প্রবন্ধ

কুরবানী : ইতিহাস, গুরুত্ব ও শিক্ষা

লেখক:মাসিক আলকাউসার
১৯ মে, ২০২৫
২০৪৮৩ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও  বিশেষ ইবাদত। হযরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে তা চলে আসছে। তবে সব নবীর শরীয়তে এর পদ্ধতি এক ছিল না। ইসলামী শরীয়তে এর যে পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে তার মূল সূত্র মিল্লাতে ইবরাহীমীতে বিদ্যমান ছিল। এজন্য কুরবানীকে সুন্নতে ইবরাহীমী বলা হয়।

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কুরবানীর কথা খোদ কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে এবং এর সঙ্গে জুড়ে আছে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।

বহু দিন ধরে ইবরাহীম আ.-এর কোনো সন্তান হচ্ছে না। ধীরে ধীরে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর সন্তান জন্মের স্বাভাবিক বয়স পার হয়ে যায়। জীবনসন্ধ্যায় দাঁড়িয়েও তিনি আল্লাহ তাআলার কাছে নেক সন্তান প্রার্থনা করেন-

رَبِّ هَبْ لِيْ مِنَ الصّٰلِحِيْنَ.

হে আমার রব! আমাকে নেক সন্তান দান করুন। -সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০০

যত দিন যাচ্ছিল ইবরাহীম আ.-এর হৃদয়ে সন্তানের আকাক্সক্ষা ততই তীব্র হচ্ছিল এবং আল্লাহর কাছে ততই দুআ-কাতর হচ্ছিলেন। অবশেষে আল্লাহ তাঁর আকাক্সক্ষা পূরণ করে একজন সহনশীল পুত্রসন্তান দান করেন। এই সন্তানের নাম রাখেন ইসমাঈল।

একজন অশীতিপর বৃদ্ধ লোক সন্তানের মুখ দেখলে কত আনন্দিত হবে সহজেই অনুমেয়। ইবরাহীম আ. শুধু আনন্দিতই হননিআল্লাহর শোকরে তাঁর হৃদয় ভরে যায়। তিনি শোকর আদায় করে বলেন-

الْحَمْدُ لِلهِ الَّذِيْ وَهَبَ لِيْ عَلَي الْكِبَرِ اِسْمٰعِيْلَ وَاِسْحٰقَ  اِنَّ رَبِّيْ لَسَمِيْعُ الدُّعَآء.

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যযিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাক দান করেছেন। নিশ্চয় আমার রব দুআ শ্রবণকারী। -সূরা ইবরাহীম  (১৪) : ৩৯

ইবরাহীম আ. শামে বসবাস করতেন। একসময় আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলপুত্র ইসমাঈল ও তাঁর মা হা-জারকে যেন মক্কায় রেখে যান। মক্কায় তখন জনবসতি ও জীবনোপকরণ কিছুই ছিল না। তার পরও আল্লাহর নির্দেশমতো তিনি তাঁদেরকে সুদূর মক্কায় রেখে যান।

ইসমাঈল আ. ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে শুরু করেন। তিনি যত বড় হচ্ছিলেনতাঁর প্রতি পিতার ভালবাসা তত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যখন তিনি ছোটাছুটি করার বয়সে উপনীত হন তখন ইবরাহীম আ. এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন। তিনি স্বপ্নে দেখেনএকমাত্র কলিজার টুকরোকে যবেহ করছেন।

এটা যদিও স্বপ্ন ছিলকিন্তু নবীগণের স্বপ্ন ওহীর মতো হয়ে থাকে। তাই এ স্বপ্নের অর্থ এই ছিল যেআল্লাহর পক্ষ থেকে ইবরাহীম আ.-কে একমাত্র সন্তান ইসমাঈল আ.-কে যবেহ করার আদেশ করা হয়েছে।

ইসমাঈল আ. যদিও ইবরাহীম আ.-এর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও দুআর ফলকিন্তু তাঁর কাছে আল্লাহর আদেশ ছিল সবার উপরে। তিনি খুশিমনে এ আদেশ পালন করতে রাজি হয়ে গেলেন। কেননা সন্তান আল্লাহ্ই দান করেছেন। এখন তিনিই তাকে যবেহ করার আদেশ করেছেন। তাঁর দেওয়া সম্পদ তাঁর জন্য কুরবান করতে দ্বিধা কীসেরবান্দার জন্য এটা বরং সৌভাগ্যের বিষয়।

