প্রবন্ধ

মুজাহাদা কেন করবেন? কীভাবে করবেন?

লেখক:মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
১৮ মে, ২০২৫
১৪৯৬৭ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য
আল্লাহ তাআলা জাহান্নামে যাওয়ার উপকরণসমূহকে মানুষের সামনে লোভনীয় করে দিয়েছেন। যে কারণে মানুষের মন সর্বদা সেদিকেই ধাবিত হয়।
আর জান্নাতে যাওয়ার উপকরণগুলো করেছেন তিক্ত ও অপ্রিয়। যার দরুণ মানুষের মন সে দিকে যেতে চায় না। বরং সে দিকে যেতে হলে মনের সঙ্গে কঠোর মেহনত ও মুজাহাদা করতে হয়। 
এখন আপনিই ঠিক করুন, আপনি কোন পথে আগাবেন?


اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ. وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيْمِ، وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ اْلآيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيْمِ. وجَعَلَنِيْ وَإِيَّاكُمْ مِنَ الصَّالِحِينَ. أَقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا أَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِيْنَ. فَاسْتَغْفِرُوْهُ، إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ.اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ
এক কাঠুরিয়ার ঘটনা
মনসবী শরীফে মাওলানা রূমী রহ. ঘটনাটি লিখেছেন। এক কাঠুরিয়ার ঘটনা। প্রতিদিন সে জঙ্গলে যেতো, লাকড়ি জোগাড় করতো, তারপর বাজারে বিক্রি করে দিতো, এভাবেই তার পরিবার চলতো। 
প্রতিদিনের মতো আজও সে জঙ্গলে গেলো। লাকড়ি কুড়িয়ে আঁটি বেধে বাড়িতে নিয়ে এলো। এরই মধ্যে ঘটে গেলো এক ভয়াবহ ঘটনা। 
লাকড়ির আঁটির ভেতরে চলে এলো একটি বিষধর সাপ। তবে জীবিত নয়, মনে হয় মৃত। 
কাঠুরিয়া ভাবলো, মরা সাপ আর কী-ই-বা করতে পারবে, তাই সে এর প্রতি বিশেষ মনোযোগী হলো না। রাতে সে ঘুমিয়ে পড়লো। 
অপরদিকে সাপটি তো আসলে মৃত ছিল না, বরং জীবিতই ছিল। হয়ত তার শরীরটার ওপর বিশাল ধকল গিয়েছিল, তাই আধমরা হয়ে গিয়েছিল। কাঠুরিয়া একেই ভেবে ছিল মৃত। 
এখন সাপটি দীর্ঘ বিশ্রাম পেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠলো, ধীরে ধীরে ফোঁস ফোঁস শুরু করে দিলো। এতকিছু ঘটে যাচ্ছিলো, অথচ কাঠুরিয়া ও তার পরিবার ছিল সম্পূর্ণ বেখবর। 
এক পর্যায়ে সাপটি ফণা তুললো এবং কাঠুরিয়াকে দংশন করে নিজের ঠিকানায় চলে গেলো। আর কাঠুরিয়া মারা গেলো।
সকাল বেলা ওঠে পরিবারের সকলেই তো হতবাক, কী থেকে কী হয়ে গেলো! একটি মরা সাপ কীভাবে একজন জলজ্যান্ত লোককে এভাবে মেরে ফেললো!
নফসও একটি বিষধর সাপ
উক্ত বর্ণনা করার পর মাওলানা রূমী রহ. বলেন, মানুষের নফসও একটি বিষধর সাপের মতো। মানুষ যখন আল্লাহওয়ালার সোহবতে থাকে, রিয়াযত-মুজাহাদা করে, তখন নফস কিছু সময়ের জন্য হয়ত নিস্তেজ হয়ে পড়ে, কিন্তু মরে তো যায় না। 
সময় মতো সে আবার জেগে ওঠতে পারে, ফণা তুলতে পারে এবং বিষ ঢেলে দিতে পারে। সুতরাং তাকে মৃত ভাবার কোনো কারণ নেই। মাওলানা রূমীর ভাষায়
نفس اژد ها است مرده است
از غمے بے آتی افسرده است
অর্থাৎ মানুষের নফসও ওই বিষাক্ত সাপের মতো, এখনও যার মৃত্যু হয়নি। যে-কোনো সময় সে তেজী হয়ে ওঠতে পারে, ছোবল মারতে পারে, ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। 
অতএব, এর ধ্বংস-ক্ষমতা সম্পর্কে উদাস থাকা যাবে না মোটেও। এক মুহূর্তের অসতর্কতার সুযোগে সে ধ্বংস করে দিতে পারে অনেক কিছু।
মুজাহাদা কাকে বলে? 
এজন্যই নফস নামক এই মহাশত্রুর ধোঁকা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হয়। তার ব্যাপারে সারাক্ষণ সতর্ক থাকতে হয়। আর এর জন্য প্রয়োজন হয় কঠিন সাধনা ও সর্বাত্মক চেষ্টা এবং এই চেষ্টা ও সাধনা সর্বক্ষণ চালিয়ে যেতে হয়। এরই নাম মুজাহাদা। আল্লাহ তাআলা বলেন 
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
যারা আমার পথে মুজাহাদা করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন। [সূরা আনকাবুত : ৬৯]
নফস দুগ্ধপোষ্য শিশুর মত
আল্লামা বুসিরী রহ. ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ বুজুর্গ, ফকিহ এবং মিশরীয় একজন সুপ্রসিদ্ধ কবি। যিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর প্রশংসায় ‘কাসীদায়ে বুরদাহ’ নামক সুদীর্ঘ কিতাব রচনা করেছিলেন। তিনি তাতে নফস সম্পর্কে একটি জ্ঞানগর্ভ ও বিস্ময়কর কবিতা লিখেছেন। তিনি বলেন
النَّفْسُ كَا لَطِفْلِ إِنْ تُهْمِلْهُ شَبُّ عَلَى
حُبِّ الرِّضَاعِ وَإِنْ تُفْطِمُهُ يَنْقَطِمُ
অর্থাৎ নফস দুগ্ধপোষ্য শিশুর মত। তাকে দুধপানের সুযোগ দিলে সে বড় হয়েও দুধ পানে অভ্যস্ত থেকে যাবে। আর যদি দুগ্ধপান বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে প্রথমদিকে সে কান্নাকাটি করবে। অবশেষে দুগ্ধপান ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।
এখন যদি কোনো ব্যক্তি এই চিন্তা করে যে, দুধ ছাড়ালে আমার সন্তান কান্নাকাটি করবে, তার কষ্ট হবে; সুতরাং তার দুধপান বন্ধ করা যাবে না, তাহলে শিশুটি বড় হয়েও দুগ্ধপান করতে চাইবে। তার সামনে রুটি বা সাধারণ খাবার এলে সে বলবে, আমি খাবো না। আমাকে দুধ দিতে হবে। 
কিন্তু কোনো সচেতন মা-বাবা তাদের শিশুসন্তানটিকে সাময়িক কান্নাকাটি ও কষ্টের ভয়ে আজীবন মায়ের দুগ্ধপানে অভ্যস্ত রাখে না। তারা জানে, শিশুর দুগ্ধপান বন্ধ করলে সে স্বাভাবিকভাবেই কিছুদিন কান্নাকাটি করবে, রাতে ঘুমোতে চাইবে না, মা-বাবাকে ঘুমোতে দিবে না। তবুও শিশুর বৃহত্তর স্বার্থ ও কল্যাণের কথা ভেবে তারা দুধ ছাড়িয়ে নেয়। যদি শিশুর দুধ ছাড়ানো না হয়, সারা জীবনেও সে স্বাভাবিক খাবারের উপযোগী হবে না।
গুনাহের স্বাদ তাকে পেয়ে বসেছে
আল্লামা বুসিরী রহ. বলেন, মানুষের নফসও এই ছোট শিশুটির মত। তার অন্তরে গুনাহের মজা জেঁকে বসেছে। যদি তাকে স্বাধীন ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে সে নানা রকম গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে যাবে। তাকে তখন ফেরানো বড়ই মুশকিল হবে। এখন যদি নফসের এই সাময়িক কষ্ট দেখে পিছিয়ে পড়ে বা ঘাবড়ে যায়, তাহলে সারা জীবনেও সে গুনাহের কাজ ছাড়তে পারবে না।
মুজাহাদা চালিয়ে যেতে হয় কেন?
আরেকটি দৃষ্টান্ত নিন। জমিনে আগাছা ফলানোর জন্য মেহনতের দরকার হয় না। বরং মেহনত ছেড়ে দিলে এমনিতেই আগাছা ভরপুর হয়ে যায়। তারপর আগাছাগুলো বড় হয় এবং সাপ-বিচ্ছুর আবাসস্থলে পরিণত হয়। অনুরূপভাবে জাহান্নামে যাওয়ার জন্যও মেহনতের দরকার হয় না। বরং মুজাহাদা তথা চেষ্টা ও সাধনা ছেড়ে দিয়ে মনের চাহিদা মত স্বাধীনভাবে চললেই জাহান্নামে চলে যাওয়া যায়। মেহনত দরকার হয় জমিন আবাদ করার জন্য। ঘাম ঝরাতে হয় জমিনে ফসল ফলানোর জন্য। সময় দিতে হয়, গতর খাটতে হয় জমিনে সুজলা শস্য উৎপাদন করার জন্য। 
অনুরূপভাবে নিজের চরিত্রকে সংশোধন করার জন্য, নিজেকে জান্নাতের উপযুক্ত বানানোর জন্য সময় দিতে হয়, আমল করতে হয়, মুজাহাদা চালিয়ে যেতে হয়।
জাগতিক কাজেও মুজাহাদা
দীনের কাজ তো চেষ্টা-সাধনা ছাড়া চলেই না; বরং জাগতিক কাজও মুজাহাদা ছাড়া হয় না। 
