প্রবন্ধ

অমুসলিমদের আচার-আচরণের ফিতনা

লেখক:মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী
৯ জানুয়ারী, ২০২৫
১৫১৩১ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য


অমুসলিমদের আচার-আচরণ ও কালচার Vs ইসলামী সভ্যতার মূলনীতি 


পর্ব ১

বর্তমান যুগকে বলা হয় সভ্যতার সংঘাতের যুগ (Clash of Civilizations)। সাতটি মহাদেশে বিস্তৃত পৃথিবী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আবিষ্কার এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে একটি গ্লোবাল গ্রামে রূপ নিয়েছে। এই বড় গ্রামে পশ্চিমা সংস্কৃতির আক্রমণ ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। প্রভাবশালী ইউরোপীয় জাতিগুলো কোনো সামরিক আক্রমণ ছাড়াই এবং এক ইঞ্চি দেয়ালও টপকে না গিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করে সভ্যতার আধিপত্য বিস্তার করেছে। এমনকি সোনিয়া গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ জয়ের ঘোষণা করেছিলেন।

এই সাংস্কৃতিক যুদ্ধে মুসলিম জাতি হিসেবে আমাদের তিনটি ভিন্ন ধরনের মনোভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল:

• পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি মুগ্ধতা ও অন্ধ অনুকরণ:

অনেকেই পশ্চিমা সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েছেন এবং এর প্রভাব ও আধুনিকতা গ্রহণ করাকেই উন্নতির চাবিকাঠি বলে মনে করেন। এরা নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে ও আচরণে পশ্চিমা সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করতে থাকেন। এদেরকে প্রগতিশীল বা আধুনিকতাবাদী বলা হয়।

• প্রাচীনপন্থী বা রক্ষণশীল মনোভাব:

এই গোষ্ঠী পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রকাশিত দিকগুলোর বিরোধিতা করে এবং নিজেদের জীবনযাপনের ধরণে অতীতের চিত্রকে আঁকড়ে ধরে থাকে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এমন কিছু প্রথাও অনুসরণ করেন যা ইসলামী সভ্যতার অংশ নয়, তবে অতীতে ধার্মিক মুসলিম সমাজে দেখা যেত। যেমন, গলার কলারযুক্ত শার্ট না পরা ইত্যাদি।

• পরিমিতিবোধ ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি:

এই গোষ্ঠী ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ এমন বিষয়গুলো গ্রহণে কোনো আপত্তি করে না। এরা ইসলামের প্রজ্ঞা ও ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ করে কল্যাণকর বিষয়গুলো গ্রহণ করে এবং ক্ষতিকর বিষয়গুলো প্রত্যাখ্যান করে।

এখন প্রশ্ন হলো, মুসলিমরা কি একজন অভিনয়শিল্পীর মতো বহুমুখী চরিত্র গ্রহণ করবে? নাকি নিজের সভ্যতার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে? প্রকৃত মুসলিম কখনো অমুসলিম সভ্যতার অনুসরণ বা তার প্রতিনিধি হতে পারে না। তবে সাংস্কৃতিক যুদ্ধে কল্যাণকর বিষয়গুলো প্রত্যাখ্যান করাও ইসলামী মানসিকতা নয়। এটি মক্কার মুশরিকদের আচরণের মতো, যারা বলত:

"হে আল্লাহ! যদি এটি সত্য হয়ে থাকে তবে আমাদের ওপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করো বা কঠোর শাস্তি পাঠাও।" (সূরা আল-আনফাল: ৩২)


মনে রাখা উচিত যে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ এবং সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এবং চলমান জীবনের সব বিভাগ ও ক্ষেত্রের জন্য যথার্থ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এটি এমন এক জীবনদর্শন, যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সমস্ত সমস্যা ও বিষয়ের সমাধান দিয়ে থাকে। তাই আমরা, ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা, কোনো ভিত্তিহীন ধর্ম, বিভ্রান্তিকর মতবাদ বা কোনো মিথ্যা প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যতা বা সংস্কৃতি থেকে কিছু শেখার বা গ্রহণ করার প্রয়োজন অনুভব করি না। আমাদের জন্য কেবল কুরআন ও সুন্নতই যথেষ্ট এবং পরিপূর্ণ।


