।

أُحِبُّ الصَّالِحِينَ وَلَسْتُ مِنْهُمْ

لَعَلِّي أَنْ أَنَالَ بِهِمْ شَفَاعَـــــة

لَعَلَّ اللهَ يَرْزُقُنِي صَلَاحًا

‘আমি নেককারদের ভালোবাসি, যদিও আমি তাদের মতো নই,
তবুও আশায় থাকি যেন তাদের সুপারিশ পেয়ে যাই।’
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

المَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ

মানুষ তার প্রিয়জনের সঙ্গেই হাশরের দিন থাকবে। [সহীহ বুখারী : ৬১৬৯]
সুতরাং, ভালো বন্ধুত্ব শুধু দুনিয়ার সম্পদ নয়, আখিরাতেরও পাথেয়। ভালো মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখুন, তাদের ভালোবাসুন। তাহলে তাদের উসিলায় আপনি আল্লাহর রহমত পাবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

সংশোধনের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত
যদি কোনো সৎ, বিচক্ষণ ও ধর্মপ্রাণ বন্ধু আমাদের ভুল ধরিয়ে দেয়, তাহলে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা উচিত নয়। বরং তাকে হিতাকাঙ্ক্ষী মনে করতে হবে। কেননা, যে আমাদের ভুলগুলো জানিয়ে দেয়, সে আসলে আমাদের উপকারই করে।
হযরত উমর রাযি. বলতেন

رَحِمَ اللَّهُ امْرَأً أَهْدَى إِلَيَّ عُيُوبِي

আল্লাহ তাকে রহম করুন, যে ব্যক্তি আমাকে আমার দোষ জানিয়ে দেয়! [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন : ৭/৩৪৮]

আমিও সেদিন থেকে আর মদ পান করি না
একদিন উমর রাযি. একটি বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাড়ির জানালা দিয়ে তাকালেন। তিনি এটি করতেন শুধুমাত্র মানুষকে খারাপ কাজ থেকে নিষেধ বা ভালো কাজের উপদেশ দানের জন্য।
তিনি দেখলেন যে, একজন মুসলিম মদ পান করছে। তিনি দ্রুত তার বাসায় প্রবেশ করলেন এবং তাকে বললেন যে, তুমি তো হারাম কাজ করছো। তখন ওই লোকটি উমর রাযি.-কে বললো

وأنت يا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ فَلَا تَعْجَلْ، فَإِنِّي إِنْ كُنْتُ عَصَيْتُ اللَّهَ فِي وَاحِدَةٍ فَإِنَّكَ قَدْ عَصَيْتَ اللَّهَ فِي ثَلَاثٍ 

আমীরুল মুমিনীন! আমার বিষয়ে এত তাড়াহুড়ো করবেন না। কেননা আপনি কী কাজ করলেন! আমি একটি হারাম করছি আর আপনি তো তিনটি হারাম কাজ করলেন।

قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: (وَلَا تَجَسَّسُوا) وَقَدْ تَجَسَّسْتَ

এক. আপনি গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন। অথচ আল্লাহ বলেছেন, তোমরা গুপ্তচরবৃত্তি করো না।

وَقَالَ اللَّهُ تَعَالَى: (وَلَيْسَ الْبِرُّ أَنْ تَأْتُوا الْبُيُوتَ مِنْ ظُهُورِهَا) وَقَدْ تَسَوَّرْتَ عَلَيَّ.

দুই. আপনি দেয়াল বেয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেছেন। অথচ আল্লাহ বলেছেন, তোমরা গৃহসমূহে তার দরজা দিয়ে প্রবেশ কর।

وَقَالَ تَعَالَى: (لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَى أَهْلِهَا). وَقَدْ دَخَلْتَ بَيْتِي بِغَيْرِ إِذْنٍ وَلَا سَلَامٍ

তিন. আপনি অনুমতি না নিয়ে এবং সালাম না দিয়ে অন্যের বাড়িতে প্রবেশ করেছেন। অথচ আল্লাহ বলেছেন, তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য কারও গৃহে গৃহবাসীদের অনুমতি না নিয়ে এবং তাদেরকে সালাম না করে প্রবেশ করো না।
তখন উমর রাযি. বললেন যে, তুমি ঠিকই বলেছ। এ বলে উনি চলে গেলেন।
এর কিছুদিন পর উমর রাযি. মসজিদে খুতবা দিচ্ছিলেন সেই সময়ে ওই লোক মসজিদে প্রবেশ করে পেছনে বসলো। খুতবা শেষ করে উমর রাযি. ওই লোকের কাছে গেলেন গিয়ে চারপাশে তাকিয়ে চুপচুপে বললেন যে, দেখ! সেদিনের পর আমি আর কারো বাড়ির জানালার দিকে তাকাই না। আর আমি তোমার ওই ঘটনাকে কারো কাছে বলি নি।
তখন ওই লোক বললো যে, আমিও সেদিন থেকে আর মদ পান করি না। [মাকারিমুল আখলাক : ৪১৯]

উমর রাযি.-এর অভ্যাস
উমর রাযি. নিজের ভুলত্রুটি নিজেই জানতে চাইতেন এবং তা সংশোধন করতেন।
একবার সালমান ফারসি রাযি. তার কাছে এলে উমর রাযি. সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার সম্পর্কে এমন কী শুনেছেন, যা আপনার অপছন্দ হয়েছে?’
সালমান রাযি. প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেন, বললেন, ‘আমি কিছু বলতে চাই না।’
কিন্তু উমর রাযি. জোর দিলে তিনি বললেন, ‘আমি শুনেছি, আপনি একই খাবারের সঙ্গে দুটি তরকারি খান এবং আপনার দুই সেট পোশাক আছে—একটি দিনের জন্য, আরেকটি রাতের জন্য।’
উমর রাযি. জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ ছাড়া আর কিছু?’
সালমান রাযি. বললেন, ‘না।’
উমর রাযি. তখন বললেন, ‘আমি এই দুটি বিষয় সংশোধন করেছি।’ [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন : ৭/৩৪৯]
এমনকি তিনি হুযাইফা রাযি.-কেও প্রশ্ন করতেন

أَنْتَ صَاحِبُ سِرِّ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فِي الْمُنَافِقِينَ ، فَهَلْ تَرَى عَلَيَّ شَيْئًا مِنْ آثَارِ النِّفَاقِ؟

‘আপনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাছ থেকে মুনাফিকদের গোপন তালিকা জেনেছেন, আমার মধ্যে কি কোনো মুনাফিকির লক্ষণ দেখেছেন?’ [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন : ৭/৩৪৯]
দেখুন, কত বড় মাপের মানুষ হয়েও তিনি নিজের ভুলত্রুটি জানতে চাইতেন! আমাদেরও কি এমন মানসিকতা গড়ে তোলা উচিত নয়?

ভালো বন্ধু, সংশোধনের অন্যতম সেরা মাধ্যম
এ কারণেই বলি, দীনদার ও সৎ লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করুন। এতে জীবনের নানা মোড়ে সংশোধনের সুযোগ পাওয়া যায়। পদে পদে সংশোধনের সুযোগ এনে দেয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

الْمَرْءُ عَلَى دِينِ خَلِيْلِهِ فَلْيَنْظُرُ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلْ

মানুষ তার বন্ধুর আদর্শের ওপর থাকে। তাই প্রত্যেকেরই উচিত সতর্কভাবে বিবেচনা করা যে, সে কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে। [তিরমিযী : ২৩৭৮] 
শায়খে কামেল বা বুজুর্গ ব্যক্তিদের সোহবত প্রতিদিন পাওয়া সহজ নয়। তাদের সঙ্গ লাভ হয় সামান্য সময়ের জন্য। তাহলে জীবনের বাকি সময় কীভাবে কাটবে? তাই আশেপাশের মুত্তাকী ও পরহেজগার ব্যক্তিদের বন্ধু করুন। আশেপাশে যদি মুত্তাকী-পরহেজগার বন্ধু থাকে, যদি তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করা যায় তবে তারা আপনাকে ভালো কাজে সহযোগিতা করবে, গুনাহ থেকে দূরে রাখবে, ভুলত্রুটি শুধরে নিতে সাহায্য করবে।
ভালো বন্ধুর হাত ধরলে পথও সহজ হয়। তাই এমন বন্ধু নির্বাচন করুন, যারা আপনাকে জান্নাতের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে!
নবীজী ﷺ-ও আমাদেরকে দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন যে, এভাবে দোয়া করবে

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ حُبَّكَ وَحُبَّ مَنْ يُحِبُّكَ ، وَحُبَّ عَمَلٍ يُقَرِّبُ إِلَى حُبِّكَ

