প্রবন্ধ
উপমহাদেশে নামধারী সুন্নী যারা
ভূমিকা
ইসলাম এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যার আকীদা ও আমল নির্ভর করে কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের বুঝ ও কর্মপন্থার ওপর। এই নিখাদ দ্বীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচয় হলো—আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আত, যাঁরা রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবীদের পথ অনুসরণে অবিচল ছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আজকের সময়ের অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী “সুন্নি” বা “আহলে সুন্নত” এর সম্মানজনক নাম ধারণ করে, অথচ তাদের আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগি এবং চিন্তা-চেতনা সুন্নিয়তের মৌলিক ভিত্তির সাথেই সাংঘর্ষিক। এরা নিজেরা নিজেদের 'সুন্নি', 'হানাফি', এমনকি 'আশিকে রাসূল' বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা এক নতুন চিন্তার ধারক—যা মূল সুন্নি মতবাদের কাঠামোকে ধ্বংস করে একধরনের আবেগনির্ভর বিদ‘আত ও গুলতানিতে পরিপূর্ণ পথ নির্মাণ করেছে।
এই শ্রেণির মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত ও প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী হলো বেরলভী ফেরকা। এরা নবী ﷺ-এর মহব্বতের নামে এমন সব বিশ্বাস ও কর্ম প্রচার করে থাকে, যা ইসলাম ও সাহাবায়ে কেরামের সরলতম আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মাজারপূজা, জীবিত বা মৃত ব্যক্তিকে গায়েবানা জ্ঞানী ও সাহায্যকারী মনে করা, মীলাদ, কিয়াম, ওরস, গাউস-আযমের আহ্বানসহ বহু বিদ‘আতি প্রথা তারা ‘ইসলামি ভালোবাসা’ নাম দিয়ে চালিয়ে দেয়। এর ফলে সাধারণ মুসলমানেরা বিভ্রান্ত হয়, এবং সুন্নি নামে বিভ্রান্তিকর পথকে ইসলাম ভেবে গ্রহণ করে নেয়।
এই উপমহাদেশে “বেরলভী সুন্নি” কারা? তাদের উৎপত্তী ও ক্রমবিকাশ
বেরলভী ফেরকার সূচনা ঘটে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে, যখন আহমদ রেজা খান বেরলভী (১৮৫৬–১৯২১) “নবী ﷺ-এর ভালোবাসা” এর নামে এক নতুন ধর্মীয় আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেন।
ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ— এই উপমহাদেশে "বেরলভী সুন্নি" বা "বেরলভী মক্তবে ফিকর" এমন একটি দল, যারা নিজেদেরকে “আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত” বলে দাবি করে। কিন্তু তাদের বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের বহু দিক ইসলামের মূল তাওহীদের আকীদা এবং ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীনের পথনির্দেশনা থেকে স্পষ্ট বিচ্যুতি বহন করে।
এই মতবাদ মূলত আহমদ রেজা খান বেরলভী (১৮৫৬–১৯২১) এর অনুসারী হওয়ার কারণে “ব্রেলভী” নামে পরিচিত। তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের ব্রেলি শহরের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি "রসুলপ্রেম" বা "নবীজীর মহব্বত" নামে বহু নতুন নতুন বিষয় ধর্মে সংযোজন করেন,
তিনি ফিকহে হানাফি ও সুফিবাদের কাদরিয়া তরিকার অনুসারী ছিলেন, আর কালামশাস্ত্রে আশ‘আরী-মাতুরিদি মত অনুসরণ করতেন।
তাঁর বিখ্যাত ফতোয়ার সংকলন “ফতাওয়া রজভিয়া” (৩০ খণ্ড) এ তার নিজস্ব মতবাদ এবং তার বিরোধীদের প্রতি কড়া ভাষা ব্যবহৃত করেছেন।
যেগুলোকে ইসলামি বিদ্বানগণ বিদআত, (غلوّ) বাড়াবাড়ি এবং শিরকের কাছাকাছি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
বেরলভী দল কাদের বলা হয়?