কবির ভাষায়ঃ

مسلمانی بود گردن نہادن ، عنان خود بدست خواجہ دادن

"মুসলমান হওয়া মানে নিজেকে বিনয়ী করে তোলা এবং নিজের নিয়ন্ত্রণ (অধিকার) প্রভুর হাতে সমর্পণ করা।"

এখানে "گردن نہادن" মানে আত্মসমর্পণ করা বা বিনয়ী হওয়া, এবং "عنان خود بدست خواجہ دادن" মানে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রভুর হাতে অর্পণ করা।


কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আজকের দিনে উম্মতের একটি বড় অংশ অমুসলিম (কাফের ও মুশরিক এবং ইহুদী-নাসারা) জাতির আচার-আচরণ ও রীতিনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। তারা এই রীতিগুলো অনুসরণ করতে পছন্দ করে এবং এমনকি সেগুলোকে নিজেদের জন্য গর্বের বিষয় মনে করে। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: জন্মদিন উদযাপন করা, খ্রিস্টীয় নতুন বছরের আগমনে "নতুন বছরের শুভেচ্ছা" জানানো এবং এর বার্তা প্রেরণ করা, "এপ্রিল ফুল" উদযাপন করা এবং "ভালোবাসা দিবস" পালন করা।

এসব প্রথা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য এবং বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার মানদণ্ডেও এগুলো নিরর্থক। সুতরাং, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে এগুলোর বাস্তবধর্মী পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।


রীতিনীতি পর্যালোচনা

১. জন্মদিন উদযাপন:

জন্মদিন কোনো আনন্দ উৎসব করার উপলক্ষ নয়; বরং এটি চিন্তা করার সময় যে আমাদের সীমিত জীবনের একটি বছর কমে গেছে।


২. খ্রিস্টীয় নতুন বছর উদযাপন:

খ্রিস্টীয় নতুন বছরের আগমনে "নতুন বছরের শুভেচ্ছা" জানানো বা এটি ঈদের রাতের মতো উদযাপন করা বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার দৃষ্টিতে সঠিক নয়। কারণ, এর মাধ্যমে পৃথিবীর আয়ু এক বছর কমে যায় এবং কিয়ামতের দিন আরও নিকটবর্তী হয়। প্রকৃতপক্ষে, নতুন বছর নয়; বরং প্রতিটি মুহূর্তই নতুন। তাহলে নতুন বছর উদযাপনের অর্থ কী? বর্তমানে এই উদযাপন চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। রাত বারোটার জন্য নাচ-গান, মদ্যপান, উত্তেজনাপূর্ণ সংগীত এবং বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আতশবাজি ফোটানো ও বেলুন ফাটানোর মতো কর্মকাণ্ড করা হয়।


৩. এপ্রিল ফুল:

এপ্রিল ফুল মিথ্যা, প্রতারণা, ধোঁকা এবং কষ্টদানের সমষ্টি। যারা এটিকে বিনোদনের মাধ্যম মনে করে তাদের বুদ্ধি নিয়ে অবাক হতে হয়।


৪. ভালোবাসা দিবস:

এই দিনে বেপর্দা, লজ্জাহীন এবং অশ্লীলতায় যুবক-যুবতীর মেলামেশা হয়, এবং লাল গোলাপ উপহার দেওয়া হয়। এটি কি জিনার (পাপাচারের) আহ্বান নয়?

এসব রীতিনীতির মধ্যে মানুষের কোনো উপকার বা কল্যাণের দিকও নেই।


৫. দ্বৈততা ত্যাগ করা

আল্লাহ তাআলা এটাও অপছন্দ করেন যে কেউ যদি ইসলামকে পুরোপুরি গ্রহণ করার পরও ইহুদিদের কিছু বিষয় অনুসরণ করে। যেমন তাফসির গ্রন্থে উল্লেখ আছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (যিনি ইসলাম গ্রহণের আগে ইহুদিদের বিখ্যাত আলেম ছিলেন) এবং তাঁর কিছু সাথী ইসলাম গ্রহণের পরও শনিবারের (ইহুদিদের বিশেষ দিন) মর্যাদা প্রদান করতেন এবং উটের মাংস ও দুধকে অপবিত্র মনে করতেন। তারা নবী করিম ﷺ-এর কাছে আরজি করলেন:

