প্রবন্ধ
যিলহজের প্রথম দশ দিনের ফজিলত ও আমল
লেখক:মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
২৫ মে, ২০২৫
১৩৪৯১ বার দেখা হয়েছে
০ মন্তব্য
রমযানুল মোবারকের পর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও ফজিলতময় যিলহজ মাসের এই প্রথম দশক। তাই একজন মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে খাঁটি তাওবা করার মাধ্যমে এ দিনগুলোতে আমল শুরু করা। নেক আমল যতটুকু করতে পারি-না পারি; গুনাহের মাধ্যমে যেন এ সম্মানিত দিনগুলোর অসম্মান না করি।
এজাতীয় ফজিলতময় দিন বা রাতের কথা যখন আমরা শুনি তখন আমাদের একটা অভ্যাস হল, আমরা মনে করি, কিছু তাসবীহ-তাহলীল কিংবা নফল আমল করলেই কেল্লা ফতেহ হয়ে যাবে। ব্যাস! আর কিছুর প্রয়োজন নেই। জান্নাত তো পেয়েই গিয়েছি। অথচ এটাও এক প্রকার ধোঁকা। এই ধোঁকাটা আমরা অন্য কাউকে দিচ্ছি না; বরং নিজেকেই ধোঁকা দিচ্ছি।
এজাতীয় ফজিলতময় দিন বা রাতের কথা যখন আমরা শুনি তখন আমাদের একটা অভ্যাস হল, আমরা মনে করি, কিছু তাসবীহ-তাহলীল কিংবা নফল আমল করলেই কেল্লা ফতেহ হয়ে যাবে। ব্যাস! আর কিছুর প্রয়োজন নেই। জান্নাত তো পেয়েই গিয়েছি। অথচ এটাও এক প্রকার ধোঁকা। এই ধোঁকাটা আমরা অন্য কাউকে দিচ্ছি না; বরং নিজেকেই ধোঁকা দিচ্ছি।
اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ. وَ الْفَجْرِ، وَ لَیَالٍ عَشْرٍ
بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيْمِ، وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ اْلآيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيْمِ. وجَعَلَنِيْ إِيَّاكُمْ مِنَ الصَّالِحِينَ. أَقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا أَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِيْنَ. فَاسْتَغْفِرُوْهُ، إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ.اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ
ইবাদতের মহান মৌসুমبَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيْمِ، وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ اْلآيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيْمِ. وجَعَلَنِيْ إِيَّاكُمْ مِنَ الصَّالِحِينَ. أَقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا أَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِيْنَ. فَاسْتَغْفِرُوْهُ، إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ.اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ
আর দু’-চার দিন পরেই শুরু হবে যিলহজ মাস। বছরের বারো মাসের মধ্যে যিলহজের প্রথম দশকের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাই এই সুবাদে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন।
যিলহজের প্রথম দশদিন ইবাদতের মহান মৌসুম। আল্লাহ তাআলা বছরের অন্যসব দিনের উপর এ দিনগুলোকে মর্যাদা দিয়েছেন। এ দশক এতটাই ফজিলতপূর্ণ ও মহিমান্বিত যে, আল্লাহ তাআলা এ দশকের রাতগুলোর কসম করেছেন।
ইরশাদ হয়েছে
وَ الْفَجْرِ، وَ لَیَالٍ عَشْرٍ
শপথ ফজরের, শপথ দশ রাত্রির। [সূরা ফাজর : ১-২]ফজিলতময় দশটি দিন
হাদীস শরীফে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهَا أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الْأَيَّامِ يَعْنِي أَيَّامَ الْعَشْرِ ، قَالوا يَا رسولَ الله: وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ؟ قال: وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، إِلَّا رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ
অন্য যে কোনো সময়ের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে এ দিনগুলোর তথা দশদিনের নেক আমল অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়?