ইবরাহীম আ. অতীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন এবং সবগুলোতে চূড়ান্ত সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। এই আদেশ পালনেও নিজের দিক থেকে তিনি  সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা যেহেতু দুইজনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় ছিলতাই অপরজনের অভিমত জানা বা অন্তত অবহিত করা উচিত। এতে তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারবেন অথবা তার কোনো দ্বিধা থাকলে বুঝানো-সমঝানো যাবে।

ইবরাহীম আ. নিজ স্বপ্নের কথা সন্তানকে জানিয়ে তাঁর অভিমত জানতে চাইলেন-

يٰبُنَيَّ اِنِّيْۤ اَرٰي فِي الْمَنَامِ اَنِّيْۤ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَا ذَا تَرٰي.

হে আমরা বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিতোমাকে যবেহ করছি। তাই তুমি চিন্তা করে দেখতোমার অভিমত কী।

কিন্তু তিনি তো ছিলেন খলীলুল্লাহর পুত্র এবং ভাবী নবী। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন-

يٰۤاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِيْۤ اِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ الصّٰبِرِيْنَ.

হে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা করে ফেলুন। আপনি আমাকে আল্লাহ চাহেন তো অবশ্যই ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। -সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০২

এটা ইসমাঈল আ.-এর গভীর জ্ঞান ও বিনয়ের পরিচায়ক। ইবরাহীম আ.  তাঁর কাছে একথা বলেননি যেআল্লাহ তোমাকে যবেহ করার আদেশ করেছেনতিনি একটি স্বপ্নের কথা বলেছেন মাত্র। কিন্তু ইসমাঈল আ. বুঝে ফেলেছেনএ স্বপ্ন মূলত আল্লাহর একটি আদেশ।

দ্বিতীয়ততিনি ইনশাআল্লাহ’ বলে বিষয়টি আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছেন এবং আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন’ বলে এ ইঙ্গিত করেছেন যেএই ধৈর্য একা আমারই কৃতিত্ব নয়বরং দুনিয়াতে আরো বহু ধৈর্যশীল আছেন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে তাদের মধ্যে পাবেন। এভাবে তিনি অহংকার ও আত্মমুগ্ধতার নাম-গন্ধটুকু পর্যন্ত খতম করে চূড়ান্ত বিনয়ের প্রকাশ করলেন।

যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য রাজি হয়ে গেলেন তখন এল আসল পর্ব। ইবরাহীম আ. পুত্রকে যবেহ করার জন্য কাত করে শোয়ালেন।

যবেহের ক্ষেত্রে যদিও সাধারণ নিয়ম হল চিত করে শোয়ানোকিন্তু ইবরাহীম আ. ইসমাঈল আ.-কে কাত করে শোয়ানোর উদ্দেশ্য সম্ভবত এই ছিল যেআল্লাহ তাআলার আদেশ পালন প্রসঙ্গে তাঁরা দুইজন নিজেদের পক্ষ থেকে তো এটাই ধরে নিয়েছিলেন যেপিতা পুত্রকে কার্যত যবেহ করবেন। তাই ইবরাহীম আ. পুত্রকে কাত করে শোয়ালেনযাতে ছুরি চালানোর সময় চেহারা নজরে না পড়েপাছে পুত্রবাৎসল্য উঠলে মন টলে যায়। এ থেকে অনুমেয়এই আদেশ পালনের জন্য তাঁরা কত আন্তরিক ছিলেন।

আল্লাহ তাআলার আদেশ পালনের জন্য তাঁরা যেহেতু তাঁদের এখতিয়ারাধীন সবকিছুই করে ফেলেছিলেনতাই তাঁদের পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল। অনন্তর আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরতের এক কারিশমা দেখালেন। তিনি নিজ কুদরতে সেখানে একটি  দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন। ইবরাহীম আ. আল্লাহর নির্দেশে পুত্রের স্থলে সেটি যবেহ করলেন। ইসমাঈল আ. জীবিত ও নিরাপদ থাকলেন।

কুরআনের ভাষায়-

فَلَمَّاۤ اَسْلَمَا وَتَلَّهٗ لِلْجَبِيْنِ وَنَادَيْنٰهُ اَنْ يّٰۤاِبْرٰهِيْمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْيَا اِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ، اِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْبَلٰٓؤُا الْمُبِيْنُ، وَفَدَيْنٰهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ.