یَارَسُوْلَ اللہِ اِنَّ التَّوْرَاةَ کِتَابُ اللہِ، فَدَعْنَا فَلْنَقُمْ بِھَا فِیْ صَلَاتِنَا بِاللَّیْلِ،

"ইয়া রাসুলুল্লাহ! তাওরাতও আল্লাহর একটি কিতাব, আমাদের অনুমতি দিন যেন আমরা রাতের সালাতে তাওরাত তিলাওয়াত করি।"

এরপর এই বিষয়ে কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াত অবতীর্ণ হয়:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ 

"হে ঈমানদারগণ! ইসলামে সম্পূর্ণভাবে প্রবেশ করো, এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।" (সূরা বাকারা: ২০৮)

এই আয়াতের অর্থ হলো, ইসলামকে পুরোপুরি গ্রহণ করো। ইসলামের বিধানই তোমাদের জন্য যথেষ্ট ও পরিপূর্ণ। এখন তোমাদের অন্য কোনো শরিয়ত অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই। পূর্ববর্তী ধর্মের কিছু বিষয় পালনের চিন্তা শয়তানের প্ররোচনা মাত্র। তাই এই চিন্তা পরিত্যাগ করো। পূর্ববর্তী ধর্মের কিছু বিষয় অনুসরণ করলে তাদের সাদৃশ্যতা হয়ে যায়, যা নিন্দনীয়।

(তাফসির আল-বাগাভি: ১/২৪০)


ইহুদী ও খ্রিস্টানরা শুরু থেকেই ইসলাম ধর্মের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল। এ দুটি জাতি নিজেদের "আহলে কিতাব" হওয়ার কারণে গর্ব করত। ইহুদিরা বনি ইসরাইলের মধ্যে একজন শেষ নবীর আগমনের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু যখন শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ ﷺ বনি ইসমাইলের মধ্যে প্রেরিত হলেন, তখন ইহুদিরা ইসলামের প্রতি চরম শত্রুতা প্রদর্শন করল। মদিনায় তারা খন্দকের যুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার চেষ্টা করেছিল।

নবী করিম ﷺ তাদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন। পরে, হজরত উমর (রা.) তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে পুরো আরব উপদ্বীপ থেকে তাদের বের করে দেন। নবী করিম ﷺ-এর এই নির্দেশনা তিনি স্মরণ রেখেছিলেন: "ইহুদী ও খ্রিস্টানদের আরব উপদ্বীপ থেকে বের করে দাও।" (আবু দাউদ: ৩০২৯)


ইহুদী ও খ্রিস্টানরা তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে গিয়েছিল এবং মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালায়, যার ফলে মুসলমানদের তাদের সঙ্গে বহু যুদ্ধ করতে হয়। তবে, তাদের এই সমস্ত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সত্ত্বেও মুসলমানদের মধ্যে কখনো পরাজয়ের অনুভূতি বা হতাশা দেখা দেয়নি। বরং, তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃঢ়তা দেখিয়েছে এবং সাহসিকতার সঙ্গে তাদের প্রতিহত করেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের মুসলমানরা তাদের রীতিনীতি, কালচারের প্রভাবে প্রভাবিত। সেজন্য আমাদের জানতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাদের যাবতীয় কালচার থেকে পৃথক থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।


তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন,

সূরা আল-মায়েদা, আয়াত ৫১

{يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللّٰهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ}

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ জালিমদেরকে হিদায়াত দান করেন না।”


সূরা আলে ইমরান, আয়াত ২৮

{لَا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ}

“মুমিনরা যেন বিশ্বাসীদের বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করে। আর যে কেউ এটি করবে, তার সাথে আল্লাহ্‌র কোনো সম্পর্ক থাকবে না, তবে যদি তাদের থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে কোনো কৌশল গ্রহণ করতে হয়। আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে তার শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করছেন। আর আল্লাহ্‌র কাছেই প্রত্যাবর্তন।”


সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১২০

{وَلَن تَرْضَىٰ عَنكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ ۗ قُلْ إِنَّ هُدَى اللَّهِ هُوَ الْهُدَىٰ ۗ وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُم بَعْدَ الَّذِي جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ ۙ مَا لَكَ مِنَ اللَّهِ مِن وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ}

“ইহুদি ও খ্রিস্টানরা কখনোই তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্ম গ্রহণ করো। বলো, ‘আল্লাহ্‌র পথনির্দেশই প্রকৃত পথনির্দেশ।’ আর যদি তুমি জ্ঞান পাওয়ার পর তাদের আকাঙ্ক্ষার অনুসরণ করো, তবে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তোমার কোনো বন্ধু বা সাহায্যকারী থাকবে না।”


(১)- ইহুদী-নাসারার বিরোধিতায় খিজাব ও সালামের নিয়ম

খিজাবে ইহুদী-নাসারার বিরোধিতা:

ইহুদী ও নাসারা তাদের চুলে খিজাব (রঙ) ব্যবহার করত না। নবী করিম ﷺ তাদের এই অভ্যাসের বিরোধিতা করতে মুসলমানদের খিজাব ব্যবহারের আদেশ দিয়েছেন। হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত:

اِنَّ الْیَھُوْدَ وَالنَّصَارَی لَایَصْبَغُوْنَ فَخَالِفُوْھُمْ

"নিশ্চয়ই ইহুদী ও নাসারা চুলে খিজাব ব্যবহার করে না, তাই তোমরা তাদের বিরোধিতা করো।"

(বুখারি ৫৮৯৯)

অর্থাৎ খিজাব ব্যবহার করো। তবে যেকোনো রঙের খিজাব ব্যবহার বৈধ, কিন্তু কালো রঙের খিজাব ব্যবহার নিষিদ্ধ। কারণ, অন্যান্য হাদিসে কালো রঙ ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।


(২) সালামের নিয়মে ইহুদী-নাসারার বিরোধিতা:

ইহুদীরা আঙুলের ইশারায় এবং নাসারা হাতের তালুর ইশারায় সালাম করত। নবী করিম ﷺ তাদের এই পদ্ধতির বিরোধিতা করতে মুসলমানদের ভাষায় সালাম করার নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম ﷺ বলেছেন:

لَاتَشَبَّھُوْا بِالْیَھُوْدِ وَلَا بِالنَّصَارَی، فَاِنَّ تَسْلِیْمَ الْیَھُوْدِ الِاشَارَةُ بِاْلَاصَابِعِ، وَتَسْلِیْمَ النَّصَارَی اِلاشَارَةُ بِالْاَکُفِّ

"ইহুদী ও নাসারার মতো হও না। ইহুদীরা আঙুল দিয়ে ইশারা করে সালাম করে, আর নাসারারা হাতের তালু দিয়ে ইশারা করে সালাম করে।"

(তিরমিজি (২৬৯৫)

অর্থাৎ মুখে সালামের শব্দ উচ্চারণ না করে শুধুমাত্র আঙুল বা হাতের তালু দিয়ে ইশারা করা ইহুদী ও নাসারার সালামের পদ্ধতি। তবে, যদি কেউ দূরত্বে থাকে, তাহলে মুখে সালামের শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে হাত দিয়ে ইশারা করাও বৈধ।


(৩) সেহরির মাধ্যমে ইহুদী-নাসারার থেকে ভিন্নতা

সেহরিতে ইহুদী-নাসারার থেকে পার্থক্য:

ইহুদী ও নাসারার রোজায় সেহরির কোনো ব্যবস্থা ছিল না, অথচ আমাদের জন্য সেহরি খাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের এবং তাদের রোজার মধ্যে পার্থক্যের একটি প্রধান চিহ্ন সেহরি। হজরত আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

فَصْلُ مَابَیْنَ صِیَامِنَا وَصِیَامِ اَھْلِ الْکِتَابِ اَکْلَةُ السِّحْرِ․

"আমাদের রোজা এবং আহলে কিতাবের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সেহরির খাবার।"

(মুসলিম (১০৯৬)

অর্থাৎ, ইসলামের শিষ্টাচার অনুযায়ী আমাদের রোজাকে তাদের থেকে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র রাখা হয়েছে।


(৪) ইফতারে তাড়াহুড়ো করে ইহুদী-নাসারার বিরোধিতা

ইফতারে দ্রুততা এবং ইহুদী-নাসারার থেকে বিরোধিতা:

ইহুদী ও নাসারা ইফতারে দেরি করত। নবী করিম ﷺ এই অভ্যাস নিষিদ্ধ করেছেন এবং বলেছেন এটি আহলে কিতাবের (ইহুদী-নাসারার) একটি পদ্ধতি। হাদিসে এসেছে:

لَایَزَالُ الدِّیْنُ ظَاھِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ، لِاَنَّ الْیَھُوْدَ وَالنَّصَارَی یُوَٴخِّرُوْنَ

"যতক্ষণ মানুষ ইফতারে তাড়াহুড়ো করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ধর্ম (ইসলাম) বিজয়ী অবস্থায় থাকবে। কারণ ইহুদী ও নাসারা ইফতারে দেরি করে।"

(আবু দাউদ (২৩৫৩)


(৫) আজানের পদ্ধতিতে ইহুদী ও নাসারার থেকে পার্থক্য

 এটি ইহুদী ও নাসারার পদ্ধতি:

প্রাথমিকভাবে মুসলমানদের জন্য জামাতে নামাজের সময় সবাইকে ডাকার জন্য কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছিল না। মুসলমানরা নিজেরাই সময় আন্দাজ করে জমায়েত হতেন। পরে রাসুলুল্লাহ ﷺ সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন:

"কীভাবে মানুষকে নামাজের জন্য একত্র করা যাবে?"

কেউ পরামর্শ দিলেন "ঘন্টা বাজানো হোক"। নবী করিম ﷺ তা প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ھُوَ مِنْ اَمْرِ النَّصَارَی"এটি নাসারাদের পদ্ধতি।"

কেউ বললেন, "শিঙ্গা ফুঁকানো হোক"। তিনি এটিও প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ھُوَ مِنْ اَمْرِ الْیَھُوْد "এটি ইহুদীদের পদ্ধতি।"

কেউ বললেন, "আগুন জ্বালানো হোক"। তিনি বললেন, هُوَ مِنْ اَمْرِ الْمَجُوْسِيَّةٍ"এটি মজুসীদের পদ্ধতি।"

পরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.) এবং আরও কিছু সাহাবা আজানের স্বপ্ন দেখলেন এবং নবী করিম ﷺ-কে জানালেন। নবী করিম ﷺ এই স্বপ্নকে সত্য ও আল্লাহ প্রদত্ত বলে ঘোষণা করেন এবং আজানের পদ্ধতি চালু করেন।

আবু দাউদ (৪৯৮)


(৬) আশুরার রোজায় ইহুদী ও খ্রিস্টানদের বিপরীতে অবস্থান

যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ মদীনায় এসে জানতে পারলেন যে ইহুদীরা আশুরার রোজা পালন করে, তখন তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন:

“তোমরা এই রোজা কেন রাখ?”

তারা জবাব দিল:

“এটি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বরকতময় দিন। এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আলাইহিস সালাম) এবং তাঁর সম্প্রদায়কে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়কে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন।”

তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: نَحْنُ اَحَقُّ بِمُوْسٰی مِنْکُمْ

“আমরা মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর অধিক হকদার তোমাদের চেয়ে।”

এরপর তিনি আশুরার রোজা রাখার তাগিদ দেন।

তবে, যখন ইহুদী ও খ্রিস্টানদের ধূর্ততা এবং ইসলামের প্রতি তাদের শত্রুতা প্রকাশ পেতে শুরু করল, তখন সাহাবারা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে আরজ করে বললেন:اِنَّہُ یَوْمٌ یُعَظِّمُہُ الْیَھُوْدُ،

“ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই দিনটি এমন একটি দিন, যা ইহুদীরা বিশেষভাবে সম্মান করে।”

তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন:فَاِذَا کَانَ الَعَامُ الْمُقْبِلْ اِنْشَاء اللہُ صُمْنَا الْیَوْمَ التَّاسِع․

“ইনশাআল্লাহ, আগামী বছর আমরা (দশমের সঙ্গে) নবম দিনেও রোজা রাখব।”৬

এইভাবে তিনি আশুরার রোজায় ইহুদীদের সাথে মিল ও সামঞ্জস্যতা পরিবর্তন করলেন। তবে, পরবর্তী বছর মহররম মাস আসার আগেই, ১২ রবিউল আউয়াল ১১ হিজরিতে, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইন্তেকাল করলেন এবং মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন।

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। মুসলিম (১১৩৪)


(৭) ইহুদী-নাসারার বিরোধিতায় শনিবার ও রবিবারে রোজা রাখা

রাসূলুল্লাহ ﷺ ইহুদী ও নাসারার বিরোধিতা করে শনিবার (শনিবার) এবং রবিবারে (রবিবার) বেশি রোজা রাখতেন। হজরত উম্মে সালমা (রা.) বর্ণনা করেন:

یَصُوْمُ یَوْمَ السَّبْتِ وَ یَوْمَ الْاَحَدِ اَکْثَرَ مِمَّا یَصُوْمُ مِنَ اْلاَیَّامِ، وَیَقُوْلُ: اِنَّھُمَا عِیْدَا الْمُشْرِکِیْنَ، فَاَنَا اُحِبُّ اَنْ اُخَالِفَھُمْ

"রাসূলুল্লাহ ﷺ শনিবার ও রবিবারে অন্য দিনের তুলনায় বেশি রোজা রাখতেন এবং বলতেন: ‘এই দুই দিন মুশরিকদের উৎসবের দিন। তাই আমি তাদের বিরোধিতা করতে পছন্দ করি।’"

(আবু দাউদ)(৭) মুসনাদ আহমাদ (২৬৭৯৩)

অর্থাৎ শনিবার হলো ইহুদীদের উৎসবের দিন এবং রবিবার হলো নাসারাদের উৎসবের দিন। এই দিনগুলোতে তারা কখনোই রোজা রাখত না। আর এই দিনগুলোতে রোজা রাখা দ্বারা তাদের থেকে পার্থক্য ও বিরোধিতা প্রকাশ পায়, যা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


(৮) নাসারাদের বিরোধিতায় একটানা রোজা রাখা নিষিদ্ধ

হজরত লাইলা (রা.) বলেন, اَرَدتُّ اَنْ اَصُوْمَ یَوْمَیْنِ مُوَاصَلَةً

"আমি একটানা দুদিন بغیر سحری (সাহরি ছাড়া) রোজা রাখার ইচ্ছা করলাম। আমার স্বামী বশির আমাকে নিষেধ করলেন এবং বললেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এটি নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, یَفْعَلُ ذَالِکَ النَّصَارَی،(۸) ‘নাসারা এমনটি করে।’"

(সহিহ মুসলিম) মুসনাদ আহমাদ (১১৫২)

অর্থাৎ নাসারা সাহরি ছাড়া একটানা রোজা রাখত। আমাদের এই ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


(৯) ইহুদী-নাসারার থেকে ভিন্নতায় নারীদের সঙ্গে আচরণ

ইহুদী ও নাসারা তাদের নারীদের হায়েজ (মাসিক) অবস্থায় একেবারে আলাদা করত। তারা না খেত, না বসত, না কথা বলত, এমনকি তাদের পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রাখত। রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন:

اِصْنَعُوْا کُلَّ شَیْءٍ اِلَّا النِّکَاحْ

"সহবাস ছাড়া সব কিছু করো।"

(সহিহ বুখারি)

অর্থাৎ সহবাস নিষিদ্ধ থাকলেও খাওয়া-দাওয়া, একসঙ্গে বসা-উঠা, কথা বলা এমনকি একসঙ্গে শুয়ে থাকার অনুমতি আছে। এভাবে ইসলামে এই বিষয়ে মধ্যপন্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং ইহুদী-নাসারার অতিরঞ্জিত পন্থা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