একজন ছাত্র পরীক্ষার রাতে দীর্ঘ সময় পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পরিবারের সদস্যরা ব্যস্ত থাকে কোনো আয়োজনে কিংবা বিনোদনে। তারও তাদের সঙ্গ দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে পারে না। সে বই-খাতা নিয়ে পড়ে থাকে। আর সহ্য করে যায় অন্যদের সাথে শরীক হতে না পারার বেদনা। এক সময় রেজাল্ট বের হয়। ভালো রেজাল্টের স্বাদ তার কষ্টগুলো ধুয়ে দেয়।
রোগী অসুস্থতায় কাতরাতে থাকে। সাধারণ পথ্যই হয় তার খাবার। সবাই মজা করে খায়। সে রোগের কারণে খেতে পারে না। কেবল চেয়ে চেয়ে দেখে। তার খুবই কষ্ট হয়। এক সময় সে সুস্থ হয়ে যায়। সুস্থতার আনন্দ তাকে বঞ্চনার কষ্টগুলো ভুলিয়ে দেয়।
জীবিকা নির্বাহের তাগিদে মানুষকে দৌড়ঝাপ করতে হয়, নিজের কামনা-বাসনা বিসর্জন দিতে হয়। নফসের অভিলাস তো ছিল, দিব্যি আরামে বাসায় বসে থাকবে। তবুও মানুষকে ছুটে বেড়াতে হয়, যেহেতু শুয়ে-বসে থাকলে পকেটে অর্থ আসবে না।
এভাবে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মানুষ কষ্ট করে। তাকে কষ্ট সহ্য করতে হয়। কত জিনিস ত্যাগ করতে হয়! যে এভাবে বৃহত্তর স্বার্থে কষ্ট করে যায়, তার জীবনে এক সময় সাফল্যের বসন্ত নামে।
ঈমানদার অলস হতে পারে না
এ কারণে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি.-এর কাছে এক যুবক এসে বললো, হযরত! আমল করতে পারি না। 
ইবনু আব্বাস রাযি. জিজ্ঞেস করলেন, কেন? 
যুবক উত্তর দিল, إِنِّي كَسْلَانٌ আমি অলস। তাই সময় কেটে যায়, আমল করতে পারি না। 
ইবনু আব্বাস রাযি. তখন যুবককে বললেন
إِنِّي أَكْرَهُ أَنْ يَقُولَ الرَّجُلُ: إِنِّي كَسْلَانٌ
আর আমি এই কথা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না যে, একজন লোক বলবে, আমি অলস। [  মুসান্নাফ ইবনি আবী শাইবা : ৯/৬৭]
শিশুকাল থেকে মুজাহাদার অভ্যাস
মূলত এই মুজাহাদা শুরু হয় শিশুকাল থেকেই। একটা শিশু পড়ার বয়সে পড়তে যেতে হয়। মন না চাইলেও অভিভাবকের চাপে সে পড়তে যায়, চাহিদার বিপরীত কাজ তাকে করতেই হয়। একেই বলে মুজাহাদা; তথা চেষ্টা-সাধনা। শিক্ষার্জনের লক্ষ্যে, উপার্জনের প্রয়োজনে; বরং দুনিয়ার সকল প্রয়োজনে মানুষকে কামনা-বাসনার বিপরীতে সাধনা করতে হয়। কেউ এমনটি না করলে পার্থিব কোনো বিষয়ই সে লাভ করতে পারবে না। বিফল হবে জীবনের সকল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য।
তিন ধরনের জগত
শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. বলেন, আল্লাহ তিন ধরনের জগত সৃষ্টি করেছেন। 
প্রথমটি হলো, যাতে মানুষের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে। কোনো কাজই যেখানে মনের বিপরীত হবে না। সব ধরনের কাজ করার স্বাধীনতা সেই জগতে থাকবে। সকল সুযোগ সেখানে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। এই জগতটি হচ্ছে জান্নাত। এই জগত প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন
وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُوْنَ
সেখানে তোমাদের জন্য আছে যা কিছু তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্য আছে যা তোমরা ফরমায়েশ করবে। [সূরা হা-মীম সিজদা: ৩১]
দ্বিতীয় জগতটি উপরোক্ত জগতের সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে আরাম-আনন্দ এবং শান্তি বলতে কোনো কিছুই আশা করা যাবে না। ওই জগতকে বলা হয় জাহান্নাম। দুঃখ, কষ্ট, বালা-মুসিবত, বেদনা-পেরেশানিসহ মনের প্রতিকূল অবস্থা, সব ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রিয় জিনিস সেখানে থাকবে। 
তৃতীয় জগতটি বৈচিত্রময়, যেখানে ইচ্ছার অনুকূল-প্রতিকূল অর্থাৎ উভয় ধরনেরই বস্তু থাকবে। আনন্দ-বেদনা, কষ্ট-আরাম, সুখ-দুঃখ সবই এখানে রয়েছে। আবার কখনও সুখ ও আনন্দের মাঝে লুকিয়ে থাকে কষ্ট ও বিস্বাদ। স্বস্তির ভেতর ঘাপটি মেরে থাকে অস্বস্তি। তেমনি কখনও দুঃখের পেছনে ঘুমিয়ে থাকে সুখ। নিরানন্দের ভেতরে চুপটি মেরে থাকে আনন্দ। কান্নার মাঝে চাপা পড়ে থাকে হাসি। এই বৈচিত্রময় জগতটিই হচ্ছে দুনিয়া।
যে জগতে সুখ আর দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলে
এ-জগতে বিশাল অর্থবৈভব, ভবন-অট্টালিকা এবং আবিষ্কার ও উপকরণের মালিককেও যদি জিজ্ঞাসা করেন, আপনার জীবনে বেদনাদায়ক কোনো ঘটনা ঘটেছে কি? পুরোটা জীবন কি সুখেই কাটিয়েছেন? তাহলে একজনকেও পাবেন না, যিনি এর উত্তরে বলবেন, জীবনটা পুরোপুরি সুখ ও শান্তিতেই কেটেছে, জীবনের সকল আকাঙ্ক্ষাই পূর্ণ হয়েছে। 
কেন পাবেন না? যেহেতু এটা জান্নাত নয়, এটা দুনিয়া। এখানে সুখ আর দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলে। এখানে শুধু সুখের আশা করা দূরাশা ছাড়া কিছু নয়। এমন আশা জীবনেও পূর্ণ হওয়ার নয়। কবি বলেছেন
قید حیات بند و غم اصل میں دونوں ایک ہیں
موت سے پہلے ادم غم سے نجات پائے کیوں
যেহেতু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে দুশ্চিন্তা পেরেশানি,
তাহলে মৃত্যুর পূর্বে মানুষ পেরেশানি থেকে মুক্তি পাবে কেন?
মানুষের সামনে দুটি পথ
অতএব, এই দুনিয়া পরিচালনার জন্য মানুষের সামনে দুটি পথ—
প্রথম পথটি হলো, মানুষ নফস তথা প্রবৃত্তির বিপরীত কাজ করবে, দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে কাটাবে, কিন্তু এতসব দুঃখ কষ্টের ফলাফল আখেরাতে কিছুই পাবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টিও ভাগ্যে জুটবে না।
দ্বিতীয় পথ হলো, আল্লাহ যেন খুশি হন-এর জন্য মানুষ নফসের সাথে লড়াই করে চলবে। প্রবৃত্তির বিপরীত কাজ করবে, দুঃখ-কষ্ট সহ্য করবে, কিন্তু এসব দুঃখ কষ্টের ফলাফল আখেরাতে পাবে।
নবীগণ যে পথটির প্রতি মানুষকে ডেকেছেন
প্রকৃতপক্ষে নবীগণও দ্বিতীয় এই পথটির প্রতিই মানুষকে ডেকেছেন। তাঁরা বলেছেন, দুনিয়াতে যখন নিজের মনমতো চলা যায় না- চাইলেও চলা যায় না, না চাইলেও না। তখন কেবল এই প্রতিজ্ঞা-ই করে নাও যে, মনমতো যখন চলা-ই যাবে না, তাহলে সেভাবেই চলব, যেভাবে চললে আল্লাহ খুশি হন।
একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত
মনে করুন, আপনি একজন মুসাফির। একা পথ চলেছেন। আপনার সামনে দুটি পথ। একটি কঠিন, পথ চলতে কষ্ট, পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে গেছে। অন্যটি মসৃণ, ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে নীচের দিকে, পথচলা বড় সহজ।
প্রথমটি এবড়ো-থেবড়ো, মাঝে মাঝে খাদ, বড় বড় অমসৃণ পাথর। পথচলা বড় কষ্ট। ভ্রমন সুখকর নয়। 
কিন্তু তার সামনে একটা ফলক, যা স্থাপন করেছে সরকার। তাতে লিখা—এই রাস্তার শুরুটা অমসৃণ, পথচলা কষ্ট, কিন্তু এটিই সঠিক পথ, যেটি পৌঁছে গেছে বড় শহরে, আকাঙ্খিত গন্তব্যে।
আর দ্বিতীয়টি চলাচলযোগ্য, গাছের ছায়ায় ঢাকা, দু’পাশে ফুল ও ফল। মাঝে মাঝে কফিশপ, তাতে রয়েছে বিনোদনেরও সামগ্রী, যা অন্তরকে মোহিত করে, চোখ তৃপ্তি পায়, কানগুলো সুরের মূর্ছনায় আপ্লুত হয়। কিন্তু পথের শেষে একটা ফলকের উপর লিখা- সাবধান! এটি খুবই বিপদসংকুল পথ, এর শেষে রয়েছে গভীর গর্ত, যাতে পড়লে সাক্ষাৎ মৃত্যু, নিশ্চিত ধ্বংস।
এখন আপনি কোন পথ বেছে নিবেন?