তিনি বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়; তবে কোনো লোক যদি তার জানমাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং কোনো কিছু নিয়ে ফেরত না আসে সেটা ভিন্ন কথা। [বুখারী : ৯৬৯, আবু দাউদ : ২৪৩৮]
এই দিনগুলোতে বিশেষ দুটি ইবাদত
তাছাড়া আল্লাহ তাআলা এমন কিছু ইবাদত এই দিনগুলোতে করতে বলেছেন, যেসব ইবাদত বছরের অন্য দিনে করা যায় না।
মনে করুন, হজের কথা-ই বলছি, যা পালন করতে হলে এই দিনগুলোতেই করতে হয়। অথচ অন্যান্য ইবাদত মানুষ যখন ইচ্ছে তখন করতে পারে। যথা নির্দিষ্ট সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা ফরজ। আর নফল নামায? নফল নামায যে-কোনো সময় আদায় করা যায়, তেমনি রমযান মাসে রোযা ফরজ। আর নফল রোযা রমযান ছাড়া যে-কোনো সময় রাখা যায়। যাকাত বছরে একবার ফরজ হয় আর নফল সাদকা যে-কোনো সময় দেয়া যায়।
কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে দুটি ইবাদত, যার জন্যে আল্লাহ তাআলা সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই এই দুটো ইবাদত সম্পন্ন না করে অন্য সময় করলে চলবে না এবং তা ইবাদতের মাঝে পরিগণিত হবে না। তন্মধ্যে প্রথমটির নাম হজ। হজের আরকান ও বিধিবিধান সম্পাদন করতে হয় নির্দিষ্ট দিনগুলোর ভেতরেই। যথা- আরাফায় অবস্থান, মোযদালেফায় রাতযাপন, জামারাতে পাথর নিক্ষেপণ ইত্যাদিসহ হজের যাবতীয় বিধিবিধান ওই নির্দিষ্ট সময়ে না করলে আদায় হবে না। কেউ যদি আরাফার দিনে না করে অন্য কোনো দিন উকুফে আরাফা করে, তাহলে তা ইবাদত হবে না। কিংবা জামারা তো সারা বছরেই আছে। এখন যদি জামারাতের নির্ধারিত সময় রমি তথা কংকর নিক্ষেপ না করে অন্য কোনো দিনে করে, তাহলে তাকে ইবাদত মনে করা হবে না।
বোঝা গেল, হজ নামক ইবাদতের যাবতীয় বিধিবিধান আদায় করতে হয় নির্দিষ্ট সময়ে। অন্যথায় তা ইবাদতের মাঝে শামিল হয় না।
ব্যতিক্রম দ্বিতীয় ইবাদতটির নাম কুরবানি। কুরবানির জন্যে আল্লাহ নির্ধারিত করেছেন তিনটি দিন। অর্থাৎ যিলহজের দশ, এগারো ও বারো তারিখ। এই তিন দিন ব্যতীত অন্য কোনোদিন কুরবানি করতে চাইলেও করা যায় না। হ্যাঁ, কেউ যদি চায় বকরি জবাই করে গোশত সাদকা করে দেবে, তা সে করতে পারবে; কিন্তু তা কুরবানি হবে না— হবে সাদকা।
যিলহজের প্রথম দশক এত মর্যাদাপূর্ণ কেন?
উক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হল, আল্লাহ তাআলা যিলহজ মাসের এই প্রথম দশককে আলাদা মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। ওলামায়ে কেরাম বিভিন্ন হাদীসের আলোকে লিখেছেন, রমযানুল মোবারকের পর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও ফজিলতময় যিলহজ মাসের এই প্রথম দশক।
সহীহ বুখারীর প্রখ্যাত ব্যাখ্যাকার ইবনু হাজার আসকালানী রহ. যিলহজের প্রথম দশকের বিশেষ মর্যাদার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, যিলহজের প্রথম দশকের মর্যাদার কারণ হল
لِمَكَانِ اجْتِمَاعِ أُمَّهَاتِ الْعِبَادَةِ فِيهِ ، وَهِيَ الصَّلَاةُ وَالصِّيَامُ وَالصَّدَقَةُ وَالْحَجُّ ، وَلَا يَتَأَتَّى ذَلِكَ فِي غَيْرِهِ
এ দিনগুলোতে ইসলামের সবগুলো মৌলিক ইবাদত অর্থাৎ নামায, রোযা, সাদকা, ও হজ একত্রিত হয় যা অন্য কোনো সময় হয় না। [ফাতহুল বারী : ২/৫৩৪]তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দশক
كَانُوا يُعَظِّمُونَ ثَلَاثَ عَشَرَاتٍ : الْعَشْرَ الْأُوَلَ مِنْ ذِي الْحِجَّةِ وَالْعَشْرَ الْأَخِيرَ مِنْ رَمَضَانَ ، وَالْعَشْرَ الْأُوَلَ مِنَ الْمُحَرَّمِ
আবু উসমান আন-নাহদী রহ. বলেন, সালাফ তথা পূর্বসূরীগণ তিনটি দশককে খুব গুরুত্ব দিতেন। ১. যিলহজ মাসের প্রথম দশক। ২. রমযান মাসের শেষ দশক এবং ৩. মহররম মাসের প্রথম দশক। [ ইবনুল জাওযী, আত-তাবসিরাহ : ১/৫০৫]দিনগুলোর আমল
তাই একজন মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে খাঁটি তাওবা করার মাধ্যমে এ দিনগুলোতে আমল শুরু করা। আমলগুলো কী হতে পারে— এ সুবাদে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা জরুরি মনে করছি।
১. গুনাহ না করা
নেক আমল যতটুকু করতে পারি— না পারি; গুনাহের মাধ্যমে যেন এ সম্মানিত দিনগুলোর অসম্মান না করি। কুরআন-সুন্নাহর বর্ণনা অনুযায়ী চারটি মাস আল্লাহ তাআলার নিকট সম্মানিত। ওই মাসগুলো হচ্ছে— জিলকদ, যিলহজ, মহররম ও রজব। এই মাসগুলো সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন
فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُمْ
সুতরাং এ মাসসমূহে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না। [সূরা তাওবা : ৩৬]আল্লাহর নাফরমানি নিজের উপর সবচেয়ে বড় জুলুম। কারণ, এর ক্ষতি তো নিজের উপরই আপতিত হবে। সুতরাং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এ মাসের প্রথম কাজ, সাথে সাথে নেক আমলেও যত্নবান হওয়া দরকার।
ইবনু রজব হাম্বলী রহ. লাতাইফুল মাআরিফে যিলহজের আলোচনায় বলেন
اِحْذَرُوا الْمَعَاصِيَ فَإِنَّهَا تَحْرِمُ الْمَغْفِرَةَ فِي مَواسِمِ الرَّحْمَةِ
রহমতের মওসুমসমূহে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো। কেননা তা ক্ষমা থেকে বঞ্চিত করে। [লাতায়েফুল মাআরেফ : ৩৭৯]সবচেয়ে বড় ধোঁকা
এজাতীয় ফজিলতময় দিন বা রাতের কথা যখন আমরা শুনি তখন আমাদের একটা অভ্যাস হল, আমরা মনে করি, কিছু তাসবীহ-তাহলীল কিংবা নফল আমল করলেই কেল্লা ফতেহ হয়ে যাবে। ব্যাস! আর কিছুর প্রয়োজন নেই। জান্নাত তো পেয়েই গিয়েছি। অথচ এটাও এক প্রকার ধোঁকা। এই ধোঁকাটা আমরা অন্য কাউকে দিচ্ছিনা; বরং নিজেকেই ধোঁকা দিচ্ছি।
ইয়াহইয়া ইবনু মুয়ায রহ. বলেন, আমার কাছে সবচেয়ে বড় ধোঁকার জিনিস হল
التَّمَادِي فِي الذُّنُوبِ مَعَ رَجَاءِ الْعَفْوِ مِنْ غَيْرِ نَدَامَةٍ
১. ক্ষমা পাওয়ার আশায় গুনাহের চরমে পৌঁছে যাওয়া; লজ্জিত না হওয়া।وَتَوَقُّعُ الْقُرْبِ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى بِغَيْرِ طَاعَةٍ
২. আল্লাহ তাআলার আনুগত্য না করে তার নৈকট্য লাভের আশা করা।وَانْتِظَارُ زَرْعِ الْجَنَّةِ بِبَذْرِ النَّارِ
৩. জাহান্নামের বীজ বপন করে জান্নাতের ফসল আশা করা।وَطَلَبُ دَارِ الْمُطِيعِينَ بِالْمَعَاصِي
৪. গুনাহ করেও ইবাদতকারীদের সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রত্যাশা করা।وَانْتِظَارُ الْجَزَاءِ بِغَيْرِ عَمَلٍ
৫. আমল করা ছাড়াই বিনিময় পাওয়ার আশা করা।وَالتَّمَنِّي عَلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ مَعَ الْإِفْرَاطِ
৬. গুনাহে লিপ্ত থেকেও আল্লাহ তাআলার মাগফিরাতের আশাবাদী হওয়া। [ইহইয়ায়ু উলুমিদ্দীন : ৪/১৪৪] কবি বলেন
تَرْجُو النَّجَاةَ وَلَمْ تَسْلُكْ مَسَالِكَهَا
إِنَّ السَّفِينَةَ لَا تَجْرِي عَلَى الْيَبَسِ
তুমি নাজাতের পথ না ধরে নাজাতের আশা করে বসে আছ!
অথচ পাথুরে জমিনে কক্ষনো নৌকা চলতে পারেনা।
২. রাত জেগে ইবাদত করাযিলহজের এই দশটি রাতে রাত জেগে ইবাদতের গুরুত্ব অপরিসীম। এ দশকের রাতসমূহে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা মুস্তাহাব।
প্রখ্যাত তাবিয়ী সাঈদ ইবনু জুবাইর রহ. বলেন
لاَ تُطْفِئُوا سُرُجَكُم لَيَالِيَ العَشْرِ
তোমরা দশ রাত্রিতে তোমাদের ঘরের বাতিসমূহ নিভিয়ে ফেলো না। অর্থাৎ ঘুমিয়ে পড়ো না। [লাতায়িফুল মাআ’রিফ : ২৬৩]হাফিযে হাদীস ইবনু আসাকির রহ. রমাযানের শেষ দশকে এবং যিলহজ মাসের প্রথম দশকে অধিক ইবাদত করার উদ্দেশে মসজিদে ইতেকাফ করতেন। [তাযকিরাতুল হুফফায : ৪/১৩৩২]
প্রতিটি রাতের মর্যাদা শবে কদরের সমান
আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
مَا مِنْ أَيَّامٍ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ أَنْ يُتَعَبَّدَ لَهُ فِيهَا مِنْ عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ يَعْدِلُ صِيَامُ كُلِّ يَوْمٍ مِنْهَا بِصِيَامِ سَنَةٍ وَقِيَامُ كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْهَا بِقِيَامِ لَيْلَةِ الْقَدْرِ
এমন কোনো দিন নেই যে দিনগুলোর [নফল] ইবাদত আল্লাহ তাআলার নিকট যিলহজ মাসের দশ দিনের ইবাদত হতে বেশি প্রিয়। এই দশ দিনের প্রতিটি রোযা এক বছরের রোযার সমকক্ষ এবং এর প্রতিটি রাতের ইবাদত কদরের রাতের ইবাদতের সমকক্ষ। [তিরমিযী : ৭০৬]৩. এই দশটি দিনকে যিকির-তাসবীহ দ্বারা প্রাণবন্ত রাখা
এ দশকের আমল হিসেবে বিশেষভাবে যিকিরের কথা এসেছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
فَأَكْثِرُوا فِيهِنّ مِنَ التّهْلِيلِ وَالتّكْبِيرِ والتَّحميدِ والتسبيح
সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আলহামদুলিল্লাহ এবং সুবহানাল্লাহ পড়। [মুসনাদে আহমাদ : ৫৪৪৬; আদদাআওয়াতুল কাবীর, তবারানী : ৫৩৪]সহীহ বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমর রাযি. ও আবু হুরায়রা রাযি. এই দশ দিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারের দিকে যেতেন এবং তাদের তাকবীরের সঙ্গে অন্যরাও তাকবীর বলত।
মুহাম্মদ ইবনু আলী রহ. নফল নামাযের পরেও তাকবীর বলতেন। [বুখারী : পরিচ্ছেদ : ৬১২ : তাশরীকের দিনগুলোতে আমলের ফজীলত]
একবার সুবহানাল্লাহ বলার সওয়াব
এমনিতে যিকির আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক প্রিয় আমল। আবু ইমরান জূনী রহ. বলেন, সুলাইমান আ. একবার বাতাসের ওপর ভর করে উড়ে বেড়াচ্ছিলেন। পাখ-পাখালি তাঁকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছিল। জীন ও মানুষ দ্বারা তিনি বেষ্টিত ছিলেন। এভাবে যেতে যেতে তিনি বনী ইসরাঈলের এক আবেদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আবেদ এই দৃশ্য দেখে বলে ওঠলেন, আল্লাহর কসম! হে দাউদের সন্তান! আল্লাহ আপনাকে সুবিশাল রাজত্ব দান করেছেন।
সুলাইমান আ. আবেদের উক্ত মন্তব্য শুনে বলেন
لَتَسْبِيحَةٌ فِي صَحِيفَةِ مُؤْمِنٍ خَيْرٌ مِمَّا أُعْطِيَ ابْنُ دَاوُدَ، فَمَا أُعْطِيَ لِابْنِ دَاوُدَ يَذْهَبُ وَالتَّسْبِيحَةُ تَبْقَى
মুমিনের আমলনামায় লিখিত একবার সুবহানাল্লাহ বলার সওয়াব দাউদের সন্তানকে প্রদত্ত এই বিশাল সাম্রাজ্যের চেয়েও বেশি। কেননা দাউদের সন্তানের এই রাজত্ব একদিন বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু সুবহানাল্লাহ বলার সওয়াব অবশিষ্ট থেকে যাবে। [ইবনু আবিদ্দুনয়া, আযযুহদ : ৪৫]৪. অধিকহারে দোয়া করা
এ দশকের আরেকটি বিশেষ আমল হল, অধিকহারে দোয়া করা। ইবনুল কাইয়িম রহ. লিখেছেন
كَانَ ﷺ يُكْثِرُ الدُّعَاءَ فِي عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ ، وَيَأْمُرُ فِيهِ بِالْإِكْثَارِ مِنَ التَّهْلِيلِ وَالتَّكْبِيرِ وَالتَّحْمِيدِ
রাসূলুল্লাহ ﷺ যিলহজের প্রথম দশকে অধিকহারে দোয়া করতেন এবং অধিকহারে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আলহামদুলিল্লাহ পড়ার নির্দেশ দিতেন। [যাদুল মাআদ : ২/৩৬১]কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস অন্তরে রেখে দোয়া করবেন
দ্বিধা ও দোদুল্যমনা না হয়ে কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস অন্তরে রেখে দোয়া করবেন। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
ادْعُوا اللهَ وأنتمْ مُوقِنُونَ بالإجابةِ ، واعلمُوا أنَّ اللهَ لا يَستجيبُ دُعاءً من قلْبٍ غافِلٍ لَاهٍ
তোমরা দোয়া কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহ্র কাছে দোয়া কর। তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহ তাআলা কোনো উদাসীন অন্তরের দোয়া কবুল করেন না। [তিরমযী : ৩৪৭৯]দোয়া এমন সেনাবাহিনী, যা কখনই পরাজিত হয় না
ইবনু তায়মিয়াহ রহ. বলেন
القُلُوبُ الصَّادِقَةُ وَالأَدْعِيَةُ الصَّالِحَةُ هِيَ الْعَسْكَرُ الَّذِي لَا يُغْلَبُ
সত্যবাদী আত্মা এবং মানুষের উত্তম দোয়া এমন সেনাবাহিনী, যা কখনই পরাজিত হয় না। [মাজমূ‘ ফাতাওয়া : ২৮/৬৪৪]عاشقاں را ایں بود آرام جاں
کہ رساند آہرا تا آسماں
প্রেমিক-হৃদয় হয় খুশি
শুনে মালিক আহাজারি।
৫. চুল, নখ, মোচ ইত্যাদি না কাটাএ দিনগুলোতে আরেকটি বিশেষ আমল হচ্ছে, যিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানির আগ পর্যন্ত নিজের নখ, চুল, মোচ, নাভীর নিচের পশম ইত্যাদি কাটবে না। এটা মুস্তাহাব আমল।
উম্মে সালামা রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
إذا رَأَيْتُمْ هِلالَ ذِي الحِجَّةِ، وأَرادَ أحَدُكُمْ أنْ يُضَحِّيَ، فَلْيُمْسِكْ عن شَعْرِهِ وأَظْفارِهِ
তোমরা যদি যিলহজ মাসের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছা করে তবে সে যেন স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। [সহীহ মুসলিম : ১৯৭৭; জামে তিরমিযী : ১৫২৩]আমলটি কুরবানি করতে সক্ষম নয় তার জন্যও
যে ব্যক্তি কুরবানি করতে সক্ষম নয় সেও এ আমল পালন করবে।
অর্থাৎ নিজের চুল, নখ, গোঁফ ইত্যাদি কাটবে না; বরং তা কুরবানির দিন কাটবে।
আবদুল্লাহ ইবনু আমর রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللَّهُ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ . قَالَ لَهُ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا مَنِيحَةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا؟ قَالَ: لَا وَلَكِنْ خُذْ مِنْ شَعْرِكَ وَأَظْفَارِكَ وَتَقُصُّ مِنْ شَارِبِكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللَّهِ
আমি কুরবানির দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানি করার আদেশ করা হয়েছে।) আল্লাহ তাআলা তা এ উম্মতের জন্য ঈদ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে অর্থাৎ যা শুধু দুধপানের জন্য দেওয়া হয়েছে?
আল্লাহর রাসূল ﷺ বললেন, না; বরং সেদিন তুমি তোমার চুল কাটবে (মুণ্ডাবে বা ছোট করবে), নখ কাটবে, মোচ এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানি বলে গণ্য হবে। [মুসনাদে আহমদ : ৬৫৭৫]
অর্থাৎ যারা কুরবানি করতে সক্ষম নয় তারাও যেন মুসলমানদের সাথে ঈদের আনন্দ ও খুশি উদযাপনে অংশীদার হয়। তারা এগুলো কর্তন করেও পরিপূর্ণ সাওয়াবের অধিকারী হবে। অনুরূপভাবে হাজীদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী হবে।
শিশুরাও আমলটি করবে
এমনকি বাচ্চাদেরকেও অভিভাবকগণ চুল-নখ কাটা থেকে বিরত রাখতে পারেন। এতেও ইনশাআল্লাহ সাওয়াব হাছিল হবে।
আবদুল্লাহ ইবনু উমর রাযি. এক নারীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। ওই নারী যিলহজের দশকে ছেলের চুল কেটে দিচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন, সে যদি কুরবানির দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতো, অনেক ভালো হতো। [মুস্তাদরাকে হাকিম : ৭৫৯৫]
কিছুটা তাদের মতো হও
চাঁদ দেখার পর চুল-নখ না কাটার হুকুম খুবই আশ্চর্যজনক মনে হলেও এর পেছনে রয়েছে চমৎকার হেকমত। তাহল, এই দিনগুলোতেই আল্লাহ তাআলা হজের মতো ইসলামের মৌলিক একটি ইবাদত রেখে দিয়েছেন। উম্মাহ-র বড় একটি দল আলহামদুলিল্লাহ ও সময়ে ইবাদতটি করার সৌভাগ্য লাভ করে। তারা এ-সময়ে পবিত্র কাবার উষ্ণ অভ্যর্থণা, ভালোবাসা ও আত্মার টানে ভিন্ন এক আমেজ অনুভূব করে। কেমন যেন সেখানে রাখা হয়েছে কোনো চুম্বকীয় শক্তি বা সম্মোহনী যন্ত্র। হাজারো মুমিন বাইতুল্লাহর আশপাশে জামায়েত হয় বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিটি মুহূর্তে। আল্লাহ তাদের হজ করার সৌভাগ্য দান করেন। তাই তাদের প্রতি তাঁর নির্দেশ হলো, বাইতুল্লাহ শরীফের প্রতীক তথা ইহরাম পরে সেখানে যাওয়ার।
ইহরামের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা রকম বিধিনিষেধ। যেমন- ইহরামের সময় সেলাইযুক্ত কাপড় পরিধান করতে পারবে না, খুশবু লাগানো নিষেধ, মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা যাবে না ইত্যাদি। ইহরামের এসব বিধিনিষেধের মধ্য একে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান হলো চুল-নখ কাটা যাবে না।
নবীজি ﷺ কেমন যেন আমাদের মত যারা বাইতুল্লাহ-য় হাজিরা দিতে পারে নি, তাদেরকে আল্লাহর রহম ও করমের অংশীদার করার লক্ষ্যে বলেন, তোমরা বাইতুল্লাহ শরীফে হজ পালনকারীদের সাথে কিছুটা সাদৃশ্য অবলম্বন করো। কিছুটা তাদের মতো হও।
তারা যেমন চুল কাটে না, তোমরাও তেমন করো। তারা যেভাবে নখ কাটে না, তোমরাও সেভাবে কেটো না। এভাবে হজ পালনকারীদের মতো আমাদেরকেও সৌভাগ্যের অংশীদার বানিয়ে দিলেন।
আল্লাহর রহমত বাহানা খোঁজে
আরিফ বিল্লাহ ডাক্তার মোহাম্মদ আবদুল হাই রহ. বলতেন, আল্লাহর রহমত বাহানা খোঁজে। তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করার অর্থ হচ্ছে, তাদের জন্য যেসব রহমত মঞ্জুর হয়েছে, তার একটা অংশ আমাদের দান করা হবে।
আল্লাহ তাঁর বান্দার ওপর রহমতের যে-বারিধারা আরাফাতের ময়দানে বর্ষণ করেন, সেই রহমতের কিছু ভাগ আমাদেরও দেওয়া হবে— এটাই তাঁর উদ্দেশ্য। সুতরাং এই সাদৃশ্য তৈরি করাও মহান আল্লাহর বড় এক নেয়ামত।
تیرے محبوب کی یا رب شباہت لے کر آیا ہوں
حقیقت اس کو تو کردے میں صورت لے کرایا ہوں
তোমার প্রিয়তমের সাদৃশ্য নিয়ে এসেছি হে প্রভু!
তাকে তুমি হাকীকতে রূপান্তর করে দাও, আমি এসেছি সুরত নিয়ে।
আশা করি, আল্লাহ সুরতের বরকতে হাকীকতে পরিণত করবেন। রহমতের যে-ঝর্ণাধারা তিনি সেখানে বর্ষণ করেন, হতে পারে তা এখানেও বর্ষণ করবেন।৬. ঈদুল আযহার দিন ছাড়া প্রথম ০৯ দিন রোযা রাখা
এই দশকের আরেকটি বিশেষ আমল হল, ঈদুল আযহার দিন ছাড়া প্রথম নয় দিন রোযা রাখা। হাদীস শরীফে এসেছে
كَانَ رَسُولُ اللهِ ﷺ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجّةِ
নবী কারীম ﷺ এই নয়টি দিবসে (যিলহজ মাসের প্রথম নয় দিন) রোযা রাখতেন। [আবু দাউদ : ২৪৩৭, মুসনাদে আহমাদ : ২২২৩৪]অপর হাদীসে এসেছে, যেমনটি একটু আগে হাদীসটি বলেছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
يَعْدِلُ صِيَامُ كُلِّ يَوْمٍ مِنْهَا بِصِيَامِ سَنَةٍ
এই দশ দিনের প্রতিটি রোযা এক বছরের রোযার সমকক্ষ। [তিরমিযী : ৭০৬]৭. বিশেষভাবে ০৯ তারিখের রোযা রাখা
জিলহজ মাসের প্রথম নয় দিনের মধ্যে নবম তারিখের রোযা সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
صِيامُ يومِ عَرَفَةَ، إِنِّي أحْتَسِبُ على اللهِ أنْ يُكَفِّرَ السنَةَ التي قَبلَهُ والسنَةَ التي بَعدَهُ
আরাফার দিনের রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী বছরের গুনাহ মিটিয়ে দিবেন। [সহীহ মুসলিম : ১১৬২]আরেক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
مَن صامَ يومَ عَرَفَةَ غُفِر له سَنَتَينِ متتابعتَينِ
যে ব্যক্তি আরাফার দিন রোযা রাখবে তার লাগাতার দুই বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হবে। [মুসনাদে আবু ইয়ালা : ৭৫৪৮, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫১৪১] আরাফার দিনের রোযা কবে রাখবেন?
আমাদের সমাজে আরাফার দিনের রোযা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিছু লোকের দাবী হল, যেদিন আরাফার ময়দানে হাজীরা অবস্থান করেন রোযা রাখবে সে-ই দিন। চাই সেটা আমাদের দেশে যিলহজের আট তারিখে হোক কিংবা নয় তারিখে হোক।
মূলত তাদের এ দাবী সঠিক নয়। বরং ইয়াওমে আরাফা তথা আরাফার দিন দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যিলহজ মাসের নয় তারিখ। এটিই সঠিক ব্যাখ্যা। কারণ এই রোযা আরাফা বা উকুফে আরাফার আমল নয়; বরং তা ওই তারিখের আমল। ‘ইয়াওমে আরাফা’ হচ্ছে ৯ যিলহজের পারিভাষিক নাম। যেহেতু ইসলামের হজের প্রধান রোকন তথা উকুফে আরাফা ওই স্থানের তারিখ হিসাবে ৯ যিলহজ্বে আদায় করা হয় তাই এ তারিখেরই নাম পড়ে গেছে ‘ইয়াওমে আরাফা’ বা আরাফার দিন। একারণে যেসব আমল আরাফা নামক স্থান বা উকূফে আরাফার সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট নয়; বরং যিলহজের নয় তারিখের সাথে সংশ্লিষ্ট, সেগুলোকেও ‘ইয়াওমে আরাফা’র আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, নয় তারিখে বা ঈদের আগের দিন আমলটি করতে হবে।
ইয়াওমে আরাফা অর্থ যে যিলহজ মাসের নয় তারিখ উদ্দেশ্য এর আরেকটি দৃষ্টান্ত ‘তাকবীরে তাশরীক’। এটি আরাফা বা উকুফে আরাফার বিশেষ আমল নয়। এটি শুরু হয় ৯ যিলহজ ফজর থেকে, অথচ যে দলীল দ্বারা নয় তারিখ থেকে তাকবীরে তাশরীক শুরু হওয়া প্রমাণিত সেখানেও ‘ইয়াওমে আরাফা’ শব্দই আছে।
তাছাড়া গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা আছে যে, ইয়াওমে আরাফার পরের দিনটিই ইয়াওমুন নাহর। এটি প্রমাণ করে, ‘ইয়াওমে আরাফা’ একটি তারিখের নাম, আর তা হচ্ছে ৯ যিলহজ, যেমন ‘ইয়াওমুন নাহর’ একটি তারিখের নাম, আর তা হচ্ছে ১০ যিলহজ।
শুধুমাত্র সগীরা গুনাহ মাফ হয়
এখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, তাহল, উক্ত রোযার ফযিলত বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আরাফার দিন রোযা রাখবে তার লাগাতার দুই বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হবে— পূর্ববর্তী এক বছরের এবং পরবর্তী এক বছরের।
অনেকেই এ ধরনের হাদীস এলে মনে করে বসে, পূর্ববর্তী এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহ যখন মাফ-ই করে দেয়া হয়, তাহলে এর অর্থ হচ্ছে পুরো বছরের জন্য আমাদের ছুটি। সব গুনাহ মাফ হয় বিধায় যে কোনো কিছু আমরা করতে পারবো।
মনে রাখবেন, গুনাহ মাফ হয় বলে যেসব আমলের বর্ণনা রাসূলুল্লাহ ﷺ দিয়েছেন, যেমন বলা হয় অযু করার সময় প্রত্যেক অঙ্গের গুনাহ ধৌতকালীন সময়ে মাফ হয়ে যায়। নামায পড়ার উদ্দেশ্যে যখন মানুষ মসজিদে গমন করে তখন প্রতিটি কদমে একটি গুনাহ মাফ হয় ও একটি মর্তবা বুলন্দ হয়। রমযানের রোযার ব্যাপারে বলা হয়েছে রোযাদারের পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
এ ধরনের সকল হাদীসে গুনাহ দ্বারা উদ্দেশ্য সগীরা গুনাহ। আর কবীরা গুনাহের ব্যাপারে বিধান হলো, কবীরা গুনাহ তাওবা ব্যতীত মাফ হয় না। হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলা যদি কাউকে তাওবা ছাড়াও ক্ষমা করতে চান সেটা অবশ্য ভিন্ন কথা। কিন্তু বিধানগত কথা হলো, কবীরা গুনাহের জন্য যতক্ষণ পর্যন্ত তাওবা করা হবে না ততক্ষন পর্যন্ত মাফ হবে না। তাও তখন যখন গুনাহটি হুকুকুল্লাহ বা আল্লাহ তাআলার হকের ক্ষেত্রে হয়।
যদি গুনাহটির সম্পর্ক হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হকের সাথে হয়, যেমন মনে করুন, কারো হক বলপূর্বক নিয়ে নিয়েছে, কারো অধিকার হরণ করে নিয়েছে এরূপ যদি হয় তাহলে বিধান হচ্ছে, হক্কদারের হক ফিরিয়ে দেয়া পর্যন্ত কিংবা তার থেকে মাফ নেয়া পর্যন্ত শুধুমাত্র তাওবা দ্বারা গুনাহ মাফ হবে না।
সুতরাং ফজিলতের হাদীসগুলোতে যে জাতীয় গুনাহ মাফ করে দেয়ার কথা এসেছে সেগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে সগীরা গুনাহ।
৮. ০৯ জিলহজ থেকে তাকবীরে তাশরীক শুরু করা
এ দিনগুলোতে আরেকটি বিশেষ আমল হচ্ছে, ৯ জিলহজ ফজর হতে ১৩ জিলহ আসর পর্যন্ত মোট তেইশ ওয়াক্তের নামাযের পর একবার করে তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। তাকবীরে তাশরীক বলবে উচ্চস্বরে। তাকবীরে তাশরীক এই
اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ وَلِلهِ الْحَمْدُ
যেন ইসলামের মহত্ত্ব প্রকাশ পায় মুফতী শফী রহ. বলেন, ইসলামের এই তাকবীরে তাশরীফ এভাবে উচ্চারণ করার জন্য বলা হয়েছে, যেন ইসলামের মহত্ত্ব প্রকাশ পায়। এ জন্য তার দাবি হচ্ছে সালাম ফেরানোর পর এই তাকবীর ধ্বনি উচ্চস্বরে বলে উঠতে হবে। তাকে উঁচু গলায় বলতে হবে। অনুরূপভাবে ঈদুল আযহায় নামাযের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময়ও সুন্নাত হচ্ছে এই তাকবীর উচ্চ আওয়াজে বলা। অবশ্য ঈদুল ফিতরের সময় বলতে হবে নিচু স্বরে।
নারীদের উপরও তাকবীরে তাশরীক ওয়াজিব
তাকবীরের তাশরীক নারীরাও পড়তে হবে। এটাই শরীয়তের বিধান। অথচ এ ব্যাপারে সাধারণত অনেক উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। এই তাকবীর পড়তে নারীরা সাধরণত ভুলে যায়।
পুরুষরা যেহেতু জামাতের সাথে মসজিদে নামায পড়ে আর মসজিদে সালাম ফেরানোর পর এই তাকবীর যেহেতু পড়াও হয়, তাই সাধারণত তাদের স্মরণ পড়ে যায় এবং এই তাকবীর উচ্চারণ করে নেয়। কিন্তু নারীদের মধ্যে এরূপ খুব একটা দেখা যায় না। সুতরাং তাদের তেমন পড়াও হয় না।
হ্যাঁ, এই তাকবীর নারীদের ওয়াজিব কি-না, এ ব্যাপারে যদিও ওলামায়ে কেরামের মত দু’রকম পাওয়া যায়। অনেকে বলেন, ওয়াজিব। কেউ কেউ বলেন, ওয়াজিব নয় বরং মুস্তাহাব। তবুও স্পষ্ট কথা হচ্ছে সতর্কতা স্বরূপ নারীরা পাঁচ দিন অর্থাৎ আরাফার দিন ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবীরে তাশরীক পড়তে হবে। তবে হ্যাঁ, পুরুষরা তো পড়বে জোর গলায় আর নারীরা পড়বে নিম্নস্বরে।
শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. বলেন, আমার পরার্মশ হচ্ছে, তারা যেখানে নামায পড়ে সেখানে যেন এটি লিখে ঝুলিয়ে রাখে। যেন এই তাকবীরটি পড়তে তাদের মনে থাকে এবং সালামের পর পড়তে পারে।
৯. কুরবানির দিনে কুরবানি করা
এ দিনগুলোর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে কুরবানির আমল। আমলটি করতে হয় যিলহজের ১০, ১১, ১২ তারিখের ভিতরেই। এই দিনগুলো ছাড়া অন্য যে কোনো দিনে যত হাজার পশুই জবাই করা হোক না কেন, কুরবানি হবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى، جَعَلَهُ اللهُ عِيدًا لِهَذِهِ الْأُمّةِ
আমাকে ‘ইয়াওমুল আযহা’র আদেশ করা হয়েছে অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানি করার আদেশ করা হয়েছে; এ দিবসকে আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। [মুসনাদে আহমাদ : ৬৫৭৫]সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি না করা
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে হাদীস শরীফে কঠোর ধমকি এসেছে। আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
مَنْ وَجَد سَعَةً فلم يُضَحِّ فلا يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنا
যার কুরবানির সামর্থ্য আছে তবুও সে কুরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। [মুস্তাদরাকে হাকেম : ৭৬৩৯]আসুন এ মাসের যথাযথ কদর করি
সুতরাং আসুন, গুনাহ থেকে বেঁচে থেকে এ মাসের সম্মান রক্ষা করি। নেক আমলের মাধ্যমে এ মাসের যথাযথ কদর করি। তাকবীর-তাসবীহ-জিকিরে প্রাণবন্ত করি এ মাসকে। তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে ধন্য হই ক্ষমা লাভে। একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য হজ-কুরবানিসহ অন্যান্য আমল করি। নয় দিনের রোযার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করি নেক আমলের ভাণ্ডার।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দান করুন— আমীন।
وَاخِرُ دَعْوَانَا أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِين
—জুমআর বয়ান অবলম্বনে
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
হাদীস ও সুন্নাহর আলোকে তারাবীর নামায
بسم الله الرحمن الرحيم نحمد الله تبارك وتعالى، ونصلي على صفوة خلقه سيدنا محمد صلى الله عليه وسلم، ال...
শায়েখ মুহাম্মাদ আলী আসসাবুনী রহঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৪৯০৫ বার দেখা হয়েছে
সুরা ওয়াকীয়ার ফযীলত সম্পর্কিত বর্ণনার তাহকীক
সুরা ওয়াকিয়া পবিত্র কুরআনের ৫৬ তম সুরা। এ সুরার ফযীলত সম্পর্কে বেশ কিছু হাদিস এবং সাহাবি-তাবেয়ীদে...
'মুসলিম বাংলা' সম্পাদকীয়
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৬৫১৩ বার দেখা হয়েছে
শা'বান ও শবে বরাত : ফযীলত, করণীয় ও বর্জনীয়
ফযীলত ও বরকতময় মাসসমূহের একটি হল শা‘বান মাস। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় পুরো শা‘...
মুফতী ওমর আহমদ
৯ নভেম্বর, ২০২৪
৭১৭৯ বার দেখা হয়েছে
উলামায়ে সালাফের উক্তির আলোকে শবে বরাত
মাসিক আলকাউসার-এর শাবান ১৪২৬ হি. (সেপ্টেম্বর ২০০৫ ঈ.) সংখ্যায় ‘বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শাবান ও শবে...
শাঈখুল ইসলাম হযরত আব্দুল মালেক
৬ নভেম্বর, ২০২৪
২২১৯ বার দেখা হয়েছে