ইহুদী-নাসারা যখন দেখল মুসলমানরা তাদের থেকে ভিন্ন আচরণ করছে, তারা বলল:

مَا یُرِیْدُ ھٰذَ الرَّجُلُ اَنْ یَّدَعَنَا مِنْ اَمْرِنَا شَےْئاً اِلاَّ خَالَفْنَا فِیْہِ

"এ লোক (মুহাম্মদ ﷺ) আমাদের প্রতিটি বিষয়ে বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।" মুসলিম (৩০২)

(সহিহ বুখারি)


(১০) গোরস্থানে ইহুদীদের বিরোধিতা

প্রথমদিকে রাসূলুল্লাহ ﷺ জানাজায় অংশ নিয়ে কবর দেওয়া পর্যন্ত বসতেন না। এক ইহুদী পণ্ডিত বলল: ھٰکَذَا نَصْنَعُ یَا مُحَمَّدْ "আমরাও এমনটি করি।"এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বসে পড়লেন এবং বললেন:خَالِفُوھُم "তাদের বিরোধিতা করো।"তিরমিজি (১০২০)

(সহিহ বুখারি)

অর্থাৎ, ইহুদীরা কখনো জানাজার সঙ্গে বসত না। তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ নির্দেশ দিলেন যে, যখন জানাজা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখা হবে, তখন বসা যেতে পারে।


উল্লিখিত হাদিসগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, ইসলাম ইহুদী ও নাসারার পথ থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র। রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের সব বিষয়ে তাদের থেকে পৃথক থাকতে এবং তাদের অনুকরণ না করতে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন:مَنْ َتشَبَّہَ بِقَوْمٍ فَھُوَ مِنْھُمْ (۱۱)

"যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের অনুকরণ করবে, সে তাদেরই একজন বলে গণ্য হবে।আবু দাউদ (৪০৩১)


এটি অত্যন্ত কঠোর সতর্কবাণী। কোনো মুসলমান যদি ইহুদী-নাসারার সঙ্গে আচরণ, আচার-অনুষ্ঠান বা দৈনন্দিন জীবনে তাদের অনুকরণ করে, তবে তার অবস্থান ইসলামের বাইরে বিবেচিত হবে।

অন্য একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

لَیْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّہَ بِغَیْرِنَا

"যে ব্যক্তি আমাদের থেকে পৃথক হয়ে অন্যদের অনুকরণ করবে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।"

(তিরমিজি)


উপসংহার

ইসলামের এই কঠোর নির্দেশনার বিপরীতে আজকের মুসলিম সমাজের একটি বড় অংশ ইহুদী-নাসারার আচার-আচরণকে গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করছে। অথচ এ কাজ ইসলামের মৌলিক চেতনার বিপরীত এবং এটি থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


আফসোস! আমরা অনুভূতি হারিয়েছি

দুঃখের বিষয়, আমরা আমাদের ক্ষতির অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছি। আল্লাহর জন্য আমাদের উচিত নিজের আত্মসমালোচনা করা এবং নিজেদের মূল্যায়ন করা।

আল্লাহ তাআলা আমাদের পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ও শরীয়ত দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ব্যক্তিত্বকে আদর্শ এবং অনুসরণযোগ্য রূপে দান করেছেন। আমাদের জন্য সুন্নাহর অমূল্য সম্পদ রেখে গেছেন।

তবুও, আজ আমাদের পরিবারগুলোতে কেন অমুসলিমদের আচার-আচরণের প্রসার ঘটছে? কেন আমাদের তরুণদের পোশাক এবং চুল তাদের মতো হচ্ছে? কেন আমাদের বিবাহ-অনুষ্ঠান তাদের মতো হচ্ছে? কেন আমাদের জীবনের ধারা ও আচার-ব্যবহার তাদের মতো হচ্ছে? আজ কেন মুসলিম সন্তানরা তাদের রং ও ধরনে নিজেকে রাঙানোর জন্য এত ব্যাকুল এবং আগ্রহী?

আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তার অশেষ দয়া ও করুণার মাধ্যমে আমাদেরকে অমুসলিমদের ফিতনা থেকে রক্ষা করেন।

আমিন!

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →