প্রবন্ধ

জীবিতদের নিকট মৃতব্যক্তির হক

লেখক:মাসিক আলকাউসার
৩ মে, ২০২৫
১৫৯১০ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

কত শত বৈচিত্র্যের সমাহার আমাদের এ পৃথিবী! পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার হাজার হাজার সৃষ্টি। একেক সৃষ্টির একেক ধরন। একই প্রজাতির মধ্যে আবার কত ভিন্নতা! মানুষের কথাই যদি ধরিকেউ সাদাকেউ কালোকেউ খাটোকেউ লম্বাকেউ উন্নত স্বাস্থ্যের অধিকারীকারও দেহ হাড়জিড়জিড়ে। এসবের পাশাপাশি ধনী-গরীব শিক্ষিত-অশিক্ষিত ইত্যাদি আরও কত বৈচিত্র্যময় দিক। সবকিছু মিলিয়ে আমরা মানুষজগতের একটি ক্ষুদ্র সৃষ্টি। এমন আরও কত কিছু যে দয়াময় আল্লাহ সৃষ্টি করে রেখেছেন এ জগতেসংখ্যা দিয়ে তা প্রকাশ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু যে বিন্দুটিতে এসে সকল বৈচিত্র্য মিলে একাকার হয়ে গেছে তা হচ্ছে-এ জগতের কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়কোনোটার আয়ু খুবই সামান্যকোনোটা আবার টিকে থাকে বহু বছরএমনকি অনেক শতাব্দীতবুও সবই ক্ষণস্থায়ীসবই ধ্বংসশীল। দিনের শেষে টিকে থাকবে না কিছুই। ব্যতিক্রম কেবলই আল্লাহর মহান সত্তা।

كُلُّ مَنْ عَلَیْهَا فَانٍ، وَّ یَبْقٰی وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلٰلِ وَ الْاِكْرَامِ.

ভূপৃষ্ঠে যা আছে সবই নশ্বর। অবিনশ্বর কেবল তোমার প্রতিপালকের সত্তাযিনি মহিমময়মহানুভব। -সূরা আররাহমান (৫৫) : ২৬-২৭

জন্মিলে মরিতে হইবেঅমর কে কোথা কবে-এ কথাটি অস্বীকার করার সাধ্য নেই কারও। তাও শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়জগতের যত জীবসবকিছুকেই গ্রহণ করতে হয় মরণের স্বাদ। পবিত্র কুরআনে এ চিরসত্যটি একাধিক স্থানে আলোচিত হয়েছে-

كُلُّ نَفْسٍ ذَآىِٕقَةُ الْمَوْتِ.

প্রত্যেক প্রাণই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮৫

মানুষ মারা যাবেই। মৃত্যু অনিবার্য। অনস্বীকার্য এ বাস্তবতাটির ভেতর দিয়ে প্রত্যেকেই যাবে একাকীকেউ কারও সঙ্গী নয়। দুনিয়ার এ ক্ষুদ্র জীবনে কতজনের সঙ্গে কতভাবে তার বন্ধন গড়ে ওঠে! মৃত্যু এসে সকল বন্ধন ছিন্ন করে দিয়ে তাকে একাকী তুলে নিয়ে যায়। দুনিয়ায় থেকে যায় পরিবারপরিজন-বাবা-মা ছেলে-মেয়ে স্বামী-স্ত্রী আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশীসহ আরও কত আপনজন। এভাবে একে একে সকলেই চলে যায়। কেউ আগেকেউ পরে। কিন্তু যায় সকলেই। যাদেরকে আপাতত রেখে যায় দুনিয়ার বুকেতাদের প্রতি মৃত ব্যক্তির কী হককী অধিকার-এটা নিয়েই আজকের আলোচনা।


মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে আপনজনের করণীয়

মৃত্যু হচ্ছে মোহনা-এখানে দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি আবার আখেরাতের জীবনের সূচনা। দুনিয়াকে বলা হয় ‘মাযরাআতুল আখিরাহ’ বা আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। দুনিয়ার জীবন যার যেমন কাটবেপরকালে এর ফলই সে ভোগ করবে। আর যে কোনোকিছু ভালো হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্যে এর সমাপ্তি সুন্দর হওয়া জরুরি। হাদীসে আছেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِنّمَا الأَعْمَالُ بِالْخَوَاتِيمِ.