অতঃপর যখন তারা উভয়ে আদেশ মান্য করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল। আর আমি তাকে ডাক দিয়ে বললামহে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল স্পষ্ট পরীক্ষা। এবং আমি এক মহান কুরবানীর (পশুর) বিনিময়ে তাকে (ইসমাঈল) মুক্ত করলাম। -সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০৩-১০৭

ইবরাহীম আ.-এর এই দুম্বা কুরবানী হলইসলামী শরীয়তে নির্দেশিত কুরবানীর পদ্ধতির মূল সূত্র। (সামর্থ্যবান) মুসলমানদের কর্তব্য হল (নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট) পশু কুরবানী করা। এটা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْ.

সুতরাং আপনার প্রতিপালকের জন্য সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন। -সূরা কাওসার (১০৮) : ২

এ আয়াতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে গোটা উম্মতকে নামায ও কুরবানীর আদেশ করা হয়েছে।                        

আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে এসেছেএক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দ্বীন সম্পর্কে জানতে এসেছিল। ফিরে যাওয়ার সময় নবীজী তাকে ডেকে বললেন-

أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى، جَعَلَهُ اللهُ عِيدًا لِهَذِهِ الْأُمَّةِ.

আমাকে ইয়াওমুল আযহার আদেশ করা হয়েছে। এ দিবসকে আল্লাহ এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ৬৫৭৫সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৭৮৯;  সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৫৯১৪

এ হাদীস থেকে জানা গেলআল্লাহর পক্ষ থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরবানীর দিন কুরবানী করার জন্য বিশেষভাবে আদেশ করা হয়েছে।

মিখনাফ ইবনে সুলাইম রা. বলেন-

كُنّا وُقُوفًا مَعَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِعَرَفَاتٍ، فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ: يَا أَيّهَا النّاسُ، عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيّةٌ.

আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আরাফায় অবস্থান করছিলাম। তখন তাঁকে বলতে শুনেছিহে লোকসকল! প্রত্যেক ঘরওয়ালার উপর প্রতি বছর কুরবানী আবশ্যক। -জামে তিরমিযীহাদীস ১৫১৮সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৭৮৮মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহাদীস ২৪৭৮৬মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৭৮৮৯

ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন-

هذا حديث حسن غريب.

তাছাড়া নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদানী-জীবনে প্রতি বছর কুরবানী করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন-

أَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلَّ سَنَةٍ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় দশ বছর ছিলেন। প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন। -জামে তিরমিযীহাদীস ১৫০৭মুসনাদে আহমাদহাদীস ৪৯৫৫

ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন-

هذا حديث حسن

উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকে বোঝা গেলকুরবানী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধান। সামর্থ্যবানদের জন্য কুরবানী করা আবশ্যক।

কুরবানীর মধ্যে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। এখানে কয়েকটি শিক্ষা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল :

১. কুরবানীর গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা হলআল্লাহর প্রতি তাওহীদের বিশ্বাসকে দৃঢ়পরিপূর্ণ ও নিখুঁত করা। কুরবানী আমাদের এ শিক্ষা দেয় যেইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া আর কেউআর কোনো কিছু ইবাদতের উপযুক্ত নয়। সুতরাং ইবাদত একমাত্র আল্লাহর করব। আল্লাহ ছাড়া আর কারোআর কোনো কিছুর ইবাদত করব না। কোথাও উপাসনাধর্মী কোনো কাজ গায়রুল্লাহর জন্য হলে আমি তাতে শরীক হব না।

আল্লাহ তাআলা নবীজীকে বলেন-

قُلْ اِنَّنِيْ هَدٰىنِيْ رَبِّيْۤ اِلٰي صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ دِيْنًا قِيَمًا مِّلَّةَ اِبْرٰهِيْمَ حَنِيْفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ، قُلْ اِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ، لَا شَرِيْكَ لَهٗ وَبِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ.

