প্রবন্ধ

নামাযের খুশূ হাসিল হবে যেভাবে

লেখক:শাঈখুল ইসলাম হযরত আব্দুল মালেক
১৭ অক্টোবর, ২০২৪
১৪০০৭ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

হামদ ও সালাতের পর...

গত কয়েক মজলিসে খুশূ সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। বলা হয়েছেখুশূ কেবল বিশেষ কোনো আমলের বৈশিষ্ট্য নয়বরং খুশূ মুমিনের যিন্দেগীর বৈশিষ্ট্য। মুমিনের পুরো যিন্দেগীই হতে হবে খুশূওয়ালা যিন্দেগী। দ্বীন-দুনিয়ার সকল কাজেই খুশূ থাকা চাই। খুশূ থাকতে হবে মুমিনের চলা-ফেরাকথা-বার্তাআচার-আচরণআওয়াজ-উচ্চারণ সবকিছুতে।

উদাহরণস্বরূ, হাঁটা-চলা ও কথাবার্তার খুশূ সম্পর্কে কুরআন করীমের ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَ لَا تَمْشِ فِی الْاَرْضِ مَرَحًا اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ، وَ اقْصِدْ فِیْ مَشْیِكَ وَ اغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ اِنَّ اَنْكَرَ الْاَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِیْرِ.

তুমি অহংকারবশত মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না এবং পৃথিবীতে দম্ভ করে চলো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিকঅহংকারীকে পছন্দ করেন না। তুমি হাঁটা-চলায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর এবং কন্ঠস্বর সংযত রাখ। নিশ্চয় সবচেয়ে অপ্রীতিকর আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ! - সূরা লুকমান (৩১) : ১৮-১৯

এভাবে শরীরের প্রতিটা অঙ্গের খুশূ রয়েছে। তাই আমরা যদি এককথায় খুশূর অর্থ করতে চাইতাহলে বলা যায় ‘আমার প্রতিটা অঙ্গ শরীয়তের বিধান এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক পরিচালিত হওয়া।

প্রত্যেক নেকআমলের খুশূ রয়েছে। যেমন যাকাত আদায় করা বা আল্লাহর রাস্তায় দান করার খুশূ কীশুনুন কুরআনের ভাষায়-

وَ الَّذِیْنَ یُؤْتُوْنَ مَاۤ اٰتَوْا وَّ قُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ اَنَّهُمْ اِلٰی رَبِّهِمْ رٰجِعُوْنَ.

এবং যারা যা কিছু দান করেদান করার সময় তাদের অন্তর এই ভয়ে ভীত থাকে যেতাদেরকে নিজ প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে। - সূরা মুমিনূন (২৩) : ৬০

অর্থাৎ নেককাজে খরচ করুক বা আল্লাহর কোনো বান্দাকে সাহায্য করুকÑ কোনো অবস্থাতেই তার মাথায় আসে না যেআমি করুণা করছিকিংবা আমি প্রশংসা বা কৃতজ্ঞতা পাবার যোগ্যবরং নিজের হালাল অর্থ থেকে কম বেশ যা-ই পেশ করেতার অন্তরটা থাকে ভীত-কম্পিত। কুরআনের ভাষায়-

وَّ قُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ.

(তাদের হৃদয় থাকে ভীত-কম্পিত।)

وَ یُطْعِمُوْنَ الطَّعَامَ عَلٰی حُبِّهٖ مِسْكِیْنًا وَّ یَتِیْمًا وَّ اَسِیْرًا، اِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِیْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّ لَا شُكُوْرًا، اِنَّا نَخَافُ مِنْ رَّبِّنَا یَوْمًا عَبُوْسًا قَمْطَرِیْرًا.

তারা আল্লাহর মহব্বতে অভাবীএতীম ও বন্দিকে আহার দান করে। (তাদের অভিব্যক্তি হল,) আমরা তো তোমাদের আহার করাই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আমরা তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না। আমরা তো আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এক কঠিনভয়ংকর  দিনের আশঙ্কা করি। - সূরা দাহর (৭৬) : ৮-১০

নেককার ব্যক্তিরা দান করে এই চিন্তায় থাকে যেএর মধ্যে কোনো ধরনের রিয়া যুক্ত হচ্ছে না তোবা পরবর্তীতে খোঁটা যুক্ত হবে না তোকিংবা আমার অজান্তে কোনো সমস্যা যুক্ত হয়ে আমলটি বাতিল হয়ে যাবে না তোআল্লাহ মেহেরবানি করে কবুল করবেন তোআখেরাতে আমি মুক্তি পাব তোএসব চিন্তা তাদেরকে ভীত-কম্পিত রাখে।

একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি যাকাত আদায় করার অর্থ মূলত গ্রহীতার হক’ গ্রহীতার কাছে পৌঁছে দেওয়া। তেমনি আরো যেসব ক্ষেত্রে শরীয়ত খরচ করাকে জরুরি করে দিয়েছেযেসব ক্ষেত্রে আমি আসলে কোনো দাতা-ই নইআমি তো কেবল দায়িত্ব আদায় করছি মাত্র। কাজেই সেখানে আমি কাউকে কিছু দিচ্ছি বা কারো প্রতি অনুগ্রহ করছি- এমন কিছু ভাবার সুযোগই নেই। এমনিতে যে কোনো দানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কারণ যা দেওয়া হচ্ছে,  সেটা তো আল্লাহর দেওয়া রিযিক থেকেই দিচ্ছি। ইরশাদ হয়েছে-

وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ.

এবং আমি তাদেরকে যা-কিছু দিয়েছিতা থেকে (আল্লাহর সন্তোষজনক কাজে) ব্যয় করে। - সূরা বাকারা (০২) : ৩

মোটকথাপ্রত্যেক নেক কাজে খুশূ রয়েছে। জাগতিক সকল কাজেও খুশূ রয়েছে । বিনয়ী মানুষ যারা এবং বিনয় যাদের জীবনের অংশ; আর বিনয় তো মুমিনের দায়েমী সিফাত। তারা সর্বদা আল্লাহকে হাযির-নাযির মনে করে তাঁর সামনে বিনয়ী থাকে। হাঁকখনো গাফলত এসে যায় সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু যতক্ষণ একথা মনে থাকবে যেআল্লাহ হাযির-নাযির এবং আমি আল্লাহর সামনে আছিসেই সময়টাতে বান্দা বিনয়ী হবেই।

যেমন নিজের ঘরকে সাধারণত মানুষ নিরাপদ মনে করে। কেউ নিজের ঘরে যাচ্ছে মানে নিরাপদ আবাসস্থলের দিকে যাচ্ছে। অথচ ঘর তখনই নিরাপদ হতে পারেযখন আল্লাহ তাআলা নিরাপত্তা দান করেন। কত মানুষের ঘরেই কত বিপদ আসে! কেউ আবার ঘর থেকে পালিয়ে বেড়ায়। কেন হয় এসবকারণ বান্দার জন্য আল্লাহ যখন যে স্থানে নিরাপত্তা দান করেন তখন সে স্থানটাই তার জন্য নিরাপদ।

সুতরাং ঘরে প্রবেশ করার সময়ও খুশূ অবলম্বন করা চাই। ঘরে প্রবেশের সময় আগে ডান পা দিয়ে প্রবেশ করাতবে জুতা খোলার সময় বাম পায়ের জুতা আগে খোলা তারপর ডান পায়ের জুতা খোলা। সালাম দেওয়া। বিসমিল্লাহ ও মাসনূন দুআ পড়ে প্রবেশ করা। অনুভূতির সঙ্গে দুআ পড়া। এই হল ঘরে প্রবেশের খুশূ।

এক হল দুআ পড়া। তারও অনেক সওয়াব। কিন্তু সঙ্গে যদি দুআর অনুভূতি জাগ্রত থাকে এবং দুআর অর্থ-মর্ম যেহেনে থাকে আর সে অনুভূতি ও অর্থ-মর্ম অন্তরে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে পারেতাহলে সেটি কিন্তু অনেক বড় বিষয়।

সুতরাং ঘরে প্রবেশের মাসনূন দুআর প্রতি আমরা যত্নবান হব। দুআটি এই-

اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَ الْمَوْلِجِ، وَخَيْرَ الْمَخْرَجِ، بِسْمِ اللهِ وَلَجْنَا، وَبِسْمِ اللهِ خَرَجْنَا، وَعَلَى اللهِ رَبِّنَا تَوَكَّلْنَا.

হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কল্যাণকর প্রবেশ ও কল্যাণকর বহির্গমন প্রার্থনা করছি। আল্লাহর নামে আমরা প্রবেশ করিআল্লাহর নামেই বের হই এবং আমাদের রব আল্লাহর ওপরেই আমরা ভরসা করি। - সুনানে আবু দাউদহাদীস ৫০৯৬

দুআর মর্মার্থ

এই দুআয় দুইটি বিষয়ে আরজি জানানো হয়েছে-

১. আমার প্রবেশটা যেন কল্যাণকর হয়। এমন যেন না হয় যে আমি বাহির থেকে অকল্যাণ নিয়ে ঘরে ফিরছি! ফলে ঘরটা আমার কারণে বে-বরকত হয়ে গেল!

২. আমার বহির্গমনটাও যেন কল্যাণকর হয়।

তাই আমি ঘরে প্রবেশের সময়ও বিসমিল্লাহ’ বলিবের হওয়ার সময়ও বিসমিল্লাহ’ বলি। আর সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপরই ভরসা করি। কারণ তিনিই আমাদের রব (প্রতিপালক) এবং তিনিই সমস্ত কল্যাণ ও বরকতের মালিক।

যাহোক এটা হল ঘরে প্রবেশের খুশূ। তেমনি ঘর থেকে বের হওয়ারও খুশূ রয়েছে। বের হওয়ার সময় আগে বাম পা দেব। কিন্তু জুতা পরার সময় ডান পায়ের জুতা আগে পরব। এবং বের হওয়ার দুআ পড়ব-

بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ، لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلّا بِاللهِ.

আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করে বের হচ্ছি! সকল কল্যাণ একমাত্র আল্লাহর রহমতেই অর্জিত হতে পারে। সকল বালা-মসিবত ও অকল্যাণ থেকে একমাত্র আল্লাহর কুদরতেই রক্ষা পেতে পারি!

কেউ যখন এই দুআ পড়ে ঘর থেকে বের হয়তখন সাথে সাথে ফেরেশতারা বলে ওঠেন-

هُدِيتَ، وَكُفِيتَ، وَوُقِيتَ!

তুমি সঠিক পথপ্রাপ্ত হয়েছ,  তোমার সকল প্রয়োজনের ভার গ্রহণ করা হয়েছে এবং তুমি নিরাপত্তা লাভ করেছ। - সুনানে আবু দাউদহাদীস ৫০৯৫

অর্থাৎ ব্যসতোমার জন্য এই দুআই যথেষ্ট হয়ে গিয়েছে। তুমি বাইরে গিয়ে কোনো সমস্যা বা মসিবতে পড়বে না। অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনার সম্মুখীন হবে না। হাঁআল্লাহ তাআলার হুকুমে কখনো হালত আসতেও পারেকিন্তু দুআটা পড়ে বের হলে হয়তো ওরকম অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির শিকার হবে না। যদি কখনো পরিস্থিতির শিকার হতেও হয়তখন করণীয় কীসেটি আল্লাহ তাআলা দিলের মধ্যে ঢেলে দেবেন ইনশাআল্লাহ।

ফেরেশতারা দুআয় বলেন - كُفِيتَতোমার সকল প্রয়োজনের ভার গ্রহণ করা হয়েছে।

এর মানে কেবল বাইরের বিষয় নয়বরং আমি যে ঘর থেকে বের হচ্ছিআমার ঘরও আল্লাহ তাআলার হাওয়ালায়। দুআর আবেদনের মধ্যে ঘর-বাহির উভয়টাই শামিল। অর্থাৎ উভয়টাই যেন আল্লাহর হেফাজতে থাকে।

ঘর থেকে বের হওয়ার আরেকটি দুআ

ঘর থেকে বের হয়ে কোথাও রওয়ানা দেওয়ার সময় আরেকটি দুআ পড়ার কথাও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

اَللّٰهُمَّ أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَضِلَّ أَوْ أُضَلَّ، أَوْ أَزِلَّ أَوْ أُزَلَّ، أَوْ أَظْلِمَ أَوْ أُظْلَمَ، أَوْ أَجْهَلَ أَوْ يُجْهَلَ عَلَيَّ.

হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি; যেন আমি পথভ্রষ্ট না হইআমাকেও যেন পথভ্রষ্ট করা না হয়। আমি যেন পদস্খলিত না হইঅন্য কেউ যেন আমার পদস্খলন না ঘটায়। আমি যেন কারো ওপর জুলুম না করিআমার ওপরও যেন কেউ জুলুম না করে। আমি যেন মূর্খের আচরণ না করিআমার সাথেও যেন মূর্খের আচরণ করা না হয়। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ৫০৯৪

এই দুআর মধ্যে চারটি বিষয়ে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা হচ্ছে-

এক. আমি নিজেও যেন পথভ্রষ্ট না হইঅন্য কেউ যেন আমাকে পথভ্রষ্ট করতে না পারে।

হাদীসের শব্দ ব্যাপক। তাই এখানে রাস্তা ভুলে যাওয়া বা দিক হারিয়ে ফেলাদ্বীন-ঈমান ও সিরাতে মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া সবই উদ্দেশ্য নেওয়া যেতে পারে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুআর একেকটি শব্দে বহুমাত্রিক অর্থ নিহিত থাকে। একই সঙ্গে অনেক বিষয়ের কল্যাণ যেমন প্রার্থনা করা যায়তেমনি অনেক অকল্যাণ ও অনিষ্টতা থেকেও আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা যায়।

দুই. আমি যেন পদস্খলিত না হইঅন্য কেউ যেন আমার পদস্খলন না ঘটায়।

পিচ্ছিল পথে পড়ে যাওয়াবাহন থেকে ছিটকে পড়া অথবা কোনো সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া সব ধরনের পদস্খলন থেকে আল্লাহ যেন আমাকে রক্ষা করেন। তেমনি কোনো গোনাহে লিপ্ত হয়ে যাওয়া বা অসংগত কিছু করে ফেলা বা বলে ফেলা থেকে আল্লাহ যেন আমাকে হেফাজত করেন।

তিন. নিজেও যেন কারো ওপর জুলুম না করিআমার প্রতিও যেন কেউ জুলুম না করে।

এককথায় আমি যেন জালেমও না হইমজলুমও না হই!

চার. মূর্খ সুলভ কোনো আচরণ যেন আমি না করিআমার সঙ্গেও করা না হয়।

আমার সকল কথা ও কাজ যেন সুন্দর ও মার্জিত হয়। অসুন্দর কোনো কথা বা কাজ যেন কারো সাথে আমার না হয়। তেমনি আমার সাথেও কেউ কোনো অসুন্দর ও মন্দ আচরণ না করে।

এবার চিন্তা করুন খুশূর সঙ্গে বের হওয়া আর উদাসীনতার সঙ্গে বের হওয়া এই দুইয়ের মাঝে কত ফারাক!

এজন্য বললামদ্বীন-দুনিয়ার সকল কাজে খুশূ হাসিলের বিষয় আছেযদি আমি সচেতন থাকি। তবে খুশূ-এর সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হল ইবাদত। ইবাদতের মধ্যেও নামাযতিলাওয়াতযিকির ও দুআ-মুনাজাত এগুলো হল খুশূর সবচে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এসব আমলে খুশূ হাসিল করতে পারলেএর বরকতে যিন্দেগীর অন্যান্য ক্ষেত্রেও খুশূ হাসিল হওয়া সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

যিকিরতিলাওয়াত ও দুআ-মুনাজাতে খুশূ হাসিলের উপায় সম্পর্কে গত মজলিসগুলোতে কিছু আলোচনা হয়েছিল। আজ নামাযের খুশূ সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

নামাযের খুশূ বিষয়ে কয়েকটি হাদীস

প্রথমে এই বিষয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কয়েকটি হাদীস আমরা আলোচনা করব। আল্লাহ তাআলা বোঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুন।

তাহিয়্যাতুল ওযুর বিষয়ে তিন সাহাবী থেকে তিনটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

তিনজন সাহাবী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাহিয়্যাতুল ওযুর হাদীস শুনেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আমলটির ফযীলত তিন সাহাবীকে তিন ভাষায় বর্ণনা করেছেন। ফযীলতটা সবাইকে হুবহু একই ভাষায় বলেছেনÑ তা কিন্তু নয়। এতে আমাদের ফায়দা বেশি হয়েছে। এই ভিন্ন ভিন্নভাবে বলাতে নামাযের খুশূ কীভাবে হয়সে সম্পর্কেও আমরা হাদীসগুলোতে কিছু নির্দেশনা পেয়ে যাচ্ছি।

প্রথম হাদীস

এই হাদীস বর্ণিত হয়েছে উকবা ইবনে আমের রা. থেকেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَتَوَضَّأُ فَيُحْسِنُ وُضُوءَه، ثُمَّ يَقُومُ فَيُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ، مُقْبِلٌ عَلَيْهِمَا بِقَلْبِه ٖ وَوَجْهِه ٖ، إِلّا وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ.

কোনো মুসলিম যখন উত্তমরূপে ওযু করে অতঃপর দুই রাকাত নামায এমনভাবে আদায় করে যেতার চেহারা ও অন্তুর তথা দেহ-মন পূর্ণ আল্লাহ-অভিমুখী থাকেতার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। - সহীহ মুসলিমহাদীস ২৩৪

হাদীসে বলা হয়েছে, ‘কোনো মুসলিম যদি ওযু করে এবং সুন্দরভাবে ওযু করে। সুন্দরভাবে ওযু করার অর্থ সুন্নত মোতাবেক ওযু করা। যেমন ওযুর শুরুতে পবিত্রতার নিয়ত করাবিসমিল্লাহ বলামিসওয়াক করা ইত্যাদি।

এই যে পবিত্রতার নিয়তের কথা বলা হলশরীয়তের দৃষ্টিতে পবিত্রতা কিন্তু অনেক ব্যাপক। পবিত্রতার বিভিন্ন ধরন আছে। একটা তো হল যাহেরী পবিত্রতা। এটা ছাড়া পবিত্রতার আরো বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। যেমন আকীদা-বিশ্বাসের পবিত্রতাআমলের পবিত্রতাচিন্তা-চেতনার পবিত্রতাআখলাক-চরিত্র ও সীরতের পবিত্রতা এবং সর্বোপরি গোনাহ থেকে পবিত্রতা। ওযুর মাধ্যমে আমি এই সব ধরনের পবিত্রতার নিয়ত করতে পারি। আমি যেন এই ওযুর মাধ্যমে যাবতীয় গোনাহ থেকে পবিত্র হয়ে যেতে পারি! ওযু সংশ্লিষ্ট যত দুআ হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছেতাতেও এ বিষয়টার প্রতি ইঙ্গিত আছে।  একটি দুআ এই-

اَللّٰهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَّوَّابِينَ، وَاجْعَلْنِي مِنَ الْمُتَطَهِّرِينَ.

(হে আল্লাহ! আমাকে বেশি বেশি তওবাকারী এবং অধিক পবিত্রতা রক্ষাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। - জামে তিরিমিযীহাদীস ৫৫)

এই বর্ণনা থেকেও ওযুতে তওবার বিষয়টা পাওয়া যায়। আর ওযুর মাধ্যমে যে সগীরা গোনাহ মাফ হয়সেটি তো অনেক সহীহ হাদীসে আছে। তো সগীরা গোনাহ মাফ হওয়ার পাশাপাশি আমি যদি খালেস দিলে তওবাও করে ফেলিতাহলে তো কবীরা গোনাহগুলোও মাফ হবে। কারো হক নষ্ট করা হলেএই ওযুর সময়ই যদি আমি আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করে ফেলি যে, ‘আল্লাহ! আমি তার হকগুলো আদায় করে দেব। আমি নিয়ত করলামআপনি আমাকে তাওফীক দান করুন!’ তাহলে আল্লাহ যেমন ক্ষমা করে দেবেনতেমনি হক আদায় করার রাস্তাও বের করে দেবেন ইনশাআল্লাহ!

ওযুর মাঝে এই দুআ পড়ার কথাও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي، وَوَسِّعْ لِيْ فِيْ دَارِيْ، وَبَارِكْ لِيْ فِيْ رِزْقِيْ.

হে আল্লাহ! আমার গোনাহ ক্ষমা করে দিন। আমার আবাসকে প্রশস্ত করুন এবং আমার রিযিকে বরকত দান করুন। - মুসনাদে আবু ইয়ালাহাদীস ৭২৭৩আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহনাসায়ীহাদীস ৮০আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহইবনুস সুন্নীহাদীস ২৮

এখানেও ইস্তিগফারের প্রসঙ্গ আছে। এজন্য ওযুকে ব্যাপকার্থে পবিত্রতা বানানো অনেক সহজ। সুতরাং খেয়াল করে নিয়তটাকে ব্যাপক করার চেষ্টা করতে হবে।

যাহোক হাদীসে প্রথমে সুন্দর করে ও সুন্নতসম্মতভাবে ওযু করার কথা বলা হয়েছে।

এরপর বলা হয়েছে-

ثُمَّ يَقُومُ فَيُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ.

তারপর দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামায আদায় করে।

مُقْبِلٌ عَلَيْهِمَا بِقَلْبِه ٖ وَوَجْهِه ٖ.

অর্থাৎ এমনভাবে নামায পড়ে যেওই নামাযের মধ্যে তার পুরো দিল-মন আটকানো। ডানে-বামে কোনো দিকে তাকাচ্ছে নামনটাও এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে নাবরং দিল পরিপূর্ণ নামাযের দিকে ফেরানো। দৃষ্টিও সিজদার জায়গায় অবনত।

এখান থেকে নামাযের খুশূ-এর একটা স্তর আমরা পেয়ে যাই। এ স্তরটি অন্যান্য স্তরের তুলনায় তুলনামূলক সহজ। অর্থাৎ কেবল নামাযের দিকেই দিলের খেয়াল থাকা। তাকবীরে তাহরীমা থেকে শুরু করে সানাআউযুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহসূরা ফাতেহা যা পড়ছিযেন খেয়াল করে পড়া হয়। সূরা ফাতেহা পড়ছি একথা যেমন খেয়ালে থাকবেতেমনি সূরা ফাতেহায় আমি কী বলছিকী পড়ছি সেটাও যেহেনে হাযির রাখবে। ইমামের পেছনে নামায পড়া অবস্থায় তো সূরা ফাতেহা ও পরবর্তী সূরা মেলানোর সময় চুপ থাকতে হয়। এই খামুশির সময়ও আমাকে নামাযের দিকেই মন রাখতে হবে। ভাবতে হবেআমি আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে আছি। এখন আল্লাহর দরবারে রুকুতে যাচ্ছি। আর রুকু-সিজদাতে তো এমনিতেই তাসবীহ পাঠ করার আমল আছে।

মোটকথাতাকবীরে তাহরীমা থেকে সালাম পর্যন্ত নামায নিয়ে ব্যস্ত থাকব।

হাদীসের শাব্দিক অর্থ হলতার  চেহারাটাও নামাযের দিকেতার দিলটাও নামাযের দিকে। মুখে যা পড়ছেসব বুঝেশুনে পড়ছে। যা উচ্চারণ করছেবুঝেশুনে উচ্চারণ করছে। এমন হয় না যেআত্তাহিয়্যাতু পড়ার সময় খবরই নেইমুখে আত্তাহিয়্যাতু পড়লনাকি অন্যকিছু পড়ল! অর্থ বুঝুক আর না বুঝুকযা পড়ছেশব্দে শব্দে খেয়াল করে পড়বে। আর যদি অর্থ-মর্ম খেয়াল করে পড়েতাহলে তো কথাই নেই! খুশূ হয়েই গেল।

তাহলে তাহিয়্যাতুল ওযুর হাদীসে আমরা সকল নামাযের খুশূর সবক পেয়ে গেলাম। আমি নামায এমনভাবে পড়বযেন চেহারা ও দৃষ্টির সঙ্গে আমার মনটাও আল্লাহ-অভিমুখী থাকে। দিলের মধ্যে যেন এই খেয়াল থাকে যেআমি এখন সূরা ফাতেহা পড়ছিএখন আমি রুকুতে আছিএখন সিজদাতেএখন আত্তাহিয়্যাতু পড়ছিএখন দরূদ শরীফ পড়ছি। একটা আমলও যেন আমার বে-খেয়ালিতে পার না হয়ে যায়। বেখেয়ালিতে যেন কোনো কিছু উচ্চারণ না হয়।

এই অনুশীলন যদি করতে পারিধীরে ধীরে অন্যগুলোও আসতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। খুশূর আরো গভীর দিক যেগুলোসেগুলোর তুলনায় এই অনুশীলন সহজ।

এজন্য হযরত হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রাহ. এখান থেকে খুশূর সবক শুরু করিয়েছেন। তিনি বলেছেনএমন পাকা হাফেযের মতো পড়বে না যেতার দিল যেখানেই থাকুকমুখ চলতে থাকেকোনো ভুল হয় না। বরং যে হাফেযের মনোযোগ না দিলেই লোকমার প্রয়োজন হয়তার মতো খেয়াল করে করে পড়বে।

হাদীসের শেষাংশ-

إِلّا وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ.

তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব বা অবধারিত।

দ্বিতীয় হাদীস

দ্বিতীয় হাদীসটি তৃতীয় খলীফা উসমান রা. থেকে বর্ণিত। এটাও তাহিয়্যাতুল ওযু সম্পর্কে। হুমরান ইবনে আবান নামক একজন তাবেয়ী বলেনÑ ‘আমি উসমান রা.-কে ওযু করতে দেখলাম...। এই বলে তিনি উসমান রা.-এর ওযুর বিবরণ দিলেন। তারপর তিনি উসমান রা.-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেনউসমান রা. বলেছেন-

رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَوَضَّأَ نَحْوَ وَضُوئِي هذَا.

আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরকম ওযু করতে দেখেছি।

ثُمَّ قَالَ: مَنْ تَوَضَّأَ وُضُوئِي هذَا، ثُمَّ يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ لاَ يُحَدِّثُ نَفْسَهٗ فِيهِمَا بِشَيْءٍ، إِلّا غُفِرَ لَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهٖ.

এরপর বলতে শুনেছিআমি যেভাবে ওযু করেছি সেভাবে যে ওযু করবেতারপর এমনভাবে দুই রাকাত নামায পড়বেÑ ওই সময় সে তার মনের সাথেও কোনো কথা বলবে না তার পেছনের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। - সহীহ বুখারীহাদীস ১৯৩৪মুসনাদে আহমাদহাদীস ৪২১

এখানে فَيُحْسِنُ وُضُوءَهٗ(উত্তমরূপে ওযু করবে) এ বাক্য বলা হয়নিবরং বলা হয়েছেআমি যেভাবে ওযু করেছিসেভাবে। বলার অপেক্ষা রাখে নানবীজীর ওযু সর্বোৎকৃষ্ট ওযু। এখন এই ওযুর যে যত কাছাকাছি আসতে পারেতার ওযু তত উৎকৃষ্ট ও সুন্দর হবে। প্রত্যেক অঙ্গ তিনবার করে সুন্দরভাবে ধোয়াÑ এটি সবাই পেরে যাব ইনশাআল্লাহ। সাথে অনুভূতি ও নিয়তের ক্ষেত্রে যে যতটুকু গভীরে অগ্রসর হতে পারে। 

যাইহোকএই হাদীসে খুশূর বিষয়ে বলা হয়েছে-

ثُمَّ يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ لاَ يُحَدِّثُ نَفْسَهٗ فِيهِمَا بِشَيْءٍ.

এমনভাবে দুই রাকাত নামায পড়বে যেসে তার মনের সাথেও কোনো কথা বলবে না।

নামাযে কি কেউ অন্য কারো সাথে কথা বলেবলে নাবরং যা হয় সব তো নিজের মনের সঙ্গেই হয়। এখানে বলা হয়েছেদুই রাকাত নামায এমনভাবে পড়বে যেমনের সাথেও কথা বলবে না। অর্থাৎ এদিক-সেদিকের সব চিন্তা বাদ দিয়ে একেবারে নামাযেই সমাহিত হওয়া এবং ডুবে যাওয়া।

আগের হাদীসে খুশূর যে স্তরের কথা বলা হয়েছেতার চেয়ে এটি আরো ওপরের। যদিও ওই হাদীসের মর্মের মধ্যেও এই স্তরটি রয়েছেকিন্তু সে হাদীসের পাঠ থেকে প্রথম স্তরটির কথাই আগে বুঝে আসে। আর তাতে আমাদের জন্য একটি সহজ রাস্তা খুলল। সুতরাং আগের হাদীসের বার্তা অনুযায়ী আমরা মেহনত শুরু করে পৌঁছুতে পৌঁছুতে এখানে এসে উপনীত হতে পারি! এভাবে যদি কেউ দুই রাকাত নামায পড়তে পারেতাহলে তার পেছনের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।

তৃতীয় হাদীস

তৃতীয় হাদীসটি সাহাবী আমর ইবনে আবাসা রা. বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিম (হাদীস ৮৩২)মুসনাদে আহমাদ (হাদীস ১৭০১৯)-সহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে এটি বর্ণিত হয়েছে। লম্বা হাদীস। সেখানে তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ওযুর সওয়াব ও ফযীলতের কথা বর্ণনা করেছেনতারপর তাহিয়্যাতুল ওযুর নামাযের সওয়াবও বর্ণনা করেছেন। তখন উপস্থিত একজন তাঁকে সতর্ক করার জন্য বলে উঠলেনআপনি কী বলছেন খেয়াল করে বলুন! আপনি কি এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছেনএত এত সওয়াব দেওয়া হবে কেবল একটা আমলের জন্য?! তখন তিনি বললেন-

يَا أَبَا أُمَامَةَ، لَقَدْ كَبِرَتْ سِنِّي، وَرَقَّ عَظْمِيْ، وَاقْتَرَبَ أَجَلِيْ، وَمَا بِيْ حَاجَةٌ أَنْ أَكْذِبَ عَلَى اللهِ وَلَا عَلى رَسُولِ اللهِ، لَوْ لَمْ أَسْمَعْهٗ مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلّا مَرَّةً، أَوْ مَرَّتَيْنِ، أَوْ ثَلَاثًا حَتّي عَدَّ سَبْعَ مَرَّاتٍ، مَا حَدَّثْتُ بِهٖ أَبَدًا، وَلَكِنِّي سَمِعْتُه أَكْثَرَ مِنْ ذٰلِكَ.

দেখআমি বুড়ো ও দুর্বল হয়ে গিয়েছি। মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। আল্লাহ ও রাসূলুল্লার বিষয়ে মিথ্যা বলার আমার কী প্রয়োজনআমি যদি এটি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একবারদুইবারতিনবারচারবারপাঁচবারছয়বারসাতবার না শুনতামতাহলে বলতাম না। কিন্তু এটি আমি তাঁর থেকে এর চেয়েও বেশিবার শুনেছি

সেই হাদীসে ওযুর বিবরণ এবং ওযুর সওয়াব বর্ণনা করার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

فَإِنْ هُوَ قَامَ فَصَلّى، فَحَمِدَ اللهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ وَمَجَّدَهٗ بِالَّذِي هُوَ لَهٗ أَهْلٌ، وَفَرَّغَ قَلْبَهٗ لِلهِ.

ওযু শেষ করে যদি সে নামাযে দাঁড়ায়  তারপর আল্লাহর শান মোতাবেক তাঁর হামদ ও প্রশংসা করেতাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদা বর্ণনা করতে থাকে   এবং তার দিলটাকে আল্লাহর জন্য ফারেগ করে দেয়।

 খেয়াল করুননবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

وَفَرَّغَ قَلْبَهٗ لِلهِ.

এটা খুশূ-এর একেবারে ওপরের একটা স্তর। অর্থাৎ তার দিলে আল্লাহর যিকির ও স্মরণ ছাড়া আর কিছুই নেই।

তাহলে কী সওয়াব হবেশুনুন-

إِلّا انْصَرَفَ مِنْ خَطِيئَتِهٖ كَهَيْئَتِهٖ يَوْمَ وَلَدَتْهُ أُمُّه ٗ.

তার মা যেদিন তাকে জন্ম দিয়েছেসেদিন সে যেমন একেবারে নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ ছিলওইভাবে নামাযের পরেও সে ঠিক এরকমই পবিত্র হয়ে যাবে।

এখন আপনি যদি তাহিয়্যাতুল ওযুর পুরো নামাযে এই হালত ধরে রাখার উদ্দেশ্যেনামাযের ওয়াজিবসুন্নত ও মুস্তাহাবসমূহ ঠিক ঠিকভাবে আদায় করার পাশাপাশি নামায সংক্ষিপ্ত করেনতাহলে এতে আপত্তির কিছু নেই।

যাহোক এখন আমাদের এ হাদীসগুলো পড়ার মূল উদ্দেশ্য হল,  এ হাদীসগুলো থেকে খুশূ-খুযূর সবক হাসিল করা। তবে প্রসঙ্গক্রমে আমরা ওযুর ফযীলততাহিয়্যাতুল ওযু বা ওযু-পরবর্তী নামাযের ফযীলত এবং খুশূ-খুযূর ফযীলতও জানতে পারলাম। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন।

তিন হাদীসের তিনটা কথাই কাছাকাছি। দিলটা নামাযের দিকে থাকবে। নামাযে অন্য চিন্তা-ভাবনা করবে না। মূলত নামাযে আওয়াজবিহীন কথা চলতেই থাকে। নামায কথার জায়গাকিন্তু তা আল্লাহর সঙ্গে। আমাদের হালত হল আল্লাহর সঙ্গে কথা চলতে থাকে বেখবর ও গাফলতের হালতে আর সঙ্গে অন্য কথাও চলে...!

নামায আল্লাহর সঙ্গে কথা বলার জন্যতাই নামাযে দিল-দেমাগ ও মন-মস্তিষ্ককে আল্লাহর জন্য ফারেগ করে দিতে হবে! এর জন্য অনুশীলন করতে হবে। আর অনুশীলন ও চর্চা করতে গেলে কিছু সহযোগী মাধ্যমেরও প্রয়োজন হয়।

নামাযে খুশূ হাসিলের সহায়ক তিনটি বিষয়

নামাযে খুশূ হাসিলের সহায়ক তিনটি বিষয়ে আলোচনা করা যাক।

১.

প্রথম সহায়ক বিষয় হলযা তাকী ছাহেব হুজুর বলে থাকেন। তিনি তাঁর ভাষায় বলেনআমি সংক্ষেপে বলছি।

আসলে আমরা চাই কী আমাদের ভাব দেখে মনে হয়আমরা চাই নামাযের আগে-পরের সবকিছু থাকবে খুশূমুক্ত আর শুধু নামায হয়ে যাবে খুশূওয়ালা! এটা আসলে একটু কঠিনই বটে। নামাযকে খুশূযুক্ত করতে হলে নামাযের আগে-পরের সবকিছুকেই খুশূমুখী করার চেষ্টা করতে হবে। বরং ওযু থেকে যদি আমার খুশূ শুরু হয়ঘর থেকে মসজিদে আসা যদি খুশূর সাথে হয়তাহলে নামাযের খুশূ সহজ হবে।

মসজিদে এসে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়লামতারপর সুন্নত পড়লামতারপর ফরয শুরু করলাম  এভাবে ধাপে ধাপে অগ্রসর হলে মূল ফরয নামাযের মধ্যে খুশূটা অনেক সহজ হয়ে যাবেইনশাআল্লাহ। কাজেই নামাযের খুশূর জন্য নামাযের আগে-পরের যিন্দেগীকে খুশূমুখী করার চেষ্টা করা।

অনেকের অবস্থা হল নামাযের সালাম ফেরাতে না ফেরাতে বের হওয়ার জন্য ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়ে। হাঁকারো বিশেষ প্রয়োজন হলে তো বের হবেইতবে বেশি ঠ্যাকা না হলে কিছুক্ষণ বসে থাকার মধ্যেই ফায়েদা। এক ফায়েদা তো মসজিদে বসে থাকার ফায়েদা। দ্বিতীয় ফায়েদা হলফেরেশতারা এই ব্যক্তির জন্য দুআ করতে থাকে-

اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لَه، اَللّٰهُمَّ ارْحَمْه.

আল্লাহতাকে ক্ষমা করুনতার প্রতি দয়া করুন!

ফেরেশতার দুআ পাওয়া কি কোনো মামুলি কথা!

তৃতীয় আরেক ফায়দা হলমানুষ কোনো প্রয়োজনে কারো কাছে গেলে বা কোনো অফিস-আদালতে গেলে প্রয়োজন শেষ হওয়ার পর ফিরে আসে। তো মসজিদে এসেছি কিছু আশা নিয়ে। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের আশা। কুরআনে বলা হয়েছেÑ

وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ.

সিজদা কর আর আল্লাহর নিকটে পৌঁছে যাও!

বোঝা গেল সিজদা ও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন হয়। আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের আশা নিয়ে আমি সিজদা করব। আমার জাগতিকপারিবারিক বা ব্যক্তিগত যত সমস্যাআমার বা দেশের কিংবা পুরো উম্মত ও মুসলিম বিশ্বের যত সমস্যাসব সমস্যার সমাধান আল্লাহ তাআলা নামাযের মাধ্যমে করে দিতে পারেন। কারণ বলা হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِیْنُوْا بِالصَّبْرِ وَ الصَّلٰوةِ.

তোমরা সবর ও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা কর। - সূরা বাকারা (২) : ১৫৩

নামায বলতে কেবল নফল নামায নয়বরং ফরয নামাযের মাধ্যমেও আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা যায়। আমার সকল সমস্যার সমাধান আল্লাহ তাআলা করে দেবেনÑ এ আশা নিয়ে মসজিদে এসেছিকিন্তু তাড়াহুড়ো করে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাওয়া মানেকেমন যেন আমার সকল মাকসাদ হাসিল হয়ে গেছে। আমার যা দরকার সব পেয়ে গিয়েছি। অথচ ভাবটা থাকা দরকার ছিল এমনযে উদ্দেশ্যে আমার আসাসব কি আমার হাসিল হয়েছেহাসিল করতে পেরেছিআচ্ছাআরেকটু বসে থাকি! যাদের হয়তো হাসিল হয়েছেতারা চলে যাচ্ছেআমারও কি হাসিল হয়ে গিয়েছেএভাবে একটা অনুভূতি নিয়ে কিছুক্ষণ মসজিদে দেরি করতে পারি।

এটা মাসআলা বলছি না। মাসআলা তো আগেই বললাম যেকারো প্রয়োজন থাকলে বের হতে পারে আর বসে থাকলে ফেরেশতার দুআ পাবে।

মসজিদ থেকে বের হওয়ার তরীকা

আচ্ছামসজিদ থেকে পাঁচ মিনিট আগে বের হই আর পরেবের হওয়ার তরীকা কী হবেমসজিদ থেকে বের হওয়ার সুন্নত আপনি যদি পাঁচটা বলেনআমি ছয় নম্বরটা বলব। সেটি হলমসজিদ থেকে এমন হালতে বের হবযেন দিলটা মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকে। হাদীসের ভাষায়-

قَلْبُه مُعَلَّقٌ بِالْمَسْجِدِ.

(দিলটা মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকে)

মসজিদ থেকে বের তো হতেই হবে। দ্বীন-দুনিয়ার কত যিম্মাদারি আল্লাহ তাআলা মানুষকে দিয়েছেন! কেউ সারাদিন মসজিদে বসে থাকবেএটা হয় না! আল্লাহ এটা চানও না! সূরা জুমুআতে আল্লাহ তাআলা প্রথমে বলেছেনযখন আযান হয়সমস্ত বেচাকেনা কাজ-কারবার বন্ধ করে মসজিদে চলে আসো! তারপর বলেছেননামায শেষ হয়ে গেলে-

فَانْتَشِرُوْا فِی الْاَرْضِ وَ ابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ.

আল্লাহর জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর ফযল’ তালাশ কর। কিন্তু তখনো আল্লাহকে ভুলো না-

وَ اذْكُرُوا اللهَ كَثِیْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ.

এবং আল্লাহকে স্মরণ কর বেশি বেশিযাতে তোমরা সফলকাম হও।

যাইহোকআল্লাহ আমাদের বলছেননামায শেষ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে কাজে যাওকিন্তু সেই যাওয়াটা কী হালতে হবেহাদীসের ভাষ্য হল-

قَلْبُه ٗ مُعَلَّقٌ بِالْمَسْجِدِ.

তার দিলটা মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকবেঅস্থির থাকবেÑ আবার কখন ফিরে আসব!

তো নামাযের পরের হালত হবেআমি মসজিদে যে আশা ও অনুভূতি নিয়ে এসেছিসেটি পূর্ণ হয়েছে কি না মনে এ ভয় থাকা এবং বের হওয়ার সময় দিলটা মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকা। সাথে বের হওয়ার দুআ পড়াÑ-

اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ.

অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আপনার ফযল ও রিযিক চাই।

রিযিক অনেক ব্যাপক বিষয়। পানাহার যেমন রিযিকসুস্থতাও রিযিক। দ্বীন-দুনিয়ার সকল খায়ের ও কল্যাণও রিযিক। একজন ছাত্রের মেধা দরকার। একজন তালিবুল ইলমের ইলম ও আমল দরকার। এ সবকিছু রিযক’-এর অন্তর্ভুক্ত। সবকিছু আল্লাহর নিকট চেয়েই আমি তাঁর ঘর থেকে বের হচ্ছি। সাথে আমার দিলটাও মসজিদের সঙ্গে আটকানো। যোহর পড়ে বের হয়েছি তো আসরের জন্য মনটা ব্যাকুল। আসর পড়ে বের হয়েছি তো মাগরিবের জন্য মন ব্যাকুল। বা অন্য কোনো উপলক্ষে বা উপলক্ষ ছাড়াও মসজিদে চলে আসা।

এভাবে নামাযের আগে-পরের অবস্থাকে যদি আমি খুশূমুখী করতে পারিতবে নামাযের খুশূ সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

২.

দ্বিতীয় উপায় হল ইহসান-এর অনুশীলন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهٗ  يَرَاكَ.

(তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবেযেন তুমি তাঁকে দেখছ। যদি তুমি তাঁকে নাও দেখতবে তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন। - সহীহ মুসলিমহাদীস ৮)

নামায শুরু করার আগেই চিন্তা করি যেআমি তো আল্লাহর দরবারে এসেছি। আল্লাহ আমাকে দেখছেন। সুতরাং আমিও ইবাদতটা এমনভাবে করার চেষ্টা করিযেন আমি আল্লাহকে দেখছি!

যদিও মূলত আমি দেখছি না বা দেখতে পারছি নাকারণ দুনিয়াতে আল্লাহকে কীভাবে দেখা যাবেআর সে চোখও আমার নেই। কিন্তু আল্লাহর আজমতমহত্ব ও বড়ত্ব এবং তাঁর গুণাবলি যেন আমার দিলে উপস্থিত থাকেতাঁর রহমত ও কুদরতের কথা যেন স্মরণে থাকেসর্বোপরি আল্লাহ হাযির-নাযির’ এই চিন্তা যেন আমার  মনে সদা জাগ্রত থাকে।

আল্লাহ আমাকে দেখছেনকাজেই আমার ঠিকমতো আমলটা করা উচিত এই অনুভূতি হল ইহসান-এর একটা স্তর।

ইহসানের যে শিক্ষা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন সেটি যে কোনো আমলের জন্যই প্রযোজ্য। বিশেষত নামাযের জন্য। নামায শুরু করার সময়বরং নিয়ত করার আগে যখন ওযু করে মসজিদের দিকে আসছিতখন থেকেই এটা চিন্তা করি যে-

أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهٗ   يَرَاكَ.

(তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবেযেন তুমি তাঁকে দেখছ। যদি তুমি তাঁকে নাও দেখতবে তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন।)

এর দ্বারা নামাযে দিল হাযির রাখার যে কথা বলা হয়েছেতার প্রয়োগটা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।

৩.

তৃতীয় আরেকটি সূত্র নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য হাদীসে বলেছেনযা আমরা গত মজলিসের আগের মজলিসে আলোচনা করেছি-

صَلِّ صَلَاةَ مُوَدِّعٍ.

অর্থাৎ এমনভাবে নামায আদায় করযেন এটাই জীবনের শেষ নামায।

নিজের মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত রাখার চেষ্টা করা চাইআজই বুঝি আমার জীবনের শেষ নামায! জুমা পড়ে গেলামআসর পড়ার জন্য হয়তো আর আসার সুযোগ হবে নাবরং হয়তো এখানে আমার জানাযার জন্য লাশ আসতে পারে। আমার হয়তো নামাযের জন্য আর আসা হবে না! নামাযে দাঁড়ালেই নিজের ওপরে এই ভাবনাকে হাযির করা যেএটাই আমার জীবনের শেষ নামায! কাজেই যত সুন্দর করে পড়তে পারি।

এই তিন সূত্র বা কোনো এক সূত্র বা দুই সূত্র যদি আমরা অবলম্বন করিতাহলে খুশূর ওই স্তরগুলো বিশেষত প্রথম হাদীসে যে স্তরের কথা বলা হয়েছেসেটি হাসিল করা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।

আলোচ্য তিন হাদীসের মধ্যেই চূড়ান্ত স্তর মূলত একই। কিন্তু স্তরের শুরু-শেষ আছে! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু উম্মতের প্রতি অনেক দরদী ছিলেনকুরআনের ভাষায়-

بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ.

(মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়পরম দয়ালু। - সূরা তাওবা (৯) : ১২৮)

তাই তাঁর শিক্ষার মধ্যে আমাদের জন্য রয়েছে অনেক সহজতা। এমনভাবে দ্বীনের হেদায়েতগুলো পেশ করেছেনযেন আল্লাহর বান্দাদের জন্য বিষয়গুলো আমলে নিয়ে আসা সহজ হয়ে যায়।

আর উপরোক্ত সূত্রগুলো থেকে কোনো সূত্র যদি আমরা অবলম্বন করিতাহলে আরো সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুনকবুল করুন। আমীন।

وآخِرُ دَعْوانَا أنِ الْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ الْعالَمِيْن.

 

[বয়ান : মাসিক দ্বীনী মজলিস

মারকাযুদ দাওয়াহ জামে মসজিদ

২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হি.

৬-৯-২০২৪ ঈ.

পত্রস্থকরণ : মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম]

টীকা

১. (তাহিয়্যাতুল মসজিদের অভ্যাস করুন)

এখানে প্রসঙ্গত একটি বিষয় আলোচনা করা মুনাসিব মনে হচ্ছে-

কিছু কিছু আমলের অভ্যাস আমাদের দেশে একদম কম। সেগুলোর মধ্যে তাহিয়্যাতুল ওযুতাহিয়্যাতুল মসজিদ অন্যতম। উদাহরণস্বরূপ আসরের সময় মসজিদে এসে দেখা গেলজামাতের এখনো তিন মিনিট বাকি। তিন মিনিটে যেহেতু চার রাকাত পড়া যাবে নাব্যসসোজা গিয়ে বসে থাকবে!

অথচ তিন মিনিটে চার রাকাত না পড়া গেলেও দুই রাকাত তো পড়া যাবে। কাজেই এ সময়টাতে আপনি তাহিয়্যাতুল ওযু বা তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করুন! এশার আগে মসজিদে এসে চার রাকাত পড়ার সময় না থাকলে অন্তত দুই রাকাতই পড়ুন! কারণ এশার আগে চার রাকাত নফল যেমন পড়া যায়দুই রাকাত নফলও পড়া যায়।

যাইহোকআপনি চার রাকাত সুন্নত বা নফল পড়তে পারলেন নাকিন্তু তাহিয়্যাতুল মসজিদ বা তাহিয়্যাতুল ওযু তো পড়তে পারেন। এ কেমন কথা যেচার রাকাত পড়ার সময় নেইতাই দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ বা তাহিয়্যাতুল ওযুও পড়া হবে না!

এমনকি যোহরের আগে যে চার রাকাত সুন্নতে মুআক্কাদা রয়েছেএকটু দেরি হয়ে যাওয়াতে মসজিদে এসে চার রাকাত সুন্নত পড়তে পারছি নাতাই বলে কি বসে থাকবঅনেকে ফরযের পরে দুই রাকাত সুন্নতের পরে এই চার রাকাত কাযা করার নিয়ত রাখেন। কিন্তু কথা হলফরযের আগে চার রাকাত পড়ার সময় নেইকিন্তু দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ার সময়ও কি নেইতিন মিনিটে যদিও যোহরের চার রাকাত সুন্নত পড়তে পারছি নাদুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ে ফেলার সুযোগ কেন হাতছাড়া করব?

এই মজলিসে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে অনেকে সাড়ে নয়টার আগেই মসজিদে চলে আসি। তখন কি দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করে ফেলতে পারি নাহাঁযখন মজলিস চলেতখন হয়তো একেবারে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে নামায পড়া সুন্দর হবে নাকিন্তু তখনো চাইলে আমি আড়ালে গিয়ে পড়তে পারি! যেসব মসজিদের বারান্দা মসজিদের অন্তর্ভুক্ত থাকেসেখানে তো মজলিস চলাকালীন বারান্দায়ও পড়া যায়। আমাদের খুব কম মসজিদ এমন থাকেযেখানে বারান্দাকে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয় না। আমাদের এই মসজিদেও তিন দিকের বারান্দা-ই মসজিদের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই আপনি এখানে আসার পর যদি মাকরূহ সময় না হয়তাহলে দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করে নিতে পারেন! করাচি গুলশানে ইকবাল-এর হযরত মাওলানা হাকীম আখতার ছাহেবের মসজিদে কখনো কখনো জুমার দিন যাওয়া হত। কখনো হযরত হারদূঈ রাহ. করাচি গেলে সেখানেও যেতেন। শায়েখ-মুরীদ দুজনকেই দেখতামমসজিদে প্রবেশ করে আগে দুই রাকাত নফল আদায় করে পরে মজলিসে অংশগ্রহণ করতেন।

যাহোকতাহিয়্যাতুল মসজিদতাহিয়্যাতুল ওযু এগুলো আমলে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। বিশেষত তাহিয়্যাতুল মসজিদ। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহিয়্যাতুল মসজিদের বিষয়ে যে উৎসাহ প্রদান করেছেন সেটা নির্দেশের ভাষায় করেছেন। হাদীসের শব্দ হল-

إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ الْمَسْجِدَ فَلَا يَجْلِسْ حَتّى يُصَلِّيَ رَكْعَتَيْنِ.

তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবেসে দুই রাকাত নামায পড়া ছাড়া যেন না বসে। -সহীহ বুখারীহাদীস ১১৬৭মুসনাদে আহমাদহাদীস ২২৬৫২

অর্থাৎ বসার পূর্বেই যেন দুই রাকাত নামায পড়ে নেয়।

অনেক সময় আমাদের কেউ কেউ এমন করে- মসজিদে প্রবেশ করে প্রথমে কিছুক্ষণ বসেতারপর দুই-চার রাকাত নামায আদায় করে। অথচ মসজিদে প্রবেশ করার পর প্রথম কাজই হল মাকরূহ সময় যদি না হয়ে থাকেতাহলে প্রথমে কমপক্ষে দুই রাকাত নামায পড়ে নেওয়া। তবে লক্ষ রাখতে হবেআমার নামাযের কারণে যেন কারো হাঁটা-চলা বা অন্য কোনো আমলের ক্ষতি না হয়।

২. এখানে দুই রাকাতের কথা নেই। তার মানেআপনি যদি ওযুর পরে ফরয নামাযে বা সুন্নতে মুআক্কাদা নামাযে দাঁড়িয়ে যানতাহলেও এই ফযীলত পেয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।

৩. এর মানে হলনামাযে সানা’ দীর্ঘ হতে পারে। এমনিতে ফরয নামায বা অন্য যে কোনো নামাযে আমরা সাধারণত যে সানা’ পাঠ করিএর বাইরেও আরো দীর্ঘ দীর্ঘ সানা হাদীসের কিতাবে আছেযা তাহাজ্জুদনফল নামায বা ব্যক্তিগত নামাযে পাঠ করা যায়। সেগুলোতে আল্লাহর প্রশংসা ও বড়ত্ব বিস্তারিত আছে। যদিও সূরা ফাতেহার মধ্যে আল্লাহ তাআলার সমস্ত হামদ-সানা আছেইকিন্তু তার আগেই সানা’ পাঠ করার যে বিধানসেখানে যদি একটু দীর্ঘ পাঠের সানাগুলো পড়া হয়তাহলে হাদীসের উদ্দেশ্য আশা করি আরো পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় হবে।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

ফজরের জামাত চলা অবস্থায় সুন্নত পড়ার বিধান!

...

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২৯৫৫ বার দেখা হয়েছে

ছানা কোনটি পড়া উত্তম?

...

আল্লামা আব্দুল মতীন
৯ নভেম্বর, ২০২৪
১৬১৩ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →