প্রবন্ধ

অহংকারের তিনটি মৌলিক চিকিৎসা

লেখক:মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
৪ জুলাই, ২০২৫
২৮৩৩২ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, অহংকারী আগে সালাম দিতে পারে না। কারণ অহংকারীর মজ্জাগত স্বভাব হলো, ‘আমি বড়’, আমি কেন আগে সালাম দিবো? অহংকারী সবসময় অপেক্ষা করে, অপরজন আগে সালাম বলুক। এ জন্য দেখা যায়—
ধনী গরিবকে সালাম দিতে চায় না; ধনী হওয়ার অহংকার।
শিক্ষক ছাত্রকে আগে সালাম দিতে পারছে না; শিক্ষকত্বের অহংকার।
অফিস বস কর্মচারীকে আগে সালাম দেয় না; পদমর্যাদার অহংকার।
বড় ভাই ছোট ভাইকে সালাম দিতে চায় না; বয়সের অহংকার।
স্বামী স্ত্রীকে আগে সালাম দেয় না; পুরুষত্বের অহংকার।
শাশুড়ি বৌমাকে আগে সালাম দেয় না; সম্পর্কের মর্যাদার অহংকার।
বড় হুজুর ছোট হুজুরকে সালাম দেয় না; নিজের উচ্চ মর্যাদার অহংকার।
আপনি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে এই সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে এমন অহংকার দেখতে পাবেন। অথচ রাসূল ﷺ তো আমাদের শিখিয়েছেন, আগে সালাম দেওয়া শুধু উত্তম নয়, বরং অহংকারের বড় চিকিৎসা।


اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ. إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ.
بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيْمِ، وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ اْلآيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيْمِ. وجَعَلَنِيْ إِيَّاكُمْ مِنَ الصَّالِحِينَ
 أَقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا أَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِيْنَ. فَاسْتَغْفِرُوْهُ، إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ.اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ
হামদ ও সালাতের পর!
আল্লাহ তাআলা বলেন
إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারকারী ও গর্বিত ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। [সূরা লুকমান : ১৮]
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ
আর তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহঙ্কার বশতঃ আমার ইবাদাত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে। [সূরা আল-মু’মিন : ৬০]
তিনটি ধ্বংসকারী আত্মিক ব্যাধি
হাতিম আল-আসাম রহ. এক অসাধারণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন
أَصْلُ الْمَعْصِيَةِ ثَلَاثَةُ أَشْيَاءَ: الْكِبْرُ وَالْحِرْصُ وَالْحَسَدُ
অর্থাৎ, পৃথিবীতে মানুষ যত ধরনের অপরাধ, গুনাহ বা অন্যায় করে—তা প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে, সকল গুনাহের মূল কারণ তিনটি। এই তিনটি দোষ থেকেই সমস্ত অন্যায়ের জন্ম। সেই তিনটি হলো—অহংকার, লোভ এবং হিংসা। [শুয়াবুল ঈমান : ৬/২৬] 
অনুরূপ কথা বলেছেন হাফেজ ইবনুল কাইয়্যিম রহ.। তিনি বলেন
أُصُولُ الخَطَايَا كُلَّهَا ثَلاثَةٌ
الكِبْرُ: وَهُوَ الَّذِي صَارَ إِبْلِيسُ إِلَى مَا صَارَ إِلَيْهِ
والْحِرْصُ: وَهُوَ الَّذِي أَخْرَجَ آدَمَ مِنَ الجَنَّةِ
والحَسَدُ: وَهُوَ الَّذِي جَرَّ ابْنَ آدَمَ عَلَى أَخِيهِ
মানুষ যত ধরনের অপরাধ, অন্যায় বা ভুল করে, সবকিছুর মূল উৎস এই তিনটি।
১. অহংকার। যার কারণে ইবলিস লানতপ্রাপ্ত হয়েছিল।
২. লোভ। যার কারণে আদম আ. জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন।
৩. হিংসা। যার কারণে হাবিলের ভাই কাবিল তাকে হত্যা করেছিল। [ফাওয়ায়িদ : ১০৬]
এই তিনটিকে একসাথে বলা হয়, (المُهلِكَاتُ الثَّلَاثَة) ‘আল-মুহলিকাতুস সালাসা’ অর্থাৎ মানুষকে ধ্বংস করে দেওয়ার মত ভয়ানক তিনটি আত্মিক ব্যাধি।
এ কারণেই আমাদের উচিত, এই তিনটি মারাত্মক ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকা। কারণ এগুলো থেকে বাঁচতে পারলেই আমরা অধিকাংশ গুনাহ থেকে মুক্ত থাকতে পারব ইনশাআল্লাহ।
সকল রোগের জননী
এই তিনটির মধ্যেও সবচেয়ে ভয়াবহ, সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো অহংকার (الكبر)। এ কারণে আল্লাহর ওলিরা এটাকে বলেছেন, ‘উম্মুল আমরায’ তথা অন্তরের রোগগুলোর জননী।
অহংকারের কারণে ইবলিস অভিশপ্ত
এটি এমন এক ব্যাধি, যা ইবলিসকে চিরতরের জন্য অভিশপ্ত করে দিয়েছিল। এর কারণেই জান্নাতের দরজা থেকে তাকে লাথি মেরে বের করে দেয়া হয়েছিল। আদম আ.-এর সামনে সিজদা করতে বললে সে অহংকার করে বলেছিল
أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ ۖ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ
আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। [সূরা সাদ : ৭৬]
ইবলিসের একথার মাধ্যমে তার অন্তরে লুকিয়ে থাকা সেই মারাত্মক রোগ ‘অহংকার’ প্রকাশ পেয়েছিল। যার কারণে তাকে আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত ও জান্নাত থেকে চিরতরে বঞ্চিত করে দেয়া হয়েছিল।
অহংকারের ভয়াবহতা
নবীজি ﷺ বলেছেন
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ
যার অন্তরে এক জার্রাহ পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। [সহীহ মুসলিম : ৯১]
আরবী ভাষায়, সূর্যের আলোয় ভেসে বেড়ানো অতি ছোট ধুলিকণাকে বলা হয় (ذَرَّة) 'জার্রাহ' । যখন আপনি জানালার ফাঁক দিয়ে আলো আসতে দেখেন, তখন আলোর মধ্যে ছোট ছোট মিহি ধুলার কণা বাতাসে উড়তে দেখেন— সেই অতি ছোট কণিকাকে বলা হয় (ذَرَّة) 'জার্রাহ'।
অথবা সরিষা দানার চেয়েও ক্ষুদ্রতম কিছুকে বোঝানোর জন্যও ‘জার্রাহ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়।
এবার ভেবে দেখুন, এতটুকু অহংকার থাকলেও জান্নাত হারাম হয়ে যাবে। তাহলে যদি কারো অন্তরে বড় অহংকার থাকে, সে যদি নিজেকে বড় মনে করে, অন্যকে তুচ্ছ মনে করে, কাউকে সম্মান না দেয়— তার অবস্থা কত ভয়াবহ হতে পারে তা কল্পনাকেও হার মানায়!
কিয়ামতের দিন অহংকারীরা যেভাবে উঠবে
অপর হাদিসে নবীজি ﷺ বলেছেন
يُحْشَرُ الْمُتَكَبِّرُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْثَالَ الذَّرِّ فِي صُورَةِ الرِّجَالِ، يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ، يُسَاقُونَ إِلَى سِجْنٍ مِنْ جَهَنَّمَ يُسَمَّى‏:‏ بُولَسَ، تَعْلُوهُمْ نَارُ الأَنْيَارِ، وَيُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ، طِينَةَ الْخَبَالِ
কিয়ামতের দিন অহংকারীদেরকে মানুষের আকৃতিতে পিপীলিকার মতো করে উঠানো হবে। চারপাশ থেকে তাদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনা ঘিরে ধরবে। এরপর তাদেরকে জাহান্নামের এক কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে, যার নাম ‘বুলাস’। তাদের ওপর জাহান্নামের অগ্নিশিখা তাণ্ডব চালাবে। আর তাদেরকে জাহান্নামিদের পুঁজ ও পচা রক্ত থেকে তৈরি ‘তীনাতুল খাবাল’ পান করানো হবে। [তিরমিযী : ২৪৯২]
অহংকারের কারণেই পৃথিবীতে যত দৌরাত্ম্য
মুহতারাম হাজিরীন! এই দুনিয়ায় যত ঝগড়া, বিবাদ, কলহ-বিবাদ, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দম্ভ-দৌরাত্ম্য চলছে— এর পেছনে সবাই বড় কারণ একটাই—অহংকার।
অহংকারের কারণেই দুই ভাইয়ের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।
অহংকারের কারণেই পরিবার ভেঙে যায়।
অহংকারের কারণেই সমাজে বিবাদ-বিভাজন সৃষ্টি হয়।
অহংকারই মানুষ নিজের অন্যায়কে ঢেকে রাখে। যখন কেউ ভুল করে, অহংকারই তাকে তাওবা থেকে ফিরিয়ে রাখে।
অহংকারের আলামত
একজন মানুষের অন্তরে অহংকার আছে কি না— সেটার কিছু সুস্পষ্ট আলামত বা লক্ষণ আছে। তন্মধ্যে প্রধান আলামত হলো, অহংকারী ব্যক্তি কখনো সত্যকে সহজে মেনে নিতে পারে না। যখন সত্য তার সামনে হাজির করা হয়, তখন সে সেটাকে অস্বীকার করে। অনেক সময় অহেতুক তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সে নিজের ভুলের কথা কখনো স্বীকার করতে চায় না। বরং সবসময় নিজের অবস্থানকে ঠিক প্রমাণের জন্য অযৌক্তিক যুক্তি দাঁড় করাতে থাকে। আর যখন দেখে, যুক্তিতে হারতে বসেছে, তখন সে হয়তো কথার মোড় ঘুরিয়ে দেয়, কখনো পরিবেশ উত্তপ্ত করে তোলে, আবার কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু করে। এজন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
الكِبْرُ بَطَرُ الحَقِّ، وغَمْطُ النَّاسِ
অহংকার হলো, সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। [সহীহ মুসলিম : ৯১]
আর এ কারণে কী হয় জানেন?
এই অহংকারী ব্যক্তি যেই পরিবেশেই থাকবে; পরিবারে থাকুক, পরিবার ভেঙে যাবে। সমাজে থাকুক, সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে। অফিস-আদালত হোক কিংবা বন্ধু মহল, সে সেখানে অশান্তির বীজ বপন করে যাবে।
অহংকারীর দৃষ্টান্ত
অহংকারী মানুষ আসলে নিজের চোখেই নিজেকে বড় ভাবে। মানুষজন তো তাকে বড় মনে করে না। এজন্য হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. একবার অহংকারের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটা দৃষ্টান্ত দেন। তিনি বলেন, অহংকারীর অবস্থা এমন, যেন সে একটি উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেছে। সেখানে থেকে সে যখন নিচের দিকে তাকায়, তখন দেখতে পায়, মানুষগুলো খুবই ছোট ছোট। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিচের মানুষগুলো কি তাকে বড় দেখতে পাচ্ছে? না, তারা সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। তারা তার দিকে তাকিয়ে নেইও।
অহংকারী নিজের ধ্বংস ডেকে আনে
অহংকারীর এই মানসিকতা তার নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। আর আল্লাহ তাআলার কাছে তো অহংকারীর অবস্থান সবচেয়ে নিকৃষ্ট। হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
بِئْسَ الْعَبْدُ عَبْدٌ تَجَبَّرَ وَاخْتَالَ وَنَسِيَ الْكَبِيرَ الْمُتَعَالِ
অতি নিকৃষ্ট সেই বান্দা, যে অহংকার করে, বড়াই করে, অথচ মহান, সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আল্লাহ তাআলাকে ভুলে যায়। [মুসতাদরাক হাকিম : ৭৮৮৫] 
অহংকারের মৌলিক চিকিৎসা তিনটি
এই অহংকারের চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা অনেক। তন্মধ্যে মৌলিক চিকিৎসা তিনটি। সেই তিনটি চিকিৎসা সম্পর্কেই আলোচনা করেই আজকের আলোচনা শেষ করবো, ইনশাআল্লাহ।
প্রথম চিকিৎসা : নিজেকে সবসময় অন্যের চেয়ে কম মনে করা
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাযি. অহংকার থেকে বাঁচার এবং অন্তরের এই রোগের চিকিৎসা হিসাবে এক অসাধারণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন
لَا يَحْقِرَنَّ أَحَدٌ أَحَدًا مِنَ الْمُسْلِمِينَ؛ فَإِنَّ صَغِيرَ الْمُسْلِمِينَ عِنْدَ اللَّهِ كَبِيرٌ
তোমাদের মধ্যে কেউ কখনো কোনো মুসলমানকে তুচ্ছ মনে করবে না। কারণ যে মুসলমান তোমার চোখে ছোট, সে আল্লাহর কাছে অনেক বড়, সম্মানিত ও মূল্যবান। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন : ৮/৩৪৩]
এ কথার মাধ্যমে হযরত আবু বকর রাযি. আমাদের শিক্ষা দিলেন যে, কারো পোশাক দেখে, কারো গরিবত্ব দেখে, কারো অশিক্ষা দেখে তাকে হেয় মনে করো না। কারণ আল্লাহর কাছে সে হয়তো এমন কোনো আমল করে ফেলেছে, যা তাকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদায় নিয়ে যাবে। আর তুমি অহংকার করার কারণে নিজেই ধ্বংসের মুখে পড়বে।
এটাই হচ্ছে অহংকারের অন্যতম কার্যকর চিকিৎসা। অর্থাৎ, নিজেকে সবসময় অন্যের চেয়ে কম মনে করা। সবার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকানো এবং মনে রাখা— যে কেউ আল্লাহর কাছে আমার চেয়ে উত্তম হতে পারে।
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. এবং জনৈক দরবেশ
জগৎবিখ্যাত মুহাদ্দিস, যিনি ছিলেন তৎকালীন দুনিয়ার বড় বড় আলেমদের অগ্রগণ্য— তিনি হলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ.। উম্মতের সবচেয়ে সম্মানিত মুহাদ্দিসদের একজন।
একবার তিনি সফরে গেলেন ইরাকের রাক্কা নামক শহরে। সেখানে শুনলেন, এক দরবেশ আছেন— লোকজন তার কাছে গিয়ে দোয়া নেয়। তখন ইবনু মুবারক রহ. নিজেই বললেন, চলো, আমিও গিয়ে দোয়া নিয়ে আসি।
এটা ছিল তার বিনয়। অন্যথায় তিনি চাইলেই বলতে পারতেন আমি তো জগৎবিখ্যাত আলেম, কার দোয়া নেব! কিন্তু তিনি শিখিয়ে দিলেন— প্রকৃত আলেম বিনয়ী হয়।
তিনি গেলেন দরবেশের বাড়িতে। সালাম দিলেন। কিন্তু দরবেশ অহংকারের কারণে মুখ তুলেও তাকালেন না। সালামের জবাব দেওয়া তো দূরের কথা!
ইবনু মুবারক রহ. কিছুই বললেন না। চুপচাপ ফিরে গেলেন।
পরে একজন লোক দরবেশের কানে কানে বলল, আপনি জানেন, একটু আগে কে এসেছিলেন আপনার কাছে?
দরবেশ বলল, কে এসেছিল?
লোকটি বলল, উনি ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক! বর্তমান সময়ের উম্মতের সবচেয়ে বড় মুহাদ্দিস।