আপনি বলে দিনআমার প্রতিপালক আমাকে সরলপথ প্রদর্শন করেছেনযা বিশুদ্ধ দ্বীনইবরাহীমের মিল্লাতযিনি ছিলেন একনিষ্ঠ এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আপনি বলুনআমার নামাযআমার কুরবানীআমার জীবন ও আমার মৃত্যু জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। এরই আদেশ করা হয়েছে আমাকে এবং আমিই প্রথম আনুগত্যকারী। -সূরা আনআম (৬) : ১৬১-৬৩

এ আয়াতগুলোতে নবীজীকে নিখুঁত ও পরিপূর্ণ তাওহীদের ঘোষণা করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় তাওহীদের এই ঘোষণা উচ্চারণ করতেন।

জাবির রা. থেকে বর্ণিতএকবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন দুটি দুম্বা জবাই করেছেন। তিনি যখন এগুলোকে কেবলামুখী করে শোয়ালেন তখন বললেন-

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ، عَلى مِلَّةِ إِبْرَاهِيْمَ حَنِيْفًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ. لَا شَرِيْكَ لَهٗ، وَبِذلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ.

আমি আমার মুখ তাঁর অভিমুখী করলামযিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেনইবরাহীমের মিল্লাতের ওপরযিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমার নামাযআমার কুরবানীআমার জীবন ও আমার মৃত্যু জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। এরই আদেশ করা হয়েছে আমাকে এবং আমিই প্রথম আনুগত্যকারী। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৭৯৫মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৫০২২সহীহ ইবনে খুযাইমাহাদীস ২৮৯৯

২. কুরবানীর আরেকটি বড় শিক্ষা হল আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করা। তাঁর আদেশকে শিরোধার্য করা। তাঁর হুকুম-আহকাম পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। কুরবানীর ইতিহাসে আমরা দেখেছিইবরাহীম আ. আল্লাহর নির্দেশে বৃদ্ধ বয়সে প্রাপ্ত একমাত্র সন্তান ইসমাঈল আ.-কে যবেহ করার জন্য খুশিমনে রাজি হয়েছিলেন।

৩. কুরবানীর আরেকটি বড় শিক্ষা হল যে কোনো নেক কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা। কুরবানীর এ শিক্ষা উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীস থেকেই আমরা পাই। অন্যত্র তা আরো পরিষ্কারভাবে এসেছে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰي مِنْكُمْ.

আল্লাহর কাছে সেগুলোর গোশত পৌঁছে না এবং সেগুলোর রক্তও নাবরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩৭

হাঁকুরবানীর পশুর কিছুই তো আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। গোশত আমরা খেয়ে নিই। রক্ত-ময়লা ফেলে দিই। তাহলে আল্লাহর কাছে কী পৌঁছেতাঁর কাছে পৌঁছে অন্তরের নিয়ত। যদি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কুরবানী করা হয়তাহলে এটাই তাঁর কাছে পৌঁছবে এবং তাঁর কাছে এর প্রতিদান পাওয়া যাবে। আর যদি নামদামলৌকিকতা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে করা হয় তাহলে তাঁর কাছে কোনো প্রতিদান পাওয়া যাবে না।

মানব ইতিহাসের প্রথম কুরবানীর ঘটনায়ও এ বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। যখন আদম আ.-এর দুই পুত্র কুরবানী পেশ করলেন তখন একজনের কুরবানী কবুল হলঅপরজনের কুরবানী কবুল হয়নি। এ অবস্থায় তার (যার কুরবানী কবুল হয়নি) উচিত ছিল সত্য মেনে নেওয়াকিন্তু সে উল্টো ঈর্ষাকাতর হল এবং একপর্যায়ে অপর ভাইকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হল। তখন ওই ভাই (যার কুরবানী কবুল হল) বললেন-

اِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ .

আল্লাহ তো মুত্তাকীদের থেকেই কবুল করেন। -সূরা মায়েদা (৫) : ২৭

হাদীসেও এ বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বারা ইবনে আযিব রা. থেকে বর্ণিতনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا هَذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمَّ نَرْجِعَ فَنَنْحَرَ، مَنْ فَعَلَهُ فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا، وَمَنْ ذَبَحَ قَبْلُ، فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ قَدَّمَهُ لِأَهْلِهِ، لَيْسَ مِنَ النُّسُكِ فِي شَيْءٍ.

ঈদের দিন আমরা প্রথমে নামায আদায় করি। অতঃপর ফিরে এসে কুরবানী করি। যে ব্যক্তি এভাবে আদায় করবেসে আমাদের নিয়ম মতো করল। আর যে নামাযের আগেই পশু জবাই করল সেটা তার পরিবারের জন্য গোশত হবেকুরবানী হবে না। -সহীহ বুখারীহাদীস ৫৫৪৫সহীহ মুসলিমহাদীস ১৯৬১

এ হাদীস থেকে বোঝা গেলকুরবানী শরীয়তের বিধান মোতাবেক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করতে হবে। অন্যথায় তা কুরবানী হবে নাবরং নিছক গোশত খাওয়ার আয়োজন হবে।

৪. কুরবানীর আরেকটি শিক্ষা হলকোনো কাজেই এমনকি যদি অনেক বড় কোনো নেক কাজেরও তাওফীক হয়ে যায়তবু অহংকার না করাআত্মমুগ্ধতার শিকার না হওয়াবরং বিনয়ী হওয়া এবং অন্তরে এই অনুভূতি থাকা চাই যেএটা একমাত্র আল্লাহর দয়াই আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় আমার পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। কুরবানীর ইতিহাসে আমরা লক্ষ করেছিইবরাহীম আ. যখন ইসমাঈল আ.-এর কাছে নিজ স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করে তাঁর অভিমত জানতে চেয়েছিলেন তখন তিনি বলেছিলেনহে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা করে ফেলুন। আপনি আমাকে আল্লাহ চাহেন তো অবশ্যই ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।

একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি দুম্বা কুরবানী করেন- একটি নিজের পক্ষ থেকেআরেকটি উম্মতের পক্ষ থেকে। দুম্বা দুটি জবাই করার সময় তিনি বলেন-

اَللّٰهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ.

হে আল্লাহ! এটা তোমার পক্ষ থেকেই এবং তোমার জন্যই। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৭৯৫মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৫০২২সহীহ ইবনে খুযাইমাহাদীস ২৮৯৯

নবীজীর বিনয় দেখুনদুটি দুম্বা কুরবানী করা সত্ত্বেও তিনি অহংকার করেননিবরং এই অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন যেএটা আল্লাহরই দানতিনিই এর তাওফীক দান করেছেন।

৫. কুরবানীর আরেকটি শিক্ষা হলসন্তানকে আল্লাহর অনুগত বানানোর চেষ্টা করা। কুরবানীর ইতিহাসে আমরা দেখেছিইবরাহীম আ. মনে মনে এমন সন্তানের কথাই ভাবতেন এবং আল্লাহর কাছেও এমন সন্তানই প্রার্থনা করতেনযে আল্লাহর পূর্ণ অনুগত হবেআল্লাহর জন্য জীবন দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। তিনি তা বাস্তবে প্রমাণ করেছেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুন্দরভাবে কুরবানী করা এবং এর শিক্ষা দ্বারা আলোকিত হওয়ার তাওফীক দান করুন। 

প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

বিবিধ

মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দাঃ

শাইখ মুহাম্মাদ আওয়ামা

মাওলানা ইমদাদুল হক

আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

মাওলানা মুহাম্মদ গিয়াসুদ্দীন হুসামী

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান

আল্লামা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দাঃ

মাওলানা ইনআমুল হাসান রহ.

মাওলানা যাইনুল আবিদীন

আবদুল্লাহ আল মাসউদ

শাইখুল ইসলাম আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.

মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

আল্লামা ইকবাল

হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

শাইখ আলী তানতাভী

মাওলানা আতাউল কারীম মাকসুদ