প্রবন্ধ
কুরআন ও হাদীসে ‘‘জি হা দ শব্দের প্রায়োগিক ক্ষেত্র কী?
কুরআনে কারীম ও হাদীসের মাঝে যত স্থানে পরিস্কার শব্দে কিতাল ফী সাবীলিল্লাহ শব্দ আসছে, সেসব আয়াত বা হাদীস কেবলমাত্র কিতাল তথা সশস্ত্র জিহাদের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হবে। অন্য কোন অর্থে তা ব্যবহার করা জায়েজ নয়।
কিন্তু এছাড়া যত স্থানে শুধুমাত্র জিহাদ শব্দ ব্যবহার হয়েছে। সেগুলোতে যদি কিতাল তথা সশস্ত্র যুদ্ধের পরিস্কার কোন ইংগিত না থাকে, তাহলে সেসব হাদীস ইসলামকে বিজয়ী করার অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করার সুযোগ হাদীসের মাধ্যমে জানা যায়।
জিহাদ। বিস্তৃত অর্থবোধক একটি শব্দ। যার সর্বোচ্চ স্তর হলো কিতাল ফী সাবীলিল্লাহ বা সশস্ত্র যুদ্ধ। সশস্ত্র যুদ্ধ জিহাদ শব্দের সবচেয়ে উত্তম ও মহামান্বিত অবস্থান।
তবে এটিই একমাত্র অর্থ নয়। আরো অনেক অর্থেই জিহাদ শব্দের ব্যবহার প্রযোজ্য।
শুধুমাত্র সশস্ত্র যুদ্ধের সাথে জিহাদ শব্দের অর্থকে সীমাবদ্ধ করা এ শব্দের পরিস্কার বিকৃতি। তবে সশস্ত্র যুদ্ধকে সর্বোচ্চ স্তর বা হাকীকী স্তর বলে বাকি সকল দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের কাজকও জিহাদ মেনে নেয়াই কুরআন ও হাদীসের যথার্থ মর্ম ও জিহাদ শব্দের সত্যিকার অর্থ।
কয়েকটি হাদীস দেখে নেই
১
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ “ أَفْضَلُ الْجِهَادِ كَلِمَةُ عَدْلٍ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ
আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যালেম শাসকের সামনে সত্য কথা বলা অধিক উত্তম জিহাদ। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৪০১১]
এ হাদীসে জালিম শাসকের সামনে হক কথা বলাকে সর্বোত্তম জিহাদ বলা হয়েছে।
২
عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِينَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا أَنَّهَا قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللهِ، نَرَى الْجِهَادَ أَفْضَلَ الْعَمَلِ، أَفَلَا نُجَاهِدُ؟ قَالَ: لَا، لَكِنَّ أَفْضَلَ الْجِهَادِ حَجٌّ مَبْرُورٌ
উম্মুল মু‘মিনীন ‘আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! জিহাদকে আমরা সর্বোত্তম ‘আমল মনে করি। কাজেই আমরা কি জিহাদ করবো না? তিনি বললেনঃ না, বরং তোমাদের জন্য সর্বোত্তম জিহাদ হল, হাজ্জে মাবরূর। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১৫২০]
এ হাদীসের নারীদের জন্য হজ্জ করাকে সর্বোত্তম জিহাদ বলা হয়েছে।
عَنْ أَبِي سُفْيَانَ عَنْ جَابِرٍ قَالَ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيُّ الْجِهَادِ أَفْضَلُ قَالَ مَنْ عُقِرَ جَوَادُهُ وَأُهْرِيقَ دَمُهُ
জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে) বলা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন্ জিহাদ উত্তম? তিনি বলেনঃ যে যুদ্ধে মুজাহিদের ঘোড়াকে হত্যা করা হয় এবং তার নিজেরও রক্ত প্রবাহিত হয় (নিহত হয়)। [সুনানে দারামী, হাদীস নং-২৪৩১, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৪৭২৭]
এ হাদীসে সশস্ত্র যুদ্ধকে সর্বোত্তম জিহাদ বলা হয়েছে।
৪
خَالِدُ بْنُ مَعْدَانَ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبَا أُمَامَةَ، وَجُبَيْرَ بْنَ نُفَيْرٍ، يَقُولَانِ: يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ أَفْضَلُ الْجِهَادِ الرِّبَاطُ ، فَقُلْتُ: وَمَا ذَلِكَ؟ فَقَالَ: إِذَا أَطَاطَ الْغَزْوُ وَكَثُرَتِ الْغَرَائِمُ وَاسْتُحِلَّتِ الْغَنَائِمُ فَأَفْضَلُ الْجِهَادُ يَوْمئِذٍ الرِّبَاطُ