শুনেই দরবেশ লাফ দিয়ে উঠলেন। বুঝলেন, কী ভয়ংকর ভুল করে ফেলেছেন। কারণ সোনালী যুগের মানুষরা অন্তরে নেক নিয়ত আর সচ্চরিত্র ধারণ করতেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন ইবনু মুবারক রহ.-এর কাছে। বললেন, হুজুর, আমি জানি, আপনি বুঝে গেছেন আমার ভেতরের আসল ব্যাধি কী। আমার অন্তরের আসল রোগ হলো ‘অহংকার’। এখন আপনি দয়া করে আমাকে এ রোগের চিকিৎসা বাতলে দিন। আমি ওয়াদা করছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই চিকিৎসা মেনে চলব।
তখন ইবনে মুবারক রহ. এমন এক অসাধারণ নসিহত করলেন, যা যুগে যুগে সকল মুমিনের জন্য দিশারী হয়ে থাকবে। তিনি বললেন
إِذَا خَرَجْتَ مِنْ مَنْزِلِكَ فَلَا يَقَعْ نَظَرُكَ عَلَى أَحَدٍ إِلَّا رَأَيْتَ أَنَّهُ خَيْرٌ مِنْكَ
যখনই তুমি ঘর থেকে বের হবে, আর যার দিকেই তোমার চোখ পড়বে— মনে করবে, সে আমার চেয়ে উত্তম। আর আমি তার চেয়ে তুচ্ছ। [খাত্তাবী, আল-উযলাহ : ২২০]
এ কথাটিই ভিন্নভাবে বলেছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাযি.—যা ইতোপূর্বে আপনাদের বলেছিলাম। কথাটা এতটাই মূল্যবান যে, এটি কারো জীবনে বাস্তবায়ন হলে, তার হৃদয় থেকে অহংকার উপড়ে ফেলা সম্ভব। অহংকারের মূল চিকিৎসা এখানেই—নিজেকে সবার নিচে ভাবা, নিজের দোষের প্রতি নজর দেওয়া।
এভাবেই নিজের অন্তরকে বিনয়ী রাখতে হবে
প্রশ্ন আসতে পারে, এতসব কথা তো হলো, কিন্তু কিভাবে সম্ভব?  একজন বাবা তার সন্তানের ব্যাপারে এই চিন্তা কিভাবে করবেন যে, তার দাম আমার চেয়ে বেশি? কিংবা একজন শায়েখ কি তার শিষ্যের ব্যাপারে এভাবে ভাবতে পারেন? অনুরূপভাবে একজন শিক্ষক কি তার ছাত্রকে নিজের চেয়ে উত্তম মনে করতে পারেন?
জ্বী, পারা যায়। আর এই সমস্যার অপূর্ব সমাধান দিয়েছেন জগৎবিখ্যাত মনীষী, হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজালী রহ.। তিনি আমাদেরকে এক অনন্য মানসিক অনুশীলনের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন
যদি তোমার সামনে এমন কেউ থাকে, যার বয়স কম, তাহলে তুমি এভাবে চিন্তা করবে— এর বয়স কম, সুতরাং এর গুনাহও কম। আর আমি বেশি বয়স নিয়ে বেশি গুনাহ করেছি। সুতরাং আল্লাহর কাছে এ আমার চেয়ে বেশি দামী।
যদি তোমার সামনে এমন কেউ থাকে, যার বয়স বেশি, তুমি ভাববে— সে বয়সে বড়, মানে আমার চেয়ে ইবাদতের সুযোগ বেশি পেয়েছে। শবে কদর পেয়েছে, লাইলাতুল বরাত পেয়েছে, ইবাদতের রাত-দিন বেশি কাটিয়েছে। তাওবার সুযোগ পেয়েছে। আর আমি তা পাইনি। তাই তার মর্যাদা আমার চেয়ে বড়।
তুমি যদি ধনী হও, আর সামনে গরিব কাউকে দেখো, তুমি ভাববে— ওর সম্পদ কম, তার হিসাবও কম। আর আমার সম্পদ বেশি, আমার হিসাবও বেশি। সুতরাং আল্লাহর কাছে তার দাম আমার চেয়ে বেশি।
তুমি যদি গরিব হও, আর সামনের ব্যক্তি ধনী হয়, তুমি চিন্তা করবে— সে ধনী। সে যাকাত দিচ্ছে, সাদাকা করছে, দান করছে। ইবাদতের সুযোগ আমার চেয়ে তার বেশি। আমি তো এত সুযোগও পাইনি। তাই তার মর্যাদা আমার চেয়ে বড়।
তুমি যদি আলেম হও, আর সামনের ব্যক্তি না-হয়ে থাকে, তুমি ভাববে— সে ইলম না থাকার কারণে ভুল করছে, গুনাহ করছে। আর আমি ইলম থাকার পরও গুনাহ করছি। তাই আল্লাহর কাছে তার অবস্থান আমার চেয়ে উত্তম।
আবার তুমি যদি আলেম না হও, আর সামনের ব্যক্তি আলেম হয়,  তুমি ভাববে— এ তো আল্লাহর দেয়া মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহই কুরআনে বলেছেন, ‘আল্লাহ যাকে ইলম দিয়েছেন, তার মর্যাদা তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন।’ তাই সে অবশ্যই আমার চেয়ে বড়।
এই মনোভাবই অহংকারের সেরা ও মৌলিক চিকিৎসা। এভাবে যদি প্রতিদিন প্রতিটি মানুষের ব্যাপারে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতে পারেন— সে আমার চেয়ে উত্তম, আমি তার চেয়ে তুচ্ছ—তাহলে ইনশাআল্লাহ অহংকারের মূলোচ্ছেদ হবে।
এটা শুধু মুখের কথা নয়। এই অনুশীলন করতে হয় জীবনভর। মরণ পর্যন্ত এভাবেই অন্তরকে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। 
আল্লাহ আমাদের সকলকে এই শিক্ষা অনুযায়ী চলার তাওফিক দিন—আমীন।
হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ.-এর বিনয়
একদিন দারুল উলুম দেওবন্দের মসজিদে হাদীসের দরস চলছিল। শিক্ষক ছিলেন যুগের আল্লাহওয়ালা বুজুর্গ, ফকিহুন নাফস, হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ.। দরস চলাকালীন হঠাৎ আকাশের মুখ ভার হয়ে গেল। ভারী বৃষ্টি নামল। শিক্ষার্থী ছেলেরা তাড়াহুড়ো করে তাদের কিতাবপত্র গুছিয়ে নিয়ে দৌড়ে মাদরাসার কামরার দিকে চলে গেল। ভেজা মাঠ, তীব্র বাতাস। কেউ তাড়াহুড়োয় নিজের জুতা পর্যন্ত ফেলে রেখে চলে গেছে। 
এমন সময় হযরত গাঙ্গুহী রহ. কী করলেন? নিজের রুমাল খুলে মাটিতে বিছালেন। ছাত্রদের ফেলে যাওয়া জুতাগুলো একে একে তুলে এনে রুমালের উপর রাখলেন। সব জুতা একত্র করে রুমাল দিয়ে গুছিয়ে পোটলা বানালেন। কাজ শেষ হলে নিজ হাতে সেই পোটলা মাথায় তুলে ছাত্রদের কামরায় পৌঁছে দিলেন।
ছাত্ররা যখন দেখল, তারা বলে উঠল, হযরত! আপনি এমন করলেন?!
কেউ ভয়ে চিৎকার করে উঠল। বলল,  হযরত, আমরা তো পরে এসে নিয়ে আসতাম। কেন কষ্ট করলেন?
তখন হযরত গাঙ্গুহী রহ. মাথা নিচু করে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, যে ছেলেরা قال الله و قال الرسول ﷺ (আল্লাহর বাণী আর রাসূলের কথা) শিখছে, তাদের জুতা যদি রশীদ আহমদ না তোলে, তাহলে আর কে তুলবে?
মালেক ইবনু দীনার রহ.-এর বিনয়
জগৎবিখ্যাত বুজুর্গ মালেক ইবনু দীনার রহ.। একবার তিনি নিজের জীবনের এক অপূর্ব ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ কয়েক বছর পর্যন্ত আমার অন্তর এই দাবী করে আসছিল, যে আমার মাঝে ইখলাস রয়েছে। আমার আমল খাঁটি, এতে কোনো রিয়া লোক দেখানোর বিষয় নেই।
কিন্তু যতবার এই চিন্তা আমার অন্তরে এসেছে, ততবারই আমি নিজের মনকে তিরস্কার করে বলেছি—হে মালেক! তুই মিথ্যা বলছিস। এই দাবী সত্য নয়।
এরই মধ্যে একদিন বসরার একটি গলি দিয়ে আমি হাঁটছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম, এক মহিলা আরেক মহিলাকে দেখিয়ে বলছে, যদি রিয়াকার তথা লোক দেখানো ভণ্ড কাউকে দেখতে চাও, তাহলে ওই যে মালেক ইবনু দীনারকে দেখো!
মনে হতে পারে, এমন কথা শুনে কোনো মানুষের মন ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু না। মালেক ইবনু দীনার রহ. বলেন, এই কথা শুনে আমি খুশি হয়ে গেলাম। নিজের মনকে তিরস্কার করে বললাম, ‘দেখো মালেক, আল্লাহর এক নেক বান্দী তোকে কী নামে ডাকছে!’
মালেক ইবনু দীনার রহ. এভাবে নিজের অহংকারের শিকড় উপড়ে ফেলেছিলেন। নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন বিনয়ের দরজায় ।
এরপর থেকে তিনি সবসময় বলতেন
مَن أَرَادَ أَنْ يَنظُرَ إِلَى رَجُلٍ مُرَاءٍ فَلْيَنظُرْ إِلَيَّ
কেউ যদি ভণ্ড, রিয়াকার মানুষ দেখতে চায়, তাহলে আমাকে দেখুক। [মাওয়ায়িয মালেক ইবন দীনার : ৬৮] 
এমনকি আরও কঠিন কথা বলতেন
وَاللَّهِ لَوْ أَنَّكُمْ تَجِدُونَ لِلْعَاصِي رِيحًا لَمَا اسْتَطَاعَ أَحَدٌ مِنْكُمْ أَنْ يَجْلِسَ إِلَيَّ مِنْ خُبْثِ رِيحِي
আল্লাহর কসম! যদি গুনাহগারের গুনাহের দুর্গন্ধ বের হতো, তাহলে তোমাদের কেউ-ই আমার কাছে বসতে পারতে না আমার দুর্গন্ধের কারণে। [মাওয়ায়িয মালেক ইবন দীনার : ৬২]
এটাই হলো আল্লাহওয়ালাদের মানসিকতা। বড় বড় আমল করেও তারা নিজেদের গুনাহগার, অপদার্থ মনে করতেন।
আর আমরা? পাঁচ মিনিটের ইবাদত, একদিনের রোজা, এক ওয়াক্ত জামাতে নামাজ পড়ে নিজেদের জান্নাতি ভাবতে শুরু করি। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন—আমীন।
দ্বিতীয় চিকিৎসা : নিজের আসল পরিচয় ও হাকীকত স্মরণ করা
অহংকারের একটি বড় চিকিৎসা হলো, নিজের বাস্তবতা স্মরণ করা। আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? আমার অবস্থান কী? আর আমার শেষ পরিণতি কোথায়?
এ কথাগুলো যদি আমরা অন্তর দিয়ে একবার চিন্তা করি, নিজের বাস্তবতা স্মরণ করি, তবে অহংকারের স্থান আর থাকবে না।
মুতাররিফ ইবনু আব্দুল্লাহ রহ.
একবারের ঘটনা। তাবেয়ীদের যুগ। বিখ্যাত তাবিয়ী মুতাররিফ ইবনু আব্দুল্লাহ রহ. গিয়েছিলেন মক্কা শরীফে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করতে। ঠিক তখনই সেখানে হাজির ছিলেন তৎকালীন গভর্নর মুহাল্লাব। তার প্রভাব-প্রতিপত্তি, দেহের আভিজাত্য, পোশাক-পরিচ্ছদ—সবকিছুতে ছিল গর্ব ও অহংকারের ছাপ। তিনি তখন তাওয়াফ করছিলেন পোশাক টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে। অথচ হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
‏مَنْ جَرَّ ثَوْبَهُ خُيَلَاءَ لَمْ يَنْظُرِ اللَّهُ إِلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে ব্যক্তি অহংকার করে তার কাপড় টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পরবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না। [সহীহ বুখারী : ৫৭৮৪] 
মুতাররিফ ইবনু আব্দুল্লাহ রহ. এর এই অনুচিত আচরণ সহ্য হলো না। তিনি মুখ ফস্কে বলে উঠলেন, আল্লাহর ঘরের ভেতরে এ কেমন চালচলন!
মুহাল্লাব তখন তেড়ে এলেন। রাগে-অভিমানে বললেন, চিনেন আমি কে?
দেখুন, অহংকারীর ভাষা এমনই হয়—‘তুই জানিস আমি কে?’ এটা অহংকারীদের চিরাচরিত বুলি।
তখন মুতাররিফ ইবনু আব্দুল্লাহ রহ. চমৎকার একটি উত্তর দিলেন, যা আমাদের অহংকার ভাঙার জন্য যথেষ্ট। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি জানি আপনি কে।
أَوَّلُكَ نُطْفَةٌ مَذِرَةٌ، وَآخِرُكَ جِيفَةٌ قَذِرَةٌ، وَأَنْتَ بَيْنَ ذَلِكَ تَحْمِلُ الْعَذِرَةَ
আপনার শুরু এক ফোঁটা অপবিত্র পানি। মাঝখানটা অপবিত্র বস্তুর ভার বহনকারী দেহ। আর শেষটা হবে এক দুর্গন্ধময় লাশ।
এ মর্মস্পর্শী কথা শুনে মুহাল্লাব একেবারে চুপসে গেলেন এবং বললেন, আপনিই আমাকে আমার আসল পরিচয় স্মরণ করিয়ে দিলেন! [কুরতুবী, তাফসীর সূরা মা‘আরিজ : ৩৯ আয়াত]
দেখুন, ব্যক্তি যত বড়ই হোক না কেন; এটাই তো একজন মানুষের আসল পরিচয়। শুরুটা এক নাপাক ফোঁটা। মাঝে পেশাব-পায়খানা, রক্ত, পুঁজ, দুর্গন্ধময় পদার্থ বহনকারী দেহ। আর শেষটা হলো একটি দুর্গন্ধময় লাশ। 
কিন্তু আফসোস! আজ মানুষ নিজের এই আসল পরিচয় ভুলে যায়, তাই অহংকার করে।
মানুষ কীভাবে অহংকার করে!
তাবিয়ী আহনাফ ইবনু কায়স রহ. বলতেন
عَجَبًا لِابْنِ آدَمَ ! يَتَكَبَّرُ وَقَدْ خَرَجَ مِنْ مَجْرَى الْبَوْلِ مَرَّتَيْنِ
অদ্ভুত তো এই আদম সন্তান! সে অহংকার করে অথচ সে দুইবার পেশাবের রাস্তা দিয়ে বের হয়েছে। [সিফাতুস্-সাফওয়া : ১/৩৬৭]
তিনি বোঝাতে চাইলেন, মানুষ যত বড়ই হোক, সে তো এমনই এক দেহ, যার শুরু এবং মাঝখান পবিত্র নয়। তাহলে অহংকারের জায়গা কোথায়?
হাসান বসরী রহ. বলতেন
الْعَجَبُ مِنِ ابْنِ آدَمَ ، يَغْسِلُ الْخَرْءَ بِيَدِهِ كُلَّ يَوْمٍ مَرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ ، ثُمَّ يُعَارِضُ جَبَّارَ السَّمَوَاتِ
আশ্চর্য তো আদম সন্তান! সে প্রতিদিন একবার বা দুইবার নিজ হাতে মল ধুয়ে থাকে, তারপরও সে আসমানসমূহের মালিকের সাথে দম্ভ দেখায়! [ইবনু আবিদদুনয়া, কিতাবুত-তাওয়াযু : ২/১৮২] 
এজন্য সূফিগণ কুরআন মজিদের আয়াত
وَفِي أَنْفُسِكُمْ أَفَلا تُبْصِرُونَ
আর তোমাদের নিজেদের মধ্যেও কি তোমরা দেখ না? [m~iv hvwiqvZ : 21]
এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, هُوَ سَبِيلُ الْغَائِطِ وَالْبَوْلِ পায়খানা ও পেশাবের রাস্তা। অর্থাৎ মানুষের দেহের এমন অপবিত্র প্রকৃতিই অহংকারমুক্ত থাকার শিক্ষা দেয়। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন : ৮/৩৪৪]
তৃতীয় চিকিৎসা : বেশি বেশি আগে সালাম দেওয়া
মুহতারাম হাজিরীন! অহংকার দূর করার জন্য ইসলাম আমাদের এমন একটি উপায় শিখিয়েছে, যা সহজ-সরল, কিন্তু প্রভাবশালী। তা হলো, বেশি বেশি আগে সালাম দেওয়া। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
الْبَادِئُ بِالسَّلَامِ بَرِيءٌ مِنَ الْكِبْرِ
যে আগে সালাম দেয়, সে অহংকার থেকে মুক্ত। [মুসনাদে আহমাদ : ২৮৮৭৬]
অহংকারী কেন আগে সালাম দিতে পারে না?
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, অহংকারী আগে সালাম দিতে পারে না। কারণ অহংকারীর মজ্জাগত স্বভাব হলো, ‘আমি বড়’, আমি কেন আগে সালাম দিবো? অহংকারী সবসময় অপেক্ষা করে, অপরজন আগে সালাম বলুক। এ জন্য দেখা যায়—
ধনী গরিবকে সালাম দিতে চায় না; ধনী হওয়ার অহংকার।
শিক্ষক ছাত্রকে আগে সালাম দিতে পারছে না; শিক্ষকত্বের অহংকার।
অফিস বস কর্মচারীকে আগে সালাম দেয় না; পদমর্যাদার অহংকার।
বড় ভাই ছোট ভাইকে সালাম দিতে চায় না; বয়সের অহংকার।
স্বামী স্ত্রীকে আগে সালাম দেয় না; পুরুষত্বের অহংকার।
শাশুড়ি বৌমাকে আগে সালাম দেয় না; সম্পর্কের মর্যাদার অহংকার।
বড় হুজুর ছোট হুজুরকে সালাম দেয় না; নিজের উচ্চ মর্যাদার অহংকার।
আপনি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে এই সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে এমন অহংকার দেখতে পাবেন। অথচ রাসূল ﷺ তো আমাদের শিখিয়েছেন, আগে সালাম দেওয়া শুধু উত্তম নয়, বরং অহংকারের বড় চিকিৎসা।
সাহাবায়ে কেরামের সালামের নমুনা
রাসূল ﷺ নিজেও আগে সালাম দিতেন। এমনকি তিনি শিশুদেরকেও আগে সালাম দিতেন। এক হাদিসে এসেছে, আনাস রাযি. বলেন
كَانَ النَّبِىُّ ﷺ يَمْشِى إِلَى الصِّبْيَانِ فَيُسَلِّمُ عَلَيْهِمْ
নবীজি ﷺ ছোট ছোট বাচ্চাদের পাশ দিয়ে গেলে, তিনি তাদেরকেও সালাম দিতেন। [সহীহ বুখারী : ৬২৪৭]
আজ থেকে নিজের অহংকারের পরীক্ষা নিই
আমি কি আমার চেয়ে ছোটকে আগে সালাম দিতে পারি? গরিবকে, ছাত্রকে, কর্মচারীকে আগে সালাম দিতে পারি? নিজের স্ত্রীর সাথে হাসিমুখে আগে সালাম দিতে পারি? শ্বশুর, শাশুড়ি, জামাই, বৌমা— সবার সাথে আগে সালাম দিতে পারি?
আল্লাহর কসম! যে আগে সালাম দেয়, সে ছোট হয় না। বরং সে নবীজির সুন্নত বাঁচায়, অহংকার ভাঙে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে বেশি বেশি আগে সালাম দেওয়ার তাওফিক দিন—আমীন।
আলোচনার সার
মুহতারাম হাজিরীন! আজকের মজলিসে অহংকার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে তিনটি মৌলিক চিকিৎসা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
১. নিজের চেয়ে সবাইকে উত্তম ভাবা।
২. নিজের বাস্তবতা স্মরণ করা— শুরু এক ফোঁটা নাপাক পানি, মাঝখানে নাপাক বহনকারী দেহ, আর শেষ এক দুর্গন্ধময় লাশ।
৩. আগে সালাম দেওয়া, কারণ অহংকারী মানুষ আগে সালাম দিতে পারে না।
আসুন, অহংকারের এই আগুন থেকে নিজেদের বাঁচাই। বিনয়কে আঁকড়ে ধরি। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
مَنْ تَوَاضَعَ لِلَّهِ رَفَعَهُ اللَّهُ
যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে মর্যাদা দান করেন। [মুসলিম : ২৫৮৮]
আল্লাহ আমাদের অন্তর অহংকারমুক্ত করুন। আমীন।
وَاخِرُ دَعْوَانَا أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِين
ইসলাহী বয়ান অবলম্বনে 

মন্তব্য (...)

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

বিবিধ

মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দাঃ

শাইখ মুহাম্মাদ আওয়ামা

মাওলানা ইমদাদুল হক

আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

মাওলানা মুহাম্মদ গিয়াসুদ্দীন হুসামী

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান

আল্লামা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দাঃ

মাওলানা ইনআমুল হাসান রহ.

মাওলানা যাইনুল আবিদীন

আবদুল্লাহ আল মাসউদ

শাইখুল ইসলাম আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.

মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

আল্লামা ইকবাল

হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

শাইখ আলী তানতাভী

মাওলানা আতাউল কারীম মাকসুদ