আমল তো শেষ অবস্থা অনুসারেই বিবেচিত হবে। -সহীহ বুখারীহাদীস ৬৬০৭

আমাদের এক পরিচিত প্রবাদ-শেষ ভালো যারসব ভালো তার। সবমিলিয়ে বলা যায়আখেরাতে সুন্দর জীবনের জন্যে সুন্দর মৃত্যুর বিকল্প নেই। মৃত্যুর সময় যদি ঈমানটাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায়দুনিয়ার সব দুঃখ-কষ্ট তখন তুচ্ছ। আর যদি এর বিপরীত কিছু হয়শয়তানের ধোঁকায় কেউ নিজের ঈমান খুইয়ে বসেজগতে তার চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে! এজন্যে কোনো মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে যারা উপস্থিত থাকবেনতাদের প্রথম কর্তব্য-কালেমায়ে তায়্যিবার তালকীন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَقِّنُوا مَوْتَاكُمْ لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ.

তোমরা তোমাদের মৃত্যুগামী ব্যক্তিদের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’র তালকীন করো। -সহীহ মুসলিমহাদীস ৯১৬৯১৭

তালকীনের অর্থ হচ্ছে-মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে একটু আওয়াজ করে কালেমা পড়তে থাকা। তবে মনে রাখতে হবেএ অবস্থায় তাকে কিছুতেই মুখে উচ্চারণ করে কালেমা পড়ার আদেশ করা যাবে না। জোরাজুরি করা যাবে নাএতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই নিয়ম হলতার পাশে বসে মৃদু আওয়াজে কেবল কালিমা পড়তে থাকা। কালিমা বলুন বা এজাতীয় কিছু না বলা। তার পাশে যখন কালেমা পড়া হবেতিনি যখন কালেমার আওয়াজ শুনতে পাবেনআশা করা যায়তিনি নিজেই কালেমা পড়ে নিতে পারেন। এ কালেমা যার জীবনের শেষ কথা হবে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ كَانَ آخِرُ كَلاَمِهِ لاَ إِلَهَ إِلاّ اللهُ دَخَلَ الْجَنّةَ.

যার শেষ কথা হবে-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহসে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ৩১১৮

মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে থেকে সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত করার কথাও হাদীসে রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

اقْرَءُوا (يسعَلَى مَوْتَاكُمْ.

মৃত্যুপথযাত্রী যারা তাদের পাশে থেকে তোমরা সূরা ইয়াসীন পাঠ করো। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ৩১২৩সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৩০০২

ছোট ও সহজ এ দুটি আমলের পাশাপাশি দূরের-কাছের সকলেরই উচিত-তার জন্যে দুআ করা। তার মৃত্যু যেন সহজ হয় এবং ঈমানের সঙ্গে হয়-এ দুআ করা। এ দুআটুকুর জন্যে পাশে থাকারও প্রয়োজন নেই। কোনো আপনজনের মুমূর্ষু অবস্থার সংবাদ পেলে তার জন্যে যথাসাধ্য দুআ করা উচিত। এতে শুধু তারই উপকার হবে-এমন নয়বরং দুআকারীর উপকারও এতে কম নয়। হাদীসের ভাষ্যানুসারেকোনো মুসলিম ভাইয়ের জন্যে দূর থেকে কোনো দুআ করলে ফিরিশতারা বলে-তাকেও (দুআকারীকেও) যেন এ বিষয়গুলো দান করা হয়। তাই অন্য কারও জন্যে দুআ করাকারও মুমূর্ষু অবস্থায় সহজ মৃত্যু এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুর জন্যে দুআ করলে লাভবান হবে দুআকারী নিজেও।


মৃত্যুর পর আপনজনদের করণীয়

মৃত্যু যেমন এক অনুপেক্ষ বাস্তবতামৃত্যুর জন্যে নির্ধারিত সময়ও কারও পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যার জন্যে যতটুকু হায়াত নির্ধারিতযার মৃত্যুর জন্যে যে সময় লিখে রাখা হয়েছেএ সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই কারও। পবিত্র কুরআনে একাধিক স্থানে মহামহিম আল্লাহ এ ঘোষণাও দিয়েছেন-

اِذَا جَآءَ اَجَلُهُمْ لَا یَسْتَاْخِرُوْنَ سَاعَةً وَّ لَا یَسْتَقْدِمُوْنَ.

তাদের মৃত্যুর নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হয় তখন তারা তা এক মুহূর্তও বিলম্বিত করতে পারবে নাএমনকি মুহূর্তকাল ত্বরান্বিতও করতে পারবে না। -সূরা নাহল (১৬) : ৬১

নির্ধারিত সময়েই তাই সকলের মৃত্যু হবে। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। আমাদের করণীয় বরং পরবর্তী সময়ে-মৃত ব্যক্তির কাফন-দাফন জানাযা ইত্যাদি ক্ষেত্রে।

মৃত ব্যক্তিকে সুন্দরভাবে গোসল করিয়ে কাফন পরানো এবং তার জানাযার নামায আদায় করে তাকে দাফন করা-এগুলো আপনজনদের করতে হয়। মাটি থেকেই মানুষের সৃষ্টিদুনিয়ার জীবন শেষ করে মাটিতেই হয় তার শেষ গন্তব্য। কুরআনে কারীমের ভাষায়-

مِنْهَا خَلَقْنٰكُمْ وَ فِیْهَا نُعِیْدُكُمْ وَ مِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً اُخْرٰی .

আমি তোমাদেরকে তা (অর্থাৎ মাটি) থেকেই সৃষ্টি করেছিতাতেই আবার তোমাদের আমি ফিরিয়ে নেব এবং তা থেকেই পুনরায় তোমাদের জীবিত করব। -সূরা ত্বহা (২০) : ৫৫

শরিয়তের নির্দেশনা অনুসারে গোসল-কাফন-জানাযা ও দাফন সম্পন্ন করা তো আমাদের জানা বিষয়। তবে এক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে-


দাফন যেন বিলম্বিত না হয়

নানা কারণেই মৃত ব্যক্তির দাফন বিলম্বিত করা হয়। কখনো দূর-দূরান্তের আপনজনদের অপেক্ষায়কখনো অধিক মুসল্লির অংশগ্রহণে জানাযার নামায আদায় করার জন্যেকখনো এক এলাকা থেকে মৃতদেহ অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে দাফন বিলম্বিত হয়। দুনিয়ার এ জীবন যার যত বেশি সামাজিক কর্মঅবদান কিংবা অন্য কোনো দিক থেকে যে যত বেশি মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিততার বিদায়ের সঙ্গে ঠিক তত বেশি মানুষেরই আবেগ জড়িয়ে থাকে। শেষবারের জন্যে একটু দেখার আকুলতা থাকে। এ সবই সত্য। কিন্তু শরীয়তের নির্দেশনা হলকেউ যখন মারা যায়তখন দ্রুতই যেন তাকে দাফন করা হয়। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস-

أَسْرِعُوا بِالْجِنَازَةِ فَإِنْ تَكُ صَالِحَةً فَخَيْرٌ تُقَدِّمُونَهَا إِلَيْهِ وَإِنْ يَكُ سِوَى ذَلِكَ فَشَرّ تَضَعُونَهُ عَنْ رِقَابِكُمْ.

তোমরা মৃতব্যক্তির জানাযা-দাফন ইত্যাদি দ্রুত করো। সে যদি নেককার মানুষ হয়ে থাকে তবে তো তার জন্যে কল্যাণ ও পুরস্কার রয়েছেতোমরা তাকে সেই কল্যাণের দিকেই এগিয়ে দিলে। আর যদি সে এমন না হয়তবে (দাফনের মধ্য দিয়ে) তোমরা তোমাদের ঘাড় থেকে এ মন্দকে নামিয়ে দেবে। -সহীহ বুখারীহাদীস ১৩১৫

হাদীসের ভাষ্য তো পরিষ্কার-মৃত ব্যক্তি যেমনই হোকনেককার হোক কিংবা না হোকদ্রুত দাফনের মধ্যেই রয়েছে কল্যাণহয়তো তার জন্যেকিংবা জীবিতদের জন্যে।

আরেকটি হাদীস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রা.-কে বলেন-

يَا عَلِيّثَلاَثٌ لاَ تُؤَخِّرْهَاالصّلاَةُ إِذَا أَتَتْ، وَالجَنَازَةُ إِذَا حَضَرَتْ، وَالأَيِّمُ إِذَا وَجَدْتَ لَهَا كُفْئًا.

আলী! তিনটি জিনিস বিলম্বিত করো না-নামাযযখন এর সময় হয়ে যায়জানাযার নামায এবং উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেলে মেয়েদের বিয়ে দেয়া। -জামে তিরমিযীহাদীস ১০৭৫

এজন্যে জানাযার নামায ও দাফন অপ্রয়োজনে বিলম্বিত করা উচিত নয়।

জানাযার নামায যদিও ফরযে কেফায়াকিছু মানুষ পড়লেই সকলের পক্ষ থেকে দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়কিন্তু জানাযার নামায মূলত একটি দুআমৃতব্যক্তির জন্যে জীবিতদের দুআ এবং তা এক মুসলমানের নিকট আরেক মুসলমানের হক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

حَقّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ رَدّ السّلاَمِ وَعِيَادَةُ الْمَرِيضِ وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِزِ وَإِجَابَةُ الدّعْوَةِ وَتَشْمِيتُ الْعَاطِسِ.

মুসলমানের ওপর মুসলমানের হক পাঁচটি-সালাম দিলে এর জবাব দেয়াঅসুস্থ হলে দেখতে যাওয়াজানাযা ও দাফনে শরিক হওয়ানিমন্ত্রণ গ্রহণ করা এবং হাঁচি দিয়ে কেউ আলহামদু লিল্লাহ বললে তার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা। -সহীহ বুখারীহাদীস ১২৪০

জানাযার নামাযের পর আসে দাফনের পর্ব। এ জীবনে যারা যত বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলবিদায় বেলায় সাধারণত তারাই তত বেশি সঙ্গ দেয়। কাফন-জানাযা-দাফন সব পর্বেই তারা থাকে। জানাযার নামায শেষে অনেকেই চলে যায় যার যার মতো। আপনজনেরা থাকেসঙ্গে আরও কেউ কেউ থাকে। জানাযার নামাযের সাথে সাথে দাফনকার্যে অংশগ্রহণকারীর জন্যে রয়েছে বড় পুরস্কারের ঘোষণা-

قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ شَهِدَ الْجَنَازَةَ حَتّى يُصَلِّيَ عَلَيْهَا فَلَهُ قِيرَاطٌ، وَمَنْ شَهِدَ حَتّى تُدْفَنَ كَانَ لَهُ قِيرَاطَانِ قِيلَ وَمَا الْقِيرَاطَانِ قَالَ مِثْلُ الْجَبَلَيْنِ الْعَظِيمَيْنِ.

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনমৃতব্যক্তির জানাযার নামাযে যে শরীক হয় তার জন্যে রয়েছে এক কীরাত। আর যে তাকে দাফন করা পর্যন্ত থাকেতার জন্যে রয়েছে দুই কীরাত। কেউ একজন প্রশ্ন করল-দুই কীরাত কীতিনি তখন বললেনদুটি বড় পাহাড়ের সমতুল্য। -সহীহ বুখারীহাদীস ১৩২৫


দাফনপরবর্তী সময়ে মৃতব্যক্তির অধিকার

দুআ ও ইস্তেগফার

জানাযার নামাযই মৃতব্যক্তির জন্যে একটি দুআ। কিন্তু মনে রাখতে হবেএই এক দুআই শেষ নয়। দাফনের পরপরই শুরু হয় তার কবরজগতের প্রশ্নোত্তর পর্ব। পরীক্ষার শুরু সেখানেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার একজনকে দাফন করার পর সেখানে দাঁড়িয়ে বললেন-

اسْتَغْفِرُوا لأَخِيكُمْ وَسَلُوا لَهُ التّثْبِيتَ فَإِنّهُ الآنَ يُسْأَلُ.

তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্যে ইস্তিগফার করো এবং তার জন্যে প্রার্থনা করো-সে যেন সত্যের ওপর অবিচল থাকতে পারে। এখন তো তাকে প্রশ্ন করা হবে। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ৩২২৩

তাই দাফনের পরপর মৃতব্যক্তির জন্যে দুআ করাতার সুওয়াল-জবাব যেন সহজ হয়কবরের প্রতিটি ধাপই যেন সে সহজে পেরিয়ে যেতে পারে-এ দুআ জীবিতদের নিকট তার অধিকার।

আরেক হাদীসে দুআর নির্দেশনা এসেছে আরও ব্যাপক পরিসরে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ.

মানুষ যখন মারা যায় তখন তার সব আমলই বন্ধ হয়ে যায়। ব্যতিক্রম কেবল তিনটি-সদকায়ে জারিয়াউপকারী ইলম আর এমন নেককার সন্তানযে তার জন্যে দুআ করবে। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১৬৩১

মৃত্যুপরবর্তী সময়ের এ দুআ সন্তানের নিকট বাবা-মায়ের অধিকার। এ অধিকার এড়াতে পারবে না যারা সরাসরি সন্তান না হলেও ঘনিষ্ঠতায় এবং আন্তরিকতায় মৃতব্যক্তির সন্তানতুল্য।


ওসিয়ত ও দেনা পরিশোধ

মৃত ব্যক্তির যত দেনাতার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে সেসবও পরিশোধ করে দিতে হবে। যে ওসিয়ত তিনি করে যানতাও আদায় করতে হবেতবে তা পুরো সম্পদ দিয়ে নয়বরং সম্পদের এক তৃতীয়াংশ থেকে। দেনার তালিকায় মানুষের আদায়যোগ্য ঋণ যেমন থাকতে পারেথাকতে পারে শরীয়তের কোনো বিধানও। এক সাহাবী হজ্ব আদায় না করেই ইন্তেকাল করেনঅথচ তার ওপর হজ্ব ফরয হয়েছিল। তার ছেলে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জানতে চাইলেনইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাবা তো হজ্ব না করেই ইন্তেকাল করেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্ব আদায় করবরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন-

أَرَأَيْتَ لَوْ كَانَ عَلَى أَبِيكَ دَيْنٌ أَكُنْتَ قَاضِيَهُ؟ قَالَنَعَمْ، قَالَفَدَيْنُ اللهِ أَحَقّ.

বলো তোতোমার বাবার যদি কোনো ঋণ থাকততবে কি তুমি তা আদায় করতেসাহাবী বললেনহাঁকরতাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনতবে আল্লাহ্র ঋণ আদায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। -সুনানে নাসাঈহাদীস ২৬৩৯

একই রকম প্রশ্ন করেছিলেন এক নারী সাহাবী। তার মা হজ্বের মান্নত করার পর তা আদায় না করেই মারা যান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেন-

حُجِّي عَنْهَا أَرَأَيْتِ لَوْ كَانَ عَلَى أُمِّكِ دَيْنٌ أَكُنْتِ قَاضِيَةً؟ اقْضُوا اللهَ، فَاللهُ أَحَقّ بِالْوَفَاءِ.

তুমি তার পক্ষ থেকে হজ্ব আদায় করো। তোমার মায়ের কোনো ঋণ থাকলে তুমি কি তা আদায় করতে নাআল্লাহ্র ঋণ আদায় করো। আল্লাহ্র প্রাপ্য আদায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। -সহীহ বুখারীহাদীস ১৮৫২

হজ্ব ফরয হওয়ার পরও যদি আদায় না করেই কেউ মারা যায় তার উত্তরসূরিরা তা আদায়ের ব্যবস্থা করবে। তেমনি যদি কারও কাযা রোযা থেকে থাকেনামায কাযা হয়ে থাকেসেগুলোরও ফিদইয়া আদায় করবে। মান্নত থাকলে তা পুরা করবে।


ঈসালে সওয়াব

মৃত ব্যক্তির অধিকার আদায়ের জন্যে এ প্রক্রিয়াটি দীর্ঘস্থায়ী। ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে দান-সদকা যেমন করা যেতে পারেএর পাশাপাশি কুরআন তিলাওয়াতনফল নামাযরোযাকুরবানীহজ্ব ইত্যাদি সবই করা যেতে পারে।

দুনিয়ার এ জীবনে কেউ চিরস্থায়ী নয়। আখেরাতই আসল গন্তব্যস্থায়ী নিবাস। সেখানকার জীবন যেন সুন্দর হয়সুখকর হয়উপরোক্ত বিষয়গুলো এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে। শুরুতেই বলে এসেছি-যার সঙ্গে সম্পর্ক যেমনতার প্রতি অধিকারও তেমন। এ অধিকার আদায়ে যত্নবান হতে হবে আমাদের।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

মৃত্যুর পর বরযখ, কেয়ামত ও আখেরাত

...

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৫২১৮ বার দেখা হয়েছে

কবর যিয়ারত সম্পর্কিত বিধিবিধান

...

আল্লামা ইউসুফ লুধিয়ানভী রহঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৯১৮৮ বার দেখা হয়েছে

ঈসালে সওয়াব : কিছু মাসনূন পদ্ধতি

...

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৩৭৮৩ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহঃ

শাহ আব্দুল আযীয দেহলভী রহঃ

শাইখুল ইসলাম আল্লামা কাসেম নানুতুবী রহঃ

মাওঃ উবাইদুল্লাহ সিন্ধী রহঃ

সায়্যিদ সাবেক রহঃ

আল্লামা আব্দুল মজীদ নাদীম রহঃ

মাওলানা আসলাম শাইখুপুরী

শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রহঃ

মাওঃ আবু আম্মার যাহেদ রাশেদী

মাওঃ নুরুল হাসান রাশেদ কান্ধলভী

মুফতী হাবীবুর রহমান খাইরাবাদী

আল্লামা আবুল কালাম আযাদ রহঃ

মাওলানা সাঈদ আহমদ

মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন দাঃ

হযরত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহঃ

মাওলানা হাবীবুর রহমান খান

মাওলানা সাঈদ আহমাদ বিন গিয়াসুদ্দীন

মাওঃ আবু বকর সিরাজী

শায়েখ আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনে উমার [রহ.]

মাওঃ এনামুল হাসান