খালেদ বিন মা’দান রহঃ বলেন, আমি আবূ উমামা রাঃ এবং হযরত জুবায়ের বিন নুফায়ের রাঃ বলতে শুনেছি যে, তারা উভয়ে বলেন, লোকদের মাঝে এমন যুগ আসবে, যখন সর্বোত্তম জিহাদ হবে পাহারাদারী করা। আমি বললাম, সেটা কখন? তিনি বলেন, যখন তোমাদের যুদ্ধের স্থানগুলো দূরের হয়ে যাবে, (যুদ্ধের ব্যাপারে নেতাদের) দৃঢ়তা বেড়ে যাবে, (অত্যাচারী নেতারা) গানীমাতগুলো হালাল মনে করবে, তখন তোমাদের সর্বোত্তম কর্ম (জিহাদ) হবে বিপদজনক পথে পাহারাদারী করা। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৪/২১৯, হাদীস নং-১৯৪৫৯]
এখানে স্বীয় সম্পদ হিফাজতে পাহারাদারী করাকে সর্বোত্তম জিহাদ বলা হয়েছে।
৫
وَسَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: المُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ
হযরত ফাযালা বিন উবায়েদ রাঃ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি বলতে শুনেছি যে, প্রকৃত মুজাহিদ হলো সেই, যে স্বীয় নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে। [জামে তিরমিজী, হাদীস নং-১৬২১]
এখানে নফসের কূরিপুর বিরুদ্ধে চেষ্টা মেহনত করাকে জিহাদ বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন।
এবার আমাদের ৫জন আকাবির উলামার মন্তব্য জিহাদ সম্পর্কে দেখে নেই:
১
শায়েখ জাকারিয়া রহঃ বলেন:
এ ব্যাপারে এ কথাটি পরিস্কার করে দেয়া জরুরী যে, জিহাদ শুধুমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামের নাম নয়, তবে এটি সর্বোচ্চ স্তর। বরং প্রতিটি প্রচেষ্টা যা আল্লাহর কালিমা উঁচু করতে এবং ইসলামের শক্তি ও প্রভাব বিস্তারের জন্য হয়, এসব কিছুই জিহাদের অন্তর্ভূক্ত। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম জালেম বাদশার সামনে হক কথা বলাকে উত্তম জিহাদ বলেছেন। সুতরাং যে প্রচেষ্টা উক্ত মাকসাদকে সামনে রেখে হবে তা সবই জিহাদের অন্তর্ভূক্ত। [আলই’তিদাল ফী মারাতিবিল জিহাদ, শায়েখ জাকারিয়া কান্ধলবী রহঃ, মৃত্যু ১৯৮২ ঈসাব্দ, পৃষ্ঠা-৫৯]
২
মুফতী মাহমুদ হাসান গঙ্গুহী রহঃ বলেন,
এখানে দুটি জিনিস। একতো হলো, আল্লাহর রাস্তায় ইসলামের দুশমনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা। সাধারণত এটাকে জিহাদ বলা হয়। এটার ফযীলত স্বতন্ত্র এবং তা অনেক উঁচু স্তরের।
দ্বিতীয় হলো আল্লাহর দ্বীনের জন্য চেষ্টা করা। যদিও তাতে সশস্ত্র সংগ্রামের সুযোগ না আসে। কুরআনে কারীম এবং হাদীস শরীফ মুতালাআ করার দ্বারা জানা যায় যে, এটাও জিহাদ।
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ ফাতহুল বারীতে লিখেছেন যে, দ্বীনের ইলম অর্জন করা, দ্বীন শিক্ষা দেয়া, সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজের নিষেধ করা এসবই জিহাদ। এমনিভাবে দ্বীনী কিতাব লেখা, মাসায়েল বলা ইসলাম বিরোধীদের অভিযোগের জবাব দেয়া, তাদের সাথে বাহাস করাও জিহাদ। [ফাতাওয়া মাহমূদিয়া, মুফতী মাহমুদ হাসান গঙ্গুহী রহঃ, মৃত্যু ১৯৯৬ ঈসাব্দ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-১২৪-১২৫]
৩
মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী রহঃ বলেন, শুধুমাত্র যুদ্ধের নামই জিহাদ নয়। যুদ্ধকে ‘কিতাল’ বলা হয়। আর এটি কখনো কখনো প্রয়োজন হয়। জিহাদের অর্থ আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার প্রচেষ্টা। এটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাকি থাকে। আর এর বিভিন্ন সূরত রয়েছে। এটা ভুল ধারণা যে, শুধুমাত্র কিতাল ফী সাবীলিল্লাহের নামই জিহাদ। আর যেসব প্রচেষ্টা আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার জন্য লোকেরা করে থাকে, সেটা অনর্থক। [তারীখে দাওয়াত ও আজীমাত, মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী রহঃ, মৃত্যু ১৯৯৯ ঈসাব্দ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৫৬]
৪
মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহম বলেন:
৫
মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রহমানী বলেন:
জিহাদ ইসলামের প্রচার ও হিফাজতের জন্য নিজের পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করা এবং এ পথে চলতে গিয়ে কষ্ট সহ্য করার নাম।
‘জিহাদ’ প্রশস্ত ও বিস্তৃত অর্থবোধক একটি পরিভাষা। যার উদ্দেশ্য দ্বীনের হিফাজত এবং দ্বীনের প্রসারে প্রচেষ্টা ও কষ্ট করা।
জিহাদের বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে। জবান এবং বয়ানও জিহাদের একটি মাধ্যম। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জালেম বাদশার সামনে ইনসাফের কথা বলাকে উত্তম জিহাদ বলে সাব্যস্ত করেছেন।
أَفْضَلُ الْجِهَادِ كَلِمَةُ عَدْلٍ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ
যালেম শাসকের সামনে ন্যায়ের কথা বলা অধিক উত্তম জিহাদ। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৪০১১]
জিহাদের একটি মাধ্যম এ জমানায় কলমও। বরঞ্চ এটি অত্যন্ত কার্যকরী একটি মাধ্যম। কোন মুসলমান স্বীয় কলম দ্বীনের হিফাযত ও প্রসারের জন্য ওয়াকফ করে দেয়, তাহলে এটাও জিহাদের অন্তর্ভূক্ত। আজকাল প্রচারের অন্যান্য মাধ্যমও কোন ফিকির ও চিন্তা চেতনা প্রসারে এবং তার প্রাধান্য লাভে অত্যন্ত উপকারী ও কার্যকরী। সেসবও অর্থের দিক থেকে জিহাদের শামিল।
জিহাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ মাধ্যম হলো সশস্ত্র জিহাদ। অর্থাৎ ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহার করা। [ইসলাম আওর জাদীদ ফিকরী মাসায়েল, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রহমানী-৮১-৮২]
সুতরাং বুঝা গেল যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার ও প্রচারের প্রতিটি কাজই জিহাদের অন্তর্ভূক্ত। দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত, লেখনীর মাধ্যমে বাতিলের জবাব দেয়া, বাহাস মুবাহাসার মাধ্যেমে বাতিলের মুকাবিলা করা, বয়ান ও ওয়াজের মাধ্যমে দ্বীনের প্রচার এবং দ্বীনে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের মানসে ইসলাম সমর্থিত প্রার্থীকে বিজয়ী করার প্রচেষ্টা সব কিছুই জিহাদ শব্দের উমুমিয়্যাতের অন্তর্ভূক্ত।
যদিও জিহাদের সর্বোচ্চ স্তর কিতাল ফী সাবীলিল্লাহ। কিন্তু উপরোক্ত কাজগুলোকেও জিহাদের অংশ মনে করতে হবে। শুধু কিতাল ফী সাবীলিল্লাহের মাঝে জিহাদ শব্দকে সীমাবদ্ধ করা কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং এ শব্দটির অর্থের পরিস্কার বিকৃতি ছাড়া কিছু নয়।
وَالْجهَاد بِكَسْر الْجِيمِ أَصْلُهُ لُغَةً الْمَشَقَّةُ يُقَالُ جَهِدْتُ جِهَادًا بَلَغْتُ الْمَشَقَّةَ وَشَرْعًا بَذْلُ الْجُهْدِ فِي قِتَالِ الْكُفَّارِ وَيُطْلَقُ أَيْضًا عَلَى مُجَاهَدَةِ النَّفْسِ وَالشَّيْطَانِ وَالْفُسَّاقِ فَأَمَّا مُجَاهَدَةُ النَّفْسِ فَعَلَى تَعَلُّمِ أُمُورِ الدِّينِ ثُمَّ عَلَى الْعَمَلِ بِهَا ثُمَّ عَلَى تَعْلِيمِهَا (فتح البارى، كتاب الجهاد والسير-6/77)
لَيْسَ الْجِهَادُ فِي الْآيَةِ قِتَالَ الْكُفَّارِ فَقَطْ بَلْ هُوَ نَصْرُ الدِّينِ، وَالرَّدُّ عَلَى الْمُبْطِلِينَ، وَقَمْعُ الظَّالِمِينَ، وَعِظَمُهُ الْأَمْرُ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْيُ عَنِ الْمُنْكَرِ (تفسير القرطبى، سورة العنكبوت-69، ج-13/365)
وكذا فى شرح النووى على مسلم، باب فصل الجهاد والخروج فى سبيل الله-2/134، زاد المعاد، فصل فى هديه فى الجهاد-3/9
والله اعلم بالصواب