এতে কোনো সন্দেহ নেই, নফস কঠিনটি বাদ দিয়ে সহজটার দিকেই ঝুঁকবে। কষ্টকর পথ ছেড়ে স্বাদযুক্ত পথেই চলতে চাইবে। স্বাধীনতাকে ভালবাসবে, বন্দীত্বকে অপছন্দ করবে। এটিই নফসের স্বভাব, যে স্বভাবের উপর আল্লাহ তাআলা তাকে সৃষ্টি করেছেন। যদি মানুষ নিজেকে তার মনের উপর সোপর্দ করে, তাহলে নিশ্চিত সে দ্বিতীয় রাস্তাই অবলম্বন করবে। 
কিন্তু আকল তাতে বাধা দেবে। আকল বর্তমানের সাময়িক আরামকে পরিণতির কঠিন কষ্টের সাথে ওজন করে দেখবে। অল্প সময়ের কষ্ট সত্ত্বেও অনন্তকালের আরামের কথা চিন্তা করে প্রথম রাস্তাকেই প্রাধান্য দেবে।
এটিই উদাহরণ জান্নাত ও জাহান্নামের রাস্তার।
জান্নাতে যেতে হলে মেহনতের দরকার হয়
একারণে হুজ্জাতুল ইসলাম আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. বলতেন, জান্নাতের অবস্থান উপরের দিকে। জাহান্নামের অবস্থান নিচের দিকে। উপরে যেতে হলে মেহনতের দরকার হয়। নিচে নামার জন্য মেহনত এত বেশি দরকার হয় না।
زندگی آمد براۓ بندگی‎
زندگی بے بندگی شرمندگی
জীবনের আগমন বন্দেগীর জন্য
বন্দেগীহীন জীবন লজ্জাপূর্ণ।
জান্নাতের পথ এবং জাহান্নামের পথের মাঝে পার্থক্য
জাহান্নামের রাস্তায় রয়েছে প্রতিটি স্বাদযুক্ত ভোগের সামগ্রী, যেদিকে নফস ধাবিত হয়। মন যেদিকে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়। সেদিকে আছে দেখার তৃপ্তি, নিষিদ্ধ সৌন্দর্যের হাতছানি, সেদিকে আছে ভোগ আর স্বাদের নগ্ন আহবান, যে কোনো উপায়ে সম্পদ আহরণের সুযোগ, সেদিকে আছে বল্গাহীন স্বাধীনতা। নফস মুক্ত থাকতে ভালবাসে, বাধাকে অপছন্দ করে।
আর জান্নাতের পথে আছে কষ্ট, কাঠিন্য। সেপথে আছে সীমা এবং শিকল। সেপথে আছে নফসের বিরোধিতা। কিন্তু এই কষ্ট ও অপছন্দের বিনিময়ে আছে অনন্ত সুখ।
জান্নাতকে যেসব বিষয় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে 
এ ব্যাপারে একটি দীর্ঘ হাদীস রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা প্রথম যখন জান্নাত সৃষ্টি করলেন তখন জিবরাঈল আ.-কে পাঠালেন ঘুরে দেখে আসার জন্য। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পেয়ে তিনি গেলেন এবং জান্নাতের নাজ-নেয়ামত দেখে ফিরে এলেন। 
আসার পর তিনি আল্লাহ তাআলার সামনে জান্নাতের বর্ণনা দিয়ে বলেন
أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَا يَسْمَعُ بِهَا أَحَدٌ إِلَّا دَخَلَهَا
হে রব! আপনার ইজ্জতের কসম! এটি সম্পর্কে যেই শুনবে, সে তাতে প্রবেশ না করে ছাড়বে না। 
এরপর আল্লাহ তাআলা জান্নাতকে কষ্ট-ক্লেষ দিয়ে ঢেকে দেন। আবার আল্লাহ তাআলা জিবরাঈল আ.-কে নির্দেশ দিলেন যাও! পুনরায় জান্নাত থেকে ঘুরে এসো। অবস্থা প্রত্যক্ষ করে ফিরে এসে এবার জিবরাঈল আ. মন্তব্য করলেন
أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَقَدْ خَشِيتُ أَنْ لَا يَدْخُلَهَا أَحَدٌ
হে রব! আপনার মর্যাদার কসম! আমার অত্যন্ত ভয় হচ্ছে যে, কেউই তাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
জাহান্নামকে যেসব বিষয় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে 
জাহান্নাম সৃষ্টির বেলায়ও তেমনটি ঘটেছিল। আল্লাহ তাআলা জাহান্নামকে সৃষ্টির পর জিবরাঈল আ.-কে তা পরিদর্শনে পাঠান। সেখানে গিয়ে ভয়াবহ সব দৃশ্য দেখে এলেন। এসে মন্তব্য করলেন
أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَا يَسْمَعُ بِهَا أَحَدٌ فَيَدْخُلُهَا
হে আমার রব! আপনার ইজ্জতের কসম! জাহান্নামের ভয়াবহতা সম্পর্কে কেউ জানবে আর সে জাহান্নামে যাবে এমন কখনও হবে না।
এরপর আল্লাহ তাআলা জাহান্নামকে ঢেকে দিলেন বিভিন্ন মোহনীয় বস্তু দ্বারা। যার লোভ সামলানো মানুষের জন্য প্রায় অসম্ভব। 
তারপর আবার জিবরাঈল আ.-কে নির্দেশ দিলেন, যাও! জাহান্নাম পরিদর্শন করে এসো। আল্লাহর নির্দেশে জিবরাঈল আ. আবার জাহান্নাম পরিদর্শনে গেলেন। ফিরে এসে মন্তব্য করলেন
أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَقَدْ خَشِيتُ أَنْ لَا يَبْقَى أَحَدٌ إِلَّا دَخَلَهَا
আমার রবের ইজ্জতের কসম খেয়ে বলছি, আমার মনে হয় কোনো বান্দাই জাহান্নাম থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে না বরং সকলেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে। [আবু দাউদ : ৪৭৪৪]
হাদীসের মর্ম স্পষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা জাহান্নামে যাওয়ার উপকরণসমূহকে মানুষের সামনে লোভনীয় করে দিয়েছেন। যে কারণে মানুষের মন সর্বদা সেদিকেই ধাবিত হয়। আর জান্নাতে যাওয়ার উপকরণগুলোকে করেছেন তিক্ত ও অপ্রিয়। যার দরুণ মানুষের মন সে দিকে যেতে চায় না। বরং সে দিকে যেতে হলে মনের সঙ্গে কঠোর মেহনত ও মুজাহাদা করতে হয়। আর এর জন্য প্রয়োজন হয় আল্লাহর ভয় ও আখেরাতে জবাবদিহিতার বিশ্বাস। তাতে কোনোরূপ শিথিলতা দেখা দিলে মনের সঙ্গে পেরে ওঠা যে কারো জন্যই মুশকিল।
কোন পথে আগাবেন?
এখন আপনিই ঠিক করুন, আপনি কোন পথে আগাবেন!
মুআযযিন নামাযের দিকে আহ্বান করছেন; কিন্তু অলসতা আপনাকে পেয়ে বসেছে; মসজিদে যেতে মন চায় না। এখন আপনার সামনে দুটি পথ। মনকে শাস্তি দিয়ে মসজিদে যাবেন অথবা তার সামনে বশ্যতা স্বীকার করবেন। আপনি গ্রহণ করলেন দ্বিতীয় পথ— মনের কাছে হেরে গেলেন। তাই মসজিদে গেলেন না— শুয়ে রইলেন। ইতোমধ্যে কেউ এসে আপনার দরজার কড়া নাড়ল। এবার যে আপনাকে বিছানা ছাড়তেই হবে। বিছানা থেকে উঠলেন। বাইরে গেলেন। তার সাথে কথাবার্তা বললেন। তাহলে হলো কী? অবশেষে আপনার মনের বিপরীত কাজই করতে হলো। আরামকে মাটি করে দিয়ে আপনাকে উঠতেই হলো।
বোঝা গেল, কেউ ইচ্ছা করলেই মনচাহি জীবন যাপন করতে পারে না কিংবা কষ্ট থেকেও নিজেকে বাঁচাতে পারে না। সুতরাং আল্লাহ সন্তুষ্ট হন যে-পথে, সেই পথটা-ই গ্রহণ করা উচিত। আরামকে হারাম করে মসজিদে যাওয়াটা-ই অধিক শ্রেয়।
এ-সময়ে যদি প্রেসিডেন্টের বার্তা আসে?
আরেফ বিল্লাহ হযরত ডাক্তার আবদুল হাই রহ. বলতেন, ভাই, মসজিদে গিয়ে নামায পড়তে কিংবা দীনের অন্য কোনো কাজ করতে গেলে যদি তোমার মাঝে অলসতা আসে— ধরো, ফজর কিংবা তাহাজ্জুদের নামাযের সময় তোমার ঘুম ভেঙে গেল; কিন্তু চোখে ঘুম, উঠতে কষ্ট হচ্ছে, তখন একটু ভাবো, ঘুমের এই ঘোরের মধ্যে যদি তোমার কাছে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে কোনো বার্তা আসে, যদি বলা হয়, প্রেসিডেন্ট তোমাকে ডেকেছে, বড় কোনো পদক তোমাকে দেওয়া হবে। বলো তো তখন তোমার ঘুম যাবে কোথায়? নিশ্চয়ই ঘুম, অলসতা সবই পালাবে।
কিন্তু কেন? যেহেতু প্রেসিডেন্টের সম্মান আর পদকের মর্যাদা সম্পর্কে  তোমার জানা আছে। তাই মন চাইলেও এখন আর বিছানায় শুয়ে থাকবে না; বরং পারলে দৌড়ে যাবে আর ভাববে, সুযোগ তো সব সময় আসে না; তাই এই মহা সুযোগ আলসেমির কারণে নষ্ট করে দেওয়া যাবে না।
আরে ভাই! দুনিয়ার প্রেসিডেন্ট থেকে পদক লাভের আশায় যদি তুমি এভাবে গাফলতি ছুড়ে ফেলতে পার, তাহলে বিশ্বজাহানের প্রভু মহান আল্লাহকে খুশি করার জন্য কি ক্ষণিকের আরামও ছাড়তে পারবে না? যেভাবেই হোক, তোমাকে যখন আরাম ছাড়তেই হয়, তাহলে কি এই ছাড়টা একটু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে করা যায় না?
মহান আল্লাহ তাঁর সঙ্গী হয়ে যাবে 
এই পয়গামই ছিল আম্বিয়ায়ে কেরামের। তাঁরা মানুষকে নফসের সঙ্গে লড়াই করার অভ্যাস গড়ে তোলার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এরই নাম মুজাহাদা তথা সাধনা। সাধনার এই পথে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আমাদের চলতেই হয়, তাহলে এপথে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় চলাটাই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এর কোনো লাভ আমরা দেখতে না পেলেও আল্লাহ তাআলা ওয়াদা করেছেন
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا
যারা আমার পথে মুজাহাদা-সাধনা করবে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করব।
কাজ সহজ হয়ে যাবে
আল্লাহ তাদের সাথী হন কীভাবে? এভাবে যে, প্রথমদিকে নফসের এ বিরোধিতা কঠিন মনে হতো, স্বভাববিরোধী কাজ করা কষ্টকর হতো। কিন্তু আল্লাহর তাআলার ওপর ভরসা করে তাঁর পথে চলার ওপর বদ্ধপরিকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই কঠিন ও কষ্টকর বিষয়ও সহজ হয়ে যায়। সহজটা স্বয়ং আল্লাহ করে দেন। 
যেমন— এক ব্যক্তির কাছে নামায পড়া কষ্টকর মনে হতো। পাঁচ ওয়াক্ত নামায তার কাছে এক মহা ঝামেলার বিষয় মনে হতো। কিন্তু নফসের সাথে লড়াই করে নামায পড়া শুরু করে দিল। কিছুদিন যেতে-না-যেতে সে নামাযে অভ্যস্ত হয়ে গেল। নামায এখন আর তার কাছে কষ্টকর মনে হয় না। বরং কেউ হাজার টাকার বদৌলতেও নামায ছাড়ার কথা বললে সে সম্মত হবে না। কেন হবে না? যেহেতু শুরুর দিকে নামায পড়া তার কাছে কষ্টকর মনে হলেও পরবর্তী সময়ে নিয়মিত পড়ার কারণে তা সহজ হয়ে গেছে। আর সহজ করে দিয়েছেন আল্লাহ।
সামনে অগ্রসর হও
দীনের সম্পূর্ণ বিষয়টি এমনই। বসে-বসে ভাবতে থাকলে কঠিনই মনে হবে। কিন্তু দীনের পথে চলা আরম্ভ করলে আল্লাহ সহজ করে দেন। 
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এ-প্রসঙ্গে সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত পেশ করতেন। একটা দীর্ঘ সরু পথ, দোধারে গাছের সারি। ডানে-বামে বৃক্ষরাজি। এমন একটা পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে মনে হবে, একটু পরেই পথটা মিলিয়ে গেছে, যেখান থেকে সামনে যাওয়ার পথ একেবারেই বন্ধ। এই অবস্থা দেখে কোনো নির্বোধ যদি মনে করে, যেহেতু একটু পরেই পথটা মিলিয়ে গেছে, তাই এপথে চলা অযথা। এমন মনে করলে লোকটি কখনও লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারবে না। আপন লক্ষ্যস্থলে তো সে-ই পৌঁছতে পারবে, যে সামনে পথ বন্ধ দেখেও তার তোয়াক্কা না করে সাহসিকতার সাথে এগুতে থাকবে।
যখন সে চলা শুরু করবে, তখন অনুধাবন করতে পারবে, পথ বন্ধ হয়ে যাওয়াটা ছিল চোখের একটা ধোঁকা। প্রকৃতপক্ষে সামনে এগুতে থাকলেই বোঝা যেত যে, পথ বন্ধ হয়নি। 
তেমনি দীনের ওপর যারা চলতে চায় তাদের আল্লাহ বলেন, দীন থেকে দূরে বসে থাকলে মনে হবে দীনের পলে চলা মুশকিল। দূর থেকে মুশকিল মনে করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকো না বরং সামনে বাড়তে থাকো, দেখতে পাবে, এপথে চলা কত সহজ। সহজ তো করবেন আল্লাহই। তোমার প্রয়োজন শুধু মনচাহি জীবনের উল্টো দিকে চলার হিম্মত আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞার। আর একেই বলে মুজাহাদা বা সাধনা।
বৈধ কাজ থেকে বেঁচে থাকাও মুজাহাদা
অবৈধ ও শরীয়তপরিপন্থি কাজ থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখা-ই প্রকৃত মুজাহাদা। কিন্তু আমাদের নফস যেহেতু আরাম-আয়েশ, আশা-আকাংখা ও ভোগ-বিলাসিতায় অভ্যস্ত এবং এত বেশি অভ্যস্ত যে, এই নফসকে শরীয়তের প্রতি টেনে আনতে চাইলেও সে আসে না, তাই এখন তাকে পরাজিত করতে হলে, আল্লাহর নির্দেশিত বিধিবিধানের সামনে বশ্যতা স্বীকার করাতে হলে, প্রয়োজন হবে মাঝেমধ্যে বৈধ জিনিসকেও পরিত্যাগ করার। 
কারণ বৈধ জিনিস থেকেও যখন তাকে মাঝেমধ্যে বঞ্চিত রাখা হবে, তখন সে আস্তে-আস্তে অবৈধ কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করার যোগ্যতাও অর্জন করে নেবে। তখন নিজেকে অবৈধ কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখা সহজ হবে। সূফীগণের পরিভাষায় একেই বলা হয় মুজাহাদা। যেমন— পেট ভরে খাওয়া গুনাহের কাজ নয়। অথচ সূফীগণ বলেছেন, পেট ভরে খেয়ো না। পেট ভরে খেলে নফস অলস ও অকর্মা হয়ে পড়বে, মজার-মজার জিনিসের প্রতি লোভাতুর হবে; তাই নফসকে সুস্থ রাখার জন্য আহার কিছুটা কমিয়ে দাও। এটিও মুজাহাদা।
বৈধ কাজেও মুজাহাদা কেন?
হযরত মাওলানা ইয়াকুব রহ.-কে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হযরত। সূফীগণ বৈধ কাজ থেকেও বিরত থাকতে বলেন; অথচ আল্লাহ বৈধ করেছেন; এটা কেমন কথা? 
উত্তরে হযরত বললেন, দেখো, বিষয়টির দৃষ্টান্ত কিতাবের এই পাতাটির মতো। পাতাটিকে তুমি মুড়িয়ে নাও। লোকটি মুড়িয়ে নিল। 
হযরত বললেন, আচ্ছা, এবার একে আগের মতো সোজা করো। 
কিন্তু এখন আর সোজা হয় না। চেষ্টা করেও লোকটি সোজা করতে পারল না।
হযরত বললেন, সোজা করার উপায় হলো, পাতাটিকে উল্টো দিকে মুড়িয়ে নাও। দেখবে সোজা হয়ে গেছে। 
তারপর তিনি বললেন, নফসের কাগজও গুনাহের দিকে পাঁক খেয়ে আছে। এখন তাকে সোজা করতে গেলে সোজা হবে না। তাকে তার কামনা-বাসনা থেকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দাও, পাশাপাশি কিছু বৈধ কাজও ছেড়ে দাও, যার ফলে দেখবে, সে সম্পূর্ণ সোজা হয়ে সঠিক পথে চলে এসেছে। আর এটিও মুজাহাদা।
চার বিষয়ে মুজাহাদা
প্রসিদ্ধ আছে, সূফীগণের দরবারে চারটি বিষয়ে মুজাহাদা হয়।
১. تَقْلِيلُ الطَّعَامِ কম খাওয়া।
২. تَقْلِيلُ الْكَلامِ কথা কম বলা।
৩. تَقُلِيلُ الْمَنَامِ কম ঘুমানো।
৪. تَقْلِيلُ الْإِخْتِلَاطِ مَعَ الْأَنَامِ মানুষের সাথে মেলামেশা কম করা।
স্বল্প আহারের পরিসীমা 
تَقْلِيلُ الطَّعَامِ কম খাওয়া। আগের যমানায় সূফীগণ কম আহারের প্রতি খুবই গুরুত্ব দিতেন এবং কঠিন-কঠিন মুজাহাদা করাতেন। এমনকি কোনো-কোনো সময় মানুষ ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ত। 
কিন্তু হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. বলেছেন, এই যমানায় এ-রকম মুজাহাদা করা যাবে না। এখন এমনিতেই মানুষের পেশীশক্তি দুর্বল। তার ওপর যদি খাবারও কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে। ফলে এমনও হতে পারে, আগে যে-ইবাদত করত, এখন আর তা-ও পারবে না। তাই বর্তমানে একটি কাজ করলে স্বল্প আহারের উদ্দেশ্য অর্জন হয়ে যাবে। অর্থাৎ খাবারের সময় একটা সময় আসে, যখন মানুষ দ্বিধায় পড়ে যায়, আরও খাব কি খাব না? আরেকটু নেব কি নেব না? এই দ্বিধার মুহূর্তটি আসলে তখন আর খেয়ো না। এভাবেই সূফীগণের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে।
সীমাতিরিক্ত পানাহার থেকে সাবধান
উমর রাযি. বলেন
إِيَّاكُمْ وَالْبِطْنَةَ مِنَ الطَّعَامِ 
তোমরা সীমাতিরিক্ত পানাহার থেকে সাবধান থাক।
فَإِنَّهَا مَكْسَلَةٌ عَنِ الصَّلَاةِ
কেননা অতিরিক্ত পানাহার নামায থেকে অলসকারী।
مُفْسِدَةٌ لِلِجَسَدِ
শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
مُوَرِّثَةٌ لِلسَّقَمِ
রোগ সৃষ্টিকারী।
وَأَنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يُبْغِضُ الْحَبْرَ السَّمِينَ
আল্লাহ তাআলা ভুঁড়িওয়ালা লোককে অপসন্দ করেন।
 وَلَكِنَ عَلَيْكُمْ بِالْقَصْدِ فِي قُوتِكُمْ 
তোমরা পানাহারের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। 
فَإِنَّهُ أَدْنَى مِنَ الْإِصْلَاحِ وَأَبْعَدُ مِنَ السَّرَفِ
কেননা পরিমিত পানাহার শরীরের জন্য উপকারী এবং অপচয় থেকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। [ইবনু মুফলিহ আল-মাক্বদিসী, আল-আদাবুশ শারইয়্যাহ : ২/২০১]
পেট ভরে খাওয়া 
ভালোভাবে পেট ভরে খাওয়া যদিও ফেকহি দৃষ্টিকোণ থেকে নাজায়েয বা হারাম নয়; কিন্তু শারীরিক ও আত্মিক ব্যাধি সৃষ্টি করার কারণ তো অবশ্যই। কারণ, সমূহ নাফরমানি ও গুনাহের চিন্তা পেট ভরা থাকলেই বেশি হয়। মানুষ যদি পেটে দানাপানি ঠিকমতো না দিতে পারত, তাহলে গুনাহের চিন্তা-পরিকল্পনাও কমে যেত। এজন্য বেশি খাওয়া দেখলে রাসূল ﷺ খুব বিরক্ত হতেন। তিনি বলতেন
اَلمُؤْمِنُ يَأْكُلُ فِيْ مِعًى وَاحِدٍ وَالكَافِرُ يَأْكُلُ فِيْ سَبْعَةِ أَمْعَاءٍ
মুমিন অল্প খায়, এক পেটে খায়। আর কাফির সাত পেটে ভরে খায়। [সহীহ বুখারী : ৫৩৯৩]
কম খাওয়া দায়েমি সুন্নাত
এজন্য কম খাওয়া নবীজী ﷺ-এর দায়েমি সুন্নাত। নিয়মিত সুন্নাত। নবীজী ﷺ উম্মতকে কম খাওয়ার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে ঈমানদারের নীতি হবে মনের চাহিদা কিংবা চোখের ক্ষুধা থেকে নয়; বরং শরীরের চাহিদা অনুযায়ী খাবে; যাতে সে দুনিয়ার পেশাগত কার্যক্রম ও ইবাদত-বন্দেগি স্বাভাবিকভাবে করতে পারে। সুতরাং তৃপ্তি মিটিয়ে উদরপূর্তি করে খাবে না। আর এরই নাম কম খাওয়ার সাধনা। 
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন
بِحَسْبِ ابْنِ آدَمَ أُكُلَاتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهُ فَإِنْ كَانَ لَا مَحَالَةَ فَثُلُثٌ لِطَعَامِهِ وَثُلُثٌ لِشَرَابِهِ وَثُلُثٌ لِنَفَسِهِ
যতটুকু খেলে তোমার পুষ্টিশক্তি নিশ্চিত হয়, ততটুক খাও। খাওয়ার উদ্দেশ্য পুষ্টি। খাওয়ার উদ্দেশ্য সুস্থতা। যদি কেউ বেশি খেতেই চাও, যদি কেউ বেশি খেতে চাও, তাহলে পেটটাকে তিন ভাগ করো। এক ভাগ খাদ্যের জন্যে, এক ভাগ পানীয়ের জন্যে, এক ভাগ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখো। [তিরমিযী : ২৩৮০]
নফল রোযা রাখা
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ বিশেষভাবে যুবক-সম্প্রদায়কে নফল রোযার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। এটাও একপ্রকার কম খাওয়ার মুজাহাদা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ ، مَنِ اسْتَطَاعَ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ
হে যুবক সম্প্রদায় ! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিবাহ করে। কেননা, বিবাহ তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং যৌনতাকে সংযমী করে এবং যাদের বিবাহ করার সামর্থ্য নেই, সে যেন রোযা পালন করে। কেননা, রোযা তার যৌনতাকে দমন করে। [সহীহ বুখারী : ৪৯৯৬]
প্রয়োজনে ক্ষুধার্ত থাকা
প্রয়োজনে ক্ষুধার্ত থাকার শিক্ষাও হাদীসে রয়েছে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং তার পরিবার পুরা জীবনে অনেক দিন ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন সময় ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন অতিবাহিত করেছেন এবং হাসিমুখে এই অবস্থাকে বরণ করেছেন। 
এর কারণে কিন্তু তাঁদের আমলে বা ইবাদতে কোনো প্রভাব পড়েনি; বরং ক্ষুধার্ত থাকাই তাদেরকে আরও বেশি আল্লাহঅভিমুখী করেছে এবং ইবাদতের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে।
আয়শা রাযি. বলেন যে, আমরা একচাঁদ দেখেছি, দুইচাঁদ দেখেছি, তিনচাঁদ দেখেছি, বাড়িতে চুলা জ্বালানোর মতো কোনো খাদ্য রান্না হয়নি। রুটিও বানানো হয়নি, গোশতও রান্না করা হয়নি। তরকারিও রান্না করা হয়নি। আগুন জ্বালানো হয়নি। আমরা কী করতাম? পানি এবং খেজুর খেয়ে থেকেছি। 
তবে আমাদের কিছু পড়শি আনসারী ছিলেন, তাঁরা মাঝেমাঝে আমাদের কিছু হাদিয়া দিতেন। হয়তো দুধ দিতেন, হয়তো একটু তরকারি দিতেন। এগুলো আমরা খেতাম। [সহীহ বুখারী : ২৫৬৭]
কথা কম বলাও মুজাহাদা
মুজাহাদার দ্বিতীয় প্রকার হলো تَقْلِيلُ الكَلامِ তথা কথা কম বলা। 
সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের কথা থেমে নেই। নিরবচ্ছিন্ন গতিতেই চলছে আমাদের জবান, মুখে যা আসে তা-ই বলে দিচ্ছি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে, এটা ঠিক নয়। 
যেহেতু যবানকে এভাবে বল্গাহীন ছেড়ে দিলে, তাকে কাবু না করলে গুনাহ তো হবেই। উমর রাযি. বলতেন
وَمَنْ كَثُرَ كَلَامُهُ كَثُرَ سَقْطُهُ
যার কথা বেশি, তার ভুল বেশি। [মাজমাউয-যাওয়াইদ : ১৮১৭৩]
জিহ্বা হিংস্র একটা জীবের মতো
শায়খ বকর ইবনু আবদুল্লাহ আল-মুজানি রহ.-কে চুপ থাকা নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি এত দীর্ঘ সময় চুপ থাকেন কেন? 
তিনি জবাব দেন, আমার জিহ্বা হিংস্র একটা জীবের মতো- যদি আমি ছেড়ে দিই; তাহলে এটা আমাকে খেয়ে ফেলবে। 
কবি বলেন
احْفَظْ لِسَانَكَ أَيُّهَا الإِنْسَانُ
لَا يَلْدَغَنَّكَ؛ إِنَّهُ ثُعْبَانُ
হে মানুষ! জিহবাকে সংযত রাখ। তোমার জিহবা একটা বিষাক্ত সাপের মতো, সে যেন তোমাকে ছোবল না মারে।
কম কথা বলা একটি পরিশ্রমহীন ইবাদত
কম কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নবীজী ﷺ-এর দায়েমি সুন্নাত। অথচ ইবাদতটি করতে কোনো পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। নবীজী ﷺ-এর অন্যতম গুণ ছিল, প্রয়োজন ছাড়া তিনি কথা বলতেন না। দীর্ঘক্ষণ নীরব থাকতেন। 
একবার সিমাক রহ. জাবের ইবনু সামুরা রাযি.-কে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর সোহবতে ছিলেন? 
তিনি বলেন, হ্যাঁ। রাসূল ﷺ অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন। খুব কম বলতেন। [মুসনাদে আহমদ: ৬৩০৮]
যবানের গুনাহ হতে নিষ্কৃতি পাবে
মানুষকে কথা কম বলার সাধনা এজন্যই করতে হয় যে, যবান থেকে যেন অযথা কথা বের না হয়। মাপকাঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় কথা বলবে। বলার পূর্বে চিন্তা করবে, কথাটি বলা আমার উচিত হচ্ছে কি? গুনাহের কথা বলে ফেলছি না তো? 
প্রয়োজন ছাড়া মানুষ কথা না বললে ধীরে-ধীরে স্বল্পভাষী হওয়ার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। অহেতুক বকবক করতে মন চাইলেও তখন যবানকে কাবু করে রাখা সহজ হয়। মিথ্যা, গীবত এবং যবানের অন্যান্য গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়।
জ্ঞানী ব্যক্তির জিহ্বা 
এজন্য হাসান বসরী রহ. বলতেন
لِسَانُ الْعَاقِلِ مِنْ وَرَاءِ قَلْبِهِ ،فَإِذَا أَرَادَ الْكَلامَ ؛ تَفَكَّرَ ، فَإِنْ كَانَ لَهُ قَالَ ، وَإِنْ كَانَ عَلَيْهِ أَمْسَكَ ، وَقَلْبُ الْجَاهِلِ مِنْ وَرَاءِ لِسَانِهِ ، فَإِنْ هَمَّ بِالْكَلامِ ؛ تَكَلَّمَ ، لَهُ وَعَلَيْهِ
জ্ঞানী ব্যক্তির জিহ্বা থাকে তার হৃদয়ের পেছনে। তাই সে কথা বলার ইচ্ছা করলে প্রথমে চিন্তা করে দেখে। কথাটি তার উপকারী হলে বলে, অন্যথায় চুপ করে থাকে।
আর মূর্খ ব্যক্তির হৃদয় থাকে তার জিহ্বার পেছনে। তাই সে যখনই কোনো কথা বলার ইচ্ছা করে চিন্তা ভাবনা করা ছাড়াই বলে ফেলে। [আলবায়ান ওয়াততাবয়ীন : ১/১৫৫]
বৈধ বিনোদনের অনুমতি
অহেতুক কথাবার্তার যে-মজলিস হয়, বর্তমান পরিভাষায় যাকে বলা হয় গল্পের মজলিস। কোনো বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা হলে বলা হয়, আসো, বসে একটু গল্প করি। 
এই অহেতুক গালগপ্পো মানুষকে গুনাহের প্রতি ধাবিত করে। হ্যাঁ বিনোদনের কম-বেশির অনুমতি ইসলাম আমাদের দিয়েছে। বরং নবী ﷺ তো এ-ও বলেছেন
روِّحوا القُلوبَ ساعةً وساعةً
অন্তরগুলোকে মাঝেমধ্যে বিনোদন দাও। [কানযুল উম্মাল : ৫৩৫৪]
কিছুটা আরাম-আনন্দেরও প্রয়োজন আছে
শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, নবীজির শিক্ষার জন্য উৎসর্গিত হোক। আমাদের জীবন, আমাদের স্বভাব, প্রকৃতি ও প্রয়োজন সম্বন্ধে তাঁর চেয়ে বেশি আর কে জানে! তিনি জানেন, মানুষ যেহেতু মানুষই; ফেরেশতা তো নয়, তাই তাদের যদি বলা হয়, দিবানিশি আল্লাহর যিকিরে ব্যস্ত থাকবে, এছাড়া অন্য কোনো কথা বলা নিষেধ, তাহলে তারা তা করবে না। 
তাদের কিছুটা আরাম-আনন্দেরও প্রয়োজন আছে। বিধায় ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে একটু খোশগল্প তাদের জন্য শুধু জায়েযই নয়; বরং নবীজির পছন্দও। এটি সুন্নাতও। 
তবে খোশগল্পে ডুবে যাওয়া, ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা ব্যয় করা, মূল্যবান সময় নষ্ট করা মোটেই উচিত নয়। তাহলে এই ব্যাপারটা তাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে যাবে গুনাহের পথে। তাই বলা হচ্ছে, তোমরা স্বল্পভাষী হও। আর এটাও মুজাহাদারই অন্তর্ভুক্ত।
মেহমানের সাথে খোশগল্প করা সুন্নত
আমাদের বুজুর্গদের নিয়ম ছিল, কোনো মেহমান এলে তাকে সম্মান করতেন তার কথাবার্তা শোনা এবং যথাসম্ভব আরামের প্রতি সবিশেষ মনোযোগ দিতেন। যদিও একজন ব্যস্ত মানুষের পক্ষে কাজটি কঠিন। 
আর যাদের জীবন ছিল হাজারো ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ তাদের পক্ষে তো আরও কঠিন। কিন্তু হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নিকট কোনো আগন্তুক এসে কথা বলা আরম্ভ করলে তিনি ধৈর্যসহকারে শুনতেন। 
তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন না, যতক্ষণ-না সে নিজে মুখ ফিরিয়ে নেয়। হাদীসের ভাষ্য ঠিক এরকম
حَتَّى يَكُونَ هُوَ الْمُنْصَرِفُ
যতক্ষণ না আগন্তুক নিজে চলে যায়। [শামাঈলে তিরমিযী : ২২৫]
কাজটি সত্যিই কষ্টকর। কারণ অনেকের অভ্যাস দীর্ঘক্ষণ গল্প করার, তখন তার কথা পুরোপুরি মনোযোগের সাথে শোনা নিতান্তই বিরক্তিকর। 
এতদসত্ত্বেও এটি রাসূল ﷺ-এর সুন্নাত বিধায় আমাদের বুজুর্গগণ আগন্তুকের কথা শুনতেন এবং তাকে উল্লসিত করতেন।
মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ.
হযরত মুফতী মোহাম্মাদ শফী রহ.-এর নিকট এক ভদ্রলোক আসা-যাওয়া করতেন। তিনি খুব বেশি কথা বলতেন। এসেই তিনি এটা-সেটা বলা শুরু করে দিতেন। থামার যেন নামই নিতেন না।  
কিছুদিন পর ভদ্রলোক মুফতী শফী রহ.-এর কাছে আবেদন জানালেন, হযরত! আমি আপনার সাথে ইসলাহী সম্পর্ক করতে চাই। আমাকে কিছু আমল অথবা তাসবীহ বলে দিন। 
মুফতী সাহেব বললেন, তোমার জন্য বিশেষ কোনো আমল অথবা তাসবীহ নেই। তোমার কাজ শুধু জবানকে নিয়ন্ত্রণ করা। আজ থেকে মুখে তালা লাগাও এবং অহেতুক বকবক করার অভ্যাস বর্জন করো। 
এটা তোমার ত্রুটি। আজ থেকে এখানে এলে চুপ করে বসে থাকবে। অপ্রয়োজনীয় কথা বলা এখন থেকে তোমার জন্য নিষেধ।
অবশেষে এ-জাতীয় বাধ্যবাধকতার ফলে কেমন যেন তার ওপর তুফান নেমে এল। নীরবে বসে থাকার এই সাধনা তার জন্য হাজারো সাধনার চেয়েও কষ্টসাধ্য মনে হলো। কোনো কথা বলতে মনে চাইলেও বাধ্য হয়েই নিশ্চুপ থাকতে হতো। চিকিৎসার এই পদ্ধতির মাধ্যমে মহান আল্লাহ তার হাজারো আত্মিক ব্যাধি দূর করে দিয়েছিলেন।
মূলত মুফতী শফী রহ. উপলব্ধি করেছিলেন, তার মৌলিক ব্যাধি এটিই। এই ব্যাধি বশীভূত করতে পারলে তার জন্য অন্যসব চিকিৎসা যথেষ্ট সহজ হয়ে যাবে। হলোও তা-ই। কিছুদিন পরই আল্লাহ তার অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটালেন। 
মূলত সকলের ব্যাধি এক নয়। অবস্থার অনুপাতে একেকজনের চিকিৎসা হয় একেক রকম। কার জন্য কেমন চিকিৎসার প্রয়োজন পীর বা শায়েখ তা নির্ণয় করে দেন। 
সারকথা, কথা কম বলাও একটা মুজাহাদা বা সাধনা।
ঘুমের নিয়ন্ত্রণ
তৃতীয় মুজাহাদা হলো تَقْلِيلُ الْمَنَامِ মানে, কম ঘুমানো। এক্ষেত্রেও ওই একই কথা। আগেকার যুগে তো বিনিদ্র থাকাই ছিল মুজাহাদা। পবিত্র কোরআনেও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণাবলিতে রাত্রি জাগরণ করার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন 
وَ الَّذِیۡنَ یَبِیۡتُوۡنَ لِرَبِّهِمۡ سُجَّدًا وَّ قِیَامًا
এবং তারা রাত অতিবাহিত করে তাদের রব-এর উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে। [সূরা ফুরকান : ৬৪]
এশার অযু দ্বারা ফজর নামায
এজন্যই সাহাবায়ে কেরাম এবং প্রথম যুগের বুজুর্গ আলেমদের কেউ কেউ সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন। তাদের কেউ কেউ এশার অযুতে ফজর নামায পড়তেন।
প্রসিদ্ধ আছে, ইমাম আবু হানীফা রহ. এশার অযু দ্বারা ফজর নামায পড়তেন।
রাত জেগে তারা আত্মার প্রশান্তি লাভ করেন। অধিক রাত জাগরণের কারণে তারা ক্লান্ত হন না।
অতিরিক্ত ঘুম একপ্রকার রোগ
সালাফ তথা পূর্বসূরি নেক বান্দারা আল্লাহ তাআলার কাছে এভাবে দোয়া করতেন 
اللَّهُمَّ اشْفِنِي مِنَ النَّوْمِ بِالْيَسِيرِ ، وَارْزُقْنِي سَهَرًا فِي طَاعَتِكَ
হে আল্লাহ! আমাকে সামান্য ঘুম দিয়ে আরোগ্য দান করুন এবং আপনার আনুগত্যে জেগে থাকার তাওফিক দান করুন। [হিলয়াতুল  আউলিয়া  : ৪/১৭৮]
অর্থাৎ তাঁরা অতিরিক্ত ঘুমকে একপ্রকার রোগ মনে করতেন, তাই আল্লাহ তাআলার কাছে এ থেকে আরোগ্য কামনা করতেন এবং সামান্য ঘুমেই ক্লান্তি দূর হয়ে যাওয়ার দোয়া করতেন। 
তাহাজ্জুদ, যিকির এবং আল্লাহর পথে জেগে থাকার তাওফিক প্রার্থনা করতেন।
ফুযাইল ইবনু ইয়ায রহ.
ফুযাইল ইবনু ইয়ায রহ. এক দিন হুসাইন ইবনু যিয়াদ রহ.—এর হাত ধরে বলেন, শোনো হুসাইন!
يَنْزِلُ اللهُ تَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُولُ الرَّبُّ : كَذَبَ مَنْ ادَّعَى مَحَبَّتِي إِذَا جَنَّهُ اللَّيْلُ نَامَ عَنِّي ؟ أَلَيْسَ كُلُّ حَبِيبٍ يُحِبُّ خَلْوَةَ حَبِيبِه ؟
আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক রাতে দুনিয়ার আসমানে আসেন। তারপর বলতে থাকেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি ভালোবাসার দাবী করে অথচ রাতের গভীরে ঘুমিয়ে থাকে; সে মূলত মিথ্যা দাবী করল। প্রত্যেক প্রেমিক কি তার প্রেমাষ্পদের সঙ্গে একান্ত সময় কামনা করে না! [হিলয়াতুল  আউলিয়া  : ৮/৯৯, ১০০]
কত ঘুমাবি! কবে জাগবি!
রাবেয়া বসরী রহ. রাতভর নামায পড়তেন। সুবহে সাদিকের সময় জায়নামাযে বসেই ফজর পর্যন্ত হাল্কা ঘুমিয়ে নিতেন। পুনরায় চোখ খুলতেই দ্রুত ওঠে যেতেন এবং নিজেকে সম্বোধন করে বলতেন  
يَا نَفْسُ كَمْ تَنَامِينَ ، وَإِلَى كَمْ تَقُومِينَ ، يُوشِكُ أَنْ تَنَامِي نَوْمَةً لَا تَقُومِينَ مِنْهَا إِلَّا لِيَوْمِ النُّشُورِ
আহা! আর কত ঘুমাবি! কবে জাগবি! মনে হয়, তোকে কেয়ামতের বিকট আওয়াজই জাগাতে পারবে!
রাবেয়া বসরী রহ.-এর খাদেমা আবদাহ, যিনি নিজেও একজন নেককার মহিলা ছিলেন। বলেন, রাবেয়াকে মরণ পর্যন্ত এমন করতে দেখেছি। [সিফাতুস সাফওয়া : ০২/২৫১]
কেয়ামতের সঙ্গে রাতের কতই না মিল
সালাফের যুগে একজন আবেদা ছিলেন। নাম ছিল মুনিরাহ রহ.। তাঁর সব সময়ের অভ্যাস ছিল, যখন রাত নেমে আসতো, বলতেন
قَدْ جَاءَ الهَوْلُ، قَدْ جَاءَتِ الظُّلْمَةُ، قَدْ جَاءَ الخَوْفُ، وَمَا أَشْبَهَ هَذَا بِيَوْمِ القِيَامَةِ؟
‘আতঙ্ক এসে গেছে। অন্ধকার ছেয়ে গেছে। ভয় এসে পড়েছে। কেয়ামতের সঙ্গে এর কতই না মিল!’ 
এরপর তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। ভোর পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে নামায পড়তেন। [মাউসুআ’ লি ইবনি আবিদ্দুনয়া : ১/২৬৯]
কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা ঘুম
কিন্তু পরবর্তী বুজুর্গানে দীন কম ঘুমানো প্রসঙ্গে বলেছেন, দিবা-রাত্রি কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। ছয় ঘণ্টারও কম ঘুমে মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে। ডাক্তাররাও বলে থাকেন, দীর্ঘদিন ধরে ৬ ঘণ্টা বা তার কম সময় ঘুমালে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল বৃদ্ধির মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
অসময়ে ঘুমানোর অভ্যাস ছাড়তে হবে
আর হযরত থানভী রহ. বলতেন, কারও যদি অসময়ে ঘুমানোর অভ্যাস থাকে, তাহলে তাকে তা ত্যাগ করতে হবে। আর এটিও তখন মুজাহাদা হবে। যেমন— 
অনেকের অভ্যাস আছে তারা সকাল বেলা ঘুমায়। অজুহাত পেশ করে, এই সময় না ঘুমালে মাথা ব্যথা করে। সারাদিন কাজে মন বসে না। সব কিছু আউলাঝাউলা লাগে। মূলত এরা জানে না যে, সকাল বেলার ঘুম একজন মানুষের জন্য কী পরিমাণ ক্ষতিকর।
সকাল বেলা ঘুমালে কী ক্ষতি হয়?
সকাল বেলা ঘুমালে ওই বরকত থেকে বঞ্চিত হতে হয়, যে বরকতের দোয়া রাসূলুল্লাহ ﷺ করেছেন।
সখর গামেদি রাযি. সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ এ দোয়া করেছেন
اللَّهُمَّ بَارِكْ لأُمَّتِي فِي بُكُورِهَا
‘হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য দিনের শুরু বরকতময় করুন।’
বর্ণনাকারী বলেন, এ জন্যই রাসূলুল্লাহ ﷺ কোনো যুদ্ধ অভিযানে বাহিনী পাঠানোর সময় দিনের শুরুতে পাঠাতেন। 
আর সখর রাযি. ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনিও তাঁর ব্যবসায়ী কার্যক্রম ভোর বেলা শুরু করতেন। এতে তাঁর ব্যবসায় অনেক উন্নতি হয় এবং তিনি সীমাহীন প্রাচুর্য লাভ করেন। [আবু দাউদ : ২৬০৬]
উরওয়া ইবনু যুবাইর রহ. বলেন, যুবাইর রাযি. তাঁর সন্তানদেরকে সকাল বেলা ঘুমানো থেকে নিষেধ করতেন। উরওয়া রহ. বলেন
إِنِّي لَأَسْمَعُ بِالرَّجُلِ يَتَصَبَّحُ فَأَزْهَدُ فِيهِ
আমি যখন কারো সম্পর্কে শুনি, সে সকাল বেলা ঘুমায় তখন তার প্রতি আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। [মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা : ৫/২২২]
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. তাঁর এক সন্তানকে সকাল বেলা ঘুমাতে দেখে বলেছিলেন
أَتَنَامُ فِي السَّاعَةِ الَّتِي تُقْسَمُ فِيهَا الأَرْزَاقُ؟
ওঠো, তুমি কি এমন সময়ে ঘুমিয়ে আছ, যখন রিযিক বণ্টন করা হচ্ছে। [যাদুল মাআ’দ : ৪/২৪১]
ভোরের বাতাসের উপকারিতা
তাছাড়া ভোরের বাতাসে টাটকা অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে, যা শরীর-মনে সতেজতা নিয়ে আসে।
যুক্তরাজ্যে ৪ লাখ ৩৩ হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, ভোরে ওঠা ব্যক্তিদের চেয়ে দেরিতে ওঠা মানুষের অকাল মৃত্যুর আশঙ্কা ১০ শতাংশ বেশি।
আসরের পরের ঘুম
অনুরূপভাবে আসরের পরের ঘুমও অসময়ের ঘুম। যার কারণে এসময়ে ঘুমানোর ব্যাপারেও হাদীসে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
مَنْ نَامَ بَعْدَ الْعَصْرِ، فَاخْتُلِسَ عَقْلُهُ، فلا يَلُومَنَّ إِلَّا نَفْسَهُ
যে ব্যক্তি আসরের পর ঘুমায় আর তার বুদ্ধি কমে যায়, তবে সে যেন নিজেকে তিরস্কার করে। 
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ঘুম নিয়ন্ত্রণ করার তাওফিক দান করুন— আমীন।
মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক কম রাখা
চতুর্থ মুজাহাদা تَقْلِيلُ الْإِخْتِلَاطِ مَعَ الْأَنَامِ মানে, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা কম করা। এর অর্থ একেবারে সমাজ ও দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যাওয়া নয়; বরং প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পর্ক এড়িয়ে চলা। অত্যধিক মেলামেশা থেকে বেঁচে থাকা।
মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বর্জন কখন উচিত নয়?
অন্যথায় ইসলাম আমাদের শেখায় তিন পরিস্থিতিতে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা নিষেধ নয়।
এক. পরিবারের প্রয়োজনে। 
দুই. সমাজের কল্যাণে।
তিন. দীনের প্রয়োজনে।
মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সময় আচরণ কেমন হবে?
উক্ত তিন প্রয়োজনে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা নিষেধ নয়। মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও চলাফেরা করতে গেলে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া চাই; আমরা তা একটি ঘটনার মাধ্যমে বুঝে নিতে পারি।  
এক ব্যক্তি ওয়াহাব ইবনু মুনাব্বিহ রহ.-এর কাছে এসে বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মানুষের সঙ্গে আর মেলামেশা করব না। 
তখন তিনি তাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, এটা করো না। কারণ, মানুষের সাথে মেলামেশা প্রয়োজনীয়। কারণ, তাদেরও তোমার কাছে কিছু প্রয়োজন থাকে এবং তোমারও তাদের থেকে কিছু প্রয়োজন হয়। তবে,
كُنْ فِيهِمْ أَصَمَّ، سَمِيعًا، أَعْمَى، بَصِيرًا، سَكُوتًا، نَطُوقًا
যখন মানুষের মাঝে থাকবে, তখন তোমার আচরণ যেন পাথরের মতো হয়—তাদের কথা শুনো, কিন্তু যেন কিছু শোনো না, দেখো, কিন্তু যেন কিছু দেখো না। চুপ থাকো, তবে যখন কথা বলার প্রয়োজন হয়, তখন বলো। [সিয়ারু আলামিননুবালা : ৪/৫৫০]
কবির ভাষায়
وَلَقَدْ مَرَرْتُ عَلَى اللَّئِيمِ يَسُبُّنِي
فَمَضَيْتُ ثُمَّ قُلْتُ: لَا يَعْنِينِي
একদিন আমি এক হীন ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সে আমাকে গালি দিচ্ছিল, কিন্তু আমি ভ্রূক্ষেপ না করে মনে মনে বললাম, তোমার কথায় আমার কিছু আসে যায় না।
মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পেলে সহ্য করার ফজিলত
আর এ সব ক্ষেত্রে যদি মানুষের কাছ থেকে কষ্ট বা অস্বস্তি পান, তবে তা সহ্য করলে আল্লাহ তাআলা আপনাকে বিশেষ পুরস্কার দিবেন এবং এর মাধ্যমে আমাদের চরিত্রও উন্নত হয়। এ মর্মে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন
الْمُؤْمِنُ الَّذِي يُخَالِطُ النَّاسَ ، وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ ، أَعْظَمُ أَجْرًا مِنَ الْمُؤْمِنِ الَّذِي لَا يُخَالِطُ النَّاسَ ، وَلَا يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ
যে মুমিন ব্যক্তি মানুষের সাথে মেলামেশা করে এবং তাদের জ্বালাতনে ধৈর্যধারণ করে সে এমন মুমিন ব্যক্তির তুলনায় অধিক সওয়াবের অধিকারী হয়, যে মানুষের সাথে মেলামেশা করে না এবং তাদের জ্বালাতনে ধৈর্য ধারণ করে না। [তিরমিযী : ২৫০৭]
দীন ও চরিত্র রক্ষায় ফেৎনা থেকে বাঁচতে সংযত মেলামেশা
উক্ত তিন প্রয়োজন ছাড়া অপ্রয়োজনীয় মেলামেশা কমিয়ে রাখা উচিত। বিশেষ করে, যদি তা দীন ও চরিত্রের ক্ষতির কারণ হয় বা ফেৎনার আশঙ্কা থাকে, তাহলে অহেতুক মেলামেশা এড়িয়ে চলা জরুরি।
ইবরাহিম ইবনু আদহাম রহ.
একদিন ইবরাহিম ইবনু আদহাম রহ. একটি দাওয়াতে নিমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হন। সেই সময় এক ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা শুরু হয়, যে দাওয়াতে আসেনি। কিছু লোক বলছিল, সে তেমন ভালো লোক নয়।
এভাবে গীবত যখন জমে ওঠে, তখন ইবরাহিম রহ. বলেন, আমি নিজেই ভুল করেছি, আমি এমন জায়গায় এসেছি, যেখানে অন্যদের গীবত হচ্ছে।
এ বলে তিনি অনুষ্ঠানটি ত্যাগ করেন এবং পরবর্তী তিন দিন কোনো খাবার গ্রহণ করেননি, নিজেকে গীবতের শাস্তি হিসেবে এই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। [তাম্বীহুল গাফেলীন : ১/১৭৯]
বোঝা গেল, আপনি যখন মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করবেন, গুনাহ হয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, অন্যের গীবত করা। মানুষ সাধারণত দুজনের আলাপচারিতার মাঝেই গীবতে লিপ্ত হয়ে যায়। অনেক সময় গীবত না করলেও নিজের অনিচ্ছায় গীবতের শ্রোতা হওয়া লাগে। তখন ধীরে ধীরে গীবতের অপরাধবোধ লোপ পেতে থাকে। অথচ এই গীবত করার কারণে কবরে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।
যার বন্ধুবান্ধব বেশি, তার গুনাহের আশঙ্কাও বেশি
আপনি চাইলে এটা নিজেও পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। অথচ আজকাল মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাকে একটা বিশেষ দক্ষতা মনে করা হয়। যাকে বলে ‘সোশ্যাল রিলেশন’ অর্থাৎ যত বেশি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা যাবে, তত বেশি বন্ধু, ভক্ত ও অনুসারী বাড়বে।
কিন্তু আমাদের বুজুর্গগণ অহেতুক সম্পর্ক গড়তে বারণ করেছেন। বরং তাঁরা বলতেন, পরিচিতজনের সংখ্যা কম হলে জীবন অনেক নিরাপদ থাকে।
হৃদয় একটি আয়না
কারণ, আল্লাহ মানুষের অন্তরকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যেন এটি একটি আয়না। যা কিছু মানুষ দেখে, তা তার হৃদয়ে বসে যায়। তেমনই, যত বেশি মানুষের সাথে ওঠাবসা হবে, তাদের প্রভাবও হৃদয়ে তত বেশি পড়বে।
মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ সব ধরনের মানুষ থাকে। যদি কোনো খারাপ চরিত্রের মানুষ সঙ্গে ওঠাবসা করা হয়, তাহলে তার প্রভাব হৃদয়ে পড়ে এবং তা নষ্ট হয়ে যায়।
তাই আমাদেরকে বলা হয়েছে, অহেতুক মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা থেকে বিরত থাকতে। যত কম মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে, তত বেশি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হবে। মাওলানা রুমি রহ. বলেন
تعلق حجاب است وبے حاصلی
چون پیوند ها بکسلی و اصلی
এ ধরনের সম্পর্ক আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যত বেশি দুনিয়াতে মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক বাড়বে, তত বেশি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়বে।
মালিক ইবনু দীনার রহ.-এর শিক্ষামূলক ঘটনা
এক ব্যক্তি মালিক ইবনু দীনার রহ.-এর কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি একা বসে আছেন এবং কাছেই একটি কুকুর হাঁটুর কাছে মাথা রেখে বসে আছে। লোকটি কুকুরটিকে তাড়াতে গেলে মালিক ইবনু দীনার রহ. বললেন
دَعْهُ يَا هَذَا هَذَا لَا يَضُرُّ وَلَا يُؤْذِي وَهُوَ خَيْرٌ مِنْ جَلِيسِ السُّوءِ
‘এটা ছেড়ে দাও, এটি তোমার কোনো ক্ষতি করছে না, তোমাকে কষ্টও দিচ্ছে না। আর এটি খারাপ বন্ধুর চেয়ে ভালো।’
তখন লোকটি জানতে চাইল, আপনি একা বসে আছেন কেন?
মালিক ইবনু দীনার রহ. বললেন
خَشِيتُ أَنْ أُسْلَبَ دِينِي وَلَا أَشْعُرُ
‘আমি ভয় পাচ্ছি, আমার দীন নষ্ট হয়ে যাবে, অথচ আমি বুঝতেও পারব না।’ [ইতহাফুস-সাদাহ : ৬/৩৫৭]
বোঝা গেল, খারাপ সঙ্গীর সঙ্গে মেলামেশা স্বভাব ও চরিত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।
আর এরই নাম تَقْلِيلُ الْإِخْتِلَاطِ مَعَ الْأَنَامِ তথা মাখলুকের সঙ্গে সম্পর্ক বেশি না রাখা।
সারকথা
সারকথা হলো, এসব সাধনা বা মুজাহাদা আমাদের নফস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য করতে হয়, যাতে অবৈধ কাজের প্রতি আকর্ষণ না থাকে। এই কারণে প্রত্যেকেরই মুজাহাদা করা উচিত।
সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমরা নিজের মর্জি অনুযায়ী না করে, বরং কোনো অভিজ্ঞ শায়খ ও মুরশিদ বা পথপ্রদর্শকের তত্ত্বাবধানে করি। 
যদি কেউ নিজের খাবার, ঘুম, এবং ওঠাবসা সম্পর্কে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়, তবে ভারসাম্য রাখা কঠিন হতে পারে। কিন্তু একজন পথপ্রদর্শকের দিকনির্দেশনায় মুজাহাদা করলে, ইনশাআল্লাহ, ভালো ফল পাওয়া যাবে এবং জীবনেও ভারসাম্য থাকবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন— আমীন।
وَاخِرُ دَعْوَانَا أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
—ইসলাহী বয়ান অবলম্বনে।


মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

পরিবারে খুন, নৃশংসতা ও ব্যাপক সামাজিক ধ্বস

...

আল্লামা উবায়দুর রহমান খান নদভী
৮ নভেম্বর, ২০২৪
১৮৪৮ বার দেখা হয়েছে

শরীয়তের উপর অবিচলতা

...

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ
৮ নভেম্বর, ২০২৪
১৯৪৪ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী

শাইখুল ইসলাম আল্লামা যাহেদ কাউছারী রহঃ

মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব

মুফতী সালমান মানসুরপুরী

শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস দাঃ

আল্লামা আহমাদ মায়মূন

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল

আল্লামা রফী উসমানী রহঃ

মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ.

মাওলানা নূর আলম খলীল আমিনী

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহঃ

হযরতজী মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহঃ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

মাওলানা শাহাদাত সাকিব

আল্লামা ইসহাক ওবায়দী রহঃ

মাওলানা ওমর পালনপুরী

মুফতী আবুল কাসেম নোমানী

হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ)

আল্লামা মানাযির আহসান গিলানী রহঃ