এরা সেইসব মানুষ: যারা আহমদ রেজা খান বেরলভীকে“ইমাম আহলে সুন্নাত”, “মুজাদ্দিদে যমান”, এমনকি কখনো কখনো “গাউসে আযম ছানী” পর্যন্ত মনে করে।
যারা মাজার, ওলী, ও পীরপূজারতাকে দ্বীনের অংশ মনে করে।
যারা মিলাদ, ওরস, গিয়ারোই শরীফ, কাওয়ালি, নজর-নিয়াজ, ও নাত খানি ইত্যাদিকে ইবাদতের মর্যাদা দেয়।
যারা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে ‘আলিমুল গাইব’, ‘নূরের মূর্ত প্রতীক’, ‘হাযির-নাযির’ ও ‘মুখতার-এ-কুল’ (সব কিছুর মালিক) মনে করে।
বেরলভী মতবাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
ভারতীয় উপমহাদেশে “বেরলভীধারা” ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় সুফি খানকাহ, দরবার, নাত মাহফিল এবং মিলাদ প্রথার মাধ্যমে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, পীরদের দখল ও গদিনশিনদের প্রভাব সমাজে এদের বিস্তার ঘটায়। ধর্মীয় আবেগ উস্কে দিয়ে তারা প্রতিপক্ষদের—“ওহাবী”, “নবীর দুশমন”, ‘‘আহলে বাইতের দুশমন’’, “কাফের” বলে অভিহিত করে থাকেন।
বেরলভীদের সংক্ষেপে কিছু ভ্রান্ত আকীদা ও বিশ্বাস:
তাদের বিশ্বাস: নবী করীম ﷺ স্বশরীরে সর্বত্র উপস্থিত এবং প্রত্যেকের আমল দেখেন ও শুনেন।
খণ্ডন: কুরআনে বলা হয়েছে:
{نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ أَحْسَنَ الْقَصَصِ بِمَا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ هَذَا الْقُرْآنَ وَإِنْ كُنْتَ مِنْ قَبْلِهِ لَمِنَ الْغَافِلِينَ } [يوسف: 3]
আমি আপনাকে এ কুরআনে সর্বোত্তম ঘটনা বর্ণনা করছি, এবং এ বিষয়টি আপনি আগে থেকে জানতেন না। (সূরা ইউসূফ, আয়াত ৩)
রাসূল সা. যদি সব জায়গায় উপস্থিত থাকতেন, সর্বাবস্থায় সবকিছু অবলোকন করতেন। তাহলে এ ঘটনা না জানা থাকার কথা না। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেতেছেন, রাসূল সা. এ ঘটনা আগে থেকে জানতেন না।
২. নবী ﷺ "গায়েবের জ্ঞান রাখেন"
তাদের বিশ্বাস: নবী ﷺ সবকিছুর জ্ঞান রাখেন, এমনকি লাওহে মাহফূজেরও।
খণ্ডন: কুরআনে বলা হয়েছে:
"قُلۡ لَّاۤ اَقُوۡلُ لَکُمۡ عِنۡدِیۡ خَزَآئِنُ اللّٰہِ وَلَاۤ اَعۡلَمُ الۡغَیۡبَ "
“(হে নবী! তাদেরকে) বল, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন ভাণ্ডার আছে। অদৃশ্য সম্পর্কেও আমি (পরিপূর্ণ) জ্ঞান রাখি না। সূরা আনআম: ৫০
তাদের বিশ্বাস: নবী ﷺ সাধারণ মানুষ নন, বরং "নূর মিন নূরিল্লাহ" (আল্লাহর নূর থেকে আগত নূর)।
খণ্ডন: কুরআন স্পষ্ট বলেছে:
"قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ..." “বলুন: আমি তো তোমাদের মতো একজন মানুষ।” সূরা কাহফ: ১১০
৪. গাউস, কুতুব, ওলিয়াদের কাছে সাহায্য চাওয়া
“ইয়া গাউসে আযম মাদাদ”, “ইয়া আলী মুশকিল কুশা”, “ইয়া খাজা মাদাদ”— এই ধরনের বাক্য তারা বহুল ব্যবহারে অভ্যস্ত।
খণ্ডন: এটি তাওহীদের বিরুদ্ধে। দোয়া ও সাহায্য চাওয়া কেবল আল্লাহর কাছেই বৈধ।
"إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ" “আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।
সূরা ফাতিহা: ৫
৫. মাজারে সিজদা, নজর-নিয়াজ, চাদর চড়ানো
মাজারে চাদর চড়ানো, মানত মানা, তাওয়াফ করা, সিজদা করা, ও নেয়াজ বিতরণ করা— এসব তাদের কাছে সাধারণ আমল।
খণ্ডন:
فَاسْجُدُوا لِلَّهِ وَاعْبُدُوا
সুতরাং তোমরা আল্লাহকেই সিজদা কর এবং তাঁরই ইবাদত কর।” (সূরা আন-নাজম: ৬২)
এসব ইসলামী শরীয়তে বিদআত, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে শিরকে আকবারে পরিণত হয়।
৬. ওরস, গিয়ারোই, চেহলাম, মিলাদ
এসব অনুষ্ঠান কুরআনে বা নবীজির যুগে ছিল না। এগুলো ধর্মে নতুন সংযোজন।
খণ্ডন: রাসূল ﷺ বলেন:
"من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد" “যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু নব উদ্ভাবন করল যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়— তা প্রত্যাখ্যাত।” সহীহ বুখারী: ২৬৯৭
৭. আহমদ রেজা খানকে অতিমাত্রায় সম্মান
কেউ কেউ তাকে “কামিল ওলী”, “ভুলবিহীন ব্যক্তি”, “ইলমে লাদুন্নীধারী”, এমনকি নবীদের পর সর্বোচ্চ مقام প্রাপ্ত পর্যন্ত বলে থাকে।
খণ্ডন: এটি অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি, যা নবী ﷺ নিজেই নিষেধ করেছেন:
"لا تُطْرُونِي كما أطْرَتِ النَّصارى ابنَ مريمَ، فإنَّما أنا عبدٌ، فقولوا عبدُ اللهِ ورسولُهُ" “তোমরা আমাকে এমনভাবে বাড়িয়ে দিও না, যেভাবে খ্রিস্টানরা ঈসা ইবনে মরিয়মকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি তো কেবল আল্লাহর বান্দা, তাই বলো: আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।” সহীহ বুখারী: ৩৪৪৫
৮. নবী ﷺ-কে “মুখতার-ই-কুল” (সব কিছুর মালিক ও কর্তৃত্বসম্পন্ন) মনে করা
তাদের বিশ্বাস: নবী কারিম ﷺ পৃথিবী ও আখিরাতের প্রতিটি বিষয়ে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব রাখেন; যাকে ইচ্ছা দান করতে পারেন, যাকে ইচ্ছা বঞ্চিত করতে পারেন।
খণ্ডন: (আল-কুরআনের ভাষায়):
قُلْ إِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا رَشَدًا বলুন (হে নবী): আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি বা কল্যাণের মালিক নই। সূরা আল-জিন: ২১
৯. নবী ﷺ-কে দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মনে করা
তাদের একটি বক্তব্য:
❝নবী কারিম ﷺ-এর হাতে দুনিয়া ও আখিরাতের সব বিষয়ে ইখতিয়ার (কর্তৃত্ব) আছে।❞ ফতাওয়া রজভিয়া, খণ্ড: ১১
খণ্ডন: এই বিশ্বাস তাওহীদের ‘রুবূবিয়াত’ অংশের বিরুদ্ধে, কেননা কুরআনে বলা হয়েছে:
وَاللَّهُ يَحْكُمُ لَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ আল্লাহই ফয়সালা দেন,
তাঁর হুকুমে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সূরা রা'দ: ৪১
১০. তাওয়াসসুলে (মধ্যস্থতায়) বাড়াবাড়ি
তাদের আমল: তারা নবী ﷺ, অলী, পীর ও বুযুর্গদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে সরাসরি ডাক দিয়ে বলেন:
"ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের দরকার পূরণ করুন।" "ইয়া গাউসুল আযম! আমাদের সাহায্য করুন।"
খণ্ডন: এটা অবৈধ তাওয়াসসুল এবং এক ধরনের শিরক-ফি-দু'আ (আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ডাকা)।
১১. অলী-আউলিয়াকে মৃত বা জীবিত অবস্থায় সাহায্যদাতা ও সমস্যার সমাধানকারী মনে করা
খণ্ডন: এটি “দুআর মধ্যে শিরক” ও অন্য কারো ইবাদত করার সমতুল্য।
আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِن دُونِ اللَّهِ... আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ডাকে—এমন লোকের চেয়ে বেশি পথভ্রষ্ট আর কে? সূরা আহকাফ: ৫
১২. কবরপূজা ও কবরের অতি-সম্মান তাদের প্রচলিত কাজ:
কবরের সামনে সিজদা করা
চাদর ও ফুল দিয়ে সাজানো
কবরের চারপাশে তাওয়াফ করা
মাজারকে "দরবার" নামে ডাকা
খণ্ডন: (নবী ﷺ এর হাদীস):
"لَعَنَ اللهُ اليَهُودَ والنَّصَارَى، اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنبِيائِهِمْ مَسَاجِدَ" "আল্লাহ ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ওপর লা‘নত করেছেন, কারণ তারা নিজেদের নবীদের কবরকে সিজদার জায়গা বানিয়েছে।" সহীহ বুখারী: ১৩৩০
১৩. প্রচলীত মিলাদুন্নবী (ঈদে মিলাদ) কে ফরজ মনে করা
তাদের বিশ্বাস: মিলাদ পালন করা ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং বড় সওয়াবের কাজ।
খণ্ডন: রাসূল ﷺ, সাহাবা, তাবেঈন কিংবা চার ইমাম—কারো যুগে এই আমল ছিল না। এটি স্পষ্ট বিদ‘আত।
নবী ﷺ বলেছেন:
"عن معمر، عن ابن طاوس، عن أبيه، قال: قال رسول الله - صلى الله عليه وسلم -: "لا تتخذوا شهرًا عيدًا، ولا يومًا عيدًا"
"রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,তোমরা কোন মাসকে উৎসব (ঈদ) বানাবে না এবং (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা) কোন দিবসকে উৎসব (ঈদ) বানাবে না।" মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং: ৭৪৫৩
১৪. সুফিবাদ ও “ওয়াহদাতুল উজুদ” এর বিশ্বাস
তাদের মধ্যে অনেকে বিশ্বাস করেন: আল্লাহ ও সৃষ্টির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই—(নাউযুবিল্লাহ!)।
খণ্ডন: সূরা ইখলাস: ১-৪। এটি আল্লাহর তাওহীদ ও পবিত্রতা এর ঘোরতর বিরোধিতা এবং কুফরের কাছাকাছি বিশ্বাস।
১৫. পীর-পূজা ও শরীয়তবিরোধী অন্ধ অনুসরণ
তাদের প্রচলিত কথা:
“পীর যা বলেন, সেটাই হক” “শরীয়তের আগে পীরের কথা মানো”
খণ্ডন: আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর অনুসরণই ফরজ। কোনো পীর বা আলেমের অন্ধ অনুসরণ হারাম।
১৬. ফতাওয়া রজভিয়ার মধ্যে কুফরিপূর্ণ ও চরমপন্থী বক্তব্য
আহমদ রেজা খান তার বিরোধীদের যেমন: শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী, শাহ ইসমাঈল শহীদ, কাসেম নানুতুবী, আশরাফ আলী থানবী রহ. দেওবন্দী উলামা তাদেরকে কাফির, মুরতাদ ও বিদ‘আতি ফতোয়া দেন।
আহমদ রেজা খাঁর তাকফিরি (অন্যকে কাফের বলা) নীতি
তিনি শুধু দেওবন্দি বা আহলে হাদীস নয়, এমনকি কিছু আশআরি ও মাতুরিদি আলেমদের বিরুদ্ধেও কুফর, রিদ্দা (ইসলাম ত্যাগ), এবং শত্রু-এ-রাসূল বলে ফতোয়া দিয়েছেন।
উদাহরণ: হুসসামুল হারামাইন (১৯০৬ সাল): এই বইতে আহমদ রেজা খান আরব ও অজমের ৩০ জন আলেমের স্বাক্ষর নিয়ে দেওবন্দি আলেমদের কাফের ঘোষণা করার অভিযান চালান।
খণ্ডন: অন্য মুসলমানদের ভিত্তিহীনভাবে কাফির বলা কঠিন গুনাহ, যা ইসলামের মূলনীতি লঙ্ঘন করে।
১৭. নবী ﷺ-এর সৃষ্টির পূর্বত্ব (خلقِ محمدی)
তাদের অনেকের মতে, নবী ﷺ হলেন আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি, এবং তাঁকে আল্লাহ নিজের নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন। খণ্ডন: এটি কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং নবী ﷺ নিজেই বলেন—
"আমি তোমাদের মত একজন মানুষ, আল্লাহ আমার প্রতি ওহি করেন।" সূরা কাহফ: ১১০
সারসংক্ষেপে:
(নামধারী সুন্নী) বেরলভী মতবাদ—তাওহীদের নামে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত, রাসূল ﷺ ও অলীদের মধ্যে এমন গুণ আরোপ করে যা কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। নতুন নতুন ইবাদত ও আনুষ্ঠানিকতা চালু করে,
আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট সাহায্য চাওয়াকে বৈধ তো করে-ই, বরং তা শ্রেষ্ঠ মনে করে
যারা তাদের বিরোধিতা করে, তাদের ‘কাফের’ ঘোষণা করে
নির্দেশনা: বেরলভী সাধারণ অনুসারীদের মাঝে অনেকেই অজ্ঞতা ও আবেগবশত এসব কাজ করে থাকেন। তাই তাদেরকে নরমভাবে দাওয়াত, সদিচ্ছা ও জ্ঞান দিয়ে সংশোধনের চেষ্টা করা উচিত।
ব্রেলভী গোষ্ঠী নিজেদেরকে "আহলে সুন্নাত" বলে পরিচয় দিলেও, তাদের বিশ্বাস ও কর্মপন্থা ছাহাবা ও সালাফে সালেহীনের পথ থেকে ভিন্ন।
তাদের অধিকাংশ আকীদা শিরক, বিদআত, বাড়াবাড়ি ও অ-ইসলামী প্রথার ওপর ভিত্তি করে গঠিত।
ইসলামে রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা মানে হলো: তাঁর অনুসরণ করা, তাঁর গুণে বাড়াবাড়ি না করা।
তারা নিজেদের “আহলে সুন্নত” বলে দাবি করলেও, তাদের বিশ্বাস ও আমল সাহাবা, তাবেঈন ও ইমামগণের পথের বিপরীত।
প্রশ্ন: সাহাবারা কি কবরের সামনে সিজদা করতেন?
ইমাম আবু হানিফা কি কখনো "উরস", "গিয়ারোই" চালু করেছিলেন?
ইমাম মালিক কি নবী ﷺ-কে দোয়া করে ডেকেছেন—"ইয়া রাসূলাল্লাহ!"?
উত্তর: কখনোই না। এসব বিদআত ইসলামের পরে তৈরি হয়েছে। তারা যেহেতু হানাফি মাযহাব অনুসরণ করে বলে দাবি করে, সেহেতু এ ধরনের বিষয়ে ফতোয়া ফতোয়ায়ে শামী কিংবা ‘ইমামুদ দুনিয়া’ ইমামে আযম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতামত থেকেই নেওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা মূলত তাদের ফেরকার গোড়াপত্তনকারী আহমদ রেজা খাঁর অনুসারী। সে কারণেই তারা কখনোই সেই সরল ও বিশুদ্ধ পথে চলবে না।
আল্লাহ আমাদেরকে শিরক ও বিদআতের সকল ছায়া থেকে রক্ষা করুন এবং তাওহীদ ও সুন্নাহর উপর অটল থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
ইসলামের মানদন্ডে পহেলা বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও বাংলাদেশের চিত্র
পহেলা বৈশাখ উদযাপন চিত্র: পহেলা বৈশাখ শুরু হয় ভোরে। সূর্যোদয়ের পর পর। মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় অবশ্য ...
সুন্নাতে খাতনা : করণীয়-বর্জনীয়
একটি হাদীসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, পাঁচটি বিষয় ইসলামের স্বভাবজাত বৈ...
আজানে নবীজী সাঃ এর নাম শুনে আঙ্গুল চুম্বন বিদআত!
ইদানিং আজানের সময় “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ” শব্দ শুনে আঙ্গুলে চুমু খেয়ে চোখে মোছা বিষয়ে...
যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধিঃ বহু কবীরা গোনাহের সমষ্টি
...