হে আল্লাহ! আমি চাই আপনার প্রতি ভালোবাসা। আপনাকে যারা ভালোবাসেন তাদের ভালোবাসা এবং যে সব আমল আমাকে আপনার নিকট করবে সেসব আমলের ভালোবাসা। [তিরমিযী : ৩২৩৫] 

৩. শত্রুর সমালোচনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা
নিজের ভুল-দোষ-ত্রুটি জানার তৃতীয় উপায় হলো, শত্রুর কথাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা। কারণ, শত্রু যা বলে, তাতে হয়তো বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসা থাকতে পারে, কিন্তু কখনো তোষামোদ বা মিষ্টি প্রশংসা থাকে না। শত্রু আমাদের দুর্বলতা বা ভুলগুলো সরাসরি তুলে ধরে, যা আমাদের সংশোধনের সুযোগ এনে দেয়।
আমাদের আশেপাশে অনেক বন্ধু থাকে, যারা আমাদের ভালোবাসে এবং আমাদের দোষগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় না। তারা আমাদের ভুলগুলো এড়িয়ে যায় বা গোপন রাখে, তাদের উদ্দেশ্য আমাদের ভালো রাখা। কিন্তু শত্রু কখনো এটা করবে না। শত্রু আমাদের ভুলগুলো প্রকাশ্যে বলে, আর এতে যদি সত্য থাকে, তখন তা সংশোধনের এক বড় সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়।
সত্যি বলতে, একজন কঠোর সমালোচক অনেক সময় এমন কিছু বলে, যা আমাদের আত্মসংশোধনের পথ খুলে দেয়।
কিন্তু আমাদের স্বভাব হলো, শত্রুর কথাগুলো সহজে বিশ্বাস না করা। আমরা ভাবি— সে আমাদের ক্ষতি করার জন্য এসব বলছে। অথচ আমাদের আকাবির-আসলাফ কখনো শত্রুর কথাকে একেবারে উড়িয়ে দিতেন না। ইতিবাচক দৃষ্টিতে তারা শত্রু এবং হিংসুকদের কথা শুনতেন। এতে যদি কোনো সত্য থাকে, তাহলে তা গ্রহণ করে নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করতেন।

মালেক ইবনু দীনার রহ.
মালেক ইবনু দীনার রহ. একবার বলেছিলেন, এক বছর ধরে আমার মন বলছিল, আমার মাঝে ইখলাস আছে। কিন্তু প্রতিবারই আমি নিজেকে বলতাম, তোমার এই দাবী সঠিক নয়।
এরই মধ্যে এক দিনের ঘটনা। আমি বসরার একটি গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন শুনতে পেলাম, আমাকে উদ্দেশ্য করে এক মহিলা আরেক মহিলাকে বলছে, ‘যদি তোমরা রিয়াকারী দেখতে চাও, তাহলে মালেক ইবনু দীনার-এর দিকে তাকাও।’
এটা শোনার পর আমি খুশি হয়ে গেলাম। নিজের মনকে তিরস্কার করে বললাম, ‘দেখো, আল্লাহর এক নেক বান্দি তোমাকে কী নামে ডেকেছে!’
এর পর থেকেই তিনি বলতেন

مَن أَرَادَ أَنْ يَنظُرَ إِلَى رَجُلٍ مُرَاءٍ فَلْيَنظُرْ إِلَيَّ

যদি কেউ রিয়াকারী বা ভণ্ড দেখতে চায়, তাহলে আমাকে দেখো। [মাওয়ায়িয মালেক ইবন দীনার : ৬৮]


এছাড়া, তিনি আরো বলতেন

وَاللَّهِ لَوْ أَنَّكُمْ تَجِدُونَ لِلْعَاصِي رِيحًا لَمَا اسْتَطَاعَ أَحَدٌ مِنْكُمْ أَنْ يَجْلِسَ إِلَيَّ مِنْ خُبْثِ رِيحِي

আল্লাহর কসম! যদি তোমরা গুনাহগারের দুর্গন্ধ অনুভব করতে, তাহলে আমার গন্ধের কারণে তোমরা কেউ আমার কাছে বসতে পারতে না। [মাওয়ায়িয মালেক ইবন দীনার : ৬২] 
তাঁর এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি কখনোই সমালোচনাকে নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করতেন না। বরং, তিনি সেটাকে নিজের উন্নতির উপায় হিসেবে দেখতেন। এভাবে সমালোচনা বা খোলামেলা সমালোচকের কথা যদি আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখি, তাহলে তা আমাদের আত্মসমালোচনার পথ খুলে দিতে পারে।

উবাইদুল্লাহ ইবনুল হাসান আলআম্বরী রহ.
বড় মানুষ তো পরের কথা, আমাদের আকাবির-আসলাফ এমনকি একজন শিশুর সমালোচনাও কোন দৃষ্টিতে দেখতেন, তা আমরা একটি ঘটনা থেকে বুঝতে পারি।
উবাইদুল্লাহ ইবনুল হাসান আলআম্বরী রহ. ছিলেন তৎকালীন বসরার একজন প্রখ্যাত বুজুর্গ আলেম ও ফকীহ। তিনি ছিলেন একজন শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিস এবং এক সময় কাজীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। লোকজন তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা দেখাতো।
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আব্দুর রহমান ইবনুল মাহদী রহ. বলেন, তখন আমি ছোট ছিলাম এবং উবাইদুল্লাহ ইবনুল হাসান আলআম্বরীর ছাত্র ছিলাম। একদিন আমি তাঁর সঙ্গে এক জানাজায় অংশ নিলাম। তখন উস্তাদজীকে একটি মাসআলা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো, কিন্তু তিনি ভুল উত্তর দিলেন। আমি বললাম, ‘আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথ দেখাক, বিষয়টা মনে হয় এমন নয়, সঠিক উত্তর হল এভাবে’।
উবাইদুল্লাহ ইবনুল হাসান রহ. কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নিচু করে রইলেন। এরপর তিনি মাথা তুলে বললেন, ‘বৎস! তুমিই ঠিক বলেছ। কাজেই আমি নম্রতার সঙ্গে আমার মত থেকে ফিরে আসলাম।’
তারপর তিনি বলেন

لَأَنْ أَكُونَ ذَنَبًا فِي الْحَقِّ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَكُونَ رَأْسًا فِي الْبَاطِلِ

হক ও সত্যের একজন সাধারণ অধীনস্থ হয়ে থাকা আমার নিকট অধিক প্রিয়, মিথ্যা ও বাতিলের সরদার হওয়ার চেয়ে। [হিলয়াতুল আউলিয়া : ৯/৬; তাহযীবুত তাহযীব : ৭/৭]

রশীদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ.
একবার ফকীহুননাফস মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ.-এর কাছে একটি কিতাব পৌঁছায়, যা তার এক হিংসুক শত্রু লিখেছিল। তখন তাঁর দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তিনি তার ছাত্রকে বললেন, এটি আমাকে পড়ে শোনাও।
ছাত্রটি বলল, হযরত, এটি আপনার শত্রুর লেখা। এতে অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট কথা রয়েছে।
হযরত জবাব দিলেন, হ্যাঁ, আমি জানি। তবে তুমি পড়ো। হতে পারে, এর মধ্যে এমন কিছু কথা আছে যা বাস্তবে আমার মধ্যেও রয়েছে, আর আমি সেগুলো সংশোধন করতে চাই।

আমাদের অবস্থা
আজকাল আমাদের মধ্যে যখন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু আমাদের সমালোচনা করে, আমরা সেটা একদম সহ্য করতে পারি না। শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, আলেম হোক বা মুফতি—নিজের মত থেকে ভিন্ন মত কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। আর এ কারণেই আমাদের ইসলাহ বা সংশোধন অনেক সময় বাধাগ্রস্ত হয়।
মনে রাখবেন, যাদের দোষ-ত্রুটি কেউ বলবে না, তাদের জন্য বিপদ অপেক্ষা করে থাকে। জানা নেই, শয়তান কীভাবে তাদের ধ্বংস করে ফেলতে পারে। আমাদের আকাবির-আসলাফ শত্রুদের এমন সমালোচনাকে মিষ্টান্নের মতো গ্রহণ করতেন এবং নিজের সংশোধনের সুযোগ হিসেবে তা ব্যবহার করতেন।
তাদের এ প্রাণবন্ত দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকেও গ্রহণ করা উচিত। শত্রুর সমালোচনাকে হাসিমুখে গ্রহণ করে তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। কারণ, এটা হল নিজেকে সংশোধন করার এবং আত্মিক উন্নতির অন্যতম পথ।

ভালো মানুষের শত্রু থাকে কেন?
প্রাসঙ্গিক একটা বিষয় স্পষ্ট করছি। আমরা মাঝে মাঝে ভাবি, ভালো মানুষদের বিরুদ্ধে কেন এত হিংসা? তারা তো মানুষের উপকার করেন, তাহলে তাদের শত্রু কেন থাকবে?
এর আসল কারণ হতে পারে তাদের দোয়া। আমাদের শায়খ ও মুরশিদ মাহবুবুল ওলামা হযরত পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী দা. বা. বলেন, যখন তারা আল্লাহ তাআলার কাছে নামাজে এই দোয়া করেন

اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ

‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সরল পথ দেখান।’
তখন আল্লাহ তাআলা তাদের সোজা পথে চলার জন্য শত্রু তৈরি করেন। এই শত্রুরা তাদের ছোটখাটো ভুলগুলোও তিলকে তাল বানিয়ে তুলে ধরে, যাতে তারা ভুল পথে না চলে।
তারা মনে হতে পারে শত্রু, কিন্তু আসলে আল্লাহর ইচ্ছায় তারা তাদের সোজা পথে ফিরিয়ে আনার জন্যই হিংসা করে।
তাই, কখনো হিংসুকদের জন্য খারাপ ধারণা তৈরি করা ঠিক নয়। তারা আমাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে না, বরং আল্লাহ তাদের মাধ্যমে আমাদের ইসলাহ বা উন্নতির ব্যবস্থা করেন।
যেমন, পুলিশ সিসি ক্যামেরা দিয়ে মানুষের অপরাধ আটকায়, ঠিক তেমনি, শত্রুদের কথাও অনেক সময় আমাদের অজান্তে ইসলাহের জন্য উপকারে আসে। অনেক মানুষ শত্রু বা নিন্দুকদের ভয় পেয়ে ভালো থাকতে চেষ্টা করে। তারা ভাবে, যদি আমার দোষ ধরা পড়ে, তাহলে সবাই কী বলবে?
অতএব, শত্রুদের নিন্দাও অনেক সময় আমাদের জন্য উপকারে আসে, যদি আমরা তা সহনশীলতার সাথে গ্রহণ করতে পারি। এটা হল আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত, যা তিনি আমাদের সংশোধনের জন্য শত্রুদের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে এভাবে ইতিবাচকভাবে চিন্তা করার তাওফীক দান করুন—আমীন।

৪. অন্যদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা
নিজের দোষ চেনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলো, অন্যদের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া। অর্থাৎ, যদি কোনো ব্যক্তি ভুল করে এবং তার ভুলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি হবে, যে তার সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে একই ভুল আর না করে। মুমিন একে অপরের জন্য আয়না, অর্থাৎ অন্যের ভুল দেখে সে নিজের ভুলও বুঝে ফেলে এবং নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করে। এর মাধ্যমে সে বুঝতে পারে যে, অন্যদের খারাপ দিকগুলো থেকে সাবধান থাকতে হবে।
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযি. বলতেন

السَّعِيدُ مَنْ وُعِظَ بِغَيْرِهِ

সেই ব্যক্তি সৌভাগ্যবান, যে অন্যদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। [সহীহ মুসলিম : ২৬৪৫]

প্রকাশ্যে চোরের হাত কাটার বিধানের হেকমত
শরীয়ত কেন চোরের হাত কাটার শাস্তি প্রকাশ্যে কার‌্যকর করতে বলেছে? এটা তো গোপনেও করা যেত! আসলে এর উদ্দেশ্য শুধু চোরকে শাস্তি দেওয়া নয়, বরং সমাজের সবাইকে সতর্ক করা।
একজন চোর যখন ধরা পড়ে, তখন সে তো নিজের ভুলের সাজা পাচ্ছেই। কিন্তু যারা এখনো অপরাধের পথে যায়নি, তারা যেন এ ঘটনা দেখে শিক্ষা নেয়, যেন কেউ আর চুরির মতো অন্যায় কাজে লিপ্ত না হয়। এজন্যই জনসমক্ষে শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে-যাতে অন্যরা ভয় পায়, সচেতন হয় এবং ভুল পথে না যায়।
বুদ্ধিমানরা অন্যের ভুল থেকে শেখে, আর যারা নির্বোধ, তারা নিজের ভুলের শাস্তি পেলেও বারবার একই ভুল করে। তাই শুধু নিজের ভুল থেকে নয়, অন্যের ভুল থেকেও শিক্ষা নেওয়া জরুরি।
প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়ার আসল উদ্দেশ্য এটিই-সমাজকে সতর্ক করা, অপরাধ কমানো এবং সবাইকে ভালো পথে রাখার সুযোগ দেওয়া।

মানুষের অজ্ঞতা দেখে শিষ্টাচার শিখেছি
হযরত ঈসা আ.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল مَنْ أَدَّبَكَ؟ আপনাকে শিষ্টাচার শিখিয়েছে কে?
তিনি উত্তর দিলেন

مَا أَدَّبَنِي أَحَدٌ ، رَأَيْتُ جَهْلَ الْجَاهِلِ فَجَانَبْتُ

কেউ আমাকে শিখায়নি। আমি অজ্ঞ মানুষের অজ্ঞতা দেখে তা থেকে দূরে থাকতাম। এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি শিষ্টাচার শিখেছি। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন : ৭/৩৪৮] 

বড়দের ভুল ধরার চমৎকার পদ্ধতি
আসলে এভাবেই যদি সবাই অন্যদের ভুল দেখে সেগুলো থেকে শিক্ষা নিত, তাহলে অনেক ভুল এড়ানো যেত।
একবার এক বৃদ্ধ ব্যক্তি তাড়াহুড়ো করে অযু করলেন। এত দ্রুত করলেন যে, তার অযু ঠিকমতো হল না। এরপর আগের মতোই তাড়াহুড়ো করে নামাজ আদায় করলেন, যেখানে ‘খুশু’ ও ‘খুযু’—কোনোটাই ছিল না।
এই দৃশ্য দেখছিলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দুই প্রিয় নাতি, হাসান ও হোসাইন রাযি.। তারা উভয়েই অস্থির হয়ে ভাবছিলেন যে, এ বৃদ্ধ লোকের ভুলগুলো কিভাবে শুধরে দেয়া যায়! কোনো বেয়াদবি হয়ে যায় কিনা! তখন তারা খুব চমৎকার বিনয়ী-পন্থা অবলম্বন করলেন।
যখন বৃদ্ধ লোকটির নামায শেষ হল তখন তারা বিনয়ের সূরে তাকে বললেন, জনাব! আপনি আমাদেরকে একটু সময় দিবেন। বৃদ্ধ সম্মতি প্রকাশ করলে তারা বললেন যে, আমরা অযু করব এবং নামাজ আদায় করব। আপনি দয়া করে আমাদের ভুলগুলো শুধরে দেবেন।
অতপর হাসান ও হোসাইন রাযি. উভয়েই সুন্নত তরিকায় ইতমিনানের সঙ্গে অযু করলেন এবং দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। তাদের নামাজ ছিল স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামাযের মত ‘খুশু’, ‘খুযুু’ সম্পন্ন।
বৃদ্ধ ব্যক্তি তাদের দেখে নিজেই বুঝতে পারলেন যে, তার অযু ও নামাজ যথাযথ হয়নি। [ফায়যুল কাদীর : ২/৪১৬]
ঘটনা থেকে আমরা শিখতে পারি যে, অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং বিনয়ীভাবে তা সংশোধন করার চেষ্টা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদেরকে ভুলের পুনরাবৃত্তি থেকে রক্ষা করে এবং সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

إِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدٍ خَيْرًا جَعَلَ لَهُ وَاعِظًا مِنْ نَفْسِهِ يَأْمُرُهُ وَيَنْهَاهُ

যখন আল্লাহ কোনো বান্দার মঙ্গল চান, তখন তিনি তার মধ্যে এমন একজন উপদেশদাতা তৈরি করেন, যে তাকে ভালো কাজের দিকে উৎসাহিত করে এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে। [সূয়ুতী, জামি’ সগীর : ৩৭৮]

আলোচনার সার
মুহতারাম হাজিরিন! আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। এর আগে পুরো আলোচনার সার সংক্ষেপ বলে দিচ্ছি। আমি বলেছিলাম, আত্মশুদ্ধির প্রথম ধাপই হলো নিজের খুঁতগুলো চেনা, তারপর সেগুলো থেকে মুক্তির পথ খোঁজা। কিন্তু কীভাবে আমরা নিজের দোষত্রুটি জানতে পারি? চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় রয়েছে—
প্রথমত, আপনাকে এমন একজন শায়খ খুঁজে বের করতে হবে, যিনি মনের অসুখ সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল। আপনি তার মজলিসে বসবেন, নিজেকে উন্মুক্ত করবেন, আর তিনি আপনাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আপনার মনোজগতে লুকিয়ে থাকা ত্রুটিগুলো বের করবেন। এরপর তিনি আপনাকে শেখাবেন, কীভাবে এই দোষগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, যেহেতু সব সময়ে এমন শায়খ পাওয়া বেশ কঠিন, তাই আপনাকে একজন দীনদার ও খাঁটি বন্ধু খুঁজে নিতে হবে। কেননা একজন ভালো বন্ধু এমন আয়না, যেখানে আপনি নিজের বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখতে পারেন। সে আপনার প্রতিটি আচরণ ও আমলের ভুলগুলো চিহ্নিত করবে এবং আপনাকে সেগুলো দেখিয়ে দেবে।
তাকে বন্ধুত্বের বাঁধনে আবদ্ধ করুন। তার উপদেশকে গ্রহণ করুন।
তৃতীয়ত, কখনো কখনো আমাদের সবচেয়ে বড় দোষগুলো আমাদের শত্রুর মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে। শত্রুর চোখে আমরা যেমনই হই না কেন, সে আমাদের দুর্বলতাগুলো প্রকাশ করতে কার্পণ্য করবে না। এটিই হতে পারে আত্মশুদ্ধির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। তার সমালোচনাগুলোকে রাগ কিংবা ঘৃণার দৃষ্টিতে না দেখে বরং খোলা মনে বিশ্লেষণ করুন। হতে পারে, আপনার সবচেয়ে গোপন খুঁতটি শত্রুর জবানেই বেরিয়ে এসেছে—যা আপনার নিকটতম বন্ধুও কখনো বলবে না। বরং সে সেগুলো ঢেকে বাহবা দেবে, প্রশংসায় ভাসাবে।
চতুর্থত, আপনি যখন সমাজে চলাফেরা করবেন, মানুষজনের সঙ্গে মিশবেন, তখন আশপাশের মানুষের মধ্যে নানা দোষত্রুটি দেখতে পাবেন। কিন্তু এগুলো শুধু দেখেই ক্ষান্ত হবেন না; বরং আত্মজিজ্ঞাসা করুন—এই দোষগুলোর কোনোটি কি আমার মধ্যেও আছে? অন্যদের ভুল থেকে শিক্ষা নিন, যেন আপনিও সেই ভুলে না পড়েন। কারণ, পরের ভুল দেখে শিখতে পারলে নিজের ভুল করার প্রয়োজন হয় না।

আত্মশুদ্ধি একদিনের কাজ নয়
পরিশেষে বলবো, আত্মশুদ্ধি কোনো একদিনের কাজ নয়; এটি এক অবিরাম সাধনার নাম। নিজের দোষত্রুটি জানা মানেই হলো নিজেকে পরিবর্তনের পথে এগিয়ে নেওয়া। তাই আসুন, আমরা সত্যের আয়নায় নিজেদের দেখি, নিজেদের সংশোধনের প্রচেষ্টা করি, যেন এই জীবন আলোকিত হয় এবং আখিরাতেও আমাদের মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে আত্মশুদ্ধির এই নুরানী কাফেলার যাত্রী হওয়ার তাওফীক দান করুন—আমীন।

وَاخِرُ دَعْوَانَا أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِين


ইসলাহী বয়ান অবলম্বনে 

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

উক্তি ও উপদেশ

...

মাওলানা তারিক জামিল
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৮৭৫৩ বার দেখা হয়েছে

পরিবারে খুন, নৃশংসতা ও ব্যাপক সামাজিক ধ্বস

...

আল্লামা উবায়দুর রহমান খান নদভী
৮ নভেম্বর, ২০২৪
১৮৩৬ বার দেখা হয়েছে

গোনাহের ক্ষতি - ১ম পর্ব

...

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২৭৪২ বার দেখা হয়েছে

আপনি কি দ্বীনের খাদিম হতে চান?

...

মাওলানা আবু আহমাদ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১০৫৩ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →